আল্লাহর কর্তিক মনোনীত ইমাম ও তার দায়িত্বআমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, রাসূল (সা.) এর ইমাম বা খলিফা তথা প্রতিনিধির দু’ধরনের দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। যথা :একটি বাহ্যিক শাসন অপরটি আধ্যাত্মিক শাসন।বাহ্যিক শাসনঅর্থাৎ শাসন পরিচালনা, আইনের বাস্তবায়ন, অধিকার সংরক্ষণ, ইসলামী রাষ্ট্রের সংরক্ষণ ইত্যাদি।এক্ষেত্রে ইমাম বা খলিফা তথা প্রতিনিধির কাজ অন্যান্য শাসকদের মতই, তবে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা কখনই ইসলামের আইন ও বিচারবিধির ওপর পূর্ণ জ্ঞান ব্যতীত সম্ভব নয়।আধ্যাত্মিক শাসনআধ্যাত্মিক শাসন এই অর্থে যে, ইমাম বা খলিফা তথা প্রতিনিধির কর্তব্য হচ্ছে সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যার সমাধান দান ও মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি (যা কোন কারণে বলা হয় নি) মুসলমানদের নিকট তুলে ধরা।এক্ষেত্রে ইমাম বা খলিফা, একজন শাসকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অবশ্যই ধর্মীয় বিধি-বিধান ও কোরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যাও জনগণের সামনে বর্ণনা করবেন যাতে ইসলামের চিন্তা-ধারাকে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি থেকে রক্ষা এবং বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ-সংশয় হতে মুক্ত রাখতে পারেন। সুতরাং ইমাম বা খলিফাকে অবশ্যই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে ইসলামের ভিত্তি, মানদণ্ড ও শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিজ্ঞ হতে হবে। অর্থাৎ সবার চেয়ে বেশি মহানবী (সা.)-র প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের ঝর্ণা ধারা হতে পানি পান এবং তাঁর থাকাকালীন সময়ে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান ও নৈতিক লাভবান হওয়ার সৌভাগ্যের অধিকারী হতে হবে। সুতরাং ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য এরূপ ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য যিনি রাসূল (সা.) এর পবিত্র অস্তিত্ব থেকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত ও নৈতিক শিক্ষা লাভ করেছেন। সেই সাথে তিনি একদিকে ইসলামের জন্য অগ্রবর্তী ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হবেন অন্যদিকে সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থের উপর মুসলমানদের ও ইসলামের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বীনকে রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ করার দৃষ্টান্তের অধিকারী হবেন।ইমাম বা খলিফার শাসনকার্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের সমস্ত সম্পদের উপর তার শাসন কর্তৃত্বের অধিকার থাকবে বিশেষ করে খুম্স, যাকাত, রাজস্ব ও ভূমিকর, যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বা গণিমত, খনিজ ও অন্যান্য সাধারণ সম্পদ ইত্যাদি যা ইমাম বা খলিফার অধীনে থাকবে এবং ইমাম বা খলিফার দায়িত্ব হচ্ছে এগুলোকে কোন প্রকার অনিয়ম ছাড়াই জনগণের মাঝে বন্টন করা; অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণকর কোন কাজে লাগানো। সুতরাং তাকে অবশ্যই ইসলামের ন্যায় ভিত্তিক বন্টন ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত এবং দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত হতে হবে। এমনকি তাকে সংবেদনশীল বিশেষ মুহূর্তেও ভুল করা চলবে না অর্থাৎ তাকে জ্ঞান ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রেই নির্ভুল হতে হবে। এমন ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউই শনাক্ত করতে সক্ষম নয়। ঠিক এই দলিলের ভিত্তিতেই ইমামত তথা খেলাফত হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত যা তাঁর পক্ষ হতে উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকেই প্রদান করা হয়। তাই ঐ পবিত্র পদ মানুষের নির্বাচনের নাগালের বাইরে।অন্যভাবে বলা যায়, ইমামত তথা খেলাফত আল্লাহর মনোনীত একটি পদ যাতে মানুষের ভোটের কোন প্রভাব নেই। এ চিন্তার ভিত্তিতে আমরা রাসূল (সা.) এর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই বর্ণিত দলিল ও ঐশী নির্দেশের উপর নির্ভর করবো এবং রাসূল (সা.) এর বাণীসমূহ যা এই সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করে তার ফলাফলের উপর সিদ্ধান্ত নিব।হযরত আলীর (আ.) খেলাফতের অকাট্য প্রমাণযে সকল প্রমাণাদি সরাসরি সুস্পষ্টভাবে আলীর (আ.) খেলাফত ও নেতৃত্বকে প্রমাণ করে তার সংখ্যা এত বেশী যে যদি আমরা তা উল্লেখ করতে চাই তাহলে শুধু সেগুলিই একটা বড় গ্রন্থে রূপ লাভ করবে। তাই এখানে সামান্য কয়েকটির উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকবো।প্রথমেই বলা দরকার যে, যদিও মুসলিম সমাজ রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর নেতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ও রাসূল (সা.) এর প্রকৃত খলিফা হযরত আলীকে ২৫ বছর ধরে শাসনকার্য হতে দূরে রেখেছিল, কিন্তু এতে তাঁর সত্তাগত মর্যাদার মূল্য বিন্দু পরিমাণও কমে নি; বরং তারা নিজেরাই একজন নিষ্পাপ বা মাসুম নেতা হতে বঞ্চিত হয়েছে এবং উম্মতকেও তার সুফল থেকে বঞ্চিত করেছে। কারণ তাঁর মান-মর্যাদা বাহ্যিক খেলাফতের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না, বরং খেলাফতের পদটি স্বয়ং আলীর (আ.) দায়িত্বভারের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তাই তাঁকে খেলাফত থেকে দূরে রাখার কারণে রাসূলের নীতি ও সুন্নতের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।যখন আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) কুফা শহরে প্রবেশ করলেন, তখন এক ব্যক্তি তাঁর সামনে এসে বলল : ‘আল্লাহর কসম, হে আমিরুল মু’মিনীন! খেলাফতই আপনার মাধ্যমে মর্যাদা লাভ করেছে ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত হয়েছে, এমন নয় যে আপনি ঐ খেলাফতের মাধ্যমে মর্যাদা লাভ করেছেন। আপনার কারণেই এই পদটি মর্যাদার উচ্চ স্তরে পৌঁছেছে, এমন নয় যে আপনি ঐ পদের কারণে উচ্চস্তরে পৌঁছেছেন। খেলাফতই আপনার মুখাপেক্ষী হয়েছিল, আপনি তার প্রতি মুখাপেক্ষী ছিলেন না।’আহমাদ ইবনে হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেছেন : “একদিন আমার পিতার নিকট বসেছিলাম। কুফার অধিবাসী একদল লোক প্রবেশ করলো ও খলিফাদের খেলাফত সম্পর্কে আলোচনা করলো; কিন্তু আলীর খেলাফত সম্পর্কে কথা-বার্তা একটু দীর্ঘায়িত হল। আমার পিতা মাথা উঁচু করে বললেন :‘তোমরা আর কত আলী ও তার খেলাফত (শাসনকর্তৃত্ব) সম্পর্কে আলোচনা করতে চাও? খেলাফত আলীকে সুশোভিত করে নি বরং আলীই খেলাফতকে সৌন্দর্য্য দান করেছেন’।”আমরা জানি যে, গাদীরের ঘটনা একটি প্রামাণিক ঘটনা যা ইসলামের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং বেলায়াতের (কর্তৃত্বের) হাদীসও مَنْ كُنْتُ مَولاهُ فَعَليٌّ مَوْلاهُ একটি তর্কাতীত বাণী যা রাসূল (সা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। আর অর্থ ও ভাবধারার ক্ষেত্রেও কোন প্রকার অস্পষ্টতার চিহ্ন তাতে নেই; যারাই একটু আরবি ব্যকরণ সম্পর্কে জ্ঞাত ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রচলিত সর্বগ্রাহ্য মাপকাঠি সম্পর্কে পরিচিত তারা যদি ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিতে পক্ষপাতহীনভাবে এই হাদীসটির প্রতি দৃষ্টিপাত করে তাহলে অবশ্যই স্বীকার করবে যে এই হাদীসটি আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) ইমামত, নেতৃত্ব ও প্রাধান্যতার কথাই প্রমাণ করে।এমন কি এই হাদীসটিকে যদি না দেখার ভান করি, তারপরেও আলী (আ.) এর ইমামত ও নেতৃত্ব সম্পর্কে শিয়া এবং সুন্নীদের গ্রন্থসমূহে যথেষ্ট পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা আমাদের নিকট বিদ্যমান।রাসূল (সা.) হতে এ সম্পর্কে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরবো।মহানবী (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিনিধি বা খলিফারাসূল (সা.) বলেছেন : لكلِّ نَبيٍ وَصيٌّ وَ وٰارِثٌ وَ اِنَّ عَلياً وَصيّي وَ وٰارثيঅর্থাৎ ‘প্রত্যেক নবীরই ওসী বা প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী আছে এবং নিশ্চয়ই আমার প্রতিনিধি ও উত্তরাধি-কারী হল আলী।’আরো বলেন : أنٰا نَبِيُّ هٰذِهِ الاُمَّةِ وَ عَلِيٌّ وَصيّي في عِترَتي وَ اَهْلِ بَيتي وَ اُمَّتي مِنْ بَعديঅর্থাৎ ‘আমি এই উম্মতের (জাতির) নবী আর আলী হচ্ছে আমার ওসী বা প্রতিনিধি।’তিনি বলেন : عَليٌ أخي وَ وَزيري وَ وٰارثي وَ وَصيي وَ خَليفَتي في اُمَّتيঅর্থাৎ ‘আমার উম্মতের মধ্যে আলীই আমার ভাই, আমার সহযোগী উজীর, প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী ও আমার খলিফা।’এসব হাদীসে ওসী (প্রতিনিধি) ও উত্তরাধিকারী এ দু’টি শিরোনামকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ঐ দু’টির প্রত্যেকটিই আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) এর ইমামত বা খেলাফতকেই প্রমাণ করে।ওসী বা প্রতিনিধির অধিকারওসী বা প্রতিনিধি তাকেই বলা হয় যিনি সমস্ত দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে অসিয়তকারীর অনুরূপ অর্থাৎ যা কিছুর উপর অসিয়ত-কারীর অধিকার ও ক্ষমতা ছিল ওসীরও তার উপর অধিকার ও ক্ষমতা রয়েছে এবং তা ব্যবহার করতে পারবেন তবে যে ক্ষেত্রে তিনি নির্দিষ্টভাবে তাকে অসিয়ত করবেন কেবল সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত তার ব্যবহারের অধিকার আছে।এই হাদীসে রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে অসিয়তের ক্ষেত্রে দায়িত্বকে সীমিত করেন নি বরং তাঁকে নিঃশর্তভাবে ওসী বা প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন অর্থাৎ রাসূল (সা.) এর অধীনে যা কিছু আছে তার সবকিছুতে আলীর (আ.) অধিকার আছে আর এটাই হচ্ছে ইমামত বা খেলাফতের প্রকৃত অর্থ।উত্তরাধিকারীউত্তরাধিকারী শব্দটি শুনে প্রথম যে চিত্রটি মাথায় আসে তা হচ্ছে উত্তরাধিকারী ব্যক্তি উত্তরাধিকারী মনোনীতকারীর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়; কিন্তু আলী (আ.) শরীয়তের দৃষ্টিতে রাসূল (সা.) এর সম্পদের উত্তরাধিকারী ছিলেন না। কেননা, ইমামিয়া ফিক্হের আইন অনুযায়ী মৃতের যখন কোন সন্তান থাকে, তখন অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন সম্পদের উত্তরাধিকারী হয় না (সন্তানগণ সম্পদের প্রথম পর্যায়ের উত্তরাধিকারী, তারপর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন)। আর আমরা জানি যে, রাসূল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় সন্তান রেখে গিয়েছিলেন। ফাতিমা যাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা) তাঁর (রাসূলের) ইন্তেকালের পরেও কমপক্ষে ৭৫ দিন জীবিত ছিলেন, তাছাড়াও রাসূল (সা.) এর স্ত্রীগণ, যারা সম্পদের এক অষ্টাংশের অধিকারী ছিলেন, তাঁদের অনেকেই জীবিত ছিলেন। যদি এ বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করি তবুও আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর চাচাতো ভাই। আর চাচাতো ভাই তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে উত্তরাধিকার পায় এবং আমরা জানি রাসূল (সা.)-এর চাচা আব্বাস তাঁর (সা.) মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন। আর চাচা হচ্ছেন দ্বিতীয় পর্যায়ের উত্তরাধিকারী বা ওয়ারিশ।কিন্তু আহলে সুন্নাতের ফিকাহ্শাস্ত্র অনুযায়ী, স্ত্রী-গণকে তাদের অংশ (১/৮) দেওয়ার পর সম্পদকে দুইভাগে ভাগ করা হয়, তার এক অংশ পাবে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.) যিনি রাসূল (সা.)-এর একমাত্র কন্যা ছিলেন। অপর অংশটি যেটা তার অংশের বাইরে : সেটা তাঁর (সা.) চাচা আব্বাসের দিকে বর্তায়। সুতরাং, হযরত আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) কোনভাবেই রাসূল (সা.) এর সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। অপরদিকে যেহেতু রাসূল (সা.) সরাসরি তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছেন তাই অবশ্যই এই হাদীসে ‘এরস বা উত্তরাধিকারের’ বিষয়টি সম্পদ ভিন্ন অন্যকিছুকে বুঝায়। স্বাভাবিকভাবেই এই হাদীসে উত্তরাধিকারের বিষয়টি রাসূল (সা.) এর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং আলী (আ.) রাসূল (সা.) এর জ্ঞান ও সুন্নাতের উত্তরাধিকারী। সেই দলিলের ভিত্তিতেই তিনি তাঁর (সা.) খলিফা বা প্রতিনিধি।রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) বলেছেন ‘তুমি আমার ভাই ও উত্তরাধিকারী।’ আলী (আ.) বলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার কাছ থেকে উত্তরাধিকারী হিসেবে কি পাব?’ রাসূল (সা.) বললেন : ‘ঐ সকল জিনিস যা আমার পূর্ববর্তী নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন।’ জিজ্ঞেস করলেন : ‘তাঁরা কি জিনিস উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন?’ তিনি বললেন : ‘আল্লাহর কিতাব ও নবীদের সুন্নাত।’ আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) নিজেও বলেছেন : ‘আমি রাসূল (সা.) এর জ্ঞানের উত্তরাধিকারী।’ মু’মিনদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে আলী (আ.)রাসূল (সা.) যখনই এমন কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করতেন যে, আলীর (আ.) সাথে যে কারণেই হোক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে বা যদি কেউ মূর্খতার বশে আলী (আ.) সম্পর্কে রাসূল (সা.) এর নিকট অভিযোগ করতো, তিনি তাদেরকে বলতেন : مٰا تريدُونَ مِنْ عَلِيٍّ اِنَّ عَلياً مِنّي وَ أَنٰا مِنْهُ وَ هُوَ وليُّ كُلِّ مُؤمِنٍ بَعديঅর্থাৎ ‘আলীর সম্পর্কে তোমরা কি বলতে চাও সে আমার থেকে আর আমি তার থেকে। আমার পরে আলীই প্রত্যেক মো’মিনের ওয়ালী বা পৃষ্ঠপোষক (অভিভাবক)।’যদিও বাক্যে ব্যবহৃত ‘ওয়ালী’ শব্দটির অনেকগুলো আভিধানিক অর্থ রয়েছে, তারপরেও এই হাদীসে নেতা, পৃষ্ঠপোষক বা অভিভাবক ব্যতীত অন্য কোন অর্থে ব্যবহার হয় নি; এই হাদীসে ‘আমার পরে’ শব্দটিই উক্ত মতকে স্বীকৃতি প্রদান করে। কারণ, যদি ‘ওয়ালী’ শব্দের উদ্দেশ্য বন্ধুত্ব, বন্ধু, সাথী, প্রতিবেশী, একই শপথ গ্রহণকারী, এ ধরনের অর্থই হত তাহলে ‘রাসূল (সা.) এর পরে’ যে সময়ের প্রতি বিশেষ ইঙ্গিত করা হয়েছে তার দরকার ছিল না, কারণ তাঁর (সা.) জীবদ্দশায়ই তিনি (আলী) ঐরূপ ছিলেন।রাসূল (সা.) এর বাণীতে আলী (আ.)-র পৃষ্ঠপোষকতা বা অভিভাবকত্বকে মেনে নেওয়ার সুফলের কথাযখনই সাহাবীগণ রাসূল (সা.) এর পরে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি ও ইসলামী রাষ্ট্র নেতা সম্পর্কে তাঁর (সা.) সাথে কথা বলতেন, তখনই তিনি (কোন কোন হাদীস অনুযায়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন) এবং আলীর (আ.) পৃষ্ঠপোষকতা বা অভিভাবকত্ব মেনে নেওয়ার সুফল সম্পর্কে বক্তব্য দিতেন।তিনি বলতেন : إنْ وَلَّيْتُمُوهٰا عَلياً وَجَدْتُمُوهُ هٰادياً مَهْدياً يَسْلُكُ بِكُمْ عَلَى الطَّريقِ المستقيمঅর্থাৎ ‘যদি খেলাফতকে আলীর হাতে তুলে দাও, তাহলে দেখবে যে, হেদায়াত প্রাপ্ত ও হেদায়াতকারী হিসাবে সে তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করছে।’ أما وَالَّذي نَفْسي بِيَدِهِ لَئِنَ اَطاعُوه لَيَدْخُلُنَّ الجَنَّةَ اَجْمَعينَ اَكْتعينَঅর্থাৎ ‘তাঁর শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! যারা আলীর আনুগত্য করবে তারা সকলেই বেহেশ্তে প্রবেশ করবে।’ اِنْ تسْتخْلِفُوا عَلياً ـ‌وَ لا اَرٰاكُمْ فَاعِلينَ‌ـ تجِدُوهُ هٰادياً مَهْدياً يَحْمِلُكُمْ عَليَ المَحَجَّةِ الْبَيْضٰاءঅর্থাৎ ‘যদি তোমরা আলীকে খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নাও, তাহলে (আমার মনে হয় না তোমরা এমনটি করবে) দেখবে যে, সে সঠিক পথপ্রাপ্ত ও পথপ্রদর্শক; তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।’আলী (আ.) এর জন্য নির্ধারিত খেলাফতরাসূল (সা.) হতে বর্ণিত আছে যে, শবে মেরাজে (ঊর্ধ্বগমনের রাতে) যখন আমি নৈকট্যের প্রান্ত সীমাতে পৌঁছলাম ও আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হলাম, তিনি বললেন : হে মুহাম্মদ! আমি জবাব দিলাম: ‘লাব্বাইক (আমি হাজির)।’ তিনি বললেন : ‘তুমি কি আমার বান্দাদেরকে পরীক্ষা করে দেখেছ যে, তাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি আমার অনুগত?’আমি বললাম : ‘হে আল্লাহ তাদের মধ্যে আলীই সবচেয়ে বেশী অনুগত।’তিনি বললেন : ‘তুমি সত্যই বলেছ হে মুহাম্মদ! তুমি কি স্বীয় খলিফা বা প্রতিনিধি নির্ধারণ করেছ যে তোমার পরে তোমার দায়িত্বগুলি পালন করবে এবং আমার বান্দাদের মধ্যে যারা কোরআন সম্পর্কে জানে না তাদেরকে কোরআন শিক্ষা দিবে?’আমি বললাম : ‘হে আল্লাহ! আপনি নিজেই আমার জন্য প্রতিনিধি নির্ধারণ করে দিন।’ তিনি বললেন : ‘আমি আলীকে তোমার প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারণ করলাম; তুমি তাকে স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন কর।’একইভাবে রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহ প্রত্যেক জাতির জন্য নবী নির্বাচন করেছেন ও প্রত্যেক নবীর জন্য নির্ধারণ করেছেন তার প্রতিনিধি। আমি হলাম এই জাতির নবী আর আলী হচ্ছে আমার স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি বা ওসী।’উপরিউক্ত আলোচনা থেকে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয় তা হচ্ছে মহানবী (সা.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী সর্বোত্তম ও সুযোগ্য ব্যক্তি হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত বা খলিফা নির্ধারণ করেছেন। তাই তাঁর আনুগত্য করা সকল মুসলমানের জন্য ফরয। তাঁকে অমান্য করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করা। সে কারণে আমাদের সকলের দায়িত্ব হচ্ছে রাসূলে (সা.) এর নির্ধারিত ব্যক্তির অনুসরণ করা।প্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কিপ্রচারে মোঃ আবু তুরাব

আল্লাহর কর্তিক মনোনীত ইমাম ও তার দায়িত্ব

আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, রাসূল (সা.) এর ইমাম বা খলিফা তথা প্রতিনিধির দু’ধরনের দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। যথা :

একটি বাহ্যিক শাসন অপরটি আধ্যাত্মিক শাসন।

বাহ্যিক শাসন

অর্থাৎ শাসন পরিচালনা, আইনের বাস্তবায়ন, অধিকার সংরক্ষণ, ইসলামী রাষ্ট্রের সংরক্ষণ ইত্যাদি।

এক্ষেত্রে ইমাম বা খলিফা তথা প্রতিনিধির কাজ অন্যান্য শাসকদের মতই, তবে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা কখনই ইসলামের আইন ও বিচারবিধির ওপর পূর্ণ জ্ঞান ব্যতীত সম্ভব নয়।

আধ্যাত্মিক শাসন

আধ্যাত্মিক শাসন এই অর্থে যে, ইমাম বা খলিফা তথা প্রতিনিধির কর্তব্য হচ্ছে সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যার সমাধান দান ও মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি (যা কোন কারণে বলা হয় নি) মুসলমানদের নিকট তুলে ধরা।

এক্ষেত্রে ইমাম বা খলিফা, একজন শাসকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অবশ্যই ধর্মীয় বিধি-বিধান ও কোরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যাও জনগণের সামনে বর্ণনা করবেন যাতে ইসলামের চিন্তা-ধারাকে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি থেকে রক্ষা এবং বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ-সংশয় হতে মুক্ত রাখতে পারেন। সুতরাং ইমাম বা খলিফাকে অবশ্যই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে ইসলামের ভিত্তি, মানদণ্ড ও শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিজ্ঞ হতে হবে। অর্থাৎ সবার চেয়ে বেশি মহানবী (সা.)-র প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের ঝর্ণা ধারা হতে পানি পান এবং তাঁর থাকাকালীন সময়ে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান ও নৈতিক লাভবান হওয়ার সৌভাগ্যের অধিকারী হতে হবে। সুতরাং ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য এরূপ ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য যিনি রাসূল (সা.) এর পবিত্র অস্তিত্ব থেকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত ও নৈতিক শিক্ষা লাভ করেছেন। সেই সাথে তিনি একদিকে ইসলামের জন্য অগ্রবর্তী ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হবেন অন্যদিকে সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থের উপর মুসলমানদের ও ইসলামের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বীনকে রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ করার দৃষ্টান্তের অধিকারী হবেন।

ইমাম বা খলিফার শাসনকার্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের সমস্ত সম্পদের উপর তার শাসন কর্তৃত্বের অধিকার থাকবে বিশেষ করে খুম্স, যাকাত, রাজস্ব ও ভূমিকর, যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বা গণিমত, খনিজ ও অন্যান্য সাধারণ সম্পদ ইত্যাদি যা ইমাম বা খলিফার অধীনে থাকবে এবং ইমাম বা খলিফার দায়িত্ব হচ্ছে এগুলোকে কোন প্রকার অনিয়ম ছাড়াই জনগণের মাঝে বন্টন করা; অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণকর কোন কাজে লাগানো। সুতরাং তাকে অবশ্যই ইসলামের ন্যায় ভিত্তিক বন্টন ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত এবং দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত হতে হবে। এমনকি তাকে সংবেদনশীল বিশেষ মুহূর্তেও ভুল করা চলবে না অর্থাৎ তাকে জ্ঞান ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রেই নির্ভুল হতে হবে। এমন ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউই শনাক্ত করতে সক্ষম নয়। ঠিক এই দলিলের ভিত্তিতেই ইমামত তথা খেলাফত হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত যা তাঁর পক্ষ হতে উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকেই প্রদান করা হয়। তাই ঐ পবিত্র পদ মানুষের নির্বাচনের নাগালের বাইরে।

অন্যভাবে বলা যায়, ইমামত তথা খেলাফত আল্লাহর মনোনীত একটি পদ যাতে মানুষের ভোটের কোন প্রভাব নেই। এ চিন্তার ভিত্তিতে আমরা রাসূল (সা.) এর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই বর্ণিত দলিল ও ঐশী নির্দেশের উপর নির্ভর করবো এবং রাসূল (সা.) এর বাণীসমূহ যা এই সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করে তার ফলাফলের উপর সিদ্ধান্ত নিব।

হযরত আলীর (আ.) খেলাফতের অকাট্য প্রমাণ

যে সকল প্রমাণাদি সরাসরি সুস্পষ্টভাবে আলীর (আ.) খেলাফত ও নেতৃত্বকে প্রমাণ করে তার সংখ্যা এত বেশী যে যদি আমরা তা উল্লেখ করতে চাই তাহলে শুধু সেগুলিই একটা বড় গ্রন্থে রূপ লাভ করবে। তাই এখানে সামান্য কয়েকটির উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকবো।

প্রথমেই বলা দরকার যে, যদিও মুসলিম সমাজ রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর নেতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ও রাসূল (সা.) এর প্রকৃত খলিফা হযরত আলীকে ২৫ বছর ধরে শাসনকার্য হতে দূরে রেখেছিল, কিন্তু এতে তাঁর সত্তাগত মর্যাদার মূল্য বিন্দু পরিমাণও কমে নি; বরং তারা নিজেরাই একজন নিষ্পাপ বা মাসুম নেতা হতে বঞ্চিত হয়েছে এবং উম্মতকেও তার সুফল থেকে বঞ্চিত করেছে। কারণ তাঁর মান-মর্যাদা বাহ্যিক খেলাফতের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না, বরং খেলাফতের পদটি স্বয়ং আলীর (আ.) দায়িত্বভারের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তাই তাঁকে খেলাফত থেকে দূরে রাখার কারণে রাসূলের নীতি ও সুন্নতের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।

যখন আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) কুফা শহরে প্রবেশ করলেন, তখন এক ব্যক্তি তাঁর সামনে এসে বলল : ‘আল্লাহর কসম, হে আমিরুল মু’মিনীন! খেলাফতই আপনার মাধ্যমে মর্যাদা লাভ করেছে ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত হয়েছে, এমন নয় যে আপনি ঐ খেলাফতের মাধ্যমে মর্যাদা লাভ করেছেন। আপনার কারণেই এই পদটি মর্যাদার উচ্চ স্তরে পৌঁছেছে, এমন নয় যে আপনি ঐ পদের কারণে উচ্চস্তরে পৌঁছেছেন। খেলাফতই আপনার মুখাপেক্ষী হয়েছিল, আপনি তার প্রতি মুখাপেক্ষী ছিলেন না।’

আহমাদ ইবনে হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেছেন : “একদিন আমার পিতার নিকট বসেছিলাম। কুফার অধিবাসী একদল লোক প্রবেশ করলো ও খলিফাদের খেলাফত সম্পর্কে আলোচনা করলো; কিন্তু আলীর খেলাফত সম্পর্কে কথা-বার্তা একটু দীর্ঘায়িত হল। আমার পিতা মাথা উঁচু করে বললেন :

‘তোমরা আর কত আলী ও তার খেলাফত (শাসনকর্তৃত্ব) সম্পর্কে আলোচনা করতে চাও? খেলাফত আলীকে সুশোভিত করে নি বরং আলীই খেলাফতকে সৌন্দর্য্য দান করেছেন’।”

আমরা জানি যে, গাদীরের ঘটনা একটি প্রামাণিক ঘটনা যা ইসলামের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং বেলায়াতের (কর্তৃত্বের) হাদীসও مَنْ كُنْتُ مَولاهُ فَعَليٌّ مَوْلاهُ একটি তর্কাতীত বাণী যা রাসূল (সা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। আর অর্থ ও ভাবধারার ক্ষেত্রেও কোন প্রকার অস্পষ্টতার চিহ্ন তাতে নেই; যারাই একটু আরবি ব্যকরণ সম্পর্কে জ্ঞাত ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রচলিত সর্বগ্রাহ্য মাপকাঠি সম্পর্কে পরিচিত তারা যদি ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিতে পক্ষপাতহীনভাবে এই হাদীসটির প্রতি দৃষ্টিপাত করে তাহলে অবশ্যই স্বীকার করবে যে এই হাদীসটি আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) ইমামত, নেতৃত্ব ও প্রাধান্যতার কথাই প্রমাণ করে।

এমন কি এই হাদীসটিকে যদি না দেখার ভান করি, তারপরেও আলী (আ.) এর ইমামত ও নেতৃত্ব সম্পর্কে শিয়া এবং সুন্নীদের গ্রন্থসমূহে যথেষ্ট পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা আমাদের নিকট বিদ্যমান।

রাসূল (সা.) হতে এ সম্পর্কে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরবো।

মহানবী (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত প্রতিনিধি বা খলিফা

রাসূল (সা.) বলেছেন :

 لكلِّ نَبيٍ وَصيٌّ وَ وٰارِثٌ وَ اِنَّ عَلياً وَصيّي وَ وٰارثي

অর্থাৎ ‘প্রত্যেক নবীরই ওসী বা প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী আছে এবং নিশ্চয়ই আমার প্রতিনিধি ও উত্তরাধি-কারী হল আলী।’

আরো বলেন :

 أنٰا نَبِيُّ هٰذِهِ الاُمَّةِ وَ عَلِيٌّ وَصيّي في عِترَتي وَ اَهْلِ بَيتي وَ اُمَّتي مِنْ بَعدي

অর্থাৎ ‘আমি এই উম্মতের (জাতির) নবী আর আলী হচ্ছে আমার ওসী বা প্রতিনিধি।’

তিনি বলেন :

 عَليٌ أخي وَ وَزيري وَ وٰارثي وَ وَصيي وَ خَليفَتي في اُمَّتي

অর্থাৎ ‘আমার উম্মতের মধ্যে আলীই আমার ভাই, আমার সহযোগী উজীর, প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী ও আমার খলিফা।’

এসব হাদীসে ওসী (প্রতিনিধি) ও উত্তরাধিকারী এ দু’টি শিরোনামকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ঐ দু’টির প্রত্যেকটিই আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) এর ইমামত বা খেলাফতকেই প্রমাণ করে।

ওসী বা প্রতিনিধির অধিকার

ওসী বা প্রতিনিধি তাকেই বলা হয় যিনি সমস্ত দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে অসিয়তকারীর অনুরূপ অর্থাৎ যা কিছুর উপর অসিয়ত-কারীর অধিকার ও ক্ষমতা ছিল ওসীরও তার উপর অধিকার ও ক্ষমতা রয়েছে এবং তা ব্যবহার করতে পারবেন তবে যে ক্ষেত্রে তিনি নির্দিষ্টভাবে তাকে অসিয়ত করবেন কেবল সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত তার ব্যবহারের অধিকার আছে।

এই হাদীসে রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে অসিয়তের ক্ষেত্রে দায়িত্বকে সীমিত করেন নি বরং তাঁকে নিঃশর্তভাবে ওসী বা প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন অর্থাৎ রাসূল (সা.) এর অধীনে যা কিছু আছে তার সবকিছুতে আলীর (আ.) অধিকার আছে আর এটাই হচ্ছে ইমামত বা খেলাফতের প্রকৃত অর্থ।

উত্তরাধিকারী

উত্তরাধিকারী শব্দটি শুনে প্রথম যে চিত্রটি মাথায় আসে তা হচ্ছে উত্তরাধিকারী ব্যক্তি উত্তরাধিকারী মনোনীতকারীর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়; কিন্তু আলী (আ.) শরীয়তের দৃষ্টিতে রাসূল (সা.) এর সম্পদের উত্তরাধিকারী ছিলেন না। কেননা, ইমামিয়া ফিক্হের আইন অনুযায়ী মৃতের যখন কোন সন্তান থাকে, তখন অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন সম্পদের উত্তরাধিকারী হয় না (সন্তানগণ সম্পদের প্রথম পর্যায়ের উত্তরাধিকারী, তারপর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন)। আর আমরা জানি যে, রাসূল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় সন্তান রেখে গিয়েছিলেন। ফাতিমা যাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা) তাঁর (রাসূলের) ইন্তেকালের পরেও কমপক্ষে ৭৫ দিন জীবিত ছিলেন, তাছাড়াও রাসূল (সা.) এর স্ত্রীগণ, যারা সম্পদের এক অষ্টাংশের অধিকারী ছিলেন, তাঁদের অনেকেই জীবিত ছিলেন। যদি এ বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করি তবুও আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর চাচাতো ভাই। আর চাচাতো ভাই তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে উত্তরাধিকার পায় এবং আমরা জানি রাসূল (সা.)-এর চাচা আব্বাস তাঁর (সা.) মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন। আর চাচা হচ্ছেন দ্বিতীয় পর্যায়ের উত্তরাধিকারী বা ওয়ারিশ।

কিন্তু আহলে সুন্নাতের ফিকাহ্শাস্ত্র অনুযায়ী, স্ত্রী-গণকে তাদের অংশ (১/৮) দেওয়ার পর সম্পদকে দুইভাগে ভাগ করা হয়, তার এক অংশ পাবে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.) যিনি রাসূল (সা.)-এর একমাত্র কন্যা ছিলেন। অপর অংশটি যেটা তার অংশের বাইরে : সেটা তাঁর (সা.) চাচা আব্বাসের দিকে বর্তায়। সুতরাং, হযরত আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) কোনভাবেই রাসূল (সা.) এর সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। অপরদিকে যেহেতু রাসূল (সা.) সরাসরি তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছেন তাই অবশ্যই এই হাদীসে ‘এরস বা উত্তরাধিকারের’ বিষয়টি সম্পদ ভিন্ন অন্যকিছুকে বুঝায়। স্বাভাবিকভাবেই এই হাদীসে উত্তরাধিকারের বিষয়টি রাসূল (সা.) এর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং আলী (আ.) রাসূল (সা.) এর জ্ঞান ও সুন্নাতের উত্তরাধিকারী। সেই দলিলের ভিত্তিতেই তিনি তাঁর (সা.) খলিফা বা প্রতিনিধি।

রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) বলেছেন ‘তুমি আমার ভাই ও উত্তরাধিকারী।’ আলী (আ.) বলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার কাছ থেকে উত্তরাধিকারী হিসেবে কি পাব?’ রাসূল (সা.) বললেন : ‘ঐ সকল জিনিস যা আমার পূর্ববর্তী নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন।’ জিজ্ঞেস করলেন : ‘তাঁরা কি জিনিস উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন?’ তিনি বললেন : ‘আল্লাহর কিতাব ও নবীদের সুন্নাত।’ আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) নিজেও বলেছেন : ‘আমি রাসূল (সা.) এর জ্ঞানের উত্তরাধিকারী।’

 

মু’মিনদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে আলী (আ.)

রাসূল (সা.) যখনই এমন কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করতেন যে, আলীর (আ.) সাথে যে কারণেই হোক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে বা যদি কেউ মূর্খতার বশে আলী (আ.) সম্পর্কে রাসূল (সা.) এর নিকট অভিযোগ করতো, তিনি তাদেরকে বলতেন :

 مٰا تريدُونَ مِنْ عَلِيٍّ اِنَّ عَلياً مِنّي وَ أَنٰا مِنْهُ وَ هُوَ وليُّ كُلِّ مُؤمِنٍ بَعدي

অর্থাৎ ‘আলীর সম্পর্কে তোমরা কি বলতে চাও সে আমার থেকে আর আমি তার থেকে। আমার পরে আলীই প্রত্যেক মো’মিনের ওয়ালী বা পৃষ্ঠপোষক (অভিভাবক)।’

যদিও বাক্যে ব্যবহৃত ‘ওয়ালী’ শব্দটির অনেকগুলো আভিধানিক অর্থ রয়েছে, তারপরেও এই হাদীসে নেতা, পৃষ্ঠপোষক বা অভিভাবক ব্যতীত অন্য কোন অর্থে ব্যবহার হয় নি; এই হাদীসে ‘আমার পরে’ শব্দটিই উক্ত মতকে স্বীকৃতি প্রদান করে। কারণ, যদি ‘ওয়ালী’ শব্দের উদ্দেশ্য বন্ধুত্ব, বন্ধু, সাথী, প্রতিবেশী, একই শপথ গ্রহণকারী, এ ধরনের অর্থই হত তাহলে ‘রাসূল (সা.) এর পরে’ যে সময়ের প্রতি বিশেষ ইঙ্গিত করা হয়েছে তার দরকার ছিল না, কারণ তাঁর (সা.) জীবদ্দশায়ই তিনি (আলী) ঐরূপ ছিলেন।

রাসূল (সা.) এর বাণীতে আলী (আ.)-র পৃষ্ঠপোষকতা বা অভিভাবকত্বকে মেনে নেওয়ার সুফলের কথা

যখনই সাহাবীগণ রাসূল (সা.) এর পরে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি ও ইসলামী রাষ্ট্র নেতা সম্পর্কে তাঁর (সা.) সাথে কথা বলতেন, তখনই তিনি (কোন কোন হাদীস অনুযায়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন) এবং আলীর (আ.) পৃষ্ঠপোষকতা বা অভিভাবকত্ব মেনে নেওয়ার সুফল সম্পর্কে বক্তব্য দিতেন।

তিনি বলতেন :

 إنْ وَلَّيْتُمُوهٰا عَلياً وَجَدْتُمُوهُ هٰادياً مَهْدياً يَسْلُكُ بِكُمْ عَلَى الطَّريقِ المستقيم

অর্থাৎ ‘যদি খেলাফতকে আলীর হাতে তুলে দাও, তাহলে দেখবে যে, হেদায়াত প্রাপ্ত ও হেদায়াতকারী হিসাবে সে তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করছে।’

 أما وَالَّذي نَفْسي بِيَدِهِ لَئِنَ اَطاعُوه لَيَدْخُلُنَّ الجَنَّةَ اَجْمَعينَ اَكْتعينَ

অর্থাৎ ‘তাঁর শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! যারা আলীর আনুগত্য করবে তারা সকলেই বেহেশ্তে প্রবেশ করবে।’

 اِنْ تسْتخْلِفُوا عَلياً ـ‌وَ لا اَرٰاكُمْ فَاعِلينَ‌ـ تجِدُوهُ هٰادياً مَهْدياً يَحْمِلُكُمْ عَليَ المَحَجَّةِ الْبَيْضٰاء

অর্থাৎ ‘যদি তোমরা আলীকে খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নাও, তাহলে (আমার মনে হয় না তোমরা এমনটি করবে) দেখবে যে, সে সঠিক পথপ্রাপ্ত ও পথপ্রদর্শক; তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।’

আলী (আ.) এর জন্য নির্ধারিত খেলাফত

রাসূল (সা.) হতে বর্ণিত আছে যে, শবে মেরাজে (ঊর্ধ্বগমনের রাতে) যখন আমি নৈকট্যের প্রান্ত সীমাতে পৌঁছলাম ও আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হলাম, তিনি বললেন : হে মুহাম্মদ! আমি জবাব দিলাম: ‘লাব্বাইক (আমি হাজির)।’ তিনি বললেন : ‘তুমি কি আমার বান্দাদেরকে পরীক্ষা করে দেখেছ যে, তাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি আমার অনুগত?’

আমি বললাম : ‘হে আল্লাহ তাদের মধ্যে আলীই সবচেয়ে বেশী অনুগত।’

তিনি বললেন : ‘তুমি সত্যই বলেছ হে মুহাম্মদ! তুমি কি স্বীয় খলিফা বা প্রতিনিধি নির্ধারণ করেছ যে তোমার পরে তোমার দায়িত্বগুলি পালন করবে এবং আমার বান্দাদের মধ্যে যারা কোরআন সম্পর্কে জানে না তাদেরকে কোরআন শিক্ষা দিবে?’

আমি বললাম : ‘হে আল্লাহ! আপনি নিজেই আমার জন্য প্রতিনিধি নির্ধারণ করে দিন।’

 তিনি বললেন : ‘আমি আলীকে তোমার প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারণ করলাম; তুমি তাকে স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন কর।’

একইভাবে রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহ প্রত্যেক জাতির জন্য নবী নির্বাচন করেছেন ও প্রত্যেক নবীর জন্য নির্ধারণ করেছেন তার প্রতিনিধি। আমি হলাম এই জাতির নবী আর আলী হচ্ছে আমার স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি বা ওসী।’

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয় তা হচ্ছে মহানবী (সা.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী সর্বোত্তম ও সুযোগ্য ব্যক্তি হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত বা খলিফা নির্ধারণ করেছেন। তাই তাঁর আনুগত্য করা সকল মুসলমানের জন্য ফরয। তাঁকে অমান্য করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করা। সে কারণে আমাদের সকলের দায়িত্ব হচ্ছে রাসূলে (সা.) এর নির্ধারিত ব্যক্তির অনুসরণ করা।

প্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কি

প্রচারে মোঃ আবু তুরাব

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202