আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলে মুহাম্মদ সাহাবিদের মধ্যে আলী (আ.)’র অনন্য এবং শ্রেষ্ঠ মর্যাদার কিছু যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ: রাসূল (সা.) বিভিন্ন সময়ে বলেছেন: " আলী আমার থেকে এবং আমি তাঁর থেকে এবং আলীই আমার পর সমস্ত মুমিনদের ওলি তথা অভিভাববক ও নেতা" (তিরমিজি, ৫ম খণ্ড, পৃ-১১০) রাসূল (সা.) আরো বলে গেছেন, আলী সব সময়ই হকের পথে থাকবে। “আলী (আ.)-কে মহব্বত করা ঈমান, আর আলী(আ.)’র সঙ্গে শত্রুতা করা মুনাফেকী” (মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ-৪৮)।“আমি জ্ঞানের শহর, আলী তার দরজা”(সহি তিরমিজি, ৫ম খণ্ড, পৃ;২০১)। এমনকি রাসূল (সা.) এ দোয়াও করেছেন যে, “হে আল্লাহ সত্যকে আলীর পক্ষে ঘুরিয়ে দিও।” রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, কেবল মুনাফিকই আলীর সঙ্গে শত্রুতা করবে। “যে আলীকে দোষারোপ করল, সে আমাকে দোষারোপ করল, আর যে আমাকে দোষারোপ করল সে খোদাকে দোষারোপ করল। আল্লাহ তাকে মুখ নিচু করে দোজখে নিক্ষেপ করবেন।”(সহি বুখারী-দ্বিতীয় খণ্ড, সহি মুসলিম- দ্বিতীয় খণ্ড, সহি তিরমিজি, ৫ম খণ্ড)। “আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা। হে খোদা যে আলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে তুমিও তার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখ, যে আলীর সাথে শত্রুতা রাখে তুমিও তার সাথে শত্রুতা রাখ।” (সহি মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ-৩৬২, মুসনাদে ইমাম হাম্বল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ-২৮১) সাহাবিদের অনেকেই বলতেন, আমরা আলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা দেখে কে মুনাফিক ও কে মুমিন তা নির্ধারণ করতাম। রাসূল (সা.) আরো বলেছেন: “এই আলী আমার ভাই, আমার ওয়াসি এবং আমার পর আমার প্রতিনিধি হবে। তাই তাঁর আদেশ শোন, তাঁর আদেশ মত কাজ কর।” (তাফসিরে তাবারি, ১৯ খণ্ড, পৃ-১২১, ‘লাইফ অফ মুহাম্মাদ’-ড. মো. হোসাইন হায়কাল, প্রথম সংস্করণ১৩৫৪ হি,প্রথম খণ্ড, পৃ-১০৪) হযরত আহমদ বিন হাম্বল বলেছেন, “যত ফজিলতের বর্ণনা আলীর বেলায় এসেছে অন্য কোনো সাহাবির বেলায় তা আসেনি। আলী (আ.)’র অসংখ্য শত্রু ছিল। শত্রুরা অনেক অনুসন্ধান করেছে আলী (আ.)’র দোষ-ত্রুটি বের করার, কিন্তু পারেনি।” হযরত কাজী ইসমাইল নাসায়ি আবু আল নিশাবুরি বলেন, “যত সুন্দর ও মজবুত সনদের মাধ্যমে আলী (আ.)’র ফজিলতগুলো বর্ণিত হয়েছে-অন্য সাহাবিদের বেলায় তেমনি আসেনি।” হযরত আলী সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, আলী প্রেম মানুষের পাপ এমনভাবে ধ্বংস করে যেমনি আগুন জ্বালানী কাঠ ধ্বংস করে দেয়। একবার হযরত আলী (আ.)-কে দেখে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছিলেন, তিনটি এমন বৈশিষ্ট্য তোমার রয়েছে যেটা আমারও নেই, এই তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তুমি এমন একজনকে শ্বশুর হিসেবে পেয়েছে, যা আমি পাইনি, এমন একজনকে তুমি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছে, যে কিনা আমার কন্যা, আর তৃতীয়টি হচ্ছে তুমি হাসান- হুসাইনের মত সন্তানের পিতা যেটা আমার নেই। রাসূলে খোদা (সা.) এর আগেও বহুবার আলী (আ.)-র বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের কথা ঘোষণা করেছেন। ইবনে আব্বাসসহ আরো অনেকের বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসূলের পরে আলী (আ.)-ই ছিলেন সবচেয়ে মোত্তাকি ও সাহসী ব্যক্তি। একবার বিশ্বনবী (সা.) কয়েকজন সাহাবির সঙ্গে ঘরে বসেছিলেন। সেখানে একটি বিশেষ পাখীর মাংস খাবার হিসেবে আনা হয়েছিল। রাসূল (সা.) বললেন, হে আল্লাহ তোমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। এমন সময় দরজায় টোকা দিলেন আলী (আ.)। রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে নিয়ে সেই মাংস খান। জাবের বিন আব্দুল্লাহ আনসারি বলেছেন, একবার রাসূল (সা.)-র কাছে আলী (আ.) এলেন। রাসূল বললেন, আলী (আ.) ও তার অনুসারীরা কিয়ামতে পরিত্রাণপ্রাপ্ত। এ সময় সূরা বাইয়ানার ৭ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। সেখানে বলা হয়েছে, যারা ঈমান এনেছে এবং সত কাজ করেছে, তারা আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি। এরপর থেকে রাসূলের সাহাবিরা আলী (আ.)-কে দেখলেই বলতেন, ওই যে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। হযরত আলী (আ.) ছিলেন জ্ঞান, বীরত্ব, সাহস, দূরদর্শিতা, মহানুভবতা, দয়া, পরোপকার, ন্যায়নিষ্ঠা ইত্যাদি গুণের আকরসহ মানবীয় মূল্যবোধ ও যোগ্যতার সব দিক থেকে একজন ভারসাম্যপূর্ণ ও পরিপূর্ণ আদর্শ মানব। বিশ্বনবী (সা.) তাঁকে প্রায় ৫/৬ বছর বয়স থেকে নিজের হাতে ও নিজের ঘরে রেখে মনের মত করে গড়ে তোলেন এবং জ্ঞানগত নানা দিকসহ সব দিকে যোগ্য উত্তরসূরি হিসেব প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। উমর ইবনে খাত্তাব বলেছেন, আলী না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত এবং আলীর মত একজন মহামানব জন্ম দেয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর আর কোনো নারীর নেই। তিনি আলী (আ.)'র শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন হিসেবে তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা শ্রেষ্ঠত্বের কথা উল্লেখ করেছেন যা আর কারো ছিল না। এ তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল: "(নবী-নন্দিনী) ফাতিমা (সা. আ.)'র সঙ্গে তাঁর বিয়ে, মসজিদে (নববীর) ভেতরে তাঁর বসবাস অব্যাহত থাকা যা আমার জন্য বৈধ নয় এবং খায়বার যুদ্ধের পতাকা (তথা সেনাপতিত্ব) পাওয়া।" আলী (আ.)'র আগে অন্য সেনাপতিরা মদিনায় ইহুদি শত্রুদের খায়বার দুর্গ জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, "আগামীকাল আমি এমন একজনের হাতে পতাকা দেব যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাঁকে ভালবাসেন।" বেলায়েত বা নেতৃত্বের দর্শন: সমাজ পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব একটি অপরিহার্য বিষয়। মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা নেয়ামত হলো- নেতৃত্বের যোগ্যতা। এই যোগ্যতা, গুণ ও ক্ষমতা সীমিত সংখ্যক লোকের মধ্যেই আল্লাহ দিয়ে থাকেন। বাকীরা তাদের অনুসরণ করেন। মানব ইতিহাসের কিছু নেতা সরাসরি আল্লাহর মাধ্যমে মনোনীত। এঁরা হলেন, নবী, রাসূল ও আহলে বাইতের ইমামগণ, যারা সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। ফলে তাদের প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণ সব মানুষের জন্য যথাযথভাবে অনুকরণীয়। মানব সমাজের নেতৃত্বের বিষয়টি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, সে বিষয়টি পবিত্র কুরানেও উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১২৪ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্মরণ করো যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উত্তীর্ণ হলো। এরপর আল্লাহ বলেছিলেন "আমি তোমাকে সব মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করবো।" ইবরাহীম আবেদন করেছিলেন- আর আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও ( ইমাম বা নেতা করুন)। আল্লাহ জবাব দিলেন: "আমার এ অঙ্গীকার জালেমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে না (কেবলমাত্র তোমার যেসব বংশধর নিষ্পাপ ও পবিত্র থাকবে,তারাই এ পদের যোগ্য হিসেবে গণ্য হবে)। হজরত মূসা(আ.) তাঁর ভাই হারুনকে নিজের সহযোগী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য আল্লাহর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এরপর আল্লাহ তা কবুল করেন। সূরা ত্বাহার ৩৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: আল্লাহ বললেন, "হে মূসা! তুমি যা চেয়েছো তা তোমাকে দেয়া হলো।' সূরা সা'দের ২৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা, হজরত দাউদ (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, 'হে দাউদ ! আমি অবশ্যই তোমাকে পৃথিবীতে সৃষ্টিকুলের প্রতিনিধি করেছি। সুতরাং মানুষের মধ্যে সত্য ও [ ন্যায়ের ] ভিত্তিতে বিচার -মীমাংসা কর।' এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে,তিনিই মানব জাতির নেতা ও ইমাম নির্ধারণ করেন। ইসলাম ধর্মে নেতৃত্ব ও ইমামত কেবল মানুষের দৈনন্দিন ও প্রচলিত জীবন ব্যবস্থার জন্য নয়। ইসলাম ধর্মে একজন ইমাম বা নেতা, বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক-উভয় ক্ষেত্রের নেতা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি বলেছেন, ইসলাম ধর্মে একজন নেতা, জনগণ থেকে আলাদা নয়। গাদিরের ঘটনাকে তিনি জনগণের নেতৃত্ব ও নীতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হিসেবে গণ্য করেন। রাসূল (সা.)-র ওফাতের পর শান্ত মুসলিম সমাজ যাতে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়ে এবং স্বার্থান্বেষীরা ওই শোকাবহ ঘটনাকে যাতে অপব্যবহার করতে না পারে সেজন্য রাসূল (সা.)-কে এ দায়িত্ব দেয়া হয় যে, তিনি যাতে তাঁর পরবর্তী নেতার নাম ঘোষণা করেন। রাসূলে খোদা বিদায় হজ্বের পর এক সমাবেশে আলী(আ.)কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন। তিনি আলী (আ.)-এর যোগ্যতা বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন, “হে জনগণ, এমন কোনো জ্ঞান নেই, যা আল্লাহ আমাকে দেননি এবং আমিও পরহেজগারদের নেতা আলী (আ.)-কে সেই জ্ঞান শিখিয়েছি। আপনারা কেউই আলী (আ.)-র পথ থেকে বিচ্যুত হবেন না। তাঁর পথ থেকে দূরে সরে যাবেন না। তাঁর নেতৃত্বকে অমান্য করবেন না। কারণ সে সবাইকে সত্যের পথে পরিচালিত করে এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে কাজ করে। সে অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটায় এবং নিজে অন্যায় থেকে দূরে থাকে। আলী (আ.) আল্লাহর পথে চলার ক্ষেত্রে কোনো কিছুকেই ভয় করে না। আলী (আ.) হচ্ছে প্রথম মুসলমান। রাসূলে খোদার জন্য সে তাঁর প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত রয়েছে। সে সর্বদা রাসূলের পাশে ছিল ও আছে এবং আর কেউই তাঁর মতো রাসূলের নির্দেশ মেনে চলার ক্ষেত্রে এতো বেশি আন্তরিক নয়। হে মুসলমানগণ, আলী (আ.) হচ্ছে আমার ভাই, স্থলাভিষিক্ত ও আমার শিক্ষায় শিক্ষিত। সে আমার উম্মতের নেতা-কোরানের তাফসির যার জানা। সে কুরআনের দিকে আহ্বানকারী এবং কুরআনের নির্দেশ বাস্তবায়নকারী। সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে। সে আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। সে আল্লাহ বিরোধীদের শত্রু এবং আল্লাহপ্রেমীদের বন্ধু। সে আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে জনগণকে বিরত রাখে।” মানুষের ওপর তিনিই নেতৃত্ব দেয়ার সবচেয়ে বেশি যোগ্য যিনি সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী। আর বিশ্বনবী (সা.)’র পর তাঁর পবিত্র হাদিস অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ছিলেন আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)। কারণ, হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগর আর আলী হল তার দরজা। অর্থাত বিশ্বনবী (সা.)’র জ্ঞানের শহরে প্রবেশের জন্য আলী (আ.) নামক মাধ্যম বা দরজা দিয়েই ঢুকতে হবে। এ ছাড়াও হাদিসে বলা হয়েছে, “আল ওলামাউ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া।” অর্থাত নবীগণের উত্তরসূরি হচ্ছেন আলেমগণ। হযরত আলী (আ.) যে বিশ্বনবী (সা.)’র পর শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন তাতে তাঁর শত্রু -মিত্র নির্বিশেষে কোনো সাহাবিই সন্দেহ পোষণ করতেন না। এ কারণেই মহান আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বনবী (সা.) আলী (আ.)-কে তাঁর উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত তথা মুসলমানদের ইমাম বা নেতা বলে ঘোষণা করেছিলেন পবিত্র গাদীর দিবসে। এই ইমামত হচ্ছে নবুওতেরই ধারাবাহিকতা। ইসলামে ঐশী ইমামত বা খোদায়ী নেতৃত্ব ঠিক করে দেন মহান আল্লাহ। আর সেটা বংশ পরম্পরায়ও চলতে পারে। যেমন, নবী হয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ.)'র বংশধরগণ এবং হযরত দাউদ (আ.)'র পুত্র সুলায়মান ও হযরত মুসা (আ.)'র ভাই হারুন (আ.)। ইমামত বা নবুওতের মত ঐশী বা খোদায়ী পদগুলোতে কারা আসীন হবেন মানুষ তা ঠিক করার অধিকার রাখে না। কারণ, মানুষের মনোনয়ন বা নির্বাচন ভুলও হতে পারে। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই তা ঠিক করে দেন। বিশ্বনবী (সা.) বিভিন্ন সময় আলী(আ.) কে নিজ খলিফা হিসেবে নিযুক্ত করার কথা ঘোষণা করেছেন। এরমধ্যে তিনটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করছি: প্রথমত: রাসূল হিসেবে মনোনীত হওয়ার তথা বে’সাতের প্রথম দিকে: বিশ্বনবীকে (সা.) যখন নিজের আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দেয়ার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয় তখন তিনি সবার উদ্দেশে বললেন:“যে ব্যক্তি এই পথে আমাকে সাহায্য করবে, সেই হবে আমার ওয়াসি তথা কর্তৃত্বের অধিকারী, উজির বা পৃষ্ঠপোষক এবং স্থলাভিষিক্ত ।” রাসূল (স.) এভাবে বলেন- “তোমাদের মাঝে কে এমন আছে যে এই কাজে আমাকে সহযোগিতা করবে যাতে সে তোমাদের মাঝে আমার ভাই, উজির (পৃষ্ঠপোষক), খলিফা এবং স্থলাভিষিক্ত হতে পারে?” কেবল আবু তালিবের সন্তান আলী (আ.) রাসূল (স.) এর কথায় হ্যাঁ সূচক উত্তর দেন।আর তখন আল্লাহর রাসূল (স.) নিজ আত্মীয় স্বজনদের উদ্দেশে বলেন- “এই (আলী) তোমাদের মাঝে আমার ভাই, ওয়াসি এবং খলিফা। অতএব, তোমরা তার কথা শোন এবং তাকে অনুসরণ কর।” দ্বিতীয়ত: তাবুকের যুদ্ধে: রাসূলুল্লাহ (স.) আলী (আ.) এর উদ্দেশে বলেন- “[হে আলী!] তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি আমার কাছে ঠিক তদ্রূপ যেমন হারুন (আ.) ছিলেন মুসা (আ.) এর কাছে। তবে পার্থক্য এই যে, আমার পরে আর কোনা নবী নেই (আসবে না)।’ অর্থাৎ যেভাবে হারুন (আ.) কোনরকম ব্যবধান ছাড়াই মুসা (আ.) এর স্থলাভিষিক্ত ছিলেন তুমিও আমার খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত। তৃতীয়ত: দশম হিজরিতে: বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে হাজিদের এক বিশাল সমাবেশে মহানবী (স.) আলী (আ.) কে মুসলমান ও মু’মিনদের নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি বলেন- “আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা।” এই বাক্যটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। এরপর বললেন:- “হে আল্লাহ! তাকে তুমি ভালবাসত যে আলীকে ভালবাসে ও তুমি তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে; তুমি সহযোগিতা কর তাকে যে আলীকে সহযোগিতা করে, তুমি তাকে নিঃসঙ্গ কর যে আলীকে একা রাখে এবং সত্যকে আলীর সাথে রাখ তা যে দিকেই থাক না কেন”। হে লোকসকল! আপনারা অবশ্যই যারা উপস্থিত আছেন তারা এই বাণীটি অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দিবেন। রাসূলের (সা.) বক্তব্য শেষ হলে জিবরাঈল (আ.) আবার দ্বিতীয়বারের মত অবতীর্ণ হয়ে তাঁকে এই বাণীটি পৌঁছে দেন: আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও আমার নেয়ামত বা অবদানকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা-৩) রাসূল (সা.) এই বাণী পেয়ে মহা-আনন্দিত হলেন এবং বললেন- মহান আল্লাহর শুকর করছি যে তিনি দ্বীনকে পরিপূর্ণ ও তাঁর নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন এবং মহান প্রভু আমার রেসালাতের বা নবুওতি দায়িত্বের ও আলীর বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আল্লাহর রাসূল (স.) তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বলেছিলেন: “আমি কি তোমাদের ওপর তোমাদের নিজেদের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব রাখি না?” তখন উপস্থিত সব মুসলমান দাঁড়িয়ে রাসূল (স.) এর এ কথার প্রতি সম্মতি জানান। অতএব, বিষয়টি হতে স্পষ্ট হয় যে, এই হাদিসে 'মাওলা' বলতে মু’মিনদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাদের পূর্ণ কর্তৃত্বকে বোঝানো হয়েছে। অতএব, এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহর রাসূল (স.) যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন উম্মতের ক্ষেত্রে তা তিনি আলী(আ.) এর জন্যও নিশ্চিত করে যান।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202