সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান
আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছসর পূর্বে সংঘটিত পিতা পুত্রের আত্মত্যাগের এই অপূর্ব ঘটনা যুগ যুগ ধরে আল্লাহ্ তালার অবতীর্ণ দ্বীনে হক-ইছলামের হেফাজত ও মর্যাদা রক্ষায় ও মুসলিম জাতির ন্যায্য স্বর্থরক্ষার উৎসরূপে কাজ করে আসছে। আনুষ্ঠানিক কোরবানী বিগত সাড়ে হাজার বছর ধরে সমগ্ৰ মুছলিম বিশ্বে চালু রয়েছে। এটা হজরত ইবরাহিম (আঃ) ও কিশোর পুত্র হজরত ইছমাইল (আঃ)-এর ঐশী প্রেমের চরম নিদর্শন। ইহা পিতা পুত্র উভয়েরই খােদার রাহে উৎসর্গ হওয়ার চির অস্নান স্মরণিকা মাত্র।কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, বর্তমান যুগের অধিকাংশ মুছলমানই কোরবানীর শিক্ষা সম্বন্ধে অবগত নয়। আল্লাহ্ তালার আদেশে আত্মোৎসর্গের এমন মহান ঘটনা হতে যে তাদের জন্য অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে যে সম্বন্ধে মুছলমানই অজ্ঞতার তিমিরে ডুবে আছে।পিতা পুত্রের আত্মোৎসর্গের মহান ঘটনা থেকে আমরা কি শিক্ষা পাই? ইহা কি খোদা প্রেমের চরম ও পরম নিদর্শন নয়?
⭕️কোরআনের ভাষায় জবেহ আজিম মহান কোরবাণী- কী ❓
"যবেহ ’ অর্থাৎ ‘যাবিহুন বা মাযবুহুনে বোজর্গ ও আজীমবোজর্গঅর’ যার বাংলা শাব্দিক অর্থ ঃ মহান ও বৃহৎ যবাইকৃত। এধরণের গুণবাচক শব্দ কোরআনে একটি বার ব্যবহৃত হয়েছে।
🔰তাহলো সূরা আস সাফ্ফাত এর ১০৭ নং আয়াতে, এই আয়তে আল্লাহ তায়ালা বলেন ঃ ‘অফাদাইনাহু বিযিবহিন আজীম’ অর্থাৎ আমি তার পরিবর্তে মহান যবেহ কবুল করলাম।’(ছুরে ছাফফাত-এর ১০২ আয়াত থেকে ১০৯ আয়াত পর্যন্ত দেখার অনুরোধ করছি) ।
অধিকাংশ শিয়া ও সুন্নি তাফসীরকারী এখানে বলেন যে ‘যেবহে আজিম’ এর উদ্দেশ্য ভেড়া নামক পশু যবেহকে বুঝানো হয়নি।আল্লামা তাবাতাবায়ীর মতে যেহেতু এই যবেহ আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মোতাবেক ‘আজীম’ বলে নামকরণ করা হয়েছে; সেহেতু সয়ং যবেহ নিজস'লে কখনো আজিম হতে পারে না। এর উদ্দেশ্য ভিন্ন।হজরত ইবরাহিম (আঃ) যখন পুত্র হজরত ইছমাইল (আঃ)-কে কোরবানী করতে নিয়েছিলেন। যখন হজরত ইবরাহিম (আঃ) হজরত ইছমাইল (আঃ) কে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় কোরবানী করতে তৈরী হলেন তখন তার হাত থেমে গেল, পুত্র গর্দান ঝুকিয়ে দিলেন এবং সানন্দে ভাবতে লাগলেন। কখন কোরবানী হবেন। হজরত ইবরাহিম (আঃ)-এর হাতের শক্তি লোপ পেয়ে গেল। ভাবতে লাগলেন, কোরবানী করতে পারছি না কেন? আমার সবচেয়ে বেশী মহব্বতের বস্তুই ত কোরবান করা আল্লাহর আদেশ। এ দুনিয়ায় পুত্র ইছমাইলের চেয়ে বেশী মহব্বতের তা আমার আর কিছু নেই। আমার হাত কেন উঠছে না? ছুরিকে কি কেউ ধরে রাখল? না আমার মধ্যে কি মহাবৃত এসে গেল? নিশ্চয়ই মহাব্ৰত আসে নাই। তা আসলে অবশ্যই আমার হৃদয় কাঁপত, চক্ষুতে জল আসত। তার কোনটাই আমার মধ্যে আসে নাই। আচ্ছা আবার চেষ্টা করব, আবার ছুরি চালাব এবং দেখব কে আমার হাতের শক্তি কেড়ে নেয়। হজরত ইবাহিমের যে হাতে ছুরি ছিল, হঠাৎ সে হাতে টের পেলেন যে, তা পাথরের মত ভারী হয়ে গেছে। হাতের শক্তি কে যেন কেড়ে নিয়েছে। ছুরি বলল, হে ইবরাহিম (আঃ) আমার কোন দোষ নাই, আমি কি করব। এ তোমার আল্লাহর হুকুম। হজরত ইবরাহিম রাগ করে ছুরি ফেলে দিলেন। ছুরি বলতে লাগল, ইয়া খলিলুল্লাহ আমার উপর কেন রাগ করছেন? আপনার আরজু, যে ইছমাইলকে কোরবানী করবেন এবং এটা আল্লাহর হুকুম। কিন্তু এও আল্লাহর হুকুম যে আমি আপনার হুকুম এনকার করা(হুকুম রদ করা)। আমি বলি আল্লাহ্ পাকের যা হুকুম তাই হয়েছে, এতে আমার .কি দোষ। হজরত ইবরাহিম হয়রান পেরেশান হয়ে গেলেন। হঠাৎ টের পেলেন পানির মত কি যেন উনার কদম মোবারকে লাগছে। চক্ষু খুলে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। সত্যই কি দেখছেন, না স্বপু? হজরত ইছমাইল দাঁড়িয়ে আছেন, এদিকে একটি দুম্বা কোরবানী হয়ে গেছে। বেহুস বেকারার হয়ে হজরত ইবরাহিম কাঁদতে লাগলেন ও ফরিয়াদ করতে লাগলেন, আয় পাক পরওয়ারদেগার, কেন আমার কোরবানী কবুল করলেন না? কাঁদতে কাঁদতে বেহুস হেয়ে পড়লেন। তখনই আল্লাহপাকের আদেশ আসল,হে ইব্রাহিম তুমি কেদনা,তোমার ছেলেকে কোরবানী করতে পার নাই, কিন্তু আমি তোমাকে এর চেয়ে বড় ও মহান এক কোরবানী দান করলাম। হজরত ইবরাহিমের বেকারারী দূর হয়ে হুস আসল ও শুনতে পেলেন,
🔰আয় খলিল তুমি বল যে, মোহাম্মদ (দঃ) কি সবচেয়ে বেশী আজিজ নয়❓
হজরত ইবরাহিম চতুর্দিকে দেখতে লাগলেন, হঠাৎ আছমানের দিকে চাইলেন ও দেখতে পেলেন “জবোঁহ আজীম৷”। (মিনাতে হজরত ইব্রাহিম (আঃ) কুরাবানী করতে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তার কুরাবনীর পরিবর্তে মিশাল কুরবানী "যবেহ আজীম" হচ্ছে কারবালায় ইমাম হোসাইন (আঃ) এর কুরবানী তারই বংশে দান করলেন) ।হজরত ইবরাহিম আবার কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে গেলেন ছবতে রছুল, নোয়াছায়ে রছুল জামে শাহাদত পান করলেন। রোজ কিয়ামতে আল্লাহ পাক তার বদলা দেবেন।
🔰অতঃপর মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ওহীর মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করলেন হে ইব্রাহীম, তোমার নিকট আমার সৃষ্টির সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কি?
তিনি বললেন :- হে আমার পরোয়ারদেগার তোমার সৃষ্টির মধ্যে তোমার দোস্ত- মুহাম্মাদ হলো আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়।
🔰আল্লাহ তায়ালা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন :- হে ইব্রাহীম, সে সবচেয়ে প্রিয় নাকি তুমি নিজে?
তিনি বললেন ঃ তিনিই সবচেয়ে প্রিয়।
🔰আল্লাহ তায়ালা আবার জিজ্ঞাসা করলেন ঃ তার সন্তান তোমার জন্য সবচেয়ে প্রিয় নাকি তোমার সন্তান?
তিনি উত্তর বললেন ঃ তাঁর সন্তান।
🔰আবার জিজ্ঞাসা করলেন ঃ তাঁর সন্তান দুশমনের হাতে অন্যায় ও নির্যাতনের মাধ্যমে কুরবানী হলে তুমি বেশী ব্যথিত হবে নাকি তোমার সন্তান তোমার হাতে আমার আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে নিহত হলে বেশি ব্যথিত হবে?
তিনি উত্তরে বললেন :- দুশমনের হাতে তাঁর কুরবানী হওয়াটা আমাকে বেশী ব্যথিত করবে।
🔰আল্লাহ তায়ালা বললেন ঃ হে ইব্রাহীম, উম্মতে মুহাম্মাদের কিছু লোক মুহাম্মাদের সন্তান হোসাইনকে তাঁর ইনে-কালের পর জুলুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করবে যেমনিভাবে ভেড়া হত্যা করা হয়, এর জন্য তারা আমার ক্রোধের শিকার হবে।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) একথাগুলো শুনে তাঁর অন-র অশান- হয়ে গেলে, মনঃকষ্টে তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
🔰আল্লাহ তায়ালা আবারো তাঁর কাছে অহীর মাধ্যমে বললেন হে ইব্রাহীম, তোমার সন্তানকে নিজ হাতে যবেহ করতে না পারার সেই শোকটা হোসেইনের হত্যার শোকের সাথে পবির্তন করে দেব এবং মুসিবাতের ক্ষেত্রে সবরের দরুন সর্বোচ্চ সওয়াব তোমাকে প্রদান করবো। আর একারণেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘অফাদানাহু বিযিবহে আজীম’ অথাৎ আমি তার পরিবর্তে মহান যবেহ কবুল করলাম।
আল্লাহ্ পাকের দরবারে যে সর্বোচ্চ সম্মান #শাহাদতে_জাহেরী ও #শাহাদতে_ছিররী রক্ষিত আছে তা আল্লাহ্ পাক হজরত ইছমাইল (আঃ)-কে দেন নাই। তা শুধু হাসনাইন আ. জন্য রক্ষিত আছে। হজরত হাছানকে দান করবেন শাহাদতে ছিররী ও হজরত হােছাইনকে দান করবেন শাহাদতে জাহেরী। বিনা দোষে গুপ্তভাবে যে কোন উপায়ে নিহত হওয়াকে শাহাদতে ছিররী ও ধর্ম রক্ষার জন্য সম্মুখ যুদ্ধে জেনে শুনে আত্ম বিসর্জন করাকে বলা হয় শাহাদতে জাহেরী।
ইমাম বংশ হলেন করুনার কাওছার। গলায় ছুরি হাসি মুখে বরণ করে নিয়েছেন তবু আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন নি। ফরিয়াদ করলে বিরোধী দল সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যেত। আঘাতের বিনিময়ে প্রেম বিতরণ করাই ইমাম বংশের আদর্শ। নবী করিম (দঃ) ও ইমাম বংশ কাউকে ধ্বংস করতে এ দুনিয়াতে আসেননি। তারা এসেছেন গড়তে। হাসি মুখে প্রাণ বলি দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করে প্রেমের মূল্যবােধকে দাঁড় করাতে। একবার ভেবে দেখুন ত?
অবশ্য বেআদবী না করে নিরপেক্ষ মন নিয়ে হজরত ইবরাহিম (আঃ) তার আপনি পুত্রকে কোরবানী করতে যেয়ে হাত থর থর করে কাঁপছে। মমতার কাছে উৎসর্গ হার মানতে চাইছে। তাই কাপড়ে চােখ দুটাে বেঁধে নিতে হল, অথচ আড়াই দিনের উপবাসী তৃষ্ণিত অবস্থায় থেকে পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে আল্লাহ্র রাহে হজরত ইমাম হােছাইন নামক হজরত মোহাম্মদ (দঃ) কারবালার মাঠে একটি একটি করে সন্তানদের কোরবানী দিয়ে চলেছেন। পা হতে মাথা পর্যন্ত হুবহু হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর সঙ্গে মিল হজরত আলী আকবর যার কণ্ঠস্বর শুনতে নবী করীম (দঃ)-এর কণ্ঠস্বর বলে ভুলু হয়। সেই সদ্য যৌবন প্রাপ্ত হজরত আলী আকবর শাহাদত বরণ করলেন। শহীদ হলেন দুধের শিশু আলী আছগর। তবুও আল্লাহ পাকের কাছে করেন নি কোন ফরিয়াদ, কোন কাতর যাচঞা। ভেবে দেখুনত, একটু চােখ বন্ধ করে, চিন্তা করুন ত সেই কারবালার দৃশ্য। সেই পানির পিপাসায় ছান্তিফাটা আলী আছগরের শহীদ হবার দৃশ্য। তুলনা করতে গেলে কি হজরত ইবরাহিমের (আঃ) কোরবানী প্ৰদীপ হতে সূর্য খোঁজার মত তুলনা হয় না? দেহের মৃত্যু প্রেমের জীবন। যে হাত প্রেমের স্পর্শে প্রেম প্ৰজ্বলিত হয়ে বিকিরণ করে প্ৰেম, সেই হাতে পার্থিব সম্মানের মৃত্যু হিমা শীতল হয়ে বিকিরণ করে মহা ক্ষমা।
—-—— সৈয়দ হোসাইন উল হক
মন্তব্যসমূহ