সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান
আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদীও ওয়া আলে মোহাম্মদ
সালাম হো সালাম আয় যায়নাব বিনতে আলী আঃ
পর্ব ১
ইসলামের ইতিহাসে যেসব মহীয়সী নারী জ্ঞান, মনীষা, প্রজ্ঞা ও সাহসী ভূমিকার জন্য চিরভাস্বর হয়ে রয়েছেন তাঁদের মধ্যে হযরত যায়নাব (আ.) অন্যতম। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী হযরত যায়নাব শুধু যে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পরে তাঁর পরিবারের নারী ও শিশুদের এবং অসুস্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর অভিভাবিকার দায়িত্ব পালন করেন তা নয়, বরং কুফা ও দামেশ্কে অসাধারণ সাহসিকতার সাথে ইমাম হোসাইন ও তাঁর পরিবার-পরিজনের প্রতি ইয়াযীদের জুলুম-অত্যাচারের কথা সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। এর ফলে ইয়াযীদ ও তার তাঁবেদারদের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের জাল ছিন্ন হয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের কাছে সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে।
ইয়াযীদ ও তার সুবিধাভোগীরা এ মর্মে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছিল যে, ইয়াযীদ মুসলিম উম্মাহ্ বৈধ খলিফা এবং ইমাম হোসাইন ছিলেন একজন ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি যিনি ক্ষমতার লোভে ‘খলিফাতুল মুসলিমীন’ ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। কিন্তু হযরত যায়নাব এ মিথ্যাচারের স্বরূপ প্রকাশ করে দেন এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মিশন ও তাঁকে যে অন্যায়ভাবে শহীদ করা হয় তা তুলে ধরেন। ফলে কারবালার ঘটনার স্বরূপ মিথ্যাচারের জঞ্জালের নিচে চাপা পড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। হযরত যায়নাব (আ.)-এর ভূমিকার ফলে মুসলিম উম্মাহ্ অচেতনতার নিদ্রা থেকে জেগে ওঠে। এর ফলে অচিরেই বিভিন্ন স্থানে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, উমাইয়্যা নরঘাতকদের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইনকে হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হয় এবং উমাইয়্যা শাসনের ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
হযরত যায়নাব (আ.) নারীকুল শিরোমণি হযরত ফাতেমা যাহ্রা (আ.) ও জ্ঞান নগরীর দরজা হযরত আলী (আ.)-এর সন্তান। তাঁর জন্মের তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তবে অধিকতর সঠিক বলে পরিগণিত মত অনুযায়ী তাঁর জন্ম হিজরী পঞ্চম সালের পাঁচ জমাদিউল উলা। তিনি ৬২ হিজরীর ১৫ রজব ৫৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাযার দামেশ্কে অবস্থিত; তাঁর নামানুসারে ঐ জায়গা ‘যায়নাবিয়া’ নামে সুপরিচিত।
স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (আ.) তাঁর নাম রাখেন যায়নাব। তাঁর ডাকনাম ছিল উম্মে কুলসুম। উল্লেখ্য যে, তাঁর কনিষ্ঠতম বোনের নামও যায়নাব ও ডাকনাম উম্মে কুলসুম ছিল। হযরত যায়নাব (আ.) ‘যায়নাবে কোব্রা’ (বড় যায়নাব) ও তাঁর ছোট বোন ‘যায়নাবে ছোগ্রা’ (ছোট যায়নাব) নামে পরিচিত ছিলেন। যায়নাবে ছোগ্রা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর সন্তান ছিলেন না; হযরত ফাতেমার ইন্তেকালের পর হযরত আলী ‘ছাহ্বায়ে ছা’লাবিয়া’ নামে একজন মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন; তাঁরই সন্তান যায়নাবে ছোগ্রা। অনেকে এই দুই যায়নাবকে এক করে ফেলেন।
হযরত যায়নাবে কোব্রা ছিলেন মানব জাতির ইতিহাসে সর্বাধিক মহিমান্বিত পরিবারের সন্তান। বেহেশতে নারীদের নেত্রী হযরত ফাতেমা যাহ্রা ছিলেন তাঁর মাতা, শেরে খোদা হযরত আলী ছিলেন তাঁর পিতা, বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন ছিলেন তাঁর ভ্রাতা এবং সর্বোপরি সৃষ্টিলোকের সৃষ্টির কারণ রাহ্মাতুল্লিল ‘আলামীন রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন তাঁর নানা। এমন অনন্যসাধারণ প্রিয়জনদের নয়নমনি ছিলেন হযরত যায়নাবে কোব্রা। তিনি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যেখানে হযরত জিবরাঈল (আ.) অবতরণ করতেন। খোদায়ী ওহীর ধারক-বাহক ও ব্যাখ্যাকারকদের সাহচর্যে তিনি বড় হন।
হযরত যায়নাব ছিলেন অনন্যসাধারণ মেধা ও স্মরণশক্তির অধিকারী। এর অন্যতম প্রমাণ এই যে, হযরত ফাতেমা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ইন্তেকালের কিছুদিন পরে মসজিদে নববীতে যে ভাষণ দেন হযরত যায়নাব তা হুবহু মনে রাখেন ও পরবর্তীকালে বর্ণনা করেন, অথচ ঐ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস তাঁর নিকট থেকে শুনে হযরত ফাতেমা (আ.)-এর ভাষণ বর্ণনা করেন।
পরবর্তীকালে অর্থাৎ কৈশোরকাল থেকেই তিনি মনীষার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে তিনি বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত হন। লোকমুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব উপাধি প্রচলিত হয়ে পড়ে। এসব উপাধির মধ্যে সর্বাধিক বিশিষ্ট উপাধি হচ্ছে ‘আকীলাতু বানী হাশেম’ (হাশেম বংশের বুদ্ধিমতী মহিলা)। তাঁর অন্যান্য উপাধির মধ্যে রয়েছে : মুআছ্ছাক্বাহ্ (নির্ভরযোগ্য; নির্ভরযোগ্যা হাদীস-বর্ণনাকারিণী), ‘আলেমাতু গায়রা মু‘আল্লামাহ্’ (কারো কাছে শিক্ষাগ্রহণ ব্যতিরেকেই যিনি ‘আলেমাহ্), ‘আরেফাহ্, ফাযেলাহ্, কামেলাহ্ ও ‘আবেদাতু আলে ‘আলী (আলী-বংশের ‘আবেদাহ্)।
প্রচারে মোঃ শামসীর হায়দার
মন্তব্যসমূহ