আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-ই সর্বপ্রথম ইমাম। তিনি মহানবী (সা.) এর চাচা এবং বনি হাশেম গোত্রের নেতা জনাব আবু তালিবের সন্তান ছিলেন।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইনআল্লাহর রাসুল (সা.)-এর এই চাচাই শৈশবেও তাঁর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজের ঘরে মহানবী (সা.)-কে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং লালন পালনের মাধ্যমে তাঁকে বড় করেছিলেন। মহানবী (সা.)এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার পর থেকে নিয়ে যত দিন তিনি (আবু তালিব) জীবিত ছিলেন, মহানবী (সা.)-কে সার্বিক সহযোগিতা ও সমর্থন করেছিলেন। তিনি সবসময়ই মহানবী (সা.)-কে কাফেরদের, বিশেষ করে কুরাইশদের সার্বিক অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন। হযরত ইমাম আলী (আ.) (প্রশিদ্ধ মতানুযায়ী) মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার প্রায় দশ বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর জন্মের প্রায় ছ’বছর পর মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর আবেদনক্রমে ঐসময় হযরত আলী (আ.) বাবার বাড়ী থেকে মহানবী (সা.)-এর বাড়ীতে স্থানান্তরিত হন। তারপর থেকে হযরত ইমাম আলী (আ.) সরাসরি মহানবী (সা.)-এর অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধানে তাঁর কাছে লালিত পালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। মহানবী (সা.) হেরা গুহায় অবস্থানকালে তাঁর কাছে সর্বপ্রথম আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘ওহী’ বা ঐশীবাণী অবর্তীণ হয়। যার ফলে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। এরপর হেরা গুহা থেকে বের হয়ে মহানবী (সা.) নিজ গৃহে যাওয়ার পথে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে এবং তিনি তাঁর কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন। হযরত ইমাম আলী (আ.) সাথে সাথেই মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন। অতঃপর নিকট আত্মীয়দেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্‌বান জানানোর উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) তাদের সবাইকে নিজ বাড়ীতে খাওয়ার আমন্ত্রন জানিয়ে সমবেত করেন। ঐ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সবার প্রতি লক্ষ্য করে মহানবী (সা.) বলেছিলেন যে, ‘আপনাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম আমার আহ্‌বানে (ইসলাম গ্রহণে) সাড়া দেবে, সেই হবে আমার খলিফা, উত্তরাধিকারী এবং প্রতিনিধি। কিন্তু উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে একমাত্র যে ব্যক্তিটি সর্বপ্রথম উঠে দাঁড়িয়ে সেদিন বিশ্বনবী (সা.)-এর আহ্‌বানে সাড়া দিয়েছিল এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল তিনিই হচ্ছেন হযরত ইমাম আলী (আ.)। আর বিশ্বনবী (সা.) সেদিন (তাঁর প্রতি) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ঈমানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং স্বঘোষিত প্রতিশ্রুতিও তিনি তার ব্যাপারে পালন করেছিলেন। এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলিম। আর তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি কখনই মূর্তিপুজা করেননি। মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গমনের পূর্ব পর্যন্ত হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী। মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা গমনের রাতে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই মহানবী (সা.) এর বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ঐ রাতেই কাফেররা মহানবী (সা.) এর বাড়ী ঘেরাও করে শেষরাতের অন্ধকারে মহানবী (সা.)-কে বিছানায় শায়িত অবস্থায় হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। মহানবী (সা.) কাফেরদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হবার পূর্বেই গৃহত্যাগ করে মদীনার পথে পাড়ি দিয়েছিলেন। এরপর হযরত ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর কাছে গচ্ছিত জনগণের আমানতের মালা-মাল তাদের মালিকদের কাছে পৌঁছে দেন। তারপর তিনিও নিজের মা, নবী কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) ও অন্য দু’জন স্ত্রীলোক সহ মদীনার পথে পাড়ি দেন। এমনকি মদীনাতেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী। নির্জনে অথবা জনসমক্ষে তথা কোন অবস্থাতেই মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখেননি। তিনি স্বীয় কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-কেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছেই বিয়ে দেন। সাহাবীদের উপস্থিতিতে মহানবী (সা.), হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপনের ঘোষণা দেন। একমাত্র ‘তাবুকের’ যুদ্ধ ছাড়া বিশ্ব নবী (সা.) (স্বীয় জীবদ্দশায়) যত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, হযরত ইমাম আলী (আ.)-ও সেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন। এ ছাড়াও হযরত ইমাম আলী (আ.) কোন যুদ্ধেই আদৌ পিছপা হননি। জীবনে কোন শত্রুর মোকাবিলায় তিনি পৃষ্ঠ প্রর্দশন করেননি। তিনি জীবনে কখনোই মহানবী (সা.)-এর আদেশের অবাধ্যতা করেননি। তাই তাঁর সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন যে, “আলী কখনই সত্য থেকে অথবা সত্য আলী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।” বিশ্ব নবী (সা.)-এর মৃত্যুর সময় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বয়স ছিল প্রায় তেত্রিশ বছর। বিশ্বনবী (সা.)-এর সকল সাহাবীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ইসলামের সকল মহত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন তিনিই। সাহাবীদের মধ্যে হযরত ইমাম আলী (আ.) বয়সের দিক থেকে ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ। আর ইতিপূর্বে বিশ্বনবী (আ.)-এর পাশাপাশি অংশগ্রহণকৃত যুদ্ধসমূহে যে রক্তপাত ঘটেছিল, সে কারণে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি অনেকেই শত্রুতা পোষণ করত। এসব কারণেই বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরলোক গমনের পর হযরত আলী (আ.)-কে খেলাফতের পদাধিকার লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। আর এর মাধ্যমে সকল রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাই বাধ্য হয়ে তখন তিনি নিরালায় জীবন যাপন করতে শুরু করেন এবং ব্যক্তি প্রশিক্ষণের কাজে নিজেকে ব্যপৃত করেন। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর তিনজন খলিফার শাসনামল শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই জীবন যাপন করতে থাকেন। তারপর তৃতীয় খলিফা নিহত হবার পর জনগণ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে ‘বাইয়াত’ (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন এবং তাঁকে খেলাফতের পদে অধিষ্ঠিত করেন।হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকাল ছিল প্রায় ৪ বছর ৯ মাস। তিনি তাঁর এই খেলাফতের শাসন আমলে সম্পূর্ণরূপে মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করেন। তিনি তাঁর খেলাফতকে আন্দোলনমুখী এক বিপ্লবীরূপ প্রদান করে ছিলেন। তিনি তাঁর শাসন আমলে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। অবশ্য ইমাম আলী (আ.)-এর ঐসব সংস্কারমূলক কর্মসূচী বেশকিছু সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির ক্ষতির কারণ ঘটিয়ে ছিল। এ কারণে উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা, তালহা, যুবাইর ও মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে বেশকিছু সংখ্যক সাহাবী হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের দাবীর শ্লোগানকে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। আর তারা ইসলামী রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত করার মাধ্যমে এক ব্যাপক রাজনৈতিক অরাজকতার সৃষ্টি করে। যার ফলে উদ্ভুত ফিৎনা ও অরাজকতা দমনের জন্যে বস্‌রার সন্নিকটে ইমাম আলী (আ.) নবীপত্নি আয়েশা, তালহা, ও যুবায়েরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবর্তীণ হতে বাধ্য হন। ইসলামী ইতিহাসের ঐ যুদ্ধিটিই ‘জঙ্গে জামাল’ নামে পরিচিত। এ ছাড়াও ইরাক ও সিরিয়া সীমানে- অনুরূপ কারণে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে হযরত ইমাম আলী (আ.) ‘সিফফিন’ নামক আরও একটি যুদ্ধে অবর্তীণ হতে বাধ্য হন। ‘সিফফিন’ নামক ঐ যুদ্ধ দীর্ঘ দেড় বছর যাবৎ অব্যাহত ছিল। ঐ যুদ্ধ শেষ না হতেই ‘নাহ্‌রাওয়ান’ নামক স্থানে ‘খাওয়ারেজ’ (ইসলাম থেকে বহিস্কৃত) নামক বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। ঐ যুদ্ধিটি ইতিহাসে ‘নাহ্‌রাওয়ানের’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালই আভ্যন্তরীণ মতভেদ জনিত সমস্যা সমাধানের মধ্যেই অতিক্রান্ত হয়। এর কিছুদিন পরই ৪০ হিজরীর রমযান মাসের ১৯ তারীখে কুফার মসজিদে ফজরের নামাযের ইমামতি করার সময় জনৈক ‘খারেজির’ তলোয়ারের আঘাতে তিনি আহত হন। অতঃপর ২০শে রমযান দিবাগত রাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। ইতিহাসের সাক্ষ্য এবং শত্রু ও মিত্র, উভয়পক্ষের স্বীকারোক্তি অনুসারে মানবীয় গুণাবলীর দিক থেকে আমিরুল মু’মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এ ব্যাপারে সামান্যতম ক্রটির অস্তিত্বও তাঁর চরিত্রে ছিল না। আর ইসলামে মহত গুণাবলীর দিক থেকে তিনি ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)-এর আদর্শের এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিভু।ইমাম আলী (আ.)-এর মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এ যাবৎ যত আলোচনা হয়েছে এবং শীয়া, সুন্নী, জ্ঞানী গুণী ও গবেষকগণ যে পরিমাণ গ্রন্থাবলী তাঁর সম্পর্কে আজ পর্যন্ত রচনা করেছেন, ইতিহাসে এমনটি আর অন্য কারও ক্ষেত্রেই ঘটেনি। হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সকল মুসলমান এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানীব্যক্তি। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি তাঁর অগাধ জ্ঞানগর্ভ বর্ণনার মাধ্যমে ইসলামে যুক্তিভিত্তিক প্রমাণ পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেন। এভাবে তিনিই সর্ব প্রথম ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারে দর্শন চর্চার মাত্রা যোগ করেন। তিনিই কুরআনের জটিল ও রহস্যপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা করেন। কুরআনের বাহ্যিক শব্দাবলীকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্যে তিনি আরবী ভাষার ব্যাকরণ শাস্ত্র রচনা করেন। বীরত্বের ক্ষেত্রেও হযরত আলী (আ.) ছিলেন মানবজাতির জন্য প্রতীক স্বরূপ। বিশ্ব নবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর পরেও জীবনে যত যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেছেন, কখনোই তাঁকে ভীত-সন্ত্রস্ত হতে বা মানসিক অস্থিরতায় ভূগতে দেখা যায়নি। এমনকি ওহুদ, হুনাইন, খান্দাক এবং খাইবারের মত কঠিন যুদ্ধগুলো যখন মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং সাহাবীরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেই কঠিন মূহুর্তগুলোতেও হযরত ইমাম আলী (আ.) কখনোই শত্রুদের সম্মুখে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেননি। ইতিহাসে এমন একটি ঘটনাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোন খ্যাতিমান বীর যোদ্ধা ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিরাপদে নিজের প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছে। তিনি এমন মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও কখনও কোন দূর্বল লোককে হত্যা করেননি এবং তাঁর নিকট থেকে পালিয়ে যাওয়া (প্রাণ ভয়ে) ব্যক্তির পিছু ধাওয়া করেননি। তিনি কখনোই রাতের আঁধারে শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমন চালাননি। শত্রুপক্ষের জন্য পানি সরবরাহ কখনোই তিনি বন্ধ করেননি। এটা ইতিহাসের একটি সর্বজন স্বীকৃত ঘটনা যে, ইমাম আলী (আ.) খাইবারের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দূর্গম দূর্গের বিশাল লৌহ ত্বোরণটি তাঁর হাতের সামান্য ধাক্কার মাধ্যমে সম্পূর্ণ রূপে উপড়ে ফেলেছিলেন। একইভাবে মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে ইমাম আলী (আ.) কা’বা ঘরের মূর্তিগুলো ধ্বংস করেন। ‘আকিক’ পাথরের তৈরী ‘হাবল’ নামক মক্কার সর্ববৃহৎ মূর্তিটি কা’বা ঘরের ছাদে স্থাপিত ছিল। ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর কাঁধে পা রেখে কা’বা ঘরের ছাদে উঠে একাই বৃহাদাকার মূর্তিটির মূলোৎপাটন করে নীচে নিক্ষেপ করেন। খোদাভীতি ও আল্লাহ্‌র ইবাদতের ক্ষেত্রে ইমাম আলী (আ.) ছিলেন অনন্য। জনৈক ব্যক্তির প্রতি ইমাম আলী (আ.)-এর রূঢ় ব্যবহারের অভিযোগের উত্তরে মহানবী (সা.) তাকে বলেছিলেন যে, “আলীকে তিরস্কার করো না। কেননা সে তো আল্লাহ‌ প্রেমিক”। একবার রাসুল (সা.)-এর সাহাবী হযরত আবু দার্‌দা (রা.) কোন এক খেজুর বাগানে ইমাম আলী (আ.)-এর দেহকে শুষ্ক ও নিষপ্রাণ কাঠের মত পড়ে থাকতে দেখেন। তাই সাথে সাথে নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছে তাঁর স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছালেন এবং নিজের পক্ষ থেকে শোকও জ্ঞাপন করেন। কিন্তু ঐ সংবাদ শুনে হযরত ফাতিমা (আ.) বললেন ঃ “না, আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেননি। বরং ইবাদত করার সময় আল্লাহ্‌র ভয়ে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন। আর এ অবস্থা তাঁর ক্ষেত্রে বহু বারই ঘটেছে।” অধীনস্থদের প্রতি দয়াশীলতা, অসহায় ও নিঃস্বদের প্রতি ব্যথিত হওয়া এবং দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি পরম উদারতার ব্যাপার ইমাম আলী (আ.)-এর জীবনে অসংখ্য ঘটনার অস্তিত্ব বিদ্যমান। ইমাম আলী (আ.) যা-ই উপার্জন করতেন, তাই অসহায় ও দরিদ্রদেরকে সাহায্যের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র পথে দান করতেন। আর তিনি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সহজ সরল ও কষ্টপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। ইমাম আলী (আ.) কৃষি কাজকে পছন্দ করতেন। তিনি সাধারণতঃ পানির নালা কেটে সেচের ব্যবস্থা করতেন। বৃক্ষ রোপণ করতেন। চাষের মাধ্যমে মৃত জমি আবাদ করতেন। কিন্তু পানি সেচের নালা ও আবাদকৃত সব জমিই তিনি দরিদ্রদের জন্যে ‘ওয়াকফ’ (দান) করতেন। হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে দরিদ্রদের জন্যে ‘ওয়াকফ’কৃত ঐসব সম্পত্তির বার্ষিক গড় আয়ের পরিমাণ ২৪ হাজার সোনার দিনারের সমতুল্য ছিল। তাঁর ঐসব ‘ওয়াকফ্‌’কৃত সম্পত্তি ‘আলী (আ.)-এর সাদ্‌কা’ নামে খ্যাত ছিল।নিবেদক মোঃ জাহিদ হুসাইন

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-ই সর্বপ্রথম ইমাম। তিনি মহানবী (সা.) এর চাচা এবং বনি হাশেম গোত্রের নেতা জনাব আবু তালিবের সন্তান ছিলেন।

প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর এই চাচাই শৈশবেও তাঁর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজের ঘরে মহানবী (সা.)-কে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং লালন পালনের মাধ্যমে তাঁকে বড় করেছিলেন। মহানবী (সা.)এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার পর থেকে নিয়ে যত দিন তিনি (আবু তালিব) জীবিত ছিলেন, মহানবী (সা.)-কে সার্বিক সহযোগিতা ও সমর্থন করেছিলেন। তিনি সবসময়ই মহানবী (সা.)-কে কাফেরদের, বিশেষ করে কুরাইশদের সার্বিক অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন। হযরত ইমাম আলী (আ.) (প্রশিদ্ধ মতানুযায়ী) মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার প্রায় দশ বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর জন্মের প্রায় ছ’বছর পর মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর আবেদনক্রমে ঐসময় হযরত আলী (আ.) বাবার বাড়ী থেকে মহানবী (সা.)-এর বাড়ীতে স্থানান্তরিত হন। তারপর থেকে হযরত ইমাম আলী (আ.) সরাসরি মহানবী (সা.)-এর অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধানে তাঁর কাছে লালিত পালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। মহানবী (সা.) হেরা গুহায় অবস্থানকালে তাঁর কাছে সর্বপ্রথম আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘ওহী’ বা ঐশীবাণী অবর্তীণ হয়। যার ফলে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। এরপর হেরা গুহা থেকে বের হয়ে মহানবী (সা.) নিজ গৃহে যাওয়ার পথে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে এবং তিনি তাঁর কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন। হযরত ইমাম আলী (আ.) সাথে সাথেই মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন। অতঃপর নিকট আত্মীয়দেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্‌বান জানানোর উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) তাদের সবাইকে নিজ বাড়ীতে খাওয়ার আমন্ত্রন জানিয়ে সমবেত করেন। ঐ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সবার প্রতি লক্ষ্য করে মহানবী (সা.) বলেছিলেন যে, ‘আপনাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম আমার আহ্‌বানে (ইসলাম গ্রহণে) সাড়া দেবে, সেই হবে আমার খলিফা, উত্তরাধিকারী এবং প্রতিনিধি। কিন্তু উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে একমাত্র যে ব্যক্তিটি সর্বপ্রথম উঠে দাঁড়িয়ে সেদিন বিশ্বনবী (সা.)-এর আহ্‌বানে সাড়া দিয়েছিল এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল তিনিই হচ্ছেন হযরত ইমাম আলী (আ.)। আর বিশ্বনবী (সা.) সেদিন (তাঁর প্রতি) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ঈমানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং স্বঘোষিত প্রতিশ্রুতিও তিনি তার ব্যাপারে পালন করেছিলেন। এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলিম। আর তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি কখনই মূর্তিপুজা করেননি। মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গমনের পূর্ব পর্যন্ত হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী। মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা গমনের রাতে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই মহানবী (সা.) এর বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ঐ রাতেই কাফেররা মহানবী (সা.) এর বাড়ী ঘেরাও করে শেষরাতের অন্ধকারে মহানবী (সা.)-কে বিছানায় শায়িত অবস্থায় হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। মহানবী (সা.) কাফেরদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হবার পূর্বেই গৃহত্যাগ করে মদীনার পথে পাড়ি দিয়েছিলেন। এরপর হযরত ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর কাছে গচ্ছিত জনগণের আমানতের মালা-মাল তাদের মালিকদের কাছে পৌঁছে দেন। তারপর তিনিও নিজের মা, নবী কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) ও অন্য দু’জন স্ত্রীলোক সহ মদীনার পথে পাড়ি দেন। এমনকি মদীনাতেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী। নির্জনে অথবা জনসমক্ষে তথা কোন অবস্থাতেই মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখেননি। তিনি স্বীয় কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-কেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছেই বিয়ে দেন। সাহাবীদের উপস্থিতিতে মহানবী (সা.), হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপনের ঘোষণা দেন। একমাত্র ‘তাবুকের’ যুদ্ধ ছাড়া বিশ্ব নবী (সা.) (স্বীয় জীবদ্দশায়) যত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, হযরত ইমাম আলী (আ.)-ও সেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন। এ ছাড়াও হযরত ইমাম আলী (আ.) কোন যুদ্ধেই আদৌ পিছপা হননি। জীবনে কোন শত্রুর মোকাবিলায় তিনি পৃষ্ঠ প্রর্দশন করেননি। তিনি জীবনে কখনোই মহানবী (সা.)-এর আদেশের অবাধ্যতা করেননি। তাই তাঁর সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন যে, “আলী কখনই সত্য থেকে অথবা সত্য আলী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।” বিশ্ব নবী (সা.)-এর মৃত্যুর সময় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বয়স ছিল প্রায় তেত্রিশ বছর। বিশ্বনবী (সা.)-এর সকল সাহাবীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ইসলামের সকল মহত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন তিনিই। সাহাবীদের মধ্যে হযরত ইমাম আলী (আ.) বয়সের দিক থেকে ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ। আর ইতিপূর্বে বিশ্বনবী (আ.)-এর পাশাপাশি অংশগ্রহণকৃত যুদ্ধসমূহে যে রক্তপাত ঘটেছিল, সে কারণে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি অনেকেই শত্রুতা পোষণ করত। এসব কারণেই বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরলোক গমনের পর হযরত আলী (আ.)-কে খেলাফতের পদাধিকার লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। আর এর মাধ্যমে সকল রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাই বাধ্য হয়ে তখন তিনি নিরালায় জীবন যাপন করতে শুরু করেন এবং ব্যক্তি প্রশিক্ষণের কাজে নিজেকে ব্যপৃত করেন। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর তিনজন খলিফার শাসনামল শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই জীবন যাপন করতে থাকেন। তারপর তৃতীয় খলিফা নিহত হবার পর জনগণ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে ‘বাইয়াত’ (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন এবং তাঁকে খেলাফতের পদে অধিষ্ঠিত করেন।হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকাল ছিল প্রায় ৪ বছর ৯ মাস। তিনি তাঁর এই খেলাফতের শাসন আমলে সম্পূর্ণরূপে মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করেন। তিনি তাঁর খেলাফতকে আন্দোলনমুখী এক বিপ্লবীরূপ প্রদান করে ছিলেন। তিনি তাঁর শাসন আমলে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। অবশ্য ইমাম আলী (আ.)-এর ঐসব সংস্কারমূলক কর্মসূচী বেশকিছু সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির ক্ষতির কারণ ঘটিয়ে ছিল। এ কারণে উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা, তালহা, যুবাইর ও মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে বেশকিছু সংখ্যক সাহাবী হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের দাবীর শ্লোগানকে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। আর তারা ইসলামী রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত করার মাধ্যমে এক ব্যাপক রাজনৈতিক অরাজকতার সৃষ্টি করে। যার ফলে উদ্ভুত ফিৎনা ও অরাজকতা দমনের জন্যে বস্‌রার সন্নিকটে ইমাম আলী (আ.) নবীপত্নি আয়েশা, তালহা, ও যুবায়েরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবর্তীণ হতে বাধ্য হন। ইসলামী ইতিহাসের ঐ যুদ্ধিটিই ‘জঙ্গে জামাল’ নামে পরিচিত। এ ছাড়াও ইরাক ও সিরিয়া সীমানে- অনুরূপ কারণে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে হযরত ইমাম আলী (আ.) ‘সিফফিন’ নামক আরও একটি যুদ্ধে অবর্তীণ হতে বাধ্য হন। ‘সিফফিন’ নামক ঐ যুদ্ধ দীর্ঘ দেড় বছর যাবৎ অব্যাহত ছিল। ঐ যুদ্ধ শেষ না হতেই ‘নাহ্‌রাওয়ান’ নামক স্থানে ‘খাওয়ারেজ’ (ইসলাম থেকে বহিস্কৃত) নামক বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। ঐ যুদ্ধিটি ইতিহাসে ‘নাহ্‌রাওয়ানের’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালই আভ্যন্তরীণ মতভেদ জনিত সমস্যা সমাধানের মধ্যেই অতিক্রান্ত হয়। এর কিছুদিন পরই ৪০ হিজরীর রমযান মাসের ১৯ তারীখে কুফার মসজিদে ফজরের নামাযের ইমামতি করার সময় জনৈক ‘খারেজির’ তলোয়ারের আঘাতে তিনি আহত হন। অতঃপর ২০শে রমযান দিবাগত রাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। ইতিহাসের সাক্ষ্য এবং শত্রু ও মিত্র, উভয়পক্ষের স্বীকারোক্তি অনুসারে মানবীয় গুণাবলীর দিক থেকে আমিরুল মু’মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এ ব্যাপারে সামান্যতম ক্রটির অস্তিত্বও তাঁর চরিত্রে ছিল না। আর ইসলামে মহত গুণাবলীর দিক থেকে তিনি ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)-এর আদর্শের এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিভু।ইমাম আলী (আ.)-এর মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এ যাবৎ যত আলোচনা হয়েছে এবং শীয়া, সুন্নী, জ্ঞানী গুণী ও গবেষকগণ যে পরিমাণ গ্রন্থাবলী তাঁর সম্পর্কে আজ পর্যন্ত রচনা করেছেন, ইতিহাসে এমনটি আর অন্য কারও ক্ষেত্রেই ঘটেনি। হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সকল মুসলমান এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানীব্যক্তি। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি তাঁর অগাধ জ্ঞানগর্ভ বর্ণনার মাধ্যমে ইসলামে যুক্তিভিত্তিক প্রমাণ পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেন। এভাবে তিনিই সর্ব প্রথম ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারে দর্শন চর্চার মাত্রা যোগ করেন। তিনিই কুরআনের জটিল ও রহস্যপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা করেন। কুরআনের বাহ্যিক শব্দাবলীকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্যে তিনি আরবী ভাষার ব্যাকরণ শাস্ত্র রচনা করেন। বীরত্বের ক্ষেত্রেও হযরত আলী (আ.) ছিলেন মানবজাতির জন্য প্রতীক স্বরূপ। বিশ্ব নবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর পরেও জীবনে যত যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেছেন, কখনোই তাঁকে ভীত-সন্ত্রস্ত হতে বা মানসিক অস্থিরতায় ভূগতে দেখা যায়নি। এমনকি ওহুদ, হুনাইন, খান্দাক এবং খাইবারের মত কঠিন যুদ্ধগুলো যখন মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং সাহাবীরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেই কঠিন মূহুর্তগুলোতেও হযরত ইমাম আলী (আ.) কখনোই শত্রুদের সম্মুখে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেননি। ইতিহাসে এমন একটি ঘটনাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোন খ্যাতিমান বীর যোদ্ধা ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিরাপদে নিজের প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছে। তিনি এমন মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও কখনও কোন দূর্বল লোককে হত্যা করেননি এবং তাঁর নিকট থেকে পালিয়ে যাওয়া (প্রাণ ভয়ে) ব্যক্তির পিছু ধাওয়া করেননি। তিনি কখনোই রাতের আঁধারে শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমন চালাননি। শত্রুপক্ষের জন্য পানি সরবরাহ কখনোই তিনি বন্ধ করেননি। এটা ইতিহাসের একটি সর্বজন স্বীকৃত ঘটনা যে, ইমাম আলী (আ.) খাইবারের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দূর্গম দূর্গের বিশাল লৌহ ত্বোরণটি তাঁর হাতের সামান্য ধাক্কার মাধ্যমে সম্পূর্ণ রূপে উপড়ে ফেলেছিলেন। একইভাবে মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে ইমাম আলী (আ.) কা’বা ঘরের মূর্তিগুলো ধ্বংস করেন। ‘আকিক’ পাথরের তৈরী ‘হাবল’ নামক মক্কার সর্ববৃহৎ মূর্তিটি কা’বা ঘরের ছাদে স্থাপিত ছিল। ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর কাঁধে পা রেখে কা’বা ঘরের ছাদে উঠে একাই বৃহাদাকার মূর্তিটির মূলোৎপাটন করে নীচে নিক্ষেপ করেন। খোদাভীতি ও আল্লাহ্‌র ইবাদতের ক্ষেত্রে ইমাম আলী (আ.) ছিলেন অনন্য। জনৈক ব্যক্তির প্রতি ইমাম আলী (আ.)-এর রূঢ় ব্যবহারের অভিযোগের উত্তরে মহানবী (সা.) তাকে বলেছিলেন যে, “আলীকে তিরস্কার করো না। কেননা সে তো আল্লাহ‌ প্রেমিক”। একবার রাসুল (সা.)-এর সাহাবী হযরত আবু দার্‌দা (রা.) কোন এক খেজুর বাগানে ইমাম আলী (আ.)-এর দেহকে শুষ্ক ও নিষপ্রাণ কাঠের মত পড়ে থাকতে দেখেন। তাই সাথে সাথে নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছে তাঁর স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছালেন এবং নিজের পক্ষ থেকে শোকও জ্ঞাপন করেন। কিন্তু ঐ সংবাদ শুনে হযরত ফাতিমা (আ.) বললেন ঃ “না, আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেননি। বরং ইবাদত করার সময় আল্লাহ্‌র ভয়ে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন। আর এ অবস্থা তাঁর ক্ষেত্রে বহু বারই ঘটেছে।” অধীনস্থদের প্রতি দয়াশীলতা, অসহায় ও নিঃস্বদের প্রতি ব্যথিত হওয়া এবং দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি পরম উদারতার ব্যাপার ইমাম আলী (আ.)-এর জীবনে অসংখ্য ঘটনার অস্তিত্ব বিদ্যমান। ইমাম আলী (আ.) যা-ই উপার্জন করতেন, তাই অসহায় ও দরিদ্রদেরকে সাহায্যের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র পথে দান করতেন। আর তিনি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সহজ সরল ও কষ্টপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। ইমাম আলী (আ.) কৃষি কাজকে পছন্দ করতেন। তিনি সাধারণতঃ পানির নালা কেটে সেচের ব্যবস্থা করতেন। বৃক্ষ রোপণ করতেন। চাষের মাধ্যমে মৃত জমি আবাদ করতেন। কিন্তু পানি সেচের নালা ও আবাদকৃত সব জমিই তিনি দরিদ্রদের জন্যে ‘ওয়াকফ’ (দান) করতেন। হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে দরিদ্রদের জন্যে ‘ওয়াকফ’কৃত ঐসব সম্পত্তির বার্ষিক গড় আয়ের পরিমাণ ২৪ হাজার সোনার দিনারের সমতুল্য ছিল। তাঁর ঐসব ‘ওয়াকফ্‌’কৃত সম্পত্তি ‘আলী (আ.)-এর সাদ্‌কা’ নামে খ্যাত ছিল।

নিবেদক মোঃ জাহিদ হুসাইন

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদপবিত্র কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর হাদিস থেকে আমিরুল মোমেনীন আলী ইবনে আবি তালিব আঃ এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিসমহানবী হযরত মুহাম্মদ ‎(সা.)-এর উত্তরাধিকারী,তাঁর নবুওয়াতের মিশনের প্রধান সাহায্যকারী এবং দুনিয়া ও আখেরাতে রাসূলের ভ্রাতা আলী ‎(আ.) ‏আবরাহার পবিত্র মক্কা আক্রমণের ৩৩ বছর পর ১৩ রজব পবিত্র কা’বা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। মহান আল্লাহর আদেশে তাঁর নাম রাখা হয় আলী।শিশুকাল থেকেই মহানবী ‎(সা.)-এর সাথে হযরত আলীর বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কে আলী ‎(আ.) ‏নিজেই বলেছেন ‎: ‘...তিনি আমাকে তাঁর কোলে রাখতেন যখন আমি শিশু ছিলাম। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং তাঁর বিছানায় শুইয়ে রাখতেন। তাঁর পবিত্র দেহ আমার দেহকে স্পর্শ করত এবং তিনি আমাকে তাঁর শরীরের সুগন্ধির ঘ্রাণ নেওয়াতেন। তিনি খাদ্য-দ্রব্য চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন।...’১হযরত আবু তালিবের সংসারের ব্যয়ভার কমানোর জন্য হযরত আলীর বালক বয়সেই মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখন থেকে তিনি রাসূলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে যান। রাসূল হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর ইবাদাত করতে গেলেও তাঁকে সাথে নিয়ে যেতেন। হযরত আলী বলেন ‎: ‘তিনি ‎(মহানবী) ‏প্রতি বছর হেরাগুহায় একান্ত নির্জনে বাস করতেন। আমি তাঁকে দেখতাম। আমি ব্যতীত আর কোন লোকই তাঁকে দেখতে পেত না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ ও খাদীজাহ্ ব্যতীত কোন মুসলিম পরিবারই পৃথিবীর বুকে ছিল না। আমি ছিলাম তাঁদের পরিবারের তৃতীয় সদস্য। আমি ওহী ও রেসালতের আলো প্রত্যক্ষ করেছি এবং নবুওয়াতের সুবাস ও সুঘ্রাণ অনুভব করেছি।’২তিনি মহানবীর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করতেন। তিনি বলেন ‎: ‘উষ্ট্র শাবক যেমনভাবে উষ্ট্রীকে অনুসরণ করে ঠিক সেভাবে আমি তাঁকে অনুসরণ করতাম। তিনি প্রতিদিন তাঁর উন্নত চরিত্র থেকে একটি নিদর্শন আমাকে শিক্ষা দিতেন এবং আমাকে তা পালন করার নির্দেশ দিতেন।... ‏তাঁর ওপর যখন ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল তখন আমি শয়তানের ক্রন্দন ধ্বনি শুনেছিলাম। তাই আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‎: ‏হে রাসূলুল্লাহ্! ‏এ ক্রন্দন ধ্বনি কার? ‏তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন ‎: ‏এই শয়তান এখন থেকে তার পূজা ‎(ইবাদাত) ‏করা হবে না বলে হতাশ হয়ে গেছে। নিশ্চয় আমি যা শুনি তুমি তা শোন এবং আমি যা দেখি তা দেখ। তবে তুমি নবী নও,কিন্তু ‎[নবীর] ‏সহকারী এবং নিঃসন্দেহে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণের ওপরই আছ।’৩আর তাই মহানবী ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর ওপর ঈমান আনেন এবং তিনিই তাঁর সাথে নামায আদায় করা প্রথম ব্যক্তি। ইমাম মালেক বর্ণনা করেছেন ‎: ‘মহানবী ‎(সা.) ‏সোমবারে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন এবং আলী মঙ্গলবারে তাঁর ওপর ঈমান আনেন।’৪হযরত আলী নিজেই বলেন ‎: ‘আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূলের ভ্রাতা এবং তাঁর নবুওয়াতের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসস্থাপনকারী। একমাত্র মিথ্যাবাদী ছাড়া আমার পর কেউ এ দাবি করবে না। অন্য লোকদের নামায পড়ারও ৭ বছর আগে থেকে আমি নামায পড়েছি।’৫হযরত আলী ‎(আ.)-এর প্রসিদ্ধ উপাধিরাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে সিদ্দিকে আকবার,ফারুকে আযম,আসাদুল্লাহ ও মুরতাজা।পবিত্র কুরআনে হযরত আলী ‎(আ.)-এর মর্যাদাহযরত আলীর শানে পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,কোন ব্যক্তির গুণ বর্ণনায় এত অধিক কুরআনের বাণী অবতীর্ণ হয়নি যা হযরত আলী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস আরও বলেছেন যে,হযরত আলীর শানে তিনশ’ ‏আয়াত নাযিল হয়েছে এবং তাঁর গুণাবলি অত্যধিক ও প্রসিদ্ধ।৬ পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত আয়াতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াতوَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ‘এবং মানুষের মধ্যে এমনও আছে,যে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিক্রয় করে দেয় এবং আল্লাহ ‎(এরূপ) ‏বান্দাদের প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল।’সালাবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিলেন সেই সময় হযরত আলীকে তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকার নির্দেশ দেন যাতে কাফির-মুশরিকরা মনে করে যে,রাসূল তাঁর নিজ ঘরেই রয়েছেন। আলী ‎(আ.) ‏নির্দ্বিধায় এ নির্দেশ পালন করলে মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন।৭ ২. ‏সূরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াতفَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ‘অতঃপর তোমার নিকট যখন জ্ঞান ‎(কুরআন) ‏এসে গেছে,এরপরও যদি কেউ ‎(খ্রিস্টান) ‏তোমার সাথে তার ‎(ঈসার) ‏সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করে,তবে বল,‘(ময়দানে) ‏এস,আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের ও তোমাদের পুত্রদের,আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের সত্তাদের ও তোমাদের সত্তাদের;’ ‏অতঃপর সকলে মিলে ‎(আল্লাহর দরবারে) ‏নিবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি।’ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের সত্যতা যাচাই করার জন্য নাজরানের একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল মদীনায় আসল। তাদের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ হলো না। রাসূল ‎(সা.) ‏হযরত ঈসা ‎(আ.) ‏সম্বন্ধে প্রতিনিধিদের বললেন যে,তিনি আল্লাহর পুত্র নন,বরং আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। রাসূলুল্লাহ্ হযরত ঈসার জন্মের ব্যাপারে হযরত আদমের উদাহরণও দিলেন। কিন্তু তারা কোন কথাই শুনল না। অবশেষে তিনি আল্লাহর আদেশে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোয়া ও মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিশাপ বর্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন,যাকে ‎‘মুবাহিলা’ ‏বলে। স্থির করা হল যে,নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে উভয়ে নিজ নিজ পুত্রদের,নারীদের ‎(কন্যা সন্তানদের) ‏এবং তাদের নিজেদের ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে একত্র হবে এবং প্রত্যেকে অপরের প্রতি অভিসম্পাত ও আল্লাহর শাস্তি কামনা করবে। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হুসাইনকে কোলে নিয়ে ইমাম হাসানের হাত ধরলেন এবং হযরত ফাতিমাকে নিজের পেছনে,আর হযরত আলীকে তাঁর পেছনে রাখলেন। অর্থাৎ ছেলেদের স্থানে তিনি নাতিদের,নারীদের স্থানে নিজ কন্যাকে এবং ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্যদের স্থানে আলীকে নিলেন এবং দোয়া করলেন,‘হে আল্লাহ! ‏প্রত্যেক নবীর আহলে বাইত থাকে,এরা আমার আহলে বাইত। এদের সকল দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত ও পাক-পবিত্র রেখ।’ ‏তিনি এভাবে ময়দানে পৌঁছলে খ্রিস্টানদের নেতা আকব তা দেখে বলল,‘আল্লাহর কসম,আমি এমন নূরানী চেহারা দেখছি যে,যদি এ পাহাড়কে নিজ স্থান হতে সরে যেতে বলেন,তবে অবশ্যই সরে যাবে। সুতরাং মুবাহিলা হতে হাত গুটিয়ে নেওয়াই কল্যাণকর,অন্যথায় কিয়ামত অবধি খ্রিস্টানদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।’ ‏পরিশেষে তারা জিযিরা কর দিতে সম্মত হল। এটা হযরত আলীর একটি উঁচু স্তরের ফযিলত যে,তিনি আল্লাহর আদেশে রাসূলের ‎‘নাফ্স’ (অনুরূপ সত্তা) ‏সাব্যস্ত হলেন এবং সমুদয় নবীর থেকে শ্রেষ্ঠ হলেন।৮৩. ‏সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াত ‎يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ‘হে বিশ্বাসিগণ! ‏তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যে যারা নির্দেশের অধিকর্তা,তাদের আনুগত্য কর...।’ইমাম জাফর সাদিক ‎(আ.)- ‏কে জিজ্ঞেস করা হলো যে,উত্তরাধিকারীর আদেশ মান্য করা কি অবশ্যই কর্তব্য? ‏তিনি বললেন ‎: ‏হ্যাঁ,তাঁরা ঐসব ব্যক্তি যাঁদের আদেশ পালন করা এ আয়াতে ওয়াজিব করা হয়েছে...। এ আয়াত হযরত আলী বিন আবি তালিব,হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন ‎(আ.)-এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে।৯ ৪. ‏সূরা মায়েদার ৫৫ নং আয়াতإِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ‘(হে বিশ্বাসিগণ!) ‏তোমাদের অভিভাবক তো কেবল আল্লাহ,তাঁর রাসূল এবং সেই বিশ্বাসীরা যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করে।’শীয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের তফসীরকাররা একমত যে,আয়াতটি হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে। যেমন ইবনে মারদুইয়া এবং খাতীব বাগদাদী ইবনে আব্বাস সূত্রে এবং তাবরানী ও ইবনে মারদুইয়া আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আলী ইবনে আবি তালিব সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি আলী ইবনে আবি তালিব ‎(আ.) ‏সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে যখন তিনি রুকু অবস্থায় যাকাত দেন।ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏একদিন হযরত আলী ‎(আ.) ‏মদীনার মসজিদে নামায পড়ছিলেন। এমন সময় একজন ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইল। কিন্তু কোন ভিক্ষা না পাওয়ায় সে ফরিয়াদ করল যে,রাসূলের মসজিদ থেকে সে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। এ সময় হযরত আলী রুকু অবস্থায় ছিলেন। তিনি সেই অবস্থায় তাঁর ডান হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নেওয়ার জন্য ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করেন। ভিক্ষুক তাঁর হাত থেকে আংটি খুলে নেয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে উপরিউক্ত আয়াত নাযিল হয়।১০৫. ‏সূরা মায়েদার ৬৭ নং আয়াতيَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ‘হে রাসূল! ‏যা ‎(যে আদেশ) ‏তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দাও,আর যদি তুমি তা না কর,তবে তুমি ‎(যেন) ‏তার কোন বার্তাই পৌঁছাওনি,এবং ‎(তুমি ভয় কর না) ‏আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন;এবং নিশ্চয় আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালিত করেন না।’যখন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏দশম হিজরিতে বিদায় হজ্ব থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন সে সময় আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। ইবনে আবী হাতিম ও ইবনে আসাকির আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণনা করেছেন যে,এ আয়াত গাদীরে খুম প্রান্তরে হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে।বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করার সময় গাদীরে খুম নামক স্থানে মহানবী ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে তাঁর পরে সকল মুমিনের অভিভাবক বলে ঘোষণা দেন।১১এ ঘোষণা দেয়ার পর হযরত ওমর হযরত আলীর সাথে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানান এবং বলেন ‎: ‘হে আলী ইবনে আবি তালিব! ‏আপনি আজ হতে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর মাওলা হয়ে গেলেন।’১২৬. ‏সূরা রাদের ৭ নং আয়াতإِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ‘(হে রাসূল!) ‏তুমি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে এক পথ প্রদর্শক।’ইবনে মারদুইয়্যা,ইবনে জারীর,আবু নাঈম তাঁর ‎‘মারেফাত’ ‏গ্রন্থে,ইবনে আসাকির,দাইলামী ও ইবনে নাজ্জার তাঁদের স্ব স্ব গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি নাযিল হলে মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁর হাত নিজের বুকে রেখে বললেন,‘আমিই সতর্ককারী।’ ‏অতঃপর আলীর কাঁধের প্রতি তাঁর হাত দ্বারা ইশারা করে বললেন,‘হে আলী! ‏তুমিই পথপ্রদর্শক এবং মানুষ আমার পর তোমার মাধ্যমে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।’ ‏উক্ত রেওয়ায়েতটি শব্দের তারতম্যে ইবনে মারদুইয়্যা সাহাবী আবু বারযাহ আসলামী হতে,জীয়াফীল হযরত ইবনে আব্বাস হতে,ইবনে আহমাদ তাঁর মুসনাদে এবং ইবনে মারদুইয়্যা ও ইবনে আসাকির স্বয়ং হযরত আলী ‎(আ.) ‏হতে বর্ণনা করেছেন।১৩৭. ‏সূরা রাদের ৪৩ নং আয়াতوَيَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَسْتَ مُرْسَلًا قُلْ كَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَمَنْ عِنْدَهُ عِلْمُ الْكِتَابِযারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে,‘তুমি আল্লাহর রাসূল নও।’ ‏তুমি বল,‘আমার ও তোমাদের মধ্যে ‎(রেসালাতের) ‏সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সেই ব্যক্তি যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান রয়েছে।’অধিকাংশ তাফসীরকার স্বীকার করেছেন যে,আয়াতে বর্ণিত সেই ব্যক্তি হলেন হযরত আলী ‎(আ.)। যেমন আসমী ‎‘যায়নুল ফাতা’ ‏নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং সা’লাবী আবদুল্লাহ ইবনে আতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,আবদুল্লাহ বিন সালাম বলতেন,‘যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান আছে’-এর উদ্দিষ্ট হযরত আলী ‎(আ.)। এজন্যই হযরত আলী ‎(আ.) ‏বারবার বলতেন,‘আমার কাছে আমার মৃত্যুর পূর্বে যা চাও জিজ্ঞেস কর।’১৪৮. ‏সূরা নাহলের ৪৩ নং আয়াতوَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَতোমার পূর্বেও আমরা কেবল পুরুষদেরই ‎(রাসূল করে) ‏প্রেরণ করেছি যাদের প্রতি আমরা প্রত্যাদেশ প্রেরণ করতাম;যদি তোমরা না জেনে থাক তবে যারা জানে তাদের জিজ্ঞেস কর।আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন ‎: ‏জ্ঞানী ব্যক্তিরা অর্থাৎ আহলুয যিকর হলেন হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.),হযরত আলী ‎(আ.),হযরত ফাতেমা ‎(আ.),হযরত হাসান ও হুসাইন ‎(আ.)। যাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেছেন ‎: ‏যখন এই আয়াত নাযিল হল তখন হযরত আলী বললেন ‎: ‏আমরাই হলাম জ্ঞানের ভাণ্ডার।১৫৯. ‏সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতوَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا‘হে নবী পরিবার! ‏আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামার ঘরে এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত ফাতিমা,ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ‎(আ.)-কে ডাকেন এবং তাঁদেরকে একটি চাদরে ঢেকে নেন। হযরত আলী তাঁর পেছনে ছিলেন। তিনি তাঁকেও চাদরে ঢেকে নেন। অতঃপর বলেন ‎: ‘হে আল্লাহ্! ‏এরা আমার আহলে বাইত। অতএব,তুমি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে দাও এবং তাদেরকে উত্তমরূপে পবিত্র কর।’ ‏তখন উম্মে সালামা বলেন ‎: ‘হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমিও কি তাদের অন্তর্ভুক্ত?’ ‏তিনি বলেন ‎: ‘তুমি স্ব স্থানে আছ এবং তুমি কল্যাণের মধ্যেই আছ।’১৬হযরত উম্মে সালামা ছাড়াও হযরত আবু সাঈদ খুদরী ও আনাস ইবনে মালিক কর্তৃক এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।১৭১০. ‏সূরা শূরার ২৩ নং আয়াতقُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى‘বল,আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা ছাড়া আর কোন প্রতিদান চাই না।’রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নিকটাত্মীয় আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি ভালবাসা পোষণকে এ আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য ফরয বলে ঘোষণা করেন।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন ‎: ‏যখন এ আয়াত নাযিল হল তখন সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন,হে রাসূলুল্লাহ! ‏আপনার নিকটাত্মীয়,যাদেরকে ভালবাসা আমাদের ওপর ওয়াজিব করা হয়েছে তারা কারা? ‏রাসূল ‎(সা.) ‏বললেন ‎: ‏আলী,ফাতেমা,হাসান ও হুসাইন।১৮রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর হাদীসে আলী ‎(আ.)হযরত আলীর মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী ‎(সা.)-এর নিকট থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বলেন,নবী ‎(সা.) ‏তাবুক যুদ্ধের সময় আলীকে লক্ষ্য করে বলেছেন ‎: ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে,মর্যাদার দিক থেকে মূসার নিকট হারুন যে পর্যায়ে ছিলেন,তুমিও আমার নিকট ঐ পর্যায়ে রয়েছ?’১৯২. ‏অন্য একটি হাদীসে এসেছে ‎: ‏রাসূল বলেন ‎: ‘তুমি তো আমার নিকট তদ্রূপ যেরূপ হারুনের স্থান মূসার নিকট। পার্থক্য এতটুকু যে,আমার পরে কোন নবী নেই।’২০৩. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হাসান ও হুসাইনের হাত ধরে বলেন ‎: ‘যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসে এবং এ দু’জন ও তাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসে,সে কিয়ামতের দিন আমার সাথে একই মর্যাদায় অবস্থান করবে।’২১৪. ‏আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত। রাসূল বলেছেন ‎: ‘আলীর চেহারার দিকে তাকানোও ইবাদত।’২২৫. ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.) ‏আলী ‎(আ.)-কে সম্বোধন করে বলেছিলেন ‎: ‘মুমিনরাই তোমাকে মহব্বত করবে এবং মুনাফিকরাই তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে।’২৩৬. ‏তিরমিযী,নাসাঈ ও ইবনে মাযাহ হুবশী ইবনে জুনাদাহ্ ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূল ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘আলী আমা থেকে এবং আমি আলী থেকে। যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আমাকে ভালোবেসেছে। আর যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আল্লাহকে ভালবেসেছে। যে ব্যক্তি আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে সে আমার সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে। আর যে আমার শত্রু সে আল্লাহর শত্রু। যে ব্যক্তি আলীকে কষ্ট দিয়েছে,সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে।’২৪৭. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‘(হে আলী!) ‏দুনিয়া ও আখেরাতে তুমি আমারই ভাই।’২৫৮. ‏আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা ‎(র.) ‏থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘চার ব্যক্তিকে ভালবাসতে আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন এবং তিনি আমাকে এও অবহিত করেছেন যে,তিনিও তাদের ভালবাসেন। বলা হল ‎: ‏হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমাদের তাদের নামগুলো বলুন। তিনি বলেন ‎: ‏আলীও তাদের অন্তর্ভুক্ত। এ কথা তিনি তিনবার বলেন। ‎(অবশিষ্ট তিনজন হলেন) ‏আবু যার,মিকদাদ ও সালমান।...’২৬৯. ‏জাবির ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏তায়েফ অভিযানের দিন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏আলীকে কাছে ডেকে তার সাথে চুপিসারে আলাপ করেন। লোকেরা বলল ‎: ‏তিনি তাঁর চাচাত ভাইয়ের সাথে দীর্ঘক্ষণ চুপিসারে কথা বললেন। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‏আমি তার সাথে চুপিসারে কথা বলিনি;বরং আল্লাহই তার সাথে চুপিসারে কথা বলেছেন। ‎(অর্থাৎ তার সাথে চুপিসারে কথা বলার জন্য আল্লাহ্ই আমাকে আদেশ করেছেন।)২৭হযরত আলী সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীহযরত আবু বকর প্রায়ই হয়রত আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। হযরত আয়েশা এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন ‎: ‘আমি রাসূলে করীমকে বলতে শুনেছি,আলীর মুখ দেখা ইবাদাতের শামিল।’২৮হযরত উমর বিন খাত্তাব বলতেন,হযরত আলী বিন আবি তালিবের তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল। যদি তার একটি আমার থাকত তাহলে আমি বলতাম যে,আমাকে লাল রঙের একটি উট দেয়া হলে তা অপেক্ষাও আমি তা পছন্দ করতাম। তাঁকে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ‎: ‏১.তাঁর বিয়ে হয় রাসূল ‎(সা.)-এর কন্যার সাথে,২. ‏তাঁর সঙ্গে রাসূলে করীমের মসজিদে অবস্থান এবং যা রাসূলে করিমের জন্য বৈধ ছিল তার জন্যও তা বৈধ ছিল এবং ৩. ‏খায়বার যুদ্ধের পতাকা বহনের দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল।২৯হযরত উমর বলেছেন,হে আল্লাহ! ‏আমার ওপর এমন কোন বিপদ দিও না যখন আবুল হাসান ‎(আলী) ‏আমার নিকট উপস্থিত না থাকে। কারণ,তিনি আমার নিকট উপস্থিত থাকলে আমাকে সে বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দেবেন।’৩০তাবরানী হযরত ইবনে আব্বাস থেকে রেওয়ায়াত করেছেন যে,হযরত আলীর আঠারটি বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যা সমগ্র উম্মতের কারও ছিল না।’৩১তথ্যসূত্র১. ‏মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত নাহজ আল বালাঘা,২য় মুদ্রণ,আল খুতবাতুল কাসেয়াহ্,খুতবা নং ১৯১২. ‏প্রাগুক্ত৩. ‏প্রাগুক্ত৪. ‏মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১১২;এটি ইমাম মালেক কর্তৃক বর্ণিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হেরা গুহায় জিবরাঈল ‎(আ.) ‏কর্তৃক রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নবুওয়াত ঘোষণার পর পরই হযরত আলী ‎(আ.) ‏তাঁর ঈমান আনার বিষয়টি প্রকাশ করেন।৫. ‏সুনানে ইবনে মাজাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৪৪৬. ‏নূর-এ-সাকালাইন কর্তৃক প্রকাশিত,সাইয়্যেদ আলী জাফরী প্রণীত আল মুরতাজা,পৃ. ‏৩০।৭. ‏এহইয়াউ উলুমিদ্দীন,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২৩৮;নুরুল আবসার,পৃ. ‏৮৬,মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৭১;তাযকিরাতু সিবতে ইবনে যাওযী,পৃ. ‏২১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏৯২।৮. ‏তাফসীরে জালালাইন,১ম খণ্ড,পৃ.৬০;বায়দ্বাভী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১১৮,তাফসীরে দুররুল মানসুর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৯,মিশর মুদ্রণ;মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৫;৯. ‏মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏২১;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪৮;তাফসীরে ফুরাত,পৃ.২৮১০. ‏তাফসীরে তাবারী,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৬৫;তাফসীরে রাযী,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪৩১;মানাকেবে খাওয়ারেযমী,পৃ. ‏১৭৮;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏১০২;তাফসীরে ইবনে কাসীর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৭১;আল- ‏বেদায়া ওয়ান নেহায়া,৭ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৫৭;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏২৫;১১. ‏মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৩৭২;ইমাম নাসাঈ প্রণীত খাসায়েসে আমীরুল মুমিনীন,পৃ. ‏২১;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১০৯;আল গাদীর,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২১৪ ও ২২৯;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৭ ।১২. ‏তাফসীরে তাবারী,৩য় খণ্ড,মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল,৩য় খণ্ড,দারে কুতনী।১৩. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৪৫ দ্রষ্টব্য।১৪. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৬৯ ।১৫. ‏কেফাইয়াতুল মুওয়াহহিদীন,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৬৫০;মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৪১৩;কানযুল উম্মাল,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৫৬;তাফসীরে তাবারী,১৪তম খণ্ড,পৃ. ‏১০৮ ।১৬. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৭২৫,পৃ. ‏৩৫৯ ।১৭. ‏মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৩১;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏২১,তাফসীরে তাবারী,২২তম খণ্ড,পৃ. ‏৮;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২০৮;ফাজায়েলে খামসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৪;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১০ ।১৮. ‏যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏৯ ও ১২;তাফসীরে যামাখশারী,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৩৯;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১০১,তাফসীরে দুররুল মানসূর,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏৭;মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৯;আল গাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১৭২;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩০ ।১৯. ‏আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী,৩য় খণ্ড,হাদীস নং ৩৪৩১;বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪২ ।২০. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪০ ও জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৬৮ ।২১. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭০২২. ‏এমদাদীয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ইবনে আবি তালিব ‎(রা.),পৃ. ‏১৫ ।২৩. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭৩ ।২৪. ‏এমদাদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ‎(রা.),পৃ. ‏১৫-১৬ ।২৫. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৫৮;২৬. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৫৬;২৭. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৬৪২৮. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১৭৫ ।২৯. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,৩য় খণ্ড,এবং মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড ।৩০. ‏মুনতাখাবে কানজুল উম্মাল,৩য় খণ্ড ।৩১. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ ১১৩ ।(প্রত্যাশা,৩য় বর্ষ, ‏১ম সংখ্যাপ্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

শিশু ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ.)'র জন্মবার্ষিকীসকল মোমিন মোমিনা কে জানাই ঈদ মোবারক🎂🎂🎂🎂🎂(((পর্ব ১)))🎂🎂🎂🎂🎂দশই রজব ইসলামের মহাখুশির দিন। এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন মাওলা মোহাম্মদ (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য নবম ইমাম হযরত জাওয়াদ বা তাকি(আ)। নবীজীর আহলে বাইতের সদস্যরা কেবল মুসলমানদেরই ধর্মীয় নেতা নন বরং যারাই সত্য পথের সন্ধানী কিংবা কল্যাণকামী-তাদের সবারই নেতা।আহলে বাইতের এই মহান ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ) এর জন্ম-বার্ষিকীতে আপনাদের সবার প্রতি রইলো অশেষ অভিনন্দন ও প্রাণঢালা মোবারকবাদ এবং মাওলা মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম ।ইমাম জাওয়াদের জন্ম হয়েছিল ১৯৫ হিজরিতে তথা ৮১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল পবিত্র মদীনায়। মজলুম ও দরিদ্রদের প্রতি ব্যাপক দানশীলতা ও দয়ার জন্য তিনি 'জাওয়াদ' উপাধি পেয়েছিলেন। তাকি বা খোদাভীরু ছিল তাঁর আরেকটি উপাধি। জগত-বিখ্যাত মহাপুরুষ ইমাম রেজা (আ) ছিলেন তাঁর বাবা। আর তাঁর মায়ের নাম ‘সাবিকাহ’ বলে জানা যায়। ইমাম রেজা (আ) তাঁর এই স্ত্রীর নাম রেখেছিলেন খিইজরান। তিনি ছিলেন মহানবীর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনিন হযরত মারিয়া কিবতির (আ) বংশধর। ইমাম জাওয়াদ (আ) ১৭ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালনের পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন। তিনিই হলেন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়স্ক ইমাম। আহলে বাইতের অন্য ইমামগণের মত ইমাম জাওয়াদ (আ.)ও ছিলেন উচ্চতর নৈতিক গুণ, জ্ঞান ও পরিপূর্ণতার অধিকারী। ইসলামের মূল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন এবং বিকাশ ছিল তাঁর তৎপরতার মূল লক্ষ্য বা কেন্দ্রবিন্দু। সেযুগের সব মাজহাবের জ্ঞানী-গুণীরা ইমাম জাওয়াদ (আ.)'র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।সমসাময়িক যুগের প্রখ্যাত সুন্নি চিন্তাবিদ কামালউদ্দিন শাফেয়ি ইমাম জাওয়াদ (আ.) সম্পর্কে বলেছেন, "মুহাম্মাদ বিন আলী তথা ইমাম জাওয়াদ (আ.) ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মর্যাদা ও গুণের অধিকারী। মানুষের মুখে মুখে ফিরতো তাঁর প্রশংসা। তাঁর উদারতা, প্রশস্ত দৃষ্টি ও সুমিষ্ট কথা সবাইকে আকৃষ্ট করত। যে-ই তাঁর কাছে আসতো নিজের অজান্তেই এই মহামানবের অনুরাগী হয়ে পড়ত এবং তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করত।" ইমাম জাওয়াদ (আ) মাত্র সাত বা আট বছর বয়সে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতো অল্প বয়সে তাঁর ইমামতিত্বের বিষয়টি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়কর। ফলে অনেকেই এ বিষয়ে সন্দেহ করতেন। অথচ আল্লাহর তো এই শক্তি আছে যে তিনি মানুষকে তার বয়সের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন। কোরানের আয়াতের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যেও এরকম উদাহরণ বহু আছে। যেমন শিশুকালে হযরত ইয়াহিয়া (আ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তি, মায়ের কোলে নবজাতক ঈসা (আ) এর কথা বলা ইত্যাদি সর্বশক্তিমান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতারই নিদর্শন। ইমাম জাওয়াদ (আ) শৈশব-কৈশোরেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, ধৈর্য ও সহনশীলতায়, ইবাদত-বন্দেগিতে, সচেতনতায়, কথাবার্তায় শীর্ষস্থানীয় মহামানব। একবার হজ্জ্বের সময় বাগদাদ এবং অন্যান্য শহরের বিখ্যাত ফকীহদের মধ্য থেকে আশি জন মদীনায় ইমাম জাওয়াদ (আ) এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা ইমামকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞেস করে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সন্তোষজনক জবাব পেলেন। ফলে জাওয়াদ (আ)’র ইমামতিত্বের ব্যাপারে তাদের মনে যেসব সন্দেহ ছিল-তা দূর হয়ে যায়।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম‌লা'নাতুল্লাহি আলাল কাজেবিন🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂