হাদীসে সাকালাইন ও এর সাথে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হাদীসসমূহের পর্যালোচনাহাদীসে সাকালাইনের অর্থঅনেক হাদীস থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে,গাদীরে খুমে একটি ভাষণের মধ্যেই মহানবী (সা.) হাদীসে সাকালাইন ও হাদীসে গাদীরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব হাদীসের কয়েকটি মুত্তাকী আল-হিন্দী তাঁর ‘কানজুল উম্মাল’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ১৬৭),ইবনে কাসির তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে (৫ম খণ্ড,পৃ. ২০৯),আস সাখাভী তাঁর ‘আল-ইসতিজলাব’ গ্রন্থে,আল সামহুদী তাঁর ‘জাওয়াহির আল ইকদাইন’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তাঁর ‘সাওয়ায়েক’ গ্রন্থে তাবারানী ও অন্যদের থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন।কতিপয় হাদীসে ‘খালিফাতাইন’ (উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি) শব্দটি সাকালাইন শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ করা হয়েছে,যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁর মুসনাদে (৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮১) উল্লেখ করেছেন। আবার তাবারানী,ইবনে আবি আসিম,আবু বকর ইবনে আবি শায়বাহ,আল-যারকানী এবং অন্যরাও উল্লেখ করেছেন। এই শব্দ ইমাম আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের নেতৃত্ব ও খেলাফতের বিষয়টিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ করে।এ হাদীসের কতিপয় বর্ণনা,যেমন কুন্দুজী তাঁর ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহতে হাসান ইবনে আলী (আ.) থেকে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাতে নবী (সা.)-এর বাণী রয়েছে যা ইমামতের চিরস্থায়িত্বের বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে :‘হে আল্লাহ! তুমি দুনিয়াকে সৃষ্টির ওপর তোমার হুজ্জাত থেকে খালি রেখ না যাতে তোমার হুজ্জাত বাতিল হয়ে যায় অথবা তুমি তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার পর তোমার বন্ধুরা বিপথে যেতে না পারে। তারা (আল্লাহর হুজ্জাত) সংখ্যায় অল্প,কিন্তু সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহর নৈকট্যশীল। নিশ্চয়ই আমি প্রশংসিত ও মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমার বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বংশধরদের বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বীজের মধ্যে এবং আমার বীজের বীজের মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দেওয়ার। আর আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে।’এটি নাহজুল বালাগায় বর্ণিত (হিকাম : ১৪৭) আলী (আ.) কর্তৃক তাঁর শিষ্য কুমাইল ইবনে যিয়াদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ :...হ্যাঁ,পৃথিবী কখনও এমন লোকশূন্য হয়ে যায় না যারা গোপনে বা প্রকাশ্যে আল্লাহর ওপর রক্ষা করে এবং তারা সব সময় শংকিত থাকে যে,আল্লাহর গুপ্ত ওজর ও প্রমাণ যেন অপ্রমাণিত না হয়। তাদের সংখ্যা কত,আর তারা কোথায়? আল্লাহর কসম,তাদের সংখ্যা কম,কিন্তু আল্লাহর নিকট তাদের সম্মান অনেক বেশি। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর ওজর ও প্রমাণ রক্ষা করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের মতো অপর কাউকে বিশ্বাস না করে এবং তাদের মতো অন্য কারও হৃদয়ে আস্থার বীজ বপন না করে।জ্ঞান তাদেরকে সত্যিকার বোধগম্যতার দিকে চালিত করে এবং এ কারণে তারা দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন আত্মার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। অন্যেরা যেটাকে কঠিন বলে মনে করে তা তারা সহজ বলে মনে করে। অজ্ঞরা যা বিস্ময়কর মনে করে,তারা তা সাদরে গ্রহণ করে। তারা এ পৃথিবীতে দেহ নিয়ে বসবাস করে,কিন্তু তাদের আত্মা অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। আল্লাহর জমিনে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তাঁর দীনের প্রতি আহ্বানকারী। আহা! তাদেরকে দেখার জন্য আমার আকুল আগ্রহ!হযরত আলীর এ বক্তব্য অনেক হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিক তাঁদের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইবনে আব্দ রাব্বিহ তাঁর ‘আল ইকদুল ফারীদ’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ২৬৫,২৯৩);ইয়াকুবী তাঁর ‘তারিখ’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ৪০০);আল হাররানী তাঁর ‘তুহাফুল উকূল’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬৯);আল খাতীব আল বাগদাদী তাঁর ‘তারীখে বাগদাদ’ গ্রন্থে (৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ৩৮৯);আল রাযী তাঁর ‘তাফসীরে কাবীর’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২);ইবনে আবদুল বার তাঁর ‘আল মুখতাসার’ গ্রন্থে (পৃ. ২৯) এ রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হওয়া কতিপয় হাদীস ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী একটি গ্রন্থে (তোহফায়ে ইসনা আশারা) হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করে হাদীসে সাকালাইনের ঘোষিত আহলে বাইতের নেতৃত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। আমরা এখানে সেই হাদীসগুলো উল্লেখ করে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করব।প্রথম হাদীসশাহ আবদুল আযীয তাঁর তুহ্ফা গ্রন্থে বলেন,যদি হাদীসে সাকালাইন গ্রহণ করা হয়েও থাকে,তবু তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অপর কয়েকটি হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব হাদীসের মধ্য থেকে তিনি নিম্নোল্লিখিত হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেন :‘আমার সুন্নাহ অনুসরণ কর এবং আমার পর সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারীদের (খোলাফায়ে রাশেদীনের) অনুসরণ কর,তা আঁকড়ে ধর এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন (আবাকাত আল আনওয়ার গ্রন্থের প্রণেতা) বলেন যে,এমন হাদীস সহীহ নয়।প্রথমত,তিনি বলেন,এ হাদীসটি কেবল সুন্নীদের দ্বারা বর্ণনাকৃত। অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন সুন্নীদের পাশাপাশি আহলে বাইতের মাযহাবের আলেমগণও বর্ণনা করেছেন।দ্বিতীয়ত শাহ আবদুল আযীয এখানে তাঁর স্বঘোষিত নীতি ওপর বহাল থাকেননি যে,আহলে বাইতের মতবাদের বিপক্ষে তাঁর যুক্তি তাদের দ্বারা গ্রহণীয় লেখনীর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হবে।তৃতীয়ত হাদীসটি মুসলিম ও বুখারী লিপিবদ্ধ করেননি-হাদীসের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত যাঁদেরকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করে থাকে।চতুর্থত,উপরিউক্ত হাদীসের সহীহ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। কারণ,সুন্নী আলেমগণের দ্বারাই এ হাদীসের সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।এ হাদীসের ওপর পর্যালোচনাএ হাদীসটি আবু দাউদ,তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে। আবু দাউদের রাবীদের সম্পর্কিত আলোচনা :আল-আরবাদ ইবনে সারিআহ-তিনি এ হাদীসের অন্যতম রাবী (বর্ণনাকারী)। তিনি নির্ভরযোগ্য নন। কারণ,তিনি নিজের সম্বন্ধেই এমন উক্তি করেছেন যে,‘আমি ইসলামের এক-চতুর্থাংশ।’হাজার ইবনে হাজার আল কিলাই-সিরিয়ার একটি শহরে বসবাস করত যে শহরের অধিবাসীরা আলী (আ.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। ইবনে হাজার তাঁর তাহযীব আত তাহযীবে তাঁর অবস্থা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। (৩য় খণ্ড,পৃ. ১১৮)খালিদ ইবনে মাদান ইবনে আবি কারিব আল কিতাবী-সে ছিল ইসলামের ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়ার পুলিশ বাহিনীর প্রধান।সাওর ইবনে ইয়াযীদ-ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে,সে আলী (আ.)-কে ঘৃণা করত। কারণ,তিনি এক যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন এবং তাঁকে একজন গোঁড়া মনে করতেন।পরবর্তী রাবী হলো আল ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম। আবু মুসহার কর্তৃক জালকরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে,যা মিযানুল ইতিদালে যাহাবী উল্লেখ করেছেন (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৪৭) ।অন্যদিকে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ যেসব রাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন,যেমন আবু আসিম,হাসান ইবনে আলী আল-খাল্লাল,বুহাইর ইবনে সা’দ,বাকীয়াহ ইবনে আল-ওয়ালীদ,ইয়াহইয়া ইবনে আবি আল-মুতী,আবদুল্লাহ ইবনে আলা’,মু‘আবিয়া ইবনে সালিহ,ইসমাঈল ইবনে বিশর ইবনে মানসূর এবং আবুল মালিক ইবনে আল-সাব্বাহ-তাঁরা সকলেই দুর্বল রাবী। আহলে সুন্নাতের রেজালশাস্ত্রবিদগণ তাঁদের সকলকেই দুর্বল রাবী হিসাবে অভিহিত করেছেন।উপরন্তু যদি এ হাদীসটি সহীহ বলে ধরেও নিই,তবু তা হাদীসে সাকালাইনের বিপক্ষে কোন গুরুত্ব রাখে না। কারণ,হাদীসে সাকালাইন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিপুল সংখ্যক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে,অন্যদিকে সুন্নী পণ্ডিতদের বিপুল সংখ্যক তাঁদের হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করেননি। যদি এ হাদীসটি সত্যিই নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে,তবে ‘সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারী’ শব্দগুলো আহলে বাইতের বারো ইমামের ওপর আরোপ করা যায়-যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সমর্থিত হতে পারে। আর সেই হাদীসটি হল ‘আমার পরে বারো জন খলীফা বা ইমাম আসবে।’শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত আরেকটি প্রশ্নের জবাব দানআবদুল আযীয বলেছেন,যদি হাদীসে সাকালাইন পূর্বোক্ত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নাও হয়,তবুও ‘ইতরাত’ শব্দ সাধারণভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গোত্র বনি হাশিমের সকল আত্মীয় অথবা হযরত ফাতিমার সকল বংশধরের ওপর আরোপ করা যায়। তাহলে এটি বলা অবান্তর যে,তাঁদের সকলেই হলেন ইমাম।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এ সন্দেহ সম্পর্কে নানা অভিধান রচয়িতার অর্থ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন,যেমন জাওহারী,ইবনে আসির,ইবনে মানযুর,আল ফিরূযাবাদী এবং অন্যরা। তাঁদের মতে ‘ইতরাত’ বলতে বুঝায় কারও নিকটতম আত্মীয় (আখাস আকরাবীন),সন্তানাদি (ওয়ালাদ) এবং বংশধর (যুররিয়াহ)।উপরন্তু তিনি উল্লেখ করেন,হাদীসে সাকালাইন তাঁদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাধান্যের পাশাপাশি তাঁদের পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিও নির্দেশ করে। এমন বর্ণনা নিঃসন্দেহে কেবল বারো ইমামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,আলী (আ.) যাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ‘ইতরাত’ বলে পরিচিত করিয়েছেন এবং কুরআনের ব্যাপারে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন।দ্বিতীয় হাদীসশাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত দ্বিতীয় হাদীসটি হলো :‘ধর্মের বিষয়াদি তোমরা এই হুমায়রার (আয়েশা) নিকট থেকে গ্রহণ কর।’তিনি এ হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেছেন।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,সুন্নী পণ্ডিতগণই এ হাদীসকে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন :১. আল-মিযযী এবং যাহাবী (আল-তাকরীর ওয়াল তাহবীর ফি শাহর আল-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।২. ইবনুল কাইয়্যেম জাওযীয়াহ,যেসব হাদীস ‘হে হুমায়রা’ এবং ‘আল-হুমায়রা’ শব্দযোগে এসেছে সেসব হাদীসকে তিনি জাল বলে গণ্য করেছেন।৩. ইবনে কাসির,(আল-দুরুর আল-মুনতাশিরাহ ফি আল-আহাদীস আল-মুশতাহিরাহ,পৃ. ৭৯)।৪. ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(আল-তাকরীর ওয়া আল-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।৫. তাঁদের পাশাপাশি ইবনুল মুলাক্কিন,আস সুবকি,ইবনে আমির আল-হাজ,আল-সাখাভী,আল-সুয়ূতী,আল-শায়বানী,আল-শেখ আলী আল-কারী,আল-যারকানী,আবদুল আলী আল-শাওকানী এবং অন্যরাও এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তৃতীয় হাদীসশাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে এনেছেন। আর তা হলো :‘আম্মারের নিকট থেকে পথনির্দেশনা চাও।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন হাদীস কখনই হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উত্থাপন করা যায় না। কারণ,হযরত আম্মার নিজেই হযরত আলী (আ.)-এর একনিষ্ঠ শিয়া (অনুসারী) ছিলেন এবং মহানবী (সা.) তাঁকে হযরত আলীকে মেনে চলা ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে :‘হে আম্মার! আলী তোমাকে সত্যপথ হতে বিচ্যুত করবে না। হে আম্মার! আলীর আনুগত্য আমার আনুগত্য,আর আমার আনুগত্যই হল সর্বশক্তিমান ও প্রশংসিত আল্লাহর আনুগত্য।’এ হাদীসটি বেশ কয়েকটি সুন্নী হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ফারায়েদুস সিমতাইন,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭৮;আল মাওয়াদ্দাহ ফিল কুরবা;আল খারাযমীর মানাকিব,পৃ. ৫৭ ও ১২৪;ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ১২৮ ও ২৫০;মিফতাহ আন-নাযা এবং কানজুল উম্মাল,১২তম খণ্ড,পৃ. ২১২।উপরন্তু এ বিষয়টি অদ্ভুত যে,শাহ আবদুল আযীয এ হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উপস্থাপন করেছেন,যেখানে ঐতিহাসিক ইয়াকুবী তাঁর তারিখে (২য় খণ্ড,পৃ. ১১৪) এবং মাসউদী তাঁর মুরুযুয যাহাব (২য় খণ্ড,পৃ. ৩৪২) গ্রন্থে আম্মারকে তাঁদের মধ্যে গণ্য করেছেন যাঁরা প্রথম খলীফার আনুগত্য করা থেকে দূরে ছিলেন। হযরত উমর তাঁর খেলাফতকালে আম্মারের দিকনির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং কর্কশ কণ্ঠে তাঁর সাথে কথা বলেছিলেন যখন তিনি ওযূর জন্য পানি না পেলে নামায ছেড়ে না দিয়ে তায়াম্মুম করার মাধ্যমে পবিত্র হবার বিষয়টি তাঁর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। এ ঘটনাটি নিম্নের হাদীস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : মুসনাদে আহমাদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৫;সহীহ মুসলিম,১ম খণ্ড,পৃ. ১১০;আবু দাউদ,নাসাঈ,তাবারী,আল-আঈনী,ইবনে আসির এবং আল-শায়বানীও এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন।হযরত উসমান তাঁর খেলাফতকালে আম্মারকে ততক্ষণ প্রহার করেন যতক্ষণ না আম্মার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ঘটনাটি তখন ঘটে যখন তিনি হযরত উসমানের শাসনামলের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে মুসলমানদের প্রতিবাদলিপি তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। এ ঘটনাটি নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : ইবনে কুতাইবার আল-ইমামাহ্ ওয়াল সিয়াসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ৩২;ইবনে আবদ রাব্বিহের আল-ইকদুল ফারীদ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২;মাসউদীর মুরুযুয যাহাব,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৩৮;ইবনে আবদুল বারের আল-ইসতিয়াব,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬;ইয়াকুবীর তারিখ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৬০।যদিও রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আম্মার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছিলেন,যেমন ‘আম্মারের শত্রু আল্লাহর শত্রু’,তারপরও রাসূলের কতিপয় সাহাবী কর্তৃক তিনি প্রতিরোধের মুখে পড়েন,তাঁরা তাঁকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করতেন,যেমন আবদুর রহমান ইবনে আওফ,সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,মুগীরাহ ইবনে শোবা,আবু মূসা আশআরী,আবু মাসউদ আল-আনসারী এবং অন্যরা। আম্মার দৃঢ়ভাবে আলীর পক্ষে এবং আলীর বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে দাঁড়ান। যেমন তিনি তালহা,যুবায়েরের বিপক্ষে জামাল যুদ্ধে এবং মু‘আবিয়ার বিপক্ষে সিফ্ফীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরিশেষে তিনি মু‘আবিয়ার সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হয় যে,‘আম্মার একদল বিদ্রোহী (আল-ফিআত আল-বাগিয়াহ) কর্তৃক নিহত হবে।’ চতুর্থ হাদীসসাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন আরও কয়েকটি হাদীসের ওপর আলোচনা করেন যা আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছে। যেমন :‘ইবনে উম্মে আবদ (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ) এর সিদ্ধান্তের ওপর কর্ম সম্পাদন কর।’ অথবা ‘ইবনে উম্মে আবদ এর অভিমতই তোমাদের জন্য আমার অভিমত।’এ দু’টি হাদীসই দুর্বল (যাইফ) এবং খবরে আহাদ,যেখানে হাদীসে সাকালাইন হলো মুতাওয়াতির। মুসলিম ও বুখারী উভয়েই যেহেতু এটি তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেননি,তাই বলা যায় তাঁরা এগুলোর সনদকে দুর্বল মনে করেছেন।উপরন্তু যদি এগুলো সত্য বলে ধরে নেয়া হয় তুবও সেগুলো হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ,এগুলো কেবল ইবনে মাসউদের প্রতিভাকে বর্ণনা করে,অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁদের নেতৃত্বের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।উপরন্তু শাহ আবদুল আযীযের ক্ষেত্রে এখানে দ্বিমুখিতা লক্ষ্যণীয় যে,তিনি এ হাদীসগুলোকে উপস্থাপন করেছেন,অথচ ইবনে মাসউদের কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে হযরত উমর তাঁকে ফতোয়া দিতে নিষেধ করেছিলেন,রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর মদীনা ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এ অবস্থা হযরত উমরের ইন্তেকাল পর্যন্ত বহাল ছিল। হযরত উসমান আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ইবনে মাসউদকে এতটা নির্দয়ভাবে প্রহার করেছিলেন যে,তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। পঞ্চম হাদীসশাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন :‘মু‘আয ইবনে জাবাল হারাম ও হালাল সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এটি কেবল সুন্নীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারী এ হাদীসকে পরিহার করেছেন। সুন্নী পণ্ডিতদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়াহ,ইবনে আবদুল হাদী,যাহাবী,মানাভী প্রমুখ এ হাদীসকে দুর্বল মনে করেছেন বা ভিত্তিহীন বলেছেন।এ হাদীসের রাবীদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহমান আল-বাইলামানী,তাঁর পিতা,যায়েদ আল-আম্মি,সালিম ইবনে সালিম হাদীস ও রিযালশাস্ত্রের আলেমগণ কর্তৃক অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছেন। যেমন : বুখারী,নাসাঈ,আল-মাকদিসী,দারে কুতনী,ইবনে হাজার,আল-যাহাবী,ইবনুল জাওযী এবং অন্যরা অবিশ্বস্ত বলেছেন।উপরন্তু তাবাকাতে ইবনে সা’দ (৩য় খণ্ড,পৃ. ৫৮৫) এবং ইবনে আবদুল বারের আল-ইস্তিআবে (৩য় খণ্ড,পৃ. ১৪০৪) এমন কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যাতে বোঝা যায় যে,উপরিউক্ত হাদীসে তাঁর জন্য যে যোগ্যতা দাবি করা হয় তিনি সে রকম যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন না। ষষ্ঠ হাদীসশাহ আবদুল আযীয রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস এনেছেন যেটার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকারের দাবি করেছেন যা তাওয়াতুরের কাছাকাছি :‘আমার পরে যারা আসবে তাদের অনুসরণ কর,আবু বকর ও উমর।’হামিদ হুসাইন বলেন,শুরার দাবি সমর্থনযোগ্য নয় এবং অনেক সুন্নী আলেম এ হাদীসের ত্রুটি পেয়েছেন এবং একে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। যেমন : আবু হাতিম আল-রাযী,আল-বাযযায এবং ইবনে হায্ম (ফাত্হ আল-কাদির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৫২);তিরমিযী,(সহীহ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৬৭২);উকাইলী,(আদ-দুআফা);নাক্কাস,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪২);দারে কুতনী,(লিসান আল মিযানে,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);ইবরী আল-ফারগানী,(শারহ আল মিনহাজ);যাহাবী,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১০৫);ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(লিসানুল মিযান,১ম খণ্ড,পৃ. ১৮৮ ও ২৭২,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);এবং শায়খুল ইসলাম আল-হারাভী,(আল-দুররুন নাদিদ,পৃ. ৯৭)ইবরাহীম ইবনে ইসমাঈল,ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া,ইয়াহইয়া ইবনে সালামাহ ইবনে কুহাইল এবং আবু আল-জারা-যাঁরা এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাঁদেরকে আবু যুরাহ,আবু হাতিম,ইবনে নুমাইর,দারে কুতনী,বুখারী,নাসাঈ,ইবনে মুঈন,ইবনে হিব্বান,তিরমিযী এবং অন্য অনেকেই অবিশ্বস্ত বলে গণ্য করেছেন।উপরিউক্ত হাদীসগুলো শাহ আবদুল আযীয উত্থাপন করেছেন এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে,যদি হাদীসে সাকালাইনকে আহলে বাইতের ইমামদের ইমামতের নির্দেশক হিসাবে গণ্য করা হয় তবে এসব হাদীসও হুমায়রা,আম্মার,ইবনে মাসউদ,মুয়াজ ইবনে জাবাল,হযরত আবু বকর এবং হযরত উমরের ইমামতের বিষয়টি নির্দেশ করছে। সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন উপসংহারে আমরা তখনই পৌঁছব যখন উপস্থাপিত হাদীসগুলো নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আবাকাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে,এ হাদীসগুলো দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য যেগুলো কোনভাবেই হাদীসে সাকালাইনের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে না-যা মুতাওয়াতির হাদীস এবং শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক রাবী ও পণ্ডিত কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সপ্তম হাদীসশাহ আবদুল আযীয তাঁর যুক্তির সপক্ষে মহানবী (সা.)-এর আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা ‘হাদীসে নুজুম’ নামে পরিচিত। হাদীসটি হলো :‘নিশ্চয়ই আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রতুল্য (নুজুম);তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে,তুমি সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আমার সাহাবীদের মধ্যে মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমত।’সুন্নী আলেমদের মধ্যে যাঁরা এ হাদীসকে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করেছেন তাঁরা হলেন :১.আহমাদ ইবনে হাম্বাল (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯):২.আল-মিযযী (আল-জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৮৯-৯০);৩. আল-বাযযায (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০);৪. ইবনে আল কাততান,(আল-কামিল);৫. দারে কুতনী (লিসান আল-মিযান,২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৭);৬. ইবনে হায্ম,(বাহার আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৮);৭. আল-বায়হাকী,আল-হাফিয আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);৮. ইবনে আবদুল বার (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০-৯১);৯. ইবনে আসাকির (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);১০. ইবনুল জাওযী,(আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়াহ ফি আল-আহাদীস আল-ওয়াহিয়াহ);১১. ইবনে দাহিয়াহ (তালিক তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);১২. আবু হাইয়ান আল-আন্দালুসী (আল-দুর আল-লাকিত মিন আল-বাহর আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৭-৫২৮);১৩. আল-যাহাবী (মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ৪১৩,২য় খণ্ড,পৃ. ১০২ ও ৬০৫);১৪. ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযীয়াহ (ইলাম আল-মুকিন,২য় খণ্ড,পৃ. ২২৩)১৫. যাইন আল-দীন আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);১৬. ইবনে হাজার আল-আসকালানী (তালখীস আল-খাবীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৯০-১৯১)১৭. ইবনে আল-হুমাম (আল-তাহরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);১৮. ইবনে আমীর আল-হাজ (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);১৯. আল-সাখাভী (আল-মাকাসিদ আল-হাসানাহ্,পৃ. ২৬-২৭);২০. ইবনে আবি শারীফ (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২১. আল-সুয়ূতী (ইতমাম আল-দিরায়াহ্ এবং আল-জামি আস-সাগীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২২. আল-মুত্তাকী আল-হিন্দী (কানজুল উম্মাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৩৩);২৩. আল-কারী (আল-মিরকাত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৩);২৪. আল-মানাভী (আল-তাইসির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৪৮ এবং ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২৫. আল-কাফাযী [নাসীম আর রিয়াদ (আশ শিফার ব্যাখ্যাগ্রন্থ),৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩২৩-৩২৪];২৬. আল-সিন্দী (দিরাসাত আল-লাবিব ফি আল-উসওয়াত আল-হাসানাহ্ আল-হাবীব,পৃ. ২৪০);২৭. আল-কাযী মুহিব্বুল্লাহ আল-বিহারী (মুসাল্লিম আল-সুবুত বি শারহ আবদুল আলী,২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০);২৮. নিযাম আল-দীন সাহালাভী [আল-সুবহ আল-সাদিক (মানার এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ)];২৯. আল-মাওলাভী আবদুল আলী [ফাওয়াতিহ আর-রাহমাত (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত),২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০];৩০. আল-শাওকানী (ইরশাদ আল-ফুহুল,পৃ. ৮৩);৩১. ওয়ালিউল্লাহ ইবনে হাবীবুল্লাহ্ আল-লাখনাভী (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত);৩২. সিদ্দীক হাসান খান আল-কনৌজী (হুসুল আল-মামুল,পৃ. ৫৬৮)।৩৩. নাসির উদ্দিন আলবানী (যঈফ ও মওযু হাদীস)নিম্নলিখিত কারণেও এ হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য :১. হাদীসটি কেবল এটিই ইঙ্গিত করে না যে,প্রত্যেক সাহাবীই ন্যায়নিষ্ঠ;বরং প্রত্যেকেই উম্মতের যোগ্য নেতা ও পথপ্রদর্শক। এটি সর্বসম্মতভাবে মিথ্যা। কারণ,তাঁরা নিজেরাই পথনির্দেশনার মুখাপেক্ষী ছিলেন।২. ইতিহাসের বর্ণনা মতে তাঁদের একটি দল বিভিন্ন গুরুতর পাপের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। যেমন হত্যাকাণ্ডএবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান ইত্যাদি। আর তাই এটি যুক্তিসংগত নয় যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মাহর পথনির্দেশক ও নেতা মনোনীত করবেন।৩. পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে,বিশেষ করে সূরা বাকারা,সূরা আহযাব,সূরা জুমুআহ এবং সূরা মুনাফিকুন,যেগুলো সাহাবীদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের মন্দ চরিত্রের ওপর আলোকপাত করেছে এবং এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মতের পথনির্দেশক ও নেতা বলে ঘোষণা করবেন।৪. মাযহাব নির্বিশেষে বিভিন্ন সূত্রে মহানবী (সা.)-এর অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যেগুলো সাহাবীদেরকে একটি দল হিসাবে গণ্য করেছে। উপরিউক্ত হাদীস সেসব নির্ভরযোগ্য হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।১৫. সুন্নী সূত্রে অনেক হাদীস রয়েছে যা উম্মাহকে সাহাবীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে। যাইন আল-ফাতা ফি তাফসীরে সূরা হাল আতা’য় আসিমী কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে যে,মহানবী (সা.) বলেছেন :‘আমার পরে আমার সাহাবীদের দ্বারা বেদআত তৈরি করা হবে (যেমন তাদের মধ্যে যে ফিতনা হবে)। আল্লাহ তাদের পূর্বেকার (উত্তম) আমলের কারণে তাদের ক্ষমা করে দেবেন,কিন্তু যদি লোকজন আমার পরে তাদের অনুসরণ করে,তবে আল্লাহ তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।’৬. মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ এমন সব কথা বলেছেন যাতে বোঝা যায় যে,উম্মতের নেতা ও পথপ্রদর্শক হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না। হযরত আবু বকর ও হযরত উমর তাঁদের নিজেদের সম্পর্কে এমন অনেক বিবৃতি দিয়েছেন যা প্রকাশ করে যে,পথপ্রদর্শক হিসাবে কুরআনের মতো নির্দ্বিধায় অনুসরণ করার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না।২হাদীসে নুজুম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকার ফলে শাহ আবদুল আযীয স্বীকার করেছেন যে,কিছু সংখ্যক সাহাবী ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। কারণ,তা কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশের (নাস) বিপরীত। তারপরও তিনি স্বীকার করেছেন যে,যেসব ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায় না সেসব ক্ষেত্রে সাহাবীদের ইজতিহাদের অনুসরণ করা যাবে।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এর জবাব দিয়েছেন এভাবে :প্রথমত যে ব্যক্তির ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল করার ব্যাপারটি নিশ্চিত সে আইনসঙ্গতভাবে পথপ্রদর্শক হতে পারে না।দ্বিতীয়ত যেখানে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সাহাবীদের ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে,তাহলে যেখানে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে ভুল করার সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি।তৃতীয়ত যেখানে সঠিক পথপ্রদর্শক রয়েছেন-যাঁর পথনির্দেশনা এবং যাঁর পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে,সেখানে যার ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে তার অনুসরণ করার কোন অনুমতি নেই। আয়াতে তাতহীর (সূরা আহযাব : ৩৩) এবং হাদীসে সাকালাইনসহ অনেক আয়াত ও হাদীস আহলে বাইতের ইমামদের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে।চতুর্থত সাহাবীরা শরীয়তের অনেক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করেছেন-যেগুলোর ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের সকলকে পথনির্দেশনার জন্য নক্ষত্রতুল্য বিবেচনা করা সম্পূর্ণরূপে ভুল।পঞ্চমত সাহাবীরা নিজেরাই একে অপরের ভুল ধরেছেন। কখনও কখনও পরিমিতিবোধ লুপ্ত হয়েছে;একে অপরকে মিথ্যাবাদী,অজ্ঞ,এমনকি কাফের পর্যন্ত বলেছেন-যেগুলো আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয়ই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি তাঁদের প্রত্যেককে মুসলিম উম্মাহর সঠিক পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করবে না।ষষ্ঠত সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁরা কিয়াসের অনুশীলন করতেন যে বিষয়ে উম্মতের বিপুল সংখ্যক আইনজ্ঞ দোষারোপ করেছেন।সপ্তমত তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন,এমনকি প্রথম তিন খলীফাও,যাঁরা শরীয়তের নানা বিধান জানার জন্য অন্যদের শরণাপন্ন হতেন। এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) মতবাদগত ও আইনগত বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তিদের উম্মতের কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করবেন। তাঁদের মধ্যে এমনও ছিলেন যাঁরা কুরআনের কিছু শব্দের অর্থও বুঝতেন না। যেমন হযরত উমর ‘কালালাহ’ শব্দের অর্থ বুঝতেন না যেটা তাবারী তাঁর তাফসীরে (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৮৩-২৮৪) উল্লেখ করেছেন। হযরত উমরের নিজের কথাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।অষ্টমত তাঁদের কেউ কেউ সুদের লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন৩,কেউ মদ বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন৪ অথবা জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফতোয়া দিতেন,এমনকি মহানবী (সা.)-এর স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে। কেউ কেউ মহানবী (সা.)-এর সুন্নাতের বিপরীতে বেদআত সৃষ্টির দোষে দুষ্ট। ‘কিতাবুল্লাহ ও আমার সুন্নাহ’ সংক্রান্ত হাদীসের ওপর আলোচনাপথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে সমাজে বহুল প্রচলিত যে হাদীস বিদ্যমান তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদীস :‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা যতক্ষণ তা ধরে থাকবে পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’‘মহান আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ আঁকড়ে ধর’-এ হাদীসটি অনির্ভরযোগ্য এবং এর কোন সহীহ সনদ নেই। কারণ,এ রেওয়ায়াতটি আহলে সুন্নাতের মাত্র আটজন আলেম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর সবকটির সনদ দুর্বল এবং ত্রুটিযুক্ত। নিচে এ হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করা হলো :১. মালেক ইবনে আনাস বলেছেন : আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে,দু’টি জিনিস আমি তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি যেগুলো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও গোমরাহ হবে না : মহান আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক,সুয়ূতীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৮;ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র.),২য়খণ্ড,তাকদীর অধ্যায়,রেওয়ায়াত ৩,পৃ. ৬১৭)তিনি এ হাদীসটি সনদ ছাড়াই মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন।২. ইবনে হিশাম এ রেওয়ায়াতটি মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনিও সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৬০৩)৩. হাকিম নিশাবুরী এ হাদীসটি দু’টি সনদসহ বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অপরটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (মুসতাদরাকে হাকিম,১ম খণ্ড,পৃ. ৯৩)হাকিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির প্রথম সনদে ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস বিদ্যমান যাঁকে এক বিরাট সংখ্যক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ (দুর্বল) বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি এবং তাঁর পিতা যাঈফ। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : তিনি তাঁর মামার কাছ থেকে বেশ কিছু গারীব (অদ্ভুত) হাদীস বর্ণনা করেছে যেগুলো কেউই গ্রহণ করেননি। ইবনে হায্ম তাঁর নিজের সনদ সহকারে সাইফ ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেছেন : ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস হাদীস জা’ল করতেন...। (তাহযীবুত তাহযীব,১ম খণ্ড,পৃ. ২৭১)আর দ্বিতীয় সনদে সালেহ ইবনে মূসা তালহী কুফী বিদ্যমান যাঁকে বহু সুন্নী রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি কিছুই নন (অর্থাৎ তাঁর কোন মূল্যই নেই)। বুখারী বলেছেন : তিনি হাদীস প্রত্যাখ্যানকারী। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : জুমহুর আলেমগণ তাঁকে গ্রহণ করেন না। আকীলী বলেছেন : তাঁর কোন হাদীসই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৫৪)৪. আবু বকর বাইহাকী এ হাদীসটি দু’টি সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অন্যটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (আস-সুনানুল কুবরা,১০ম খণ্ড,পৃ. ১১৪)। এ সনদটিও হাকিম নিশাবুরীর সনদসমূহের মতো প্রথম সনদে ইবনে আবি উওয়াইস এবং দ্বিতীয়টিতে সালেহ ইবনে মূসা আছে যাঁদের উভয়কেই যঈফ বলে গণ্য করা হয়েছে।৫. ইবনে আবদুল বার আল কুরতুবীও এ হাদীসটি দু’টি সূত্রে রেওয়ায়াত করেছেন। (ইবনে আবদুল বার প্রণীত আত তামহীদ)। এর প্রথম সনদ হচ্ছে ঐ সূত্র যা হাকিম আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন এবং এর মধ্যে সালেহ বিন মূসা বিদ্যমান যাঁকে অনেক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন।আর এর দ্বিতীয় সনদে কাসীর বিন আবদুল্লাহ বিদ্যমান যাঁকে একদল রিজালবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁকে হাদীস অমান্যকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী বলে বিবেচনা করতেন এবং তাঁর কোন মূল্যই দিতেন না। নাসাঈ তাঁকে সিকাহ (বিশ্বস্ত) বলে বিবেচনা করেননি। ইবনে আদী বলেছেন : তাঁর বর্ণনাকৃত রেওয়ায়াতসমূহ অনুসরণযোগ্য নয়। আলী ইবনে মাদানীও তাঁকে যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। ইবনে আবদুল বার বলেছেন : তাঁর যঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি তাঁর পিতা ও দাদা থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বান বলেছেন : তাঁর দাদার সূত্রে তাঁর পিতা থেকে যেসব রেওয়ায়াত তিনি বর্ণনা করেছেন সেগুলো আসলে একটি জাল পাণ্ডুলিপির সাথে জড়িত যা গ্রন্থ হিসাবে বর্ণনা করা সঠিক নয়। (আল-ইলমা ফী যাবতির রেওয়ায়াহ ওয়া তাকঈদিস সিমা’,পৃ. ৮-৯)৬. কাযী আইয়ায এ হাদীসটি নিজ সূত্রে আবু সাঈদ খুদরীর মাধ্যমে মহানবী (সা.)থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু (এ সনদের) এর বেশ কতিপয় রাবী যঈফ বলে গণ্য হয়েছে যে,তাঁদের মধ্যে শুআইব ইবনে ইবরাহীম ইবনে সাইফ ইবনে উমরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশেষ করে সাইফ ইবনে উমরের যাঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা রয়েছে। (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৫৯)৭. সুয়ূতীও উপরিউক্ত হাদীসটি হাকিম নিশাবুরীর ঐ একই সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যা ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। (মানাভী প্রণীত ফাইযুল কাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ২৪০)৮. মুত্তাকী হিন্দীও ‘কানযুল উম্মাল’ গ্রন্থে কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। একই শিরোনামের অধীনে হাকিম ও বাইহাকীর মতো অন্যান্য হাদীসবেত্তার রেওয়ায়াতসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং আল-ইবানাহ থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন : এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব।উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,এমন একটি হাদীসকে ‘হাদীসে সাকালাইন’ এর মতো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীসের বিপরীতে উপস্থাপনের কোন অবকাশই নেই। টীকা১. বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে (কিতাব আল-রুকুক) নিচের এই মুতাওয়াতির হাদীসটি হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন :বুখারী মুসলিম ইবনে ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেন,যিনি উহাইব থেকে,তিনি আবদুল আযীয থেকে,তিনি আনাস থেকে বর্ণনা করেন যে,মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমার কাছে হাউসের (হাউসে কাওসার) নিকট আমার সাহাবীদের একটি দলকে আনা হবে এবং আমি তাদের চিনতে পারব;তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব,(হে আল্লাহ! তারা কি) আমার সাহাবী (নয়)? (আল্লাহ) বলবেন,‘তুমি জান না,তোমার পরে তারা কী করেছিল!’অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে (১৪৪২ নং) মহানবী (সা.)-কে বলা হবে : ‘তোমার জানা নেই যে,তোমার পর তারা কী করেছিল! তারা পতনশীল আচরণে (শিরকের অবস্থায়) ফিরে গিয়েছিল।’বুখারী একই রকম হাদীস আর-রুকুক অধ্যায়ে হুযায়ফাহ (১৪৩৫ নং),আবদুল্লাহ (১৪৩৫ নং),সাহল ইবনে সা’দ (১৪৪২ নং),আবু সাইদ আল-খুদরী (১৪৪২ নং),ইবনে আব্বাস (১৪৪২ নং),আবু হুরায়রাহ (১৪৪৩ নং) এবং আসমা বিনতে আবি বকর (১৪৪৯ নং) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাফসীর ও বাদাউল খালক অধ্যায়েও বর্ণনা করেছেন। একই হাদীস কিছু শব্দগত পার্থক্যসহ মুসলিম,আবু দাউদ,তিরমিযী,নাসাঈ,ইবনে মাযাহ,ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় (কিতাব আল-তাহারাত অধ্যায়ে,হাদীস নং ২৮) কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন।ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় কিতাব আল জিহাদ এ ৩২ নং হাদীস হিসাবে নিম্নের হাদীসটি এনেছেন :মহানবী (সা.) ওহুদের শহীদদের উদ্দেশে বলেন : ‘আমি তাদের ব্যাপারে সাক্ষী।’ তখন আবু বকর বলেন : ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা কি তাদের ভাই নই? আমরা তাদের মতো ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তাদের মতো জিহাদ করেছি।’ মহানবী (সা.) জবাব দেন : ‘হ্যাঁ,কিন্তু আমি জানি না যে,আমার পরে তোমরা কী করবে...।’উদাহরণস্বরূপ দেখুন,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পণ্ডিত মাহমুদ আবু রিয়াহ প্রণীত আদওয়া আলাল সুন্নাত আল মুহাম্মাদীয়াহ,পৃ. ৩৩৯-৩৬৩,এবং আল্লামা হিল্লী কর্তৃক প্রণীত নাহজ আল হাক্ক ওয়া কাশফ আস সিদক,পৃ. ২৬২-৩৭৫;এ দু’টি গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনেক হাদীস আলোচনা করেছেন যেগুলো পথপ্রদর্শক হিসাবে রাসূলের প্রত্যেক সাহাবীর নক্ষত্রতুল্য হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে।২. ইবনে সা’দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে (লেইডেন,১৩২২) ২য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হযরত আবু বকরের একটি ভাষণ উল্লেখ করেছেন,যেখানে তিনি বলেছেন : ‘আমি একজন মানুষ মাত্র এবং আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। সুতরাং আমার আনুগত্য কর যখন আমি সোজা পথে চলি এবং আমাকে সংশোধন কর যখন আমাকে ভুল পথে দেখ। তোমাদের জানা উচিত যে,(কখনও) আমি শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হই। সুতরাং যখন তোমরা আমাকে ক্রোধান্বিত দেখ,তখন আমার থেকে দূরে থেক।’ একই রকম বক্তব্য তাঁর থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন :ক. তাবারী তাঁর তারিখে,(কায়রো,১৩৫৭),২য় খণ্ড,পৃ. ৪৪০;খ. ইবনে কুতায়বা তাঁর আল-ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ্ (মাকতাবাতুল ফুতুহ আল-আদাবিয়্যাহ,১৩১),পৃ. ৬;গ. আল হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ (১৩৫২),৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮৩;ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল (হায়দারাবাদ,১৩১২) ২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬ এবং অন্যরা।দ্বিতীয় খলীফা উমর প্রায়ই বলতেন,‘প্রত্যেকেরই (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি জ্ঞান রয়েছে (কুল্লু আহাদিন আ’লামু মিন উমার) এবং ‘সকল লোকের (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি বুঝ আছে’ (কুল্লু আহাদিন আফকাহু মিন উমার)। এর জন্য দেখুন :ক. আল-বায়হাকী,সুনান (হায়দারাবাদ,১৩৪৪),৭ম খণ্ড,পৃ. ২৩৩;খ. আল-সুয়ূতী,আল-দুররুল মানসূর (আল মাতবাআতুল মাইমানিয়্যাহ্,১৩১৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;গ. আল-জামাখশারী,আল-কাশশাফ (মিসর,১৩৫৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল,৮ম খণ্ড,পৃ. ২৯৮;ঙ. আল-হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৩।৩. হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে যায়েদ ইবনে আরকাম এবং একজন মহিলার লেনদেনের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে :ক. আবদুর রাযযাক,আল মুসান্নাফ;খ. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল,তাঁর মুসনাদে;গ. আল-জাসসাস,আহকামুল কুরআনে;ঘ. আল-সারাখশী,মাবসুত;ঙ. আল-দাবুসী,তাসীস আন-নাযার,এবং অনেক সুন্নী আইনজ্ঞ,হাদীসশাস্ত্রবিদ এবং তাফসীরকারই তাঁদের গ্রন্থাদিতে এটি উল্লেখ করেছেন।৪. বুখারী,মুসলিম,দারিমী,ইবনে আবি শায়বাহ,নাসাঈ,ইবনে আসির,গাযযালী,মুত্তাকী,ইবনে খালদূন এবং আবু হিলাল আল-আসকারী কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছেন যেখানে কতিপয় সাহাবী কর্তৃক মদ বিক্রির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। (প্রবন্ধটির প্রধান অংশ সংকলিত হয়েছে প্রখ্যাত ভারতীয় আলেম সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন লক্ষ্ণৌভী রচিত ‘আবাকাত আল আনওয়ার’ থেকে।)

হাদীসে সাকালাইন ও এর সাথে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হাদীসসমূহের পর্যালোচনা
হাদীসে সাকালাইনের অর্থ

অনেক হাদীস থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে,গাদীরে খুমে একটি ভাষণের মধ্যেই মহানবী (সা.) হাদীসে সাকালাইন ও হাদীসে গাদীরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব হাদীসের কয়েকটি মুত্তাকী আল-হিন্দী তাঁর ‘কানজুল উম্মাল’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ১৬৭),ইবনে কাসির তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে (৫ম খণ্ড,পৃ. ২০৯),আস সাখাভী তাঁর ‘আল-ইসতিজলাব’ গ্রন্থে,আল সামহুদী তাঁর ‘জাওয়াহির আল ইকদাইন’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তাঁর ‘সাওয়ায়েক’ গ্রন্থে তাবারানী ও অন্যদের থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন।

কতিপয় হাদীসে ‘খালিফাতাইন’ (উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি) শব্দটি সাকালাইন শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ করা হয়েছে,যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁর মুসনাদে (৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮১) উল্লেখ করেছেন। আবার তাবারানী,ইবনে আবি আসিম,আবু বকর ইবনে আবি শায়বাহ,আল-যারকানী এবং অন্যরাও উল্লেখ করেছেন। এই শব্দ ইমাম আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের নেতৃত্ব ও খেলাফতের বিষয়টিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ করে।

এ হাদীসের কতিপয় বর্ণনা,যেমন কুন্দুজী তাঁর ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহতে হাসান ইবনে আলী (আ.) থেকে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাতে নবী (সা.)-এর বাণী রয়েছে যা ইমামতের চিরস্থায়িত্বের বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে :

‘হে আল্লাহ! তুমি দুনিয়াকে সৃষ্টির ওপর তোমার হুজ্জাত থেকে খালি রেখ না যাতে তোমার হুজ্জাত বাতিল হয়ে যায় অথবা তুমি তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার পর তোমার বন্ধুরা বিপথে যেতে না পারে। তারা (আল্লাহর হুজ্জাত) সংখ্যায় অল্প,কিন্তু সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহর নৈকট্যশীল। নিশ্চয়ই আমি প্রশংসিত ও মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমার বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বংশধরদের বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বীজের মধ্যে এবং আমার বীজের বীজের মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দেওয়ার। আর আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে।’

এটি নাহজুল বালাগায় বর্ণিত (হিকাম : ১৪৭) আলী (আ.) কর্তৃক তাঁর শিষ্য কুমাইল ইবনে যিয়াদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ :

...হ্যাঁ,পৃথিবী কখনও এমন লোকশূন্য হয়ে যায় না যারা গোপনে বা প্রকাশ্যে আল্লাহর ওপর রক্ষা করে এবং তারা সব সময় শংকিত থাকে যে,আল্লাহর গুপ্ত ওজর ও প্রমাণ যেন অপ্রমাণিত না হয়। তাদের সংখ্যা কত,আর তারা কোথায়? আল্লাহর কসম,তাদের সংখ্যা কম,কিন্তু আল্লাহর নিকট তাদের সম্মান অনেক বেশি। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর ওজর ও প্রমাণ রক্ষা করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের মতো অপর কাউকে বিশ্বাস না করে এবং তাদের মতো অন্য কারও হৃদয়ে আস্থার বীজ বপন না করে।

জ্ঞান তাদেরকে সত্যিকার বোধগম্যতার দিকে চালিত করে এবং এ কারণে তারা দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন আত্মার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। অন্যেরা যেটাকে কঠিন বলে মনে করে তা তারা সহজ বলে মনে করে। অজ্ঞরা যা বিস্ময়কর মনে করে,তারা তা সাদরে গ্রহণ করে। তারা এ পৃথিবীতে দেহ নিয়ে বসবাস করে,কিন্তু তাদের আত্মা অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। আল্লাহর জমিনে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তাঁর দীনের প্রতি আহ্বানকারী। আহা! তাদেরকে দেখার জন্য আমার আকুল আগ্রহ!

হযরত আলীর এ বক্তব্য অনেক হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিক তাঁদের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইবনে আব্দ রাব্বিহ তাঁর ‘আল ইকদুল ফারীদ’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ২৬৫,২৯৩);ইয়াকুবী তাঁর ‘তারিখ’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ৪০০);আল হাররানী তাঁর ‘তুহাফুল উকূল’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬৯);আল খাতীব আল বাগদাদী তাঁর ‘তারীখে বাগদাদ’ গ্রন্থে (৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ৩৮৯);আল রাযী তাঁর ‘তাফসীরে কাবীর’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২);ইবনে আবদুল বার তাঁর ‘আল মুখতাসার’ গ্রন্থে (পৃ. ২৯) এ রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করেছেন।

 

হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হওয়া কতিপয় হাদীস

 

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী একটি গ্রন্থে (তোহফায়ে ইসনা আশারা) হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করে হাদীসে সাকালাইনের ঘোষিত আহলে বাইতের নেতৃত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। আমরা এখানে সেই হাদীসগুলো উল্লেখ করে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করব।

প্রথম হাদীস

শাহ আবদুল আযীয তাঁর তুহ্ফা গ্রন্থে বলেন,যদি হাদীসে সাকালাইন গ্রহণ করা হয়েও থাকে,তবু তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অপর কয়েকটি হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব হাদীসের মধ্য থেকে তিনি নিম্নোল্লিখিত হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেন :

‘আমার সুন্নাহ অনুসরণ কর এবং আমার পর সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারীদের (খোলাফায়ে রাশেদীনের) অনুসরণ কর,তা আঁকড়ে ধর এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক।’

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন (আবাকাত আল আনওয়ার গ্রন্থের প্রণেতা) বলেন যে,এমন হাদীস সহীহ নয়।

প্রথমত,তিনি বলেন,এ হাদীসটি কেবল সুন্নীদের দ্বারা বর্ণনাকৃত। অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন সুন্নীদের পাশাপাশি আহলে বাইতের মাযহাবের আলেমগণও বর্ণনা করেছেন।

দ্বিতীয়ত শাহ আবদুল আযীয এখানে তাঁর স্বঘোষিত নীতি ওপর বহাল থাকেননি যে,আহলে বাইতের মতবাদের বিপক্ষে তাঁর যুক্তি তাদের দ্বারা গ্রহণীয় লেখনীর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হবে।

তৃতীয়ত হাদীসটি মুসলিম ও বুখারী লিপিবদ্ধ করেননি-হাদীসের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত যাঁদেরকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করে থাকে।

চতুর্থত,উপরিউক্ত হাদীসের সহীহ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। কারণ,সুন্নী আলেমগণের দ্বারাই এ হাদীসের সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।

এ হাদীসের ওপর পর্যালোচনা

এ হাদীসটি আবু দাউদ,তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে। আবু দাউদের রাবীদের সম্পর্কিত আলোচনা :

আল-আরবাদ ইবনে সারিআহ-তিনি এ হাদীসের অন্যতম রাবী (বর্ণনাকারী)। তিনি নির্ভরযোগ্য নন। কারণ,তিনি নিজের সম্বন্ধেই এমন উক্তি করেছেন যে,‘আমি ইসলামের এক-চতুর্থাংশ।’

হাজার ইবনে হাজার আল কিলাই-সিরিয়ার একটি শহরে বসবাস করত যে শহরের অধিবাসীরা আলী (আ.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। ইবনে হাজার তাঁর তাহযীব আত তাহযীবে তাঁর অবস্থা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। (৩য় খণ্ড,পৃ. ১১৮)

খালিদ ইবনে মাদান ইবনে আবি কারিব আল কিতাবী-সে ছিল ইসলামের ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়ার পুলিশ বাহিনীর প্রধান।

সাওর ইবনে ইয়াযীদ-ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে,সে আলী (আ.)-কে ঘৃণা করত। কারণ,তিনি এক যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন এবং তাঁকে একজন গোঁড়া মনে করতেন।

পরবর্তী রাবী হলো আল ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম। আবু মুসহার কর্তৃক জালকরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে,যা মিযানুল ইতিদালে যাহাবী উল্লেখ করেছেন (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৪৭) ।

অন্যদিকে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ যেসব রাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন,যেমন আবু আসিম,হাসান ইবনে আলী আল-খাল্লাল,বুহাইর ইবনে সা’দ,বাকীয়াহ ইবনে আল-ওয়ালীদ,ইয়াহইয়া ইবনে আবি আল-মুতী,আবদুল্লাহ ইবনে আলা’,মু‘আবিয়া ইবনে সালিহ,ইসমাঈল ইবনে বিশর ইবনে মানসূর এবং আবুল মালিক ইবনে আল-সাব্বাহ-তাঁরা সকলেই দুর্বল রাবী। আহলে সুন্নাতের রেজালশাস্ত্রবিদগণ তাঁদের সকলকেই দুর্বল রাবী হিসাবে অভিহিত করেছেন।

উপরন্তু যদি এ হাদীসটি সহীহ বলে ধরেও নিই,তবু তা হাদীসে সাকালাইনের বিপক্ষে কোন গুরুত্ব রাখে না। কারণ,হাদীসে সাকালাইন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিপুল সংখ্যক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে,অন্যদিকে সুন্নী পণ্ডিতদের বিপুল সংখ্যক তাঁদের হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করেননি। যদি এ হাদীসটি সত্যিই নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে,তবে ‘সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারী’ শব্দগুলো আহলে বাইতের বারো ইমামের ওপর আরোপ করা যায়-যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সমর্থিত হতে পারে। আর সেই হাদীসটি হল ‘আমার পরে বারো জন খলীফা বা ইমাম আসবে।’

শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত আরেকটি প্রশ্নের জবাব দান

আবদুল আযীয বলেছেন,যদি হাদীসে সাকালাইন পূর্বোক্ত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নাও হয়,তবুও ‘ইতরাত’ শব্দ সাধারণভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গোত্র বনি হাশিমের সকল আত্মীয় অথবা হযরত ফাতিমার সকল বংশধরের ওপর আরোপ করা যায়। তাহলে এটি বলা অবান্তর যে,তাঁদের সকলেই হলেন ইমাম।

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এ সন্দেহ সম্পর্কে নানা অভিধান রচয়িতার অর্থ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন,যেমন জাওহারী,ইবনে আসির,ইবনে মানযুর,আল ফিরূযাবাদী এবং অন্যরা। তাঁদের মতে ‘ইতরাত’ বলতে বুঝায় কারও নিকটতম আত্মীয় (আখাস আকরাবীন),সন্তানাদি (ওয়ালাদ) এবং বংশধর (যুররিয়াহ)।

উপরন্তু তিনি উল্লেখ করেন,হাদীসে সাকালাইন তাঁদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাধান্যের পাশাপাশি তাঁদের পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিও নির্দেশ করে। এমন বর্ণনা নিঃসন্দেহে কেবল বারো ইমামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,আলী (আ.) যাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ‘ইতরাত’ বলে পরিচিত করিয়েছেন এবং কুরআনের ব্যাপারে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন।

দ্বিতীয় হাদীস

শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত দ্বিতীয় হাদীসটি হলো :

‘ধর্মের বিষয়াদি তোমরা এই হুমায়রার (আয়েশা) নিকট থেকে গ্রহণ কর।’

তিনি এ হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেছেন।

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,সুন্নী পণ্ডিতগণই এ হাদীসকে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন :

১. আল-মিযযী এবং যাহাবী (আল-তাকরীর ওয়াল তাহবীর ফি শাহর আল-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।

২. ইবনুল কাইয়্যেম জাওযীয়াহ,যেসব হাদীস ‘হে হুমায়রা’ এবং ‘আল-হুমায়রা’ শব্দযোগে এসেছে সেসব হাদীসকে তিনি জাল বলে গণ্য করেছেন।

৩. ইবনে কাসির,(আল-দুরুর আল-মুনতাশিরাহ ফি আল-আহাদীস আল-মুশতাহিরাহ,পৃ. ৭৯)।

৪. ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(আল-তাকরীর ওয়া আল-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।

৫. তাঁদের পাশাপাশি ইবনুল মুলাক্কিন,আস সুবকি,ইবনে আমির আল-হাজ,আল-সাখাভী,আল-সুয়ূতী,আল-শায়বানী,আল-শেখ আলী আল-কারী,আল-যারকানী,আবদুল আলী আল-শাওকানী এবং অন্যরাও এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

 

তৃতীয় হাদীস

শাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে এনেছেন। আর তা হলো :

‘আম্মারের নিকট থেকে পথনির্দেশনা চাও।’

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন হাদীস কখনই হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উত্থাপন করা যায় না। কারণ,হযরত আম্মার নিজেই হযরত আলী (আ.)-এর একনিষ্ঠ শিয়া (অনুসারী) ছিলেন এবং মহানবী (সা.) তাঁকে হযরত আলীকে মেনে চলা ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে :

‘হে আম্মার! আলী তোমাকে সত্যপথ হতে বিচ্যুত করবে না। হে আম্মার! আলীর আনুগত্য আমার আনুগত্য,আর আমার আনুগত্যই হল সর্বশক্তিমান ও প্রশংসিত আল্লাহর আনুগত্য।’

এ হাদীসটি বেশ কয়েকটি সুন্নী হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ফারায়েদুস সিমতাইন,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭৮;আল মাওয়াদ্দাহ ফিল কুরবা;আল খারাযমীর মানাকিব,পৃ. ৫৭ ও ১২৪;ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ১২৮ ও ২৫০;মিফতাহ আন-নাযা এবং কানজুল উম্মাল,১২তম খণ্ড,পৃ. ২১২।

উপরন্তু এ বিষয়টি অদ্ভুত যে,শাহ আবদুল আযীয এ হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উপস্থাপন করেছেন,যেখানে ঐতিহাসিক ইয়াকুবী তাঁর তারিখে (২য় খণ্ড,পৃ. ১১৪) এবং মাসউদী তাঁর মুরুযুয যাহাব (২য় খণ্ড,পৃ. ৩৪২) গ্রন্থে আম্মারকে তাঁদের মধ্যে গণ্য করেছেন যাঁরা প্রথম খলীফার আনুগত্য করা থেকে দূরে ছিলেন। হযরত উমর তাঁর খেলাফতকালে আম্মারের দিকনির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং কর্কশ কণ্ঠে তাঁর সাথে কথা বলেছিলেন যখন তিনি ওযূর জন্য পানি না পেলে নামায ছেড়ে না দিয়ে তায়াম্মুম করার মাধ্যমে পবিত্র হবার বিষয়টি তাঁর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। এ ঘটনাটি নিম্নের হাদীস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : মুসনাদে আহমাদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৫;সহীহ মুসলিম,১ম খণ্ড,পৃ. ১১০;আবু দাউদ,নাসাঈ,তাবারী,আল-আঈনী,ইবনে আসির এবং আল-শায়বানীও এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন।

হযরত উসমান তাঁর খেলাফতকালে আম্মারকে ততক্ষণ প্রহার করেন যতক্ষণ না আম্মার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ঘটনাটি তখন ঘটে যখন তিনি হযরত উসমানের শাসনামলের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে মুসলমানদের প্রতিবাদলিপি তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। এ ঘটনাটি নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : ইবনে কুতাইবার আল-ইমামাহ্ ওয়াল সিয়াসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ৩২;ইবনে আবদ রাব্বিহের আল-ইকদুল ফারীদ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২;মাসউদীর মুরুযুয যাহাব,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৩৮;ইবনে আবদুল বারের আল-ইসতিয়াব,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬;ইয়াকুবীর তারিখ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৬০।

যদিও রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আম্মার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছিলেন,যেমন ‘আম্মারের শত্রু আল্লাহর শত্রু’,তারপরও রাসূলের কতিপয় সাহাবী কর্তৃক তিনি প্রতিরোধের মুখে পড়েন,তাঁরা তাঁকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করতেন,যেমন আবদুর রহমান ইবনে আওফ,সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,মুগীরাহ ইবনে শোবা,আবু মূসা আশআরী,আবু মাসউদ আল-আনসারী এবং অন্যরা। আম্মার দৃঢ়ভাবে আলীর পক্ষে এবং আলীর বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে দাঁড়ান। যেমন তিনি তালহা,যুবায়েরের বিপক্ষে জামাল যুদ্ধে এবং মু‘আবিয়ার বিপক্ষে সিফ্ফীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরিশেষে তিনি মু‘আবিয়ার সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হয় যে,‘আম্মার একদল বিদ্রোহী (আল-ফিআত আল-বাগিয়াহ) কর্তৃক নিহত হবে।’

 

চতুর্থ হাদীস

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন আরও কয়েকটি হাদীসের ওপর আলোচনা করেন যা আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছে। যেমন :

‘ইবনে উম্মে আবদ (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ) এর সিদ্ধান্তের ওপর কর্ম সম্পাদন কর।’ অথবা ‘ইবনে উম্মে আবদ এর অভিমতই তোমাদের জন্য আমার অভিমত।’

এ দু’টি হাদীসই দুর্বল (যাইফ) এবং খবরে আহাদ,যেখানে হাদীসে সাকালাইন হলো মুতাওয়াতির। মুসলিম ও বুখারী উভয়েই যেহেতু এটি তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেননি,তাই বলা যায় তাঁরা এগুলোর সনদকে দুর্বল মনে করেছেন।

উপরন্তু যদি এগুলো সত্য বলে ধরে নেয়া হয় তুবও সেগুলো হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ,এগুলো কেবল ইবনে মাসউদের প্রতিভাকে বর্ণনা করে,অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁদের নেতৃত্বের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।

উপরন্তু শাহ আবদুল আযীযের ক্ষেত্রে এখানে দ্বিমুখিতা লক্ষ্যণীয় যে,তিনি এ হাদীসগুলোকে উপস্থাপন করেছেন,অথচ ইবনে মাসউদের কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে হযরত উমর তাঁকে ফতোয়া দিতে নিষেধ করেছিলেন,রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর মদীনা ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এ অবস্থা হযরত উমরের ইন্তেকাল পর্যন্ত বহাল ছিল। হযরত উসমান আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ইবনে মাসউদকে এতটা নির্দয়ভাবে প্রহার করেছিলেন যে,তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল।

 

পঞ্চম হাদীস

শাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন :

‘মু‘আয ইবনে জাবাল হারাম ও হালাল সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।’

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এটি কেবল সুন্নীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারী এ হাদীসকে পরিহার করেছেন। সুন্নী পণ্ডিতদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়াহ,ইবনে আবদুল হাদী,যাহাবী,মানাভী প্রমুখ এ হাদীসকে দুর্বল মনে করেছেন বা ভিত্তিহীন বলেছেন।

এ হাদীসের রাবীদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহমান আল-বাইলামানী,তাঁর পিতা,যায়েদ আল-আম্মি,সালিম ইবনে সালিম হাদীস ও রিযালশাস্ত্রের আলেমগণ কর্তৃক অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছেন। যেমন : বুখারী,নাসাঈ,আল-মাকদিসী,দারে কুতনী,ইবনে হাজার,আল-যাহাবী,ইবনুল জাওযী এবং অন্যরা অবিশ্বস্ত বলেছেন।

উপরন্তু তাবাকাতে ইবনে সা’দ (৩য় খণ্ড,পৃ. ৫৮৫) এবং ইবনে আবদুল বারের আল-ইস্তিআবে (৩য় খণ্ড,পৃ. ১৪০৪) এমন কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যাতে বোঝা যায় যে,উপরিউক্ত হাদীসে তাঁর জন্য যে যোগ্যতা দাবি করা হয় তিনি সে রকম যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন না।

 

ষষ্ঠ হাদীস

শাহ আবদুল আযীয রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস এনেছেন যেটার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকারের দাবি করেছেন যা তাওয়াতুরের কাছাকাছি :

‘আমার পরে যারা আসবে তাদের অনুসরণ কর,আবু বকর ও উমর।’

হামিদ হুসাইন বলেন,শুরার দাবি সমর্থনযোগ্য নয় এবং অনেক সুন্নী আলেম এ হাদীসের ত্রুটি পেয়েছেন এবং একে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। যেমন : আবু হাতিম আল-রাযী,আল-বাযযায এবং ইবনে হায্ম (ফাত্হ আল-কাদির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৫২);তিরমিযী,(সহীহ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৬৭২);উকাইলী,(আদ-দুআফা);নাক্কাস,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪২);দারে কুতনী,(লিসান আল মিযানে,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);ইবরী আল-ফারগানী,(শারহ আল মিনহাজ);যাহাবী,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১০৫);ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(লিসানুল মিযান,১ম খণ্ড,পৃ. ১৮৮ ও ২৭২,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);এবং শায়খুল ইসলাম আল-হারাভী,(আল-দুররুন নাদিদ,পৃ. ৯৭)

ইবরাহীম ইবনে ইসমাঈল,ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া,ইয়াহইয়া ইবনে সালামাহ ইবনে কুহাইল এবং আবু আল-জারা-যাঁরা এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাঁদেরকে আবু যুরাহ,আবু হাতিম,ইবনে নুমাইর,দারে কুতনী,বুখারী,নাসাঈ,ইবনে মুঈন,ইবনে হিব্বান,তিরমিযী এবং অন্য অনেকেই অবিশ্বস্ত বলে গণ্য করেছেন।

উপরিউক্ত হাদীসগুলো শাহ আবদুল আযীয উত্থাপন করেছেন এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে,যদি হাদীসে সাকালাইনকে আহলে বাইতের ইমামদের ইমামতের নির্দেশক হিসাবে গণ্য করা হয় তবে এসব হাদীসও হুমায়রা,আম্মার,ইবনে মাসউদ,মুয়াজ ইবনে জাবাল,হযরত আবু বকর এবং হযরত উমরের ইমামতের বিষয়টি নির্দেশ করছে। সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন উপসংহারে আমরা তখনই পৌঁছব যখন উপস্থাপিত হাদীসগুলো নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আবাকাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে,এ হাদীসগুলো দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য যেগুলো কোনভাবেই হাদীসে সাকালাইনের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে না-যা মুতাওয়াতির হাদীস এবং শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক রাবী ও পণ্ডিত কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে।

 

সপ্তম হাদীস

শাহ আবদুল আযীয তাঁর যুক্তির সপক্ষে মহানবী (সা.)-এর আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা ‘হাদীসে নুজুম’ নামে পরিচিত। হাদীসটি হলো :

‘নিশ্চয়ই আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রতুল্য (নুজুম);তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে,তুমি সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আমার সাহাবীদের মধ্যে মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমত।’

সুন্নী আলেমদের মধ্যে যাঁরা এ হাদীসকে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করেছেন তাঁরা হলেন :

১.আহমাদ ইবনে হাম্বাল (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯):

২.আল-মিযযী (আল-জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৮৯-৯০);

৩. আল-বাযযায (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০);

৪. ইবনে আল কাততান,(আল-কামিল);

৫. দারে কুতনী (লিসান আল-মিযান,২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৭);

৬. ইবনে হায্ম,(বাহার আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৮);

৭. আল-বায়হাকী,আল-হাফিয আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);

৮. ইবনে আবদুল বার (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০-৯১);

৯. ইবনে আসাকির (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);

১০. ইবনুল জাওযী,(আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়াহ ফি আল-আহাদীস আল-ওয়াহিয়াহ);

১১. ইবনে দাহিয়াহ (তালিক তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);

১২. আবু হাইয়ান আল-আন্দালুসী (আল-দুর আল-লাকিত মিন আল-বাহর আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৭-৫২৮);

১৩. আল-যাহাবী (মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ৪১৩,২য় খণ্ড,পৃ. ১০২ ও ৬০৫);

১৪. ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযীয়াহ (ইলাম আল-মুকিন,২য় খণ্ড,পৃ. ২২৩)

১৫. যাইন আল-দীন আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);

১৬. ইবনে হাজার আল-আসকালানী (তালখীস আল-খাবীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৯০-১৯১)

১৭. ইবনে আল-হুমাম (আল-তাহরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);

১৮. ইবনে আমীর আল-হাজ (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);

১৯. আল-সাখাভী (আল-মাকাসিদ আল-হাসানাহ্,পৃ. ২৬-২৭);

২০. ইবনে আবি শারীফ (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);

২১. আল-সুয়ূতী (ইতমাম আল-দিরায়াহ্ এবং আল-জামি আস-সাগীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);

২২. আল-মুত্তাকী আল-হিন্দী (কানজুল উম্মাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৩৩);

২৩. আল-কারী (আল-মিরকাত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৩);

২৪. আল-মানাভী (আল-তাইসির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৪৮ এবং ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);

২৫. আল-কাফাযী [নাসীম আর রিয়াদ (আশ শিফার ব্যাখ্যাগ্রন্থ),৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩২৩-৩২৪];

২৬. আল-সিন্দী (দিরাসাত আল-লাবিব ফি আল-উসওয়াত আল-হাসানাহ্ আল-হাবীব,পৃ. ২৪০);

২৭. আল-কাযী মুহিব্বুল্লাহ আল-বিহারী (মুসাল্লিম আল-সুবুত বি শারহ আবদুল আলী,২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০);

২৮. নিযাম আল-দীন সাহালাভী [আল-সুবহ আল-সাদিক (মানার এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ)];

২৯. আল-মাওলাভী আবদুল আলী [ফাওয়াতিহ আর-রাহমাত (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত),২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০];

৩০. আল-শাওকানী (ইরশাদ আল-ফুহুল,পৃ. ৮৩);

৩১. ওয়ালিউল্লাহ ইবনে হাবীবুল্লাহ্ আল-লাখনাভী (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত);

৩২. সিদ্দীক হাসান খান আল-কনৌজী (হুসুল আল-মামুল,পৃ. ৫৬৮)।

৩৩. নাসির উদ্দিন আলবানী (যঈফ ও মওযু হাদীস)

নিম্নলিখিত কারণেও এ হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য :

১. হাদীসটি কেবল এটিই ইঙ্গিত করে না যে,প্রত্যেক সাহাবীই ন্যায়নিষ্ঠ;বরং প্রত্যেকেই উম্মতের যোগ্য নেতা ও পথপ্রদর্শক। এটি সর্বসম্মতভাবে মিথ্যা। কারণ,তাঁরা নিজেরাই পথনির্দেশনার মুখাপেক্ষী ছিলেন।

২. ইতিহাসের বর্ণনা মতে তাঁদের একটি দল বিভিন্ন গুরুতর পাপের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। যেমন হত্যাকাণ্ডএবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান ইত্যাদি। আর তাই এটি যুক্তিসংগত নয় যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মাহর পথনির্দেশক ও নেতা মনোনীত করবেন।

৩. পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে,বিশেষ করে সূরা বাকারা,সূরা আহযাব,সূরা জুমুআহ এবং সূরা মুনাফিকুন,যেগুলো সাহাবীদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের মন্দ চরিত্রের ওপর আলোকপাত করেছে এবং এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মতের পথনির্দেশক ও নেতা বলে ঘোষণা করবেন।

৪. মাযহাব নির্বিশেষে বিভিন্ন সূত্রে মহানবী (সা.)-এর অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যেগুলো সাহাবীদেরকে একটি দল হিসাবে গণ্য করেছে। উপরিউক্ত হাদীস সেসব নির্ভরযোগ্য হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।১

৫. সুন্নী সূত্রে অনেক হাদীস রয়েছে যা উম্মাহকে সাহাবীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে। যাইন আল-ফাতা ফি তাফসীরে সূরা হাল আতা’য় আসিমী কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে যে,মহানবী (সা.) বলেছেন :

‘আমার পরে আমার সাহাবীদের দ্বারা বেদআত তৈরি করা হবে (যেমন তাদের মধ্যে যে ফিতনা হবে)। আল্লাহ তাদের পূর্বেকার (উত্তম) আমলের কারণে তাদের ক্ষমা করে দেবেন,কিন্তু যদি লোকজন আমার পরে তাদের অনুসরণ করে,তবে আল্লাহ তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।’

৬. মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ এমন সব কথা বলেছেন যাতে বোঝা যায় যে,উম্মতের নেতা ও পথপ্রদর্শক হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না। হযরত আবু বকর ও হযরত উমর তাঁদের নিজেদের সম্পর্কে এমন অনেক বিবৃতি দিয়েছেন যা প্রকাশ করে যে,পথপ্রদর্শক হিসাবে কুরআনের মতো নির্দ্বিধায় অনুসরণ করার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না।২

হাদীসে নুজুম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকার ফলে শাহ আবদুল আযীয স্বীকার করেছেন যে,কিছু সংখ্যক সাহাবী ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। কারণ,তা কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশের (নাস) বিপরীত। তারপরও তিনি স্বীকার করেছেন যে,যেসব ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায় না সেসব ক্ষেত্রে সাহাবীদের ইজতিহাদের অনুসরণ করা যাবে।

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এর জবাব দিয়েছেন এভাবে :

প্রথমত যে ব্যক্তির ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল করার ব্যাপারটি নিশ্চিত সে আইনসঙ্গতভাবে পথপ্রদর্শক হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত যেখানে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সাহাবীদের ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে,তাহলে যেখানে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে ভুল করার সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি।

তৃতীয়ত যেখানে সঠিক পথপ্রদর্শক রয়েছেন-যাঁর পথনির্দেশনা এবং যাঁর পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে,সেখানে যার ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে তার অনুসরণ করার কোন অনুমতি নেই। আয়াতে তাতহীর (সূরা আহযাব : ৩৩) এবং হাদীসে সাকালাইনসহ অনেক আয়াত ও হাদীস আহলে বাইতের ইমামদের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে।

চতুর্থত সাহাবীরা শরীয়তের অনেক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করেছেন-যেগুলোর ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের সকলকে পথনির্দেশনার জন্য নক্ষত্রতুল্য বিবেচনা করা সম্পূর্ণরূপে ভুল।

পঞ্চমত সাহাবীরা নিজেরাই একে অপরের ভুল ধরেছেন। কখনও কখনও পরিমিতিবোধ লুপ্ত হয়েছে;একে অপরকে মিথ্যাবাদী,অজ্ঞ,এমনকি কাফের পর্যন্ত বলেছেন-যেগুলো আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয়ই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি তাঁদের প্রত্যেককে মুসলিম উম্মাহর সঠিক পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করবে না।

ষষ্ঠত সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁরা কিয়াসের অনুশীলন করতেন যে বিষয়ে উম্মতের বিপুল সংখ্যক আইনজ্ঞ দোষারোপ করেছেন।

সপ্তমত তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন,এমনকি প্রথম তিন খলীফাও,যাঁরা শরীয়তের নানা বিধান জানার জন্য অন্যদের শরণাপন্ন হতেন। এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) মতবাদগত ও আইনগত বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তিদের উম্মতের কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করবেন। তাঁদের মধ্যে এমনও ছিলেন যাঁরা কুরআনের কিছু শব্দের অর্থও বুঝতেন না। যেমন হযরত উমর ‘কালালাহ’ শব্দের অর্থ বুঝতেন না যেটা তাবারী তাঁর তাফসীরে (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৮৩-২৮৪) উল্লেখ করেছেন। হযরত উমরের নিজের কথাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

অষ্টমত তাঁদের কেউ কেউ সুদের লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন৩,কেউ মদ বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন৪ অথবা জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফতোয়া দিতেন,এমনকি মহানবী (সা.)-এর স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে। কেউ কেউ মহানবী (সা.)-এর সুন্নাতের বিপরীতে বেদআত সৃষ্টির দোষে দুষ্ট।

 

‘কিতাবুল্লাহ ও আমার সুন্নাহ’ সংক্রান্ত হাদীসের ওপর আলোচনা

পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে সমাজে বহুল প্রচলিত যে হাদীস বিদ্যমান তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদীস :

‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা যতক্ষণ তা ধরে থাকবে পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’

‘মহান আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ আঁকড়ে ধর’-এ হাদীসটি অনির্ভরযোগ্য এবং এর কোন সহীহ সনদ নেই। কারণ,এ রেওয়ায়াতটি আহলে সুন্নাতের মাত্র আটজন আলেম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর সবকটির সনদ দুর্বল এবং ত্রুটিযুক্ত। নিচে এ হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করা হলো :

১. মালেক ইবনে আনাস বলেছেন : আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে,দু’টি জিনিস আমি তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি যেগুলো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও গোমরাহ হবে না : মহান আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক,সুয়ূতীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৮;ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র.),২য়খণ্ড,তাকদীর অধ্যায়,রেওয়ায়াত ৩,পৃ. ৬১৭)

তিনি এ হাদীসটি সনদ ছাড়াই মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন।

২. ইবনে হিশাম এ রেওয়ায়াতটি মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনিও সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৬০৩)

৩. হাকিম নিশাবুরী এ হাদীসটি দু’টি সনদসহ বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অপরটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (মুসতাদরাকে হাকিম,১ম খণ্ড,পৃ. ৯৩)

হাকিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির প্রথম সনদে ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস বিদ্যমান যাঁকে এক বিরাট সংখ্যক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ (দুর্বল) বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি এবং তাঁর পিতা যাঈফ। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : তিনি তাঁর মামার কাছ থেকে বেশ কিছু গারীব (অদ্ভুত) হাদীস বর্ণনা করেছে যেগুলো কেউই গ্রহণ করেননি। ইবনে হায্ম তাঁর নিজের সনদ সহকারে সাইফ ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেছেন : ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস হাদীস জা’ল করতেন...। (তাহযীবুত তাহযীব,১ম খণ্ড,পৃ. ২৭১)

আর দ্বিতীয় সনদে সালেহ ইবনে মূসা তালহী কুফী বিদ্যমান যাঁকে বহু সুন্নী রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি কিছুই নন (অর্থাৎ তাঁর কোন মূল্যই নেই)। বুখারী বলেছেন : তিনি হাদীস প্রত্যাখ্যানকারী। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : জুমহুর আলেমগণ তাঁকে গ্রহণ করেন না। আকীলী বলেছেন : তাঁর কোন হাদীসই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৫৪)

৪. আবু বকর বাইহাকী এ হাদীসটি দু’টি সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অন্যটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (আস-সুনানুল কুবরা,১০ম খণ্ড,পৃ. ১১৪)। এ সনদটিও হাকিম নিশাবুরীর সনদসমূহের মতো প্রথম সনদে ইবনে আবি উওয়াইস এবং দ্বিতীয়টিতে সালেহ ইবনে মূসা আছে যাঁদের উভয়কেই যঈফ বলে গণ্য করা হয়েছে।

৫. ইবনে আবদুল বার আল কুরতুবীও এ হাদীসটি দু’টি সূত্রে রেওয়ায়াত করেছেন। (ইবনে আবদুল বার প্রণীত আত তামহীদ)। এর প্রথম সনদ হচ্ছে ঐ সূত্র যা হাকিম আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন এবং এর মধ্যে সালেহ বিন মূসা বিদ্যমান যাঁকে অনেক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন।

আর এর দ্বিতীয় সনদে কাসীর বিন আবদুল্লাহ বিদ্যমান যাঁকে একদল রিজালবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁকে হাদীস অমান্যকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী বলে বিবেচনা করতেন এবং তাঁর কোন মূল্যই দিতেন না। নাসাঈ তাঁকে সিকাহ (বিশ্বস্ত) বলে বিবেচনা করেননি। ইবনে আদী বলেছেন : তাঁর বর্ণনাকৃত রেওয়ায়াতসমূহ অনুসরণযোগ্য নয়। আলী ইবনে মাদানীও তাঁকে যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। ইবনে আবদুল বার বলেছেন : তাঁর যঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি তাঁর পিতা ও দাদা থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বান বলেছেন : তাঁর দাদার সূত্রে তাঁর পিতা থেকে যেসব রেওয়ায়াত তিনি বর্ণনা করেছেন সেগুলো আসলে একটি জাল পাণ্ডুলিপির সাথে জড়িত যা গ্রন্থ হিসাবে বর্ণনা করা সঠিক নয়। (আল-ইলমা ফী যাবতির রেওয়ায়াহ ওয়া তাকঈদিস সিমা’,পৃ. ৮-৯)

৬. কাযী আইয়ায এ হাদীসটি নিজ সূত্রে আবু সাঈদ খুদরীর মাধ্যমে মহানবী (সা.)থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু (এ সনদের) এর বেশ কতিপয় রাবী যঈফ বলে গণ্য হয়েছে যে,তাঁদের মধ্যে শুআইব ইবনে ইবরাহীম ইবনে সাইফ ইবনে উমরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশেষ করে সাইফ ইবনে উমরের যাঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা রয়েছে। (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৫৯)

৭. সুয়ূতীও উপরিউক্ত হাদীসটি হাকিম নিশাবুরীর ঐ একই সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যা ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। (মানাভী প্রণীত ফাইযুল কাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ২৪০)

৮. মুত্তাকী হিন্দীও ‘কানযুল উম্মাল’ গ্রন্থে কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। একই শিরোনামের অধীনে হাকিম ও বাইহাকীর মতো অন্যান্য হাদীসবেত্তার রেওয়ায়াতসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং আল-ইবানাহ থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন : এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,এমন একটি হাদীসকে ‘হাদীসে সাকালাইন’ এর মতো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীসের বিপরীতে উপস্থাপনের কোন অবকাশই নেই।

 

টীকা

১. বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে (কিতাব আল-রুকুক) নিচের এই মুতাওয়াতির হাদীসটি হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন :

বুখারী মুসলিম ইবনে ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেন,যিনি উহাইব থেকে,তিনি আবদুল আযীয থেকে,তিনি আনাস থেকে বর্ণনা করেন যে,মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমার কাছে হাউসের (হাউসে কাওসার) নিকট আমার সাহাবীদের একটি দলকে আনা হবে এবং আমি তাদের চিনতে পারব;তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব,(হে আল্লাহ! তারা কি) আমার সাহাবী (নয়)? (আল্লাহ) বলবেন,‘তুমি জান না,তোমার পরে তারা কী করেছিল!’

অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে (১৪৪২ নং) মহানবী (সা.)-কে বলা হবে : ‘তোমার জানা নেই যে,তোমার পর তারা কী করেছিল! তারা পতনশীল আচরণে (শিরকের অবস্থায়) ফিরে গিয়েছিল।’

বুখারী একই রকম হাদীস আর-রুকুক অধ্যায়ে হুযায়ফাহ (১৪৩৫ নং),আবদুল্লাহ (১৪৩৫ নং),সাহল ইবনে সা’দ (১৪৪২ নং),আবু সাইদ আল-খুদরী (১৪৪২ নং),ইবনে আব্বাস (১৪৪২ নং),আবু হুরায়রাহ (১৪৪৩ নং) এবং আসমা বিনতে আবি বকর (১৪৪৯ নং) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাফসীর ও বাদাউল খালক অধ্যায়েও বর্ণনা করেছেন। একই হাদীস কিছু শব্দগত পার্থক্যসহ মুসলিম,আবু দাউদ,তিরমিযী,নাসাঈ,ইবনে মাযাহ,ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় (কিতাব আল-তাহারাত অধ্যায়ে,হাদীস নং ২৮) কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় কিতাব আল জিহাদ এ ৩২ নং হাদীস হিসাবে নিম্নের হাদীসটি এনেছেন :

মহানবী (সা.) ওহুদের শহীদদের উদ্দেশে বলেন : ‘আমি তাদের ব্যাপারে সাক্ষী।’ তখন আবু বকর বলেন : ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা কি তাদের ভাই নই? আমরা তাদের মতো ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তাদের মতো জিহাদ করেছি।’ মহানবী (সা.) জবাব দেন : ‘হ্যাঁ,কিন্তু আমি জানি না যে,আমার পরে তোমরা কী করবে...।’

উদাহরণস্বরূপ দেখুন,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পণ্ডিত মাহমুদ আবু রিয়াহ প্রণীত আদওয়া আলাল সুন্নাত আল মুহাম্মাদীয়াহ,পৃ. ৩৩৯-৩৬৩,এবং আল্লামা হিল্লী কর্তৃক প্রণীত নাহজ আল হাক্ক ওয়া কাশফ আস সিদক,পৃ. ২৬২-৩৭৫;এ দু’টি গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনেক হাদীস আলোচনা করেছেন যেগুলো পথপ্রদর্শক হিসাবে রাসূলের প্রত্যেক সাহাবীর নক্ষত্রতুল্য হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে।

২. ইবনে সা’দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে (লেইডেন,১৩২২) ২য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হযরত আবু বকরের একটি ভাষণ উল্লেখ করেছেন,যেখানে তিনি বলেছেন : ‘আমি একজন মানুষ মাত্র এবং আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। সুতরাং আমার আনুগত্য কর যখন আমি সোজা পথে চলি এবং আমাকে সংশোধন কর যখন আমাকে ভুল পথে দেখ। তোমাদের জানা উচিত যে,(কখনও) আমি শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হই। সুতরাং যখন তোমরা আমাকে ক্রোধান্বিত দেখ,তখন আমার থেকে দূরে থেক।’ একই রকম বক্তব্য তাঁর থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন :

ক. তাবারী তাঁর তারিখে,(কায়রো,১৩৫৭),২য় খণ্ড,পৃ. ৪৪০;

খ. ইবনে কুতায়বা তাঁর আল-ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ্ (মাকতাবাতুল ফুতুহ আল-আদাবিয়্যাহ,১৩১),পৃ. ৬;

গ. আল হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ (১৩৫২),৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮৩;

ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল (হায়দারাবাদ,১৩১২) ২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬ এবং অন্যরা।

দ্বিতীয় খলীফা উমর প্রায়ই বলতেন,‘প্রত্যেকেরই (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি জ্ঞান রয়েছে (কুল্লু আহাদিন আ’লামু মিন উমার) এবং ‘সকল লোকের (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি বুঝ আছে’ (কুল্লু আহাদিন আফকাহু মিন উমার)। এর জন্য দেখুন :

ক. আল-বায়হাকী,সুনান (হায়দারাবাদ,১৩৪৪),৭ম খণ্ড,পৃ. ২৩৩;

খ. আল-সুয়ূতী,আল-দুররুল মানসূর (আল মাতবাআতুল মাইমানিয়্যাহ্,১৩১৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;

গ. আল-জামাখশারী,আল-কাশশাফ (মিসর,১৩৫৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;

ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল,৮ম খণ্ড,পৃ. ২৯৮;

ঙ. আল-হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৩।

৩. হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে যায়েদ ইবনে আরকাম এবং একজন মহিলার লেনদেনের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে :

ক. আবদুর রাযযাক,আল মুসান্নাফ;

খ. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল,তাঁর মুসনাদে;

গ. আল-জাসসাস,আহকামুল কুরআনে;

ঘ. আল-সারাখশী,মাবসুত;

ঙ. আল-দাবুসী,তাসীস আন-নাযার,এবং অনেক সুন্নী আইনজ্ঞ,হাদীসশাস্ত্রবিদ এবং তাফসীরকারই তাঁদের গ্রন্থাদিতে এটি উল্লেখ করেছেন।

৪. বুখারী,মুসলিম,দারিমী,ইবনে আবি শায়বাহ,নাসাঈ,ইবনে আসির,গাযযালী,মুত্তাকী,ইবনে খালদূন এবং আবু হিলাল আল-আসকারী কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছেন যেখানে কতিপয় সাহাবী কর্তৃক মদ বিক্রির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।

 

(প্রবন্ধটির প্রধান অংশ সংকলিত হয়েছে প্রখ্যাত ভারতীয় আলেম সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন লক্ষ্ণৌভী রচিত ‘আবাকাত আল আনওয়ার’ থেকে।)

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদপবিত্র কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর হাদিস থেকে আমিরুল মোমেনীন আলী ইবনে আবি তালিব আঃ এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিসমহানবী হযরত মুহাম্মদ ‎(সা.)-এর উত্তরাধিকারী,তাঁর নবুওয়াতের মিশনের প্রধান সাহায্যকারী এবং দুনিয়া ও আখেরাতে রাসূলের ভ্রাতা আলী ‎(আ.) ‏আবরাহার পবিত্র মক্কা আক্রমণের ৩৩ বছর পর ১৩ রজব পবিত্র কা’বা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। মহান আল্লাহর আদেশে তাঁর নাম রাখা হয় আলী।শিশুকাল থেকেই মহানবী ‎(সা.)-এর সাথে হযরত আলীর বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কে আলী ‎(আ.) ‏নিজেই বলেছেন ‎: ‘...তিনি আমাকে তাঁর কোলে রাখতেন যখন আমি শিশু ছিলাম। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং তাঁর বিছানায় শুইয়ে রাখতেন। তাঁর পবিত্র দেহ আমার দেহকে স্পর্শ করত এবং তিনি আমাকে তাঁর শরীরের সুগন্ধির ঘ্রাণ নেওয়াতেন। তিনি খাদ্য-দ্রব্য চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন।...’১হযরত আবু তালিবের সংসারের ব্যয়ভার কমানোর জন্য হযরত আলীর বালক বয়সেই মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখন থেকে তিনি রাসূলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে যান। রাসূল হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর ইবাদাত করতে গেলেও তাঁকে সাথে নিয়ে যেতেন। হযরত আলী বলেন ‎: ‘তিনি ‎(মহানবী) ‏প্রতি বছর হেরাগুহায় একান্ত নির্জনে বাস করতেন। আমি তাঁকে দেখতাম। আমি ব্যতীত আর কোন লোকই তাঁকে দেখতে পেত না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ ও খাদীজাহ্ ব্যতীত কোন মুসলিম পরিবারই পৃথিবীর বুকে ছিল না। আমি ছিলাম তাঁদের পরিবারের তৃতীয় সদস্য। আমি ওহী ও রেসালতের আলো প্রত্যক্ষ করেছি এবং নবুওয়াতের সুবাস ও সুঘ্রাণ অনুভব করেছি।’২তিনি মহানবীর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করতেন। তিনি বলেন ‎: ‘উষ্ট্র শাবক যেমনভাবে উষ্ট্রীকে অনুসরণ করে ঠিক সেভাবে আমি তাঁকে অনুসরণ করতাম। তিনি প্রতিদিন তাঁর উন্নত চরিত্র থেকে একটি নিদর্শন আমাকে শিক্ষা দিতেন এবং আমাকে তা পালন করার নির্দেশ দিতেন।... ‏তাঁর ওপর যখন ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল তখন আমি শয়তানের ক্রন্দন ধ্বনি শুনেছিলাম। তাই আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‎: ‏হে রাসূলুল্লাহ্! ‏এ ক্রন্দন ধ্বনি কার? ‏তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন ‎: ‏এই শয়তান এখন থেকে তার পূজা ‎(ইবাদাত) ‏করা হবে না বলে হতাশ হয়ে গেছে। নিশ্চয় আমি যা শুনি তুমি তা শোন এবং আমি যা দেখি তা দেখ। তবে তুমি নবী নও,কিন্তু ‎[নবীর] ‏সহকারী এবং নিঃসন্দেহে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণের ওপরই আছ।’৩আর তাই মহানবী ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর ওপর ঈমান আনেন এবং তিনিই তাঁর সাথে নামায আদায় করা প্রথম ব্যক্তি। ইমাম মালেক বর্ণনা করেছেন ‎: ‘মহানবী ‎(সা.) ‏সোমবারে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন এবং আলী মঙ্গলবারে তাঁর ওপর ঈমান আনেন।’৪হযরত আলী নিজেই বলেন ‎: ‘আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূলের ভ্রাতা এবং তাঁর নবুওয়াতের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসস্থাপনকারী। একমাত্র মিথ্যাবাদী ছাড়া আমার পর কেউ এ দাবি করবে না। অন্য লোকদের নামায পড়ারও ৭ বছর আগে থেকে আমি নামায পড়েছি।’৫হযরত আলী ‎(আ.)-এর প্রসিদ্ধ উপাধিরাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে সিদ্দিকে আকবার,ফারুকে আযম,আসাদুল্লাহ ও মুরতাজা।পবিত্র কুরআনে হযরত আলী ‎(আ.)-এর মর্যাদাহযরত আলীর শানে পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,কোন ব্যক্তির গুণ বর্ণনায় এত অধিক কুরআনের বাণী অবতীর্ণ হয়নি যা হযরত আলী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস আরও বলেছেন যে,হযরত আলীর শানে তিনশ’ ‏আয়াত নাযিল হয়েছে এবং তাঁর গুণাবলি অত্যধিক ও প্রসিদ্ধ।৬ পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত আয়াতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াতوَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ‘এবং মানুষের মধ্যে এমনও আছে,যে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিক্রয় করে দেয় এবং আল্লাহ ‎(এরূপ) ‏বান্দাদের প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল।’সালাবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিলেন সেই সময় হযরত আলীকে তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকার নির্দেশ দেন যাতে কাফির-মুশরিকরা মনে করে যে,রাসূল তাঁর নিজ ঘরেই রয়েছেন। আলী ‎(আ.) ‏নির্দ্বিধায় এ নির্দেশ পালন করলে মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন।৭ ২. ‏সূরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াতفَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ‘অতঃপর তোমার নিকট যখন জ্ঞান ‎(কুরআন) ‏এসে গেছে,এরপরও যদি কেউ ‎(খ্রিস্টান) ‏তোমার সাথে তার ‎(ঈসার) ‏সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করে,তবে বল,‘(ময়দানে) ‏এস,আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের ও তোমাদের পুত্রদের,আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের সত্তাদের ও তোমাদের সত্তাদের;’ ‏অতঃপর সকলে মিলে ‎(আল্লাহর দরবারে) ‏নিবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি।’ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের সত্যতা যাচাই করার জন্য নাজরানের একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল মদীনায় আসল। তাদের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ হলো না। রাসূল ‎(সা.) ‏হযরত ঈসা ‎(আ.) ‏সম্বন্ধে প্রতিনিধিদের বললেন যে,তিনি আল্লাহর পুত্র নন,বরং আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। রাসূলুল্লাহ্ হযরত ঈসার জন্মের ব্যাপারে হযরত আদমের উদাহরণও দিলেন। কিন্তু তারা কোন কথাই শুনল না। অবশেষে তিনি আল্লাহর আদেশে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোয়া ও মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিশাপ বর্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন,যাকে ‎‘মুবাহিলা’ ‏বলে। স্থির করা হল যে,নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে উভয়ে নিজ নিজ পুত্রদের,নারীদের ‎(কন্যা সন্তানদের) ‏এবং তাদের নিজেদের ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে একত্র হবে এবং প্রত্যেকে অপরের প্রতি অভিসম্পাত ও আল্লাহর শাস্তি কামনা করবে। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হুসাইনকে কোলে নিয়ে ইমাম হাসানের হাত ধরলেন এবং হযরত ফাতিমাকে নিজের পেছনে,আর হযরত আলীকে তাঁর পেছনে রাখলেন। অর্থাৎ ছেলেদের স্থানে তিনি নাতিদের,নারীদের স্থানে নিজ কন্যাকে এবং ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্যদের স্থানে আলীকে নিলেন এবং দোয়া করলেন,‘হে আল্লাহ! ‏প্রত্যেক নবীর আহলে বাইত থাকে,এরা আমার আহলে বাইত। এদের সকল দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত ও পাক-পবিত্র রেখ।’ ‏তিনি এভাবে ময়দানে পৌঁছলে খ্রিস্টানদের নেতা আকব তা দেখে বলল,‘আল্লাহর কসম,আমি এমন নূরানী চেহারা দেখছি যে,যদি এ পাহাড়কে নিজ স্থান হতে সরে যেতে বলেন,তবে অবশ্যই সরে যাবে। সুতরাং মুবাহিলা হতে হাত গুটিয়ে নেওয়াই কল্যাণকর,অন্যথায় কিয়ামত অবধি খ্রিস্টানদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।’ ‏পরিশেষে তারা জিযিরা কর দিতে সম্মত হল। এটা হযরত আলীর একটি উঁচু স্তরের ফযিলত যে,তিনি আল্লাহর আদেশে রাসূলের ‎‘নাফ্স’ (অনুরূপ সত্তা) ‏সাব্যস্ত হলেন এবং সমুদয় নবীর থেকে শ্রেষ্ঠ হলেন।৮৩. ‏সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াত ‎يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ‘হে বিশ্বাসিগণ! ‏তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যে যারা নির্দেশের অধিকর্তা,তাদের আনুগত্য কর...।’ইমাম জাফর সাদিক ‎(আ.)- ‏কে জিজ্ঞেস করা হলো যে,উত্তরাধিকারীর আদেশ মান্য করা কি অবশ্যই কর্তব্য? ‏তিনি বললেন ‎: ‏হ্যাঁ,তাঁরা ঐসব ব্যক্তি যাঁদের আদেশ পালন করা এ আয়াতে ওয়াজিব করা হয়েছে...। এ আয়াত হযরত আলী বিন আবি তালিব,হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন ‎(আ.)-এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে।৯ ৪. ‏সূরা মায়েদার ৫৫ নং আয়াতإِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ‘(হে বিশ্বাসিগণ!) ‏তোমাদের অভিভাবক তো কেবল আল্লাহ,তাঁর রাসূল এবং সেই বিশ্বাসীরা যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করে।’শীয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের তফসীরকাররা একমত যে,আয়াতটি হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে। যেমন ইবনে মারদুইয়া এবং খাতীব বাগদাদী ইবনে আব্বাস সূত্রে এবং তাবরানী ও ইবনে মারদুইয়া আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আলী ইবনে আবি তালিব সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি আলী ইবনে আবি তালিব ‎(আ.) ‏সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে যখন তিনি রুকু অবস্থায় যাকাত দেন।ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏একদিন হযরত আলী ‎(আ.) ‏মদীনার মসজিদে নামায পড়ছিলেন। এমন সময় একজন ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইল। কিন্তু কোন ভিক্ষা না পাওয়ায় সে ফরিয়াদ করল যে,রাসূলের মসজিদ থেকে সে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। এ সময় হযরত আলী রুকু অবস্থায় ছিলেন। তিনি সেই অবস্থায় তাঁর ডান হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নেওয়ার জন্য ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করেন। ভিক্ষুক তাঁর হাত থেকে আংটি খুলে নেয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে উপরিউক্ত আয়াত নাযিল হয়।১০৫. ‏সূরা মায়েদার ৬৭ নং আয়াতيَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ‘হে রাসূল! ‏যা ‎(যে আদেশ) ‏তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দাও,আর যদি তুমি তা না কর,তবে তুমি ‎(যেন) ‏তার কোন বার্তাই পৌঁছাওনি,এবং ‎(তুমি ভয় কর না) ‏আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন;এবং নিশ্চয় আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালিত করেন না।’যখন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏দশম হিজরিতে বিদায় হজ্ব থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন সে সময় আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। ইবনে আবী হাতিম ও ইবনে আসাকির আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণনা করেছেন যে,এ আয়াত গাদীরে খুম প্রান্তরে হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে।বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করার সময় গাদীরে খুম নামক স্থানে মহানবী ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে তাঁর পরে সকল মুমিনের অভিভাবক বলে ঘোষণা দেন।১১এ ঘোষণা দেয়ার পর হযরত ওমর হযরত আলীর সাথে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানান এবং বলেন ‎: ‘হে আলী ইবনে আবি তালিব! ‏আপনি আজ হতে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর মাওলা হয়ে গেলেন।’১২৬. ‏সূরা রাদের ৭ নং আয়াতإِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ‘(হে রাসূল!) ‏তুমি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে এক পথ প্রদর্শক।’ইবনে মারদুইয়্যা,ইবনে জারীর,আবু নাঈম তাঁর ‎‘মারেফাত’ ‏গ্রন্থে,ইবনে আসাকির,দাইলামী ও ইবনে নাজ্জার তাঁদের স্ব স্ব গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি নাযিল হলে মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁর হাত নিজের বুকে রেখে বললেন,‘আমিই সতর্ককারী।’ ‏অতঃপর আলীর কাঁধের প্রতি তাঁর হাত দ্বারা ইশারা করে বললেন,‘হে আলী! ‏তুমিই পথপ্রদর্শক এবং মানুষ আমার পর তোমার মাধ্যমে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।’ ‏উক্ত রেওয়ায়েতটি শব্দের তারতম্যে ইবনে মারদুইয়্যা সাহাবী আবু বারযাহ আসলামী হতে,জীয়াফীল হযরত ইবনে আব্বাস হতে,ইবনে আহমাদ তাঁর মুসনাদে এবং ইবনে মারদুইয়্যা ও ইবনে আসাকির স্বয়ং হযরত আলী ‎(আ.) ‏হতে বর্ণনা করেছেন।১৩৭. ‏সূরা রাদের ৪৩ নং আয়াতوَيَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَسْتَ مُرْسَلًا قُلْ كَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَمَنْ عِنْدَهُ عِلْمُ الْكِتَابِযারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে,‘তুমি আল্লাহর রাসূল নও।’ ‏তুমি বল,‘আমার ও তোমাদের মধ্যে ‎(রেসালাতের) ‏সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সেই ব্যক্তি যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান রয়েছে।’অধিকাংশ তাফসীরকার স্বীকার করেছেন যে,আয়াতে বর্ণিত সেই ব্যক্তি হলেন হযরত আলী ‎(আ.)। যেমন আসমী ‎‘যায়নুল ফাতা’ ‏নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং সা’লাবী আবদুল্লাহ ইবনে আতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,আবদুল্লাহ বিন সালাম বলতেন,‘যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান আছে’-এর উদ্দিষ্ট হযরত আলী ‎(আ.)। এজন্যই হযরত আলী ‎(আ.) ‏বারবার বলতেন,‘আমার কাছে আমার মৃত্যুর পূর্বে যা চাও জিজ্ঞেস কর।’১৪৮. ‏সূরা নাহলের ৪৩ নং আয়াতوَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَতোমার পূর্বেও আমরা কেবল পুরুষদেরই ‎(রাসূল করে) ‏প্রেরণ করেছি যাদের প্রতি আমরা প্রত্যাদেশ প্রেরণ করতাম;যদি তোমরা না জেনে থাক তবে যারা জানে তাদের জিজ্ঞেস কর।আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন ‎: ‏জ্ঞানী ব্যক্তিরা অর্থাৎ আহলুয যিকর হলেন হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.),হযরত আলী ‎(আ.),হযরত ফাতেমা ‎(আ.),হযরত হাসান ও হুসাইন ‎(আ.)। যাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেছেন ‎: ‏যখন এই আয়াত নাযিল হল তখন হযরত আলী বললেন ‎: ‏আমরাই হলাম জ্ঞানের ভাণ্ডার।১৫৯. ‏সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতوَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا‘হে নবী পরিবার! ‏আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামার ঘরে এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত ফাতিমা,ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ‎(আ.)-কে ডাকেন এবং তাঁদেরকে একটি চাদরে ঢেকে নেন। হযরত আলী তাঁর পেছনে ছিলেন। তিনি তাঁকেও চাদরে ঢেকে নেন। অতঃপর বলেন ‎: ‘হে আল্লাহ্! ‏এরা আমার আহলে বাইত। অতএব,তুমি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে দাও এবং তাদেরকে উত্তমরূপে পবিত্র কর।’ ‏তখন উম্মে সালামা বলেন ‎: ‘হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমিও কি তাদের অন্তর্ভুক্ত?’ ‏তিনি বলেন ‎: ‘তুমি স্ব স্থানে আছ এবং তুমি কল্যাণের মধ্যেই আছ।’১৬হযরত উম্মে সালামা ছাড়াও হযরত আবু সাঈদ খুদরী ও আনাস ইবনে মালিক কর্তৃক এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।১৭১০. ‏সূরা শূরার ২৩ নং আয়াতقُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى‘বল,আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা ছাড়া আর কোন প্রতিদান চাই না।’রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নিকটাত্মীয় আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি ভালবাসা পোষণকে এ আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য ফরয বলে ঘোষণা করেন।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন ‎: ‏যখন এ আয়াত নাযিল হল তখন সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন,হে রাসূলুল্লাহ! ‏আপনার নিকটাত্মীয়,যাদেরকে ভালবাসা আমাদের ওপর ওয়াজিব করা হয়েছে তারা কারা? ‏রাসূল ‎(সা.) ‏বললেন ‎: ‏আলী,ফাতেমা,হাসান ও হুসাইন।১৮রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর হাদীসে আলী ‎(আ.)হযরত আলীর মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী ‎(সা.)-এর নিকট থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বলেন,নবী ‎(সা.) ‏তাবুক যুদ্ধের সময় আলীকে লক্ষ্য করে বলেছেন ‎: ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে,মর্যাদার দিক থেকে মূসার নিকট হারুন যে পর্যায়ে ছিলেন,তুমিও আমার নিকট ঐ পর্যায়ে রয়েছ?’১৯২. ‏অন্য একটি হাদীসে এসেছে ‎: ‏রাসূল বলেন ‎: ‘তুমি তো আমার নিকট তদ্রূপ যেরূপ হারুনের স্থান মূসার নিকট। পার্থক্য এতটুকু যে,আমার পরে কোন নবী নেই।’২০৩. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হাসান ও হুসাইনের হাত ধরে বলেন ‎: ‘যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসে এবং এ দু’জন ও তাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসে,সে কিয়ামতের দিন আমার সাথে একই মর্যাদায় অবস্থান করবে।’২১৪. ‏আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত। রাসূল বলেছেন ‎: ‘আলীর চেহারার দিকে তাকানোও ইবাদত।’২২৫. ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.) ‏আলী ‎(আ.)-কে সম্বোধন করে বলেছিলেন ‎: ‘মুমিনরাই তোমাকে মহব্বত করবে এবং মুনাফিকরাই তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে।’২৩৬. ‏তিরমিযী,নাসাঈ ও ইবনে মাযাহ হুবশী ইবনে জুনাদাহ্ ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূল ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘আলী আমা থেকে এবং আমি আলী থেকে। যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আমাকে ভালোবেসেছে। আর যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আল্লাহকে ভালবেসেছে। যে ব্যক্তি আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে সে আমার সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে। আর যে আমার শত্রু সে আল্লাহর শত্রু। যে ব্যক্তি আলীকে কষ্ট দিয়েছে,সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে।’২৪৭. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‘(হে আলী!) ‏দুনিয়া ও আখেরাতে তুমি আমারই ভাই।’২৫৮. ‏আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা ‎(র.) ‏থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘চার ব্যক্তিকে ভালবাসতে আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন এবং তিনি আমাকে এও অবহিত করেছেন যে,তিনিও তাদের ভালবাসেন। বলা হল ‎: ‏হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমাদের তাদের নামগুলো বলুন। তিনি বলেন ‎: ‏আলীও তাদের অন্তর্ভুক্ত। এ কথা তিনি তিনবার বলেন। ‎(অবশিষ্ট তিনজন হলেন) ‏আবু যার,মিকদাদ ও সালমান।...’২৬৯. ‏জাবির ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏তায়েফ অভিযানের দিন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏আলীকে কাছে ডেকে তার সাথে চুপিসারে আলাপ করেন। লোকেরা বলল ‎: ‏তিনি তাঁর চাচাত ভাইয়ের সাথে দীর্ঘক্ষণ চুপিসারে কথা বললেন। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‏আমি তার সাথে চুপিসারে কথা বলিনি;বরং আল্লাহই তার সাথে চুপিসারে কথা বলেছেন। ‎(অর্থাৎ তার সাথে চুপিসারে কথা বলার জন্য আল্লাহ্ই আমাকে আদেশ করেছেন।)২৭হযরত আলী সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীহযরত আবু বকর প্রায়ই হয়রত আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। হযরত আয়েশা এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন ‎: ‘আমি রাসূলে করীমকে বলতে শুনেছি,আলীর মুখ দেখা ইবাদাতের শামিল।’২৮হযরত উমর বিন খাত্তাব বলতেন,হযরত আলী বিন আবি তালিবের তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল। যদি তার একটি আমার থাকত তাহলে আমি বলতাম যে,আমাকে লাল রঙের একটি উট দেয়া হলে তা অপেক্ষাও আমি তা পছন্দ করতাম। তাঁকে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ‎: ‏১.তাঁর বিয়ে হয় রাসূল ‎(সা.)-এর কন্যার সাথে,২. ‏তাঁর সঙ্গে রাসূলে করীমের মসজিদে অবস্থান এবং যা রাসূলে করিমের জন্য বৈধ ছিল তার জন্যও তা বৈধ ছিল এবং ৩. ‏খায়বার যুদ্ধের পতাকা বহনের দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল।২৯হযরত উমর বলেছেন,হে আল্লাহ! ‏আমার ওপর এমন কোন বিপদ দিও না যখন আবুল হাসান ‎(আলী) ‏আমার নিকট উপস্থিত না থাকে। কারণ,তিনি আমার নিকট উপস্থিত থাকলে আমাকে সে বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দেবেন।’৩০তাবরানী হযরত ইবনে আব্বাস থেকে রেওয়ায়াত করেছেন যে,হযরত আলীর আঠারটি বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যা সমগ্র উম্মতের কারও ছিল না।’৩১তথ্যসূত্র১. ‏মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত নাহজ আল বালাঘা,২য় মুদ্রণ,আল খুতবাতুল কাসেয়াহ্,খুতবা নং ১৯১২. ‏প্রাগুক্ত৩. ‏প্রাগুক্ত৪. ‏মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১১২;এটি ইমাম মালেক কর্তৃক বর্ণিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হেরা গুহায় জিবরাঈল ‎(আ.) ‏কর্তৃক রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নবুওয়াত ঘোষণার পর পরই হযরত আলী ‎(আ.) ‏তাঁর ঈমান আনার বিষয়টি প্রকাশ করেন।৫. ‏সুনানে ইবনে মাজাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৪৪৬. ‏নূর-এ-সাকালাইন কর্তৃক প্রকাশিত,সাইয়্যেদ আলী জাফরী প্রণীত আল মুরতাজা,পৃ. ‏৩০।৭. ‏এহইয়াউ উলুমিদ্দীন,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২৩৮;নুরুল আবসার,পৃ. ‏৮৬,মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৭১;তাযকিরাতু সিবতে ইবনে যাওযী,পৃ. ‏২১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏৯২।৮. ‏তাফসীরে জালালাইন,১ম খণ্ড,পৃ.৬০;বায়দ্বাভী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১১৮,তাফসীরে দুররুল মানসুর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৯,মিশর মুদ্রণ;মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৫;৯. ‏মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏২১;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪৮;তাফসীরে ফুরাত,পৃ.২৮১০. ‏তাফসীরে তাবারী,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৬৫;তাফসীরে রাযী,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪৩১;মানাকেবে খাওয়ারেযমী,পৃ. ‏১৭৮;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏১০২;তাফসীরে ইবনে কাসীর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৭১;আল- ‏বেদায়া ওয়ান নেহায়া,৭ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৫৭;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏২৫;১১. ‏মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৩৭২;ইমাম নাসাঈ প্রণীত খাসায়েসে আমীরুল মুমিনীন,পৃ. ‏২১;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১০৯;আল গাদীর,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২১৪ ও ২২৯;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৭ ।১২. ‏তাফসীরে তাবারী,৩য় খণ্ড,মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল,৩য় খণ্ড,দারে কুতনী।১৩. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৪৫ দ্রষ্টব্য।১৪. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৬৯ ।১৫. ‏কেফাইয়াতুল মুওয়াহহিদীন,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৬৫০;মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৪১৩;কানযুল উম্মাল,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৫৬;তাফসীরে তাবারী,১৪তম খণ্ড,পৃ. ‏১০৮ ।১৬. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৭২৫,পৃ. ‏৩৫৯ ।১৭. ‏মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৩১;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏২১,তাফসীরে তাবারী,২২তম খণ্ড,পৃ. ‏৮;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২০৮;ফাজায়েলে খামসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৪;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১০ ।১৮. ‏যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏৯ ও ১২;তাফসীরে যামাখশারী,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৩৯;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১০১,তাফসীরে দুররুল মানসূর,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏৭;মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৯;আল গাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১৭২;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩০ ।১৯. ‏আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী,৩য় খণ্ড,হাদীস নং ৩৪৩১;বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪২ ।২০. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪০ ও জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৬৮ ।২১. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭০২২. ‏এমদাদীয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ইবনে আবি তালিব ‎(রা.),পৃ. ‏১৫ ।২৩. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭৩ ।২৪. ‏এমদাদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ‎(রা.),পৃ. ‏১৫-১৬ ।২৫. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৫৮;২৬. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৫৬;২৭. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৬৪২৮. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১৭৫ ।২৯. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,৩য় খণ্ড,এবং মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড ।৩০. ‏মুনতাখাবে কানজুল উম্মাল,৩য় খণ্ড ।৩১. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ ১১৩ ।(প্রত্যাশা,৩য় বর্ষ, ‏১ম সংখ্যাপ্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

শিশু ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ.)'র জন্মবার্ষিকীসকল মোমিন মোমিনা কে জানাই ঈদ মোবারক🎂🎂🎂🎂🎂(((পর্ব ১)))🎂🎂🎂🎂🎂দশই রজব ইসলামের মহাখুশির দিন। এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন মাওলা মোহাম্মদ (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য নবম ইমাম হযরত জাওয়াদ বা তাকি(আ)। নবীজীর আহলে বাইতের সদস্যরা কেবল মুসলমানদেরই ধর্মীয় নেতা নন বরং যারাই সত্য পথের সন্ধানী কিংবা কল্যাণকামী-তাদের সবারই নেতা।আহলে বাইতের এই মহান ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ) এর জন্ম-বার্ষিকীতে আপনাদের সবার প্রতি রইলো অশেষ অভিনন্দন ও প্রাণঢালা মোবারকবাদ এবং মাওলা মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম ।ইমাম জাওয়াদের জন্ম হয়েছিল ১৯৫ হিজরিতে তথা ৮১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল পবিত্র মদীনায়। মজলুম ও দরিদ্রদের প্রতি ব্যাপক দানশীলতা ও দয়ার জন্য তিনি 'জাওয়াদ' উপাধি পেয়েছিলেন। তাকি বা খোদাভীরু ছিল তাঁর আরেকটি উপাধি। জগত-বিখ্যাত মহাপুরুষ ইমাম রেজা (আ) ছিলেন তাঁর বাবা। আর তাঁর মায়ের নাম ‘সাবিকাহ’ বলে জানা যায়। ইমাম রেজা (আ) তাঁর এই স্ত্রীর নাম রেখেছিলেন খিইজরান। তিনি ছিলেন মহানবীর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনিন হযরত মারিয়া কিবতির (আ) বংশধর। ইমাম জাওয়াদ (আ) ১৭ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালনের পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন। তিনিই হলেন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়স্ক ইমাম। আহলে বাইতের অন্য ইমামগণের মত ইমাম জাওয়াদ (আ.)ও ছিলেন উচ্চতর নৈতিক গুণ, জ্ঞান ও পরিপূর্ণতার অধিকারী। ইসলামের মূল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন এবং বিকাশ ছিল তাঁর তৎপরতার মূল লক্ষ্য বা কেন্দ্রবিন্দু। সেযুগের সব মাজহাবের জ্ঞানী-গুণীরা ইমাম জাওয়াদ (আ.)'র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।সমসাময়িক যুগের প্রখ্যাত সুন্নি চিন্তাবিদ কামালউদ্দিন শাফেয়ি ইমাম জাওয়াদ (আ.) সম্পর্কে বলেছেন, "মুহাম্মাদ বিন আলী তথা ইমাম জাওয়াদ (আ.) ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মর্যাদা ও গুণের অধিকারী। মানুষের মুখে মুখে ফিরতো তাঁর প্রশংসা। তাঁর উদারতা, প্রশস্ত দৃষ্টি ও সুমিষ্ট কথা সবাইকে আকৃষ্ট করত। যে-ই তাঁর কাছে আসতো নিজের অজান্তেই এই মহামানবের অনুরাগী হয়ে পড়ত এবং তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করত।" ইমাম জাওয়াদ (আ) মাত্র সাত বা আট বছর বয়সে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতো অল্প বয়সে তাঁর ইমামতিত্বের বিষয়টি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়কর। ফলে অনেকেই এ বিষয়ে সন্দেহ করতেন। অথচ আল্লাহর তো এই শক্তি আছে যে তিনি মানুষকে তার বয়সের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন। কোরানের আয়াতের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যেও এরকম উদাহরণ বহু আছে। যেমন শিশুকালে হযরত ইয়াহিয়া (আ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তি, মায়ের কোলে নবজাতক ঈসা (আ) এর কথা বলা ইত্যাদি সর্বশক্তিমান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতারই নিদর্শন। ইমাম জাওয়াদ (আ) শৈশব-কৈশোরেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, ধৈর্য ও সহনশীলতায়, ইবাদত-বন্দেগিতে, সচেতনতায়, কথাবার্তায় শীর্ষস্থানীয় মহামানব। একবার হজ্জ্বের সময় বাগদাদ এবং অন্যান্য শহরের বিখ্যাত ফকীহদের মধ্য থেকে আশি জন মদীনায় ইমাম জাওয়াদ (আ) এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা ইমামকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞেস করে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সন্তোষজনক জবাব পেলেন। ফলে জাওয়াদ (আ)’র ইমামতিত্বের ব্যাপারে তাদের মনে যেসব সন্দেহ ছিল-তা দূর হয়ে যায়।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম‌লা'নাতুল্লাহি আলাল কাজেবিন🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂