(পর্ব ৪১): কারবালা বিপ্লব পরবর্তী ঘটনাবলীজুন ০১, ২০১৯ ১৮:২২ Asia/Dhakaআশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা কুফা ও শামের ভর মজলিসে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র তেজদ্বীপ্ত ভাষণ এবং জনগণের ওপর এসব ভাষণের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা কারবালা বিপ্লব পরবর্তী কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করব।ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র জ্বালাময়ী ভাষণের প্রভাবে জনগণ বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে এমন চিন্তায় ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পাপিষ্ঠ এজিদ। মদীনার জনগণ এজিদের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে- এমন খবর পাওয়ার পর মোসলেম বিন উকবার নেতৃত্বে মদীনায় সৈন্য পাঠায় সে। বিন উকবা মদীনায় গিয়ে তিনদিন ধরে সেখানকার নিরীহ জনগণের ওপর গণহত্যা ও নারীদের ওপর গণধর্ষণ চালায়। অথচ এই মদীনা সম্পর্কে বিশ্বনবীর এক হাদিসে বলা হয়েছে, “হে আল্লাহ যে কেউ মদীনার জনগণের ওপর হামলা চালাবে এবং তাদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করবে তার ওপর তোমার নিজের ও ফেরেশতাদের ঘৃণা বর্ষণ করো।” সেই মদীনার জনগণ বনি উমাইয়া শাসকদের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজের শিকার হন।মদীনাবাসীর ওপর পাশবিকতা চালিয়ে দৃশ্যত মুসলিম বিন উকবার রক্তপিপাসা মেটেনি। সে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরকে হত্যা করার জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়। এ সময় এজিদের নির্দেশে হুসাইনুবনু নুমায়েরকে এই আগ্রাসী বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের মক্কার বাইরে এজিদের পাঠানো বাহিনীকে প্রতিহত করেন। কিন্তু যুদ্ধে তার অনেক সৈন্য নিহত হওয়ার পর আব্দুল্লাহ মক্কা শরীফে আশ্রয় নেন। এ সময় ইবনে নুমায়ের বাহিনী মক্কার চারপাশ থেকে শহরে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করে যার ফলে কাবা শরীফে আগুন ধরে যায়। এজিদের পাঠানো রক্তপীপাসু বাহিনী মক্কা নগরীতেও ব্যাপক লুটপাট চালায়। কিন্তু হিজরি ৬৪ সালের রবিউস সানি মাসের প্রথমদিকে এজিদের মৃত্যুর খবর মক্কায় পৌঁছালে হুসাইনিবনু নুমায়ের তার বাহিনী নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।এখানে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে তা হচ্ছে, কারবালার হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা, আল্লাহর রাসূলের শহর মদীনায় গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালানো এবং মক্কায় আল্লাহর ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মতো যেসব ধৃষ্টতা বনি উমাইয়া গোষ্ঠী দেখায় তার সূত্রপাত কবে হয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বিদায় হজ্ব শেষে আল্লাহর রাসূল (সা.) গাদিরে খোমে হযরত আলী (আ.)কে নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা উপেক্ষা করার সময়ই এসব অপরাধযজ্ঞের বীজ বপিত হয়।এই বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় এজিদের মৃত্যুর পর তার পুত্র মুয়াবিয়া ইবনে এজিদ ক্ষমতায় আসলে। মুয়াবিয়া ইবনে এজিদ ক্ষমতা গ্রহণ করেই এক বক্তব্যে তার পূর্বপুরুষদের অপতৎপরতার সমালোচনা করেন, কারবালা বিপর্যয় এবং মদীনা ও মক্কায় চালানো পাশবিকতার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, এসব পাশবিকতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করে জানান, রাসূলে খোদার পবিত্র বংশধররাই খেলাফতের যোগ্য উত্তরাধিকার।নিঃসন্দেহে ইসলামের অঙ্কুরেই যদি হযরত আলী (আ.) মুসলিম উম্মাহর ইমামত ও খেলাফতের দায়িত্ব নিতেন তাহলে মুয়াবিয়া ও এজিদের মতো লোকেরা মুসলিম জাহানের অধিপতি হতে পারত না এবং কারবালা ও মক্কা-মদীনার বিপর্যয় ঘটতে পারত না। এখানে অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যে, ইমাম সাজ্জাদ (আ.) কেন এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি এবং মদীনা ও মক্কায় বনি উমাইয়া বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিহত করার চেষ্টা করেননি?এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, ইমাম সাজ্জাদ নিজের চোখে তাঁর পূর্ব পুরুষদের যেসব বেদনাদায়ক ঘটনা দেখতে পেয়েছিলেন তারপর আর বিদ্রোহ করার মতো মানসিকতা তার ছিল না। সেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) উপলব্ধি করেন, তিনি এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আবার নিরীহ কিছু মুসলমানের রক্তপাত ছাড়া আর কোনো ফল বয়ে আসবে না। তাই তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিবর্তে সচেতনতামূলক ভাষণের মাধ্যমে ঘুমিয়ে পড়া জনগণের বিবেক জাগিয়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর অযোগ্যতা ও দুঃশাসনের বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি রাসূলের আহলে বাইতের যোগ্যতা ও উচ্চ মর্যাদার কথা প্রচার করতে থাকেন।এ সময় কিছু অদূরদর্শী লোক ভাবতে থাকে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে ভয় পাচ্ছেন। তাই তারা ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে সূরা তওবার ১১১ নম্বর আয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই আয়াতের একাংশে বলা হয়েছে: “নিশ্চয় আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, অতঃপর মারে ও মারা যায়।”ইমাম তাদের এ বক্তব্য শোনার পর বলেন: সূরা তওবার যে আয়াতের কথা তোমরা বললে তার পরের আয়াতেই এসব মুমিন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। আমি যদি তোমাদের মধ্যে সেসব বৈশিষ্ট্য দেখতে পেতাম তাহলে তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই বনি উমাইয়াদের শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতাম। ওই আয়াতে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, “তারা তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোযার, রোজা পালনকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহর দেওয়া সীমাসমূহের হেফাযতকারী। বস্তুতঃ সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে।”এজিদের মৃত্যুর পর মক্কা আগ্রাসন থেকে বেঁচে যাওয়া আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের বিদ্রোহ করেন এবং হিজাজ, ইয়েমেন, ইরাক ও খোরাসানের জনগণ তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। অন্যদিকে মুয়াবিয়া ইবনে এজিদ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করার পর মারওয়ান ইবনে হাকাম ক্ষমতা দখল করে। মারওয়ান ছিল আল্লাহর রাসূলের শত্রু এবং এই শত্রুতার কারণে বিশ্বনবী (সা.) মারওয়ান ও তার পিতাকে মদীনা থেকে বহিস্কার করেছিলেন। মাওয়ান শাম ও মিশরে নিজের ক্ষমতা সংহত করে। তার মৃত্যুর পর ৬৫ হিজরিতে তার ছেলে আব্দুলমালেক মারওয়ান শামের ক্ষমতা গ্রহণ করে। ওদিকে মক্কায় তখন চলছিল আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের শাসন। ৭০ হিজরিতে আব্দুলমালেক মক্কা অবরোধ করে আব্দুল্লাহকে প্রথমে বন্দি ও পরে হত্যা করে।আব্দুলমালেক ছিল চরম নির্দয় ও নিষ্ঠুর এক শাসক। নরহত্যায় তার কোনো তুলনা ছিল না। শাসনকাজ পরিচালনায় তার সহযোগীরাও ছিল একই চরিত্রের অধিকারী। উদাহরণ হিসেবে বাগদাদে তার খলিফা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নাম উল্লেখ করা যায়। রক্তপিপাসু এই শাসকের হাতে এক লাখ ২০ হাজার বা মতান্তরে এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ নিহত হয়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নিজে বলে বেড়াত যে, মানুষ হত্যা করার মতো অন্য কিছুতে সে এত বেশি আনন্দ পায় না। আব্দুলমালেকের মৃত্যুর পর পর ওয়ালিদ ক্ষমতায় আসে। সেও ক্ষমতায় এসে তার শাসনের বিরুদ্ধাচরণকারীদের কঠোর হাতে দমন করার ঘোষণা দেয়। তো বন্ধুরা! অবৈধভাবে শাসনক্ষমতা দখলদারদের এই ধরনের ভয়ঙ্কর আচরণের কারণে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র সামনে গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আগামী আসরে আমরা এ সম্পর্কে আরো আলোচনা করব। সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০১
(পর্ব ৪১): কারবালা বিপ্লব পরবর্তী ঘটনাবলী
জুন ০১, ২০১৯ ১৮:২২ Asia/Dhaka
আশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা কুফা ও শামের ভর মজলিসে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র তেজদ্বীপ্ত ভাষণ এবং জনগণের ওপর এসব ভাষণের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা কারবালা বিপ্লব পরবর্তী কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করব।
ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র জ্বালাময়ী ভাষণের প্রভাবে জনগণ বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে এমন চিন্তায় ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পাপিষ্ঠ এজিদ। মদীনার জনগণ এজিদের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে- এমন খবর পাওয়ার পর মোসলেম বিন উকবার নেতৃত্বে মদীনায় সৈন্য পাঠায় সে। বিন উকবা মদীনায় গিয়ে তিনদিন ধরে সেখানকার নিরীহ জনগণের ওপর গণহত্যা ও নারীদের ওপর গণধর্ষণ চালায়। অথচ এই মদীনা সম্পর্কে বিশ্বনবীর এক হাদিসে বলা হয়েছে, “হে আল্লাহ যে কেউ মদীনার জনগণের ওপর হামলা চালাবে এবং তাদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করবে তার ওপর তোমার নিজের ও ফেরেশতাদের ঘৃণা বর্ষণ করো।” সেই মদীনার জনগণ বনি উমাইয়া শাসকদের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজের শিকার হন।
মদীনাবাসীর ওপর পাশবিকতা চালিয়ে দৃশ্যত মুসলিম বিন উকবার রক্তপিপাসা মেটেনি। সে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরকে হত্যা করার জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়। এ সময় এজিদের নির্দেশে হুসাইনুবনু নুমায়েরকে এই আগ্রাসী বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের মক্কার বাইরে এজিদের পাঠানো বাহিনীকে প্রতিহত করেন। কিন্তু যুদ্ধে তার অনেক সৈন্য নিহত হওয়ার পর আব্দুল্লাহ মক্কা শরীফে আশ্রয় নেন। এ সময় ইবনে নুমায়ের বাহিনী মক্কার চারপাশ থেকে শহরে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করে যার ফলে কাবা শরীফে আগুন ধরে যায়। এজিদের পাঠানো রক্তপীপাসু বাহিনী মক্কা নগরীতেও ব্যাপক লুটপাট চালায়। কিন্তু হিজরি ৬৪ সালের রবিউস সানি মাসের প্রথমদিকে এজিদের মৃত্যুর খবর মক্কায় পৌঁছালে হুসাইনিবনু নুমায়ের তার বাহিনী নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
এখানে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে তা হচ্ছে, কারবালার হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা, আল্লাহর রাসূলের শহর মদীনায় গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালানো এবং মক্কায় আল্লাহর ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মতো যেসব ধৃষ্টতা বনি উমাইয়া গোষ্ঠী দেখায় তার সূত্রপাত কবে হয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বিদায় হজ্ব শেষে আল্লাহর রাসূল (সা.) গাদিরে খোমে হযরত আলী (আ.)কে নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা উপেক্ষা করার সময়ই এসব অপরাধযজ্ঞের বীজ বপিত হয়।
এই বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় এজিদের মৃত্যুর পর তার পুত্র মুয়াবিয়া ইবনে এজিদ ক্ষমতায় আসলে। মুয়াবিয়া ইবনে এজিদ ক্ষমতা গ্রহণ করেই এক বক্তব্যে তার পূর্বপুরুষদের অপতৎপরতার সমালোচনা করেন, কারবালা বিপর্যয় এবং মদীনা ও মক্কায় চালানো পাশবিকতার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, এসব পাশবিকতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করে জানান, রাসূলে খোদার পবিত্র বংশধররাই খেলাফতের যোগ্য উত্তরাধিকার।
নিঃসন্দেহে ইসলামের অঙ্কুরেই যদি হযরত আলী (আ.) মুসলিম উম্মাহর ইমামত ও খেলাফতের দায়িত্ব নিতেন তাহলে মুয়াবিয়া ও এজিদের মতো লোকেরা মুসলিম জাহানের অধিপতি হতে পারত না এবং কারবালা ও মক্কা-মদীনার বিপর্যয় ঘটতে পারত না। এখানে অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যে, ইমাম সাজ্জাদ (আ.) কেন এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি এবং মদীনা ও মক্কায় বনি উমাইয়া বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিহত করার চেষ্টা করেননি?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, ইমাম সাজ্জাদ নিজের চোখে তাঁর পূর্ব পুরুষদের যেসব বেদনাদায়ক ঘটনা দেখতে পেয়েছিলেন তারপর আর বিদ্রোহ করার মতো মানসিকতা তার ছিল না। সেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) উপলব্ধি করেন, তিনি এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আবার নিরীহ কিছু মুসলমানের রক্তপাত ছাড়া আর কোনো ফল বয়ে আসবে না। তাই তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিবর্তে সচেতনতামূলক ভাষণের মাধ্যমে ঘুমিয়ে পড়া জনগণের বিবেক জাগিয়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর অযোগ্যতা ও দুঃশাসনের বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি রাসূলের আহলে বাইতের যোগ্যতা ও উচ্চ মর্যাদার কথা প্রচার করতে থাকেন।
এ সময় কিছু অদূরদর্শী লোক ভাবতে থাকে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে ভয় পাচ্ছেন। তাই তারা ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে সূরা তওবার ১১১ নম্বর আয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই আয়াতের একাংশে বলা হয়েছে: “নিশ্চয় আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, অতঃপর মারে ও মারা যায়।”
ইমাম তাদের এ বক্তব্য শোনার পর বলেন: সূরা তওবার যে আয়াতের কথা তোমরা বললে তার পরের আয়াতেই এসব মুমিন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। আমি যদি তোমাদের মধ্যে সেসব বৈশিষ্ট্য দেখতে পেতাম তাহলে তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই বনি উমাইয়াদের শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতাম। ওই আয়াতে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, “তারা তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোযার, রোজা পালনকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহর দেওয়া সীমাসমূহের হেফাযতকারী। বস্তুতঃ সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে।”
এজিদের মৃত্যুর পর মক্কা আগ্রাসন থেকে বেঁচে যাওয়া আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের বিদ্রোহ করেন এবং হিজাজ, ইয়েমেন, ইরাক ও খোরাসানের জনগণ তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। অন্যদিকে মুয়াবিয়া ইবনে এজিদ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করার পর মারওয়ান ইবনে হাকাম ক্ষমতা দখল করে। মারওয়ান ছিল আল্লাহর রাসূলের শত্রু এবং এই শত্রুতার কারণে বিশ্বনবী (সা.) মারওয়ান ও তার পিতাকে মদীনা থেকে বহিস্কার করেছিলেন। মাওয়ান শাম ও মিশরে নিজের ক্ষমতা সংহত করে। তার মৃত্যুর পর ৬৫ হিজরিতে তার ছেলে আব্দুলমালেক মারওয়ান শামের ক্ষমতা গ্রহণ করে। ওদিকে মক্কায় তখন চলছিল আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের শাসন। ৭০ হিজরিতে আব্দুলমালেক মক্কা অবরোধ করে আব্দুল্লাহকে প্রথমে বন্দি ও পরে হত্যা করে।
আব্দুলমালেক ছিল চরম নির্দয় ও নিষ্ঠুর এক শাসক। নরহত্যায় তার কোনো তুলনা ছিল না। শাসনকাজ পরিচালনায় তার সহযোগীরাও ছিল একই চরিত্রের অধিকারী। উদাহরণ হিসেবে বাগদাদে তার খলিফা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নাম উল্লেখ করা যায়। রক্তপিপাসু এই শাসকের হাতে এক লাখ ২০ হাজার বা মতান্তরে এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ নিহত হয়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নিজে বলে বেড়াত যে, মানুষ হত্যা করার মতো অন্য কিছুতে সে এত বেশি আনন্দ পায় না। আব্দুলমালেকের মৃত্যুর পর পর ওয়ালিদ ক্ষমতায় আসে। সেও ক্ষমতায় এসে তার শাসনের বিরুদ্ধাচরণকারীদের কঠোর হাতে দমন করার ঘোষণা দেয়।
তো বন্ধুরা! অবৈধভাবে শাসনক্ষমতা দখলদারদের এই ধরনের ভয়ঙ্কর আচরণের কারণে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র সামনে গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আগামী আসরে আমরা এ সম্পর্কে আরো আলোচনা করব। সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০১
মন্তব্যসমূহ