প্রথম তিন খলিফার সময় ইমাম আলী (আঃ) এর নিরবতাবলম্বনের অন্তর্নিহিত কারণ

আলোচনার সূচনাতেই বলে নেয়া সমীচীন মনে করছি যে, এ সংক্রান্ত ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য বহু গবেষণার দরকার। আর বিষয়টি খুবই জটিল ও দীর্ঘ পরিসরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তাই সামান্য কলেবরে উল্লেখিত
শিরোনামের সামান্য কিছু ব্যাখ্যার প্রয়াস পাব। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) আহ্‌লে বাইয়াতকে মুহাব্বত করে না এমন মুসলমান খুবই কম। তবে যুগ যুগ ধরে আহলে বাইয়াতকে মাজলুম বানিয়ে কোনঠাসা করে রাখার অপতৎপরতা চালিয়েছে
মুসলমান নামধারী বকধার্মিক কিছু মোনাফেকের দল। তাই আজও কিছু মানব জগৎসংসারে বসবাস করে যারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা করে থাকেন। সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা, সত্য ইতিহাস না জেনে নির্বোধের মত কথা
বলা এ যেন তাদের নিত্তনৈমিত্তিক পেশা। কতক লোক আজও ইমাম আলী (আঃ) এর মারেফাত লাভ না করার কারণে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনামুলক কথাবার্তা বলেন যা বিবেকবহির্ভূত এবং অন্তঃসারশূন্য কাজ। অনেকেই
নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে যদি খেলাফত আলী (আঃ) এর হক ছিল তবে কেন তিনি তার হক আদায় করতে আন্দোলন করেননি, কেন তিনি নিরবতাকে বেঁছে নিলেন, কেন প্রতিবাদ করেননি। যাই হোক এ জাতীয় প্রশ্ন করে
এক প্রকার বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে থাকেন। তাই আসুন ইনসাফের সুরে কথা বলি এবং সত্যকে জানার, বুঝায় ব্রতী হয় তাহলে আর বিষয়টি বুঝতে কষ্ট হবে না। এবার মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পয়গাম্বর (সাঃ) এর বেদনাময় ওফাতে গোটা মুসলিম সমাজ এবং তাঁর পবিত্র বংশধরদের উপর নেমে আসে যন্ত্রণার মহাপ্লাবন ও মহাসংকট। রাষ্ট্রে সর্বদা একটা টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি
বিরাজ করছিল বিশেষ করে খেলাফতের শাসন কর্তৃত্বের রদবদলের কারণে মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং সার্বক্ষণিক একটা ভীতি কাজ করছিল যে, হয়তো আরবের নব দীক্ষিত মুসলমানরা
জাহিলিয়াতের পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে যাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন একটি নব প্রষ্ফুটিত ফুলের পাঁপড়ির ন্যায় সবেমাত্র উঁকি মেরে আত্মপ্রকাশ করেছিল যার ফলে জনগণ ইসলামের সাথে তখনও সখ্যতা গড়তে পারেনি বা
ইসলামী আন্দোলনকে তারা গুরুত্বহীন ভেবে পাশ কেটে চলেছে। ইমাম আলী (আঃ) এবং মহানবী (সাঃ) এর কিছু বিশ্বস্ত সাহাবা কেরাম সবেমাত্র রাসুলুল্লাহর (সাঃ) দাফন কাফন সুসম্পন্ন করতে না করতেই সাহাবাকেরামের
মাঝে দুটি দল খেলাফতের দাবিদার সেজে হৈ হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেয়। দল দুটি হচ্ছে,
১) আনসারগণ যারা খাজরাজ জনগোষ্ঠীর লোক ছিল। তারা আগে থেকেই সাকিফায়ে বানী সাআদা নামক স্থানে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় মুসলিম রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্ব খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদ বিন উবাদার হাতে ন্যস্ত
করতে হবে এবং সেই হবে পয়গাম্বর (সাঃ) এর জানেশিন বা উত্তরসূরি। কিন্তু আনসারদের মধ্যে ঐকমত্য না থাকায় বিশেষতঃ আউস ও খাজরাজ গোত্রের পারস্পরিক পূর্ব শত্রুতার জের ধরে শুরু হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। আউস গোত্রের
লোকেরা খাজরাজ গোত্রের প্রধান সাআদের সাথে শুধু বিরোধীতাই করেনি বরং তারা ক্ষমতা তার হাত থেকে নিয়ে মুহাজিরদের কারো হাতে দেয়ার পক্ষপাতি ছিল।
২) মুহাজিরগণ যদিও বানী সাকিফায় মুহাজিরদের উপস্থিত লোকের সংখ্যা সামান্য ছিল তথাপি এক ধরনের কৌশল অবলম্বনের ফলে সকলেই হযরত আবু বকরের প্রতি সমর্থন জানায়। আশে পাশের অনেকেই তাকে রাসুলুল্লাহর (সাঃ)
খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আর এ সুযোগে তিনি জনগণকে নিজের বাইয়াত করার আহ্বান জানান।
উক্ত দুটি দল ছাড়াও আরেকটি দল বিদ্যমান ছিল যারা ইমাম আলী (আঃ) এর জন্য ছিল নিবেদিত। এদের মধ্যে বানী হাশিম ও কিছুসংখ্যক বুযুর্গ সাহাবা কেরাম মনে করতেন খেলাফতের একমাত্র হকদার ইমাম আলী (আঃ)
এবং অন্য সবার চেয়ে ইমাম আলী নেতা ও রাহবার হিসেবে যোগ্য। এই দলটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছিল যে, রাসূলুল্লাহর পবিত্র দেহ মোবারক সবেমাত্র দাফন হতে না হতেই মুহাজির ও আনসারদের মাঝে খলিফা মনোনয়ন নিয়ে
বাকবিতন্ডা, সংঘর্ষ বেঁধে গেছে। তারা নিজেদের বিরোধী মনোভাবকে মুহাজির ও আনসারদের বরং সমস্ত মুসলমানদের কর্ণকুহরে পৌঁছানোর অভিপ্রায়ে হযরত আবু বকরের খলিফা মনোনয়ন পন্থাকে বাতিল ঘোষণা করে সরাসরি
হযরত ফাতেমার গৃহাভিমুখে গমন করেন। অবশেষে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ফাতেমার গৃহকে ত্যাগ করে মসজিদে গিয়ে অবস্থান নেন। নাজুক পরিস্থিতিতে তৃতীয় দলটি বিশেষ করে ইমাম আলী ও তার সঙ্গী সাথীরা দেখলেন যে
ইসলামী শাসন কর্তৃত্ব তার সঠিক হকদার ও প্রাপকের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে এবং তার সাথে শরীয়তের মাঝেও কাঁটছাট করা হচ্ছে পাশাপাশি পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে মোড় নিল যে খেলাফতের সত্যিকারের আল্লাহর
মনোনীত ব্যক্তির স্থলে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তিকে জনসাধারণ রাসূলুল্লাহর প্রকৃত উত্তরসুরি ভাবতে শুরু করল। আর এমতাবস্থায় হযরত আলী (আঃ) এর ন্যায় মহোত্তম ব্যক্তির পক্ষে নিশ্চুপ থাকাটা মোটেও ভাল ঠেকেনি
তাই তিনি নিরবতাকে পিছনে ঠেলে জবানের তীক্ষ্ণতাকে কাজে লাগান। মসজিদে নব্বীতে আসার পর তাঁর কাছ থেকে বাইয়াত নেয়ার জন্য পিড়াপীড়ি করা হলে সমবেত মুহাজিরদের সম্বোধন করে বলেন, হে মুহাজিরগণ!
পয়গাম্বর (সাঃ) স্বয়ং যে হুকুমাতের ভিত্তি স্থাপন করেছেন সেটাকে তোমরা তাঁর পবিত্র অভিজাত বংশের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নিজেদের কুটিরে আবদ্ধ রাখার বৃথা চেষ্টা করোনা। আল্লাহর শপথ! মহানবীর পরিবার একাজের
জন্য সর্বাপেক্ষা উত্তম। কেননা তাদের মধ্যে (আহলে বাইত) এমন সমস্ত যোগ্য ও মেধাবান ব্যক্তিরা রয়েছে যারা কোরআনের সঠিক গুঢ়রহস্য জানে এবং দ্বীন ইসলামের জ্ঞানভান্ডার তাদের অধীনে সুরক্ষিত, পয়গাম্বর (সাঃ)
এর সুন্নাত সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত, তারাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে সুশৃংখলভাবে পরিচালনার ক্ষমতা রাখে, সমস্ত ফেতনা ফ্যাসাদের শিকড়কে তারাই উপড়ে ফেলতে পারে এবং বাইতুল মাল গাণিমতের সম্পদকে সুষমভাবে
একমাত্র তারাই বন্টন করার মনমানসিকতা রাখে। আর বাস্তবতা হচ্ছে এমন সকল যোগ্য পন্ডিত ব্যক্তিরা থাকতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অন্যদের হাতে মানায় না। এমন যেন না হয় যে, তোমরা নফসের খায়েশ মোতাবেক চলতে গিয়ে
আল্লাহর পথ থেকে ছিটকে পড় এবং হাকীকাত থেকে মুখ ফিরিয়ে ভ্রান্তিতে হামাগুড়ি খেতে থাক। (সূত্রঃ আল ইমামত ওয়াসসিয়াসাত খ.১, প.১১)
উক্ত বক্তৃতায় ইমাম নিজের শ্র্রেষ্ঠত্বের বিষয়টিকে কত সুন্দর ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া এখানে অবৈধ খেলাফতের দাবিদারদের সাথে নিজের বিরোধী মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শিয়া নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে
ইমাম আলী (আঃ) বানী হাশিমের একটি দল নিয়ে আবু বকরের নিকট যান এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, যোগ্যতা, বীরত্বগাঁথা ইতিহাস, রণাঙ্গনের সাহসিকতা এ সমস্ত বিষয়কে তার সামনে তুলে ধরে বলেন, আমি পয়গাম্বরের
জীবদ্দশায় এবং তাঁর ওফাতের পর তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উপযুক্ত। আমি তাঁর (সাঃ) উযির, উত্তরসূরি, জ্ঞানভান্ডার এবং গুপ্তরহস্য ভান্ডার। আমি হলাম সিদ্দিকে আকবার এবং সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী ন্যায়বান ব্যক্তি।
আমি সেই পুরুষ যে প্রথম মহানবীর উপর ঈমান আনার পর তাঁকে সত্যবাদী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। আমি মুশরিকদের সাথে রণক্ষেত্রে দৃঢ় ও অটলভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তি, সুন্নাত ও কিতাবের সর্বজান্তা, উসূলে দ্বীন ও ফুরুয়ে
দ্বীনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ, ভাষার মাধুর্যতা আর বাক্যালংকারে আমার রয়েছে পুরোপুরি দখল। তবু কেন তোমরা আমার অধিকারের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছো?
ইমাম আলী (আঃ) অন্য আরেকটি খুতবায় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সক্ষম ক্ষমতাবান ও সর্বাপেক্ষা আল্লাহর বিধি বিধান সম্পর্কে সুঅভিজ্ঞ পন্ডিত একজন কোয়ালিটি সম্পন্ন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, হে জনতা! হুকুমত
পরিচালনার জন্য তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত যিনি জনতার মাঝে রাষ্ট্র চালানোর কলাকৌশলে অভিজ্ঞ এবং আল্লাহর বিধানকে ভাল করে জানেন। যার মধ্যে এই সামষ্টিক গুণাবলী অবর্তমান সে যদি খেলাফত লাভের চিন্তায় মগ্ন হয় এবং
নিজের ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডকে চালাতে থাকে তবে সে কতল তো হবেই। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-১৬৮)
এটা ছিল ইমাম আলীর দূরদর্শিতা, যুক্তিবিদ্যার পরিচায়ক রহস্য। আর নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শুধুমাত্র তাঁরই জবানীতে প্রকাশিত হয়নি বরং তাঁর ঘোরবিরোধীরাও একথা অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইমাম আলী যুগশ্রেষ্ঠ
মানব ও খেলাফতের যথাযোগ্য প্রাপক। প্রাধান্য রাখা সত্ত্বেও তাঁকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত রেখে তাঁর অধিকারকে ভূ-লন্ঠিত করা হয়েছে। আবু উবাইদা জাররা যখন শুনতে পায় যে ইমাম আবু বকরের বাইয়াত করতে অস্বীকৃতি
জানিয়েছে তখন ইমামের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, শাসন কর্তৃত্বকে আবু বকরের হাতে ছেড়ে দিন। আমি জানি আপনি এর জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। কারণ শ্রেষ্ঠত্বে, মর্যাদায়, ঈমানদার হিসেবে, জ্ঞানগরিমায়, দূরদর্শিতায়,
বংশমর্যাদায় এবং রাসুলুল্লাহর জামাতা হিসেবে আপনার সমতুল্য কেউই নেই। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১ পৃ. ১২)
ইমাম নিজের অধিকার পুনরুদ্ধারে শুধু বক্তৃতা ভাষণ বা স্মরণ করানোর উপরই ডিফেন্স করেননি ইতিহাসবেত্তাদের লেখনীতে জানা যায় পাশাপাশি তিনি কখনো কখনো ফাতেমা, হাসান-হোসাইনকে নিয়ে আনসারদের শীর্ষ নেতৃবর্গের
নিকট গমন করতেন যাতে করে খেলাফতকে তার হকদারের কাছে ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো তাদের কাছ থেকে কোন প্রকার সাড়া পাননি। বিভিন্ন অজুহাতে তারা বলাবলি করত যে আলী নিজেই যদি সবার
আগে খেলাফতের চিন্তা করে এবং আমাদের কাছ থেকে বাইয়াত চায় তাহলে আমরা তো তার সমর্থন ব্যক্ত করতে পারিনা কখনো; কেননা তার পূর্বেও তো আমরা প্রথম খলিফার বাইয়াতকে নাকচ করে দিয়েছি? ইমাম তাদের
প্রশ্নোত্তরে বলতেন, আচ্ছা আপনাদের দৃষ্টিতে এটাই কি উত্তম হত যে আমি পয়গাম্বরের মৃতদেহকে ফেলে রেখে খেলাফতের মোহে ছুটে যেতাম এবং সবার কাছ থেকে বাইয়াতের আহ্বান জানাতাম? ইমামের কথার সমর্থনে হযরত
ফাতেমা যাহরা বলেন, আলী নিজের দায়িত্ব কর্তব্যকে সবার চেয়ে ভালই জানেন। যারা আলীর হককে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাধাদান করেছে তাদের হিসাব মহান আল্লাহর হাতে। (সূত্রঃ আল ইমামা ওয়াসসিয়াসা, খ.১, পৃ. ১২)
অবাধ্য সীমালংঘনকারী দলের সামনে ইমামের এটা ছিল প্রথম পদক্ষেপ যার মাধ্যমে তিনি আশাবাদী ছিলেন হয়তো আনসারদের বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গকে বলে কয়ে অবহিত করে নিজের অধিকারকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে; কিন্তু
ইতিহাসের সাক্ষ্যমতে এতে তিনি কোন ফলাফল লাভ করতে পারেননি বরং তাঁর হককে পঁয়মাল করা হয়। এখন যদি কোন বিবেকবান ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয় পরিবেশের এমন অস্থিতিশীল, সংবেদনশীল, অরাজকতাপূর্ণ
ও টানটান উত্তেজনায় ইমাম আলীর পক্ষে কোন পন্থাবলম্বন করলে ভাল হত, শুধুমাত্র সমাজকে পর্যবেক্ষণ করা ও নিশ্চুপ থাকা নাকি যুদ্ধ ও আন্দোলনের ডাক দেয়া?
ইমাম আলী (আঃ) এর সামনে একটি মাত্র রাস্তা খোলা ছিলঃ
পরিস্থিতির এমন নাজুক অবস্থায় ইমামের সামনে একটি পথ ব্যতীত ভিন্ন কোন উপায় না থাকায় তিনি শুধু আনসার ও মুহাজিরদের বিভিন্ন উপদেশমুলক, পরামর্শমুলক, সাবধানমুলক এবং সমাধানমুলক বাণীর মাধ্যমে
পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন এবং জনগণের নিকট সত্যকে পরিষ্কার ও নিজের হুজ্জাতকে সমাপ্ত করেন। অন্য দিকে খলিফা ও তার সমমনা ব্যক্তিরা খেলাফতের রশিকে কবজা করার জন্য জোরাজুরি করতে লাগে এবং তারা নিজেদের
ক্ষমতাকে সমপ্রসারণের অভিসন্ধি নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যায়। আর যুগের আবর্তে খেলাফতের মসনদে আরোহণকারীরা খেলাফতের বিষয়টিকে এমনভাবে জনতার মন-মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করাতে থাকে যে এক সময় এটাকেই তারা
সঠিক প্রচলিত হুকুমাত হিসেবে মনে করতে লাগে এবং তাদের থেকে জীবনাদর্শ গ্রহণ করতে শুরু করে। সমাজের এমন সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে মুহূর্তে মুহূর্তে মহানবীর পরিবারের উপর নেমে আসে দুর্ভোগ। বিপরীত দিকে
শাসকদের ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। এমতাবস্থায় ইমাম আলী (আঃ) এর দুটি পন্থা বেছে নেয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
ক) নবী বংশের সহায়তা করা এবং অনুরক্তদের নিয়ে লড়াই করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনা।
খ) আর নয়তো নিরব থাকা ও সামাজিক বিষয়াদি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া এবং ব্যক্তিগত, চারিত্রিক দায়দায়িত্বকেই শুধু আঞ্জাম দেয়া।
অতএব, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে জানা যায় ইমাম যদি এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বিগ্রহের পন্থা অবলম্বন করতেন তাহলে এতে তৎকালীন নব জন্ম নেয়া ইসলামের ক্ষতি ও অমঙ্গল বৈ কোনই কল্যাণ হত না। যার ফলে দ্বিতীয়
পথ নির্বাচন ছাড়া ইমামের সামনে ভিন্ন কোন উপায়ন্তর ছিল না।
পয়গাম্বর (সাঃ) উম্মাতের মুর্তাদ হওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেনঃ
১। মহানবী (সাঃ) জীবদ্দশায় ইসলামী সমাজের ভবিষ্যত ও ভয়ানক পরিণাম সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন এবং তিনি সমাজের অবাধ্যতা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে মুসলমানদের মধ্যে কিছু দল তার মৃত্যুর পর সেই জাহিলিয়াতের
দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। সাথে সাথে ইলাহী বিধি আহকামকেও ভুলে যাবে। তাঁর এই ভাবনা আরো দৃঢ়তা লাভ করে উহুদের যুদ্ধের সময়। উহুদের যুদ্ধে যখন পয়গাম্বর (সাঃ) এর কতল হওয়ার অপপ্রচার শুরু হয় তিনি প্রত্যক্ষদর্শী
হিসেবে দেখতে পান যে অধিকাংশ সাধুবেশী পাশে অবস্থানকারী বুযুর্গ ব্যক্তিরা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করতে আরম্ভ করেছে। তারা পাহাড়, পর্বত ও ময়দানের আশেপাশে জান বাঁচাতে ছুটাছুটি করছে। আবার অনেকেই
আবু সুফিয়ান ও মুনাফিক আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর পাশে থাকাকে নিরাপদ মনে করে ছুটে যায়। এসকল লোকদের আকিদা বিশ্বাস এতই নড়বড়ে ও দুর্বল ছিল যে আল্লাহর সম্পর্কে হীন ধারণা করতেও তাদের বুক ততটুকু কাঁপেনি।
এ সমস্ত ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করে পবিত্র কোরআন ইরশাদ করে, “স্মরণ কর, তোমরা যখন উপরের দিকে ছুটছিলে এবং পিছন ফিরে কারো প্রতি লক্ষ্য করছিলেনা আর রাসুল তোমাদের পিছন দিক হতে আহ্বান করছিল।
ফলে তিনি তোমাদের বিপদের উপর বিপদ দিলেন যাতে তোমরা যা হারিয়েছো অথবা যে বিপদ তোমাদের উপর এসেছিল তার জন্য তোমরা দুঃখিত না হও। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।
(সূত্রঃ আলে ইমরানঃ ১৫৩)
পয়গাম্বরের কিছু সঙ্গীরা আল্লাহ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতে শুরু করল যেভাবে জাহিলিয়াতের লোকেরা করত তারা এটাও বলতে লাগে যে এছাড়া কি আমাদের জন্য আর কোন পথ খোলা ছিল?
পবিত্র কোরআন অন্য একটি আয়াতে পয়গাম্বরের ওফাতের পর মুসলিম উম্মাহর কিছু লোকের ছত্রভঙ্গ ও দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। যেমন বলা হচ্ছে, মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র; তার পূর্বে
বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করতে পারবে না বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।
(সূত্রঃ আলে ইমরান আয়াত ১৪৪)
উক্ত আয়াত আসহাবে পয়গাম্বরকে দুটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছে এক. জাহিলিয়াতের যুগে প্রত্যাবর্তনকারী দল, দুই. মজবুত ঈমানের উপর অবিচল অবস্থানকারী কৃতজ্ঞ দল।
২) বানী সাকিফার ঘটনা থেকে অনুধাবন করা যায় যে, মুসলমানদের মধ্যে নীল নকশা তৈরি, গোত্র ও বংশীয় বিদ্বেষ, জাহিলিয়াতের দিকে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে, ঐ সমস্ত মুসলমানদের মনে
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তখনও পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারেনি। ইসলাম ও ঈমান কেবলমাত্র তাদের অজ্ঞতাপূর্ণ চেহারায় ঢাকনার ন্যায় ঝুলছিল। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায় ঐ সমস্ত জামাত, তাদের বক্তৃতা ভাষণ কোন কিছুই
মঙ্গলার্থে ছিল না। প্রত্যেকেই খেলাফতের রাজমুকুট তার যোগ্য ব্যক্তির হাতে না দিয়ে নিজের গায়ে জড়াতে চেয়েছে। উক্ত সংগঠনটি ইসলাম ও মুসলমানদের কোন ধরণের কল্যাণমুলক চিন্তা তো করেনই নি বরং ইসলামের ভঙ্গুর
কিশতিকে যিনি সমুদ্রের পারে নিয়ে মুক্তি দিতে পারেন তার কাছ থেকে খেলাফত লুন্ঠন করেছে। মোটকথা হলো ঐ সমস্ত লোকদের অন্তরে ইসলামী আকিদা তখনও পর্যন্ত স্থান পায়নি, জাহিলিয়াতের আদিখ্যেতা চালচলন
অভ্যাস তাদের মন মস্তিষ্ককে ঘিরে রেখেছিল এবং মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বিগ্রহ, ফেরকাবাজী, দলে দলে বিভক্তির ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ হুমকির মুখে পড়ে আর কিছু লোক শিরকে লিপ্ত হয়ে যায়।
৩) বানী সাকিফার ঘটনার পর ইমাম আলী (আঃ) এর প্রদত্ত ভাষণ এ বিষয়গুলোকে আরো পরিষ্কার করে। তিনি নিজের বক্তৃতায় ইসলামী উম্মাহর ঐক্য সংহতির গুরুত্ব এবং ছত্রভঙ্গতা, দলাদলির পরিণাম সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, আবু সুফিয়ান যখন ইমাম আলীকে বাইয়াতের চাপ দিতে থাকে ইমাম জনসমাবেশের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, হে জনমন্ডলী! ফিতনার তরঙ্গের মাঝে শক্ত হাতে হাল ধরে মুক্তির নৌকা চালিয়ে যাও; বিভেদের পথ থেকে
ফিরে এসো; এবং অহংকারের মুকুট নামিয়ে ফেলো ........ যদি আমি বলেই ফেলি খেলাফতের কথা তবে তারা আমাকে বলবে ক্ষমতালোভী, আর যদি আমি নিশ্চুপ হয়ে থাকি তবে তারা বলবে আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত।
দুঃখের বিষয় এই যে, সকল উত্থান-পতনের মধ্যেও আমি টিকে আছি। আল্লাহর কসম, আবু তালিবের পুত্র মৃত্যুর সাথে এমনভাবে পরিচিত যেমন একটি শিশু তার মায়ের স্তনের সাথে। আমি নিরব রয়েছি আমার গুপ্ত জ্ঞানের
কারনে যা আমাকে দান করা হয়েছে। যদি আমি তা প্রকাশ করি তবে গভীর কূপ থেকে পানি উত্তোলনরত রশির মতো তোমরা কাঁপতে থাকবে। (সূত্রঃ নাহাজুল বালাগা, খুতবা নং-৫)
৪) নবমুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে পয়গাম্বরের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্রই তাদের মাঝে কতক দল ধর্মত্যাগ করে জাহিলিয়াতের তাদের পূর্বপুরুষদের পথকে স্বাগত জানায়। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ইসলামী হুকুমতের বিরোধীতায় নেমে
পড়ে এবং ইসলামী কর দিতেও অস্বীকৃতি জানায়। শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রথম পদক্ষেপ হলো, মুসলমানদের মধ্যে যারা ঈমানে বলিষ্ঠ তাদেরকে সাথে নিয়ে মুর্তাদদের সাথে সংগ্রাম করা যাতে তারা পুনরায় শাসকদের আনুগত্য
প্রকাশ করে এবং ইসলামী আইন কানুনের কাছে মস্তকাবনত করে। এছাড়া অন্য একটি গ্রুপ ইয়ামানে (মুসাইলামা, সাজ্জাহ ও তালাইহা) মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদার সেজে আরেকটি ফিতনার সৃষ্টি করে। তাই মুহাজির ও আনসারদের
মধ্যে যেখানে ঐক্য ফিরিয়ে আনা অসম্ভব, পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের ইসলামকে বিদায় জানানো এবং বিভিন্ন স্থানে মিথ্যে নবুয়াতের দাবিদারদের উত্থান এ সমস্ত পরিস্থিতি সমূহে ইমাম আলী (আঃ) এর ন্যায় মহামানবের পক্ষে
নিজের অধিকার আদায়কল্পে কিয়াম করা মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা। ইমাম মিশরবাসীদের প্রতি একটি পত্রে উক্ত বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহর কসম, আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে আরবরা খেলাফতকে পয়গাম্বরের খান্দান
থেকে ছিনিয়ে নিবে বা এ থেকে আমাকে বিরত রাখবে। তারা যখন আমার বাইয়াত নিতে চাপ সৃষ্টি করছিল এ দেখে আমি আরো চমকে গেলাম। কিন্তু আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। দেখলাম জনতার একটি দল ইসলামকে ত্যাগ করেছে
এবং তারা মুহাম্মদের দ্বীনকে ধ্বংসের পাঁয়তারায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপলব্ধি করলাম যে যদি ইসলাম ও মুসলমানদের সাহায্যার্থে এগিয়ে না যাই তাহলে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। আর দ্বীন ধ্বংস হওয়ার যন্ত্রণা আমার নিকট খানিক
দিনের হুকুমত না পাবার যন্ত্রণা অপেক্ষা অধিক বেশি যা বন্যার বানের মত অতিদ্রুত শেষ হয়ে যাবে। অতঃপর আমি ঐ সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম এবং মুসলমানদের সহযোগিতা করতে প্রস্তত হলাম যাতে বাতিল অপসারিত
হয় আর জনতা ইসলামের নিরাপদ দূর্গে প্রবেশ করতে পারে। (নাহাজুল বালাগা)
উসমানের খেলাফতের সূচনালগ্নে যখন শূরা কমিটির সদস্যরা তার প্রতি রায় প্রকাশ করে ইমাম তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, আপনারা সকলেই জানেন আমি খেলাফতের জন্য একমাত্র উপযুক্ত। এ মুহূর্তে যদিও আমার উপর জুলুম
করা হয় তবুও খেলাফতকে ছালাম জানালাম এবং শুধুমাত্র সওয়াবের আশায় আমি হুকুমতের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করছি।
ইবনে আবিল হাদীদের মন্তব্যঃ
ইমাম আলী (আঃ) নিজ দেশে পরবাসীর ন্যায় নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন রাখলেন কিছু দিন। হযরত নবী দুলালী ফাতেমা যাহরা (সাঃ আঃ) তাঁকে নিজের অধিকার আদায় করার জন্য লড়াই করতে পরামর্শ দেন। মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের
আযানের ধ্বনি আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ ভেসে আসছিল ইমাম ফাতেমার দিকে মুখ করে বলেন, তুমি কি চাও এই ধ্বনি বিলুপ্ত হয়ে যাক? ফাতেমা বলেন, কখনো না। তারপর ইমাম বলেন, তাহলে আমি যে পথ
নির্বাচন করেছি এটা আঁকড়ে থাকাটাই হবে উত্তম। (সূত্রঃ শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১১, পৃ.১১৩)
এতক্ষণ আলোচনার পর এখন আমরা ইমাম ঠান্ডা মাথায় সার্বজনীন কল্যাণ চিন্তা করে যে পদক্ষেপ নিলেন তার ফলাফল সম্পর্কে পরখ করে দেখব,
মহৎ উদ্দেশ্যের মূল্যায়নঃ
এ রকম খুব কম সমাজই চোখে পড়ে যেখানে যোগ্য পরিচালক বা রাহবারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। একজন দক্ষ রাহবারের যে শর্তাবলী থাকা বাঞ্ছনীয় এ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি তাহলে বলা যায় যে গোটা সমাজের মাঝে
এ কাজের জন্য হাতেগোনা কয়েকজনকে পাওয়া যাবে যারা এ দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত। সেই যোগ্য সমাজের রাহবারদের মধ্যে যিনি ঐশ্বী প্রদত্ত রাহবার হিসাবে মনোনীত তার দায় দায়িত্ব নিঃসন্দেহে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
আল্লাহ মনোনীত রাহবারগণ নিজের মাকাম বা পদমর্যাদাকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেন। আর খোদায়ী রাহবারগণ তো সেই মহৎ লক্ষ্যকে সমাজে বাস্তবায়ন করতেই প্রেরিত। তাদের
সামনে যখন দুটি রাস্তা উন্মোচন হয় তখন বাধ্য হয়ে একটি ত্যাগ করে অন্যটিকে বেছে নেন এবং নিজের মিশন বা অভিসন্ধিকে বাঁচানোর তাগিদে রাহবারত্বকে বিসর্জন দিয়ে দেন; কেননা এ ক্ষেত্রে মাকামের চেয়ে পবিত্র লক্ষ্যই
অগ্রাধিকার রাখে।
মুত্তাকিনদের মাওলা ইমাম আলী (আঃ) পয়গাম্বর (সাঃ) এর ওফাতের পর পরই ঠিক এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হোন। মানুষ যেভাবে কচি চারা গাছকে অতিযত্নে লালন করে ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে তার শাখা প্রশাখা,
ফল ফলাদি, শীতল ছায়া দ্বারা উপকার ভোগ করতে পারে তদ্রুপ মহানবী (সাঃ) ইমাম আলী (আঃ)কে লালন পালন করেন যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তার পবিত্র অস্তিত্ব থেকে লাভবান হতে পারে। ইমাম মহানবীর (সাঃ) মৃত্যুর
পর পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারলেন যে যদি খেলাফতকে হস্তগত করা হয় তাহলে এমন জটিলতার উদয় হবে যে পয়গাম্বরের পবিত্র মিশন যা তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে তার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তা বিফলে যাবে।
পূর্ব শত্রুতা ও বিদ্বেষঃ
তৎকালীন ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার দুরাবস্থা এবং মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদ বিসম্বাদের ফলে মুসলমানদের মধ্যে চরম আক্রোশ ও রক্তারক্তি শুরু হয়। মদিনার ও বাহিরের অধিকাংশ সমপ্রদায় ইমাম আলী (আঃ)
এর প্রতি ছিল নির্দয়। তারা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আলী (আঃ) এর উপর আক্রোশে ফেটে পড়ে। কারণ এসকল গোত্রের লোকদের পূর্বপুরুষদের তিনি কুফরের পক্ষে অবস্থান করার জন্য শায়েস্তা করেন এবং বিভিন্ন
যুদ্ধক্ষেত্রে ইমামের হাতেই তারা নিহত হোন। যদিও সে সকল মুশরিকদের পরবর্তী প্রজন্ম ইসলামের সাথে বাহ্যিক বন্ধন তৈরি করে কিন্তু মনে মনে চরম বিদ্বেষ লালন করে আসছিল। আর এমতাবস্থায় যদি ইমাম নিজের শক্তিমত্তা
দিয়ে লড়াই করে স্বীয় অধিকারকে ছিনিয়ে আনতেন তাহলে এ লড়াই থেকে নিম্নের ফলাফল বের হয়ে আসতঃ
১। এ লড়াইয়ে নিজের অধিকাংশ প্রিয় সাথীদের হারাতে হত। তারা মাওলার জন্য মৃত্যুকে বরণ করলেও বিনিময়ে ইমামের হক ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত না।
২। শুধু বিশ্বস্থ সাথীদের শাহাদতই নয় বরং বানী হাশিম ও প্রিয় ব্যক্তিদের আন্দোলনের কারণে পয়গাম্বরের সাহাবাদের মধ্যে যারা আলীর খেলাফতকে মানতে পারেনি তারা কখনো তাঁর কাছে মাথা নত করত না। ফলে মুসলমান সমাজ
নড়বড়ে হয়ে যেত। সাহাবীদের মধ্যে যদিও আলীর রাহবারিত্বকে অনেকে মানতে নারাজ ছিল; কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে তারা ইমামের সাথে ঐক্যমত ছিল।
৩। মুসলমানদের ঈমানী দূর্বলতার কারণে অন্যান্য প্রদেশে যাদের মধ্যে সবেমাত্র ইসলামের ছোঁয়া লেগেছিল তারাও ইসলাম বিদ্বেষী ও মুর্তাদদের সাথে যোগদান করে। তারা এক কাতারে শামিল হয় এবং সমাজের সঠিক দিকনির্দেশক না
থাকার ফলে তাদের মাঝ থেকে তাওহীদের চেরাগ চিরদিনের জন্য খামোশ হয়ে যেত। ইমাম আলী (আঃ) এমন একটা তিক্ত ভয়ানক পরিস্থিতিকে অতি কাছে থেকে অবলোকন করে নিরব থাকাটাই মঙ্গলজনক মনে করেন।
বিষয়টি আরো ভাল হবে যদি তা ইমামের জবান থেকে শ্রবণ করি।
আব্দুল্লাহ ইবনে জুনাদা বলেন, আমি আলী (আঃ) এর ক্ষমতায় আরোহণকালে একদিন মক্কা থেকে মদিনায় আসলাম। দেখলাম যে, জনতা মসজিদে পয়গাম্বরে একত্রিত হয়েছে এবং ইমামের প্রতীক্ষায় বসে আছে। ইমাম একটি
তরবারী সাথে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করেন। সকলেই তার প্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর তিনি মিম্বারে উঠে আল্লাহর স'তি গাওয়ার পর সবাইকে সম্বোধন করে বলেন, সাবধান হও হে জনমন্ডলী! পয়গাম্বরের
ওফাতের পর তোমাদের উচিত ছিল তিনি হুকুমাতের জন্য যাকে নির্বাচিত করে ছিলেন তার ব্যাপারে বিরোধীতা না করা। কেননা, আমরাই মহানবীর উত্তরসূরি, আহলে বাইয়াত। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কুরাইশদের মধ্যে
একটি দল আমাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে, খেলাফতকে আমাদের কাছ থেকে ছিনতাই করেছে এবং তা নিজেরদের কাছে রাখতে চেয়েছে। আল্লাহর কসম! যদি মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকত বা ইসলাম
থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় না থাকত অথবা ইসলাম নিঃশ্বেষ হওয়ার উপত্রুম না হত তবে তোমরা আলীর ভিন্ন রুপ দেখতে। (শারহে নাহজুল বালাগা ইবনে আবিল হাদীদ, খ.১, পৃ. ৩০৭)
মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তৈরি করা ও ঐক্য বজায় রাখা ছিল ইমামের একটি মহান লক্ষ্য। তিনি ভাল করে জানতেন যে এই ঐক্যের কারণেই মহানবীর (সাঃ)আমলে স্বৈরবাদীদের ভীত নড়বড়ে হয়েছিল এবং ইসলামের বিকাশ ও
অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং যদি এই বন্ধন ক্ষমতার জটিলতার কারণে বিনষ্ট হয় তাহলে মুসলমানরা এখতেলাফের মধ্যে নিমজ্জিত হবে। তাছাড়া কুরাইশদের মধ্যে যে দলটি ইসলামের অমঙ্গল চেয়েছিল তারা একটি অজুহাতে
ইসলামের মূলে আঘাত হানার অপচেষ্টা করবে।
সমস্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে ইমাম আলী (আঃ) কেন নিরবতাকেই যুদ্ধের উপর প্রাধান্য দিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। একজন কবি বিষয়টি তার কবিতার চরণে সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। যার অনুবাদ হলোঃ
আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি উম্মতের নেতৃত্ব খান্দানে হাশিম ও আবুল হাসানের কাছ থেকে ছিনতাই করা হবে।
আলী কি প্রথম পুরুষ নন যিনি কেবলার দিকে নামাজ আদায় করেছেন? তিনি কি কোরআন ও সুন্নাতে তোমাদের চেয়ে জ্ঞানী নন? তিনি কি মহানবীর ঘনিষ্ঠজন ছিলেন না? তিনি কি প্রত্যেকটি সমরে পয়গাম্বরকে সাহায্য করেননি?
সিফফিনের যুদ্ধে বানী আসাদের এক ব্যক্তি ইমামকে জিজ্ঞাসা করেন, কুরাইশগণ কিভাবে আপনার মত ব্যক্তিকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করলো? ইমাম তার এই অসময়ে প্রশ্ন করার জন্য অসন্তষ্ট হলেন কারণ অনেক ইমামের
পক্ষাবলম্বনকারী সিপাহীরা অন্য খলিফাদের উপর বিশ্বাস করত। তার এহেন প্রশ্নের কারণে তাদের সারিতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। ইমাম ব্যথিত হৃদয়ে বলেন, পয়গাম্বরের প্রতি অনুরাগের কারণে এবং যেহেতু প্রত্যেক মুসলমান প্রশ্ন করার
হক রাখে তাই তোমাকে এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলব উম্মতের পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতেই ছিল এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মহানবীর সাথে। কিন্তু একদল কৃপণতা প্রকাশ করল এবং একদল চোখ বন্ধ করে রাখল।
তাদের ও আমাদের মাঝে ফয়সালা দান করবে আল্লাহপাক এবং আমরা সকলেই তার কাছে ফিরে যাব।

পরিশেষে বলব, এ ধরনের আরো বহু কারণ বিদ্যমান ছিল যার কারণে ইমাম ইসলাম রক্ষার্থে নিজের অধিকার থেকে হাত গুটিয়ে নেন এবং প্রায় পঁচিশ বছর নিরব থেকে বুক ভরা বেদনা নিয়ে দিনাতিপাত করেন

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202