আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ ইমামত নবুওয়াতের নির্বাহী ক্ষমতার ধারাবাহিকতা মহানবী ‎(সা.) ‏নবুয়্যত, ‏রিসালাত এবং ইসলামের আহকাম প্রচার ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছাড়াও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দয়িত্বে ও নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকার্য ও সামরিক নেতৃত্ব ইত্যাদি এ থেকেই উৎকলিত হত। যেমনিকরে ইসলামে ইবাদত ও আচরণগত দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক, ‏অর্থনৈতিক ও অধিকারগত ইত্যাদি কর্তব্যও বিদ্যমান, ‏তেমনি করে ইসলামের নবী ‎(সা.) ‏প্রচার, ‏প্রশিক্ষণ ও ‎(আধ্যাত্মিক) ‏পরিচর্যার দায়িত্ব ছাড়াও মহান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে ঐশী বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সকল প্রকার প্রশাসনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।এটা অনস্বীকার্য যে, ‏যদি কোন দ্বীন বিশ্বের শেষাবধি সকল প্রকার সামাজিক কর্তব্য পালনের দাবি করে তবে এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। অনুরূপ যে সমাজ এ দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, ‏সে সমাজ এ ধরনের কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তব্য থেকে নিরুদ্দিষ্ট থাকবে, ‏যা ইমামত নামে অভিষিক্ত, ‏তাও হতে পারে না।কিন্তু কথা হল মহানবী ‎(সা.) ‏এর তিরোধানের পর, ‏কে এ দায়িত্ব লাভ করবেন? ‏এবং তা কার কাছ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবেন? ‏মহান আল্লাহ্‌ ‏এ মর্যাদা যেরূপে মহানবীকে ‎(সা.) ‏দিয়েছিলেন সেরূপে অন্য কাউকেও কি দিয়েছেন? ‏এ দায়িত্বভার অন্য কারও গ্রহণের কোন বৈধতা রয়েছে কি? ‏নাকি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এ মর্যাদা মহানবী ‎(সা.)-এর জন্যেই নির্ধারিত ছিল এবং অতঃপর মুসলিম জনতাই তাদের ইমাম নির্বাচন করবে ও তাকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্থান দিবে, ‏তা-ও বিধিসম্মত? ‏মানুষের কি এ ধরনের কোন অধিকার আছে? ‏না নেই?আর এটিই হল শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয়। অর্থাৎ একদিকে শিয়াদের বিশ্বাস যে ইমামত হল একটি ঐশী মর্যাদা, ‏যা মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃকই যথোপযুক্ত ও যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা আবশ্যক। আর মহান আল্লাহ্‌, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏এর মাধ্যমে এ কর্মটি সম্পাদন করেছেন এবং আমীরুল মু’মীনিন আলীকে ‎(আ.) ‏তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষনা করেছেন। অতঃপর তাঁরই সন্তানদের মধ্য থেকে পরস্পরায় বারজনকে ইমামতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করছেন। অপরদিকে সুন্নি মাযহাবের বিশ্বাস নবী ‎(সা.)-এর তিরোধানের মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগতের সাথে মানুষের সম্পর্ক কর্তিত হয়ে গেছে এবং মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় পৌঁছেছে। এখন তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে কোরআনকে বুঝতে ও তাদের পথকে চিনে নিতে পারে। তাই তাদের পথপ্রদর্শনের জন্য ঐশী কোন ব্যক্তির আর প্রয়োজন নাই। আর নবী ‎(সা.) ‏এর পর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্বও তাদের উপরই অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি আহলে সুন্নাতের কোন কোন বিজ্ঞজন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ‏যদি কেউ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, ‏তবে তার আনুগত্য করাও অন্যান্যদের জন্যে অপরিহার্য!১ স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, ‏এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী, ‏অত্যাচারী ও প্রতারকদের অপরাধের জন্যে কতটা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের অবক্ষয় ও বিভেদের পথে কতটা সহায়ক হয়েছে!প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ঐশী সস্পর্কহীন ইমামতের বৈধতা দিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর শিয়া মাযহাবের বিশ্বাস, ‏এটিই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সত্য সুন্দর পথ থেকে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুতির মূল কারণ। অনুরূপ শতসহস্র ধরনের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার সূতিকাগারও এখানেই, ‏যেগুলো মহানবী ‎(সা.) ‏এর পরলোক গমনের পর থেকে মুসলমানদের মাঝে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং করবে।অতএব প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই কোন প্রকার অন্ধ অনুকরণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যতিরেকে এ বিষয়টির উপর পরিপূর্ণ গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য।২ আর সেই সাথে সত্য ও সঠিক মাযহাবের শনাক্তকরণের মাধ্যমে এর প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।উল্লেখ্য এ ব্যাপোরে ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রুদের জন্যে সুযোগ করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না যা ইসলামী সমাজে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হবে। আর এ ক্ষতির অংশীদার মুসলমানরাই হবে, ‏যার ফলশ্রুতি মুসলিম সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা বৃদ্ধি ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য সংরক্ষণ যেন, ‏সঠিক ও সত্য মাযহাবের অনুসন্ধান ও শনাক্তকরণের জন্যে, ‏অনুসন্ধান ও গবেষণার সুষ্ঠ পথকে রুদ্ধ না করে ফেলে। আর ইমামতের বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুষ্ঠ পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‏এ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধানের উপর মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে।ইমামতের তাৎপর্যইমামতের আভিধানিক অর্থ হল নেতা, ‏পথপ্রদর্শক এবং যে কেউ কোন জনসমষ্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহন করবে তাকেই ইমাম ‎(امام) ‏বলা হয়ে থাকে ‎-হোক সে সত্য পথের অনুসারী কিংবা মিথ্যা পথের অনুসারী। যেমন: ‏পবিত্র কোরানে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে ‎(ائمة الكفر) ‏অর্থাৎ কাফেরদের নেতারা ‎(সূরা তওবাহ-১২) ‏কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তদনুরূপ মুসুল্লীরা নামাজের জন্যে যার পিছনে সমবেত হয়ে থাকেন, ‏তাকে ‎‘ইমামুল জামা’ত’ ‏নামকরণ করা হয়।কিন্তু কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ইমামত হল ইহ ও পরলৌকিক সকল বিষয়ে ইসলামী সমাজের সর্বময় ও বিস্তৃত নেতৃত্ব প্রদান। ইহলৌকিক শব্দটি ইমামতের পরিসীমার ব্যাপকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা ইসলামী সমাজে ইহলৌকিক বিষয়াদিও দ্বীন ইসলামেরই অন্তর্ভুক্ত।শিয়া মাযহাবের মতে এ ধরনের নেতৃত্ব কেবলমাত্র তখনই বৈধ হবে, ‏যখন তা মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অনুমোদিত হবে। আর প্রকৃতপক্ষে যিনি এ মর্যাদার অধিকারী হবেন, ‏তিনি আহকাম ও ইসলাম পরিচিতির বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত থাকবেন। অনুরূপ তিনি সকল প্রকার গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবেন। বস্তুতঃ পবিত্র ইমাম, ‏একমাত্র নবুয়্যত ও রিসালাত ব্যতীত মহানবীকে ‎(সা.), ‏মহান আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত সকল মর্যাদার অধিকারী হবেন। ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য যেমন নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য, ‏তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়েও তাঁর আদেশ পালন করাও অপরিহার্য।এভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে।দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।তৃতীয়তঃ ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে।তবে মা’সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও ‎(সালামুল্লাহ আলাইহা) ‏মা’সুম ছিলেন, ‏যদিও তিনি ইমামতের অধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম ‎(আ.) ‏ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহ্‌র ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, ‏যদিও আমরা তাঁদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা’সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাঁদেরকে চিনা সম্ভব নয়।একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনাবিশ্বাসগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন না এমন অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে, ‏শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামত প্রসঙ্গে বিরোধ এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে শিয়াদের বিশ্বাস হলঃ মহানবী ‎(সা.) ‘আলী ইবনে আবি তালিবকে’ (আ.) ‏ইসলামী সমাজের পরিচালনার জন্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস যে, ‏এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং রাসূল ‎(সা.) ‏উম্মতকে কোন নেতা মনোনীত করা ছাড়াই ত্যাগ করেছিলেন। আর তাই তাঁর মৃত্যুর পর জনগণ নিজেদের পছন্দ মত প্রথম খলিফাকে নেতা নির্বাচন করেছিল। প্রথম খলিফা যদিও নিজে জনগণ কর্তৃক নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীকে নিজেই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব ছয় সদস্য বিশিষ্ট গোষ্ঠীর নিকট অর্পণ করা হয়েছিল। অপরদিকে চতুর্থ খলিফাও আবার প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন পন্থা ছিল না। ফলে চতুর্থ খলিফার পর যার সামরিক শক্তি অধিক ছিল, ‏সে-ই এ স্থান দখল করেছিল, ‏যেমন: ‏অনৈসলামিক দেশসমূহেও মোটামুটি এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।অন্যকথায়ঃ তারা এ রকম মনে করেন যে, ‏প্রথম ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শীয়াদের বিশ্বাস সেরূপ, ‏যেরূপ আহলে সুন্নাত প্রথম খলিফা কর্তৃক দ্বিতীয় খলিফার নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেন, ‏পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏এর বক্তব্য মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, ‏কিন্তু প্রথম খলিফার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল!কিন্তু প্রশ্ন হল, ‏প্রথম খলিফা এ অধিকার কোথা থেকে পেয়েছিলেন? ‏আল্লাহ্‌র রাসূল ‎(সা.) (আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস মতে) ‏ইসলামের জন্যে কেন তার ‎(প্রথম খলিফা) ‏মত আন্তরিকতা প্রদর্শন করেননি এবং নব গঠিত ইসলামী সমাজকে অভিভাবকহীন অবস্থায় রেখে গেলেন অথচ যুদ্ধের জন্যে মদীনা থেকে অন্যত্র যাওয়ার সময়ও একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এবং যেখানে স্বয়ং তিনিই ‎(এ বিষয়ের উপর) ‏তাঁর উম্মতদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তির সংবাদ দিয়েছিলেন? ‏এছাড়া ও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ‏শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূলতঃ মতবিরোধ সর্বাগ্রে এখানেই যে, ‏ইমামত কি এক ধর্মীয় মর্যাদা, ‏যা ঐশী বিধানের অনুগামী ও আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়? ‏নাকি পার্থিব রাজকীয় বা অন্য কোন পদ মর্যাদা, ‏যা সামাজিক নীতিমালার অনুগামী? ‏শিয়াদের বিশ্বাস যে, ‏স্বয়ং মহানবীও ‎(সা.) ‏নিজ থেকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেননি। বরং মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক আদিষ্ট হয়েই এ কর্ম সম্পাদন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন পবিত্র ইমামগণের নিয়োগদানের সাথে সস্পর্কযুক্ত। আর এ ধরনের ইমামের উপস্থিতিতেই রাসূল ‎(সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী সমাজের অপরিহার্য বিষয়াদির নিশ্চয়তা প্রদান করা যেতে পারে।এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ‏কেন শিয়া মাযহাবের মতে ইমামত ‎‘মূল বিশ্বাসগত’ ‏বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয় ‎-শুধুমাত্র একটি ফিকাহ্‌গত গৌণ বিষয় নয়। আর সেই সাথে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ‏কেন তারা তিনটি শর্ত ‎(ঐশী জ্ঞান, ‏ইসমাত ও আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) ‏বিবেচ্য বলে মনে করেন এবং কেন শিয়া সাধারণের মধ্যে এ ভাবার্থগুলো ঐশী আহকাম, ‏প্রশাসন ও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃত্বের ধারনার সাথে এমনভাবে মিশে আছে, ‏যেন ইমামত শব্দটি এ ভাবার্থগুলোর সবগুলোকেই সমন্বিত করে।এখন শিয়াদের সামগ্রিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, ‏ইমামতের তাৎপর্য ও মর্যাদার আলোকে এর বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা করব।ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তাআমরা জানি খতমে নবুওয়াতের দর্শন হল এই যে, ‏ইসলাম হল পবিত্র, ‏চিরন্তন, ‏সার্বজনীন ও অবিস্মৃত ধর্ম এবং ইসলামের নবী ‎(সা.)-এর পর আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না। নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন, ‏তখনই কেবলমাত্র নবীগণের আবির্ভাবের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে, ‏যখন সর্বশেষ ঐশী শরীয়ত মানব মাযহাবের সকল প্রশ্নের জবাব প্রদানে সক্ষম হবে এবং বিশ্বের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এ শরীয়তের অটুট থাকার নিশ্চয়তা থাকবে।উল্লেখিত নিশ্চয়তা পবিত্র কোরআনে রয়েছে এবং মহান আল্লাহ্‌ ‏স্বয়ং সকল প্রকার বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে প্রিয় গ্রন্থের সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের সকল বিধি-বিধান কোরানের আয়াতের বাহ্যিক যুক্তি থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন: ‏নামাযের রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি এবং আবশ্যকীয় ও অনাবশ্যকীয় এমন অসংখ্য বিধান রয়েছে, ‏যেগুলোকে পবিত্র কোরান থেকে উদঘাটন করা অসম্ভব। সাধারণতঃ পবিত্র কোরানে আহকাম ও কানুন বিশদভাবে বর্ণিত হয়নি। ফলে এগুলোর প্রশিক্ষণ ও সুস্পষ্ট বর্ণনার দায়িত্ব মহানবী ‎(সা.)-এর উপর অর্পণ করা হয়েছে, ‏যাতে তিনি মহান আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত জ্ঞানের ‎(কোরআনের ওহী ব্যতীত) ‏মাধ্যমে ঐগুলোকে মানুষের জন্যে বর্ণনা করেন।৩ আর এভাবে ইসলাম পরিচিতির প্রকৃত উৎস হিসেবে তাঁর সুন্নাহ বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।কিন্তু হযরত ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের প্রচার কর্ম শুরুর পর দশ বছর ধরে নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে ছিলেন, ‏অতঃপর আবি তালিবের উপত্যকায় কয়েক বছরের বন্দীদশা কাটিয়েছেন, ‏মদীনায় হিজরতের পর শত্রুদের সাথে দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ ইত্যাদির মত জীবনের সংকটময় মুহূর্তগুলো সাধারণ মানুষের জন্যে ইসলামের বিভিন্ন আহ‌কাম, ‏বর্ণনার পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। অপর দিকে সাহাবাগণ যা শিখতেন তা সংরক্ষিত থাকারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এমন কি অজু করার প্রক্রিয়া যা তেইশ বছর ধরে সাহাবাদের চোখের সামনে সম্পাদিত হয়েছে তাও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতএব যেখানে এ সুস্পষ্ট বিষয়টি ‎(যা মুসলমানদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বা আছে এবং এর পরিবর্তন ও বিকৃতির মধ্যে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য জড়িত ছিল না) ‏বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, ‏সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ও গোত্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জটিল ও সূক্ষ্ম নিয়মসমূহের বর্ণনার ক্ষেত্রে বিকৃতি ও ভ্রান্তির সম্ভাবনা অবশ্যই অধিকতর।৪এ বিষয়টির আলোকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ‏ইসলাম ধর্ম কেবলমাত্র তখনই এক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে পৃথিবীর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত মানুষের সকল প্রয়োজন ও প্রশ্নের জবাবদানে সক্ষম হবে যখন দ্বীনের মূলভাষ্যে, ‏সমাজের এ সকল কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধিত হবে, ‏যেগুলো মহানবী ‎(সা.)-এর ইন্তেকালের পর সংকট ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আর এ নিশ্চয়তা বিধানের পথ মহানবী ‎(সা.)-এর যোগ্য উত্তরসুরি নির্বাচন ব্যতীত কিছুই নয়। এ উত্তরসুরিকে একদিকে যেমন ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে, ‏যাতে দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন। অপরদিকে তেমনি দৃঢ়রূপে পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে,যাতে কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানী প্ররোচনায় প্রভাবিত না হন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীনের বিকৃতিতে লিপ্ত না হন। অনুরূপ মানব জাতির আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে মহানবী ‎(সা.)-এর দায়িত্ব স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিয়ে, ‏উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে পৌঁছে দিতেও তাঁরা বদ্ধপরিকর। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে সমাজের শাসন, ‏পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা, ‏বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তাঁরা গ্রহণ করে থাকেন।উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ‏নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি কেবলমাত্র তখনই প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে, ‏যখন এমন পবিত্র ইমামগণকে নিয়োগ করা হবে, ‏যাঁরা একমাত্র নবুয়্যত ব্যতীত মহানবী ‎(সা.)-এর সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন।আর এভাবেই একদিকে যেমন সমাজে ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হয়, ‏অপরদিকে তেমনি তাঁদের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্র মর্যাদাও। অনুরূপ মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন এ ধরনের জ্ঞান ও মর্যাদা কাকে দিয়েছেন এবং তিনিই বস্তুতঃ তাঁর বান্দাগণের উপর বিলায়াত ও কর্তৃত্বের অধিকার রাখেন। আর তিনিই এর অধিকার অপেক্ষাকৃত হ্রাসকৃত মাত্রায় উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে প্রদান করতে সক্ষম।এখানে স্মরণযোগ্য যে, ‏আহলে সুন্নাত কোন খলিফার ক্ষেত্রেই উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিকেই স্বীকার করেন না। মহান আল্লাহ্‌ ‏ও রাসূলের ‎(সা.) ‏পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়ার দাবি যেমন তারা তুলেন না, ‏তেমনি খলিফাগণের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রসঙ্গও তুলেন না। বরং মানুষের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দানের ক্ষেত্রে তাদের অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি ও অযোগ্যতার দৃষ্টান্ত তারা তাদের বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহে তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ প্রথম খলিফা প্রসঙ্গে ইবনে কুতাইবা রচিত ‎‘আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ’ ‏গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, ‏তিনি বলেছিলেন:«انّ لي شيطانا يعتريني»‘আমার পশ্চাতে এমন এক শয়তান বিদ্যমান যে আমাকে বিভ্রান্ত করে।’অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‏তিনি প্রথম খলিফার আনুগত্য স্বীকারকে ‎‘فلته’ ‏অর্থাৎ অবিলম্বকর্ম ও অবিবেচনাপূর্ণ কর্ম নামকরণ করেছেন।৫ অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা অসংখ্যবার এ বাক্যটি স্বীয় কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন:«لولاعليّ لهلك عمر»‘যদি আলী না থাকতেন, ‏তবে আমি ওমর ধ্বংস হয়ে যেতাম।’অর্থাৎ যদি আলী ‎(আ.) ‏না থাকতেন তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেতেন।৬ এছাড়া তৃতীয় খলিফা৭ এবং বনি উমাইয়্যা ও বনি আব্বাসের ভুল-ভ্রান্তির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখেনা। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে কেউ ন্যূনতম ধারণা নিলেই এ সম্পর্কে উত্তমরূপে পরিজ্ঞাত হতে পারবেন।একমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ই দ্বাদশ ইমামের ক্ষেত্রে এ শর্তত্রয়ে বিশ্বাসী। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইমামত প্রসঙ্গে তাদের বিশ্বাসের বৈধতা প্রমাণিত হয়। ‎#আল-বাসাইরমূল: ‏আয়াতুল্লাহ্‌ ‏মিসবাহ্‌ ‏ইয়াজদির অমুজেশে আকায়েদ গ্রন্থঅনুবাদ: ‏মোহাম্মাদ মাঈনুদ্দীনসঙ্কলন ও সম্পাদন: ‏আবুল কাসেমতথ্যসূত্র১. ‏আল আহ্‌কামুল সোলতানিয়াহ্‌, ‏লিখেছেন আবু ইয়ালা এবং ‎‘আস সাওয়াদুল আ’যাম’ ‏লিখেছেন আবুল কাশিম সামারক্বান্দি, ‏পৃঃ ৪০-৪২।২. ‏সৌভাগ্যবশতঃ বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ের উপর একাধিক ভাষায় ও একাধিক পদ্ধতিতে শতসহস্র গ্রন্থ রচনা করে সত্যানুসন্ধিৎসুগণের জন্যে গবেষণার পথকে বিস্তৃত করেছেন। উদাহরণতঃ আবাক্বাতুল আনওয়ার, ‏আল গাদির, ‏দালায়িলুস সিদক্ব, ‏গায়াতুল মারাম এবং ইসবাতুল হুদাহ ইত্যাদি গ্রন্থের নাম উল্লেখ যোগ্য।যারা পড়াশুনার যথেষ্ট সুযোগ পান না তারা ‎‘আল মুরাজিয়াত’ ‏নামক একটি বই, ‏যা শিয়া ও সুন্নী দু’জন মনীষীর মধ্যে বিনিময়কৃত পত্রসমূহের সমাহার, ‏তা পড়তে পারেন। সৌভাগ্যবশতঃ বইটি বাংলায় অনুদিত করা হয়েছে।৩. ‏বাকারাঃ ১৫১, ‏আলে-ইমরান-১৬৪, ‏জুমুআ’-২, ‏নাহল ‎-৬৪, ‏৬৪, ‏আহযাব- ‏২১, ‏হাশর ‎-৭।৪. ‏আল্লামা আমিনি ‎(র.) ‏সাতশতজন মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীর নাম তার ‎"আল গাদীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক লক্ষেরও অধিক হাদীসের বর্ণনাকারী রয়েছে ‎(আল গাদীর, ‏খণ্ড-৫ পৃঃ-২০৮)।৫. ‏শারহে নাহজুল বালাগাহ ‎: ‏ইবনে আবিল হাদিদ, ‏খণ্ড- ‏১, ‏পৃষ্ঠা-৮৫ খণ্ড-৪, ‏পৃঃ-২৩১-২৬২, ‏এবং আল গাদীর ‎: ‏খণ্ড ‎-৭, ‏পৃঃ-১০২-১৮০।৬. ‏ইবনে আবদুল বার, ‏আলইসতিয়াব, ‏৩য় খণ্ড, ‏পৃ.১১০৩; ‏শারহে নাহজুল বালাগাহ ‎: ‏খণ্ড ‎-১, ‏পৃঃ-১৪২-১৫৮ ‎, ‏খণ্ড-৩, ‏পৃঃ-৫৭।৭. ‏আল গাদীর ‎: ‏খণ্ড ‎- ‏৬, ‏পৃঃ ‎-৯৩ ও পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো।প্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কি

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ 
ইমামত নবুওয়াতের নির্বাহী ক্ষমতার ধারাবাহিকতা
 

মহানবী (সা.) নবুয়্যত, রিসালাত এবং ইসলামের আহকাম প্রচার ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছাড়াও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দয়িত্বে ও নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকার্য ও সামরিক নেতৃত্ব ইত্যাদি এ থেকেই উৎকলিত হত। যেমনিকরে ইসলামে ইবাদত ও আচরণগত দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অধিকারগত ইত্যাদি কর্তব্যও বিদ্যমান, তেমনি করে ইসলামের নবী (সা.) প্রচার, প্রশিক্ষণ ও (আধ্যাত্মিক) পরিচর্যার দায়িত্ব ছাড়াও মহান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে ঐশী বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সকল প্রকার প্রশাসনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

এটা অনস্বীকার্য যে, যদি কোন দ্বীন বিশ্বের শেষাবধি সকল প্রকার সামাজিক কর্তব্য পালনের দাবি করে তবে এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। অনুরূপ যে সমাজ এ দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সমাজ এ ধরনের কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তব্য থেকে নিরুদ্দিষ্ট থাকবে, যা ইমামত নামে অভিষিক্ত, তাও হতে পারে না।

কিন্তু কথা হল মহানবী (সা.) এর তিরোধানের পর, কে এ দায়িত্ব লাভ করবেন? এবং তা কার কাছ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবেন? মহান আল্লাহ্‌ এ মর্যাদা যেরূপে মহানবীকে (সা.) দিয়েছিলেন সেরূপে অন্য কাউকেও কি দিয়েছেন? এ দায়িত্বভার অন্য কারও গ্রহণের কোন বৈধতা রয়েছে কি? নাকি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এ মর্যাদা মহানবী (সা.)-এর জন্যেই নির্ধারিত ছিল এবং অতঃপর মুসলিম জনতাই তাদের ইমাম নির্বাচন করবে ও তাকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্থান দিবে, তা-ও বিধিসম্মত? মানুষের কি এ ধরনের কোন অধিকার আছে? না নেই?

আর এটিই হল শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয়। অর্থাৎ একদিকে শিয়াদের বিশ্বাস যে ইমামত হল একটি ঐশী মর্যাদা, যা মহান আল্লাহ্‌ কর্তৃকই যথোপযুক্ত ও যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা আবশ্যক। আর মহান আল্লাহ্‌, মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে এ কর্মটি সম্পাদন করেছেন এবং আমীরুল মু’মীনিন আলীকে (আ.) তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষনা করেছেন। অতঃপর তাঁরই সন্তানদের মধ্য থেকে পরস্পরায় বারজনকে ইমামতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করছেন। অপরদিকে সুন্নি মাযহাবের বিশ্বাস নবী (সা.)-এর তিরোধানের মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগতের সাথে মানুষের সম্পর্ক কর্তিত হয়ে গেছে এবং মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় পৌঁছেছে। এখন তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে কোরআনকে বুঝতে ও তাদের পথকে চিনে নিতে পারে। তাই তাদের পথপ্রদর্শনের জন্য ঐশী কোন ব্যক্তির আর প্রয়োজন নাই। আর নবী (সা.) এর পর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্বও তাদের উপরই অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি আহলে সুন্নাতের কোন কোন বিজ্ঞজন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যদি কেউ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তবে তার আনুগত্য করাও অন্যান্যদের জন্যে অপরিহার্য!১ স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী, অত্যাচারী ও প্রতারকদের অপরাধের জন্যে কতটা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের অবক্ষয় ও বিভেদের পথে কতটা সহায়ক হয়েছে!

প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ঐশী সস্পর্কহীন ইমামতের বৈধতা দিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর শিয়া মাযহাবের বিশ্বাস, এটিই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সত্য সুন্দর পথ থেকে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুতির মূল কারণ। অনুরূপ শতসহস্র ধরনের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার সূতিকাগারও এখানেই, যেগুলো মহানবী (সা.) এর পরলোক গমনের পর থেকে মুসলমানদের মাঝে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং করবে।

অতএব প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই কোন প্রকার অন্ধ অনুকরণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যতিরেকে এ বিষয়টির উপর পরিপূর্ণ গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য।২ আর সেই সাথে সত্য ও সঠিক মাযহাবের শনাক্তকরণের মাধ্যমে এর প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।

উল্লেখ্য এ ব্যাপোরে ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রুদের জন্যে সুযোগ করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না যা ইসলামী সমাজে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হবে। আর এ ক্ষতির অংশীদার মুসলমানরাই হবে, যার ফলশ্রুতি মুসলিম সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা বৃদ্ধি ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য সংরক্ষণ যেন, সঠিক ও সত্য মাযহাবের অনুসন্ধান ও শনাক্তকরণের জন্যে, অনুসন্ধান ও গবেষণার সুষ্ঠ পথকে রুদ্ধ না করে ফেলে। আর ইমামতের বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুষ্ঠ পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধানের উপর মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে।

ইমামতের তাৎপর্য

ইমামতের আভিধানিক অর্থ হল নেতা, পথপ্রদর্শক এবং যে কেউ কোন জনসমষ্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহন করবে তাকেই ইমাম (امام) বলা হয়ে থাকে -হোক সে সত্য পথের অনুসারী কিংবা মিথ্যা পথের অনুসারী। যেমন: পবিত্র কোরানে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে (ائمة الكفر) অর্থাৎ কাফেরদের নেতারা (সূরা তওবাহ-১২) কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তদনুরূপ মুসুল্লীরা নামাজের জন্যে যার পিছনে সমবেত হয়ে থাকেন, তাকে ‘ইমামুল জামা’ত’ নামকরণ করা হয়।

কিন্তু কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ইমামত হল ইহ ও পরলৌকিক সকল বিষয়ে ইসলামী সমাজের সর্বময় ও বিস্তৃত নেতৃত্ব প্রদান। ইহলৌকিক শব্দটি ইমামতের পরিসীমার ব্যাপকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা ইসলামী সমাজে ইহলৌকিক বিষয়াদিও দ্বীন ইসলামেরই অন্তর্ভুক্ত।

শিয়া মাযহাবের মতে এ ধরনের নেতৃত্ব কেবলমাত্র তখনই বৈধ হবে, যখন তা মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অনুমোদিত হবে। আর প্রকৃতপক্ষে যিনি এ মর্যাদার অধিকারী হবেন, তিনি আহকাম ও ইসলাম পরিচিতির বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত থাকবেন। অনুরূপ তিনি সকল প্রকার গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবেন। বস্তুতঃ পবিত্র ইমাম, একমাত্র নবুয়্যত ও রিসালাত ব্যতীত মহানবীকে (সা.), মহান আল্লাহ্‌ প্রদত্ত সকল মর্যাদার অধিকারী হবেন। ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য যেমন নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য, তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়েও তাঁর আদেশ পালন করাও অপরিহার্য।

এভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:

প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

তৃতীয়তঃ ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে।

তবে মা’সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও (সালামুল্লাহ আলাইহা) মা’সুম ছিলেন, যদিও তিনি ইমামতের অধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম (আ.) ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহ্‌র ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, যদিও আমরা তাঁদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা’সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ্‌ কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাঁদেরকে চিনা সম্ভব নয়।

একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

বিশ্বাসগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন না এমন অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে, শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামত প্রসঙ্গে বিরোধ এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে শিয়াদের বিশ্বাস হলঃ মহানবী (সা.) ‘আলী ইবনে আবি তালিবকে’ (আ.) ইসলামী সমাজের পরিচালনার জন্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস যে, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং রাসূল (সা.) উম্মতকে কোন নেতা মনোনীত করা ছাড়াই ত্যাগ করেছিলেন। আর তাই তাঁর মৃত্যুর পর জনগণ নিজেদের পছন্দ মত প্রথম খলিফাকে নেতা নির্বাচন করেছিল। প্রথম খলিফা যদিও নিজে জনগণ কর্তৃক নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীকে নিজেই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব ছয় সদস্য বিশিষ্ট গোষ্ঠীর নিকট অর্পণ করা হয়েছিল। অপরদিকে চতুর্থ খলিফাও আবার প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন পন্থা ছিল না। ফলে চতুর্থ খলিফার পর যার সামরিক শক্তি অধিক ছিল, সে-ই এ স্থান দখল করেছিল, যেমন: অনৈসলামিক দেশসমূহেও মোটামুটি এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।

অন্যকথায়ঃ তারা এ রকম মনে করেন যে, প্রথম ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শীয়াদের বিশ্বাস সেরূপ, যেরূপ আহলে সুন্নাত প্রথম খলিফা কর্তৃক দ্বিতীয় খলিফার নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেন, পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, মহানবী (সা.) এর বক্তব্য মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, কিন্তু প্রথম খলিফার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল!

কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রথম খলিফা এ অধিকার কোথা থেকে পেয়েছিলেন? আল্লাহ্‌র রাসূল (সা.) (আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস মতে) ইসলামের জন্যে কেন তার (প্রথম খলিফা) মত আন্তরিকতা প্রদর্শন করেননি এবং নব গঠিত ইসলামী সমাজকে অভিভাবকহীন অবস্থায় রেখে গেলেন অথচ যুদ্ধের জন্যে মদীনা থেকে অন্যত্র যাওয়ার সময়ও একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এবং যেখানে স্বয়ং তিনিই (এ বিষয়ের উপর) তাঁর উম্মতদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তির সংবাদ দিয়েছিলেন? এছাড়া ও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূলতঃ মতবিরোধ সর্বাগ্রে এখানেই যে, ইমামত কি এক ধর্মীয় মর্যাদা, যা ঐশী বিধানের অনুগামী ও আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়? নাকি পার্থিব রাজকীয় বা অন্য কোন পদ মর্যাদা, যা সামাজিক নীতিমালার অনুগামী? শিয়াদের বিশ্বাস যে, স্বয়ং মহানবীও (সা.) নিজ থেকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেননি। বরং মহান আল্লাহ্‌ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েই এ কর্ম সম্পাদন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন পবিত্র ইমামগণের নিয়োগদানের সাথে সস্পর্কযুক্ত। আর এ ধরনের ইমামের উপস্থিতিতেই রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী সমাজের অপরিহার্য বিষয়াদির নিশ্চয়তা প্রদান করা যেতে পারে।

এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কেন শিয়া মাযহাবের মতে ইমামত ‘মূল বিশ্বাসগত’ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয় -শুধুমাত্র একটি ফিকাহ্‌গত গৌণ বিষয় নয়। আর সেই সাথে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কেন তারা তিনটি শর্ত (ঐশী জ্ঞান, ইসমাত ও আল্লাহ্‌ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) বিবেচ্য বলে মনে করেন এবং কেন শিয়া সাধারণের মধ্যে এ ভাবার্থগুলো ঐশী আহকাম, প্রশাসন ও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃত্বের ধারনার সাথে এমনভাবে মিশে আছে, যেন ইমামত শব্দটি এ ভাবার্থগুলোর সবগুলোকেই সমন্বিত করে।

এখন শিয়াদের সামগ্রিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, ইমামতের তাৎপর্য ও মর্যাদার আলোকে এর বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা

আমরা জানি খতমে নবুওয়াতের দর্শন হল এই যে, ইসলাম হল পবিত্র, চিরন্তন, সার্বজনীন ও অবিস্মৃত ধর্ম এবং ইসলামের নবী (সা.)-এর পর আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না। নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন, তখনই কেবলমাত্র নবীগণের আবির্ভাবের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে, যখন সর্বশেষ ঐশী শরীয়ত মানব মাযহাবের সকল প্রশ্নের জবাব প্রদানে সক্ষম হবে এবং বিশ্বের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এ শরীয়তের অটুট থাকার নিশ্চয়তা থাকবে।

উল্লেখিত নিশ্চয়তা পবিত্র কোরআনে রয়েছে এবং মহান আল্লাহ্‌ স্বয়ং সকল প্রকার বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে প্রিয় গ্রন্থের সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের সকল বিধি-বিধান কোরানের আয়াতের বাহ্যিক যুক্তি থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন: নামাযের রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি এবং আবশ্যকীয় ও অনাবশ্যকীয় এমন অসংখ্য বিধান রয়েছে, যেগুলোকে পবিত্র কোরান থেকে উদঘাটন করা অসম্ভব। সাধারণতঃ পবিত্র কোরানে আহকাম ও কানুন বিশদভাবে বর্ণিত হয়নি। ফলে এগুলোর প্রশিক্ষণ ও সুস্পষ্ট বর্ণনার দায়িত্ব মহানবী (সা.)-এর উপর অর্পণ করা হয়েছে, যাতে তিনি মহান আল্লাহ্‌ প্রদত্ত জ্ঞানের (কোরআনের ওহী ব্যতীত) মাধ্যমে ঐগুলোকে মানুষের জন্যে বর্ণনা করেন।৩ আর এভাবে ইসলাম পরিচিতির প্রকৃত উৎস হিসেবে তাঁর সুন্নাহ বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিন্তু হযরত (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রচার কর্ম শুরুর পর দশ বছর ধরে নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে ছিলেন, অতঃপর আবি তালিবের উপত্যকায় কয়েক বছরের বন্দীদশা কাটিয়েছেন, মদীনায় হিজরতের পর শত্রুদের সাথে দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ ইত্যাদির মত জীবনের সংকটময় মুহূর্তগুলো সাধারণ মানুষের জন্যে ইসলামের বিভিন্ন আহ‌কাম, বর্ণনার পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। অপর দিকে সাহাবাগণ যা শিখতেন তা সংরক্ষিত থাকারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এমন কি অজু করার প্রক্রিয়া যা তেইশ বছর ধরে সাহাবাদের চোখের সামনে সম্পাদিত হয়েছে তাও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতএব যেখানে এ সুস্পষ্ট বিষয়টি (যা মুসলমানদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বা আছে এবং এর পরিবর্তন ও বিকৃতির মধ্যে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য জড়িত ছিল না) বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ও গোত্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জটিল ও সূক্ষ্ম নিয়মসমূহের বর্ণনার ক্ষেত্রে বিকৃতি ও ভ্রান্তির সম্ভাবনা অবশ্যই অধিকতর।৪

এ বিষয়টির আলোকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলাম ধর্ম কেবলমাত্র তখনই এক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে পৃথিবীর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত মানুষের সকল প্রয়োজন ও প্রশ্নের জবাবদানে সক্ষম হবে যখন দ্বীনের মূলভাষ্যে, সমাজের এ সকল কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধিত হবে, যেগুলো মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর সংকট ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আর এ নিশ্চয়তা বিধানের পথ মহানবী (সা.)-এর যোগ্য উত্তরসুরি নির্বাচন ব্যতীত কিছুই নয়। এ উত্তরসুরিকে একদিকে যেমন ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে, যাতে দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন। অপরদিকে তেমনি দৃঢ়রূপে পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে,যাতে কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানী প্ররোচনায় প্রভাবিত না হন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীনের বিকৃতিতে লিপ্ত না হন। অনুরূপ মানব জাতির আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর দায়িত্ব স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিয়ে, উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে পৌঁছে দিতেও তাঁরা বদ্ধপরিকর। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে সমাজের শাসন, পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তাঁরা গ্রহণ করে থাকেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি কেবলমাত্র তখনই প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে, যখন এমন পবিত্র ইমামগণকে নিয়োগ করা হবে, যাঁরা একমাত্র নবুয়্যত ব্যতীত মহানবী (সা.)-এর সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন।

আর এভাবেই একদিকে যেমন সমাজে ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হয়, অপরদিকে তেমনি তাঁদের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্র মর্যাদাও। অনুরূপ মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন এ ধরনের জ্ঞান ও মর্যাদা কাকে দিয়েছেন এবং তিনিই বস্তুতঃ তাঁর বান্দাগণের উপর বিলায়াত ও কর্তৃত্বের অধিকার রাখেন। আর তিনিই এর অধিকার অপেক্ষাকৃত হ্রাসকৃত মাত্রায় উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে প্রদান করতে সক্ষম।

এখানে স্মরণযোগ্য যে, আহলে সুন্নাত কোন খলিফার ক্ষেত্রেই উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিকেই স্বীকার করেন না। মহান আল্লাহ্‌ ও রাসূলের (সা.) পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়ার দাবি যেমন তারা তুলেন না, তেমনি খলিফাগণের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রসঙ্গও তুলেন না। বরং মানুষের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দানের ক্ষেত্রে তাদের অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি ও অযোগ্যতার দৃষ্টান্ত তারা তাদের বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহে তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ প্রথম খলিফা প্রসঙ্গে ইবনে কুতাইবা রচিত ‘আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, তিনি বলেছিলেন:

«انّ لي شيطانا يعتريني»

‘আমার পশ্চাতে এমন এক শয়তান বিদ্যমান যে আমাকে বিভ্রান্ত করে।’

অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তিনি প্রথম খলিফার আনুগত্য স্বীকারকে ‘فلته’  অর্থাৎ অবিলম্বকর্ম ও অবিবেচনাপূর্ণ কর্ম নামকরণ করেছেন।৫ অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা অসংখ্যবার এ বাক্যটি স্বীয় কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন:

«لولاعليّ لهلك عمر»

‘যদি আলী না থাকতেন, তবে আমি ওমর ধ্বংস হয়ে যেতাম।’

অর্থাৎ যদি আলী (আ.) না থাকতেন তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেতেন।৬ এছাড়া তৃতীয় খলিফা৭ এবং বনি উমাইয়্যা ও বনি আব্বাসের ভুল-ভ্রান্তির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখেনা। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে কেউ ন্যূনতম ধারণা নিলেই এ সম্পর্কে উত্তমরূপে পরিজ্ঞাত হতে পারবেন।

একমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ই দ্বাদশ ইমামের ক্ষেত্রে এ শর্তত্রয়ে বিশ্বাসী। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইমামত প্রসঙ্গে তাদের বিশ্বাসের বৈধতা প্রমাণিত হয়। #আল-বাসাইর

মূল: আয়াতুল্লাহ্‌ মিসবাহ্‌ ইয়াজদির অমুজেশে আকায়েদ গ্রন্থ

অনুবাদ: মোহাম্মাদ মাঈনুদ্দীন

সঙ্কলন ও সম্পাদন: আবুল কাসেম

তথ্যসূত্র

১. আল আহ্‌কামুল সোলতানিয়াহ্‌, লিখেছেন আবু ইয়ালা এবং ‘আস সাওয়াদুল আ’যাম’ লিখেছেন আবুল কাশিম সামারক্বান্দি, পৃঃ ৪০-৪২।

২. সৌভাগ্যবশতঃ বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ের উপর একাধিক ভাষায় ও একাধিক পদ্ধতিতে শতসহস্র গ্রন্থ রচনা করে সত্যানুসন্ধিৎসুগণের জন্যে গবেষণার পথকে বিস্তৃত করেছেন। উদাহরণতঃ আবাক্বাতুল আনওয়ার, আল গাদির, দালায়িলুস সিদক্ব, গায়াতুল মারাম এবং ইসবাতুল হুদাহ ইত্যাদি গ্রন্থের নাম উল্লেখ যোগ্য।

যারা পড়াশুনার যথেষ্ট সুযোগ পান না তারা ‘আল মুরাজিয়াত’ নামক একটি বই, যা শিয়া ও সুন্নী দু’জন মনীষীর মধ্যে বিনিময়কৃত পত্রসমূহের সমাহার, তা পড়তে পারেন। সৌভাগ্যবশতঃ বইটি বাংলায় অনুদিত করা হয়েছে।

৩. বাকারাঃ ১৫১, আলে-ইমরান-১৬৪, জুমুআ’-২, নাহল -৬৪, ৬৪, আহযাব- ২১, হাশর -৭।

৪. আল্লামা আমিনি (র.) সাতশতজন মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীর নাম তার "আল গাদীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক লক্ষেরও অধিক হাদীসের বর্ণনাকারী রয়েছে (আল গাদীর, খণ্ড-৫ পৃঃ-২০৮)।

৫. শারহে নাহজুল বালাগাহ : ইবনে আবিল হাদিদ, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা-৮৫ খণ্ড-৪, পৃঃ-২৩১-২৬২, এবং আল গাদীর : খণ্ড -৭, পৃঃ-১০২-১৮০।

৬. ইবনে আবদুল বার, আলইসতিয়াব, ৩য় খণ্ড, পৃ.১১০৩; শারহে নাহজুল বালাগাহ : খণ্ড -১, পৃঃ-১৪২-১৫৮ , খণ্ড-৩, পৃঃ-৫৭।

৭. আল গাদীর : খণ্ড - ৬, পৃঃ -৯৩ ও পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো।

প্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কি

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202