আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদবিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমমহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পর ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত নাম হলো আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালেব (আ.)। তৎকালীন আরবে (সপ্তম শতাব্দী) যিনি একাধারে তাত্ত্বিক, সুবক্তা, লেখক, চিন্তক ও কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি জ্ঞান ও পবিত্রতার সাগর, ধর্মের কুতুব, ধর্মপথের প্রদর্শক, আল্লাহ্র রাসূলের চাচাত ভাই ও শেরে খোদা। তাঁর উপাধি মুরতাজা ও মুজতাবা। তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর স্বামী, আল্লাহ্র রাসূলের জামাতা। রাসূলের সাহাবিগণের মাঝে যিনি মর্যাদা ও সত্যের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকলেই একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও অতুলনীয় বীর যোদ্ধা।আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (আ.) ২৩ হিজরি পূর্বাব্দের ১৩ রজব শুক্রবার আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম ফাতিমাহ্ বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম। তিনি প্রথম ঈমানদারদের একজন। রাসূল (সা.) হযরত আলীকে তাঁর শিশুকালেই নিজ গৃহে নিয়ে আসেন এবং তাঁর পবিত্র বিছানার পাশেই তাঁর দোলনাটি রাখা হয়েছিল। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে দোল দিতেন, গোসল করাতেন এবং দুধ খাওয়াতেন। এ সম্পর্কে হজরত আলী তাঁর বিখ্যাত ‘খুত্বাতুল ক্বাসেয়াহ্তে বলেছেন : ‘রাসূলের সাথে আমার বিশেষ জ্ঞাতিত্ব ও আত্মীয়তার কারণে আমার মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা জান। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনই তিনি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর পবিত্র বুকে চেপে ধরতেন, বিছানায় তাঁর পাশে শোয়াতেন, আমার শরীরে হাত বুলাতেন। তখন আমি তাঁর পবিত্র দেহের সুঘ্রাণ নিয়েছি। তিনি খাবার চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন…. সে সময় থেকেই আমি তাঁকে এমনভাবে অনুসরণ করতাম যেভাবে উটের বাচ্চা তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। প্রতিদিন তিনি আমাকে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখাতেন এবং তা অনুসরণ করতে আদেশ দিতেন। প্রতিবছর তিনি হেরা পাহাড়ে নির্জনবাসে যেতেন। সেখানে আমি ব্যতীত আর কেউ তাঁকে দেখেনি। সে সময় খাদিজার ঘর ব্যতীত আর কোথাও ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না আর সেসময় দু’জনের পর আমি ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ ও ঐশী বাণীর তাজাল্লি আমি দেখতাম এবং নবুওয়াতের সুঘ্রাণ প্রাণভরে গ্রহণ করতাম।’একান্ত অনুগত বুদ্ধিদীপ্ত আলীকে রাসূল (সা.) ভীষণ ভালবাসতেন। জন্মের পর থেকে আলীও রাসূলকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, একই গৃহের ভেতরে একই ছাদের নিচে একান্ত নিবিড়ভাবে। ছোটবেলা থেকে হযরত আলীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। মাত্র তের বছর বয়সে তিনি নিজেকে সত্যের পয়গাম গ্রহণকারী, রাসূল (সা.)-এর রিসালাতের স্বীকৃতি দানকারী ও দ্বীনের পথে প্রথম সাহায্যকারী হিসেবে বনু হাশিমের সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি দানের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে নিজের ভাই, ওয়ালী ও খলিফা বলে উপস্থিত সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর অনুসারিগণ হাবশা ও মদিনায় হিজরত করতে শুরু করেন। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ এলে মহানবী হযরত আলী (আ.)-কে নিজের বিছানায় রেখে রাতের আঁধারে মক্কা ত্যাগ করলেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর আলী (আ.) মক্কায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। তৃতীয় বা চতুর্থ দিন মদিনার উদ্দেশে প্রকাশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাঁর সাথে ছিল তাঁর মা, নবীকন্যা হযরত ফাতেমা, হযরত উম্মে আইমানসহ আরও কয়েকজন মহিলা। তিনি মদিনায় পৌঁছলে মহানবী (সা.) নিজে এগিয়ে এসে তাঁদের কাফেলাকে গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রিয় ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় মহানবীর চোখ মমতা ও আনন্দে ভরে গিয়েছিল।মদিনায় হযরত আলীর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। হযরত আলী তখন ২২-২৩ বছরের প্রাণবন্ত যুবক। মদিনা সনদ সম্পাদনের মাধ্যমে একটি জাতি গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২য় হিজরিতে বদরের যুদ্ধে হযরত আলী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বদরের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নিতে মক্কার কাফেররা পরের বছর পুনরায় যুদ্ধের আয়োজন করে। এই যুদ্ধে মদিনার মুসলমানদের অবহেলার জন্য ইসলামের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় সংযোজিত হয়। রাসূলুল্লাহ্র আদেশ অমান্য করার ফলে মুসলমানরা নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হয়ে এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ্র মৃত্যুর গুজবে মুসলিম বাহিনী হতাশ হয়ে পালাতে থাকে। সেসময়ে হযরত আলী বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে একত্রিত করে কাফিরদের ওপর আক্রমণ করেন। কুরাইশদের পতাকাবাহী নয়জন শ্রেষ্ঠ বীরকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ্কে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ওহুদের যুদ্ধে হযরত আলীর দেহে সত্তরটির মতো আঘাত লেগেছিল।৫ম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধে মদিনা যখন মক্কার কাফেরদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয় তখন আরবের বিখ্যাত যোদ্ধা ‘আমর ইবনে আবদে উদ্দ’ মল্লযুদ্ধের জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান করে। সে ছিল এক অপরাজেয় বীর। তাই তাকে বলা হতো ‘এক হাজার ঘোড় সওয়ারের সমতুল্য’১০। রাসূল (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে হযরত আলী আমর ইবনে আবদে উদ্দকে মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং মল্লযুদ্ধের এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করেন।৬২৮ সালে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক ছিলেন হযরত আলী (আ.)। সপ্তম হিজরিতে মহানবী (সা.) খায়বর অভিযানে বের হন। খায়বরের সুরক্ষিত দুর্গ কামুস জয় করা মুসলমানদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। কামুস দুর্গের প্রধান ছিল ‘হাজার বীরের শ্রেষ্ঠ বীর’ খ্যাত মারহাব। দ্বন্দ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী (আ.) মারহাবের মাথায় এমন জোরে আঘাত করলেন যে তরবারি মারহাবের শিরস্ত্রাণ পরিহিত মাথা দ্বিখণ্ডিত করে দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত নেমে এল। হযরত আলীর নেতৃত্বে দুর্ভেদ্য কামুস দুর্গের পতন ঘটে এবং মুসলমানরা খায়বর জয় করে। খায়বরবাসী খারাজ প্রদানের শর্তে সন্ধি করে।মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন মক্কায় প্রবেশ করেন। হযরত আলী ‘কাদ’-র দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। এক বিন্দু রক্তপাত ছাড়াই হযরত আলী তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেন।মক্কা বিজয়ের পর ঐ একই বছর হোনায়েনের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দিন ‘হাওয়াযিন গোত্রের’ আক্রমণে মুসলিম সৈন্যবাহিনী যখন দিশেহারা তখন হযরত আলী ও আব্বাস (রা.) সমগ্র আনসার বাহিনীকে একত্রিত করে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে মুসলমানগণ জয় লাভ করে।অষ্টম হিজরিতে হেজাজ অঞ্চলের চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলো। এরই প্রেক্ষিতে হযরত খালিদ ইবনে ওলীদকে ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয়। খালিদ দীর্ঘ ছয় মাস এখানে ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম গ্রহণ করল না। মহানবী (সা.) তাঁর স্থলে হযরত আলীকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন। তাঁর পাণ্ডিত্য, আভিজাত্যপূর্ণ মার্জিত ব্যবহার, রাসূলের প্রতিনিধিসুলভ ব্যক্তিত্ব, জীবন যাপনের সারল্য ইয়েমেনীদের মুগ্ধ করল। ইয়েমেনের হামদান গোত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে গেল। পরের বছর পুনরায় ইয়েমেনের মাযহাজী গোত্রের কাছে হযরত আলীকে প্রেরণ করা হয়। গোত্রপতিগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ ইয়েমেন ক্রমান্বয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসে।দশম হিজরিতে রাসূল (সা.) শেষ হজ করার জন্য মক্কায় গমন করলে হযরত আলী (আ.) তাঁর সহগামী হন। সেই বিখ্যাত বিদায় হজের ভাষণ শেষ করে মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো। মহানবী (সা.) সমবেত সাহাবিগণকে নিয়ে যোহরের নামায আদায় করে উটের হাওদার তৈরি মঞ্চে আরোহণ করে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন যা ‘খুত্বায়ে গাদীর’ নামে প্রসিদ্ধ। এই খুত্বাতে মহানবী (সা.) বলেছিলেন : ‘আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা ও তাদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অধিকার রাখি এবং তাদের ওপর অধিকার রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ততর। হে লোকসকল! আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা ও নেতা।’গাদীরে খুমের ভাষণের সত্যতা লিপিবদ্ধ করেছেন আত তাবারী, আবু নাঈম ইসফাহানী, ইবনে আসাকের, আবু ইসহাক হামুইনী, আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতীর মতো বিখ্যাত আলেমগণ।হযরত আলী তাঁর পূর্ববর্তী তিন খলিফার পঁচিশ বছরের শাসনামলে অধিকাংশ সময় নিজ গৃহে এবং মসজিদে নববীতেই কাটাতেন। এই সময় তিনি যেসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সেগুলো হলো :প্রথমত, তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল থাকা।দ্বিতীয়ত, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের তাফসীর, মুতাশাবেহ আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা, দুর্বোধ্য বিষয়াবলির সমাধান অন্বেষণ করা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে শিক্ষা দান করে তাঁকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রস্তুত করে তা উম্মাহ্র মাঝে প্রচার করার ব্যবস্থা করতেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর পরে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাস্সির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।তৃতীয়ত, খলিফাদের দরবারে অনাহূত সমস্যাগুলোর সমাধান বাতলে দেওয়া। জটিল বিষয়ে হযরত আলী তাঁর বিজ্ঞ মত ব্যক্ত করতেন যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল।চতুর্থত, একদল নিঃস্বার্থ, পবিত্র অন্তর ও আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও পরকালীন যাত্রার পথে আগ্রহী অনুসারী তৈরি করা যাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারেন।পঞ্চমত, বিধবা, অনাথ ও অসহায়দের প্রতিপালন ও পুনর্বাসনের জন্য অনুসারীদের মাঝে কর্ম তৎপরতা তৈরি করা এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে বাগান তৈরি করে, কূপ খনন করে সেগুলো ওয়াক্ফ করা।অর্থাৎ হযরত আলী (আ.) দ্বীন ইসলাম ও উম্মতের খিদমতের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।এছাড়াও এই পঁচিশ বছর সময়ে তিনি মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি নুস্খা বা অনুলিপি তৈরি করেন এবং মহানবী (সা.)- এর পবিত্র জীবনের অমিয় বাণী ও সুন্নাহ্র উপর একটি সংকলন তৈরি করেন যা মুসনাদে ইমাম আলী ইবনে আবি তালেব নামে প্রসিদ্ধ।রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর খলিফাদের শাসনকালে হযরত আলী ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেই অধিক গুরুত্ব দেন এবং খলিফাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।হযরত আলীর পরামর্শক্রমেই হযরত ওমর বায়তুল মুকাদ্দাসে যাত্রা করেছিলেন। নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ, ইয়ারমুকের যুেদ্ধ হযরত আলীর পরামর্শেই মুসলিম বাহিনী ও রাজধানী মদিনা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। খলিফাদের সময় হযরত আলী কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ঐতিহাসিক রায়সমূহ মুসলিম আইনের বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। এমনি আরও বহু ঘটনা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই।হযরত আলী তাঁর খিলাফতকালে চেয়েছিলেন মুসলমানদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র শাসনকালীন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মহানবীর পদ্ধতিকে পুনর্জীবিত করে মুসলিম উম্মাহকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। খিলাফতের প্রথমদিকে বাইতুল মালের বণ্টনের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কর তাদের জেনে রাখা উচিত শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড অন্য কিছুতে। শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্য যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় অধিকারের দিক থেকে সকলে পরস্পর সমান হবে। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা আর ধনসম্পদ হলো আল্লাহ্র যা তোমাদের মাঝে সমভাবে বণ্টিত হবে। এ ক্ষেত্রে কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আগামীকাল বাইতুল মাল তোমাদের মধ্যে বণ্টিত হবে আর এতে আরব-অনারব এক সমান।’তিনি পূর্ববর্তী খলিফার সময়ে দুর্নীতিপরায়ণ আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে অপসারণ করে তদস্থলে নতুন গভর্নরদের নিয়োগ দেন। একমাত্র সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ব্যতীত অন্য সকলেই খলিফার আদেশ মেনে নিয়ে নতুন গভর্নরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন।পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানবিক ও অতি সংবেদনশীল যুদ্ধনীতি ঘোষণা করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে জেনেভা কনভেনশন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতিসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে।আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর তেষট্টি বছরের ঘটনাবহুল জীবনের বাস্তব চিত্র পাঠকদের কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুট না হলে এবং ইসলামের চরম সংকটে তাঁর অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলে ইতিহাসের সত্য দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকার সম্ভাবনাই প্রবল।‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জ্ঞাননগরীর দরজা’ খ্যাত হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের জন্য স্বীকৃতি লাভ করেন। ইয়াকীনপূর্ণ জ্ঞান আর বোধে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেনÑ ‘আলী আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং বিচার কার্যে সকলের চেয়ে উত্তম।’ ইয়েমেনের সিংহের গর্তে নিহত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর মতামতকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের নিগূঢ় জ্ঞানরাশি মুহাম্মাদ (সা.) হযরত আলীকে শিখিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন তিনি ফিরে আসলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘কী আলোচনা হলো?’ তিনি বললেন : ‘মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন, প্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্রটি দ্বার উন্মুক্ত হয়।’ মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে হযরত আলী মসজিদে নববীতে জ্ঞানচর্চার মুক্তাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় খুতবার মাধ্যমে ও সাহাবিগণের আলাপচারিতায় তিনি যে সমস্ত বিদগ্ধ আলোচনা ও বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তা পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি সত্যিকার অর্থে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ কর্তৃক ‘শারহে নাহজুল বালাগাহ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হযরত আলী (আ.)-এর খুতবা ও পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে তাঁর জ্ঞানজগতের বিশালতা ও পরিব্যাপ্তি বোঝা যায়। এই সমস্ত খুতবার বিষয়বস্তু ছিল মহাজগৎ সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র অস্তিত্ব, ফেরেশ্তা সৃষ্টি, আদম সৃষ্টি ঈমান, রুহ্, রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা, অন্যান্য আসমানি কিতাবের আলোচনাসহ বিভিন্ন দার্শনিক ও তাত্ত্বিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞান-নগরীর দরজা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। এই সমস্ত জ্ঞানপূর্ণ সমাবেশে রাসূল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিগণ উপস্থিত থাকতেন। তাঁরা তাঁর কাছে বিভিন্ন জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন আর হযরত আলী (আ.) অত্যন্ত সুবিজ্ঞ উত্তরসহ মতামত দান করতেন।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পর ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত নাম হলো আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালেব (আ.)। তৎকালীন আরবে (সপ্তম শতাব্দী) যিনি একাধারে তাত্ত্বিক, সুবক্তা, লেখক, চিন্তক ও কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি জ্ঞান ও পবিত্রতার সাগর, ধর্মের কুতুব, ধর্মপথের প্রদর্শক, আল্লাহ্র রাসূলের চাচাত ভাই ও শেরে খোদা। তাঁর উপাধি মুরতাজা ও মুজতাবা। তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর স্বামী, আল্লাহ্র রাসূলের জামাতা। রাসূলের সাহাবিগণের মাঝে যিনি মর্যাদা ও সত্যের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকলেই একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও অতুলনীয় বীর যোদ্ধা।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (আ.) ২৩ হিজরি পূর্বাব্দের ১৩ রজব শুক্রবার আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম ফাতিমাহ্ বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম। তিনি প্রথম ঈমানদারদের একজন। রাসূল (সা.) হযরত আলীকে তাঁর শিশুকালেই নিজ গৃহে নিয়ে আসেন এবং তাঁর পবিত্র বিছানার পাশেই তাঁর দোলনাটি রাখা হয়েছিল। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে দোল দিতেন, গোসল করাতেন এবং দুধ খাওয়াতেন। এ সম্পর্কে হজরত আলী তাঁর বিখ্যাত ‘খুত্বাতুল ক্বাসেয়াহ্তে বলেছেন : ‘রাসূলের সাথে আমার বিশেষ জ্ঞাতিত্ব ও আত্মীয়তার কারণে আমার মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা জান। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনই তিনি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর পবিত্র বুকে চেপে ধরতেন, বিছানায় তাঁর পাশে শোয়াতেন, আমার শরীরে হাত বুলাতেন। তখন আমি তাঁর পবিত্র দেহের সুঘ্রাণ নিয়েছি। তিনি খাবার চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন…. সে সময় থেকেই আমি তাঁকে এমনভাবে অনুসরণ করতাম যেভাবে উটের বাচ্চা তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। প্রতিদিন তিনি আমাকে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখাতেন এবং তা অনুসরণ করতে আদেশ দিতেন। প্রতিবছর তিনি হেরা পাহাড়ে নির্জনবাসে যেতেন। সেখানে আমি ব্যতীত আর কেউ তাঁকে দেখেনি। সে সময় খাদিজার ঘর ব্যতীত আর কোথাও ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না আর সেসময় দু’জনের পর আমি ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ ও ঐশী বাণীর তাজাল্লি আমি দেখতাম এবং নবুওয়াতের সুঘ্রাণ প্রাণভরে গ্রহণ করতাম।’
একান্ত অনুগত বুদ্ধিদীপ্ত আলীকে রাসূল (সা.) ভীষণ ভালবাসতেন। জন্মের পর থেকে আলীও রাসূলকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, একই গৃহের ভেতরে একই ছাদের নিচে একান্ত নিবিড়ভাবে। ছোটবেলা থেকে হযরত আলীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। মাত্র তের বছর বয়সে তিনি নিজেকে সত্যের পয়গাম গ্রহণকারী, রাসূল (সা.)-এর রিসালাতের স্বীকৃতি দানকারী ও দ্বীনের পথে প্রথম সাহায্যকারী হিসেবে বনু হাশিমের সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি দানের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে নিজের ভাই, ওয়ালী ও খলিফা বলে উপস্থিত সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর অনুসারিগণ হাবশা ও মদিনায় হিজরত করতে শুরু করেন। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ এলে মহানবী হযরত আলী (আ.)-কে নিজের বিছানায় রেখে রাতের আঁধারে মক্কা ত্যাগ করলেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর আলী (আ.) মক্কায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। তৃতীয় বা চতুর্থ দিন মদিনার উদ্দেশে প্রকাশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাঁর সাথে ছিল তাঁর মা, নবীকন্যা হযরত ফাতেমা, হযরত উম্মে আইমানসহ আরও কয়েকজন মহিলা। তিনি মদিনায় পৌঁছলে মহানবী (সা.) নিজে এগিয়ে এসে তাঁদের কাফেলাকে গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রিয় ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় মহানবীর চোখ মমতা ও আনন্দে ভরে গিয়েছিল।
মদিনায় হযরত আলীর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। হযরত আলী তখন ২২-২৩ বছরের প্রাণবন্ত যুবক। মদিনা সনদ সম্পাদনের মাধ্যমে একটি জাতি গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২য় হিজরিতে বদরের যুদ্ধে হযরত আলী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বদরের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নিতে মক্কার কাফেররা পরের বছর পুনরায় যুদ্ধের আয়োজন করে। এই যুদ্ধে মদিনার মুসলমানদের অবহেলার জন্য ইসলামের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় সংযোজিত হয়। রাসূলুল্লাহ্র আদেশ অমান্য করার ফলে মুসলমানরা নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হয়ে এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ্র মৃত্যুর গুজবে মুসলিম বাহিনী হতাশ হয়ে পালাতে থাকে। সেসময়ে হযরত আলী বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে একত্রিত করে কাফিরদের ওপর আক্রমণ করেন। কুরাইশদের পতাকাবাহী নয়জন শ্রেষ্ঠ বীরকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ্কে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ওহুদের যুদ্ধে হযরত আলীর দেহে সত্তরটির মতো আঘাত লেগেছিল।

৫ম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধে মদিনা যখন মক্কার কাফেরদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয় তখন আরবের বিখ্যাত যোদ্ধা ‘আমর ইবনে আবদে উদ্দ’ মল্লযুদ্ধের জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান করে। সে ছিল এক অপরাজেয় বীর। তাই তাকে বলা হতো ‘এক হাজার ঘোড় সওয়ারের সমতুল্য’১০। রাসূল (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে হযরত আলী আমর ইবনে আবদে উদ্দকে মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং মল্লযুদ্ধের এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করেন।
৬২৮ সালে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক ছিলেন হযরত আলী (আ.)। সপ্তম হিজরিতে মহানবী (সা.) খায়বর অভিযানে বের হন। খায়বরের সুরক্ষিত দুর্গ কামুস জয় করা মুসলমানদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। কামুস দুর্গের প্রধান ছিল ‘হাজার বীরের শ্রেষ্ঠ বীর’ খ্যাত মারহাব। দ্বন্দ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী (আ.) মারহাবের মাথায় এমন জোরে আঘাত করলেন যে তরবারি মারহাবের শিরস্ত্রাণ পরিহিত মাথা দ্বিখণ্ডিত করে দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত নেমে এল। হযরত আলীর নেতৃত্বে দুর্ভেদ্য কামুস দুর্গের পতন ঘটে এবং মুসলমানরা খায়বর জয় করে। খায়বরবাসী খারাজ প্রদানের শর্তে সন্ধি করে।
মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন মক্কায় প্রবেশ করেন। হযরত আলী ‘কাদ’-র দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। এক বিন্দু রক্তপাত ছাড়াই হযরত আলী তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেন।
মক্কা বিজয়ের পর ঐ একই বছর হোনায়েনের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দিন ‘হাওয়াযিন গোত্রের’ আক্রমণে মুসলিম সৈন্যবাহিনী যখন দিশেহারা তখন হযরত আলী ও আব্বাস (রা.) সমগ্র আনসার বাহিনীকে একত্রিত করে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে মুসলমানগণ জয় লাভ করে।

অষ্টম হিজরিতে হেজাজ অঞ্চলের চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলো। এরই প্রেক্ষিতে হযরত খালিদ ইবনে ওলীদকে ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয়। খালিদ দীর্ঘ ছয় মাস এখানে ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম গ্রহণ করল না। মহানবী (সা.) তাঁর স্থলে হযরত আলীকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন। তাঁর পাণ্ডিত্য, আভিজাত্যপূর্ণ মার্জিত ব্যবহার, রাসূলের প্রতিনিধিসুলভ ব্যক্তিত্ব, জীবন যাপনের সারল্য ইয়েমেনীদের মুগ্ধ করল। ইয়েমেনের হামদান গোত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে গেল। পরের বছর পুনরায় ইয়েমেনের মাযহাজী গোত্রের কাছে হযরত আলীকে প্রেরণ করা হয়। গোত্রপতিগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ ইয়েমেন ক্রমান্বয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসে।
দশম হিজরিতে রাসূল (সা.) শেষ হজ করার জন্য মক্কায় গমন করলে হযরত আলী (আ.) তাঁর সহগামী হন। সেই বিখ্যাত বিদায় হজের ভাষণ শেষ করে মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো। মহানবী (সা.) সমবেত সাহাবিগণকে নিয়ে যোহরের নামায আদায় করে উটের হাওদার তৈরি মঞ্চে আরোহণ করে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন যা ‘খুত্বায়ে গাদীর’ নামে প্রসিদ্ধ। এই খুত্বাতে মহানবী (সা.) বলেছিলেন : ‘আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা ও তাদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অধিকার রাখি এবং তাদের ওপর অধিকার রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ততর। হে লোকসকল! আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা ও নেতা।’

গাদীরে খুমের ভাষণের সত্যতা লিপিবদ্ধ করেছেন আত তাবারী, আবু নাঈম ইসফাহানী, ইবনে আসাকের, আবু ইসহাক হামুইনী, আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতীর মতো বিখ্যাত আলেমগণ।
হযরত আলী তাঁর পূর্ববর্তী তিন খলিফার পঁচিশ বছরের শাসনামলে অধিকাংশ সময় নিজ গৃহে এবং মসজিদে নববীতেই কাটাতেন। এই সময় তিনি যেসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সেগুলো হলো :

প্রথমত, তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল থাকা।

দ্বিতীয়ত, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের তাফসীর, মুতাশাবেহ আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা, দুর্বোধ্য বিষয়াবলির সমাধান অন্বেষণ করা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে শিক্ষা দান করে তাঁকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রস্তুত করে তা উম্মাহ্র মাঝে প্রচার করার ব্যবস্থা করতেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর পরে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাস্সির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

তৃতীয়ত, খলিফাদের দরবারে অনাহূত সমস্যাগুলোর সমাধান বাতলে দেওয়া। জটিল বিষয়ে হযরত আলী তাঁর বিজ্ঞ মত ব্যক্ত করতেন যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল।

চতুর্থত, একদল নিঃস্বার্থ, পবিত্র অন্তর ও আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও পরকালীন যাত্রার পথে আগ্রহী অনুসারী তৈরি করা যাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারেন।

পঞ্চমত, বিধবা, অনাথ ও অসহায়দের প্রতিপালন ও পুনর্বাসনের জন্য অনুসারীদের মাঝে কর্ম তৎপরতা তৈরি করা এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে বাগান তৈরি করে, কূপ খনন করে সেগুলো ওয়াক্ফ করা।
অর্থাৎ হযরত আলী (আ.) দ্বীন ইসলাম ও উম্মতের খিদমতের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
এছাড়াও এই পঁচিশ বছর সময়ে তিনি মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি নুস্খা বা অনুলিপি তৈরি করেন এবং মহানবী (সা.)- এর পবিত্র জীবনের অমিয় বাণী ও সুন্নাহ্র উপর একটি সংকলন তৈরি করেন যা মুসনাদে ইমাম আলী ইবনে আবি তালেব নামে প্রসিদ্ধ।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর খলিফাদের শাসনকালে হযরত আলী ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেই অধিক গুরুত্ব দেন এবং খলিফাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।

হযরত আলীর পরামর্শক্রমেই হযরত ওমর বায়তুল মুকাদ্দাসে যাত্রা করেছিলেন। নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ, ইয়ারমুকের যুেদ্ধ হযরত আলীর পরামর্শেই মুসলিম বাহিনী ও রাজধানী মদিনা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। খলিফাদের সময় হযরত আলী কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ঐতিহাসিক রায়সমূহ মুসলিম আইনের বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। এমনি আরও বহু ঘটনা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই।
হযরত আলী তাঁর খিলাফতকালে চেয়েছিলেন মুসলমানদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র শাসনকালীন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মহানবীর পদ্ধতিকে পুনর্জীবিত করে মুসলিম উম্মাহকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। খিলাফতের প্রথমদিকে বাইতুল মালের বণ্টনের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কর তাদের জেনে রাখা উচিত শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড অন্য কিছুতে। শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্য যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় অধিকারের দিক থেকে সকলে পরস্পর সমান হবে। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা আর ধনসম্পদ হলো আল্লাহ্র যা তোমাদের মাঝে সমভাবে বণ্টিত হবে। এ ক্ষেত্রে কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আগামীকাল বাইতুল মাল তোমাদের মধ্যে বণ্টিত হবে আর এতে আরব-অনারব এক সমান।’
তিনি পূর্ববর্তী খলিফার সময়ে দুর্নীতিপরায়ণ আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে অপসারণ করে তদস্থলে নতুন গভর্নরদের নিয়োগ দেন। একমাত্র সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ব্যতীত অন্য সকলেই খলিফার আদেশ মেনে নিয়ে নতুন গভর্নরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানবিক ও অতি সংবেদনশীল যুদ্ধনীতি ঘোষণা করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে জেনেভা কনভেনশন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতিসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর তেষট্টি বছরের ঘটনাবহুল জীবনের বাস্তব চিত্র পাঠকদের কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুট না হলে এবং ইসলামের চরম সংকটে তাঁর অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলে ইতিহাসের সত্য দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকার সম্ভাবনাই প্রবল।
‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জ্ঞাননগরীর দরজা’ খ্যাত হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের জন্য স্বীকৃতি লাভ করেন। ইয়াকীনপূর্ণ জ্ঞান আর বোধে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেনÑ ‘আলী আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং বিচার কার্যে সকলের চেয়ে উত্তম।’ ইয়েমেনের সিংহের গর্তে নিহত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর মতামতকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের নিগূঢ় জ্ঞানরাশি মুহাম্মাদ (সা.) হযরত আলীকে শিখিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন তিনি ফিরে আসলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘কী আলোচনা হলো?’ তিনি বললেন : ‘মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন, প্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্রটি দ্বার উন্মুক্ত হয়।’ মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে হযরত আলী মসজিদে নববীতে জ্ঞানচর্চার মুক্তাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় খুতবার মাধ্যমে ও সাহাবিগণের আলাপচারিতায় তিনি যে সমস্ত বিদগ্ধ আলোচনা ও বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তা পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি সত্যিকার অর্থে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ কর্তৃক ‘শারহে নাহজুল বালাগাহ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হযরত আলী (আ.)-এর খুতবা ও পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে তাঁর জ্ঞানজগতের বিশালতা ও পরিব্যাপ্তি বোঝা যায়। এই সমস্ত খুতবার বিষয়বস্তু ছিল মহাজগৎ সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র অস্তিত্ব, ফেরেশ্তা সৃষ্টি, আদম সৃষ্টি ঈমান, রুহ্, রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা, অন্যান্য আসমানি কিতাবের আলোচনাসহ বিভিন্ন দার্শনিক ও তাত্ত্বিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞান-নগরীর দরজা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। এই সমস্ত জ্ঞানপূর্ণ সমাবেশে রাসূল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিগণ উপস্থিত থাকতেন। তাঁরা তাঁর কাছে বিভিন্ন জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন আর হযরত আলী (আ.) অত্যন্ত সুবিজ্ঞ উত্তরসহ মতামত দান করতেন।

প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদপবিত্র কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর হাদিস থেকে আমিরুল মোমেনীন আলী ইবনে আবি তালিব আঃ এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিসমহানবী হযরত মুহাম্মদ ‎(সা.)-এর উত্তরাধিকারী,তাঁর নবুওয়াতের মিশনের প্রধান সাহায্যকারী এবং দুনিয়া ও আখেরাতে রাসূলের ভ্রাতা আলী ‎(আ.) ‏আবরাহার পবিত্র মক্কা আক্রমণের ৩৩ বছর পর ১৩ রজব পবিত্র কা’বা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। মহান আল্লাহর আদেশে তাঁর নাম রাখা হয় আলী।শিশুকাল থেকেই মহানবী ‎(সা.)-এর সাথে হযরত আলীর বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কে আলী ‎(আ.) ‏নিজেই বলেছেন ‎: ‘...তিনি আমাকে তাঁর কোলে রাখতেন যখন আমি শিশু ছিলাম। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং তাঁর বিছানায় শুইয়ে রাখতেন। তাঁর পবিত্র দেহ আমার দেহকে স্পর্শ করত এবং তিনি আমাকে তাঁর শরীরের সুগন্ধির ঘ্রাণ নেওয়াতেন। তিনি খাদ্য-দ্রব্য চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন।...’১হযরত আবু তালিবের সংসারের ব্যয়ভার কমানোর জন্য হযরত আলীর বালক বয়সেই মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখন থেকে তিনি রাসূলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে যান। রাসূল হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর ইবাদাত করতে গেলেও তাঁকে সাথে নিয়ে যেতেন। হযরত আলী বলেন ‎: ‘তিনি ‎(মহানবী) ‏প্রতি বছর হেরাগুহায় একান্ত নির্জনে বাস করতেন। আমি তাঁকে দেখতাম। আমি ব্যতীত আর কোন লোকই তাঁকে দেখতে পেত না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ ও খাদীজাহ্ ব্যতীত কোন মুসলিম পরিবারই পৃথিবীর বুকে ছিল না। আমি ছিলাম তাঁদের পরিবারের তৃতীয় সদস্য। আমি ওহী ও রেসালতের আলো প্রত্যক্ষ করেছি এবং নবুওয়াতের সুবাস ও সুঘ্রাণ অনুভব করেছি।’২তিনি মহানবীর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করতেন। তিনি বলেন ‎: ‘উষ্ট্র শাবক যেমনভাবে উষ্ট্রীকে অনুসরণ করে ঠিক সেভাবে আমি তাঁকে অনুসরণ করতাম। তিনি প্রতিদিন তাঁর উন্নত চরিত্র থেকে একটি নিদর্শন আমাকে শিক্ষা দিতেন এবং আমাকে তা পালন করার নির্দেশ দিতেন।... ‏তাঁর ওপর যখন ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল তখন আমি শয়তানের ক্রন্দন ধ্বনি শুনেছিলাম। তাই আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‎: ‏হে রাসূলুল্লাহ্! ‏এ ক্রন্দন ধ্বনি কার? ‏তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন ‎: ‏এই শয়তান এখন থেকে তার পূজা ‎(ইবাদাত) ‏করা হবে না বলে হতাশ হয়ে গেছে। নিশ্চয় আমি যা শুনি তুমি তা শোন এবং আমি যা দেখি তা দেখ। তবে তুমি নবী নও,কিন্তু ‎[নবীর] ‏সহকারী এবং নিঃসন্দেহে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণের ওপরই আছ।’৩আর তাই মহানবী ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর ওপর ঈমান আনেন এবং তিনিই তাঁর সাথে নামায আদায় করা প্রথম ব্যক্তি। ইমাম মালেক বর্ণনা করেছেন ‎: ‘মহানবী ‎(সা.) ‏সোমবারে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন এবং আলী মঙ্গলবারে তাঁর ওপর ঈমান আনেন।’৪হযরত আলী নিজেই বলেন ‎: ‘আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূলের ভ্রাতা এবং তাঁর নবুওয়াতের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসস্থাপনকারী। একমাত্র মিথ্যাবাদী ছাড়া আমার পর কেউ এ দাবি করবে না। অন্য লোকদের নামায পড়ারও ৭ বছর আগে থেকে আমি নামায পড়েছি।’৫হযরত আলী ‎(আ.)-এর প্রসিদ্ধ উপাধিরাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে সিদ্দিকে আকবার,ফারুকে আযম,আসাদুল্লাহ ও মুরতাজা।পবিত্র কুরআনে হযরত আলী ‎(আ.)-এর মর্যাদাহযরত আলীর শানে পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,কোন ব্যক্তির গুণ বর্ণনায় এত অধিক কুরআনের বাণী অবতীর্ণ হয়নি যা হযরত আলী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস আরও বলেছেন যে,হযরত আলীর শানে তিনশ’ ‏আয়াত নাযিল হয়েছে এবং তাঁর গুণাবলি অত্যধিক ও প্রসিদ্ধ।৬ পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত আয়াতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াতوَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ‘এবং মানুষের মধ্যে এমনও আছে,যে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিক্রয় করে দেয় এবং আল্লাহ ‎(এরূপ) ‏বান্দাদের প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল।’সালাবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিলেন সেই সময় হযরত আলীকে তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকার নির্দেশ দেন যাতে কাফির-মুশরিকরা মনে করে যে,রাসূল তাঁর নিজ ঘরেই রয়েছেন। আলী ‎(আ.) ‏নির্দ্বিধায় এ নির্দেশ পালন করলে মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন।৭ ২. ‏সূরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াতفَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ‘অতঃপর তোমার নিকট যখন জ্ঞান ‎(কুরআন) ‏এসে গেছে,এরপরও যদি কেউ ‎(খ্রিস্টান) ‏তোমার সাথে তার ‎(ঈসার) ‏সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করে,তবে বল,‘(ময়দানে) ‏এস,আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের ও তোমাদের পুত্রদের,আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের সত্তাদের ও তোমাদের সত্তাদের;’ ‏অতঃপর সকলে মিলে ‎(আল্লাহর দরবারে) ‏নিবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি।’ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের সত্যতা যাচাই করার জন্য নাজরানের একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল মদীনায় আসল। তাদের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ হলো না। রাসূল ‎(সা.) ‏হযরত ঈসা ‎(আ.) ‏সম্বন্ধে প্রতিনিধিদের বললেন যে,তিনি আল্লাহর পুত্র নন,বরং আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। রাসূলুল্লাহ্ হযরত ঈসার জন্মের ব্যাপারে হযরত আদমের উদাহরণও দিলেন। কিন্তু তারা কোন কথাই শুনল না। অবশেষে তিনি আল্লাহর আদেশে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোয়া ও মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিশাপ বর্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন,যাকে ‎‘মুবাহিলা’ ‏বলে। স্থির করা হল যে,নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে উভয়ে নিজ নিজ পুত্রদের,নারীদের ‎(কন্যা সন্তানদের) ‏এবং তাদের নিজেদের ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে একত্র হবে এবং প্রত্যেকে অপরের প্রতি অভিসম্পাত ও আল্লাহর শাস্তি কামনা করবে। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হুসাইনকে কোলে নিয়ে ইমাম হাসানের হাত ধরলেন এবং হযরত ফাতিমাকে নিজের পেছনে,আর হযরত আলীকে তাঁর পেছনে রাখলেন। অর্থাৎ ছেলেদের স্থানে তিনি নাতিদের,নারীদের স্থানে নিজ কন্যাকে এবং ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্যদের স্থানে আলীকে নিলেন এবং দোয়া করলেন,‘হে আল্লাহ! ‏প্রত্যেক নবীর আহলে বাইত থাকে,এরা আমার আহলে বাইত। এদের সকল দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত ও পাক-পবিত্র রেখ।’ ‏তিনি এভাবে ময়দানে পৌঁছলে খ্রিস্টানদের নেতা আকব তা দেখে বলল,‘আল্লাহর কসম,আমি এমন নূরানী চেহারা দেখছি যে,যদি এ পাহাড়কে নিজ স্থান হতে সরে যেতে বলেন,তবে অবশ্যই সরে যাবে। সুতরাং মুবাহিলা হতে হাত গুটিয়ে নেওয়াই কল্যাণকর,অন্যথায় কিয়ামত অবধি খ্রিস্টানদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।’ ‏পরিশেষে তারা জিযিরা কর দিতে সম্মত হল। এটা হযরত আলীর একটি উঁচু স্তরের ফযিলত যে,তিনি আল্লাহর আদেশে রাসূলের ‎‘নাফ্স’ (অনুরূপ সত্তা) ‏সাব্যস্ত হলেন এবং সমুদয় নবীর থেকে শ্রেষ্ঠ হলেন।৮৩. ‏সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াত ‎يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ‘হে বিশ্বাসিগণ! ‏তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যে যারা নির্দেশের অধিকর্তা,তাদের আনুগত্য কর...।’ইমাম জাফর সাদিক ‎(আ.)- ‏কে জিজ্ঞেস করা হলো যে,উত্তরাধিকারীর আদেশ মান্য করা কি অবশ্যই কর্তব্য? ‏তিনি বললেন ‎: ‏হ্যাঁ,তাঁরা ঐসব ব্যক্তি যাঁদের আদেশ পালন করা এ আয়াতে ওয়াজিব করা হয়েছে...। এ আয়াত হযরত আলী বিন আবি তালিব,হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন ‎(আ.)-এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে।৯ ৪. ‏সূরা মায়েদার ৫৫ নং আয়াতإِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ‘(হে বিশ্বাসিগণ!) ‏তোমাদের অভিভাবক তো কেবল আল্লাহ,তাঁর রাসূল এবং সেই বিশ্বাসীরা যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করে।’শীয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের তফসীরকাররা একমত যে,আয়াতটি হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে। যেমন ইবনে মারদুইয়া এবং খাতীব বাগদাদী ইবনে আব্বাস সূত্রে এবং তাবরানী ও ইবনে মারদুইয়া আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আলী ইবনে আবি তালিব সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি আলী ইবনে আবি তালিব ‎(আ.) ‏সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে যখন তিনি রুকু অবস্থায় যাকাত দেন।ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏একদিন হযরত আলী ‎(আ.) ‏মদীনার মসজিদে নামায পড়ছিলেন। এমন সময় একজন ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইল। কিন্তু কোন ভিক্ষা না পাওয়ায় সে ফরিয়াদ করল যে,রাসূলের মসজিদ থেকে সে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। এ সময় হযরত আলী রুকু অবস্থায় ছিলেন। তিনি সেই অবস্থায় তাঁর ডান হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নেওয়ার জন্য ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করেন। ভিক্ষুক তাঁর হাত থেকে আংটি খুলে নেয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে উপরিউক্ত আয়াত নাযিল হয়।১০৫. ‏সূরা মায়েদার ৬৭ নং আয়াতيَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ‘হে রাসূল! ‏যা ‎(যে আদেশ) ‏তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দাও,আর যদি তুমি তা না কর,তবে তুমি ‎(যেন) ‏তার কোন বার্তাই পৌঁছাওনি,এবং ‎(তুমি ভয় কর না) ‏আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন;এবং নিশ্চয় আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালিত করেন না।’যখন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏দশম হিজরিতে বিদায় হজ্ব থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন সে সময় আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। ইবনে আবী হাতিম ও ইবনে আসাকির আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণনা করেছেন যে,এ আয়াত গাদীরে খুম প্রান্তরে হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে।বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করার সময় গাদীরে খুম নামক স্থানে মহানবী ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে তাঁর পরে সকল মুমিনের অভিভাবক বলে ঘোষণা দেন।১১এ ঘোষণা দেয়ার পর হযরত ওমর হযরত আলীর সাথে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানান এবং বলেন ‎: ‘হে আলী ইবনে আবি তালিব! ‏আপনি আজ হতে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর মাওলা হয়ে গেলেন।’১২৬. ‏সূরা রাদের ৭ নং আয়াতإِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ‘(হে রাসূল!) ‏তুমি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে এক পথ প্রদর্শক।’ইবনে মারদুইয়্যা,ইবনে জারীর,আবু নাঈম তাঁর ‎‘মারেফাত’ ‏গ্রন্থে,ইবনে আসাকির,দাইলামী ও ইবনে নাজ্জার তাঁদের স্ব স্ব গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি নাযিল হলে মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁর হাত নিজের বুকে রেখে বললেন,‘আমিই সতর্ককারী।’ ‏অতঃপর আলীর কাঁধের প্রতি তাঁর হাত দ্বারা ইশারা করে বললেন,‘হে আলী! ‏তুমিই পথপ্রদর্শক এবং মানুষ আমার পর তোমার মাধ্যমে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।’ ‏উক্ত রেওয়ায়েতটি শব্দের তারতম্যে ইবনে মারদুইয়্যা সাহাবী আবু বারযাহ আসলামী হতে,জীয়াফীল হযরত ইবনে আব্বাস হতে,ইবনে আহমাদ তাঁর মুসনাদে এবং ইবনে মারদুইয়্যা ও ইবনে আসাকির স্বয়ং হযরত আলী ‎(আ.) ‏হতে বর্ণনা করেছেন।১৩৭. ‏সূরা রাদের ৪৩ নং আয়াতوَيَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَسْتَ مُرْسَلًا قُلْ كَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَمَنْ عِنْدَهُ عِلْمُ الْكِتَابِযারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে,‘তুমি আল্লাহর রাসূল নও।’ ‏তুমি বল,‘আমার ও তোমাদের মধ্যে ‎(রেসালাতের) ‏সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সেই ব্যক্তি যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান রয়েছে।’অধিকাংশ তাফসীরকার স্বীকার করেছেন যে,আয়াতে বর্ণিত সেই ব্যক্তি হলেন হযরত আলী ‎(আ.)। যেমন আসমী ‎‘যায়নুল ফাতা’ ‏নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং সা’লাবী আবদুল্লাহ ইবনে আতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,আবদুল্লাহ বিন সালাম বলতেন,‘যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান আছে’-এর উদ্দিষ্ট হযরত আলী ‎(আ.)। এজন্যই হযরত আলী ‎(আ.) ‏বারবার বলতেন,‘আমার কাছে আমার মৃত্যুর পূর্বে যা চাও জিজ্ঞেস কর।’১৪৮. ‏সূরা নাহলের ৪৩ নং আয়াতوَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَতোমার পূর্বেও আমরা কেবল পুরুষদেরই ‎(রাসূল করে) ‏প্রেরণ করেছি যাদের প্রতি আমরা প্রত্যাদেশ প্রেরণ করতাম;যদি তোমরা না জেনে থাক তবে যারা জানে তাদের জিজ্ঞেস কর।আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন ‎: ‏জ্ঞানী ব্যক্তিরা অর্থাৎ আহলুয যিকর হলেন হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.),হযরত আলী ‎(আ.),হযরত ফাতেমা ‎(আ.),হযরত হাসান ও হুসাইন ‎(আ.)। যাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেছেন ‎: ‏যখন এই আয়াত নাযিল হল তখন হযরত আলী বললেন ‎: ‏আমরাই হলাম জ্ঞানের ভাণ্ডার।১৫৯. ‏সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতوَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا‘হে নবী পরিবার! ‏আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামার ঘরে এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত ফাতিমা,ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ‎(আ.)-কে ডাকেন এবং তাঁদেরকে একটি চাদরে ঢেকে নেন। হযরত আলী তাঁর পেছনে ছিলেন। তিনি তাঁকেও চাদরে ঢেকে নেন। অতঃপর বলেন ‎: ‘হে আল্লাহ্! ‏এরা আমার আহলে বাইত। অতএব,তুমি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে দাও এবং তাদেরকে উত্তমরূপে পবিত্র কর।’ ‏তখন উম্মে সালামা বলেন ‎: ‘হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমিও কি তাদের অন্তর্ভুক্ত?’ ‏তিনি বলেন ‎: ‘তুমি স্ব স্থানে আছ এবং তুমি কল্যাণের মধ্যেই আছ।’১৬হযরত উম্মে সালামা ছাড়াও হযরত আবু সাঈদ খুদরী ও আনাস ইবনে মালিক কর্তৃক এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।১৭১০. ‏সূরা শূরার ২৩ নং আয়াতقُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى‘বল,আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা ছাড়া আর কোন প্রতিদান চাই না।’রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নিকটাত্মীয় আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি ভালবাসা পোষণকে এ আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য ফরয বলে ঘোষণা করেন।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন ‎: ‏যখন এ আয়াত নাযিল হল তখন সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন,হে রাসূলুল্লাহ! ‏আপনার নিকটাত্মীয়,যাদেরকে ভালবাসা আমাদের ওপর ওয়াজিব করা হয়েছে তারা কারা? ‏রাসূল ‎(সা.) ‏বললেন ‎: ‏আলী,ফাতেমা,হাসান ও হুসাইন।১৮রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর হাদীসে আলী ‎(আ.)হযরত আলীর মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী ‎(সা.)-এর নিকট থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বলেন,নবী ‎(সা.) ‏তাবুক যুদ্ধের সময় আলীকে লক্ষ্য করে বলেছেন ‎: ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে,মর্যাদার দিক থেকে মূসার নিকট হারুন যে পর্যায়ে ছিলেন,তুমিও আমার নিকট ঐ পর্যায়ে রয়েছ?’১৯২. ‏অন্য একটি হাদীসে এসেছে ‎: ‏রাসূল বলেন ‎: ‘তুমি তো আমার নিকট তদ্রূপ যেরূপ হারুনের স্থান মূসার নিকট। পার্থক্য এতটুকু যে,আমার পরে কোন নবী নেই।’২০৩. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হাসান ও হুসাইনের হাত ধরে বলেন ‎: ‘যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসে এবং এ দু’জন ও তাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসে,সে কিয়ামতের দিন আমার সাথে একই মর্যাদায় অবস্থান করবে।’২১৪. ‏আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত। রাসূল বলেছেন ‎: ‘আলীর চেহারার দিকে তাকানোও ইবাদত।’২২৫. ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.) ‏আলী ‎(আ.)-কে সম্বোধন করে বলেছিলেন ‎: ‘মুমিনরাই তোমাকে মহব্বত করবে এবং মুনাফিকরাই তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে।’২৩৬. ‏তিরমিযী,নাসাঈ ও ইবনে মাযাহ হুবশী ইবনে জুনাদাহ্ ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূল ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘আলী আমা থেকে এবং আমি আলী থেকে। যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আমাকে ভালোবেসেছে। আর যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আল্লাহকে ভালবেসেছে। যে ব্যক্তি আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে সে আমার সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে। আর যে আমার শত্রু সে আল্লাহর শত্রু। যে ব্যক্তি আলীকে কষ্ট দিয়েছে,সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে।’২৪৭. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‘(হে আলী!) ‏দুনিয়া ও আখেরাতে তুমি আমারই ভাই।’২৫৮. ‏আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা ‎(র.) ‏থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘চার ব্যক্তিকে ভালবাসতে আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন এবং তিনি আমাকে এও অবহিত করেছেন যে,তিনিও তাদের ভালবাসেন। বলা হল ‎: ‏হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমাদের তাদের নামগুলো বলুন। তিনি বলেন ‎: ‏আলীও তাদের অন্তর্ভুক্ত। এ কথা তিনি তিনবার বলেন। ‎(অবশিষ্ট তিনজন হলেন) ‏আবু যার,মিকদাদ ও সালমান।...’২৬৯. ‏জাবির ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏তায়েফ অভিযানের দিন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏আলীকে কাছে ডেকে তার সাথে চুপিসারে আলাপ করেন। লোকেরা বলল ‎: ‏তিনি তাঁর চাচাত ভাইয়ের সাথে দীর্ঘক্ষণ চুপিসারে কথা বললেন। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‏আমি তার সাথে চুপিসারে কথা বলিনি;বরং আল্লাহই তার সাথে চুপিসারে কথা বলেছেন। ‎(অর্থাৎ তার সাথে চুপিসারে কথা বলার জন্য আল্লাহ্ই আমাকে আদেশ করেছেন।)২৭হযরত আলী সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীহযরত আবু বকর প্রায়ই হয়রত আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। হযরত আয়েশা এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন ‎: ‘আমি রাসূলে করীমকে বলতে শুনেছি,আলীর মুখ দেখা ইবাদাতের শামিল।’২৮হযরত উমর বিন খাত্তাব বলতেন,হযরত আলী বিন আবি তালিবের তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল। যদি তার একটি আমার থাকত তাহলে আমি বলতাম যে,আমাকে লাল রঙের একটি উট দেয়া হলে তা অপেক্ষাও আমি তা পছন্দ করতাম। তাঁকে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ‎: ‏১.তাঁর বিয়ে হয় রাসূল ‎(সা.)-এর কন্যার সাথে,২. ‏তাঁর সঙ্গে রাসূলে করীমের মসজিদে অবস্থান এবং যা রাসূলে করিমের জন্য বৈধ ছিল তার জন্যও তা বৈধ ছিল এবং ৩. ‏খায়বার যুদ্ধের পতাকা বহনের দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল।২৯হযরত উমর বলেছেন,হে আল্লাহ! ‏আমার ওপর এমন কোন বিপদ দিও না যখন আবুল হাসান ‎(আলী) ‏আমার নিকট উপস্থিত না থাকে। কারণ,তিনি আমার নিকট উপস্থিত থাকলে আমাকে সে বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দেবেন।’৩০তাবরানী হযরত ইবনে আব্বাস থেকে রেওয়ায়াত করেছেন যে,হযরত আলীর আঠারটি বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যা সমগ্র উম্মতের কারও ছিল না।’৩১তথ্যসূত্র১. ‏মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত নাহজ আল বালাঘা,২য় মুদ্রণ,আল খুতবাতুল কাসেয়াহ্,খুতবা নং ১৯১২. ‏প্রাগুক্ত৩. ‏প্রাগুক্ত৪. ‏মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১১২;এটি ইমাম মালেক কর্তৃক বর্ণিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হেরা গুহায় জিবরাঈল ‎(আ.) ‏কর্তৃক রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নবুওয়াত ঘোষণার পর পরই হযরত আলী ‎(আ.) ‏তাঁর ঈমান আনার বিষয়টি প্রকাশ করেন।৫. ‏সুনানে ইবনে মাজাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৪৪৬. ‏নূর-এ-সাকালাইন কর্তৃক প্রকাশিত,সাইয়্যেদ আলী জাফরী প্রণীত আল মুরতাজা,পৃ. ‏৩০।৭. ‏এহইয়াউ উলুমিদ্দীন,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২৩৮;নুরুল আবসার,পৃ. ‏৮৬,মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৭১;তাযকিরাতু সিবতে ইবনে যাওযী,পৃ. ‏২১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏৯২।৮. ‏তাফসীরে জালালাইন,১ম খণ্ড,পৃ.৬০;বায়দ্বাভী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১১৮,তাফসীরে দুররুল মানসুর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৯,মিশর মুদ্রণ;মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৫;৯. ‏মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏২১;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪৮;তাফসীরে ফুরাত,পৃ.২৮১০. ‏তাফসীরে তাবারী,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৬৫;তাফসীরে রাযী,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪৩১;মানাকেবে খাওয়ারেযমী,পৃ. ‏১৭৮;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏১০২;তাফসীরে ইবনে কাসীর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৭১;আল- ‏বেদায়া ওয়ান নেহায়া,৭ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৫৭;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏২৫;১১. ‏মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৩৭২;ইমাম নাসাঈ প্রণীত খাসায়েসে আমীরুল মুমিনীন,পৃ. ‏২১;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১০৯;আল গাদীর,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২১৪ ও ২২৯;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৭ ।১২. ‏তাফসীরে তাবারী,৩য় খণ্ড,মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল,৩য় খণ্ড,দারে কুতনী।১৩. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৪৫ দ্রষ্টব্য।১৪. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৬৯ ।১৫. ‏কেফাইয়াতুল মুওয়াহহিদীন,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৬৫০;মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৪১৩;কানযুল উম্মাল,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৫৬;তাফসীরে তাবারী,১৪তম খণ্ড,পৃ. ‏১০৮ ।১৬. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৭২৫,পৃ. ‏৩৫৯ ।১৭. ‏মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৩১;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏২১,তাফসীরে তাবারী,২২তম খণ্ড,পৃ. ‏৮;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২০৮;ফাজায়েলে খামসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৪;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১০ ।১৮. ‏যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏৯ ও ১২;তাফসীরে যামাখশারী,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৩৯;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১০১,তাফসীরে দুররুল মানসূর,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏৭;মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৯;আল গাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১৭২;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩০ ।১৯. ‏আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী,৩য় খণ্ড,হাদীস নং ৩৪৩১;বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪২ ।২০. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪০ ও জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৬৮ ।২১. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭০২২. ‏এমদাদীয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ইবনে আবি তালিব ‎(রা.),পৃ. ‏১৫ ।২৩. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭৩ ।২৪. ‏এমদাদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ‎(রা.),পৃ. ‏১৫-১৬ ।২৫. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৫৮;২৬. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৫৬;২৭. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৬৪২৮. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১৭৫ ।২৯. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,৩য় খণ্ড,এবং মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড ।৩০. ‏মুনতাখাবে কানজুল উম্মাল,৩য় খণ্ড ।৩১. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ ১১৩ ।(প্রত্যাশা,৩য় বর্ষ, ‏১ম সংখ্যাপ্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

শিশু ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ.)'র জন্মবার্ষিকীসকল মোমিন মোমিনা কে জানাই ঈদ মোবারক🎂🎂🎂🎂🎂(((পর্ব ১)))🎂🎂🎂🎂🎂দশই রজব ইসলামের মহাখুশির দিন। এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন মাওলা মোহাম্মদ (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য নবম ইমাম হযরত জাওয়াদ বা তাকি(আ)। নবীজীর আহলে বাইতের সদস্যরা কেবল মুসলমানদেরই ধর্মীয় নেতা নন বরং যারাই সত্য পথের সন্ধানী কিংবা কল্যাণকামী-তাদের সবারই নেতা।আহলে বাইতের এই মহান ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ) এর জন্ম-বার্ষিকীতে আপনাদের সবার প্রতি রইলো অশেষ অভিনন্দন ও প্রাণঢালা মোবারকবাদ এবং মাওলা মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম ।ইমাম জাওয়াদের জন্ম হয়েছিল ১৯৫ হিজরিতে তথা ৮১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল পবিত্র মদীনায়। মজলুম ও দরিদ্রদের প্রতি ব্যাপক দানশীলতা ও দয়ার জন্য তিনি 'জাওয়াদ' উপাধি পেয়েছিলেন। তাকি বা খোদাভীরু ছিল তাঁর আরেকটি উপাধি। জগত-বিখ্যাত মহাপুরুষ ইমাম রেজা (আ) ছিলেন তাঁর বাবা। আর তাঁর মায়ের নাম ‘সাবিকাহ’ বলে জানা যায়। ইমাম রেজা (আ) তাঁর এই স্ত্রীর নাম রেখেছিলেন খিইজরান। তিনি ছিলেন মহানবীর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনিন হযরত মারিয়া কিবতির (আ) বংশধর। ইমাম জাওয়াদ (আ) ১৭ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালনের পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন। তিনিই হলেন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়স্ক ইমাম। আহলে বাইতের অন্য ইমামগণের মত ইমাম জাওয়াদ (আ.)ও ছিলেন উচ্চতর নৈতিক গুণ, জ্ঞান ও পরিপূর্ণতার অধিকারী। ইসলামের মূল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন এবং বিকাশ ছিল তাঁর তৎপরতার মূল লক্ষ্য বা কেন্দ্রবিন্দু। সেযুগের সব মাজহাবের জ্ঞানী-গুণীরা ইমাম জাওয়াদ (আ.)'র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।সমসাময়িক যুগের প্রখ্যাত সুন্নি চিন্তাবিদ কামালউদ্দিন শাফেয়ি ইমাম জাওয়াদ (আ.) সম্পর্কে বলেছেন, "মুহাম্মাদ বিন আলী তথা ইমাম জাওয়াদ (আ.) ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মর্যাদা ও গুণের অধিকারী। মানুষের মুখে মুখে ফিরতো তাঁর প্রশংসা। তাঁর উদারতা, প্রশস্ত দৃষ্টি ও সুমিষ্ট কথা সবাইকে আকৃষ্ট করত। যে-ই তাঁর কাছে আসতো নিজের অজান্তেই এই মহামানবের অনুরাগী হয়ে পড়ত এবং তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করত।" ইমাম জাওয়াদ (আ) মাত্র সাত বা আট বছর বয়সে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতো অল্প বয়সে তাঁর ইমামতিত্বের বিষয়টি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়কর। ফলে অনেকেই এ বিষয়ে সন্দেহ করতেন। অথচ আল্লাহর তো এই শক্তি আছে যে তিনি মানুষকে তার বয়সের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন। কোরানের আয়াতের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যেও এরকম উদাহরণ বহু আছে। যেমন শিশুকালে হযরত ইয়াহিয়া (আ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তি, মায়ের কোলে নবজাতক ঈসা (আ) এর কথা বলা ইত্যাদি সর্বশক্তিমান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতারই নিদর্শন। ইমাম জাওয়াদ (আ) শৈশব-কৈশোরেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, ধৈর্য ও সহনশীলতায়, ইবাদত-বন্দেগিতে, সচেতনতায়, কথাবার্তায় শীর্ষস্থানীয় মহামানব। একবার হজ্জ্বের সময় বাগদাদ এবং অন্যান্য শহরের বিখ্যাত ফকীহদের মধ্য থেকে আশি জন মদীনায় ইমাম জাওয়াদ (আ) এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা ইমামকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞেস করে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সন্তোষজনক জবাব পেলেন। ফলে জাওয়াদ (আ)’র ইমামতিত্বের ব্যাপারে তাদের মনে যেসব সন্দেহ ছিল-তা দূর হয়ে যায়।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম‌লা'নাতুল্লাহি আলাল কাজেবিন🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂