সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান
ইমাম আলী (আঃ) এর ন্যায়কামী ও সত্যান্বেষী বক্তব্যের দিক
নাহজুল বালাগায় হযরত আলী (আঃ) এর স্বরূপটা এমন একজন ইনসানে কামেলের মতো ফুটে ওঠে যিনি সত্ত্বার বিস্ময় ও রহস্যের গূঢ়ার্থ সচেতন এবং যিনি দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যের সকল রহস্যকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর গুণাবলী এমন এক বিষয় যা নাহজুল বালাগায় বারবার বর্ণিত হয়েছে। আলী (আঃ) আল্লাহর বর্ণনা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহ্যভাবে দিয়ে মানুষের চিন্তা-আবেগ-অনুভূতিকে এমন এক অনন্ত সত্যের সাথে পরিচিত করিয়ে তোলেন যে সত্য সম্পর্কে আমরা সবাই নিজেদের উপলব্ধি অনুযায়ী তাঁকে চিনতে পারি এবং যাঁর অপার দয়া ও রহমতের ছায়ায় আমরা জীবন যাপন করি
ন্যায়কামী ও সত্যান্বেষী এই মহান মনীষীর অলঙ্কারপূর্ণ ও গভীর অর্থবহ বক্তব্যের আরো কিছু দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো
মানুষের অধিকার জাগরণের ক্ষেত্রে আলী ইবনে আবি তালিব (আঃ) এর মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ইসলামী শিক্ষার আলোকে আলোকিত। জুলুম-অত্যাচার,নিরাপত্তাহীনতা বা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিগুলো। আলী (আঃ) কে যে-ই চিনতে পারবে সে অবশ্যই ভালোভাবে উপলব্ধি করবে যে,অত্যাচারের মোকাবেলায় তিনি কখনোই শান্তভাবে চুপ করে বসে থাকতে পারতেন না, চেষ্টা করতেন সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে তাঁর এই চেষ্টা-প্রচেষ্টার বিষয়টি তাঁর চিন্তা-ভাবনা, বক্তৃতা-বিবৃতি তাঁর শাসনকার্য এবং তাঁর অনুসৃত নীতি-আদর্শের মধ্যেই সুস্পষ্ট। শ্রেণী-বৈষম্য দূরীকরণের জন্যে,দারিদ্র্য বিমোচন করার লক্ষ্যে এবং শোষণ-বঞ্ছনা ও অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি ব্যাপক সংগ্রাম করেছেন। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনকালে মানুষকে ন্যায়-নীতির স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন।
যারা শাসক তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্তব্য হলো ব্যক্তিগত এবং সামাজিক নিরাপত্তার পাশাপাশি মানুষের জন্যে রাজনৈতিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে এমন সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যাতে সকল শ্রেণীর মানুষই তার সুফল ভোগ করতে পারে। আসলে রাজনৈতিক নিরাপত্তার মানেই হলো এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে আপামর জনগণ নির্দ্বধায়-নিঃসঙ্কোচে,নির্ভয়ে তাদের আশা-আকাঙ্খার কথা বলতে পারে। আলী (আঃ) তাঁর হুকুমাতকালে রাজনীতি বা হুকুমাতের বিকৃত অর্থটিকে দূরীভূত করার চেষ্টা করেছেন। বিকৃত অর্থ মানে হুকুমাত বলতে মানুষ বুঝতো একধরনের স্বৈরশাসন বা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া জগদ্দল পাথর। আলী (আঃ) এই ধারণাটি পাল্টে দিলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন যে,হুকুমাত আসলে পরিচালনা,অংশঅদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা এবং জনগণের সেবা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আজারবাইজানের স্বল্পকালীন গভর্নর ছিলেন আস্আস ইবনে কায়েস। ইমাম আলী (আঃ) এই আস্আসকে একটি চিঠিতে লিখেছেন-গভর্নরের পদ তোমার জন্যে মজাদার কিছু নয় বরং এটা তোমার ঘাড়ে চাপানো একটা আমানত,তাই তোমার উচিত হলো তোমার কমান্ডার এবং তোমার ইমামের আনগত্য করা। মানুষের ওপর স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড করা কিংবা আদেশ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার অধিকার তোমার নেই। তোমার হাতে মহান আল্লাহর দেওয়া বহু সম্পদ রয়েছে। তুমি হচ্ছো সেইসব সম্পদের কোষাধ্যক্ষ,তোমার দায়িত্ব হলো সেইসব সম্পদ আমার কাছে সোপর্দ করা।
ইমাম মনে করতেন সমাজে রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার সবচেয়ে বড়ো কারণটি হলো স্বৈরশাসন যা মানুষের অসৎ গুণাবলির মূল। সে জন্যেই ইমাম আলী (আঃ) তাঁর কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে যখন চিঠিপত্র লিখতেন সেখানে বলতেন তারা যেন অহমিকা না করে,শ্রেষ্ঠত্বকামী না হয়।
তিনি আরো তাকিদ দিতেন যে শাসক এবং জনগণের মাঝে পারস্পরিক অধিকার রয়েছে। এই অধিকারের বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দেওয়া যায় তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা,শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সেই সমাজের লোকজনের মাঝে পারস্পরিক সহানুভূতিশীল সম্পর্ক স্থাপিত হবে। এ কারণেই ইমাম আলী (আঃ) তাঁর শাসনকালের শুরু থেকেই জনগণের ওপর তাঁর কোনোরকম কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন নি যাতে মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিঘিœত হয়। এমনকি তাঁর বিরোধী ছিল যারা,তাদের কারো ওপরেও কোনোরকম চাপ সৃষ্টি করা হয় নি বা তাদের নিরাপত্তা কখনোই হুমকির মুখে পড়ে নি। আলী (আঃ) জনগণকে ভালোবাসতেন এবং তাদেরকে নির্বাচনের অধিকার দিতেন।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়টিও ইমাম আলী (আঃ) এর দৃষ্টিতে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তিনি মনে করতেন অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাই দারিদ্র্যের কারণ আর দারিদ্র্য ঈমানের দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বঞ্চিত জনগোষ্ঠির সমস্যা সমাধানে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে তিনি মনে করেন। জনকল্যাণে তাঁর ছিল গভীর মনোযোগ। তিনি মনে করতেন তাঁর হুকুমাতের একটি লক্ষ্য হলো সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। তিনি চেষ্টা করেছেন আভ্যন্তরীণ এবং বাইরের বিভিন্ন বিষয়ে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি কেবল তখনই বিরোধীদের মোকাবেলা করতেন যখন একেবারেই নিরুপায় হয়ে যেতেন অর্থাৎ যখন শান্তিপূর্ণ সমাধানের আর কোনো পথ খোলা না থাকতো। তিনি একটি চিঠিতে মালেক আশতারকে লিখেছিলেন, "শান্তি প্রস্তাব হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ,তাই শান্তিপ্রস্তাবকে কখনোই প্রত্যাখ্যান করো না। শত্রুরা যেটুকুই পেশ করুক না কেন। যোদ্ধাদের জন্যে প্রশান্তি,নিজেদের এবং দেশের জন্যে শান্তি নিশ্চিত হয় শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। তবে শান্তিচুক্তির পর শত্রুদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করবে। কেননা অনেক সময় শত্রুরা তোমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করার জন্যে তোমার সমীপে হাজির হবে। তাই সতর্কতা অবলম্বনের ব্যাপারে ত্র"টি করবে না। এভাবে হযরত আলী (আঃ) নিরাপত্তা বিষয়টিকে সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক করণীয় বলে গুরুত্ব দিতেন। সত্যি বলতে কি ইমাম আলী (আঃ) এর দৃষ্টিতে যে সমাজে নিরাপত্তা নেই সে সমাজে সার্বিক ন্যায়মূলক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়।
হযরত আলী (আঃ) ৪৯ নম্বর খোৎবায় লিখেছেন,সকল প্রশংসা আল্লাহর। যিনি সকল গোপন বস্তু সম্পর্কে অবহিত এবং সত্ত্বার সকল প্রকাশ্য বস্তুই তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে। কখনোই কারো চোখের সামনে তিনি প্রকাশিত হন না। যে চোখ দিয়ে তাকে দেখে না, সেও তাঁকে অস্বীকার করতে পারে না। যে হৃদয় তাঁকে চিনেছে সেও তাকে দেখতে পায় না। তিনি এতো মহান, মর্যাদাবান এবং উন্নত যে তাঁর সঙ্গে তুলনা করার মতো কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই। আবার তিনি সৃষ্টিকূলের এতো কাছে যে, কোনো কিছুই তাঁর চেয়ে বেশি কাছের হতে পারে না।
আলী (আঃ) এর দৃষ্টিতে আল্লাহ হলেন সকল সত্ত্বার উৎস এবং সৃষ্টির সবকিছু তাঁর কাছ থেকেই উৎসারিত। আকাশ এবং যমিনে যা কিছু আছে সবকিছুই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সৃষ্টি করেছেন। আর সৃষ্টিকূল যেহেতু তাঁর সাথেই সম্পর্কিত,সেহেতু সকল বস্তুই তাঁর মর্যাদা এবং তাঁর একত্বের লেশপ্রাপ্ত। আল্লাহর বান্দাগণ তাঁর সক্ষমতা,তাঁর কৌশল এবং তাঁর দয়অ-দিাক্ষিণ্যের কাছে অনুগত ও আত্মসমর্পিত। যদিও বান্দাদের আনুগত্যের কোনো প্রয়োজনীয়তা আল্লাহর কাছে নেই। বরং আনুগত্য বান্দার নিজের মর্যাদা বা সৌভাগ্যের জন্যেই প্রয়োজন।
আলী (আঃ) জনগণের কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন তারা যেন আল্লাহকে সময় এবং স্থানের সীমিত গণ্ডির মাঝে অবরুদ্ধ বলে মনে না করে কিংবা তাঁকে কেউ যেন নিজের সাথে তুলনা না করে। আল্লাহকে চেনার জন্যে তাঁর সৃষ্টির বিস্ময়ের প্রতি মনোনিবেশ করলেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব,বিশালত্ব এবং মহান মর্যাদার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে। নাহজুল বালাগায় তিনি মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন- হে যথার্থ কাঠামোযুক্ত সৃষ্টি!হে মায়ের পেটের অন্ধকারে লালিত সত্তা! সৃষ্টির শুরুতে তুমি ছিলে কাদার তলানি। তারপর তুমি নির্দিষ্ট একটা সময় আরামের একটি জায়গায় সুরক্ষিত ছিলে। সেই মায়ের পেট থেকে তোমাকে বের করে এমন এক পৃথিবীতে আনা হয়েছে যেই পৃথিবীকে তুমি ইতোপূর্বে দেখো নি এবং লাভের পথ কোন্টা-তাও জানতে না। তাহলে চুষে চুষে মায়ের দুধ খাওয়া কে শেখালো? দরকারের সময় ডাকা বা চাওয়ার পন্থাটি তোমাকে কে শেখালো?
তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি তার নিজের বর্ণনায় ভারসাম্য রক্ষা করতে অক্ষম সে নিঃসন্দেহে তার প্রতিপালকের প্রশংসার ক্ষেত্রে আরো বেশি অক্ষম। আলী (আঃ) অপর এক বর্ণনায় বলেছেন মানুষের সুখ-শান্তি আর সুস্থিতির মূল উৎস হলেন আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহকে খোঁজার জন্যে তাই মানুষ তার আধ্যাত্মিক শক্তি,তার জ্ঞান-বুদ্ধি,বিচার-বিবেচনাকে কাজে লাগায় যাতে খোদার প্রেমের রেকাবিতে পা রাখা যায় এবং তাঁর নিকটবর্তী হয়ে অমোঘ শক্তি লাভ করা যায়। তিনি নিজে আল্লাহর প্রেমের রশ্মিতে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্যে এতো উর্ধ্বে পৌঁছেন যে,এই পৃথিবী এই জীবন তাঁর কাছে খুবই তুচ্ছ বিষয় ছিল এবং সবসময় আল্লাহর প্রশংসা বাণী তাঁর মুখে হৃদয়গ্রাহী শব্দে গুঞ্জরিত হতো। বলা হয় যে,রাত ঘনিয়ে আসলে কিংবা আঁধারের পর্দা নেমে আসলে প্রতিটি মুহূর্তই আল্লাহর বিশেষ প্রশংসার মুহূর্ত।
আসলে আলী (আঃ) আল্লাহকে এতো গভীরভাবে চিনতেন যে স্বয়ং রাসূলে খোদা (সা) তাঁর প্রশংসা করতেন। সেইসাথে রাসূল চাইতেন জনগণ যেন তাঁর ওপর কথা না বলে কেননা আলী (আঃ) হলেন আল্লাহর প্রেমে বিমোহিত।
মন্তব্যসমূহ