সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নারীর বিয়েআগস্ট ১৩, ২০১৮ ১৪:০৬ Asia/Dhakaগত পয়লা জিলহজ ছিল 'হযরত আলী (আ) ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমার (সা.আ) শুভ বিয়ের ১৪৩৭ তম বার্ষিকী'। ইরানে এ দিবসটি পালন করা হয় পরিবার দিবস হিসেবে। এ উপলক্ষে সবাইকে অনেক সালাম ও শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি পেশ করছি বিশ্বনবী (সা) ও তার পবিত্র আহলে বাইতের শানে বিশেষ করে হযরত আলী (আ) ও ফাতিমা জাহরা (সা.আ)'র শানে অশেষ দরুদ ও সালাম।ইসলাম ধর্ম পরিবার গঠন ও পরিবার রক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে মহানবীর পরিবারের পর আলী ও ফাতিমার পরিবার হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবার। বিশ্বনবী (সা)'র বংশধারা রক্ষাকারী এ পরিবার থেকেই জন্ম নিয়েছেন বেহেশতি যুবকদের দুই সর্দার হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (মহান আল্লাহর অশেষ দরুদ বর্ষিত হোক তাদের ওপর চিরকাল)। মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদিসহ (আ) মোট ১১ জন ইমামের জন্ম হয়েছে এই মহতী পরিবারে। রাসূলুল্লাহ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন। এরপর মহান আল্লাহর নির্দেশে গোপনে তিন বছর মানুষকে ধর্মের দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। তিন বছর পর তিনি প্রকাশ্যে নিজের আত্মীয়-স্বজন ও মক্কাবাসীকে ধর্মের পথে দাওয়াত দেন। রাসূলের গোত্র বনু হাশিমের মধ্য থেকে তাঁর চাচা আবু লাহাব তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে। আর মক্কার নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের প্রায় সবাই রাসূলের সাথে শত্রুতা শুরু করে।এরমধ্যে রাসূলের পুত্রসন্তানরা মারা গেলে কাফির-মুশরিকরা রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। আস ইবনে ওয়ায়েল রাসূলকে ‘আবতার’ (লেজকাটা) বা নির্বংশ বলে গালি দেয়। সে বলত, ‘আরে মুহাম্মাদের তো কোন পুত্রসন্তান নেই, সে মরে গেলে তার নাম নেয়ার কেউ থাকবে না।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ কথায় খুব কষ্ট পেতেন। মহান আল্লাহ তাঁর এ কষ্ট দূর করার জন্য যে অমূল্য নেয়ামত তাঁকে দান করেন তিনিই হলেন হযরত ফাতিমা (আ.)। এর প্রেক্ষিতেই পবিত্র কুরআনের সূরা কাওসার নাযিল হয়।আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বলেন, হযরত ফাতিমার শানে এ সূরা নাযিল হয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে। পরবর্তী কালে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের প্রতি নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সকল ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি।আবু জাহেল, আবু সুফিয়ানরা চেয়েছিল রাসূলকে হত্যা করতে। আবু সুফিয়ানের সন্তান আমীরে মুয়াবিয়া চেয়েছিল হযরত আলীকে হত্যা করতে, তার রাজত্বকালেই ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াযীদ কারবালায় নৃশংসভাবে ইমাম হুসাইনকে সপরিবারে শহীদ করে। পরবর্তীকালে একের পর এক রাসূলের বংশধরকে হত্যা করা হয়। তারপরও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশধারাতেই শেষ জামানায় ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। সেদিন আল্লাহ তা‘আলার সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন হবে যা তিনি সূরা তওবায় বলেছেন : ‘তিনি তো সেই সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য-ধর্মসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে সেটিকে (নিজ ধর্মকে) সব ধর্মের ওপর বিজয়ী করেন; যদিও অংশীবাদীরা তা অপছন্দ করে।’রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সব নারীর সন্তানদের তাদের পুরুষদের সাথে সংযুক্ত করা হয় শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’ আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ 'হে রাসূলের সন্তান' বলে সম্বোধন করত। হযরত ফাতিমার জন্মের মাধ্যমে রাসূল অপরিসীম মানসিক শান্তি অনুভব করেন। তিনি তাঁকে কতটা ভালবাসতেন তা তাঁর কথায় বারবার প্রকাশিত হয়েছে। এ ভালবাসা অকারণ ছিল না। হযরত ফাতিমার তাকওয়া, তাঁর দুনিয়াবিমুখতা, তাঁর দায়িত্বশীলতা সব মিলিয়ে মহান আল্লাহর কাছে তাঁর যে অবস্থান সে কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ভালবাসতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে হযরত ফাতিমা আসলে তিনি তাঁকে দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ জানাতেন। এটি কি শুধু একজন কন্যার প্রতি পিতার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল? আলেমরা বলেছেন, কখনই নয়। কারণ, অন্য কোন সন্তানের ক্ষেত্রে রাসূল এমন কাজ করতেন না। প্রকৃতপক্ষে এ ছিল বেহেশতের নারীদের নেত্রীর প্রতি মহান আল্লাহর রাসূলের সম্মান বা ভালবাসা প্রদর্শন।হযরত ফাতিমা এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন যখন সারা বিশ্বে নারীদের মানুষ বলে গণ্য করা হত না। তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন করা হত। খ্রিস্টানরা নারীকে ‘শয়তানের দোসর’ বলত এবং নারী জাতিকে সব পাপের উৎস বলে মনে করত। আরবরা কন্যা-সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে জীবন্ত কবর দিত।পবিত্র কুরআনে সেই জাহেলিয়াতের যুগের কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে : ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখ কালো হয়ে যায়, অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে তাকে অপমান সহ্য করে থাকতে দেবে, না তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে।’ হযরত ফাতিমা সেই অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ নারী জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথমে তাঁর স্ত্রী হযরত খাদিজার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নারী জাতিকে সম্মানিত করেন। পরে নিজ কন্যা ফাতিমার প্রতি দায়িত্ব পালন করেও নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন।রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত ফাতিমার মর্যাদা সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। যেমন : তিনি বলেন, ‘চারজন নারী সমগ্র নারী জাতির মধ্যে সর্বোত্তম : মারইয়াম বিনতে ইমরান, আসিয়া বিনতে মুযাহিম, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ এবং ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ফাতিমা।’রাসূল (সা.) বলেন, ‘বেহেশতে সর্বপ্রথম আমার কাছে যে পৌঁছবে সে হচ্ছে ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ।’বুখারী শরীফের একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাকে রাগিয়ে দেয় সে আমাকেও রাাগিয়ে দেয়।’তিনি আরও বলেন, ‘ফাতিমা কোন ব্যাপারে রাগ করলে আল্লাহও রাগ করেন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও হন আনন্দিত ।’ হযরত ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) বেহেশতি নারীদের সর্দার তথা খাতুনে জান্নাত। তাঁর অসাধারণ নানা গুণ, অতি উচ্চ স্তরের খোদাভীতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব তথা মহান আল্লাহর সর্বশেষ রাসুলের (সা) কন্যা হওয়ার বিষয়টি সবাই জানতেন। তাই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলিফাসহ সাহাবিদের অনেকেই এই মহামানবীকে বিয়ে করার জন্য মহানবীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বনবী (সা) তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। মহানবী বলতেন, ফাতিমার ব্যাপারটি আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। অর্থাৎ ফাতিমার বিয়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে সম্পন্ন হবে।আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাসূলের কাছে গিয়ে বলেন, ‘যদি ফাতিমাকে আমার সাথে বিয়ে দেন তাহলে মূল্যবান মিশরীয় কাপড় বোঝাই এক হাজারটি উট এবং আরও এক হাজার দিনার তথা এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা মোহরানা হিসাবে প্রদান করব।’ রাসূল (সা.) এ প্রস্তাবে খুব অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন, ‘তুমি কি মনে করেছ আমি অর্থ ও সম্পদের গোলাম? তুমি সম্পদ ও অর্থ দিয়ে আমার সাথে বড়াই করতে চাও?’হযরত ফাতিমার বিয়ে প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর ফেরেশতা আমার কাছে এসে বললেন, আল্লাহ আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং বলেছেন, তিনি আপনার কন্যা ফাতিমাকে আসমানে আলী ইবনে আবি তালিবের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আপনিও তাঁকে জমিনে তাঁর সাথে বিয়ে দিন। বলা হয় ৪০ হাজার ফেরেশতা ছিলেন বেহেশতে অনুষ্ঠিত এই শুভ বিয়ের সাক্ষী।দ্বিতীয় হিজরিতেই হযরত ফাতিমার সাথে হযরত আলীর বিয়ে হয়। তাঁর বিয়ের বিষয়ে ইতিহাসে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে তাঁর মর্যাদা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) পরবর্তীকালে বলেন, ‘আলীর জন্ম না হলে ফাতিমার সুযোগ্য স্বামী পাওয়া যেত না।’ (হযরত মারইয়ামের কোনো সুযোগ্য স্বামী সৃষ্টি করেননি মহান আল্লাহ। তাই তিনি চিরকুমারীই হয়ে আছেন) বিয়ের সময় হযরত ফাতিমার বয়স ছিল মাত্র দশ-এগারো বছর। অথচ ফাতিমার এ বয়সেই রাসূল বলছেন, ‘আলীর জন্ম না হলে ফাতিমার সুযোগ্য স্বামী পাওয়া যেত না।’- এ কথার মধ্যে কত বড় রহস্য লুকিয়ে ছিল তা পরবর্তীকালে প্রকাশ হয়েছে। ইসলামের জন্য হযরত আলী (আ.)-এর ত্যাগ ও অবদান কিংবদন্তীতুল্য অমর ইতিহাস হয়ে আছে। বদর, উহুদ, খন্দক ও খায়বারসহ অন্য অনেক যুদ্ধে তাঁর অতুলনীয় বীরত্বের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। অন্যদিকে তিনিই হলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞানের ভাণ্ডার।রাসুলে খোদা যখন নবুয়্যত পান, তখন কিশোর আলীই তাঁর প্রতি প্রথম ইমান আনেন। শুধু তাই নয়, নবীজিকে তিনি সবসময় ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। তাঁর বীরত্ব, জ্ঞান গরিমা, ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও সাহসিকতায় রাসুল (সা.) ছিলেন মুগ্ধ। আর সেজন্যই তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমাকে প্রাণপ্রিয় আলীর সাথেই বিয়ে দিয়েছিলেন।একইভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও হযরত আলীর প্রশান্তির মাধ্যম হযরত ফাতিমার অবদানও অনন্য বা অতুলনীয়। তিনি রাসূলের ওফাতের পর ক্রান্তিকালে মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তাঁর ভূমিকার মাধ্যমে সত্যের আলো প্রজ্বলিত করেই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ দু’টি ভাষণ আমাদের হেদায়াতের পথনির্দেশ করে। তাই এটা স্পষ্ট কেন রাসূল সেই দশ বছরের বালিকা ও বাইশ বছরের যুবক সম্পর্কে এ কথা বলেছিলেন!হযরত আলী (আ) ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য মহানবীর (সা) কাছে আসলেও মহানবীর সামনে শ্রদ্ধার কারণে ও লজ্জায় তা বলতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় মহানবী (সা) আঁচ করতে পারেন যে আলী ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছেন। তবুও তিনি বিষয়টা তা-ই কিনা জানতে চাইলে আলী (আ) জানান যে, 'হ্যাঁ, আমি এ উদ্দেশ্যেই এসেছি'।হযরত ফাতিমা (সা.আ) তাঁর বাবা তথা মহানবীর (সা) পর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর (আ) সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হবেন- এটাই ছিল স্বাভাবিক। তবুও মহানবী (সা) নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধার আদর্শ তুলে ধরার জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে হযরত ফাতিমার মতামত জানতে চান। চাচাত ভাই আলীকেও তিনি জানান যে ফাতিমার মতামত জেনে আসি। মহানবী প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে বলেন: আমি তোমাকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির স্ত্রী করতে চাই। তোমার কি মত?[মহানবীর (সা) এ বাণী থেকে বোঝা যায় হযরত আলীর মর্যাদা ছিল হযরত ফাতিমার চেয়েও বেশি। কারণ মহানবীর (সা) পর আলী (আ) হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। অন্যদিকে তিনি বেহেশতি নারীর নেত্রীরও ইমাম বা নেতা।] ফাতিমা লজ্জায় মাথা নুইয়ে থাকেন এবং হ্যাঁ ও না-বোধক কিছুই না বলে চুপ করে থাকেন। এ অবস্থায় মহানবী বলেন: আল্লাহু আকবর! তাঁর নীরবতা সম্মতিরই প্রমাণ। তাই এটা স্পষ্ট মেয়েদের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মত নেয়া জরুরি। জোর করে কোনো নারীকে কোনো পুরুষের কাছে বিয়ে দেয়া বৈধ নয়। অন্যদিকে ইসলামী আইন অনুযায়ী কোনো কুমারী নারী পিতা বা বৈধ অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া কোনো পুরুষকে বিয়ে করতে পারে না।দ্বিতীয় হিজরির ১ জিলহাজ্জ রোজ শুক্রবার হযরত আলীর সাথে হযরত ফাতিমার শুভ-বিয়ে সম্পন্ন হয়। এ সময় হযরত আলীর বয়স ছিল প্রায় ২২ অথবা ২৩। এ বিয়ের চুক্তি চূড়ান্ত করেছিলেন মহানবী (সা) নিজেই। এ বিয়ের অনুষ্ঠানে আনসার ও মুহাজিরদের সবাই উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে মহানবী (সা:) সাহাবীদের বলেছিলেন,আল্লাহর আদেশে আমি ফাতিমার সাথে আলীর বিয়ে দিচ্ছি এবং তাদের বিয়ের মোহরানা ধার্য করেছি চারশ মিসকাল রৌপ্য। এরপর মহানবী (সা.) হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আলী তুমি কি এতে রাজী আছ? হযরত আলী সম্মতি জানিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমি রাজী। তখন নবীজী দু'হাত তুলে তাঁদের জন্য এবং তাঁদের অনাগত বংশধরদের সার্বিক কল্যাণের জন্য দোয়া করেন। বিয়েতে বরের পক্ষ থেকে কনেকে দেনমোহর পরিশোধ করা ফরজ। আর হযরত আলী (আ.) নিজের ঢাল বিক্রি করে তা পরিশোধ করেছিলেন। হযরত আলী তাঁর বর্মটি বিক্রি করে ৫০০ দিরহাম বা রৌপ্য মুদ্রা পেয়েছিলেন। একটি উট, একটি তরবারি ও একটি বর্ম এবং কয়েকটি খেজুরের বাগান ছাড়া হযরত আলীর কাছে আর কোনো সম্পদই ছিল না।কোনো কোনো হাদিসে বলা হয়, হযরত ফাতিমা (সা. আ) তাঁর বিয়ের একমাত্র মোহরানা হিসেবে বিচার-দিবস তথা কিয়ামতের দিনে তাঁরই বাবার পাপী উম্মতের শাফায়াত তথা তাঁদেরকে ক্ষমা করার অধিকার চেয়েছিলেন। আর মহান আল্লাহ তাঁর এই দাবি কবুল হওয়ার কথা জানিয়ে দেন জিবরাইলের মাধ্যমে।অথচ আজকাল মুসলমান নর-নারীর বিয়ের মোহরানা নিয়ে কত বাড়াবাড়ি হচ্ছে। মোহরানার অংক বা সম্পদ নিয়ে বস্তুগত প্রতিযোগিতা হচ্ছে! ভাবখানা এমন যে যার বিয়ের মোহরানা যত বেশি তার মর্যাদা যেন ততই উপরের!হযরত ফাতিমার বিয়ে উপলক্ষে নব-দম্পতির জন্য যেসব উপহার কেনা হয়েছিল মোহরানার অর্থ দিয়ে সেসব ছিল: একটি আতর, কিছু জামা-কাপড় ও কিছু গৃহস্থালি সামগ্রী। বর্ণনা থেকে জানা যায় যে মোট ১৮টি উপহার কেনা হয়েছিল: এসবের মধ্যে ছিল: চার দিরহাম দামের মাথা ঢাকার একটি বড় রুমাল বা স্কার্ফ। এক দিরহাম দামের একটি পোশাক-সামগ্রী। খেজুর পাতা ও কাঠের তৈরি একটি বিছানা। চারটি বালিশ। বালিশগুলো ছিল আজখার নামক সুগন্ধি ঘাসে ভরা। পশমের তৈরি একটি পর্দা। একটি ম্যাট বা পাপোশ। হাত দিয়ে গম পেশার একটি যাঁতাকল। খাবার পানি রাখার জন্য চামড়ার তৈরি একটি মোশক। তামার তৈরি একটি বেসিন বা হাত ধোয়ার পাত্র। দুম্বা বা উটের দুধ দোহনের জন্য একটি বড় পাত্র। সবুজ রং-করা একটি বড় মাটির পাত্র বা জগ।ইসলামের দুই মহীয়সী নারী উম্মে আইমান ও উম্মে সালামাহ হযরত ফাতিমাকে খুব ভালবাসতেন। ফাতিমার বিয়ের সময় তাঁরা মহানবীর (সা) কাছে এসে বললেন: হে আল্লাহর সম্মানিত রাসুল! আজ যদি খাদিজা (সা. আ) বেঁচে থাকতেন তাহলে এ বিয়ের আয়োজনে তিনি খুবই খুশি হতেন! তাই নয়কি?এমন একটি শুভক্ষণে ইসলামের জন্য সর্বস্ব-ত্যাগী ও সর্বপ্রথম মুসলমান বিবি খাদিজার নাম শোনা মাত্রই মহানবীর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। তিনি খাদিজার সব ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মহানুভবতার কথা স্মরণ করতে করতে বললেন: 'খাদিজার মত একজন নারী আর কোথায় পাওয়া যাবে? সেই দিনগুলোতে যখন সবাই আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল সে সময় কেবল খাদিজাই আমাকে সুনিশ্চিতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং তাঁর সব সম্পদ ও জীবন আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল যাতে আল্লাহর ধর্ম ইসলাম প্রচার করা যায়। খাদিজা হচ্ছে সেই নারী যাকে এই খবর দিতে মহান আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দেন যে, বেহেশতের অতি উচ্চ বা সম্মানজনক স্থানে খাদিজার জন্য মহামূল্য সবুজ পান্নার তৈরি একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হবে।'এরপর ফাতিমাকে আলীর ঘরে পাঠানোর জন্য অনুমতি চান হযরত উম্মে সালামাহ। এ অবস্থায় মহানবী বললেন, আলী নিজেই কেনো এ প্রস্তাব নিয়ে এল না আমার কাছে? লজ্জার কারণে আলী তা বলতে পারছে না বলে তিনি জানান। এ অবস্থায় মহানবী তাঁকে আসতে বললেন। আলী (আ) মহানবীর সামনে এসে মাথা নিচু করে রাখলেন। মহানবী তাকে বললেন, তুমি কি তোমার স্ত্রীকে ঘরে নিয়ে যেতে চাও? আলী মাথা নিচু রেখেই বললেন: জি, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হউক। সে রাত বা তার পরের দিনই এ জন্য ব্যবস্থা করবেন বলে মহানবী জানান।হযরত আলী জানান এ বিয়ের উৎসবের জন্য বর্ম বিক্রির অর্থ থেকে কিছু অর্থ সংরক্ষণের জন্য আলাদা করে উম্মে সালামাহ'র কাছে দেয়া হয়েছিল। মহানবী (সা) তার থেকে দশ দিরহাম নিয়ে আমায় বলেন: কিছু তেল, খেজুর ও 'কাশ্ক' ('কাশ্ক' হচ্ছে দুধ বা দই থেকে তৈরি করা বিশেষ খাদ্য) কিনে আন এই অর্থ দিয়ে। সেসব আনা হলে মহানবী তাঁর জামার হাতাগুলো গুটিয়ে সেগুলো মেশানো শুরু করেন নিজ হাতে। ওই তিন খাদ্যের মিশ্রণে তৈরি হল বিয়ের অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য হালুয়া জাতীয় বিশেষ মিষ্টি খাবার।খাবার তৈরির পর মহানবী আলীকে বললেন, দাওয়াত দাও যতজনকে তুমি ইচ্ছে করছ! আলী বললেন, আমি মসজিদে গিয়ে দেখলাম সেখানে অনেক সাহাবি সমবেত রয়েছেন। আমি তাদের বললাম: মহানবীর (সা) দাওয়াত কবুল করুন। তারা রওনা দিলেন মহানবীর (সা) দিকে। আমি মহানবীকে (সা) বললাম: মেহমানের সংখ্যা তো বিপুল। তিনি বিশেষ খাবারটি ঢাকলেন একটি শিট দিয়ে এবং বললেন: তাদেরকে আসতে বল একসাথে দশ-দশ জন করে। ফলে দশ জনের এক একটি গ্রুপ এসে খেয়ে বেরিয়ে গেলে দশ জনের অন্য গ্রুপ আসছিল। এভাবে বহু মেহমান এসে খাবার খাওয়া সত্ত্বেও তা যেন মোটেও কমছিল না। সাতশত নারী-পুরুষ মহানবীর (সা) বানানো সেই বরকতময় মিষ্টি খাবার খেয়েছিলেন।মেহমানরা সবাই চলে গেলে মহানবী (সা) আলীকে ডানে ও ফাতিমাকে নিজের বাম দিকে বসিয়ে তাঁদের জন্য দোয়া করেন। তিনি নিজের মুখ থেকে কিছু লালা বের করে তা ফাতিমা ও আলীর ওপর ছড়িয়ে দেন। এরপর আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বলেন: হে আল্লাহ! তারা আমার থেকে ও আমি তাদের থেকে! হে প্রভু! আপনি যেমন আমার থেকে সব ধরনের অপবিত্রতা ও কদর্যতা দূর করেছেন, তেমনি তাদের কাছ থেকেও সেসব দূর করে তাদের পবিত্র করুন। এরপর বর-কনেকে বললেন: ওঠো এবং ঘরে যাও। তোমাদের ওপর মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।বলা হয় বিয়ের দিন বা রাতে হযরত ফাতিমার কাছে এসে একজন দরিদ্র ব্যক্তি কিছু সাহায্য চাইলে তিনি তার বিয়ের পোশাক দান করে দেন ওই ব্যক্তির কাছে যাতে তা বিক্রি করে ওই ব্যক্তি কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন। ফলে একটি পুরনো পোশাক পরেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন হযরত ফাতিমা (সা.আ)। হযরত ফাতিমা ও আলীর বিয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই সাদামাটা। তাই হযরত উম্মে আইমান এসে মহানবীর কাছে দুঃখ করে বললেন, সেদিনও তো আনসারদের এক মেয়ের বিয়ে হল। সে অনুষ্ঠানে কত জাঁকজমক ও আনন্দ-ফুর্তি হল! অথচ বিশ্ববাসীর নেতা মহানবীর মেয়ের বিয়ে কিনা এতো সাদাসিধেভাবে হচ্ছে! এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, এ বিয়ের সাথে পৃথিবীর কোন বিয়ের তুলনাই হয় না। পৃথিবীতে এ বিয়ের কোন জাঁকজমক না হলেও আল্লাহর আদেশে আসমানে এ বিয়ে উপলক্ষে ব্যাপক জাঁকজমক হচ্ছে। বেহেশতকে অপূর্ব সাজে সাজানো হয়েছে। ফেরেশতারা, হুর-গিলমান সবাই আনন্দ করছে। বেহেশতের গাছপালা থেকে মণি-মুক্তা ঝরছে! আর সেগুলো সংগ্রহ করছেন বেহেশতের হুরিরা। কিয়ামত পর্যন্ত তারা সেগুলো সংগ্রহ করতেই থাকবেন যাতে সেগুলোর বিনিময়ে পুরস্কার পাওয়া যায়। একথা শুনে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।বিয়ের পর সাংসারিক কাজের দায়িত্ব ও শ্রম-বিভাগ:বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) আলী ও ফাতিমাকে বলে দিয়েছিলেন যে বাইরের কাজগুলো করবে আলী আর ঘরোয়া (গৃহস্থালী ও মেয়েলি) কাজগুলো করবে ফাতিমা। হযরত ফাতিমা এতে খুশি হয়েছিলেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন, এই শ্রম-বিভাজনের ফলে যেসব কাজ করতে ঘরের বাইরে যেতে হয় ও বার বার পর-পুরুষদের সামনে পড়তে হয় তা থেকে তিনি নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। ইমাম জাফর সাদিক (আ) বলেছেন, হযরত আলী পানি ও জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতেন। অন্যদিকে হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ) আটা পিষতেন ও রুটি বানাতেন।অবশ্য ইসলাম স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করতে পুরুষকে উৎসাহ দেয় যাতে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। হযরত আলীও অনেক সময় ঘরের কাজে ফাতিমাকে সাহায্য করতেন। ইসলাম নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দেয় বলে এ ধর্ম কখনও নারীকে সামাজিক ভূমিকা পালনে বিরত রাখে না। শালীনতা বজায় রেখে ও সংসারের মূল দায়িত্বগুলো পালনের পাশাপাশি নারী সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে পারেন। মহানবীর (সা) ওফাতের পর হযরত ফাতিমাকে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ফাদাকের বাগান থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং খেলাফতের ব্যাপারেও মহানবীর (সা) নির্দেশ অমান্য করা হয় বলে হযরত ফাতিমা মসজিদে নববীতে গিয়ে হযরত আলীর নেতৃত্বের অধিকার সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছিলেন। গৃহস্থালী ও সাংসারিক দায়িত্ব ছাড়াও সব ধরনের সামাজিক দায়িত্বও পুরোপুরি পালন করে গেছেন হযরত জাহরা (সা.আ)। তাই হযরত আলী (আ) বলেছিলেন, 'আল্লাহর শপথ! আমি কখনও ফাতিমাকে অসন্তুষ্ট করিনি অথবা তাকে কোনো কাজ করতে বাধ্য করিনি। অন্যদিকে ফাতিমাও আমাকে কখনও রাগিয়ে দেয়নি বা আমাকে অমান্য করেনি। বস্তুত যখনই আমি তাঁর দিকে তাকাতাম আমার অন্তর থেকে সব বেদনা বা দুঃখ দূর হয়ে যেত।' এই মহা-শুভদিন উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি আবারও শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নারীর বিয়ে

গত পয়লা জিলহজ ছিল 'হযরত আলী (আ) ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমার (সা.আ) শুভ বিয়ের ১৪৩৭ তম বার্ষিকী'। ইরানে এ দিবসটি পালন করা হয় পরিবার দিবস হিসেবে। এ উপলক্ষে সবাইকে অনেক সালাম ও শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি পেশ করছি বিশ্বনবী (সা) ও তার পবিত্র আহলে বাইতের শানে বিশেষ করে হযরত আলী (আ) ও ফাতিমা জাহরা (সা.আ)'র শানে অশেষ দরুদ ও সালাম।

ইসলাম ধর্ম পরিবার গঠন ও পরিবার রক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে মহানবীর পরিবারের পর আলী ও ফাতিমার পরিবার হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবার। বিশ্বনবী (সা)'র বংশধারা রক্ষাকারী এ পরিবার থেকেই জন্ম নিয়েছেন বেহেশতি যুবকদের দুই সর্দার হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (মহান আল্লাহর অশেষ দরুদ বর্ষিত হোক তাদের ওপর চিরকাল)। মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদিসহ (আ) মোট ১১ জন ইমামের জন্ম হয়েছে এই মহতী পরিবারে। 

রাসূলুল্লাহ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন। এরপর মহান আল্লাহর নির্দেশে গোপনে তিন বছর মানুষকে ধর্মের দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। তিন বছর পর তিনি প্রকাশ্যে নিজের আত্মীয়-স্বজন ও মক্কাবাসীকে ধর্মের পথে দাওয়াত দেন। রাসূলের গোত্র বনু হাশিমের মধ্য থেকে তাঁর চাচা আবু লাহাব তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে। আর মক্কার নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের প্রায় সবাই রাসূলের সাথে শত্রুতা শুরু করে।


এরমধ্যে রাসূলের পুত্রসন্তানরা মারা গেলে কাফির-মুশরিকরা রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। আস ইবনে ওয়ায়েল রাসূলকে ‘আবতার’ (লেজকাটা) বা নির্বংশ বলে গালি দেয়। সে বলত, ‘আরে মুহাম্মাদের তো কোন পুত্রসন্তান নেই, সে মরে গেলে তার নাম নেয়ার কেউ থাকবে না।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ কথায় খুব কষ্ট পেতেন। মহান আল্লাহ তাঁর এ কষ্ট দূর করার জন্য যে অমূল্য নেয়ামত তাঁকে দান করেন তিনিই হলেন হযরত ফাতিমা (আ.)। এর প্রেক্ষিতেই পবিত্র কুরআনের সূরা কাওসার নাযিল হয়।

আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বলেন, হযরত ফাতিমার শানে এ সূরা নাযিল হয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে। পরবর্তী কালে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের প্রতি নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সকল ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি।
আবু জাহেল, আবু সুফিয়ানরা চেয়েছিল রাসূলকে হত্যা করতে। আবু সুফিয়ানের সন্তান আমীরে মুয়াবিয়া চেয়েছিল হযরত আলীকে হত্যা করতে, তার রাজত্বকালেই ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। মুয়াবিয়ার ছেলে ইয়াযীদ কারবালায় নৃশংসভাবে ইমাম হুসাইনকে সপরিবারে শহীদ করে। পরবর্তীকালে একের পর এক রাসূলের বংশধরকে হত্যা করা হয়। তারপরও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশধারাতেই শেষ জামানায় ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। সেদিন আল্লাহ তা‘আলার সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন হবে যা তিনি সূরা তওবায় বলেছেন : ‘তিনি তো সেই সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য-ধর্মসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে সেটিকে (নিজ ধর্মকে) সব ধর্মের ওপর বিজয়ী করেন; যদিও অংশীবাদীরা তা অপছন্দ করে।’

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সব নারীর সন্তানদের তাদের পুরুষদের সাথে সংযুক্ত করা হয় শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’ আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ 'হে রাসূলের সন্তান' বলে সম্বোধন করত। 


হযরত ফাতিমার জন্মের মাধ্যমে রাসূল অপরিসীম মানসিক শান্তি অনুভব করেন। তিনি তাঁকে কতটা ভালবাসতেন তা তাঁর কথায় বারবার প্রকাশিত হয়েছে। এ ভালবাসা অকারণ ছিল না। হযরত ফাতিমার তাকওয়া, তাঁর দুনিয়াবিমুখতা, তাঁর দায়িত্বশীলতা সব মিলিয়ে মহান আল্লাহর কাছে তাঁর যে অবস্থান সে কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ভালবাসতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে হযরত ফাতিমা আসলে তিনি তাঁকে দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ জানাতেন। এটি কি শুধু একজন কন্যার প্রতি পিতার ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল? আলেমরা বলেছেন, কখনই নয়। কারণ, অন্য কোন সন্তানের ক্ষেত্রে রাসূল এমন কাজ করতেন না। প্রকৃতপক্ষে এ ছিল বেহেশতের নারীদের নেত্রীর প্রতি মহান আল্লাহর রাসূলের সম্মান বা ভালবাসা প্রদর্শন।

হযরত ফাতিমা এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন যখন সারা বিশ্বে নারীদের মানুষ বলে গণ্য করা হত না। তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন করা হত। খ্রিস্টানরা নারীকে ‘শয়তানের দোসর’ বলত এবং নারী জাতিকে সব পাপের উৎস বলে মনে করত। আরবরা কন্যা-সন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে জীবন্ত কবর দিত।

পবিত্র কুরআনে সেই জাহেলিয়াতের যুগের কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে : ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখ কালো হয়ে যায়, অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে লোকদের থেকে মুখ লুকিয়ে থাকে। সে ভাবে তাকে অপমান সহ্য করে থাকতে দেবে, না তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে।’ হযরত ফাতিমা সেই অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ নারী জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথমে তাঁর স্ত্রী হযরত খাদিজার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নারী জাতিকে সম্মানিত করেন। পরে নিজ কন্যা ফাতিমার প্রতি দায়িত্ব পালন করেও নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত ফাতিমার মর্যাদা সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। যেমন : তিনি বলেন, ‘চারজন নারী সমগ্র নারী জাতির মধ্যে সর্বোত্তম : মারইয়াম বিনতে ইমরান, আসিয়া বিনতে মুযাহিম, খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ এবং ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ফাতিমা।’

রাসূল (সা.) বলেন, ‘বেহেশতে সর্বপ্রথম আমার কাছে যে পৌঁছবে সে হচ্ছে ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ।’

বুখারী শরীফের একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাকে রাগিয়ে দেয় সে আমাকেও রাাগিয়ে দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফাতিমা কোন ব্যাপারে রাগ করলে আল্লাহও রাগ  করেন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও হন আনন্দিত ।’
 
হযরত ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) বেহেশতি নারীদের সর্দার তথা খাতুনে জান্নাত। তাঁর অসাধারণ নানা গুণ, অতি উচ্চ স্তরের খোদাভীতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব তথা মহান আল্লাহর সর্বশেষ রাসুলের (সা) কন্যা হওয়ার বিষয়টি সবাই জানতেন। তাই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলিফাসহ সাহাবিদের অনেকেই এই মহামানবীকে বিয়ে করার জন্য মহানবীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বনবী (সা) তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। মহানবী বলতেন, ফাতিমার ব্যাপারটি আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। অর্থাৎ ফাতিমার বিয়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে সম্পন্ন হবে।


আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাসূলের কাছে গিয়ে বলেন, ‘যদি ফাতিমাকে আমার সাথে বিয়ে দেন তাহলে মূল্যবান মিশরীয় কাপড় বোঝাই এক হাজারটি উট এবং আরও এক হাজার দিনার তথা এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা মোহরানা হিসাবে প্রদান করব।’ রাসূল (সা.) এ প্রস্তাবে খুব অসন্তুষ্ট হন এবং বলেন, ‘তুমি কি মনে করেছ আমি অর্থ ও সম্পদের গোলাম? তুমি সম্পদ ও অর্থ দিয়ে আমার সাথে বড়াই করতে চাও?’

হযরত ফাতিমার বিয়ে প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর ফেরেশতা আমার কাছে এসে বললেন, আল্লাহ আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং বলেছেন, তিনি আপনার কন্যা ফাতিমাকে আসমানে আলী ইবনে আবি তালিবের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আপনিও তাঁকে জমিনে তাঁর সাথে বিয়ে দিন। বলা হয় ৪০ হাজার ফেরেশতা ছিলেন বেহেশতে অনুষ্ঠিত এই শুভ বিয়ের সাক্ষী।

দ্বিতীয় হিজরিতেই হযরত ফাতিমার সাথে হযরত আলীর বিয়ে হয়। তাঁর বিয়ের বিষয়ে ইতিহাসে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে তাঁর মর্যাদা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) পরবর্তীকালে বলেন, ‘আলীর জন্ম না হলে ফাতিমার সুযোগ্য স্বামী পাওয়া যেত না।’ (হযরত মারইয়ামের কোনো সুযোগ্য স্বামী সৃষ্টি করেননি মহান আল্লাহ। তাই তিনি চিরকুমারীই হয়ে আছেন) 

বিয়ের সময় হযরত ফাতিমার বয়স ছিল মাত্র দশ-এগারো বছর। অথচ ফাতিমার এ বয়সেই রাসূল বলছেন, ‘আলীর জন্ম না হলে ফাতিমার সুযোগ্য স্বামী পাওয়া যেত না।’- এ কথার মধ্যে কত বড় রহস্য লুকিয়ে ছিল তা পরবর্তীকালে প্রকাশ হয়েছে। ইসলামের জন্য হযরত আলী (আ.)-এর ত্যাগ ও অবদান কিংবদন্তীতুল্য অমর ইতিহাস হয়ে আছে। বদর, উহুদ, খন্দক ও খায়বারসহ অন্য অনেক যুদ্ধে তাঁর অতুলনীয় বীরত্বের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। অন্যদিকে তিনিই হলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞানের ভাণ্ডার।

রাসুলে খোদা যখন নবুয়্যত পান, তখন কিশোর আলীই তাঁর প্রতি প্রথম ইমান আনেন। শুধু তাই নয়, নবীজিকে তিনি সবসময় ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। তাঁর বীরত্ব, জ্ঞান গরিমা, ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও সাহসিকতায় রাসুল (সা.) ছিলেন মুগ্ধ। আর সেজন্যই তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমাকে প্রাণপ্রিয় আলীর সাথেই বিয়ে দিয়েছিলেন।

একইভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও হযরত আলীর প্রশান্তির মাধ্যম হযরত ফাতিমার অবদানও অনন্য বা অতুলনীয়। তিনি রাসূলের ওফাতের পর ক্রান্তিকালে মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তাঁর ভূমিকার মাধ্যমে সত্যের আলো প্রজ্বলিত করেই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ দু’টি ভাষণ আমাদের হেদায়াতের পথনির্দেশ করে। তাই এটা স্পষ্ট কেন রাসূল সেই দশ বছরের বালিকা ও বাইশ বছরের যুবক সম্পর্কে এ কথা বলেছিলেন!

হযরত আলী (আ) ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য মহানবীর (সা)  কাছে আসলেও মহানবীর সামনে শ্রদ্ধার কারণে ও লজ্জায় তা বলতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় মহানবী (সা) আঁচ করতে পারেন যে আলী ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছেন। তবুও তিনি বিষয়টা তা-ই কিনা জানতে চাইলে আলী (আ) জানান যে, 'হ্যাঁ, আমি এ উদ্দেশ্যেই এসেছি'।

হযরত ফাতিমা (সা.আ) তাঁর বাবা তথা মহানবীর (সা) পর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ  আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর (আ) সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হবেন- এটাই ছিল স্বাভাবিক। তবুও মহানবী (সা) নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধার আদর্শ তুলে ধরার জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে হযরত ফাতিমার মতামত জানতে চান। চাচাত ভাই আলীকেও তিনি জানান যে ফাতিমার মতামত জেনে আসি। মহানবী প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে বলেন: আমি তোমাকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির স্ত্রী করতে চাই। তোমার কি মত?

[মহানবীর (সা) এ বাণী থেকে বোঝা যায় হযরত আলীর মর্যাদা ছিল হযরত ফাতিমার চেয়েও বেশি। কারণ মহানবীর (সা) পর আলী (আ) হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। অন্যদিকে তিনি বেহেশতি নারীর নেত্রীরও ইমাম বা নেতা।] 

ফাতিমা লজ্জায় মাথা নুইয়ে থাকেন এবং হ্যাঁ ও না-বোধক কিছুই না বলে চুপ করে থাকেন। এ অবস্থায় মহানবী বলেন: আল্লাহু আকবর! তাঁর নীরবতা সম্মতিরই প্রমাণ।
 
তাই এটা স্পষ্ট মেয়েদের বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের মত নেয়া জরুরি। জোর করে কোনো নারীকে কোনো পুরুষের কাছে বিয়ে দেয়া বৈধ নয়। অন্যদিকে ইসলামী আইন অনুযায়ী কোনো কুমারী নারী পিতা বা বৈধ অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া কোনো পুরুষকে বিয়ে করতে পারে না।

দ্বিতীয় হিজরির ১ জিলহাজ্জ রোজ শুক্রবার হযরত আলীর সাথে হযরত ফাতিমার শুভ-বিয়ে সম্পন্ন হয়। এ সময় হযরত আলীর বয়স ছিল প্রায় ২২ অথবা ২৩। এ বিয়ের চুক্তি চূড়ান্ত করেছিলেন মহানবী (সা) নিজেই।  এ বিয়ের অনুষ্ঠানে আনসার ও মুহাজিরদের সবাই উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে মহানবী (সা:) সাহাবীদের বলেছিলেন,আল্লাহর আদেশে আমি ফাতিমার সাথে আলীর বিয়ে দিচ্ছি এবং তাদের বিয়ের মোহরানা ধার্য করেছি চারশ মিসকাল রৌপ্য। এরপর মহানবী (সা.) হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আলী তুমি কি এতে রাজী আছ? হযরত আলী সম্মতি জানিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমি রাজী। তখন নবীজী দু'হাত তুলে তাঁদের জন্য এবং তাঁদের অনাগত বংশধরদের সার্বিক কল্যাণের জন্য দোয়া করেন।
 
বিয়েতে বরের পক্ষ থেকে কনেকে দেনমোহর পরিশোধ করা ফরজ। আর হযরত আলী (আ.) নিজের ঢাল বিক্রি করে তা পরিশোধ করেছিলেন। হযরত আলী তাঁর বর্মটি বিক্রি করে ৫০০ দিরহাম বা রৌপ্য মুদ্রা পেয়েছিলেন। একটি উট, একটি তরবারি ও একটি বর্ম এবং কয়েকটি খেজুরের বাগান ছাড়া হযরত আলীর কাছে আর কোনো সম্পদই ছিল না।

কোনো কোনো হাদিসে বলা হয়, হযরত ফাতিমা (সা. আ) তাঁর বিয়ের একমাত্র মোহরানা হিসেবে বিচার-দিবস তথা কিয়ামতের দিনে তাঁরই বাবার পাপী উম্মতের শাফায়াত তথা তাঁদেরকে ক্ষমা করার অধিকার চেয়েছিলেন। আর মহান আল্লাহ তাঁর এই দাবি কবুল হওয়ার কথা জানিয়ে দেন জিবরাইলের মাধ্যমে।

অথচ আজকাল মুসলমান নর-নারীর বিয়ের মোহরানা নিয়ে কত বাড়াবাড়ি হচ্ছে। মোহরানার অংক বা সম্পদ নিয়ে বস্তুগত প্রতিযোগিতা হচ্ছে!  ভাবখানা এমন যে যার বিয়ের মোহরানা যত বেশি তার মর্যাদা যেন ততই উপরের!

হযরত ফাতিমার বিয়ে উপলক্ষে নব-দম্পতির জন্য যেসব উপহার কেনা হয়েছিল মোহরানার অর্থ দিয়ে সেসব ছিল: একটি আতর, কিছু জামা-কাপড় ও কিছু গৃহস্থালি সামগ্রী। বর্ণনা থেকে জানা যায় যে মোট ১৮টি উপহার কেনা হয়েছিল: এসবের মধ্যে ছিল: চার দিরহাম দামের মাথা ঢাকার একটি বড় রুমাল বা স্কার্ফ। এক দিরহাম দামের একটি পোশাক-সামগ্রী। খেজুর পাতা ও কাঠের তৈরি একটি বিছানা। চারটি বালিশ। বালিশগুলো ছিল আজখার নামক সুগন্ধি ঘাসে ভরা। পশমের তৈরি একটি পর্দা। একটি ম্যাট বা পাপোশ। হাত দিয়ে গম পেশার একটি যাঁতাকল। খাবার পানি রাখার জন্য চামড়ার তৈরি একটি মোশক। তামার তৈরি একটি বেসিন বা হাত ধোয়ার পাত্র। দুম্বা বা উটের দুধ দোহনের জন্য একটি বড় পাত্র। সবুজ রং-করা একটি বড় মাটির পাত্র বা জগ।

ইসলামের দুই মহীয়সী নারী উম্মে আইমান ও উম্মে সালামাহ হযরত ফাতিমাকে খুব ভালবাসতেন। ফাতিমার বিয়ের সময় তাঁরা মহানবীর (সা) কাছে এসে বললেন: হে আল্লাহর সম্মানিত রাসুল! আজ যদি খাদিজা (সা. আ) বেঁচে থাকতেন তাহলে এ বিয়ের আয়োজনে তিনি খুবই খুশি হতেন! তাই নয়কি?

এমন একটি শুভক্ষণে ইসলামের জন্য সর্বস্ব-ত্যাগী ও সর্বপ্রথম মুসলমান বিবি খাদিজার নাম শোনা মাত্রই মহানবীর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। তিনি খাদিজার সব ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মহানুভবতার কথা স্মরণ করতে করতে বললেন: 'খাদিজার মত একজন নারী আর কোথায় পাওয়া যাবে? সেই দিনগুলোতে যখন সবাই আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল সে সময় কেবল খাদিজাই আমাকে সুনিশ্চিতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং তাঁর সব সম্পদ ও জীবন আমার হাতে ছেড়ে দিয়েছিল যাতে আল্লাহর ধর্ম ইসলাম প্রচার করা যায়। খাদিজা হচ্ছে সেই নারী যাকে এই খবর দিতে মহান আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দেন যে, বেহেশতের অতি উচ্চ বা সম্মানজনক স্থানে খাদিজার জন্য মহামূল্য সবুজ পান্নার তৈরি একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হবে।'

এরপর ফাতিমাকে আলীর ঘরে পাঠানোর জন্য অনুমতি চান হযরত উম্মে সালামাহ। এ অবস্থায় মহানবী বললেন, আলী নিজেই কেনো এ প্রস্তাব নিয়ে এল না আমার কাছে? লজ্জার কারণে আলী তা বলতে পারছে না বলে তিনি জানান। এ অবস্থায় মহানবী তাঁকে আসতে বললেন।  আলী (আ) মহানবীর সামনে এসে মাথা নিচু করে রাখলেন। মহানবী তাকে বললেন, তুমি কি তোমার স্ত্রীকে ঘরে নিয়ে যেতে চাও? আলী মাথা নিচু রেখেই বললেন:  জি, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হউক। সে রাত বা তার পরের দিনই এ জন্য ব্যবস্থা করবেন বলে মহানবী জানান।

হযরত আলী জানান এ বিয়ের উৎসবের জন্য বর্ম বিক্রির অর্থ থেকে কিছু অর্থ সংরক্ষণের জন্য আলাদা করে উম্মে সালামাহ'র কাছে দেয়া হয়েছিল। মহানবী (সা) তার  থেকে দশ দিরহাম নিয়ে আমায় বলেন:  কিছু তেল, খেজুর ও 'কাশ্ক' ('কাশ্ক' হচ্ছে দুধ বা দই থেকে তৈরি করা বিশেষ খাদ্য) কিনে আন এই অর্থ দিয়ে। সেসব আনা হলে মহানবী তাঁর জামার হাতাগুলো গুটিয়ে সেগুলো মেশানো শুরু করেন নিজ হাতে। ওই তিন খাদ্যের মিশ্রণে তৈরি হল বিয়ের অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য হালুয়া জাতীয় বিশেষ মিষ্টি খাবার।

খাবার তৈরির পর মহানবী আলীকে বললেন, দাওয়াত দাও যতজনকে তুমি ইচ্ছে করছ! আলী বললেন, আমি মসজিদে গিয়ে দেখলাম সেখানে অনেক সাহাবি সমবেত রয়েছেন। আমি তাদের বললাম: মহানবীর (সা) দাওয়াত কবুল করুন। তারা রওনা দিলেন মহানবীর (সা) দিকে। আমি মহানবীকে (সা) বললাম: মেহমানের সংখ্যা তো বিপুল। তিনি বিশেষ খাবারটি ঢাকলেন একটি শিট দিয়ে এবং বললেন: তাদেরকে আসতে বল একসাথে দশ-দশ জন করে। ফলে দশ জনের এক একটি গ্রুপ এসে খেয়ে বেরিয়ে গেলে দশ জনের অন্য গ্রুপ আসছিল। এভাবে বহু মেহমান এসে খাবার খাওয়া সত্ত্বেও তা যেন মোটেও কমছিল না। সাতশত নারী-পুরুষ মহানবীর (সা) বানানো সেই বরকতময় মিষ্টি খাবার খেয়েছিলেন।

মেহমানরা সবাই চলে গেলে মহানবী (সা) আলীকে ডানে ও ফাতিমাকে নিজের বাম দিকে বসিয়ে তাঁদের জন্য দোয়া করেন। তিনি নিজের মুখ থেকে কিছু লালা বের করে তা ফাতিমা ও আলীর ওপর ছড়িয়ে দেন। এরপর আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বলেন: হে আল্লাহ! তারা আমার থেকে ও আমি তাদের থেকে! হে প্রভু! আপনি যেমন আমার থেকে সব ধরনের অপবিত্রতা ও কদর্যতা দূর করেছেন, তেমনি তাদের কাছ থেকেও সেসব দূর করে তাদের পবিত্র করুন। এরপর বর-কনেকে বললেন: ওঠো এবং ঘরে যাও। তোমাদের ওপর মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।

বলা হয় বিয়ের দিন বা রাতে হযরত ফাতিমার কাছে এসে একজন দরিদ্র ব্যক্তি কিছু সাহায্য চাইলে তিনি তার বিয়ের পোশাক দান করে দেন ওই ব্যক্তির কাছে যাতে তা বিক্রি করে ওই ব্যক্তি কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন। ফলে একটি পুরনো পোশাক পরেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন হযরত ফাতিমা (সা.আ)। 
 
হযরত ফাতিমা ও আলীর বিয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই সাদামাটা। তাই হযরত উম্মে আইমান এসে মহানবীর কাছে দুঃখ করে বললেন, সেদিনও তো আনসারদের এক মেয়ের বিয়ে হল। সে অনুষ্ঠানে কত জাঁকজমক ও আনন্দ-ফুর্তি হল! অথচ বিশ্ববাসীর নেতা মহানবীর মেয়ের বিয়ে কিনা এতো সাদাসিধেভাবে হচ্ছে! এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, এ বিয়ের সাথে পৃথিবীর কোন বিয়ের তুলনাই হয় না। পৃথিবীতে এ বিয়ের কোন জাঁকজমক না হলেও আল্লাহর আদেশে আসমানে এ বিয়ে উপলক্ষে ব্যাপক জাঁকজমক হচ্ছে। বেহেশতকে অপূর্ব সাজে সাজানো হয়েছে। ফেরেশতারা, হুর-গিলমান সবাই আনন্দ করছে। বেহেশতের গাছপালা থেকে মণি-মুক্তা ঝরছে! আর সেগুলো সংগ্রহ করছেন বেহেশতের হুরিরা। কিয়ামত পর্যন্ত তারা সেগুলো সংগ্রহ করতেই থাকবেন যাতে সেগুলোর বিনিময়ে পুরস্কার পাওয়া যায়। একথা শুনে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

বিয়ের পর সাংসারিক কাজের দায়িত্ব ও শ্রম-বিভাগ:

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) আলী ও ফাতিমাকে বলে দিয়েছিলেন যে বাইরের কাজগুলো করবে আলী আর ঘরোয়া (গৃহস্থালী ও মেয়েলি) কাজগুলো করবে ফাতিমা। হযরত ফাতিমা এতে খুশি হয়েছিলেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন, এই শ্রম-বিভাজনের ফলে যেসব কাজ করতে ঘরের বাইরে যেতে হয় ও বার বার পর-পুরুষদের সামনে পড়তে হয় তা থেকে তিনি নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। ইমাম জাফর সাদিক (আ) বলেছেন, হযরত আলী পানি ও জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতেন। অন্যদিকে হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ) আটা পিষতেন ও রুটি বানাতেন।

অবশ্য ইসলাম স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করতে পুরুষকে উৎসাহ দেয় যাতে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। হযরত আলীও অনেক সময় ঘরের কাজে ফাতিমাকে সাহায্য করতেন। 

ইসলাম নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দেয় বলে এ ধর্ম কখনও নারীকে সামাজিক ভূমিকা পালনে বিরত রাখে না। শালীনতা বজায় রেখে ও সংসারের মূল দায়িত্বগুলো পালনের পাশাপাশি নারী সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে পারেন। মহানবীর (সা) ওফাতের পর হযরত ফাতিমাকে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ফাদাকের বাগান থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং খেলাফতের ব্যাপারেও মহানবীর (সা) নির্দেশ অমান্য করা হয় বলে হযরত ফাতিমা মসজিদে নববীতে গিয়ে হযরত আলীর নেতৃত্বের অধিকার সম্পর্কে ভাষণ দিয়েছিলেন। গৃহস্থালী ও সাংসারিক দায়িত্ব ছাড়াও সব ধরনের সামাজিক দায়িত্বও পুরোপুরি পালন করে গেছেন হযরত জাহরা (সা.আ)। তাই  হযরত আলী (আ) বলেছিলেন, 'আল্লাহর শপথ! আমি কখনও ফাতিমাকে অসন্তুষ্ট করিনি অথবা তাকে কোনো কাজ করতে বাধ্য করিনি। অন্যদিকে ফাতিমাও আমাকে কখনও রাগিয়ে দেয়নি বা আমাকে অমান্য করেনি। বস্তুত যখনই আমি তাঁর দিকে তাকাতাম আমার অন্তর থেকে সব বেদনা বা দুঃখ দূর হয়ে যেত।' 

এই মহা-শুভদিন উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি আবারও শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।  

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202