সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলে মোহাম্মদ
পর্ব ১
24 জিলহজ মোবাহেলা দিবস — বিস্তারিত ঘটনা সমূহ
সত্তরটি গ্রাম সমেত নাজরান অঞ্চল হিজায ও ইয়েমেন সীমান্তে অবস্থিত ।
ইসলামের চূড়ান্ত পর্যায়ে আবির্ভাব কালে এ এলাকাটি হিযাজের একমাত্র খ্রিষ্টান অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল । এ এলাকার অধিবাসীরা বিভিন্ন কারণে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল ।
সূত্র – ইয়াকুত হামাভী তাঁর মু’ জামুল বুলদান গ্রন্থের ৫ম খণ্ডের ২৬৬-২৬৭ পৃষ্ঠায় নাজরানবাসীদের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার কারণগুলো বর্ণনা করেছেন ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও ধর্মীয় কেন্দ্রসমূহের প্রধানদের কাছে চিঠি-পত্র প্রেরণের পাশাপাশি মহানবী (সঃ) নাজরানের আর্চবিশপ আবু হারিসা-এর কাছে ইসলাম ধর্মের দাওয়াত দিয়েছিলেন ।
সূত্র – .‘ উসকুফ’ বা‘ আর্চ বিশপ’ শব্দটি গ্রীক‘ ইপেসকোপ’ শব্দ থেকে উৎসারিত, যার অর্থ হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী, তদারককারী, পর্যবেক্ষক ও নিয়ন্ত্রক । আর এখন এ শব্দটি ধর্মযাজক বা পাদ্রীর চেয়ে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের খ্রিষ্টধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক পদ বোঝাতে ব্যবহৃত হয় ।
“ইবরাহীম (আঃ) , ইসহাক (আঃ) ও ইয়াকূব (আঃ) এর প্রভুর নামে ,
(এ পত্রটি) মহান আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর পক্ষ থেকে নাজরানের মহামান্য আর্চবিশপের প্রতি ।
ইসহাক ও ইয়াকূবের প্রভুর প্রশংসা করছি এবং আপনাদের বান্দাদের (গায়রুল্লাহর) উপাসনা থেকে মহান আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহবান জানাচ্ছি । আপনাদেরকে গায়রুল্লাহর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য থেকে বের হয়ে মহান আল্লাহর আধিপত্যে (বেলায়েত) প্রবেশ করার আহবান জানাচ্ছি । আর যদি আপনারা আমার দাওয়াত গ্রহণ না করেন , তা হলে অন্ততঃপক্ষে ইসলামী সরকারকে কর (জিযিয়া) প্রদান করুন (যে, এ কর প্রদান করার দরুন আপনাদের জীবন ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হবে) ।
এর অন্যথা হলে আপনাদের প্রতি সমূহ বিপদ অর্থাৎ যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে।
সূত্র – বিহারুল আনওয়ার, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৫ ।
কিছু কিছু শীয়া ঐতিহাসিক সূত্রে আরও বেশী বর্ণিত হয়েছে যে , মহানবী (সাঃ) আহলে কিতাব এর সাথে সংশ্লিষ্ট ঐ আয়াতও পত্রে লিখেছিলেন , যার মধ্যে এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের প্রতি সবাইকে আহবান জানানো হয়েছে ।
” — আপনি বলে দিন : হে আহলে কিতাব ! আমাদের ও তোমাদের মাঝে যে বিষয়টি অভিন্ন , সেই বিষয়ের দিকে তোমরা সবাই ফিরে আস ।
সূরা – আলে ইমরান / ৬৪ ।
এই আয়াতের মর্মার্থ, বিহারুল আনওয়ার, ২১তম খণ্ড, পৃ. ২৮৭ ।
মহানবী (সাঃ) এর প্রেরিত প্রতিনিধি দল নাজরানে প্রবেশ করে তাঁর পত্র নাজরানের প্রধান খ্রিষ্ট ধর্মযাজকের কাছে অর্পণ করেন ।
আর্চবিশপ ভালভাবে পত্রটি পাঠ করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য তিনি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরামর্শসভার আয়োজন করেন । ঐ পরামর্শ সভার একজন সদস্য ছিলেন শুরাহবিল , যিনি বুদ্ধিমত্তা , বিচারক্ষমতা ও দক্ষতার জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন । তিনি আর্চবিশপের উত্তরে বলেছিলেন , “আমার ধর্ম বিষয়ক জ্ঞান খুবই কম । সুতরাং অভিমত ব্যক্ত করার অধিকার আমার নেই । আর যদি আপনারা অন্য কোন বিষয়ে আমার সাথে পরামর্শ করতেন , তা হলে আমি আপনাদের সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন পথের সন্ধান দিতাম ।
কিন্তু অনন্যোপায় হয়ে একটি বিষয় সম্পর্কে আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছি যে , আমরা আমাদের ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে বহু বার শুনেছি যে , একদিন হযরত ইসহাকের বংশধারা থেকে নবুওয়াতের পদ ইসমাঈলের বংশধারায় স্থানান্তরিত হবে । আর ‘মুহাম্মদ’, যিনি ইসমাঈলের বংশধর , তিনিই যে সেই প্রতিশ্রুত নবী হবেন , তা মোটেই অসম্ভব নয় ।”
এ পরামর্শসভা এ মর্মে অভিমত ব্যক্ত করে যে , নাজরানের প্রতিনিধি দল হিসেবে একদল লোক মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করে যেসব বিষয় তাঁর নবুওয়াতের সত্যতার দলিল স্বরূপ সেসব কাছে থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করার জন্য মদীনায় যাবে ।
তাই নাজরানবাসীর মধ্য থেকে ষাটজন সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে এ প্রতিনিধি দলের সদস্য নির্বাচিত করা হয় ।
তাদের নেতৃত্বে ছিলেন তিনজন ধর্মীয় নেতা যাঁদের পরিচয় নীচে দেয়া হল –
১) – আবু হারিসাহ ইবনে আলকামাহ্ : নাজরানের প্রধান ধর্মযাজক বা আর্চবিশপ যিনি হিজাযে রোমের গীর্জাসমূহের স্বীকৃত প্রতিনিধি ছিলেন ।
২) – আবদুল মসীহ্ : নাজরানের প্রতিনিধি দলের নেতা, যিনি বিচার-বুদ্ধি, দক্ষতা, কর্মকৌশল ও ব্যবস্থাপনার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ।
৩) – আইহাম : যিনি ছিলেন একজন প্রবীণ ব্যক্তি এবং নাজরানবাসীর সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত ।
সূত্র – তারিখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৬ ।
প্রতিনিধি দল রেশমী বস্ত্র নির্মিত অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিধান করে , হাতে স্বর্ণ নির্মিত আংটি পরে এবং গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে অপরাহ্নে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে মহানবী (সাঃ) কে সালাম জানায় ।
কিন্তু তিনি তাদের ঘৃণ্য ও অসংযত অবস্থা- তাও আবার মসজিদের অভ্যন্তরে,- দেখে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হন । তারা বুঝতে পারে যে , মহানবী (সাঃ) তাদের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হয়েছেন । কিন্তু তারা এর কোন কারন খুঁজে পাচ্ছিল না ।
তাই তারা তৎক্ষণাৎ হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের এ ঘটনা সম্পর্কে জানালে তাঁরা বলেন, এ ব্যাপারে সমাধান আলী ইবনে আবী তালিবের হাতে রয়েছে ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান এবং আবদুর রহমান ইবনে আউফ তাদের পূর্ব পরিচিত ছিলেন । প্রতিনিধি দল যখন হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী (আঃ) এর কাছে গমন করে তাঁকে ঘটনা সম্পর্কে জানায় , তখন আলী (আঃ) তাদেরকে বলেছিলেন , “আপনাদের উচিত আপনাদের এসব জমকালো পোশাক ও স্বর্ণালংকার পাল্টিয়ে সাদা-সিধাভাবে মহানবী (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হওয়া । তা হলে আপনাদেরকে যথাযথ সম্মান করা হবে ।”
প্রচারে মোঃ শামসীর হায়দার
মন্তব্যসমূহ