আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদবিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমমহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পর ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত নাম হলো আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালেব (আ.)। তৎকালীন আরবে (সপ্তম শতাব্দী) যিনি একাধারে তাত্ত্বিক, সুবক্তা, লেখক, চিন্তক ও কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি জ্ঞান ও পবিত্রতার সাগর, ধর্মের কুতুব, ধর্মপথের প্রদর্শক, আল্লাহ্র রাসূলের চাচাত ভাই ও শেরে খোদা। তাঁর উপাধি মুরতাজা ও মুজতাবা। তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর স্বামী, আল্লাহ্র রাসূলের জামাতা। রাসূলের সাহাবিগণের মাঝে যিনি মর্যাদা ও সত্যের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকলেই একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও অতুলনীয় বীর যোদ্ধা।আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (আ.) ২৩ হিজরি পূর্বাব্দের ১৩ রজব শুক্রবার আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম ফাতিমাহ্ বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম। তিনি প্রথম ঈমানদারদের একজন। রাসূল (সা.) হযরত আলীকে তাঁর শিশুকালেই নিজ গৃহে নিয়ে আসেন এবং তাঁর পবিত্র বিছানার পাশেই তাঁর দোলনাটি রাখা হয়েছিল। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে দোল দিতেন, গোসল করাতেন এবং দুধ খাওয়াতেন। এ সম্পর্কে হজরত আলী তাঁর বিখ্যাত ‘খুত্বাতুল ক্বাসেয়াহ্তে বলেছেন : ‘রাসূলের সাথে আমার বিশেষ জ্ঞাতিত্ব ও আত্মীয়তার কারণে আমার মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা জান। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনই তিনি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর পবিত্র বুকে চেপে ধরতেন, বিছানায় তাঁর পাশে শোয়াতেন, আমার শরীরে হাত বুলাতেন। তখন আমি তাঁর পবিত্র দেহের সুঘ্রাণ নিয়েছি। তিনি খাবার চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন…. সে সময় থেকেই আমি তাঁকে এমনভাবে অনুসরণ করতাম যেভাবে উটের বাচ্চা তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। প্রতিদিন তিনি আমাকে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখাতেন এবং তা অনুসরণ করতে আদেশ দিতেন। প্রতিবছর তিনি হেরা পাহাড়ে নির্জনবাসে যেতেন। সেখানে আমি ব্যতীত আর কেউ তাঁকে দেখেনি। সে সময় খাদিজার ঘর ব্যতীত আর কোথাও ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না আর সেসময় দু’জনের পর আমি ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ ও ঐশী বাণীর তাজাল্লি আমি দেখতাম এবং নবুওয়াতের সুঘ্রাণ প্রাণভরে গ্রহণ করতাম।’একান্ত অনুগত বুদ্ধিদীপ্ত আলীকে রাসূল (সা.) ভীষণ ভালবাসতেন। জন্মের পর থেকে আলীও রাসূলকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, একই গৃহের ভেতরে একই ছাদের নিচে একান্ত নিবিড়ভাবে। ছোটবেলা থেকে হযরত আলীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। মাত্র তের বছর বয়সে তিনি নিজেকে সত্যের পয়গাম গ্রহণকারী, রাসূল (সা.)-এর রিসালাতের স্বীকৃতি দানকারী ও দ্বীনের পথে প্রথম সাহায্যকারী হিসেবে বনু হাশিমের সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি দানের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে নিজের ভাই, ওয়ালী ও খলিফা বলে উপস্থিত সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর অনুসারিগণ হাবশা ও মদিনায় হিজরত করতে শুরু করেন। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ এলে মহানবী হযরত আলী (আ.)-কে নিজের বিছানায় রেখে রাতের আঁধারে মক্কা ত্যাগ করলেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর আলী (আ.) মক্কায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। তৃতীয় বা চতুর্থ দিন মদিনার উদ্দেশে প্রকাশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাঁর সাথে ছিল তাঁর মা, নবীকন্যা হযরত ফাতেমা, হযরত উম্মে আইমানসহ আরও কয়েকজন মহিলা। তিনি মদিনায় পৌঁছলে মহানবী (সা.) নিজে এগিয়ে এসে তাঁদের কাফেলাকে গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রিয় ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় মহানবীর চোখ মমতা ও আনন্দে ভরে গিয়েছিল।মদিনায় হযরত আলীর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। হযরত আলী তখন ২২-২৩ বছরের প্রাণবন্ত যুবক। মদিনা সনদ সম্পাদনের মাধ্যমে একটি জাতি গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২য় হিজরিতে বদরের যুদ্ধে হযরত আলী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বদরের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নিতে মক্কার কাফেররা পরের বছর পুনরায় যুদ্ধের আয়োজন করে। এই যুদ্ধে মদিনার মুসলমানদের অবহেলার জন্য ইসলামের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় সংযোজিত হয়। রাসূলুল্লাহ্র আদেশ অমান্য করার ফলে মুসলমানরা নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হয়ে এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ্র মৃত্যুর গুজবে মুসলিম বাহিনী হতাশ হয়ে পালাতে থাকে। সেসময়ে হযরত আলী বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে একত্রিত করে কাফিরদের ওপর আক্রমণ করেন। কুরাইশদের পতাকাবাহী নয়জন শ্রেষ্ঠ বীরকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ্কে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ওহুদের যুদ্ধে হযরত আলীর দেহে সত্তরটির মতো আঘাত লেগেছিল।৫ম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধে মদিনা যখন মক্কার কাফেরদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয় তখন আরবের বিখ্যাত যোদ্ধা ‘আমর ইবনে আবদে উদ্দ’ মল্লযুদ্ধের জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান করে। সে ছিল এক অপরাজেয় বীর। তাই তাকে বলা হতো ‘এক হাজার ঘোড় সওয়ারের সমতুল্য’১০। রাসূল (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে হযরত আলী আমর ইবনে আবদে উদ্দকে মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং মল্লযুদ্ধের এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করেন।৬২৮ সালে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক ছিলেন হযরত আলী (আ.)। সপ্তম হিজরিতে মহানবী (সা.) খায়বর অভিযানে বের হন। খায়বরের সুরক্ষিত দুর্গ কামুস জয় করা মুসলমানদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। কামুস দুর্গের প্রধান ছিল ‘হাজার বীরের শ্রেষ্ঠ বীর’ খ্যাত মারহাব। দ্বন্দ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী (আ.) মারহাবের মাথায় এমন জোরে আঘাত করলেন যে তরবারি মারহাবের শিরস্ত্রাণ পরিহিত মাথা দ্বিখণ্ডিত করে দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত নেমে এল। হযরত আলীর নেতৃত্বে দুর্ভেদ্য কামুস দুর্গের পতন ঘটে এবং মুসলমানরা খায়বর জয় করে। খায়বরবাসী খারাজ প্রদানের শর্তে সন্ধি করে।মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন মক্কায় প্রবেশ করেন। হযরত আলী ‘কাদ’-র দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। এক বিন্দু রক্তপাত ছাড়াই হযরত আলী তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেন।মক্কা বিজয়ের পর ঐ একই বছর হোনায়েনের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দিন ‘হাওয়াযিন গোত্রের’ আক্রমণে মুসলিম সৈন্যবাহিনী যখন দিশেহারা তখন হযরত আলী ও আব্বাস (রা.) সমগ্র আনসার বাহিনীকে একত্রিত করে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে মুসলমানগণ জয় লাভ করে।অষ্টম হিজরিতে হেজাজ অঞ্চলের চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলো। এরই প্রেক্ষিতে হযরত খালিদ ইবনে ওলীদকে ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয়। খালিদ দীর্ঘ ছয় মাস এখানে ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম গ্রহণ করল না। মহানবী (সা.) তাঁর স্থলে হযরত আলীকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন। তাঁর পাণ্ডিত্য, আভিজাত্যপূর্ণ মার্জিত ব্যবহার, রাসূলের প্রতিনিধিসুলভ ব্যক্তিত্ব, জীবন যাপনের সারল্য ইয়েমেনীদের মুগ্ধ করল। ইয়েমেনের হামদান গোত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে গেল। পরের বছর পুনরায় ইয়েমেনের মাযহাজী গোত্রের কাছে হযরত আলীকে প্রেরণ করা হয়। গোত্রপতিগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ ইয়েমেন ক্রমান্বয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসে।দশম হিজরিতে রাসূল (সা.) শেষ হজ করার জন্য মক্কায় গমন করলে হযরত আলী (আ.) তাঁর সহগামী হন। সেই বিখ্যাত বিদায় হজের ভাষণ শেষ করে মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো। মহানবী (সা.) সমবেত সাহাবিগণকে নিয়ে যোহরের নামায আদায় করে উটের হাওদার তৈরি মঞ্চে আরোহণ করে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন যা ‘খুত্বায়ে গাদীর’ নামে প্রসিদ্ধ। এই খুত্বাতে মহানবী (সা.) বলেছিলেন : ‘আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা ও তাদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অধিকার রাখি এবং তাদের ওপর অধিকার রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ততর। হে লোকসকল! আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা ও নেতা।’গাদীরে খুমের ভাষণের সত্যতা লিপিবদ্ধ করেছেন আত তাবারী, আবু নাঈম ইসফাহানী, ইবনে আসাকের, আবু ইসহাক হামুইনী, আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতীর মতো বিখ্যাত আলেমগণ।হযরত আলী তাঁর পূর্ববর্তী তিন খলিফার পঁচিশ বছরের শাসনামলে অধিকাংশ সময় নিজ গৃহে এবং মসজিদে নববীতেই কাটাতেন। এই সময় তিনি যেসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সেগুলো হলো :প্রথমত, তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল থাকা।দ্বিতীয়ত, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের তাফসীর, মুতাশাবেহ আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা, দুর্বোধ্য বিষয়াবলির সমাধান অন্বেষণ করা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে শিক্ষা দান করে তাঁকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রস্তুত করে তা উম্মাহ্র মাঝে প্রচার করার ব্যবস্থা করতেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর পরে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাস্সির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।তৃতীয়ত, খলিফাদের দরবারে অনাহূত সমস্যাগুলোর সমাধান বাতলে দেওয়া। জটিল বিষয়ে হযরত আলী তাঁর বিজ্ঞ মত ব্যক্ত করতেন যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল।চতুর্থত, একদল নিঃস্বার্থ, পবিত্র অন্তর ও আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও পরকালীন যাত্রার পথে আগ্রহী অনুসারী তৈরি করা যাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারেন।পঞ্চমত, বিধবা, অনাথ ও অসহায়দের প্রতিপালন ও পুনর্বাসনের জন্য অনুসারীদের মাঝে কর্ম তৎপরতা তৈরি করা এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে বাগান তৈরি করে, কূপ খনন করে সেগুলো ওয়াক্ফ করা।অর্থাৎ হযরত আলী (আ.) দ্বীন ইসলাম ও উম্মতের খিদমতের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।এছাড়াও এই পঁচিশ বছর সময়ে তিনি মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি নুস্খা বা অনুলিপি তৈরি করেন এবং মহানবী (সা.)- এর পবিত্র জীবনের অমিয় বাণী ও সুন্নাহ্র উপর একটি সংকলন তৈরি করেন যা মুসনাদে ইমাম আলী ইবনে আবি তালেব নামে প্রসিদ্ধ।রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর খলিফাদের শাসনকালে হযরত আলী ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেই অধিক গুরুত্ব দেন এবং খলিফাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।হযরত আলীর পরামর্শক্রমেই হযরত ওমর বায়তুল মুকাদ্দাসে যাত্রা করেছিলেন। নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ, ইয়ারমুকের যুেদ্ধ হযরত আলীর পরামর্শেই মুসলিম বাহিনী ও রাজধানী মদিনা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। খলিফাদের সময় হযরত আলী কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ঐতিহাসিক রায়সমূহ মুসলিম আইনের বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। এমনি আরও বহু ঘটনা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই।হযরত আলী তাঁর খিলাফতকালে চেয়েছিলেন মুসলমানদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র শাসনকালীন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মহানবীর পদ্ধতিকে পুনর্জীবিত করে মুসলিম উম্মাহকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। খিলাফতের প্রথমদিকে বাইতুল মালের বণ্টনের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কর তাদের জেনে রাখা উচিত শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড অন্য কিছুতে। শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্য যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় অধিকারের দিক থেকে সকলে পরস্পর সমান হবে। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা আর ধনসম্পদ হলো আল্লাহ্র যা তোমাদের মাঝে সমভাবে বণ্টিত হবে। এ ক্ষেত্রে কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আগামীকাল বাইতুল মাল তোমাদের মধ্যে বণ্টিত হবে আর এতে আরব-অনারব এক সমান।’তিনি পূর্ববর্তী খলিফার সময়ে দুর্নীতিপরায়ণ আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে অপসারণ করে তদস্থলে নতুন গভর্নরদের নিয়োগ দেন। একমাত্র সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ব্যতীত অন্য সকলেই খলিফার আদেশ মেনে নিয়ে নতুন গভর্নরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন।পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানবিক ও অতি সংবেদনশীল যুদ্ধনীতি ঘোষণা করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে জেনেভা কনভেনশন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতিসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে।আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর তেষট্টি বছরের ঘটনাবহুল জীবনের বাস্তব চিত্র পাঠকদের কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুট না হলে এবং ইসলামের চরম সংকটে তাঁর অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলে ইতিহাসের সত্য দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকার সম্ভাবনাই প্রবল।‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জ্ঞাননগরীর দরজা’ খ্যাত হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের জন্য স্বীকৃতি লাভ করেন। ইয়াকীনপূর্ণ জ্ঞান আর বোধে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেনÑ ‘আলী আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং বিচার কার্যে সকলের চেয়ে উত্তম।’ ইয়েমেনের সিংহের গর্তে নিহত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর মতামতকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের নিগূঢ় জ্ঞানরাশি মুহাম্মাদ (সা.) হযরত আলীকে শিখিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন তিনি ফিরে আসলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘কী আলোচনা হলো?’ তিনি বললেন : ‘মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন, প্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্রটি দ্বার উন্মুক্ত হয়।’ মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে হযরত আলী মসজিদে নববীতে জ্ঞানচর্চার মুক্তাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় খুতবার মাধ্যমে ও সাহাবিগণের আলাপচারিতায় তিনি যে সমস্ত বিদগ্ধ আলোচনা ও বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তা পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি সত্যিকার অর্থে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ কর্তৃক ‘শারহে নাহজুল বালাগাহ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হযরত আলী (আ.)-এর খুতবা ও পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে তাঁর জ্ঞানজগতের বিশালতা ও পরিব্যাপ্তি বোঝা যায়। এই সমস্ত খুতবার বিষয়বস্তু ছিল মহাজগৎ সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র অস্তিত্ব, ফেরেশ্তা সৃষ্টি, আদম সৃষ্টি ঈমান, রুহ্, রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা, অন্যান্য আসমানি কিতাবের আলোচনাসহ বিভিন্ন দার্শনিক ও তাত্ত্বিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞান-নগরীর দরজা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। এই সমস্ত জ্ঞানপূর্ণ সমাবেশে রাসূল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিগণ উপস্থিত থাকতেন। তাঁরা তাঁর কাছে বিভিন্ন জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন আর হযরত আলী (আ.) অত্যন্ত সুবিজ্ঞ উত্তরসহ মতামত দান করতেন।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পর ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত নাম হলো আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালেব (আ.)। তৎকালীন আরবে (সপ্তম শতাব্দী) যিনি একাধারে তাত্ত্বিক, সুবক্তা, লেখক, চিন্তক ও কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি জ্ঞান ও পবিত্রতার সাগর, ধর্মের কুতুব, ধর্মপথের প্রদর্শক, আল্লাহ্র রাসূলের চাচাত ভাই ও শেরে খোদা। তাঁর উপাধি মুরতাজা ও মুজতাবা। তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর স্বামী, আল্লাহ্র রাসূলের জামাতা। রাসূলের সাহাবিগণের মাঝে যিনি মর্যাদা ও সত্যের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকলেই একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও অতুলনীয় বীর যোদ্ধা।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (আ.) ২৩ হিজরি পূর্বাব্দের ১৩ রজব শুক্রবার আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম ফাতিমাহ্ বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম। তিনি প্রথম ঈমানদারদের একজন। রাসূল (সা.) হযরত আলীকে তাঁর শিশুকালেই নিজ গৃহে নিয়ে আসেন এবং তাঁর পবিত্র বিছানার পাশেই তাঁর দোলনাটি রাখা হয়েছিল। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে দোল দিতেন, গোসল করাতেন এবং দুধ খাওয়াতেন। এ সম্পর্কে হজরত আলী তাঁর বিখ্যাত ‘খুত্বাতুল ক্বাসেয়াহ্তে বলেছেন : ‘রাসূলের সাথে আমার বিশেষ জ্ঞাতিত্ব ও আত্মীয়তার কারণে আমার মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা জান। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনই তিনি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর পবিত্র বুকে চেপে ধরতেন, বিছানায় তাঁর পাশে শোয়াতেন, আমার শরীরে হাত বুলাতেন। তখন আমি তাঁর পবিত্র দেহের সুঘ্রাণ নিয়েছি। তিনি খাবার চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন…. সে সময় থেকেই আমি তাঁকে এমনভাবে অনুসরণ করতাম যেভাবে উটের বাচ্চা তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। প্রতিদিন তিনি আমাকে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখাতেন এবং তা অনুসরণ করতে আদেশ দিতেন। প্রতিবছর তিনি হেরা পাহাড়ে নির্জনবাসে যেতেন। সেখানে আমি ব্যতীত আর কেউ তাঁকে দেখেনি। সে সময় খাদিজার ঘর ব্যতীত আর কোথাও ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না আর সেসময় দু’জনের পর আমি ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ ও ঐশী বাণীর তাজাল্লি আমি দেখতাম এবং নবুওয়াতের সুঘ্রাণ প্রাণভরে গ্রহণ করতাম।’
একান্ত অনুগত বুদ্ধিদীপ্ত আলীকে রাসূল (সা.) ভীষণ ভালবাসতেন। জন্মের পর থেকে আলীও রাসূলকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, একই গৃহের ভেতরে একই ছাদের নিচে একান্ত নিবিড়ভাবে। ছোটবেলা থেকে হযরত আলীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। মাত্র তের বছর বয়সে তিনি নিজেকে সত্যের পয়গাম গ্রহণকারী, রাসূল (সা.)-এর রিসালাতের স্বীকৃতি দানকারী ও দ্বীনের পথে প্রথম সাহায্যকারী হিসেবে বনু হাশিমের সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি দানের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে নিজের ভাই, ওয়ালী ও খলিফা বলে উপস্থিত সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর অনুসারিগণ হাবশা ও মদিনায় হিজরত করতে শুরু করেন। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ এলে মহানবী হযরত আলী (আ.)-কে নিজের বিছানায় রেখে রাতের আঁধারে মক্কা ত্যাগ করলেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর আলী (আ.) মক্কায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। তৃতীয় বা চতুর্থ দিন মদিনার উদ্দেশে প্রকাশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাঁর সাথে ছিল তাঁর মা, নবীকন্যা হযরত ফাতেমা, হযরত উম্মে আইমানসহ আরও কয়েকজন মহিলা। তিনি মদিনায় পৌঁছলে মহানবী (সা.) নিজে এগিয়ে এসে তাঁদের কাফেলাকে গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রিয় ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় মহানবীর চোখ মমতা ও আনন্দে ভরে গিয়েছিল।
মদিনায় হযরত আলীর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। হযরত আলী তখন ২২-২৩ বছরের প্রাণবন্ত যুবক। মদিনা সনদ সম্পাদনের মাধ্যমে একটি জাতি গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২য় হিজরিতে বদরের যুদ্ধে হযরত আলী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বদরের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নিতে মক্কার কাফেররা পরের বছর পুনরায় যুদ্ধের আয়োজন করে। এই যুদ্ধে মদিনার মুসলমানদের অবহেলার জন্য ইসলামের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় সংযোজিত হয়। রাসূলুল্লাহ্র আদেশ অমান্য করার ফলে মুসলমানরা নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হয়ে এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ্র মৃত্যুর গুজবে মুসলিম বাহিনী হতাশ হয়ে পালাতে থাকে। সেসময়ে হযরত আলী বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে একত্রিত করে কাফিরদের ওপর আক্রমণ করেন। কুরাইশদের পতাকাবাহী নয়জন শ্রেষ্ঠ বীরকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ্কে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ওহুদের যুদ্ধে হযরত আলীর দেহে সত্তরটির মতো আঘাত লেগেছিল।

৫ম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধে মদিনা যখন মক্কার কাফেরদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয় তখন আরবের বিখ্যাত যোদ্ধা ‘আমর ইবনে আবদে উদ্দ’ মল্লযুদ্ধের জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান করে। সে ছিল এক অপরাজেয় বীর। তাই তাকে বলা হতো ‘এক হাজার ঘোড় সওয়ারের সমতুল্য’১০। রাসূল (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে হযরত আলী আমর ইবনে আবদে উদ্দকে মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং মল্লযুদ্ধের এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করেন।
৬২৮ সালে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক ছিলেন হযরত আলী (আ.)। সপ্তম হিজরিতে মহানবী (সা.) খায়বর অভিযানে বের হন। খায়বরের সুরক্ষিত দুর্গ কামুস জয় করা মুসলমানদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। কামুস দুর্গের প্রধান ছিল ‘হাজার বীরের শ্রেষ্ঠ বীর’ খ্যাত মারহাব। দ্বন্দ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী (আ.) মারহাবের মাথায় এমন জোরে আঘাত করলেন যে তরবারি মারহাবের শিরস্ত্রাণ পরিহিত মাথা দ্বিখণ্ডিত করে দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত নেমে এল। হযরত আলীর নেতৃত্বে দুর্ভেদ্য কামুস দুর্গের পতন ঘটে এবং মুসলমানরা খায়বর জয় করে। খায়বরবাসী খারাজ প্রদানের শর্তে সন্ধি করে।
মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন মক্কায় প্রবেশ করেন। হযরত আলী ‘কাদ’-র দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। এক বিন্দু রক্তপাত ছাড়াই হযরত আলী তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেন।
মক্কা বিজয়ের পর ঐ একই বছর হোনায়েনের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দিন ‘হাওয়াযিন গোত্রের’ আক্রমণে মুসলিম সৈন্যবাহিনী যখন দিশেহারা তখন হযরত আলী ও আব্বাস (রা.) সমগ্র আনসার বাহিনীকে একত্রিত করে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে মুসলমানগণ জয় লাভ করে।

অষ্টম হিজরিতে হেজাজ অঞ্চলের চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলো। এরই প্রেক্ষিতে হযরত খালিদ ইবনে ওলীদকে ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয়। খালিদ দীর্ঘ ছয় মাস এখানে ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম গ্রহণ করল না। মহানবী (সা.) তাঁর স্থলে হযরত আলীকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন। তাঁর পাণ্ডিত্য, আভিজাত্যপূর্ণ মার্জিত ব্যবহার, রাসূলের প্রতিনিধিসুলভ ব্যক্তিত্ব, জীবন যাপনের সারল্য ইয়েমেনীদের মুগ্ধ করল। ইয়েমেনের হামদান গোত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে গেল। পরের বছর পুনরায় ইয়েমেনের মাযহাজী গোত্রের কাছে হযরত আলীকে প্রেরণ করা হয়। গোত্রপতিগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ ইয়েমেন ক্রমান্বয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসে।
দশম হিজরিতে রাসূল (সা.) শেষ হজ করার জন্য মক্কায় গমন করলে হযরত আলী (আ.) তাঁর সহগামী হন। সেই বিখ্যাত বিদায় হজের ভাষণ শেষ করে মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো। মহানবী (সা.) সমবেত সাহাবিগণকে নিয়ে যোহরের নামায আদায় করে উটের হাওদার তৈরি মঞ্চে আরোহণ করে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন যা ‘খুত্বায়ে গাদীর’ নামে প্রসিদ্ধ। এই খুত্বাতে মহানবী (সা.) বলেছিলেন : ‘আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা ও তাদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অধিকার রাখি এবং তাদের ওপর অধিকার রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ততর। হে লোকসকল! আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা ও নেতা।’

গাদীরে খুমের ভাষণের সত্যতা লিপিবদ্ধ করেছেন আত তাবারী, আবু নাঈম ইসফাহানী, ইবনে আসাকের, আবু ইসহাক হামুইনী, আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতীর মতো বিখ্যাত আলেমগণ।
হযরত আলী তাঁর পূর্ববর্তী তিন খলিফার পঁচিশ বছরের শাসনামলে অধিকাংশ সময় নিজ গৃহে এবং মসজিদে নববীতেই কাটাতেন। এই সময় তিনি যেসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সেগুলো হলো :

প্রথমত, তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল থাকা।

দ্বিতীয়ত, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের তাফসীর, মুতাশাবেহ আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা, দুর্বোধ্য বিষয়াবলির সমাধান অন্বেষণ করা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে শিক্ষা দান করে তাঁকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রস্তুত করে তা উম্মাহ্র মাঝে প্রচার করার ব্যবস্থা করতেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর পরে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাস্সির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

তৃতীয়ত, খলিফাদের দরবারে অনাহূত সমস্যাগুলোর সমাধান বাতলে দেওয়া। জটিল বিষয়ে হযরত আলী তাঁর বিজ্ঞ মত ব্যক্ত করতেন যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল।

চতুর্থত, একদল নিঃস্বার্থ, পবিত্র অন্তর ও আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও পরকালীন যাত্রার পথে আগ্রহী অনুসারী তৈরি করা যাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারেন।

পঞ্চমত, বিধবা, অনাথ ও অসহায়দের প্রতিপালন ও পুনর্বাসনের জন্য অনুসারীদের মাঝে কর্ম তৎপরতা তৈরি করা এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে বাগান তৈরি করে, কূপ খনন করে সেগুলো ওয়াক্ফ করা।
অর্থাৎ হযরত আলী (আ.) দ্বীন ইসলাম ও উম্মতের খিদমতের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
এছাড়াও এই পঁচিশ বছর সময়ে তিনি মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি নুস্খা বা অনুলিপি তৈরি করেন এবং মহানবী (সা.)- এর পবিত্র জীবনের অমিয় বাণী ও সুন্নাহ্র উপর একটি সংকলন তৈরি করেন যা মুসনাদে ইমাম আলী ইবনে আবি তালেব নামে প্রসিদ্ধ।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর খলিফাদের শাসনকালে হযরত আলী ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেই অধিক গুরুত্ব দেন এবং খলিফাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।

হযরত আলীর পরামর্শক্রমেই হযরত ওমর বায়তুল মুকাদ্দাসে যাত্রা করেছিলেন। নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ, ইয়ারমুকের যুেদ্ধ হযরত আলীর পরামর্শেই মুসলিম বাহিনী ও রাজধানী মদিনা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। খলিফাদের সময় হযরত আলী কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ঐতিহাসিক রায়সমূহ মুসলিম আইনের বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। এমনি আরও বহু ঘটনা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই।
হযরত আলী তাঁর খিলাফতকালে চেয়েছিলেন মুসলমানদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র শাসনকালীন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মহানবীর পদ্ধতিকে পুনর্জীবিত করে মুসলিম উম্মাহকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। খিলাফতের প্রথমদিকে বাইতুল মালের বণ্টনের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কর তাদের জেনে রাখা উচিত শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড অন্য কিছুতে। শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্য যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় অধিকারের দিক থেকে সকলে পরস্পর সমান হবে। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা আর ধনসম্পদ হলো আল্লাহ্র যা তোমাদের মাঝে সমভাবে বণ্টিত হবে। এ ক্ষেত্রে কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আগামীকাল বাইতুল মাল তোমাদের মধ্যে বণ্টিত হবে আর এতে আরব-অনারব এক সমান।’
তিনি পূর্ববর্তী খলিফার সময়ে দুর্নীতিপরায়ণ আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে অপসারণ করে তদস্থলে নতুন গভর্নরদের নিয়োগ দেন। একমাত্র সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ব্যতীত অন্য সকলেই খলিফার আদেশ মেনে নিয়ে নতুন গভর্নরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানবিক ও অতি সংবেদনশীল যুদ্ধনীতি ঘোষণা করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে জেনেভা কনভেনশন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতিসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর তেষট্টি বছরের ঘটনাবহুল জীবনের বাস্তব চিত্র পাঠকদের কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুট না হলে এবং ইসলামের চরম সংকটে তাঁর অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলে ইতিহাসের সত্য দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকার সম্ভাবনাই প্রবল।
‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জ্ঞাননগরীর দরজা’ খ্যাত হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের জন্য স্বীকৃতি লাভ করেন। ইয়াকীনপূর্ণ জ্ঞান আর বোধে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেনÑ ‘আলী আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং বিচার কার্যে সকলের চেয়ে উত্তম।’ ইয়েমেনের সিংহের গর্তে নিহত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর মতামতকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের নিগূঢ় জ্ঞানরাশি মুহাম্মাদ (সা.) হযরত আলীকে শিখিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন তিনি ফিরে আসলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘কী আলোচনা হলো?’ তিনি বললেন : ‘মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন, প্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্রটি দ্বার উন্মুক্ত হয়।’ মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে হযরত আলী মসজিদে নববীতে জ্ঞানচর্চার মুক্তাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় খুতবার মাধ্যমে ও সাহাবিগণের আলাপচারিতায় তিনি যে সমস্ত বিদগ্ধ আলোচনা ও বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তা পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি সত্যিকার অর্থে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ কর্তৃক ‘শারহে নাহজুল বালাগাহ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হযরত আলী (আ.)-এর খুতবা ও পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে তাঁর জ্ঞানজগতের বিশালতা ও পরিব্যাপ্তি বোঝা যায়। এই সমস্ত খুতবার বিষয়বস্তু ছিল মহাজগৎ সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র অস্তিত্ব, ফেরেশ্তা সৃষ্টি, আদম সৃষ্টি ঈমান, রুহ্, রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা, অন্যান্য আসমানি কিতাবের আলোচনাসহ বিভিন্ন দার্শনিক ও তাত্ত্বিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞান-নগরীর দরজা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। এই সমস্ত জ্ঞানপূর্ণ সমাবেশে রাসূল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিগণ উপস্থিত থাকতেন। তাঁরা তাঁর কাছে বিভিন্ন জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন আর হযরত আলী (আ.) অত্যন্ত সুবিজ্ঞ উত্তরসহ মতামত দান করতেন।

প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202