ইসলামের অনন্য মহানায়ক ইমাম রেজা (আ.) ১১ ই জিলকাদ ইসলামের ইতিহাসের এক মহা-খুশির দিন। কারণ, ১৪৮ হিজরির এই দিনে মদিনায় ইমাম মুসা ইবনে জাফর সাদিক (আ.)'র ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.)। তাঁর পবিত্র ও কল্যাণময়ী মায়ের নাম ছিল উম্মুল বানিন নাজমা। ১৮৩ হিজরিতে খলিফা হারুনের কারাগারে পিতা ইমাম কাজিম (আ.)'র শাহাদতের পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মুসলিম উম্মাহর ইমামতের ঐশী দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম রেজা (আ.)। এই মহান ইমামের জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে ইমাম রেজা (আ.)'র জন্মদিনের তাবাররুক হিসেবে তাঁর জীবনের প্রধান কিছু ঘটনা ও প্রকৃত ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাঁর অমর অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করব আজকের এই বিশেষ আলোচনায়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত তথা মাসুম বংশধররা ছিলেন খোদায়ী নানা গুণ ও সৌন্দর্যের প্রকাশ। তাঁরা ছিলেন মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ বা পরিপূর্ণ আদর্শ। তাঁদের মহত গুণ ও যোগ্যতাগুলো সত্য-সন্ধানী এবং খোদা-প্রেমিকদের জন্য অফুরন্ত শিক্ষা ও প্রেরণার উতস হয়ে আছে। শেখ সাদুক ইমাম রেজা (আ.) সম্পর্কে এক বইয়ে লিখেছেন, অসাধারণ নানা গুণ ও যোগ্যতার জন্য আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) রেজা বা সন্তুষ্ট, সাদিক বা সত্যবাদী, ফাজেল বা গুণধর, মু'মিনদের চোখের প্রশান্তি বা আলো ও কাফির বা অবিশ্বাসীদের ক্ষোভের উতস প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তবে আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.)'র একটি বড় উপাধি হল 'আলেমে আ'লে মুহাম্মাদ' বা মুহাম্মাদ (সা.)'র আহলে বাইতের আলেম। ইমাম রেজা (আ.)'র পিতা ইমাম মুসা কাজিম (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, আমার বাবা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) আমাকে বার বার বলতেন যে, আলে মুহাম্মাদের আলেম বা জ্ঞানী হবে তোমার বংশধর। আহা! আমি যদি তাঁকে দেখতে পেতাম!তাঁর নামও হবে আমিরুল মু'মিনিন (আ.)'র নাম তথা আলী। প্রায় হাজার বছর আগে লিখিত 'শাওয়াহেদুন্নবুওয়াত' নামক বইয়ে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, যারা ইরানের খোরাসানে অবস্থিত (যার বর্তমান নাম মাশহাদ) ইমাম রেজা (আ.)'র মাজার জিয়ারত করবে তারা বেহেশতবাসী হবে। বিশিষ্ট কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক মাওলানা আবদুর রহমান জামির লিখিত এই বইটি বহু বছর আগে বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে (মাওলানা মহিউদ্দিনের মাধ্যমে) (পৃ.১৪৩-১৪৪)। [এ বইয়ের ২৭২ পৃষ্ঠায় পবিত্র কোম শহরে অবস্থিত হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)’র পবিত্র মাজার জিয়ারত সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়েছে। এই ফাতিমা মাসুমা ছিলেন ইমাম রেজা-আ.’র ছোট বোন। মাসুমা বা নিষ্পাপ ছিল তাঁর উপাধি।] বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইরানের খোরাসানে তাঁর শরীরের একটি অংশকে তথা তাঁর পবিত্র বংশধারা বা আহলে বাইতের একজন সদস্যকে দাফন করা হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। নবীবংশের প্রত্যেক ইমামের জীবনই যেন মহাসাগরের মতই মহত গুণ, জ্ঞান, আর কল্যাণের নানা ঐশ্বর্যে কুল-কিনারাহীন এবং শাহাদাতের স্বর্গীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ভাষ্য অনুযায়ী ইমামদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো রাজনৈতিক সংগ্রাম। ইসলামের মধ্যে নানা বিকৃতি চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ। হিজরি প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইসলামি খেলাফত যখন সুস্পষ্টভাবেই রাজতন্ত্রের রূপ নেয় এবং ইসলামী নেতৃত্ব জোর- জুলুমপূর্ণ বাদশাহিতে রূপান্তরিত হয়, তখন থেকেই আহলে বাইতের সম্মানিত ইমামগণ সময়োপযোগী পদ্ধতিতে বিদ্যমান সকল অব্যবস্থা বা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তাঁদের রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে থাকেন। তাঁদের এইসব রাজনীতির বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল প্রকৃত ইসলামি সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং ইমামতের ভিত্তিতে হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করা। কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের সব ধরনের চরম অত্যাচার-নিপীড়নের মুখেও তাঁরা তাঁদের এই ইমামতের গুরুদায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁদের শাহাদাতের পবিত্র রক্ত থেকে জন্ম দিয়েছে খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের লক্ষ-কোটি অনুসারী। শাহাদতের বেহেশতি গুল বাগিচার পথ ধরে ইমামতের সেই ধারা আজো অব্যাহত রয়েছে এবং তাঁদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরিগণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আজো তৎপর রয়েছে। ইমামতের নুরানি জ্যোতিতে অলোকময় পৃথিবী তাঁদের নির্ভুল দিক-নির্দেশনায় খুঁজে পাচ্ছে প্রকৃত ইসলামের সঠিক দিশা। ইমামের পবিত্র জন্মবার্ষিকী তাই গোটা মুসলিম উম্মাহর মুক্তির স্মারক। ইমাম রেজা (আ.)'র ইমামতির সময়কাল ছিল বিশ বছর। এই বিশ বছরে আব্বাসীয় তিনজন শাসক যথাক্রমে বাদশাহ হারুন এবং তার দুই পুত্র আমিন ও মামুনের শাসনকাল অতিক্রান্ত হয়েছিল। ইমাম রেজা (আ.) তাঁর পিতা ইমাম মূসা কাজিম (আ.)’র নীতি-আদর্শকে অব্যাহত গতি দান করেন। ফলে ইমাম মূসা কাজিম (আ.)’র শাহাদাতের পেছনে যেই কারণগুলো দেখা দিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই ইমাম রেজা (আ.)ও সেই কারণগুলোর মুখোমুখি হন। অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থবাদি মহলের নেপথ্য রোষের মুখে পড়েন তিনি। আব্বাসীয় রাজবংশে বাদশা হারূন এবং মামুনই ছিল সবচে পরাক্রমশালী এবং দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। তারা প্রকাশ্যে ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির কথা বলে বেড়াতেন কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইমামদের রক্তের তৃষ্ণায় তৃষিত ছিলেন। ইমামদের প্রতি তাঁদের এ ধরনের আচরণের উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক, আহলে বাইত প্রেমিক বা নবীবংশ প্রেমিকদের আন্দোলনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া, এবং দুই শিয়া মুসলমানদের মন জয় করা। ইমামদের সাথে সম্পর্ক থাকার প্রমাণ থাকলে জনগণের কাছে তাদের শাসনও বৈধ বলে গৃহীত হবে-এ ধরনের চিন্তাও ছিল তাদের মনে। কারণ, মুসলমানরা যদি দেখে যে, বিশ্বনবী (সা.)’র নিষ্পাপ বংশধরগণ তথা হযরত আলীর (আ) পরিবারবর্গের প্রতি বাদশাহর সম্পর্ক বা যোগাযোগ রয়েছে, তাহলে তারা আব্বাসীয়দের শাসনকে বৈধ মনে করে খুশি হবে, ফলে তারা আর বিরোধিতা করবে না। এরফলে তাদের শাসনকার্য পরিচালনা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হবে। ইমাম রেজা (আ.) শাসকদের এই দুরভিসন্ধিমূলক রাজনীতি বুঝতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তাঁর কৌশলটি ছিল এমন, যার ফলে একদিকে বাদশা মামুনের উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয়, অপরদিকে মুসলিম বিশ্বের জনগণও প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারে। আর সেই সত্য হলো এই যে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ইসলামী খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকার কেবলমাত্র নবী পরিবারের নিষ্পাপ বা পবিত্র ইমামগণের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং তাঁরা ছাড়া কেউ ঐ পদের যোগ্য নয়। জনগণের মাঝে এই সত্য প্রচারিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বাদশার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবে-এই আশঙ্কায় ধূর্ত মামুন ইমাম রেজাকে (আ) সবসময়ই জনগণের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। শুধু ইমাম রেজা (আ.) নন প্রায় সকল ইমামকেই এভাবে গণ-বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকরা তাঁদেরকে গৃহবন্দী করাসহ কঠোর প্রহরার মধ্যে রাখার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু তারপরও নিষ্পাপ ইমামদের সুকৌশলের কারণে তাঁদের বার্তা জনগণের কাছে ঠিকই পৌঁছে যায়। আর জনগণের কাছে মহান ইমামগণের বার্তা পৌঁছে যাবার ফলে জনগণ প্রকৃত সত্য বুঝতে পারে, এবং নবীবংশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকে। বিশেষ করে বাদশাহ মামুনের অপততপরতার বিরুদ্ধে ইমাম রেজা (আ.) যখন দাঁড়িয়ে গেলেন, তখন ইরাকের অধিকাংশ জনগণ মামুনের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। হযরত আলী(আ.)’র পবিত্র খান্দানের কেউ বাদশাহর বিরুদ্ধে গেলে বাদশাহি যে হারাতে হবে-এই আশঙ্কা মামুনের মধ্যে ছিল। যার ফলে মামুন একটা আপোষ-নীতির কৌশল গ্রহণ করে। বাদশাহ মামুন ইমামকে খোরাসানে আসার আমন্ত্রণ জানায়। ইমাম প্রথমত রাজি হন নি, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁকে আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে । বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি বসরা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি তাঁর গতিপথ পরিবর্তন করে ইরানের দিকে পাড়ি দেন। উল্লেখ্য যে, নবীবংশের মধ্যে ইমাম রেজা(আ.)ই প্রথম ইরান সফর করেন। যাই হোক, যাত্রাপথে তিনি যেখানেই গেছেন জনগণ তাঁকে সাদরে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে। ইমামও নবী করিম (সা.), তাঁর আহলে বাইত ও নিষ্পাপ ইমামদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামের সঠিক বিধি-বিধান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। সেইসাথে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য অর্থাৎ বাদশাহর আমন্ত্রণের কথাও তাদেরকে জানান। চতুর বাদশাহ মামুন ইমামের আগমনে তার সকল সভাসদ এবং অন্যান্য লোকজনকে সমবেত করে বলেন, হে লোকেরা ! আমি আব্বাস এবং আলীর বংশধরদের মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখেছি , আলী বিন মূসা বিন রেজার মতো উত্তম লোক দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আমি চাচ্ছি যে , খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেব এবং এই দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত করবো। ইমাম, মামুনের রাজনৈতিক এই দুরভিসন্ধি সম্পর্কে জানতেন। তাই তিনি জবাবে বললেন, মহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমার জন্যে নির্ধারিত করে থাকেন, তাহলে তা অন্যকে দান করা উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারী না হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই। ইমাম শেষ পর্যন্ত মামুনের কথায় খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় মামুন ইমামকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হতে বাধ্য করে। ইমাম রেজা (আ.) শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে কিছু শর্তসাপেক্ষে তা গ্রহণ করেন। শর্তগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ছিল এরকম-এক, তিনি প্রশাসনিক কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। দূরে থেকে তিনি খেলাফতের সম্পর্ক রক্ষা করবেন। তিনি কেন এ ধরনের শর্তারোপ করেছিলেন , তার কারণ দায়িত্ব গ্রহণকালে প্রদত্ত তাঁর মোনাজাত থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি মুনাজাতে বলেছিলেন - হে খোদা ! তুমি ভালো করেই জানো , আমি বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। সুতরাং আমাকে এজন্যে পাকড়াও করো না। যেমনিভাবে তুমি ইউসূফ ও দানিয়েল ( আ ) কে পাকড়াও করো নি। হে আল্লাহ ! তোমার পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য ছাড়া আর কোনো কর্তৃত্ব হতে পারে না। আমি যেন তোমার দ্বীনকে সমুন্নত রাখতে পারি, তোমার নবীর সুন্নতকে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি। ইমাম রেজা র এই দায়িত্ব গ্রহণের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে আব্বাসীয়রা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা ভেবেছিল, খেলাফত বুঝি চিরদিনের জন্যে আব্বাসীয়দের হাত থেকে আলীর (আ) বংশধরদের হাতে চলে গেল। তাদের দুশ্চিন্তার জবাবে বাদশা মামুন তার আসল উদ্দেশ্যের কথা তাদেরকে খুলে বলে। তা থেকেই বোঝা যায়, যেমনটি আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ইমামকে খোরাসানে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাঁর পরবর্তী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পেছনে মামুনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, শিয়াদের বৈপ্লবিক সংগ্রামকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা। যাতে তাদের উত্তাল রাজনীতিতে ভাটা পড়ে যায়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ছিল আব্বাসীয় খেলাফতকে বৈধ বলে প্রমাণ করা। তৃতীয়ত, ইমামকে উত্তরাধিকার বানানোর মাধ্যমে নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও মহান উদার হিসেবে প্রমাণ করা। তো মামুনের এই অশুভ উদ্দেশ্যের কথা জানার পর আব্বাসীয়রা ইমামকে বিভিন্নভাবে হেয় ও মর্যাদাহীন করে তোলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ ইমামকে তারা কিছুতেই অপদস্থ করতে পারে নি। যেমন, বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মাধ্যমে জটিল প্রশ্নের অবতারণা করে ইমাম রেজা (আ.)-কে জব্দ করার চেষ্টা, কিংবা ক্ষরা-পীড়িত অঞ্চলে বৃষ্টি বর্ষণের জন্য ইমামকে দিয়ে এই আশায় দোয়া করানো যে দোয়া কবুল না হলে ইমামের মর্যাদা ধূলিসাৎ হবে। কিন্তু ইমাম প্রতিটি জ্ঞানগত বিতর্কে বিজয়ী হতেন এবং বৃষ্টির জন্য করা তাঁর দোয়াও কবুল হয়েছিল। বাদশাহ মামুন একবার তার সাপ্তাহিক প্রশ্নোত্তরের আসরে ইমামকে আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে ইমাম কোনো এক প্রেক্ষাপটে মামুনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিমত দেন। এতে বাদশা ভীষণ ক্ষেপে যান এবং ইমামের বিরুদ্ধে অন্তরে ভীষণ বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকেন। এইভাবে ইমামত, জনপ্রিয়তা, খেলাফত, আলীর বংশধর প্রভৃতি বিচিত্র কারণে বাদশাহ ইমামের বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে থাকে। অন্যদিকে জনগণ বুঝতে পারে যে, খেলাফতের জন্যে মামুনের চেয়ে ইমামই বেশি উপযুক্ত। ফলে ইমামের বিরুদ্ধে মামুনের ক্রোধ এবং হিংসা বাড়তেই থাকে। আর ইমামও মামুনের বিরুদ্ধে অকপট সত্য বলার ক্ষেত্রে নির্ভীক ছিলেন। কোনোভাবেই যখন ইমামকে পরাস্ত করা গেল না, তখন মার্ভ থেকে বাগদাদে ফেরার পথে ইরানের বর্তমান মাশহাদ প্রদেশের তূস নামক অঞ্চলে মামুন ইমামকে ডালিমের রস বা আঙ্গুরের সাথে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে হৃদয়-জ্বালা মেটাবার উদ্যোগ নেয়। ২০৩ হিজরির ১৭ই সফরে এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। তখন ইমামের বয়স ছিল পঞ্চান্ন বছর। আসলে বিষ প্রয়োগে ইমামের সাময়িক মৃত্যু ঘটলেও আসল মৃত্যু ঘটেছিল মামুনেরই। পক্ষান্তরে ইমাম শাহাদাতের পেয়ালা পান করে যেন অমর হয়ে গেলেন চিরকালের জন্যে। তার প্রমাণ মেলে মাশহাদে তাঁর পবিত্র সমাধিস্থলে গেলে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইমামের জন্মদিনে কাতারে কাতারে মানুষ আসে তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। সোনালি রঙ্গের সমাধি-ভবনের চারপাশ জাঁকজমক আর অপূর্ব ঐশ্বর্যে কোলাহল-মুখর হয়ে ওঠে নিমেষেই। যুগ যুগ ধরে মানুষের নেক-বাসনা পূরণের উসিলা হিসেবে কিংবদন্তীতুল্য খ্যাতি রয়েছে নবীবংশের ইমামগণের। ইমাম রেজা (আ.) ও তাঁর পবিত্র মাজারও এর ব্যতিক্রম নয়। কেনো ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইমামের মাযারে এসে ভিড় জমান? এ সম্পর্কে যিয়ারতকারীগণ বিভিন্নভাবে তাঁদের আবেগ-অনুভূতি জানিয়েছেন। একজন বলেছেন, আমি যখনই বা যেখানেই কোনো সমস্যার সম্মুখীন হই, তখনই ইমাম রেজা (আ.)’র মাজারে চলে আসি। এখানে এসে আল্লাহর দরবারে সমস্যার সমাধান চেয়ে দোয়া করি। আমি বহুবার লক্ষ্য করেছি , ধর্মীয় এবং পবিত্র স্থানসমূহ বিশেষ করে ইমাম রেজা (আ.)’র পবিত্র মাযারে এলে মনোবেদনা ও সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যায় এবং এক ধরনের মানসিক প্রশান্তিতে অন্তর ভরে যায়। মনের ভেতর নবীন আশার আলো জেগে ওঠে। এভাবে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিক প্রশান্তির কথা বলেছেন। জীবিতাবস্থায় যিনি মানুষের কল্যাণে ছিলেন আত্মনিবেদিত, শহীদ হয়েও তিনি যে অমরত্মের আধ্যাত্মিক শক্তিবলে একইভাবে মানব-কল্যাণ করে যাবেন-তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে! ইমাম রেজা (আ.)'র যুগে মুসলমানরা গ্রিক দর্শনসহ ইসলাম-বিরোধী নানা মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। এ সময় মুসলমানদের শাসক ছিলেন আব্বাসিয় খলিফা মামুন। সে ছিল আব্বাসিয় শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে ধূর্ত ও জ্ঞানী। সমসাময়িক নানা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল। আমরা আগেই বলেছি মামুন ইমাম রেজা (আ.)-কে ইরানের মার্ভ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিলেন। মার্ভ শহর ছিল মামুনের রাজধানী। সে এই মহান ইমামের উপস্থিতিতে বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞানী-গুণীদের নিয়ে জ্ঞানের নানা বিষয়ে অনেক বৈঠক করতেন। বিশেষজ্ঞ বা পণ্ডিতদের দিয়ে ইমাম রেজা (আ.)-কে জব্দ করাই ছিল এইসব বৈঠকের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু ইমাম রেজা (আ.) নানা ধরনের কঠিন প্রশ্ন ও জটিল বিতর্কের এইসব আসরে বিজয়ী হতেন এবং বিতর্ক শেষে ওইসব পণ্ডিত ও জ্ঞানীরা ইমামের শ্রেষ্ঠত্বও অকাট্য যুক্তির কথা স্বীকার করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। খলিফা মামুন হযরত ইয়াহিয়া (আ.)'র অনুসারী হওয়ার দাবিদার তথা সাবেয়ি ধর্মের এক বিখ্যাত পণ্ডিতকে একবার নিয়ে আসেন এ ধরনের এক বিতর্কের আসরে। সেখানে ইহুদি, খ্রিস্টান ও অগ্নি-উপাসকদের পণ্ডিতরাও উপস্থিতি ছিল। এই আসরে ইমাম রেজা (আ.) ইসলামের বিরোধিতা সম্পর্কে কারো কোনো বক্তব্য, যুক্তি বা প্রশ্ন থাকলে তা তুলে ধরার আহ্বান জানান এবং তিনি এর জবাব দেবেন বলে ঘোষণা করেন। ইমরান নামের ওই সাবেয়ি পণ্ডিত অবজ্ঞাভরে বলল: "তুমি যদি না চাইতে তবে তোমার কাছে আমি প্রশ্ন করতাম না। আমি কুফা, বসরা, সিরিয়া ও আরব দেশে গিয়েছি এবং তাদের সব দার্শনিক বা যুক্তিবাদীদের সঙ্গে বিতর্ক করেছি। কিন্তু তাদের কেউই প্রমাণ করতে পারেনি যে আল্লাহ এক ও তিনি ছাড়া অন্য কোনো খোদা নেই এবং তিনি এই একত্বের মধ্যে বহাল রয়েছেন। এ অবস্থায় আমি কি তোমার কাছে প্রশ্ন করতে পারি? ইমাম রেজা (আ.) বললেন, যত খুশি প্রশ্ন করতে পার। ফলে সে ইমামকে বিভিন্ন ধরনের বেশ কিছু প্রশ্ন করে। ইমাম রেজা (আ.)ও বহু সংখ্যক পণ্ডিত ও বিপুল দর্শকদের উপস্থিতিতে একে-একে ইমরানের সব প্রশ্নের এত সুন্দর জবাব দিলেন যে ওই সাবেয়ি পণ্ডিত সেখানেই মুসলমান হয়ে যান। ইমাম রেজা (আ.) বিতর্কে অংশগ্রহণকারী পণ্ডিতদের ধর্ম-বিশ্বাস ও মতবাদে উল্লেখিত দলিল-প্রমাণের আলোকেই তাদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। একবার খলিফা মামুন বিখ্যাত খ্রিস্টান পণ্ডিত জাসলিককে বললেন ইমাম রেজা (আ.)’র সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে। জাসলিক বললেন, আমি কিভাবে তাঁর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হব যখন তাঁর ধর্মগ্রন্থ তথা কুরআন ও এর দলিল-প্রমাণের প্রতি আমার বিশ্বাস নেই এবং তিনি যেই নবীর বক্তব্যকে দলিল-প্রমাণ হিসেবে পেশ করবেন তাঁর প্রতিও আমার ঈমান নেই। ইমাম রেজা (আ.) বললেন, যদি ইঞ্জিল তথা বাইবেল থেকে দলিল-প্রমাণ তুলে ধরি তাহলে কি আপনি তা গ্রহণ করবেন? জাসলিক বললেন, হ্যাঁ। আসলে ইমাম উভয়-পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে জাসলিকের সঙ্গে বিতর্ক করলেন। বিতর্কে জাসলিক এতটা প্রভাবিত হলেন যে তিনি বললেন: খ্রিস্ট বা ঈসার কসম, আমি কখনও ভাবিনি যে মুসলমানদের মধ্যে আপনার মত কেউ থাকতে পারেন। ইমাম রেজা (আ.)ইহুদি সর্দার ও পণ্ডিত রাস উল জালুত-এর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, মুসা (আ.)’র নবী হওয়ার দলিল বা প্রমাণ কী? রাস উল জালুত বললেন, তিনি এমন মু’জিজা বা অলৌকিক নিদর্শন এনেছেন যে তাঁর আগে আর কেউই তেমনটি আনতে পারেনি। ইমাম প্রশ্ন করলেন: কেমন সেই মো’জেজা? জালুত বললেন: যেমন, সাগরকে দুই ভাগকরে মাঝখানে পথ সৃষ্টি করা, হাতের লাঠিকে সাপে পরিণত করা, পাথরে ওই লাঠি দিয়ে আঘাত করে কয়েকটি ঝর্ণা বইয়ে দেয়া, হাত সাদা করা এবং এ রকম আরো অনেক মু’জিজাবা অলৌকিক নিদর্শন; আর অন্যরা এর মোকাবেলায় কিছু করতে পারত না ও এখনও তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা কারো নেই। জবাবে ইমাম রেজা (আ.) বললেন, এটা ঠিকই বলেছেন যে, হযরত মুসা (আ.)’র আহ্বানের সত্যতার প্রমাণ হল, তিনি এমন কিছু কাজ করেছেন যা অন্যরা করতে পারেনি; তাই কেউ যদি নবুওতের দাবিদার হনও এমন কিছু কাজ করেন যা অন্যরা করতে পারেন না, এ অবস্থায় তাঁর দাবিকে মেনে নেয়া কি আপনার জন্য ওয়াজিব বা অপরিহার্য নয়? ইহুদি আলেম বললেন: না, কারণ আল্লাহর কাছে উচ্চ অবস্থান ও নৈকট্যের দিক থেকে কেউই মুসা নবীর সমকক্ষ নয়। তাই কেউ যদি মুসা নবীর মত মু’জিজা বা অলৌকিক নিদর্শন দেখাতে না পারেন তাহলে তাকে নবী হিসেবে মেনে নেয়া আমাদের তথা ইহুদিদের জন্য ওয়াজিব নয়। ইমাম রেজা (আ.) বললেন, তাহলে মুসা নবী (আ.)’র আগে যে নবী-রাসূলবৃন্দ এসেছেন তাঁদের প্রতি কিভাবে ঈমান রাখছেন? তাঁরা তো মুসা (আ.)’র অনুরূপ মু’জিজা আনেননি। রাস উল জালুত এবার বললেন, ওই নবী-রাসূলবৃন্দ যদি তাঁদের নবুওতের সপক্ষে মুসা নবীর মু’জেজার চেয়ে ভিন্ন ধরনের মু’জিজা দেখাতে পারেন তাহলে তাদের নবুওতকে স্বীকৃতি দেয়ায়ও ওয়াজিব বা জরুরি। ইমাম রেজা (আ.) বললেন, তাহলে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)’র প্রতি কেন ঈমান আনছেন না? অথচ তিনি তো মৃতকে জীবিত করতে পারতেন, অন্ধকে দৃষ্টি দান করতেন, চর্ম রোগ সারিয়ে দিতেন, কাদা দিয়ে পাখি বানিয়ে তাতে ফু দিয়ে জীবন্ত পাখিতে পরিণত করতেন। রাস উল জালুত এবার বললেন, তিনি এইসব কাজ করতেন বলে বলা হয়ে থাকে, তবে আমরা তো দেখিনি। ইমাম রেজা (আ.) বললেন, আপনারা কি মুসা নবী (আ.)’রমু’জিজা দেখেছেন? এইসব মু’জিজার খবর কি আপনাদের কাছে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে পৌঁছেনি? - জি হ্যাঁ, ঠিক তাই। বললেন রাস উল জালুত - ইমাম রেজা (আ.) বললেন, "ভালো কথা, তাহলে ঈসা (আ.)’র মু’জিজাগুলোর নির্ভরযোগ্য খবরও তো আপনাদের কাছে বলা হয়েছে। কিন্তু এ অবস্থায় আপনারা মুসা নবী (আ.)-কে নবী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনলেও ঈসা (আ.)’র প্রতি ঈমান আনছেন না। "তিনি আরো বললেন, "বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র নবুওতসহ অন্যান্য নবী-রাসূলদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের নবী (সা.)র অন্যতম মু’জিজা হল এটা যে তিনি ছিলেন একজন দরিদ্র ইয়াতিম ও রাখালের কাজ করে পারিশ্রমিক নিতেন। তিনি কোনো পড়াশুনা করেননি এবং কোনো শিক্ষকের কাছেও আসা-যাওয়া করেননি। কিন্তু তারপরও তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে অতীতের নবী-রাসূলদের কাহিনী ও ঘটনাগুলোর হুবহু বিবরণ। এতে রয়েছে অতীতের লোকদের খবর এবং কিয়ামত পর্যন্ত সুদূর ভবিষ্যতের খবর। এ বই অনেক নিদর্শন ও অলৌকিক ঘটনা তুলে ধরেছে।" এভাবে রাস উল জালুতের সঙ্গে ইমাম রেজা (আ.)’র আলোচনা চলতে থাকে। সংলাপ এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে ইহুদি সর্দার ও পণ্ডিত রাস উল জালুত ইমাম রেজা (আ.)-কে বললেন: "আল্লাহর কসম! হে মুহাম্মদের সন্তান (বংশধর)! ইহুদি জাতির ওপর আমার নেতৃত্বের পথে যদি বাধা হয়ে না দাঁড়াত তাহলে আপনার নির্দেশই মান্য করতাম। সেই খোদার কসম দিয়ে বলছি, যে খোদা মুসার ওপর নাজেল করেছেন তাওরাত ও দাউদের ওপর নাজেল করেছি যাবুর। এমন কাউকে দেখিনি যিনি তাওরাত ও ইঞ্জিল আপনার চেয়ে ভালো তিলাওয়াত করেন এবং আপনার চেয়ে ভালোভাবে ও মধুরভাবে এইসব ধর্মগ্রন্থের তাফসির করেন।" এভাবে ইমাম রেজা (আ.) তাঁর অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে সবার জন্য সর্বোত্তম ও বোধগম্যভাবে ইসলামের বিশ্বাসগুলো তুলে ধরেছিলেন। আর তিনি এত গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী এবং সেসবের প্রচারক ও বিকাশক ছিলেন বলেই তাঁকে ‘আলেমে আলে মুহাম্মাদ’ বা বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের আলেম শীর্ষক উপাধি দেয়া হয়েছিল। এই মহাপুরুষের কয়েকটি বাণী শুনিয়ে ও সবাইকে আবারও শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করব তাঁর জন্মদিনের আলোচনা। ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন, ১."জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হচ্ছে এমন এক গচ্ছিত সম্পদের মত যার চাবি হল, প্রশ্ন। আল্লাহর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষিত হোক, কারণ প্রশ্নের মাধ্যমে চার গ্রুপ তথা প্রশ্নকারী, শিক্ষার্থী, শ্রবণকারী ও প্রশ্নের উত্তর- প্রচারে নাজাতের তরি পাঞ্জাতান আঃ

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202