শহীদ সম্রাট মাওলা হুসাইন ইবনে আলী আঃ পর্ব ২ গত পর্বে কারবালা বিপ্লবের মহানায়ক হযরত ইমাম হুসাইন (আ)'র পরিচয় ও মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আসলে কারবালা বিপ্লবের অশেষ গুরুত্ব ও মহিমা এবং এ বিপ্লবের প্রবাদপুরুষ ইমাম হুসাইনের (আ) অনন্য মহামর্যাদা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা অসম্ভব। কারবালায় ইমামের সহযোগী ও সঙ্গীরাও বিশ্ব-ইতিহাসে ঐশী নেতাদের সহযোগী হিসেবে অনন্য ও শ্রেষ্ঠত্বের মহিমায় সমুজ্জ্বল। আমরা এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেব। গত পর্বে আমরা আরও বলেছিলাম কারবালার মহাবিপ্লবকে বুঝতে হলে এর মহানায়ক ও তাঁর সহযোগীদের পরিচয় আর মর্যাদা জানা যেমন জরুরি তেমনি কারবালায় বাতিল ও মিথ্যার পক্ষের পতাকাধারীদের তথা বনি-উমাইয়াদের নানা কুকীর্তি এবং বিশেষ করে তাদের চরম অনৈতিক, অমানবীক, পাশবিক ও খোদাদ্রোহী চরিত্র সম্পর্কেও সম্যক ধারণা থাকা জরুরি। আসলে আরবের কোন গোত্রই বনি উমাইয়্যার মত স্বার্থপর ও অহঙ্কারী ছিল না। এ গোত্র বেড়েই উঠেছিল উগ্র স্বভাব, স্বার্থান্বেষী মনোবৃত্তি, বিলাসিতা ও আনন্দ-ফূর্তির কুশিক্ষা নিয়ে। জাহেলী যুগে ও ইসলামী যুগেও এরা ছিল অর্থসম্পদ,শাসন-ক্ষমতা ও পদমর্যাদার কাঙ্গাল। ইসলামের আগমনের পর দীর্ঘ একুশ বছর ধরে এ গোত্রই ছিল ইসলামের প্রধান ও প্রকাশ্য শত্রু এবং ইসলামকে ধ্বংসের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। মক্কা বিজয়ের পর এ গোত্র পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করলে রাসূল (সা.) তাদের ‘তোলাকা’ বা মুক্ত যুদ্ধবন্দী বলে ঘোষণা করেন। ইসলামের আবির্ভাবের পরও তারা দুনিয়াবী ফায়দা নেই এমন কোন কাজ আত্মনিয়োগ করতে রাজি হত না। ইসলাম তাদের কাছে একটাই অর্থ বহন করত। আর তা হল বনি উমাইয়্যার ওপর মহানবীর (সা) গোত্র তথা বনি হাশিমের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিস্তার এবং রাসূলের নবুওয়াতকেও তারা এ দৃষ্টিতেই দেখত। তাই আবু সুফিয়ান হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর বিজয় ও মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তার দেখে হযরত আব্বাস (রা.)-কে বলেছিল : ‘তোমার ভাতিজার রাজত্ব তো বিশাল রূপ ধারণ করেছে!’ তাই প্রথম থেকেই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল এ কর্তৃত্বকে ছিনিয়ে এনে নিজেদের হস্তগত করা। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বনি উমাইয়্যার নেতৃস্থানীয় কোন ব্যক্তিকে কোন প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ করতেন না। কিন্তু রাসূলের ওফাতের পর দামেশ্‌ক বিজিত হলে বনি উমাইয়্যা প্রশাসনিক পদ লাভ করে। দ্বিতীয় খলিফার সময় দীর্ঘ প্রায় দশ বছর মু‘আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান দামেশ্‌কের গভর্নর থাকায় বনি উমাইয়্যা তার মদদ পেত। তৃতীয় খলিফা ওসমানের বার বছরের শাসনকালে মুআবিয়া আরও স্বাধীনতা পায়। মুহাজির ও আনসারদের ঐকমত্যে খেলাফত যখন হযরত আলী (আ.)-এর হাতে আসে, তখন বনি উমাইয়্যা দীর্ঘদিনের প্রতিহিংসার আগুন প্রজ্বলন করে এবং তৃতীয় খলিফার রক্তের দোহাই দিয়ে ফেতনা ছড়াতে থাকে। এ জন্য তারা প্রথমে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পটভূমি রচনা করে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পবিত্র কুরআনকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে ও কুটচালের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতাকে সরল মুসলমানদের সামনে বৈধ বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় এবং সফলও হয়। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসাবে আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে নিয়োজিত গভর্নর ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী-সাথীদের হত্যার প্রক্রিয়া শুরু করে। যেমন আলী (আ)'র নিযুক্ত মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকরকে একটি মৃত গাধার চামড়ার মধ্যে ঢুকিয়ে ও পুড়িয়ে এবং অপর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মালিক আশতারকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। উমাইয়্যা আমলে সাধারণ জনজীবন, বিশেষ করে শাম তথা বৃহত্তর সিরিয়া ও মিশরের জনসাধারণের নৈতিকতার এত বেশি স্খলন হয় যে, বিখ্যাত ঐতিহাসিক মাসউদীর ভাষায়: ‘তারা কোন অসঙ্গত কাজ থেকেই বিরত থাকত না, দীনদারকে কাফের বানাতে তাদের কোনোই দ্বিধা ছিল না। নবী-বংশ বিরোধী প্রচারণায় সিরিয়রা এতো বেশি ধোঁকা খেয়েছিল যে হযরত আলী (আ) যখন কুফার গ্রান্ড মসজিদে ঘাতকের হামলার শিকার হন তখন সিরিয়ার জনগণ বিস্মিত হয়েছিল। তাদের অনেকেই তখন বলেছিল: আলী কি নামাজ পড়তো নাকি? সে মসজিদে কিভাবে হামলার শিকার হলো!? ইমাম হুসাইন (আ.) তৎকালীন জনগণের নৈতিক অধঃপতনের প্রতি ইশারা করেছেন এভাবে : ‘আল্লাহ্‌র কসম! হে জনগণ! যা কিছু উত্তম ও সঙ্গত তা তোমাদের মাঝে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়েছে, আর তোমাদের জীবনের শিকড় গেড়েছে সেই লাঞ্ছনার ভূমিতলে।’ অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়েছিল যে, যখন উমাইয়্যা শাসনের পতন ঘটে ও আব্বাসীয় খলিফা আবুল আব্বাস সাফফাহ্ শামের ক্ষমতা দখল করে, তখন আবদুল্লাহ্ ইবনে আলী, শাম বাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের ধরে সাফফাহ্‌র কাছে নিয়ে যায়। সে সময়ে তারা সবাই কসম করে বলতে থাকে যে, তারা বনি উমাইয়্যা ছাড়া কাউকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)- এর পরিবারের সদস্য তথা তাঁর আহলে বাইত হিসেবে চিনত না! এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, বনি উমাইয়্যা কীভাবে জনসাধারণের অজ্ঞতা ও মূর্খতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছিল। উমাইয়্যা যুগের দরবারি আলেম ও খতীবরা জনগণকে ইসলামের সঠিক হুকুম-আহকাম ও দীনের দর্শন শিক্ষা না দিয়ে আলী (আ.) এর বিরুদ্ধে অভিশাপ ও গালি দেয়ার বুলি শেখাতেন, ফলে মানুষ এভাবে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে বাদ দিয়ে বনি উমাইয়্যাকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আহলে বাইত বলে ভাবত, ও আলীর অনুসারীদের বলত ‘কাফের’ বা‘জিন্দীক’। এ অবস্থা এত দীর্ঘকাল বজায় ছিল যে আবদুল মালেক ইবনে মারোয়ানের শাসনামলে দশ বারো বছরের এক শিশু রাজদরবারে এসে কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাবার বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে বলে যে, আমার বাবা এত বড় জালিম যে তিনি আমার নাম রেখেছেন আলী! কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর নবী-পরিবারের সদস্যদের বন্দী হয়ে শামে নীত হবার পর যখন এক বৃদ্ধ অবগত হয় যে, বন্দী হয়ে আসা লোকগুলো রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সন্তান, তখন ওই বৃদ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। কারণ, তার ধারণাও ছিল না যে, মহানবী (সা.)-এর কোন সন্তান বেঁচে রয়েছেন। হয়ত এ কারণেই ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ইয়াযীদের দরবারে ভাষণ দানকালে সর্বপ্রথমে নিজের বংশ-পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। অন্যদিকে ইয়াজিদের মা ‘মেইসুন’ ছিল কালব গোত্রের খ্রিস্টান। এ গোত্র অশ্লীলতা ও নোংরামিতে অভ্যস্ত ছিল। ইয়াযীদের কুকুর নিয়ে খেলা, জুয়া, মদ্যপান, সহিংসতা, স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা, বেপরোয়া ভাব, হত্যা,রক্তপাত, নারী-আসক্তি ইত্যাদি মানব চরিত্রের জন্য কলঙ্কজনক আরও অনেক কু-অভ্যাসের কথা সেদিন কারও অজানা ছিল না। ইয়াজিদ কবিতা আওড়িয়ে বলত: অর্থ: হায়! যদি আমার পিতৃপুরুষরা বদরের ভূমি থেকে উঠে আসত এবং কুফার ঘটনা দেখত! বনি হাশিম তথা মুহাম্মাদ ও তাঁর বংশধররা তো রাজত্ব নিয়েই খেলেছে; আসলে না কোন নবী এসেছে, আর না কোন ওহী নাযিল হয়েছে! মু‘আবিয়া ৫৯ হিজরিতে তাঁর ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে শামের জনগণের কাছ থেকে ফাসেক ও মহাপাপী ইয়াযীদের জন্য খেলাফতের বাইয়াত আদায় করে। অথচ ইমাম হাসানের (আ) সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কাউকে খলিফা করার বা ঘোষণা দেয়ার অধিকার মুয়াবিয়ার ছিল না। ওই চুক্তি অনুযায়ী খেলাফত থাকবে ইমাম হাসানের (আ) হাতে অথবা তার অবর্তমানে ইমাম হুসাইনের (আ) হাতে। কিন্তু মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্রে ইমাম হাসানকে শহীদ করা হয় এবং ইয়াজিদকে খলিফা ঘোষণা করে এই উমাইয়া শাসক। মু‘আবিয়া ক্ষমতাকে তাঁর বংশগত করার লক্ষ্যে যারা খেলাফতের দাবিদার হতে পারে তাদের ওপর কঠোরতা আরোপ শুরু করে। শামের জনগণের কাছ থেকে ইয়াযীদের খেলাফতের নামে বাইয়াত নেয়ার পর মুয়াবিয়া মদীনার নেতৃবৃন্দকেও বলে ইয়াজিদের নামে বাইয়াত নিতে। কিন্তু হেজাজের নেতৃবৃন্দ ও জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বনি উমাইয়্যা ছাড়া আর কেউ বাইয়াত করল না। কিন্তু তারপরও মু‘আবিয়া হজ ও ওমরার অজুহাতে হেজাজে এসে নিজের অযোগ্য পুত্রকে যুবরাজ বলে ঘোষণা দেয়। ইমাম হুসাইন (আ.) বেশ কিছু কাল ধরে উমাইয়্যাদের চিন্তাধারার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। প্রায়ই তিনি বিপদ সংকেত দিয়ে বলতেন : ‘নিজের নীরবতার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চাই।’ কেননা, ইমাম জানতেন যে, কুরআন ও ইসলামের টিকে থাকা নির্ভর করছে তাঁর আত্মত্যাগ ও শাহাদাতের ওপর। কারণ, বনি উমাইয়্যা ইসলাম বলতে রাজত্ব ও ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই বুঝেনি। ইয়াজিদ যেমন অন্তরে ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রাখত না, তেমনি বাহ্যিকভাবেও তা মেনে চলত না। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) ছিলেন ঈমান ও হাকীকতের বাস্তব প্রতীক এবং দীনের প্রতি গভীর বিশ্বাস তাঁর সমস্ত শিরা-উপশিরায় বেগবান রক্তের মত ঢেউ খেলে যেত। তিনি ভাল করেই মু‘আবিয়ার দুরভিসন্ধি বুঝলেন এবং এক অগ্নিঝরা ভাষণের মাধ্যমে তাঁর নীল নকশাকে ফাস করে বলেন : 'হে মু‘আবিয়া! … সত্যিই কি তুমি জনগণকে ইয়াজিদের বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ করতে চাও? যখন তার চরিত্রই তার উত্তম পরিচয়। তার চিন্তাচেতনা ও অভিমত তার কাজেই প্রকাশিত। তুমি ইয়াজিদ সম্পর্কে এবং আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর তার কর্তৃত্বের ব্যাপারে যা ঘোষণা করেছ, তা আমি শুনেছি! তাহলে আস, এ ইয়াজিদকে কুকুর, বানর, কবুতর, নারী-আসক্তি ও ফূর্তিবাজি সম্পর্কে পরীক্ষা করে দেখ…। হে মু‘আবিয়া! শুনেছি যে, তুমি আমাদের প্রতিও ইশারা করেছ। আল্লাহ্‌র কসম করে বলছি, মহানবী (সা.) তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের জন্যই উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে গেছেন।' হে মু‘আবিয়া! কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড-যেখানে যোগ্যতম লোকদের থাকা দরকার, সেখানে তাদেরকে বর্জন করছ এবং একজন পাপাচারী ও সম্ভোগে বুঁদ হয়ে থাকা লোককে অগ্রগণ্য করছ?

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202