সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান
শহীদ সম্রাট মাওলা হুসাইন ইবনে আলী আঃ
পর্ব ৫
গত কয়েক পর্বে আমরা ইমাম হোসাইনের শাহাদতের প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে গিয়ে উমাইয়া শাসনামলের বিশ্লেষণ করেছি। আসলে খোদাবিমুখ উমাইয়া নেতারা ইসলামী চিন্তাধারার সাথে তাদের বিষাক্ত চিন্তাধারার উপকরণগুলোকে মিশিয়ে দিয়েছিল। ইসলামের খাঁটি রূপ দেখতে হলে এসব ভেজাল উপকরণের অপসারণ জরুরি।
মোয়াবিয়া মৃত্যুর আগে ইতোমধ্যে সংযোজিত কিছু বিদআত বা কুপ্রথার সাথে আরও কয়েকটি কুপ্রথা চালু করে যায়। যেমন : এক. হযরত আলীকে (আ.) অহরহ অভিসম্পাত করা। দুই. টাকার বিনিময়ে আলীর (আ.) বিরুদ্ধে হাদীস জাল করা। তিন. প্রথমবারের মতো ইসলামী সমাজে বিনাদোষে হত্যাযজ্ঞের অবাধ নীতি চালু করা। এছাড়া সম্মানীয়দের সম্মান খর্ব করা এবং হাত-পা কেটে বিকল করে দেয়া। চার. বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা। যে প্রথা পরবর্তী খলীফারাও অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করে। এসব অমানবিক প্রথা মোয়াবিয়াই চালু করে যায়। সে ইমাম হাসান (আ.),মালেক আশতার,সা’দ ইবনে ওয়াক্কাছ প্রমুখকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। পাঁচ. খিলাফতকে নিজের খান্দানে আবদ্ধ রেখে রাজতন্ত্র চালু করা এবং ইয়াযিদের মতো অযোগ্য ব্যক্তিকেও খলীফা পদে মনোনীত করা। ছয়. গোত্র বৈষম্যের স্তিমিতপ্রায় আগুনকে পুনরায় প্রজ্জ্বলন করা। মোয়াবিয়ার কার্যকলাপের মধ্যে হযরত আলীকে (আ.) অভিসম্পাত করা,হাদীস জাল করা এবং ইয়াযিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।
ইয়াযিদ ছিল মূর্খ ও নির্বোধ। সাধারণতঃ খলীফার পুত্রদের মধ্যে যাকে ভাবী খলীফা হিসাবে মনোনীত করা হতো তাকে বিশেষ শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হত । কিন্তু ইয়াযিদ বড় হয় মরুভূমিতে রাজকীয় বিলাসিতায়। দুনিয়াবি ও পরকালীন কোনো বিষয়েরই সে খবর রাখত না বলে খলীফা হবার বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও তার ছিল না। ওসমানের সরলতার সুযোগে বায়তুলমাল লুন্ঠিত হয়েছিল,বড় বড় পদগুলো অযোগ্যদের হাতে চলে গিয়েছিল। মোয়াবিয়া হযরত আলীর (আ.) বিরুদ্ধে অভিশাপ দেয়া,হাদীস জাল করা, বিনা দোষে হত্যা,বিষ প্রয়োগ ও খেলাফতকে রাজতন্ত্রে রুপান্তরিত করার মত নানা কুপ্রথা চালু করেছিল। কিন্তু ইয়াযিদের যুগে এসে ইসলামের ইজ্জত চরম রসাতলে যায়। দেশ-বিদেশের দূতরা এসে অবাক হয়ে দেখতো যে,রাসূলুল্লাহর (সা.) আসনে এমন একজন বসে আছে যার হাতে মদের বোতল,আর পাশে বসিয়ে রেখেছে রেশমী কাপড় পরা বানর। ইয়াযিদ ছিল অহংকারী, প্রকাশ্য ব্যাভিচারী,ক্ষমতালোভী এবং মদ্যপ। এ কারণেই ইমাম হোসাইন (আ.) বলেছিলেনঃ ‘যদি ইয়াযিদের মতো দুর্ভাগা উম্মতের শাসক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের ইতি টানতে হবে।
ইয়াযিদ প্রকাশ্যে খোদাদ্রোহিতায় নামে। অন্য কথায়,এতোদিনের গোপনতার পর্দা ছিন্ন করে ইয়াযিদ উমাইয়াদের আসল চেহারাটা প্রকাশ করে দেয়। ফলে ইসলামী জিহাদের এটাই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তাই ,যদি কেউ প্রশ্ন করে যে,ইমাম হোসাইন (আ.) কেন বিদ্রোহ করতে গেলেন?- তাহলে একই সাথে তার এ প্রশ্নও করা উচিত যে, মহানবী কেন আপোষহীন বিদ্রোহ করেছিলেন ? কিংবা,হযরত ইবরাহীম (আ.) কেন একা হয়েও নমরুদের বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন? আর কেনই বা হযরত মূসা (আ.) একমাত্র সহযোগী ভ্রাতা হারুনকে নিয়ে ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন?
এসবের জবাব খুবই স্পষ্ট। নাস্তিকতা এবং খোদাদ্রোহিতাকে সমূলে উৎপাটন করাই ছিল এসব কালজয়ী মহাপুরুষদের মূল উদ্দেশ্য। আর নাস্তিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে বস্তুগত সাজ-সরঞ্জাম না হলেও চলে। কারণ,স্বয়ং আল্লাহই তাদের সহায়। তাই ইমাম হোসাইন (আ.)ও উমাইয়া খোদাদ্রোহিতা এবং ইয়াযিদী বিচ্যুতিকে ধুলিসাৎ করতে চরম সংকটে থেকেও বিদ্রোহে নামেন।
আসলে ইমামের এ পদক্ষেপ ছিল অতীতের নবী-রাসূলদেরই (আ.) অনুকরণ। বুদ্ধিজীবীদের মতে, বিদ্রোহ তখনই মানায় যখন বিদ্রোহীদের অন্ততপক্ষে সমান সাজ-সরঞ্জাম এবং শক্তি থাকে। কিন্তু,ঐশী-পুরুষদের বেলায় আমরা এই যুক্তির কোনো প্রতিফলন দেখি না। বরং তারা সবাই একবারে খালি হাতে তৎকালীন সর্ববৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ইমাম হোসাইন (আ.)ও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নন। তাছাড়া ইমাম হোসাইন (আ.) যদি সেদিন ইয়াযিদ বাহিনীর সমান এক বাহিনী নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতেন তাহলে তার এ অসামান্য বিপ্লব ঐশী দ্যুতি হারিয়ে অতি নিস্প্রভ হয়ে পড়তো। এই দর্শন রয়েছে প্রতিটি ঐশী বিপ্লবেই।
মানব সমাজে সংঘটিত অজস্র বিপ্লবের মধ্যে ঐশী বিপ্লবকে পৃথক মনে করার দুটি মাপকাঠি রয়েছেঃ প্রথমত ঐ বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য। খোদায়ী বিপ্লবগুলো মনুষ্যত্বকে উন্নত ও উত্তম করতে, মানবতাকে মুক্তি দিতে, একত্ববাদ ও ন্যায়পরায়ণতাকে রক্ষা করতে এবং জুলুম ও স্বৈরাচারের মূলোৎপাটন করে মজলুমের অধিকার ফিরিয়ে দিতেই পরিচালিত হয়। জমি-জায়গা বা পদের লোভে কিংবা গোষ্ঠীগত বা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে নয়। দ্বিতীয়ত. ঐশী বা খোদায়ি বিপ্লবের উদ্ভব হয় স্ফুলিঙ্গের মতো। চারদিকে যখন মজলুম-নিপীড়ন এবং অত্যাচার ও স্বৈরাচারের ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকারের বুক চিরে বারুদের মতো জ্বলে ওঠে এসব বিপ্লব। চরম দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়ে মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মানুষের ভাগ্যাকাশে আশার দীপ জ্বালিয়ে দেয় এসমস্ত ঐশী বিপ্লব। এই চরম দুর্দিনে মানবতাকে মুক্তি দেয়ার মতো দূরদর্শিতা একমাত্র ঐশীপুরুষদেরই থাকে। কিন্তু,সাধারণ মানুষ একেবারে হাল ছেড়ে দেয়-এমনকি কেউ প্রতিকারে উদ্যোগী হলেও তারা তাকে সমর্থন করতে চায় না। এ ঘটনা ইমাম হোসাইনের (আ.) বিপ্লবেও দেখা গেছে।
ইমাম হুসাইন (আ) যখন ইয়াযিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিলেন তখন সমসাময়িক তথাকিথত বুদ্ধিজীবীরা এটাকে অবাস্তব ব্যাপার বলে মনে করল। এ কারণে তাদের অনেকেই ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে একাত্মতা প্রকাশে বিরত থাকে।
কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ভালভাবে জানতেন যে,এ মুহূর্তে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া অনিবার্য। তাই অন্য কারও সহযোগিতা থাকবে কি-না সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নবী-রাসূলদের পথ ধরে আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠলেন। হযরত আলী (আ.) বনী উমাইয়াদের ধূর্তামী সম্পর্কে বলেন :
‘‘তাদের এ ধোকাবাজি নিরেট ও অন্ধকারময় প্রতারণা।’’ তাই ইমাম হোসাইন (আ.) এই অন্ধকার থেকে উম্মতকে মুক্ত করার জন্যে ইতিহাসে বিরল এক অনন্য ও অবিস্মরণীয় মহাবিপ্লবের পথ বেছে নেন।
মন্তব্যসমূহ