হাদীসে সাকালাইন ও এর সাথে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হাদীসসমূহের পর্যালোচনাহাদীসে সাকালাইনের অর্থঅনেক হাদীস থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে,গাদীরে খুমে একটি ভাষণের মধ্যেই মহানবী (সা.) হাদীসে সাকালাইন ও হাদীসে গাদীরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব হাদীসের কয়েকটি মুত্তাকী আল-হিন্দী তাঁর ‘কানজুল উম্মাল’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ১৬৭),ইবনে কাসির তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে (৫ম খণ্ড,পৃ. ২০৯),আস সাখাভী তাঁর ‘আল-ইসতিজলাব’ গ্রন্থে,আল সামহুদী তাঁর ‘জাওয়াহির আল ইকদাইন’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তাঁর ‘সাওয়ায়েক’ গ্রন্থে তাবারানী ও অন্যদের থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন।কতিপয় হাদীসে ‘খালিফাতাইন’ (উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি) শব্দটি সাকালাইন শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ করা হয়েছে,যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁর মুসনাদে (৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮১) উল্লেখ করেছেন। আবার তাবারানী,ইবনে আবি আসিম,আবু বকর ইবনে আবি শায়বাহ,আল-যারকানী এবং অন্যরাও উল্লেখ করেছেন। এই শব্দ ইমাম আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের নেতৃত্ব ও খেলাফতের বিষয়টিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ করে।এ হাদীসের কতিপয় বর্ণনা,যেমন কুন্দুজী তাঁর ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহতে হাসান ইবনে আলী (আ.) থেকে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাতে নবী (সা.)-এর বাণী রয়েছে যা ইমামতের চিরস্থায়িত্বের বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে :‘হে আল্লাহ! তুমি দুনিয়াকে সৃষ্টির ওপর তোমার হুজ্জাত থেকে খালি রেখ না যাতে তোমার হুজ্জাত বাতিল হয়ে যায় অথবা তুমি তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার পর তোমার বন্ধুরা বিপথে যেতে না পারে। তারা (আল্লাহর হুজ্জাত) সংখ্যায় অল্প,কিন্তু সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহর নৈকট্যশীল। নিশ্চয়ই আমি প্রশংসিত ও মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমার বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বংশধরদের বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বীজের মধ্যে এবং আমার বীজের বীজের মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দেওয়ার। আর আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে।’এটি নাহজুল বালাগায় বর্ণিত (হিকাম : ১৪৭) আলী (আ.) কর্তৃক তাঁর শিষ্য কুমাইল ইবনে যিয়াদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ :...হ্যাঁ,পৃথিবী কখনও এমন লোকশূন্য হয়ে যায় না যারা গোপনে বা প্রকাশ্যে আল্লাহর ওপর রক্ষা করে এবং তারা সব সময় শংকিত থাকে যে,আল্লাহর গুপ্ত ওজর ও প্রমাণ যেন অপ্রমাণিত না হয়। তাদের সংখ্যা কত,আর তারা কোথায়? আল্লাহর কসম,তাদের সংখ্যা কম,কিন্তু আল্লাহর নিকট তাদের সম্মান অনেক বেশি। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর ওজর ও প্রমাণ রক্ষা করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের মতো অপর কাউকে বিশ্বাস না করে এবং তাদের মতো অন্য কারও হৃদয়ে আস্থার বীজ বপন না করে।জ্ঞান তাদেরকে সত্যিকার বোধগম্যতার দিকে চালিত করে এবং এ কারণে তারা দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন আত্মার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। অন্যেরা যেটাকে কঠিন বলে মনে করে তা তারা সহজ বলে মনে করে। অজ্ঞরা যা বিস্ময়কর মনে করে,তারা তা সাদরে গ্রহণ করে। তারা এ পৃথিবীতে দেহ নিয়ে বসবাস করে,কিন্তু তাদের আত্মা অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। আল্লাহর জমিনে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তাঁর দীনের প্রতি আহ্বানকারী। আহা! তাদেরকে দেখার জন্য আমার আকুল আগ্রহ!হযরত আলীর এ বক্তব্য অনেক হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিক তাঁদের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইবনে আব্দ রাব্বিহ তাঁর ‘আল ইকদুল ফারীদ’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ২৬৫,২৯৩);ইয়াকুবী তাঁর ‘তারিখ’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ৪০০);আল হাররানী তাঁর ‘তুহাফুল উকূল’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬৯);আল খাতীব আল বাগদাদী তাঁর ‘তারীখে বাগদাদ’ গ্রন্থে (৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ৩৮৯);আল রাযী তাঁর ‘তাফসীরে কাবীর’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২);ইবনে আবদুল বার তাঁর ‘আল মুখতাসার’ গ্রন্থে (পৃ. ২৯) এ রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হওয়া কতিপয় হাদীস ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী একটি গ্রন্থে (তোহফায়ে ইসনা আশারা) হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করে হাদীসে সাকালাইনের ঘোষিত আহলে বাইতের নেতৃত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। আমরা এখানে সেই হাদীসগুলো উল্লেখ করে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করব।প্রথম হাদীসশাহ আবদুল আযীয তাঁর তুহ্ফা গ্রন্থে বলেন,যদি হাদীসে সাকালাইন গ্রহণ করা হয়েও থাকে,তবু তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অপর কয়েকটি হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব হাদীসের মধ্য থেকে তিনি নিম্নোল্লিখিত হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেন :‘আমার সুন্নাহ অনুসরণ কর এবং আমার পর সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারীদের (খোলাফায়ে রাশেদীনের) অনুসরণ কর,তা আঁকড়ে ধর এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন (আবাকাত আল আনওয়ার গ্রন্থের প্রণেতা) বলেন যে,এমন হাদীস সহীহ নয়।প্রথমত,তিনি বলেন,এ হাদীসটি কেবল সুন্নীদের দ্বারা বর্ণনাকৃত। অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন সুন্নীদের পাশাপাশি আহলে বাইতের মাযহাবের আলেমগণও বর্ণনা করেছেন।দ্বিতীয়ত শাহ আবদুল আযীয এখানে তাঁর স্বঘোষিত নীতি ওপর বহাল থাকেননি যে,আহলে বাইতের মতবাদের বিপক্ষে তাঁর যুক্তি তাদের দ্বারা গ্রহণীয় লেখনীর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হবে।তৃতীয়ত হাদীসটি মুসলিম ও বুখারী লিপিবদ্ধ করেননি-হাদীসের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত যাঁদেরকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করে থাকে।চতুর্থত,উপরিউক্ত হাদীসের সহীহ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। কারণ,সুন্নী আলেমগণের দ্বারাই এ হাদীসের সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।এ হাদীসের ওপর পর্যালোচনাএ হাদীসটি আবু দাউদ,তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে। আবু দাউদের রাবীদের সম্পর্কিত আলোচনা :আল-আরবাদ ইবনে সারিআহ-তিনি এ হাদীসের অন্যতম রাবী (বর্ণনাকারী)। তিনি নির্ভরযোগ্য নন। কারণ,তিনি নিজের সম্বন্ধেই এমন উক্তি করেছেন যে,‘আমি ইসলামের এক-চতুর্থাংশ।’হাজার ইবনে হাজার আল কিলাই-সিরিয়ার একটি শহরে বসবাস করত যে শহরের অধিবাসীরা আলী (আ.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। ইবনে হাজার তাঁর তাহযীব আত তাহযীবে তাঁর অবস্থা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। (৩য় খণ্ড,পৃ. ১১৮)খালিদ ইবনে মাদান ইবনে আবি কারিব আল কিতাবী-সে ছিল ইসলামের ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়ার পুলিশ বাহিনীর প্রধান।সাওর ইবনে ইয়াযীদ-ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে,সে আলী (আ.)-কে ঘৃণা করত। কারণ,তিনি এক যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন এবং তাঁকে একজন গোঁড়া মনে করতেন।পরবর্তী রাবী হলো আল ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম। আবু মুসহার কর্তৃক জালকরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে,যা মিযানুল ইতিদালে যাহাবী উল্লেখ করেছেন (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৪৭) ।অন্যদিকে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ যেসব রাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন,যেমন আবু আসিম,হাসান ইবনে আলী আল-খাল্লাল,বুহাইর ইবনে সা’দ,বাকীয়াহ ইবনে আল-ওয়ালীদ,ইয়াহইয়া ইবনে আবি আল-মুতী,আবদুল্লাহ ইবনে আলা’,মু‘আবিয়া ইবনে সালিহ,ইসমাঈল ইবনে বিশর ইবনে মানসূর এবং আবুল মালিক ইবনে আল-সাব্বাহ-তাঁরা সকলেই দুর্বল রাবী। আহলে সুন্নাতের রেজালশাস্ত্রবিদগণ তাঁদের সকলকেই দুর্বল রাবী হিসাবে অভিহিত করেছেন।উপরন্তু যদি এ হাদীসটি সহীহ বলে ধরেও নিই,তবু তা হাদীসে সাকালাইনের বিপক্ষে কোন গুরুত্ব রাখে না। কারণ,হাদীসে সাকালাইন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিপুল সংখ্যক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে,অন্যদিকে সুন্নী পণ্ডিতদের বিপুল সংখ্যক তাঁদের হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করেননি। যদি এ হাদীসটি সত্যিই নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে,তবে ‘সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারী’ শব্দগুলো আহলে বাইতের বারো ইমামের ওপর আরোপ করা যায়-যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সমর্থিত হতে পারে। আর সেই হাদীসটি হল ‘আমার পরে বারো জন খলীফা বা ইমাম আসবে।’শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত আরেকটি প্রশ্নের জবাব দানআবদুল আযীয বলেছেন,যদি হাদীসে সাকালাইন পূর্বোক্ত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নাও হয়,তবুও ‘ইতরাত’ শব্দ সাধারণভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গোত্র বনি হাশিমের সকল আত্মীয় অথবা হযরত ফাতিমার সকল বংশধরের ওপর আরোপ করা যায়। তাহলে এটি বলা অবান্তর যে,তাঁদের সকলেই হলেন ইমাম।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এ সন্দেহ সম্পর্কে নানা অভিধান রচয়িতার অর্থ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন,যেমন জাওহারী,ইবনে আসির,ইবনে মানযুর,আল ফিরূযাবাদী এবং অন্যরা। তাঁদের মতে ‘ইতরাত’ বলতে বুঝায় কারও নিকটতম আত্মীয় (আখাস আকরাবীন),সন্তানাদি (ওয়ালাদ) এবং বংশধর (যুররিয়াহ)।উপরন্তু তিনি উল্লেখ করেন,হাদীসে সাকালাইন তাঁদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাধান্যের পাশাপাশি তাঁদের পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিও নির্দেশ করে। এমন বর্ণনা নিঃসন্দেহে কেবল বারো ইমামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,আলী (আ.) যাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ‘ইতরাত’ বলে পরিচিত করিয়েছেন এবং কুরআনের ব্যাপারে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন।দ্বিতীয় হাদীসশাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত দ্বিতীয় হাদীসটি হলো :‘ধর্মের বিষয়াদি তোমরা এই হুমায়রার (আয়েশা) নিকট থেকে গ্রহণ কর।’তিনি এ হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেছেন।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,সুন্নী পণ্ডিতগণই এ হাদীসকে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন :১. আল-মিযযী এবং যাহাবী (আল-তাকরীর ওয়াল তাহবীর ফি শাহর আল-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।২. ইবনুল কাইয়্যেম জাওযীয়াহ,যেসব হাদীস ‘হে হুমায়রা’ এবং ‘আল-হুমায়রা’ শব্দযোগে এসেছে সেসব হাদীসকে তিনি জাল বলে গণ্য করেছেন।৩. ইবনে কাসির,(আল-দুরুর আল-মুনতাশিরাহ ফি আল-আহাদীস আল-মুশতাহিরাহ,পৃ. ৭৯)।৪. ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(আল-তাকরীর ওয়া আল-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।৫. তাঁদের পাশাপাশি ইবনুল মুলাক্কিন,আস সুবকি,ইবনে আমির আল-হাজ,আল-সাখাভী,আল-সুয়ূতী,আল-শায়বানী,আল-শেখ আলী আল-কারী,আল-যারকানী,আবদুল আলী আল-শাওকানী এবং অন্যরাও এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তৃতীয় হাদীসশাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে এনেছেন। আর তা হলো :‘আম্মারের নিকট থেকে পথনির্দেশনা চাও।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন হাদীস কখনই হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উত্থাপন করা যায় না। কারণ,হযরত আম্মার নিজেই হযরত আলী (আ.)-এর একনিষ্ঠ শিয়া (অনুসারী) ছিলেন এবং মহানবী (সা.) তাঁকে হযরত আলীকে মেনে চলা ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে :‘হে আম্মার! আলী তোমাকে সত্যপথ হতে বিচ্যুত করবে না। হে আম্মার! আলীর আনুগত্য আমার আনুগত্য,আর আমার আনুগত্যই হল সর্বশক্তিমান ও প্রশংসিত আল্লাহর আনুগত্য।’এ হাদীসটি বেশ কয়েকটি সুন্নী হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ফারায়েদুস সিমতাইন,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭৮;আল মাওয়াদ্দাহ ফিল কুরবা;আল খারাযমীর মানাকিব,পৃ. ৫৭ ও ১২৪;ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ১২৮ ও ২৫০;মিফতাহ আন-নাযা এবং কানজুল উম্মাল,১২তম খণ্ড,পৃ. ২১২।উপরন্তু এ বিষয়টি অদ্ভুত যে,শাহ আবদুল আযীয এ হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উপস্থাপন করেছেন,যেখানে ঐতিহাসিক ইয়াকুবী তাঁর তারিখে (২য় খণ্ড,পৃ. ১১৪) এবং মাসউদী তাঁর মুরুযুয যাহাব (২য় খণ্ড,পৃ. ৩৪২) গ্রন্থে আম্মারকে তাঁদের মধ্যে গণ্য করেছেন যাঁরা প্রথম খলীফার আনুগত্য করা থেকে দূরে ছিলেন। হযরত উমর তাঁর খেলাফতকালে আম্মারের দিকনির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং কর্কশ কণ্ঠে তাঁর সাথে কথা বলেছিলেন যখন তিনি ওযূর জন্য পানি না পেলে নামায ছেড়ে না দিয়ে তায়াম্মুম করার মাধ্যমে পবিত্র হবার বিষয়টি তাঁর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। এ ঘটনাটি নিম্নের হাদীস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : মুসনাদে আহমাদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৫;সহীহ মুসলিম,১ম খণ্ড,পৃ. ১১০;আবু দাউদ,নাসাঈ,তাবারী,আল-আঈনী,ইবনে আসির এবং আল-শায়বানীও এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন।হযরত উসমান তাঁর খেলাফতকালে আম্মারকে ততক্ষণ প্রহার করেন যতক্ষণ না আম্মার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ঘটনাটি তখন ঘটে যখন তিনি হযরত উসমানের শাসনামলের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে মুসলমানদের প্রতিবাদলিপি তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। এ ঘটনাটি নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : ইবনে কুতাইবার আল-ইমামাহ্ ওয়াল সিয়াসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ৩২;ইবনে আবদ রাব্বিহের আল-ইকদুল ফারীদ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২;মাসউদীর মুরুযুয যাহাব,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৩৮;ইবনে আবদুল বারের আল-ইসতিয়াব,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬;ইয়াকুবীর তারিখ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৬০।যদিও রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আম্মার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছিলেন,যেমন ‘আম্মারের শত্রু আল্লাহর শত্রু’,তারপরও রাসূলের কতিপয় সাহাবী কর্তৃক তিনি প্রতিরোধের মুখে পড়েন,তাঁরা তাঁকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করতেন,যেমন আবদুর রহমান ইবনে আওফ,সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,মুগীরাহ ইবনে শোবা,আবু মূসা আশআরী,আবু মাসউদ আল-আনসারী এবং অন্যরা। আম্মার দৃঢ়ভাবে আলীর পক্ষে এবং আলীর বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে দাঁড়ান। যেমন তিনি তালহা,যুবায়েরের বিপক্ষে জামাল যুদ্ধে এবং মু‘আবিয়ার বিপক্ষে সিফ্ফীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরিশেষে তিনি মু‘আবিয়ার সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হয় যে,‘আম্মার একদল বিদ্রোহী (আল-ফিআত আল-বাগিয়াহ) কর্তৃক নিহত হবে।’ চতুর্থ হাদীসসাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন আরও কয়েকটি হাদীসের ওপর আলোচনা করেন যা আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছে। যেমন :‘ইবনে উম্মে আবদ (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ) এর সিদ্ধান্তের ওপর কর্ম সম্পাদন কর।’ অথবা ‘ইবনে উম্মে আবদ এর অভিমতই তোমাদের জন্য আমার অভিমত।’এ দু’টি হাদীসই দুর্বল (যাইফ) এবং খবরে আহাদ,যেখানে হাদীসে সাকালাইন হলো মুতাওয়াতির। মুসলিম ও বুখারী উভয়েই যেহেতু এটি তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেননি,তাই বলা যায় তাঁরা এগুলোর সনদকে দুর্বল মনে করেছেন।উপরন্তু যদি এগুলো সত্য বলে ধরে নেয়া হয় তুবও সেগুলো হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ,এগুলো কেবল ইবনে মাসউদের প্রতিভাকে বর্ণনা করে,অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁদের নেতৃত্বের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।উপরন্তু শাহ আবদুল আযীযের ক্ষেত্রে এখানে দ্বিমুখিতা লক্ষ্যণীয় যে,তিনি এ হাদীসগুলোকে উপস্থাপন করেছেন,অথচ ইবনে মাসউদের কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে হযরত উমর তাঁকে ফতোয়া দিতে নিষেধ করেছিলেন,রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর মদীনা ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এ অবস্থা হযরত উমরের ইন্তেকাল পর্যন্ত বহাল ছিল। হযরত উসমান আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ইবনে মাসউদকে এতটা নির্দয়ভাবে প্রহার করেছিলেন যে,তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। পঞ্চম হাদীসশাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন :‘মু‘আয ইবনে জাবাল হারাম ও হালাল সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এটি কেবল সুন্নীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারী এ হাদীসকে পরিহার করেছেন। সুন্নী পণ্ডিতদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়াহ,ইবনে আবদুল হাদী,যাহাবী,মানাভী প্রমুখ এ হাদীসকে দুর্বল মনে করেছেন বা ভিত্তিহীন বলেছেন।এ হাদীসের রাবীদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহমান আল-বাইলামানী,তাঁর পিতা,যায়েদ আল-আম্মি,সালিম ইবনে সালিম হাদীস ও রিযালশাস্ত্রের আলেমগণ কর্তৃক অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছেন। যেমন : বুখারী,নাসাঈ,আল-মাকদিসী,দারে কুতনী,ইবনে হাজার,আল-যাহাবী,ইবনুল জাওযী এবং অন্যরা অবিশ্বস্ত বলেছেন।উপরন্তু তাবাকাতে ইবনে সা’দ (৩য় খণ্ড,পৃ. ৫৮৫) এবং ইবনে আবদুল বারের আল-ইস্তিআবে (৩য় খণ্ড,পৃ. ১৪০৪) এমন কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যাতে বোঝা যায় যে,উপরিউক্ত হাদীসে তাঁর জন্য যে যোগ্যতা দাবি করা হয় তিনি সে রকম যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন না। ষষ্ঠ হাদীসশাহ আবদুল আযীয রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস এনেছেন যেটার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকারের দাবি করেছেন যা তাওয়াতুরের কাছাকাছি :‘আমার পরে যারা আসবে তাদের অনুসরণ কর,আবু বকর ও উমর।’হামিদ হুসাইন বলেন,শুরার দাবি সমর্থনযোগ্য নয় এবং অনেক সুন্নী আলেম এ হাদীসের ত্রুটি পেয়েছেন এবং একে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। যেমন : আবু হাতিম আল-রাযী,আল-বাযযায এবং ইবনে হায্ম (ফাত্হ আল-কাদির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৫২);তিরমিযী,(সহীহ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৬৭২);উকাইলী,(আদ-দুআফা);নাক্কাস,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪২);দারে কুতনী,(লিসান আল মিযানে,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);ইবরী আল-ফারগানী,(শারহ আল মিনহাজ);যাহাবী,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১০৫);ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(লিসানুল মিযান,১ম খণ্ড,পৃ. ১৮৮ ও ২৭২,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);এবং শায়খুল ইসলাম আল-হারাভী,(আল-দুররুন নাদিদ,পৃ. ৯৭)ইবরাহীম ইবনে ইসমাঈল,ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া,ইয়াহইয়া ইবনে সালামাহ ইবনে কুহাইল এবং আবু আল-জারা-যাঁরা এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাঁদেরকে আবু যুরাহ,আবু হাতিম,ইবনে নুমাইর,দারে কুতনী,বুখারী,নাসাঈ,ইবনে মুঈন,ইবনে হিব্বান,তিরমিযী এবং অন্য অনেকেই অবিশ্বস্ত বলে গণ্য করেছেন।উপরিউক্ত হাদীসগুলো শাহ আবদুল আযীয উত্থাপন করেছেন এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে,যদি হাদীসে সাকালাইনকে আহলে বাইতের ইমামদের ইমামতের নির্দেশক হিসাবে গণ্য করা হয় তবে এসব হাদীসও হুমায়রা,আম্মার,ইবনে মাসউদ,মুয়াজ ইবনে জাবাল,হযরত আবু বকর এবং হযরত উমরের ইমামতের বিষয়টি নির্দেশ করছে। সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন উপসংহারে আমরা তখনই পৌঁছব যখন উপস্থাপিত হাদীসগুলো নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আবাকাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে,এ হাদীসগুলো দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য যেগুলো কোনভাবেই হাদীসে সাকালাইনের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে না-যা মুতাওয়াতির হাদীস এবং শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক রাবী ও পণ্ডিত কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সপ্তম হাদীসশাহ আবদুল আযীয তাঁর যুক্তির সপক্ষে মহানবী (সা.)-এর আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা ‘হাদীসে নুজুম’ নামে পরিচিত। হাদীসটি হলো :‘নিশ্চয়ই আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রতুল্য (নুজুম);তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে,তুমি সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আমার সাহাবীদের মধ্যে মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমত।’সুন্নী আলেমদের মধ্যে যাঁরা এ হাদীসকে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করেছেন তাঁরা হলেন :১.আহমাদ ইবনে হাম্বাল (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯):২.আল-মিযযী (আল-জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৮৯-৯০);৩. আল-বাযযায (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০);৪. ইবনে আল কাততান,(আল-কামিল);৫. দারে কুতনী (লিসান আল-মিযান,২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৭);৬. ইবনে হায্ম,(বাহার আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৮);৭. আল-বায়হাকী,আল-হাফিয আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);৮. ইবনে আবদুল বার (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০-৯১);৯. ইবনে আসাকির (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);১০. ইবনুল জাওযী,(আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়াহ ফি আল-আহাদীস আল-ওয়াহিয়াহ);১১. ইবনে দাহিয়াহ (তালিক তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);১২. আবু হাইয়ান আল-আন্দালুসী (আল-দুর আল-লাকিত মিন আল-বাহর আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৭-৫২৮);১৩. আল-যাহাবী (মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ৪১৩,২য় খণ্ড,পৃ. ১০২ ও ৬০৫);১৪. ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযীয়াহ (ইলাম আল-মুকিন,২য় খণ্ড,পৃ. ২২৩)১৫. যাইন আল-দীন আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);১৬. ইবনে হাজার আল-আসকালানী (তালখীস আল-খাবীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৯০-১৯১)১৭. ইবনে আল-হুমাম (আল-তাহরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);১৮. ইবনে আমীর আল-হাজ (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);১৯. আল-সাখাভী (আল-মাকাসিদ আল-হাসানাহ্,পৃ. ২৬-২৭);২০. ইবনে আবি শারীফ (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২১. আল-সুয়ূতী (ইতমাম আল-দিরায়াহ্ এবং আল-জামি আস-সাগীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২২. আল-মুত্তাকী আল-হিন্দী (কানজুল উম্মাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৩৩);২৩. আল-কারী (আল-মিরকাত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৩);২৪. আল-মানাভী (আল-তাইসির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৪৮ এবং ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২৫. আল-কাফাযী [নাসীম আর রিয়াদ (আশ শিফার ব্যাখ্যাগ্রন্থ),৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩২৩-৩২৪];২৬. আল-সিন্দী (দিরাসাত আল-লাবিব ফি আল-উসওয়াত আল-হাসানাহ্ আল-হাবীব,পৃ. ২৪০);২৭. আল-কাযী মুহিব্বুল্লাহ আল-বিহারী (মুসাল্লিম আল-সুবুত বি শারহ আবদুল আলী,২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০);২৮. নিযাম আল-দীন সাহালাভী [আল-সুবহ আল-সাদিক (মানার এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ)];২৯. আল-মাওলাভী আবদুল আলী [ফাওয়াতিহ আর-রাহমাত (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত),২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০];৩০. আল-শাওকানী (ইরশাদ আল-ফুহুল,পৃ. ৮৩);৩১. ওয়ালিউল্লাহ ইবনে হাবীবুল্লাহ্ আল-লাখনাভী (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত);৩২. সিদ্দীক হাসান খান আল-কনৌজী (হুসুল আল-মামুল,পৃ. ৫৬৮)।৩৩. নাসির উদ্দিন আলবানী (যঈফ ও মওযু হাদীস)নিম্নলিখিত কারণেও এ হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য :১. হাদীসটি কেবল এটিই ইঙ্গিত করে না যে,প্রত্যেক সাহাবীই ন্যায়নিষ্ঠ;বরং প্রত্যেকেই উম্মতের যোগ্য নেতা ও পথপ্রদর্শক। এটি সর্বসম্মতভাবে মিথ্যা। কারণ,তাঁরা নিজেরাই পথনির্দেশনার মুখাপেক্ষী ছিলেন।২. ইতিহাসের বর্ণনা মতে তাঁদের একটি দল বিভিন্ন গুরুতর পাপের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। যেমন হত্যাকাণ্ডএবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান ইত্যাদি। আর তাই এটি যুক্তিসংগত নয় যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মাহর পথনির্দেশক ও নেতা মনোনীত করবেন।৩. পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে,বিশেষ করে সূরা বাকারা,সূরা আহযাব,সূরা জুমুআহ এবং সূরা মুনাফিকুন,যেগুলো সাহাবীদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের মন্দ চরিত্রের ওপর আলোকপাত করেছে এবং এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মতের পথনির্দেশক ও নেতা বলে ঘোষণা করবেন।৪. মাযহাব নির্বিশেষে বিভিন্ন সূত্রে মহানবী (সা.)-এর অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যেগুলো সাহাবীদেরকে একটি দল হিসাবে গণ্য করেছে। উপরিউক্ত হাদীস সেসব নির্ভরযোগ্য হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।১৫. সুন্নী সূত্রে অনেক হাদীস রয়েছে যা উম্মাহকে সাহাবীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে। যাইন আল-ফাতা ফি তাফসীরে সূরা হাল আতা’য় আসিমী কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে যে,মহানবী (সা.) বলেছেন :‘আমার পরে আমার সাহাবীদের দ্বারা বেদআত তৈরি করা হবে (যেমন তাদের মধ্যে যে ফিতনা হবে)। আল্লাহ তাদের পূর্বেকার (উত্তম) আমলের কারণে তাদের ক্ষমা করে দেবেন,কিন্তু যদি লোকজন আমার পরে তাদের অনুসরণ করে,তবে আল্লাহ তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।’৬. মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ এমন সব কথা বলেছেন যাতে বোঝা যায় যে,উম্মতের নেতা ও পথপ্রদর্শক হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না। হযরত আবু বকর ও হযরত উমর তাঁদের নিজেদের সম্পর্কে এমন অনেক বিবৃতি দিয়েছেন যা প্রকাশ করে যে,পথপ্রদর্শক হিসাবে কুরআনের মতো নির্দ্বিধায় অনুসরণ করার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না।২হাদীসে নুজুম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকার ফলে শাহ আবদুল আযীয স্বীকার করেছেন যে,কিছু সংখ্যক সাহাবী ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। কারণ,তা কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশের (নাস) বিপরীত। তারপরও তিনি স্বীকার করেছেন যে,যেসব ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায় না সেসব ক্ষেত্রে সাহাবীদের ইজতিহাদের অনুসরণ করা যাবে।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এর জবাব দিয়েছেন এভাবে :প্রথমত যে ব্যক্তির ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল করার ব্যাপারটি নিশ্চিত সে আইনসঙ্গতভাবে পথপ্রদর্শক হতে পারে না।দ্বিতীয়ত যেখানে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সাহাবীদের ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে,তাহলে যেখানে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে ভুল করার সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি।তৃতীয়ত যেখানে সঠিক পথপ্রদর্শক রয়েছেন-যাঁর পথনির্দেশনা এবং যাঁর পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে,সেখানে যার ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে তার অনুসরণ করার কোন অনুমতি নেই। আয়াতে তাতহীর (সূরা আহযাব : ৩৩) এবং হাদীসে সাকালাইনসহ অনেক আয়াত ও হাদীস আহলে বাইতের ইমামদের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে।চতুর্থত সাহাবীরা শরীয়তের অনেক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করেছেন-যেগুলোর ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের সকলকে পথনির্দেশনার জন্য নক্ষত্রতুল্য বিবেচনা করা সম্পূর্ণরূপে ভুল।পঞ্চমত সাহাবীরা নিজেরাই একে অপরের ভুল ধরেছেন। কখনও কখনও পরিমিতিবোধ লুপ্ত হয়েছে;একে অপরকে মিথ্যাবাদী,অজ্ঞ,এমনকি কাফের পর্যন্ত বলেছেন-যেগুলো আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয়ই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি তাঁদের প্রত্যেককে মুসলিম উম্মাহর সঠিক পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করবে না।ষষ্ঠত সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁরা কিয়াসের অনুশীলন করতেন যে বিষয়ে উম্মতের বিপুল সংখ্যক আইনজ্ঞ দোষারোপ করেছেন।সপ্তমত তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন,এমনকি প্রথম তিন খলীফাও,যাঁরা শরীয়তের নানা বিধান জানার জন্য অন্যদের শরণাপন্ন হতেন। এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) মতবাদগত ও আইনগত বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তিদের উম্মতের কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করবেন। তাঁদের মধ্যে এমনও ছিলেন যাঁরা কুরআনের কিছু শব্দের অর্থও বুঝতেন না। যেমন হযরত উমর ‘কালালাহ’ শব্দের অর্থ বুঝতেন না যেটা তাবারী তাঁর তাফসীরে (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৮৩-২৮৪) উল্লেখ করেছেন। হযরত উমরের নিজের কথাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।অষ্টমত তাঁদের কেউ কেউ সুদের লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন৩,কেউ মদ বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন৪ অথবা জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফতোয়া দিতেন,এমনকি মহানবী (সা.)-এর স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে। কেউ কেউ মহানবী (সা.)-এর সুন্নাতের বিপরীতে বেদআত সৃষ্টির দোষে দুষ্ট। ‘কিতাবুল্লাহ ও আমার সুন্নাহ’ সংক্রান্ত হাদীসের ওপর আলোচনাপথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে সমাজে বহুল প্রচলিত যে হাদীস বিদ্যমান তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদীস :‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা যতক্ষণ তা ধরে থাকবে পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’‘মহান আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ আঁকড়ে ধর’-এ হাদীসটি অনির্ভরযোগ্য এবং এর কোন সহীহ সনদ নেই। কারণ,এ রেওয়ায়াতটি আহলে সুন্নাতের মাত্র আটজন আলেম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর সবকটির সনদ দুর্বল এবং ত্রুটিযুক্ত। নিচে এ হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করা হলো :১. মালেক ইবনে আনাস বলেছেন : আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে,দু’টি জিনিস আমি তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি যেগুলো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও গোমরাহ হবে না : মহান আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক,সুয়ূতীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৮;ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র.),২য়খণ্ড,তাকদীর অধ্যায়,রেওয়ায়াত ৩,পৃ. ৬১৭)তিনি এ হাদীসটি সনদ ছাড়াই মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন।২. ইবনে হিশাম এ রেওয়ায়াতটি মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনিও সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৬০৩)৩. হাকিম নিশাবুরী এ হাদীসটি দু’টি সনদসহ বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অপরটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (মুসতাদরাকে হাকিম,১ম খণ্ড,পৃ. ৯৩)হাকিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির প্রথম সনদে ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস বিদ্যমান যাঁকে এক বিরাট সংখ্যক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ (দুর্বল) বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি এবং তাঁর পিতা যাঈফ। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : তিনি তাঁর মামার কাছ থেকে বেশ কিছু গারীব (অদ্ভুত) হাদীস বর্ণনা করেছে যেগুলো কেউই গ্রহণ করেননি। ইবনে হায্ম তাঁর নিজের সনদ সহকারে সাইফ ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেছেন : ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস হাদীস জা’ল করতেন...। (তাহযীবুত তাহযীব,১ম খণ্ড,পৃ. ২৭১)আর দ্বিতীয় সনদে সালেহ ইবনে মূসা তালহী কুফী বিদ্যমান যাঁকে বহু সুন্নী রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি কিছুই নন (অর্থাৎ তাঁর কোন মূল্যই নেই)। বুখারী বলেছেন : তিনি হাদীস প্রত্যাখ্যানকারী। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : জুমহুর আলেমগণ তাঁকে গ্রহণ করেন না। আকীলী বলেছেন : তাঁর কোন হাদীসই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৫৪)৪. আবু বকর বাইহাকী এ হাদীসটি দু’টি সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অন্যটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (আস-সুনানুল কুবরা,১০ম খণ্ড,পৃ. ১১৪)। এ সনদটিও হাকিম নিশাবুরীর সনদসমূহের মতো প্রথম সনদে ইবনে আবি উওয়াইস এবং দ্বিতীয়টিতে সালেহ ইবনে মূসা আছে যাঁদের উভয়কেই যঈফ বলে গণ্য করা হয়েছে।৫. ইবনে আবদুল বার আল কুরতুবীও এ হাদীসটি দু’টি সূত্রে রেওয়ায়াত করেছেন। (ইবনে আবদুল বার প্রণীত আত তামহীদ)। এর প্রথম সনদ হচ্ছে ঐ সূত্র যা হাকিম আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন এবং এর মধ্যে সালেহ বিন মূসা বিদ্যমান যাঁকে অনেক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন।আর এর দ্বিতীয় সনদে কাসীর বিন আবদুল্লাহ বিদ্যমান যাঁকে একদল রিজালবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁকে হাদীস অমান্যকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী বলে বিবেচনা করতেন এবং তাঁর কোন মূল্যই দিতেন না। নাসাঈ তাঁকে সিকাহ (বিশ্বস্ত) বলে বিবেচনা করেননি। ইবনে আদী বলেছেন : তাঁর বর্ণনাকৃত রেওয়ায়াতসমূহ অনুসরণযোগ্য নয়। আলী ইবনে মাদানীও তাঁকে যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। ইবনে আবদুল বার বলেছেন : তাঁর যঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি তাঁর পিতা ও দাদা থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বান বলেছেন : তাঁর দাদার সূত্রে তাঁর পিতা থেকে যেসব রেওয়ায়াত তিনি বর্ণনা করেছেন সেগুলো আসলে একটি জাল পাণ্ডুলিপির সাথে জড়িত যা গ্রন্থ হিসাবে বর্ণনা করা সঠিক নয়। (আল-ইলমা ফী যাবতির রেওয়ায়াহ ওয়া তাকঈদিস সিমা’,পৃ. ৮-৯)৬. কাযী আইয়ায এ হাদীসটি নিজ সূত্রে আবু সাঈদ খুদরীর মাধ্যমে মহানবী (সা.)থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু (এ সনদের) এর বেশ কতিপয় রাবী যঈফ বলে গণ্য হয়েছে যে,তাঁদের মধ্যে শুআইব ইবনে ইবরাহীম ইবনে সাইফ ইবনে উমরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশেষ করে সাইফ ইবনে উমরের যাঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা রয়েছে। (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৫৯)৭. সুয়ূতীও উপরিউক্ত হাদীসটি হাকিম নিশাবুরীর ঐ একই সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যা ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। (মানাভী প্রণীত ফাইযুল কাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ২৪০)৮. মুত্তাকী হিন্দীও ‘কানযুল উম্মাল’ গ্রন্থে কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। একই শিরোনামের অধীনে হাকিম ও বাইহাকীর মতো অন্যান্য হাদীসবেত্তার রেওয়ায়াতসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং আল-ইবানাহ থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন : এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব।উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,এমন একটি হাদীসকে ‘হাদীসে সাকালাইন’ এর মতো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীসের বিপরীতে উপস্থাপনের কোন অবকাশই নেই। টীকা১. বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে (কিতাব আল-রুকুক) নিচের এই মুতাওয়াতির হাদীসটি হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন :বুখারী মুসলিম ইবনে ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেন,যিনি উহাইব থেকে,তিনি আবদুল আযীয থেকে,তিনি আনাস থেকে বর্ণনা করেন যে,মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমার কাছে হাউসের (হাউসে কাওসার) নিকট আমার সাহাবীদের একটি দলকে আনা হবে এবং আমি তাদের চিনতে পারব;তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব,(হে আল্লাহ! তারা কি) আমার সাহাবী (নয়)? (আল্লাহ) বলবেন,‘তুমি জান না,তোমার পরে তারা কী করেছিল!’অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে (১৪৪২ নং) মহানবী (সা.)-কে বলা হবে : ‘তোমার জানা নেই যে,তোমার পর তারা কী করেছিল! তারা পতনশীল আচরণে (শিরকের অবস্থায়) ফিরে গিয়েছিল।’বুখারী একই রকম হাদীস আর-রুকুক অধ্যায়ে হুযায়ফাহ (১৪৩৫ নং),আবদুল্লাহ (১৪৩৫ নং),সাহল ইবনে সা’দ (১৪৪২ নং),আবু সাইদ আল-খুদরী (১৪৪২ নং),ইবনে আব্বাস (১৪৪২ নং),আবু হুরায়রাহ (১৪৪৩ নং) এবং আসমা বিনতে আবি বকর (১৪৪৯ নং) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাফসীর ও বাদাউল খালক অধ্যায়েও বর্ণনা করেছেন। একই হাদীস কিছু শব্দগত পার্থক্যসহ মুসলিম,আবু দাউদ,তিরমিযী,নাসাঈ,ইবনে মাযাহ,ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় (কিতাব আল-তাহারাত অধ্যায়ে,হাদীস নং ২৮) কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন।ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় কিতাব আল জিহাদ এ ৩২ নং হাদীস হিসাবে নিম্নের হাদীসটি এনেছেন :মহানবী (সা.) ওহুদের শহীদদের উদ্দেশে বলেন : ‘আমি তাদের ব্যাপারে সাক্ষী।’ তখন আবু বকর বলেন : ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা কি তাদের ভাই নই? আমরা তাদের মতো ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তাদের মতো জিহাদ করেছি।’ মহানবী (সা.) জবাব দেন : ‘হ্যাঁ,কিন্তু আমি জানি না যে,আমার পরে তোমরা কী করবে...।’উদাহরণস্বরূপ দেখুন,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পণ্ডিত মাহমুদ আবু রিয়াহ প্রণীত আদওয়া আলাল সুন্নাত আল মুহাম্মাদীয়াহ,পৃ. ৩৩৯-৩৬৩,এবং আল্লামা হিল্লী কর্তৃক প্রণীত নাহজ আল হাক্ক ওয়া কাশফ আস সিদক,পৃ. ২৬২-৩৭৫;এ দু’টি গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনেক হাদীস আলোচনা করেছেন যেগুলো পথপ্রদর্শক হিসাবে রাসূলের প্রত্যেক সাহাবীর নক্ষত্রতুল্য হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে।২. ইবনে সা’দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে (লেইডেন,১৩২২) ২য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হযরত আবু বকরের একটি ভাষণ উল্লেখ করেছেন,যেখানে তিনি বলেছেন : ‘আমি একজন মানুষ মাত্র এবং আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। সুতরাং আমার আনুগত্য কর যখন আমি সোজা পথে চলি এবং আমাকে সংশোধন কর যখন আমাকে ভুল পথে দেখ। তোমাদের জানা উচিত যে,(কখনও) আমি শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হই। সুতরাং যখন তোমরা আমাকে ক্রোধান্বিত দেখ,তখন আমার থেকে দূরে থেক।’ একই রকম বক্তব্য তাঁর থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন :ক. তাবারী তাঁর তারিখে,(কায়রো,১৩৫৭),২য় খণ্ড,পৃ. ৪৪০;খ. ইবনে কুতায়বা তাঁর আল-ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ্ (মাকতাবাতুল ফুতুহ আল-আদাবিয়্যাহ,১৩১),পৃ. ৬;গ. আল হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ (১৩৫২),৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮৩;ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল (হায়দারাবাদ,১৩১২) ২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬ এবং অন্যরা।দ্বিতীয় খলীফা উমর প্রায়ই বলতেন,‘প্রত্যেকেরই (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি জ্ঞান রয়েছে (কুল্লু আহাদিন আ’লামু মিন উমার) এবং ‘সকল লোকের (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি বুঝ আছে’ (কুল্লু আহাদিন আফকাহু মিন উমার)। এর জন্য দেখুন :ক. আল-বায়হাকী,সুনান (হায়দারাবাদ,১৩৪৪),৭ম খণ্ড,পৃ. ২৩৩;খ. আল-সুয়ূতী,আল-দুররুল মানসূর (আল মাতবাআতুল মাইমানিয়্যাহ্,১৩১৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;গ. আল-জামাখশারী,আল-কাশশাফ (মিসর,১৩৫৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল,৮ম খণ্ড,পৃ. ২৯৮;ঙ. আল-হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৩।৩. হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে যায়েদ ইবনে আরকাম এবং একজন মহিলার লেনদেনের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে :ক. আবদুর রাযযাক,আল মুসান্নাফ;খ. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল,তাঁর মুসনাদে;গ. আল-জাসসাস,আহকামুল কুরআনে;ঘ. আল-সারাখশী,মাবসুত;ঙ. আল-দাবুসী,তাসীস আন-নাযার,এবং অনেক সুন্নী আইনজ্ঞ,হাদীসশাস্ত্রবিদ এবং তাফসীরকারই তাঁদের গ্রন্থাদিতে এটি উল্লেখ করেছেন।৪. বুখারী,মুসলিম,দারিমী,ইবনে আবি শায়বাহ,নাসাঈ,ইবনে আসির,গাযযালী,মুত্তাকী,ইবনে খালদূন এবং আবু হিলাল আল-আসকারী কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছেন যেখানে কতিপয় সাহাবী কর্তৃক মদ বিক্রির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। (প্রবন্ধটির প্রধান অংশ সংকলিত হয়েছে প্রখ্যাত ভারতীয় আলেম সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন লক্ষ্ণৌভী রচিত ‘আবাকাত আল আনওয়ার’ থেকে।)

হাদীসে সাকালাইন ও এর সাথে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হাদীসসমূহের পর্যালোচনা
হাদীসে সাকালাইনের অর্থ

অনেক হাদীস থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে,গাদীরে খুমে একটি ভাষণের মধ্যেই মহানবী (সা.) হাদীসে সাকালাইন ও হাদীসে গাদীরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব হাদীসের কয়েকটি মুত্তাকী আল-হিন্দী তাঁর ‘কানজুল উম্মাল’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ১৬৭),ইবনে কাসির তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে (৫ম খণ্ড,পৃ. ২০৯),আস সাখাভী তাঁর ‘আল-ইসতিজলাব’ গ্রন্থে,আল সামহুদী তাঁর ‘জাওয়াহির আল ইকদাইন’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তাঁর ‘সাওয়ায়েক’ গ্রন্থে তাবারানী ও অন্যদের থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন।

কতিপয় হাদীসে ‘খালিফাতাইন’ (উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি) শব্দটি সাকালাইন শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ করা হয়েছে,যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁর মুসনাদে (৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮১) উল্লেখ করেছেন। আবার তাবারানী,ইবনে আবি আসিম,আবু বকর ইবনে আবি শায়বাহ,আল-যারকানী এবং অন্যরাও উল্লেখ করেছেন। এই শব্দ ইমাম আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের নেতৃত্ব ও খেলাফতের বিষয়টিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ করে।

এ হাদীসের কতিপয় বর্ণনা,যেমন কুন্দুজী তাঁর ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহতে হাসান ইবনে আলী (আ.) থেকে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাতে নবী (সা.)-এর বাণী রয়েছে যা ইমামতের চিরস্থায়িত্বের বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে :

‘হে আল্লাহ! তুমি দুনিয়াকে সৃষ্টির ওপর তোমার হুজ্জাত থেকে খালি রেখ না যাতে তোমার হুজ্জাত বাতিল হয়ে যায় অথবা তুমি তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার পর তোমার বন্ধুরা বিপথে যেতে না পারে। তারা (আল্লাহর হুজ্জাত) সংখ্যায় অল্প,কিন্তু সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহর নৈকট্যশীল। নিশ্চয়ই আমি প্রশংসিত ও মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমার বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বংশধরদের বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বীজের মধ্যে এবং আমার বীজের বীজের মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দেওয়ার। আর আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে।’

এটি নাহজুল বালাগায় বর্ণিত (হিকাম : ১৪৭) আলী (আ.) কর্তৃক তাঁর শিষ্য কুমাইল ইবনে যিয়াদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ :

...হ্যাঁ,পৃথিবী কখনও এমন লোকশূন্য হয়ে যায় না যারা গোপনে বা প্রকাশ্যে আল্লাহর ওপর রক্ষা করে এবং তারা সব সময় শংকিত থাকে যে,আল্লাহর গুপ্ত ওজর ও প্রমাণ যেন অপ্রমাণিত না হয়। তাদের সংখ্যা কত,আর তারা কোথায়? আল্লাহর কসম,তাদের সংখ্যা কম,কিন্তু আল্লাহর নিকট তাদের সম্মান অনেক বেশি। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর ওজর ও প্রমাণ রক্ষা করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের মতো অপর কাউকে বিশ্বাস না করে এবং তাদের মতো অন্য কারও হৃদয়ে আস্থার বীজ বপন না করে।

জ্ঞান তাদেরকে সত্যিকার বোধগম্যতার দিকে চালিত করে এবং এ কারণে তারা দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন আত্মার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। অন্যেরা যেটাকে কঠিন বলে মনে করে তা তারা সহজ বলে মনে করে। অজ্ঞরা যা বিস্ময়কর মনে করে,তারা তা সাদরে গ্রহণ করে। তারা এ পৃথিবীতে দেহ নিয়ে বসবাস করে,কিন্তু তাদের আত্মা অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। আল্লাহর জমিনে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তাঁর দীনের প্রতি আহ্বানকারী। আহা! তাদেরকে দেখার জন্য আমার আকুল আগ্রহ!

হযরত আলীর এ বক্তব্য অনেক হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিক তাঁদের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইবনে আব্দ রাব্বিহ তাঁর ‘আল ইকদুল ফারীদ’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ২৬৫,২৯৩);ইয়াকুবী তাঁর ‘তারিখ’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ৪০০);আল হাররানী তাঁর ‘তুহাফুল উকূল’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬৯);আল খাতীব আল বাগদাদী তাঁর ‘তারীখে বাগদাদ’ গ্রন্থে (৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ৩৮৯);আল রাযী তাঁর ‘তাফসীরে কাবীর’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২);ইবনে আবদুল বার তাঁর ‘আল মুখতাসার’ গ্রন্থে (পৃ. ২৯) এ রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করেছেন।

 

হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হওয়া কতিপয় হাদীস

 

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী একটি গ্রন্থে (তোহফায়ে ইসনা আশারা) হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করে হাদীসে সাকালাইনের ঘোষিত আহলে বাইতের নেতৃত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। আমরা এখানে সেই হাদীসগুলো উল্লেখ করে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করব।

প্রথম হাদীস

শাহ আবদুল আযীয তাঁর তুহ্ফা গ্রন্থে বলেন,যদি হাদীসে সাকালাইন গ্রহণ করা হয়েও থাকে,তবু তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অপর কয়েকটি হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব হাদীসের মধ্য থেকে তিনি নিম্নোল্লিখিত হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেন :

‘আমার সুন্নাহ অনুসরণ কর এবং আমার পর সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারীদের (খোলাফায়ে রাশেদীনের) অনুসরণ কর,তা আঁকড়ে ধর এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক।’

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন (আবাকাত আল আনওয়ার গ্রন্থের প্রণেতা) বলেন যে,এমন হাদীস সহীহ নয়।

প্রথমত,তিনি বলেন,এ হাদীসটি কেবল সুন্নীদের দ্বারা বর্ণনাকৃত। অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন সুন্নীদের পাশাপাশি আহলে বাইতের মাযহাবের আলেমগণও বর্ণনা করেছেন।

দ্বিতীয়ত শাহ আবদুল আযীয এখানে তাঁর স্বঘোষিত নীতি ওপর বহাল থাকেননি যে,আহলে বাইতের মতবাদের বিপক্ষে তাঁর যুক্তি তাদের দ্বারা গ্রহণীয় লেখনীর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হবে।

তৃতীয়ত হাদীসটি মুসলিম ও বুখারী লিপিবদ্ধ করেননি-হাদীসের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত যাঁদেরকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করে থাকে।

চতুর্থত,উপরিউক্ত হাদীসের সহীহ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। কারণ,সুন্নী আলেমগণের দ্বারাই এ হাদীসের সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।

এ হাদীসের ওপর পর্যালোচনা

এ হাদীসটি আবু দাউদ,তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে। আবু দাউদের রাবীদের সম্পর্কিত আলোচনা :

আল-আরবাদ ইবনে সারিআহ-তিনি এ হাদীসের অন্যতম রাবী (বর্ণনাকারী)। তিনি নির্ভরযোগ্য নন। কারণ,তিনি নিজের সম্বন্ধেই এমন উক্তি করেছেন যে,‘আমি ইসলামের এক-চতুর্থাংশ।’

হাজার ইবনে হাজার আল কিলাই-সিরিয়ার একটি শহরে বসবাস করত যে শহরের অধিবাসীরা আলী (আ.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। ইবনে হাজার তাঁর তাহযীব আত তাহযীবে তাঁর অবস্থা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। (৩য় খণ্ড,পৃ. ১১৮)

খালিদ ইবনে মাদান ইবনে আবি কারিব আল কিতাবী-সে ছিল ইসলামের ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়ার পুলিশ বাহিনীর প্রধান।

সাওর ইবনে ইয়াযীদ-ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে,সে আলী (আ.)-কে ঘৃণা করত। কারণ,তিনি এক যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন এবং তাঁকে একজন গোঁড়া মনে করতেন।

পরবর্তী রাবী হলো আল ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম। আবু মুসহার কর্তৃক জালকরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে,যা মিযানুল ইতিদালে যাহাবী উল্লেখ করেছেন (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৪৭) ।

অন্যদিকে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ যেসব রাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন,যেমন আবু আসিম,হাসান ইবনে আলী আল-খাল্লাল,বুহাইর ইবনে সা’দ,বাকীয়াহ ইবনে আল-ওয়ালীদ,ইয়াহইয়া ইবনে আবি আল-মুতী,আবদুল্লাহ ইবনে আলা’,মু‘আবিয়া ইবনে সালিহ,ইসমাঈল ইবনে বিশর ইবনে মানসূর এবং আবুল মালিক ইবনে আল-সাব্বাহ-তাঁরা সকলেই দুর্বল রাবী। আহলে সুন্নাতের রেজালশাস্ত্রবিদগণ তাঁদের সকলকেই দুর্বল রাবী হিসাবে অভিহিত করেছেন।

উপরন্তু যদি এ হাদীসটি সহীহ বলে ধরেও নিই,তবু তা হাদীসে সাকালাইনের বিপক্ষে কোন গুরুত্ব রাখে না। কারণ,হাদীসে সাকালাইন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিপুল সংখ্যক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে,অন্যদিকে সুন্নী পণ্ডিতদের বিপুল সংখ্যক তাঁদের হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করেননি। যদি এ হাদীসটি সত্যিই নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে,তবে ‘সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারী’ শব্দগুলো আহলে বাইতের বারো ইমামের ওপর আরোপ করা যায়-যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সমর্থিত হতে পারে। আর সেই হাদীসটি হল ‘আমার পরে বারো জন খলীফা বা ইমাম আসবে।’

শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত আরেকটি প্রশ্নের জবাব দান

আবদুল আযীয বলেছেন,যদি হাদীসে সাকালাইন পূর্বোক্ত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নাও হয়,তবুও ‘ইতরাত’ শব্দ সাধারণভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গোত্র বনি হাশিমের সকল আত্মীয় অথবা হযরত ফাতিমার সকল বংশধরের ওপর আরোপ করা যায়। তাহলে এটি বলা অবান্তর যে,তাঁদের সকলেই হলেন ইমাম।

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এ সন্দেহ সম্পর্কে নানা অভিধান রচয়িতার অর্থ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন,যেমন জাওহারী,ইবনে আসির,ইবনে মানযুর,আল ফিরূযাবাদী এবং অন্যরা। তাঁদের মতে ‘ইতরাত’ বলতে বুঝায় কারও নিকটতম আত্মীয় (আখাস আকরাবীন),সন্তানাদি (ওয়ালাদ) এবং বংশধর (যুররিয়াহ)।

উপরন্তু তিনি উল্লেখ করেন,হাদীসে সাকালাইন তাঁদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাধান্যের পাশাপাশি তাঁদের পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিও নির্দেশ করে। এমন বর্ণনা নিঃসন্দেহে কেবল বারো ইমামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,আলী (আ.) যাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ‘ইতরাত’ বলে পরিচিত করিয়েছেন এবং কুরআনের ব্যাপারে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন।

দ্বিতীয় হাদীস

শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত দ্বিতীয় হাদীসটি হলো :

‘ধর্মের বিষয়াদি তোমরা এই হুমায়রার (আয়েশা) নিকট থেকে গ্রহণ কর।’

তিনি এ হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেছেন।

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,সুন্নী পণ্ডিতগণই এ হাদীসকে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন :

১. আল-মিযযী এবং যাহাবী (আল-তাকরীর ওয়াল তাহবীর ফি শাহর আল-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।

২. ইবনুল কাইয়্যেম জাওযীয়াহ,যেসব হাদীস ‘হে হুমায়রা’ এবং ‘আল-হুমায়রা’ শব্দযোগে এসেছে সেসব হাদীসকে তিনি জাল বলে গণ্য করেছেন।

৩. ইবনে কাসির,(আল-দুরুর আল-মুনতাশিরাহ ফি আল-আহাদীস আল-মুশতাহিরাহ,পৃ. ৭৯)।

৪. ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(আল-তাকরীর ওয়া আল-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।

৫. তাঁদের পাশাপাশি ইবনুল মুলাক্কিন,আস সুবকি,ইবনে আমির আল-হাজ,আল-সাখাভী,আল-সুয়ূতী,আল-শায়বানী,আল-শেখ আলী আল-কারী,আল-যারকানী,আবদুল আলী আল-শাওকানী এবং অন্যরাও এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

 

তৃতীয় হাদীস

শাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে এনেছেন। আর তা হলো :

‘আম্মারের নিকট থেকে পথনির্দেশনা চাও।’

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন হাদীস কখনই হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উত্থাপন করা যায় না। কারণ,হযরত আম্মার নিজেই হযরত আলী (আ.)-এর একনিষ্ঠ শিয়া (অনুসারী) ছিলেন এবং মহানবী (সা.) তাঁকে হযরত আলীকে মেনে চলা ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে :

‘হে আম্মার! আলী তোমাকে সত্যপথ হতে বিচ্যুত করবে না। হে আম্মার! আলীর আনুগত্য আমার আনুগত্য,আর আমার আনুগত্যই হল সর্বশক্তিমান ও প্রশংসিত আল্লাহর আনুগত্য।’

এ হাদীসটি বেশ কয়েকটি সুন্নী হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ফারায়েদুস সিমতাইন,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭৮;আল মাওয়াদ্দাহ ফিল কুরবা;আল খারাযমীর মানাকিব,পৃ. ৫৭ ও ১২৪;ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ১২৮ ও ২৫০;মিফতাহ আন-নাযা এবং কানজুল উম্মাল,১২তম খণ্ড,পৃ. ২১২।

উপরন্তু এ বিষয়টি অদ্ভুত যে,শাহ আবদুল আযীয এ হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উপস্থাপন করেছেন,যেখানে ঐতিহাসিক ইয়াকুবী তাঁর তারিখে (২য় খণ্ড,পৃ. ১১৪) এবং মাসউদী তাঁর মুরুযুয যাহাব (২য় খণ্ড,পৃ. ৩৪২) গ্রন্থে আম্মারকে তাঁদের মধ্যে গণ্য করেছেন যাঁরা প্রথম খলীফার আনুগত্য করা থেকে দূরে ছিলেন। হযরত উমর তাঁর খেলাফতকালে আম্মারের দিকনির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং কর্কশ কণ্ঠে তাঁর সাথে কথা বলেছিলেন যখন তিনি ওযূর জন্য পানি না পেলে নামায ছেড়ে না দিয়ে তায়াম্মুম করার মাধ্যমে পবিত্র হবার বিষয়টি তাঁর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। এ ঘটনাটি নিম্নের হাদীস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : মুসনাদে আহমাদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৫;সহীহ মুসলিম,১ম খণ্ড,পৃ. ১১০;আবু দাউদ,নাসাঈ,তাবারী,আল-আঈনী,ইবনে আসির এবং আল-শায়বানীও এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন।

হযরত উসমান তাঁর খেলাফতকালে আম্মারকে ততক্ষণ প্রহার করেন যতক্ষণ না আম্মার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ঘটনাটি তখন ঘটে যখন তিনি হযরত উসমানের শাসনামলের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে মুসলমানদের প্রতিবাদলিপি তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। এ ঘটনাটি নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : ইবনে কুতাইবার আল-ইমামাহ্ ওয়াল সিয়াসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ৩২;ইবনে আবদ রাব্বিহের আল-ইকদুল ফারীদ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২;মাসউদীর মুরুযুয যাহাব,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৩৮;ইবনে আবদুল বারের আল-ইসতিয়াব,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬;ইয়াকুবীর তারিখ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৬০।

যদিও রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আম্মার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছিলেন,যেমন ‘আম্মারের শত্রু আল্লাহর শত্রু’,তারপরও রাসূলের কতিপয় সাহাবী কর্তৃক তিনি প্রতিরোধের মুখে পড়েন,তাঁরা তাঁকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করতেন,যেমন আবদুর রহমান ইবনে আওফ,সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,মুগীরাহ ইবনে শোবা,আবু মূসা আশআরী,আবু মাসউদ আল-আনসারী এবং অন্যরা। আম্মার দৃঢ়ভাবে আলীর পক্ষে এবং আলীর বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে দাঁড়ান। যেমন তিনি তালহা,যুবায়েরের বিপক্ষে জামাল যুদ্ধে এবং মু‘আবিয়ার বিপক্ষে সিফ্ফীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরিশেষে তিনি মু‘আবিয়ার সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হয় যে,‘আম্মার একদল বিদ্রোহী (আল-ফিআত আল-বাগিয়াহ) কর্তৃক নিহত হবে।’

 

চতুর্থ হাদীস

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন আরও কয়েকটি হাদীসের ওপর আলোচনা করেন যা আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছে। যেমন :

‘ইবনে উম্মে আবদ (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ) এর সিদ্ধান্তের ওপর কর্ম সম্পাদন কর।’ অথবা ‘ইবনে উম্মে আবদ এর অভিমতই তোমাদের জন্য আমার অভিমত।’

এ দু’টি হাদীসই দুর্বল (যাইফ) এবং খবরে আহাদ,যেখানে হাদীসে সাকালাইন হলো মুতাওয়াতির। মুসলিম ও বুখারী উভয়েই যেহেতু এটি তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেননি,তাই বলা যায় তাঁরা এগুলোর সনদকে দুর্বল মনে করেছেন।

উপরন্তু যদি এগুলো সত্য বলে ধরে নেয়া হয় তুবও সেগুলো হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ,এগুলো কেবল ইবনে মাসউদের প্রতিভাকে বর্ণনা করে,অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁদের নেতৃত্বের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।

উপরন্তু শাহ আবদুল আযীযের ক্ষেত্রে এখানে দ্বিমুখিতা লক্ষ্যণীয় যে,তিনি এ হাদীসগুলোকে উপস্থাপন করেছেন,অথচ ইবনে মাসউদের কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে হযরত উমর তাঁকে ফতোয়া দিতে নিষেধ করেছিলেন,রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর মদীনা ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এ অবস্থা হযরত উমরের ইন্তেকাল পর্যন্ত বহাল ছিল। হযরত উসমান আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ইবনে মাসউদকে এতটা নির্দয়ভাবে প্রহার করেছিলেন যে,তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল।

 

পঞ্চম হাদীস

শাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন :

‘মু‘আয ইবনে জাবাল হারাম ও হালাল সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।’

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এটি কেবল সুন্নীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারী এ হাদীসকে পরিহার করেছেন। সুন্নী পণ্ডিতদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়াহ,ইবনে আবদুল হাদী,যাহাবী,মানাভী প্রমুখ এ হাদীসকে দুর্বল মনে করেছেন বা ভিত্তিহীন বলেছেন।

এ হাদীসের রাবীদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহমান আল-বাইলামানী,তাঁর পিতা,যায়েদ আল-আম্মি,সালিম ইবনে সালিম হাদীস ও রিযালশাস্ত্রের আলেমগণ কর্তৃক অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছেন। যেমন : বুখারী,নাসাঈ,আল-মাকদিসী,দারে কুতনী,ইবনে হাজার,আল-যাহাবী,ইবনুল জাওযী এবং অন্যরা অবিশ্বস্ত বলেছেন।

উপরন্তু তাবাকাতে ইবনে সা’দ (৩য় খণ্ড,পৃ. ৫৮৫) এবং ইবনে আবদুল বারের আল-ইস্তিআবে (৩য় খণ্ড,পৃ. ১৪০৪) এমন কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যাতে বোঝা যায় যে,উপরিউক্ত হাদীসে তাঁর জন্য যে যোগ্যতা দাবি করা হয় তিনি সে রকম যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন না।

 

ষষ্ঠ হাদীস

শাহ আবদুল আযীয রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস এনেছেন যেটার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকারের দাবি করেছেন যা তাওয়াতুরের কাছাকাছি :

‘আমার পরে যারা আসবে তাদের অনুসরণ কর,আবু বকর ও উমর।’

হামিদ হুসাইন বলেন,শুরার দাবি সমর্থনযোগ্য নয় এবং অনেক সুন্নী আলেম এ হাদীসের ত্রুটি পেয়েছেন এবং একে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। যেমন : আবু হাতিম আল-রাযী,আল-বাযযায এবং ইবনে হায্ম (ফাত্হ আল-কাদির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৫২);তিরমিযী,(সহীহ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৬৭২);উকাইলী,(আদ-দুআফা);নাক্কাস,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪২);দারে কুতনী,(লিসান আল মিযানে,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);ইবরী আল-ফারগানী,(শারহ আল মিনহাজ);যাহাবী,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১০৫);ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(লিসানুল মিযান,১ম খণ্ড,পৃ. ১৮৮ ও ২৭২,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);এবং শায়খুল ইসলাম আল-হারাভী,(আল-দুররুন নাদিদ,পৃ. ৯৭)

ইবরাহীম ইবনে ইসমাঈল,ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া,ইয়াহইয়া ইবনে সালামাহ ইবনে কুহাইল এবং আবু আল-জারা-যাঁরা এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাঁদেরকে আবু যুরাহ,আবু হাতিম,ইবনে নুমাইর,দারে কুতনী,বুখারী,নাসাঈ,ইবনে মুঈন,ইবনে হিব্বান,তিরমিযী এবং অন্য অনেকেই অবিশ্বস্ত বলে গণ্য করেছেন।

উপরিউক্ত হাদীসগুলো শাহ আবদুল আযীয উত্থাপন করেছেন এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে,যদি হাদীসে সাকালাইনকে আহলে বাইতের ইমামদের ইমামতের নির্দেশক হিসাবে গণ্য করা হয় তবে এসব হাদীসও হুমায়রা,আম্মার,ইবনে মাসউদ,মুয়াজ ইবনে জাবাল,হযরত আবু বকর এবং হযরত উমরের ইমামতের বিষয়টি নির্দেশ করছে। সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন উপসংহারে আমরা তখনই পৌঁছব যখন উপস্থাপিত হাদীসগুলো নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আবাকাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে,এ হাদীসগুলো দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য যেগুলো কোনভাবেই হাদীসে সাকালাইনের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে না-যা মুতাওয়াতির হাদীস এবং শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক রাবী ও পণ্ডিত কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে।

 

সপ্তম হাদীস

শাহ আবদুল আযীয তাঁর যুক্তির সপক্ষে মহানবী (সা.)-এর আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা ‘হাদীসে নুজুম’ নামে পরিচিত। হাদীসটি হলো :

‘নিশ্চয়ই আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রতুল্য (নুজুম);তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে,তুমি সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আমার সাহাবীদের মধ্যে মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমত।’

সুন্নী আলেমদের মধ্যে যাঁরা এ হাদীসকে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করেছেন তাঁরা হলেন :

১.আহমাদ ইবনে হাম্বাল (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯):

২.আল-মিযযী (আল-জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৮৯-৯০);

৩. আল-বাযযায (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০);

৪. ইবনে আল কাততান,(আল-কামিল);

৫. দারে কুতনী (লিসান আল-মিযান,২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৭);

৬. ইবনে হায্ম,(বাহার আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৮);

৭. আল-বায়হাকী,আল-হাফিয আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);

৮. ইবনে আবদুল বার (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০-৯১);

৯. ইবনে আসাকির (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);

১০. ইবনুল জাওযী,(আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়াহ ফি আল-আহাদীস আল-ওয়াহিয়াহ);

১১. ইবনে দাহিয়াহ (তালিক তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);

১২. আবু হাইয়ান আল-আন্দালুসী (আল-দুর আল-লাকিত মিন আল-বাহর আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৭-৫২৮);

১৩. আল-যাহাবী (মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ৪১৩,২য় খণ্ড,পৃ. ১০২ ও ৬০৫);

১৪. ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযীয়াহ (ইলাম আল-মুকিন,২য় খণ্ড,পৃ. ২২৩)

১৫. যাইন আল-দীন আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);

১৬. ইবনে হাজার আল-আসকালানী (তালখীস আল-খাবীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৯০-১৯১)

১৭. ইবনে আল-হুমাম (আল-তাহরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);

১৮. ইবনে আমীর আল-হাজ (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);

১৯. আল-সাখাভী (আল-মাকাসিদ আল-হাসানাহ্,পৃ. ২৬-২৭);

২০. ইবনে আবি শারীফ (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);

২১. আল-সুয়ূতী (ইতমাম আল-দিরায়াহ্ এবং আল-জামি আস-সাগীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);

২২. আল-মুত্তাকী আল-হিন্দী (কানজুল উম্মাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৩৩);

২৩. আল-কারী (আল-মিরকাত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৩);

২৪. আল-মানাভী (আল-তাইসির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৪৮ এবং ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);

২৫. আল-কাফাযী [নাসীম আর রিয়াদ (আশ শিফার ব্যাখ্যাগ্রন্থ),৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩২৩-৩২৪];

২৬. আল-সিন্দী (দিরাসাত আল-লাবিব ফি আল-উসওয়াত আল-হাসানাহ্ আল-হাবীব,পৃ. ২৪০);

২৭. আল-কাযী মুহিব্বুল্লাহ আল-বিহারী (মুসাল্লিম আল-সুবুত বি শারহ আবদুল আলী,২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০);

২৮. নিযাম আল-দীন সাহালাভী [আল-সুবহ আল-সাদিক (মানার এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ)];

২৯. আল-মাওলাভী আবদুল আলী [ফাওয়াতিহ আর-রাহমাত (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত),২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০];

৩০. আল-শাওকানী (ইরশাদ আল-ফুহুল,পৃ. ৮৩);

৩১. ওয়ালিউল্লাহ ইবনে হাবীবুল্লাহ্ আল-লাখনাভী (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত);

৩২. সিদ্দীক হাসান খান আল-কনৌজী (হুসুল আল-মামুল,পৃ. ৫৬৮)।

৩৩. নাসির উদ্দিন আলবানী (যঈফ ও মওযু হাদীস)

নিম্নলিখিত কারণেও এ হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য :

১. হাদীসটি কেবল এটিই ইঙ্গিত করে না যে,প্রত্যেক সাহাবীই ন্যায়নিষ্ঠ;বরং প্রত্যেকেই উম্মতের যোগ্য নেতা ও পথপ্রদর্শক। এটি সর্বসম্মতভাবে মিথ্যা। কারণ,তাঁরা নিজেরাই পথনির্দেশনার মুখাপেক্ষী ছিলেন।

২. ইতিহাসের বর্ণনা মতে তাঁদের একটি দল বিভিন্ন গুরুতর পাপের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। যেমন হত্যাকাণ্ডএবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান ইত্যাদি। আর তাই এটি যুক্তিসংগত নয় যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মাহর পথনির্দেশক ও নেতা মনোনীত করবেন।

৩. পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে,বিশেষ করে সূরা বাকারা,সূরা আহযাব,সূরা জুমুআহ এবং সূরা মুনাফিকুন,যেগুলো সাহাবীদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের মন্দ চরিত্রের ওপর আলোকপাত করেছে এবং এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মতের পথনির্দেশক ও নেতা বলে ঘোষণা করবেন।

৪. মাযহাব নির্বিশেষে বিভিন্ন সূত্রে মহানবী (সা.)-এর অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যেগুলো সাহাবীদেরকে একটি দল হিসাবে গণ্য করেছে। উপরিউক্ত হাদীস সেসব নির্ভরযোগ্য হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।১

৫. সুন্নী সূত্রে অনেক হাদীস রয়েছে যা উম্মাহকে সাহাবীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে। যাইন আল-ফাতা ফি তাফসীরে সূরা হাল আতা’য় আসিমী কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে যে,মহানবী (সা.) বলেছেন :

‘আমার পরে আমার সাহাবীদের দ্বারা বেদআত তৈরি করা হবে (যেমন তাদের মধ্যে যে ফিতনা হবে)। আল্লাহ তাদের পূর্বেকার (উত্তম) আমলের কারণে তাদের ক্ষমা করে দেবেন,কিন্তু যদি লোকজন আমার পরে তাদের অনুসরণ করে,তবে আল্লাহ তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।’

৬. মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ এমন সব কথা বলেছেন যাতে বোঝা যায় যে,উম্মতের নেতা ও পথপ্রদর্শক হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না। হযরত আবু বকর ও হযরত উমর তাঁদের নিজেদের সম্পর্কে এমন অনেক বিবৃতি দিয়েছেন যা প্রকাশ করে যে,পথপ্রদর্শক হিসাবে কুরআনের মতো নির্দ্বিধায় অনুসরণ করার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না।২

হাদীসে নুজুম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকার ফলে শাহ আবদুল আযীয স্বীকার করেছেন যে,কিছু সংখ্যক সাহাবী ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। কারণ,তা কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশের (নাস) বিপরীত। তারপরও তিনি স্বীকার করেছেন যে,যেসব ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায় না সেসব ক্ষেত্রে সাহাবীদের ইজতিহাদের অনুসরণ করা যাবে।

সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এর জবাব দিয়েছেন এভাবে :

প্রথমত যে ব্যক্তির ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল করার ব্যাপারটি নিশ্চিত সে আইনসঙ্গতভাবে পথপ্রদর্শক হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত যেখানে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সাহাবীদের ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে,তাহলে যেখানে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে ভুল করার সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি।

তৃতীয়ত যেখানে সঠিক পথপ্রদর্শক রয়েছেন-যাঁর পথনির্দেশনা এবং যাঁর পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে,সেখানে যার ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে তার অনুসরণ করার কোন অনুমতি নেই। আয়াতে তাতহীর (সূরা আহযাব : ৩৩) এবং হাদীসে সাকালাইনসহ অনেক আয়াত ও হাদীস আহলে বাইতের ইমামদের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে।

চতুর্থত সাহাবীরা শরীয়তের অনেক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করেছেন-যেগুলোর ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের সকলকে পথনির্দেশনার জন্য নক্ষত্রতুল্য বিবেচনা করা সম্পূর্ণরূপে ভুল।

পঞ্চমত সাহাবীরা নিজেরাই একে অপরের ভুল ধরেছেন। কখনও কখনও পরিমিতিবোধ লুপ্ত হয়েছে;একে অপরকে মিথ্যাবাদী,অজ্ঞ,এমনকি কাফের পর্যন্ত বলেছেন-যেগুলো আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয়ই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি তাঁদের প্রত্যেককে মুসলিম উম্মাহর সঠিক পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করবে না।

ষষ্ঠত সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁরা কিয়াসের অনুশীলন করতেন যে বিষয়ে উম্মতের বিপুল সংখ্যক আইনজ্ঞ দোষারোপ করেছেন।

সপ্তমত তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন,এমনকি প্রথম তিন খলীফাও,যাঁরা শরীয়তের নানা বিধান জানার জন্য অন্যদের শরণাপন্ন হতেন। এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) মতবাদগত ও আইনগত বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তিদের উম্মতের কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করবেন। তাঁদের মধ্যে এমনও ছিলেন যাঁরা কুরআনের কিছু শব্দের অর্থও বুঝতেন না। যেমন হযরত উমর ‘কালালাহ’ শব্দের অর্থ বুঝতেন না যেটা তাবারী তাঁর তাফসীরে (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৮৩-২৮৪) উল্লেখ করেছেন। হযরত উমরের নিজের কথাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

অষ্টমত তাঁদের কেউ কেউ সুদের লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন৩,কেউ মদ বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন৪ অথবা জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফতোয়া দিতেন,এমনকি মহানবী (সা.)-এর স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে। কেউ কেউ মহানবী (সা.)-এর সুন্নাতের বিপরীতে বেদআত সৃষ্টির দোষে দুষ্ট।

 

‘কিতাবুল্লাহ ও আমার সুন্নাহ’ সংক্রান্ত হাদীসের ওপর আলোচনা

পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে সমাজে বহুল প্রচলিত যে হাদীস বিদ্যমান তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদীস :

‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা যতক্ষণ তা ধরে থাকবে পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’

‘মহান আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ আঁকড়ে ধর’-এ হাদীসটি অনির্ভরযোগ্য এবং এর কোন সহীহ সনদ নেই। কারণ,এ রেওয়ায়াতটি আহলে সুন্নাতের মাত্র আটজন আলেম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর সবকটির সনদ দুর্বল এবং ত্রুটিযুক্ত। নিচে এ হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করা হলো :

১. মালেক ইবনে আনাস বলেছেন : আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে,দু’টি জিনিস আমি তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি যেগুলো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও গোমরাহ হবে না : মহান আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক,সুয়ূতীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৮;ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র.),২য়খণ্ড,তাকদীর অধ্যায়,রেওয়ায়াত ৩,পৃ. ৬১৭)

তিনি এ হাদীসটি সনদ ছাড়াই মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন।

২. ইবনে হিশাম এ রেওয়ায়াতটি মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনিও সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৬০৩)

৩. হাকিম নিশাবুরী এ হাদীসটি দু’টি সনদসহ বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অপরটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (মুসতাদরাকে হাকিম,১ম খণ্ড,পৃ. ৯৩)

হাকিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির প্রথম সনদে ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস বিদ্যমান যাঁকে এক বিরাট সংখ্যক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ (দুর্বল) বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি এবং তাঁর পিতা যাঈফ। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : তিনি তাঁর মামার কাছ থেকে বেশ কিছু গারীব (অদ্ভুত) হাদীস বর্ণনা করেছে যেগুলো কেউই গ্রহণ করেননি। ইবনে হায্ম তাঁর নিজের সনদ সহকারে সাইফ ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেছেন : ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস হাদীস জা’ল করতেন...। (তাহযীবুত তাহযীব,১ম খণ্ড,পৃ. ২৭১)

আর দ্বিতীয় সনদে সালেহ ইবনে মূসা তালহী কুফী বিদ্যমান যাঁকে বহু সুন্নী রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি কিছুই নন (অর্থাৎ তাঁর কোন মূল্যই নেই)। বুখারী বলেছেন : তিনি হাদীস প্রত্যাখ্যানকারী। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : জুমহুর আলেমগণ তাঁকে গ্রহণ করেন না। আকীলী বলেছেন : তাঁর কোন হাদীসই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৫৪)

৪. আবু বকর বাইহাকী এ হাদীসটি দু’টি সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অন্যটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (আস-সুনানুল কুবরা,১০ম খণ্ড,পৃ. ১১৪)। এ সনদটিও হাকিম নিশাবুরীর সনদসমূহের মতো প্রথম সনদে ইবনে আবি উওয়াইস এবং দ্বিতীয়টিতে সালেহ ইবনে মূসা আছে যাঁদের উভয়কেই যঈফ বলে গণ্য করা হয়েছে।

৫. ইবনে আবদুল বার আল কুরতুবীও এ হাদীসটি দু’টি সূত্রে রেওয়ায়াত করেছেন। (ইবনে আবদুল বার প্রণীত আত তামহীদ)। এর প্রথম সনদ হচ্ছে ঐ সূত্র যা হাকিম আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন এবং এর মধ্যে সালেহ বিন মূসা বিদ্যমান যাঁকে অনেক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন।

আর এর দ্বিতীয় সনদে কাসীর বিন আবদুল্লাহ বিদ্যমান যাঁকে একদল রিজালবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁকে হাদীস অমান্যকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী বলে বিবেচনা করতেন এবং তাঁর কোন মূল্যই দিতেন না। নাসাঈ তাঁকে সিকাহ (বিশ্বস্ত) বলে বিবেচনা করেননি। ইবনে আদী বলেছেন : তাঁর বর্ণনাকৃত রেওয়ায়াতসমূহ অনুসরণযোগ্য নয়। আলী ইবনে মাদানীও তাঁকে যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। ইবনে আবদুল বার বলেছেন : তাঁর যঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি তাঁর পিতা ও দাদা থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বান বলেছেন : তাঁর দাদার সূত্রে তাঁর পিতা থেকে যেসব রেওয়ায়াত তিনি বর্ণনা করেছেন সেগুলো আসলে একটি জাল পাণ্ডুলিপির সাথে জড়িত যা গ্রন্থ হিসাবে বর্ণনা করা সঠিক নয়। (আল-ইলমা ফী যাবতির রেওয়ায়াহ ওয়া তাকঈদিস সিমা’,পৃ. ৮-৯)

৬. কাযী আইয়ায এ হাদীসটি নিজ সূত্রে আবু সাঈদ খুদরীর মাধ্যমে মহানবী (সা.)থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু (এ সনদের) এর বেশ কতিপয় রাবী যঈফ বলে গণ্য হয়েছে যে,তাঁদের মধ্যে শুআইব ইবনে ইবরাহীম ইবনে সাইফ ইবনে উমরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশেষ করে সাইফ ইবনে উমরের যাঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা রয়েছে। (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৫৯)

৭. সুয়ূতীও উপরিউক্ত হাদীসটি হাকিম নিশাবুরীর ঐ একই সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যা ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। (মানাভী প্রণীত ফাইযুল কাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ২৪০)

৮. মুত্তাকী হিন্দীও ‘কানযুল উম্মাল’ গ্রন্থে কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। একই শিরোনামের অধীনে হাকিম ও বাইহাকীর মতো অন্যান্য হাদীসবেত্তার রেওয়ায়াতসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং আল-ইবানাহ থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন : এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,এমন একটি হাদীসকে ‘হাদীসে সাকালাইন’ এর মতো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীসের বিপরীতে উপস্থাপনের কোন অবকাশই নেই।

 

টীকা

১. বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে (কিতাব আল-রুকুক) নিচের এই মুতাওয়াতির হাদীসটি হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন :

বুখারী মুসলিম ইবনে ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেন,যিনি উহাইব থেকে,তিনি আবদুল আযীয থেকে,তিনি আনাস থেকে বর্ণনা করেন যে,মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমার কাছে হাউসের (হাউসে কাওসার) নিকট আমার সাহাবীদের একটি দলকে আনা হবে এবং আমি তাদের চিনতে পারব;তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব,(হে আল্লাহ! তারা কি) আমার সাহাবী (নয়)? (আল্লাহ) বলবেন,‘তুমি জান না,তোমার পরে তারা কী করেছিল!’

অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে (১৪৪২ নং) মহানবী (সা.)-কে বলা হবে : ‘তোমার জানা নেই যে,তোমার পর তারা কী করেছিল! তারা পতনশীল আচরণে (শিরকের অবস্থায়) ফিরে গিয়েছিল।’

বুখারী একই রকম হাদীস আর-রুকুক অধ্যায়ে হুযায়ফাহ (১৪৩৫ নং),আবদুল্লাহ (১৪৩৫ নং),সাহল ইবনে সা’দ (১৪৪২ নং),আবু সাইদ আল-খুদরী (১৪৪২ নং),ইবনে আব্বাস (১৪৪২ নং),আবু হুরায়রাহ (১৪৪৩ নং) এবং আসমা বিনতে আবি বকর (১৪৪৯ নং) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাফসীর ও বাদাউল খালক অধ্যায়েও বর্ণনা করেছেন। একই হাদীস কিছু শব্দগত পার্থক্যসহ মুসলিম,আবু দাউদ,তিরমিযী,নাসাঈ,ইবনে মাযাহ,ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় (কিতাব আল-তাহারাত অধ্যায়ে,হাদীস নং ২৮) কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় কিতাব আল জিহাদ এ ৩২ নং হাদীস হিসাবে নিম্নের হাদীসটি এনেছেন :

মহানবী (সা.) ওহুদের শহীদদের উদ্দেশে বলেন : ‘আমি তাদের ব্যাপারে সাক্ষী।’ তখন আবু বকর বলেন : ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা কি তাদের ভাই নই? আমরা তাদের মতো ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তাদের মতো জিহাদ করেছি।’ মহানবী (সা.) জবাব দেন : ‘হ্যাঁ,কিন্তু আমি জানি না যে,আমার পরে তোমরা কী করবে...।’

উদাহরণস্বরূপ দেখুন,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পণ্ডিত মাহমুদ আবু রিয়াহ প্রণীত আদওয়া আলাল সুন্নাত আল মুহাম্মাদীয়াহ,পৃ. ৩৩৯-৩৬৩,এবং আল্লামা হিল্লী কর্তৃক প্রণীত নাহজ আল হাক্ক ওয়া কাশফ আস সিদক,পৃ. ২৬২-৩৭৫;এ দু’টি গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনেক হাদীস আলোচনা করেছেন যেগুলো পথপ্রদর্শক হিসাবে রাসূলের প্রত্যেক সাহাবীর নক্ষত্রতুল্য হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে।

২. ইবনে সা’দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে (লেইডেন,১৩২২) ২য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হযরত আবু বকরের একটি ভাষণ উল্লেখ করেছেন,যেখানে তিনি বলেছেন : ‘আমি একজন মানুষ মাত্র এবং আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। সুতরাং আমার আনুগত্য কর যখন আমি সোজা পথে চলি এবং আমাকে সংশোধন কর যখন আমাকে ভুল পথে দেখ। তোমাদের জানা উচিত যে,(কখনও) আমি শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হই। সুতরাং যখন তোমরা আমাকে ক্রোধান্বিত দেখ,তখন আমার থেকে দূরে থেক।’ একই রকম বক্তব্য তাঁর থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন :

ক. তাবারী তাঁর তারিখে,(কায়রো,১৩৫৭),২য় খণ্ড,পৃ. ৪৪০;

খ. ইবনে কুতায়বা তাঁর আল-ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ্ (মাকতাবাতুল ফুতুহ আল-আদাবিয়্যাহ,১৩১),পৃ. ৬;

গ. আল হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ (১৩৫২),৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮৩;

ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল (হায়দারাবাদ,১৩১২) ২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬ এবং অন্যরা।

দ্বিতীয় খলীফা উমর প্রায়ই বলতেন,‘প্রত্যেকেরই (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি জ্ঞান রয়েছে (কুল্লু আহাদিন আ’লামু মিন উমার) এবং ‘সকল লোকের (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি বুঝ আছে’ (কুল্লু আহাদিন আফকাহু মিন উমার)। এর জন্য দেখুন :

ক. আল-বায়হাকী,সুনান (হায়দারাবাদ,১৩৪৪),৭ম খণ্ড,পৃ. ২৩৩;

খ. আল-সুয়ূতী,আল-দুররুল মানসূর (আল মাতবাআতুল মাইমানিয়্যাহ্,১৩১৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;

গ. আল-জামাখশারী,আল-কাশশাফ (মিসর,১৩৫৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;

ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল,৮ম খণ্ড,পৃ. ২৯৮;

ঙ. আল-হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৩।

৩. হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে যায়েদ ইবনে আরকাম এবং একজন মহিলার লেনদেনের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে :

ক. আবদুর রাযযাক,আল মুসান্নাফ;

খ. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল,তাঁর মুসনাদে;

গ. আল-জাসসাস,আহকামুল কুরআনে;

ঘ. আল-সারাখশী,মাবসুত;

ঙ. আল-দাবুসী,তাসীস আন-নাযার,এবং অনেক সুন্নী আইনজ্ঞ,হাদীসশাস্ত্রবিদ এবং তাফসীরকারই তাঁদের গ্রন্থাদিতে এটি উল্লেখ করেছেন।

৪. বুখারী,মুসলিম,দারিমী,ইবনে আবি শায়বাহ,নাসাঈ,ইবনে আসির,গাযযালী,মুত্তাকী,ইবনে খালদূন এবং আবু হিলাল আল-আসকারী কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছেন যেখানে কতিপয় সাহাবী কর্তৃক মদ বিক্রির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।

 

(প্রবন্ধটির প্রধান অংশ সংকলিত হয়েছে প্রখ্যাত ভারতীয় আলেম সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন লক্ষ্ণৌভী রচিত ‘আবাকাত আল আনওয়ার’ থেকে।)

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202