ইমামত নবুওয়াতের নির্বাহী ক্ষমতার ধারাবাহিকতাShare0 ‏বিভিন্ন মতামত0.0 / 5প্রবন্ধ ‎›ইসলামী বিশ্বাস ‎›দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহ ‎›ইমামতপ্রকাশিত হয়েছে ‎2019-08-19 11:11:21ভূমিকামহানবী ‎(সা.) ‏নবুয়্যত, ‏রিসালাত এবং ইসলামের আহকাম প্রচার ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছাড়াও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দয়িত্বে ও নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকার্য ও সামরিক নেতৃত্ব ইত্যাদি এ থেকেই উৎকলিত হত। যেমনিকরে ইসলামে ইবাদত ও আচরণগত দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক, ‏অর্থনৈতিক ও অধিকারগত ইত্যাদি কর্তব্যও বিদ্যমান, ‏তেমনি করে ইসলামের নবী ‎(সা.) ‏প্রচার, ‏প্রশিক্ষণ ও ‎(আধ্যাত্মিক) ‏পরিচর্যার দায়িত্ব ছাড়াও মহান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে ঐশী বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সকল প্রকার প্রশাসনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।এটা অনস্বীকার্য যে, ‏যদি কোন দ্বীন বিশ্বের শেষাবধি সকল প্রকার সামাজিক কর্তব্য পালনের দাবি করে তবে এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। অনুরূপ যে সমাজ এ দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, ‏সে সমাজ এ ধরনের কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তব্য থেকে নিরুদ্দিষ্ট থাকবে, ‏যা ইমামত নামে অভিষিক্ত, ‏তাও হতে পারে না।কিন্তু কথা হল মহানবী ‎(সা.) ‏এর তিরোধানের পর, ‏কে এ দায়িত্ব লাভ করবেন? ‏এবং তা কার কাছ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবেন? ‏মহান আল্লাহ্‌ ‏এ মর্যাদা যেরূপে মহানবীকে ‎(সা.) ‏দিয়েছিলেন সেরূপে অন্য কাউকেও কি দিয়েছেন? ‏এ দায়িত্বভার অন্য কারও গ্রহণের কোন বৈধতা রয়েছে কি? ‏নাকি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এ মর্যাদা মহানবী ‎(সা.)-এর জন্যেই নির্ধারিত ছিল এবং অতঃপর মুসলিম জনতাই তাদের ইমাম নির্বাচন করবে ও তাকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্থান দিবে, ‏তা-ও বিধিসম্মত? ‏মানুষের কি এ ধরনের কোন অধিকার আছে? ‏না নেই?আর এটিই হল শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয়। অর্থাৎ একদিকে শিয়াদের বিশ্বাস যে ইমামত হল একটি ঐশী মর্যাদা, ‏যা মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃকই যথোপযুক্ত ও যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা আবশ্যক। আর মহান আল্লাহ্‌, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏এর মাধ্যমে এ কর্মটি সম্পাদন করেছেন এবং আমীরুল মু’মীনিন আলীকে ‎(আ.) ‏তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষনা করেছেন। অতঃপর তাঁরই সন্তানদের মধ্য থেকে পরস্পরায় বারজনকে ইমামতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করছেন। অপরদিকে সুন্নি মাযহাবের বিশ্বাস নবী ‎(সা.)-এর তিরোধানের মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগতের সাথে মানুষের সম্পর্ক কর্তিত হয়ে গেছে এবং মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় পৌঁছেছে। এখন তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে কোরআনকে বুঝতে ও তাদের পথকে চিনে নিতে পারে। তাই তাদের পথপ্রদর্শনের জন্য ঐশী কোন ব্যক্তির আর প্রয়োজন নাই। আর নবী ‎(সা.) ‏এর পর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্বও তাদের উপরই অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি আহলে সুন্নাতের কোন কোন বিজ্ঞজন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ‏যদি কেউ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, ‏তবে তার আনুগত্য করাও অন্যান্যদের জন্যে অপরিহার্য!১ স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, ‏এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী, ‏অত্যাচারী ও প্রতারকদের অপরাধের জন্যে কতটা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের অবক্ষয় ও বিভেদের পথে কতটা সহায়ক হয়েছে!প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ঐশী সস্পর্কহীন ইমামতের বৈধতা দিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর শিয়া মাযহাবের বিশ্বাস, ‏এটিই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সত্য সুন্দর পথ থেকে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুতির মূল কারণ। অনুরূপ শতসহস্র ধরনের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার সূতিকাগারও এখানেই, ‏যেগুলো মহানবী ‎(সা.) ‏এর পরলোক গমনের পর থেকে মুসলমানদের মাঝে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং করবে।অতএব প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই কোন প্রকার অন্ধ অনুকরণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যতিরেকে এ বিষয়টির উপর পরিপূর্ণ গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য।২ আর সেই সাথে সত্য ও সঠিক মাযহাবের শনাক্তকরণের মাধ্যমে এর প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।উল্লেখ্য এ ব্যাপোরে ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রুদের জন্যে সুযোগ করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না যা ইসলামী সমাজে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হবে। আর এ ক্ষতির অংশীদার মুসলমানরাই হবে, ‏যার ফলশ্রুতি মুসলিম সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা বৃদ্ধি ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য সংরক্ষণ যেন, ‏সঠিক ও সত্য মাযহাবের অনুসন্ধান ও শনাক্তকরণের জন্যে, ‏অনুসন্ধান ও গবেষণার সুষ্ঠ পথকে রুদ্ধ না করে ফেলে। আর ইমামতের বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুষ্ঠ পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‏এ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধানের উপর মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে।ইমামতের তাৎপর্যইমামতের আভিধানিক অর্থ হল নেতা, ‏পথপ্রদর্শক এবং যে কেউ কোন জনসমষ্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহন করবে তাকেই ইমাম ‎(امام) ‏বলা হয়ে থাকে ‎-হোক সে সত্য পথের অনুসারী কিংবা মিথ্যা পথের অনুসারী। যেমন: ‏পবিত্র কোরানে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে ‎(ائمة الكفر) ‏অর্থাৎ কাফেরদের নেতারা ‎(সূরা তওবাহ-১২) ‏কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তদনুরূপ মুসুল্লীরা নামাজের জন্যে যার পিছনে সমবেত হয়ে থাকেন, ‏তাকে ‎‘ইমামুল জামা’ত’ ‏নামকরণ করা হয়।কিন্তু কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ইমামত হল ইহ ও পরলৌকিক সকল বিষয়ে ইসলামী সমাজের সর্বময় ও বিস্তৃত নেতৃত্ব প্রদান। ইহলৌকিক শব্দটি ইমামতের পরিসীমার ব্যাপকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা ইসলামী সমাজে ইহলৌকিক বিষয়াদিও দ্বীন ইসলামেরই অন্তর্ভুক্ত।শিয়া মাযহাবের মতে এ ধরনের নেতৃত্ব কেবলমাত্র তখনই বৈধ হবে, ‏যখন তা মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অনুমোদিত হবে। আর প্রকৃতপক্ষে যিনি এ মর্যাদার অধিকারী হবেন, ‏তিনি আহকাম ও ইসলাম পরিচিতির বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত থাকবেন। অনুরূপ তিনি সকল প্রকার গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবেন। বস্তুতঃ পবিত্র ইমাম, ‏একমাত্র নবুয়্যত ও রিসালাত ব্যতীত মহানবীকে ‎(সা.), ‏মহান আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত সকল মর্যাদার অধিকারী হবেন। ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য যেমন নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য, ‏তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়েও তাঁর আদেশ পালন করাও অপরিহার্য।এভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে।দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।তৃতীয়তঃ ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে।তবে মা’সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও ‎(সালামুল্লাহ আলাইহা) ‏মা’সুম ছিলেন, ‏যদিও তিনি ইমামতের অধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম ‎(আ.) ‏ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহ্‌র ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, ‏যদিও আমরা তাঁদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা’সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাঁদেরকে চিনা সম্ভব নয়।একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনাবিশ্বাসগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন না এমন অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে, ‏শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামত প্রসঙ্গে বিরোধ এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে শিয়াদের বিশ্বাস হলঃ মহানবী ‎(সা.) ‘আলী ইবনে আবি তালিবকে’ (আ.) ‏ইসলামী সমাজের পরিচালনার জন্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস যে, ‏এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং রাসূল ‎(সা.) ‏উম্মতকে কোন নেতা মনোনীত করা ছাড়াই ত্যাগ করেছিলেন। আর তাই তাঁর মৃত্যুর পর জনগণ নিজেদের পছন্দ মত প্রথম খলিফাকে নেতা নির্বাচন করেছিল। প্রথম খলিফা যদিও নিজে জনগণ কর্তৃক নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীকে নিজেই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব ছয় সদস্য বিশিষ্ট গোষ্ঠীর নিকট অর্পণ করা হয়েছিল। অপরদিকে চতুর্থ খলিফাও আবার প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন পন্থা ছিল না। ফলে চতুর্থ খলিফার পর যার সামরিক শক্তি অধিক ছিল, ‏সে-ই এ স্থান দখল করেছিল, ‏যেমন: ‏অনৈসলামিক দেশসমূহেও মোটামুটি এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।অন্যকথায়ঃ তারা এ রকম মনে করেন যে, ‏প্রথম ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শীয়াদের বিশ্বাস সেরূপ, ‏যেরূপ আহলে সুন্নাত প্রথম খলিফা কর্তৃক দ্বিতীয় খলিফার নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেন, ‏পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏এর বক্তব্য মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, ‏কিন্তু প্রথম খলিফার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল!কিন্তু প্রশ্ন হল, ‏প্রথম খলিফা এ অধিকার কোথা থেকে পেয়েছিলেন? ‏আল্লাহ্‌র রাসূল ‎(সা.) (আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস মতে) ‏ইসলামের জন্যে কেন তার ‎(প্রথম খলিফা) ‏মত আন্তরিকতা প্রদর্শন করেননি এবং নব গঠিত ইসলামী সমাজকে অভিভাবকহীন অবস্থায় রেখে গেলেন অথচ যুদ্ধের জন্যে মদীনা থেকে অন্যত্র যাওয়ার সময়ও একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এবং যেখানে স্বয়ং তিনিই ‎(এ বিষয়ের উপর) ‏তাঁর উম্মতদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তির সংবাদ দিয়েছিলেন? ‏এছাড়া ও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ‏শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূলতঃ মতবিরোধ সর্বাগ্রে এখানেই যে, ‏ইমামত কি এক ধর্মীয় মর্যাদা, ‏যা ঐশী বিধানের অনুগামী ও আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়? ‏নাকি পার্থিব রাজকীয় বা অন্য কোন পদ মর্যাদা, ‏যা সামাজিক নীতিমালার অনুগামী? ‏শিয়াদের বিশ্বাস যে, ‏স্বয়ং মহানবীও ‎(সা.) ‏নিজ থেকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেননি। বরং মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক আদিষ্ট হয়েই এ কর্ম সম্পাদন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন পবিত্র ইমামগণের নিয়োগদানের সাথে সস্পর্কযুক্ত। আর এ ধরনের ইমামের উপস্থিতিতেই রাসূল ‎(সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী সমাজের অপরিহার্য বিষয়াদির নিশ্চয়তা প্রদান করা যেতে পারে।এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ‏কেন শিয়া মাযহাবের মতে ইমামত ‎‘মূল বিশ্বাসগত’ ‏বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয় ‎-শুধুমাত্র একটি ফিকাহ্‌গত গৌণ বিষয় নয়। আর সেই সাথে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ‏কেন তারা তিনটি শর্ত ‎(ঐশী জ্ঞান, ‏ইসমাত ও আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) ‏বিবেচ্য বলে মনে করেন এবং কেন শিয়া সাধারণের মধ্যে এ ভাবার্থগুলো ঐশী আহকাম, ‏প্রশাসন ও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃত্বের ধারনার সাথে এমনভাবে মিশে আছে, ‏যেন ইমামত শব্দটি এ ভাবার্থগুলোর সবগুলোকেই সমন্বিত করে।এখন শিয়াদের সামগ্রিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, ‏ইমামতের তাৎপর্য ও মর্যাদার আলোকে এর বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা করব।ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তাআমরা জানি খতমে নবুওয়াতের দর্শন হল এই যে, ‏ইসলাম হল পবিত্র, ‏চিরন্তন, ‏সার্বজনীন ও অবিস্মৃত ধর্ম এবং ইসলামের নবী ‎(সা.)-এর পর আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না। নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন, ‏তখনই কেবলমাত্র নবীগণের আবির্ভাবের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে, ‏যখন সর্বশেষ ঐশী শরীয়ত মানব মাযহাবের সকল প্রশ্নের জবাব প্রদানে সক্ষম হবে এবং বিশ্বের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এ শরীয়তের অটুট থাকার নিশ্চয়তা থাকবে।উল্লেখিত নিশ্চয়তা পবিত্র কোরআনে রয়েছে এবং মহান আল্লাহ্‌ ‏স্বয়ং সকল প্রকার বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে প্রিয় গ্রন্থের সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের সকল বিধি-বিধান কোরানের আয়াতের বাহ্যিক যুক্তি থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন: ‏নামাযের রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি এবং আবশ্যকীয় ও অনাবশ্যকীয় এমন অসংখ্য বিধান রয়েছে, ‏যেগুলোকে পবিত্র কোরান থেকে উদঘাটন করা অসম্ভব। সাধারণতঃ পবিত্র কোরানে আহকাম ও কানুন বিশদভাবে বর্ণিত হয়নি। ফলে এগুলোর প্রশিক্ষণ ও সুস্পষ্ট বর্ণনার দায়িত্ব মহানবী ‎(সা.)-এর উপর অর্পণ করা হয়েছে, ‏যাতে তিনি মহান আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত জ্ঞানের ‎(কোরআনের ওহী ব্যতীত) ‏মাধ্যমে ঐগুলোকে মানুষের জন্যে বর্ণনা করেন।৩ আর এভাবে ইসলাম পরিচিতির প্রকৃত উৎস হিসেবে তাঁর সুন্নাহ বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।কিন্তু হযরত ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের প্রচার কর্ম শুরুর পর দশ বছর ধরে নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে ছিলেন, ‏অতঃপর আবি তালিবের উপত্যকায় কয়েক বছরের বন্দীদশা কাটিয়েছেন, ‏মদীনায় হিজরতের পর শত্রুদের সাথে দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ ইত্যাদির মত জীবনের সংকটময় মুহূর্তগুলো সাধারণ মানুষের জন্যে ইসলামের বিভিন্ন আহ‌কাম, ‏বর্ণনার পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। অপর দিকে সাহাবাগণ যা শিখতেন তা সংরক্ষিত থাকারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এমন কি অজু করার প্রক্রিয়া যা তেইশ বছর ধরে সাহাবাদের চোখের সামনে সম্পাদিত হয়েছে তাও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতএব যেখানে এ সুস্পষ্ট বিষয়টি ‎(যা মুসলমানদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বা আছে এবং এর পরিবর্তন ও বিকৃতির মধ্যে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য জড়িত ছিল না) ‏বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, ‏সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ও গোত্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জটিল ও সূক্ষ্ম নিয়মসমূহের বর্ণনার ক্ষেত্রে বিকৃতি ও ভ্রান্তির সম্ভাবনা অবশ্যই অধিকতর।৪এ বিষয়টির আলোকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ‏ইসলাম ধর্ম কেবলমাত্র তখনই এক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে পৃথিবীর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত মানুষের সকল প্রয়োজন ও প্রশ্নের জবাবদানে সক্ষম হবে যখন দ্বীনের মূলভাষ্যে, ‏সমাজের এ সকল কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধিত হবে, ‏যেগুলো মহানবী ‎(সা.)-এর ইন্তেকালের পর সংকট ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আর এ নিশ্চয়তা বিধানের পথ মহানবী ‎(সা.)-এর যোগ্য উত্তরসুরি নির্বাচন ব্যতীত কিছুই নয়। এ উত্তরসুরিকে একদিকে যেমন ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে, ‏যাতে দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন। অপরদিকে তেমনি দৃঢ়রূপে পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে,যাতে কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানী প্ররোচনায় প্রভাবিত না হন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীনের বিকৃতিতে লিপ্ত না হন। অনুরূপ মানব জাতির আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে মহানবী ‎(সা.)-এর দায়িত্ব স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিয়ে, ‏উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে পৌঁছে দিতেও তাঁরা বদ্ধপরিকর। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে সমাজের শাসন, ‏পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা, ‏বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তাঁরা গ্রহণ করে থাকেন।উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ‏নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি কেবলমাত্র তখনই প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে, ‏যখন এমন পবিত্র ইমামগণকে নিয়োগ করা হবে, ‏যাঁরা একমাত্র নবুয়্যত ব্যতীত মহানবী ‎(সা.)-এর সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন।আর এভাবেই একদিকে যেমন সমাজে ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হয়, ‏অপরদিকে তেমনি তাঁদের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্র মর্যাদাও। অনুরূপ মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন এ ধরনের জ্ঞান ও মর্যাদা কাকে দিয়েছেন এবং তিনিই বস্তুতঃ তাঁর বান্দাগণের উপর বিলায়াত ও কর্তৃত্বের অধিকার রাখেন। আর তিনিই এর অধিকার অপেক্ষাকৃত হ্রাসকৃত মাত্রায় উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে প্রদান করতে সক্ষম।এখানে স্মরণযোগ্য যে, ‏আহলে সুন্নাত কোন খলিফার ক্ষেত্রেই উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিকেই স্বীকার করেন না। মহান আল্লাহ্‌ ‏ও রাসূলের ‎(সা.) ‏পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়ার দাবি যেমন তারা তুলেন না, ‏তেমনি খলিফাগণের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রসঙ্গও তুলেন না। বরং মানুষের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দানের ক্ষেত্রে তাদের অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি ও অযোগ্যতার দৃষ্টান্ত তারা তাদের বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহে তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ প্রথম খলিফা প্রসঙ্গে ইবনে কুতাইবা রচিত ‎‘আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ’ ‏গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, ‏তিনি বলেছিলেন:«انّ لي شيطانا يعتريني»‘আমার পশ্চাতে এমন এক শয়তান বিদ্যমান যে আমাকে বিভ্রান্ত করে।’অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‏তিনি প্রথম খলিফার আনুগত্য স্বীকারকে ‎‘فلته’ ‏অর্থাৎ অবিলম্বকর্ম ও অবিবেচনাপূর্ণ কর্ম নামকরণ করেছেন।৫ অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা অসংখ্যবার এ বাক্যটি স্বীয় কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন:«لولاعليّ لهلك عمر»‘যদি আলী না থাকতেন, ‏তবে আমি ওমর ধ্বংস হয়ে যেতাম।’অর্থাৎ যদি আলী ‎(আ.) ‏না থাকতেন তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেতেন।৬ এছাড়া তৃতীয় খলিফা৭ এবং বনি উমাইয়্যা ও বনি আব্বাসের ভুল-ভ্রান্তির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখেনা। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে কেউ ন্যূনতম ধারণা নিলেই এ সম্পর্কে উত্তমরূপে পরিজ্ঞাত হতে পারবেন।একমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ই দ্বাদশ ইমামের ক্ষেত্রে এ শর্তত্রয়ে বিশ্বাসী। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইমামত প্রসঙ্গে তাদের বিশ্বাসের বৈধতা প্রমাণিত হয়। ‎#আল-বাসাইরমূল: ‏আয়াতুল্লাহ্‌ ‏মিসবাহ্‌ ‏ইয়াজদির অমুজেশে আকায়েদ গ্রন্থঅনুবাদ: ‏মোহাম্মাদ মাঈনুদ্দীনসঙ্কলন ও সম্পাদন: ‏আবুল কাসেমতথ্যসূত্র১. ‏আল আহ্‌কামুল সোলতানিয়াহ্‌, ‏লিখেছেন আবু ইয়ালা এবং ‎‘আস সাওয়াদুল আ’যাম’ ‏লিখেছেন আবুল কাশিম সামারক্বান্দি, ‏পৃঃ ৪০-৪২।২. ‏সৌভাগ্যবশতঃ বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ের উপর একাধিক ভাষায় ও একাধিক পদ্ধতিতে শতসহস্র গ্রন্থ রচনা করে সত্যানুসন্ধিৎসুগণের জন্যে গবেষণার পথকে বিস্তৃত করেছেন। উদাহরণতঃ আবাক্বাতুল আনওয়ার, ‏আল গাদির, ‏দালায়িলুস সিদক্ব, ‏গায়াতুল মারাম এবং ইসবাতুল হুদাহ ইত্যাদি গ্রন্থের নাম উল্লেখ যোগ্য।যারা পড়াশুনার যথেষ্ট সুযোগ পান না তারা ‎‘আল মুরাজিয়াত’ ‏নামক একটি বই, ‏যা শিয়া ও সুন্নী দু’জন মনীষীর মধ্যে বিনিময়কৃত পত্রসমূহের সমাহার, ‏তা পড়তে পারেন। সৌভাগ্যবশতঃ বইটি বাংলায় অনুদিত করা হয়েছে।৩. ‏বাকারাঃ ১৫১, ‏আলে-ইমরান-১৬৪, ‏জুমুআ’-২, ‏নাহল ‎-৬৪, ‏৬৪, ‏আহযাব- ‏২১, ‏হাশর ‎-৭।৪. ‏আল্লামা আমিনি ‎(র.) ‏সাতশতজন মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীর নাম তার ‎"আল গাদীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক লক্ষেরও অধিক হাদীসের বর্ণনাকারী রয়েছে ‎(আল গাদীর, ‏খণ্ড-৫ পৃঃ-২০৮)।৫. ‏শারহে নাহজুল বালাগাহ ‎: ‏ইবনে আবিল হাদিদ, ‏খণ্ড- ‏১, ‏পৃষ্ঠা-৮৫ খণ্ড-৪, ‏পৃঃ-২৩১-২৬২, ‏এবং আল গাদীর ‎: ‏খণ্ড ‎-৭, ‏পৃঃ-১০২-১৮০।৬. ‏ইবনে আবদুল বার, ‏আলইসতিয়াব, ‏৩য় খণ্ড, ‏পৃ.১১০৩; ‏শারহে নাহজুল বালাগাহ ‎: ‏খণ্ড ‎-১, ‏পৃঃ-১৪২-১৫৮ ‎, ‏খণ্ড-৩, ‏পৃঃ-৫৭।৭. ‏আল গাদীর ‎: ‏খণ্ড ‎- ‏৬, ‏পৃঃ ‎-৯৩ ও পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো।

ইমামত নবুওয়াতের নির্বাহী ক্ষমতার ধারাবাহিকতা

মহানবী (সা.) নবুয়্যত, রিসালাত এবং ইসলামের আহকাম প্রচার ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছাড়াও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দয়িত্বে ও নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকার্য ও সামরিক নেতৃত্ব ইত্যাদি এ থেকেই উৎকলিত হত। যেমনিকরে ইসলামে ইবাদত ও আচরণগত দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অধিকারগত ইত্যাদি কর্তব্যও বিদ্যমান, তেমনি করে ইসলামের নবী (সা.) প্রচার, প্রশিক্ষণ ও (আধ্যাত্মিক) পরিচর্যার দায়িত্ব ছাড়াও মহান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে ঐশী বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সকল প্রকার প্রশাসনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

এটা অনস্বীকার্য যে, যদি কোন দ্বীন বিশ্বের শেষাবধি সকল প্রকার সামাজিক কর্তব্য পালনের দাবি করে তবে এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। অনুরূপ যে সমাজ এ দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সমাজ এ ধরনের কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তব্য থেকে নিরুদ্দিষ্ট থাকবে, যা ইমামত নামে অভিষিক্ত, তাও হতে পারে না।

কিন্তু কথা হল মহানবী (সা.) এর তিরোধানের পর, কে এ দায়িত্ব লাভ করবেন? এবং তা কার কাছ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবেন? মহান আল্লাহ্‌ এ মর্যাদা যেরূপে মহানবীকে (সা.) দিয়েছিলেন সেরূপে অন্য কাউকেও কি দিয়েছেন? এ দায়িত্বভার অন্য কারও গ্রহণের কোন বৈধতা রয়েছে কি? নাকি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এ মর্যাদা মহানবী (সা.)-এর জন্যেই নির্ধারিত ছিল এবং অতঃপর মুসলিম জনতাই তাদের ইমাম নির্বাচন করবে ও তাকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্থান দিবে, তা-ও বিধিসম্মত? মানুষের কি এ ধরনের কোন অধিকার আছে? না নেই?

আর এটিই হল শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয়। অর্থাৎ একদিকে শিয়াদের বিশ্বাস যে ইমামত হল একটি ঐশী মর্যাদা, যা মহান আল্লাহ্‌ কর্তৃকই যথোপযুক্ত ও যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা আবশ্যক। আর মহান আল্লাহ্‌, মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে এ কর্মটি সম্পাদন করেছেন এবং আমীরুল মু’মীনিন আলীকে (আ.) তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষনা করেছেন। অতঃপর তাঁরই সন্তানদের মধ্য থেকে পরস্পরায় বারজনকে ইমামতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করছেন। অপরদিকে সুন্নি মাযহাবের বিশ্বাস নবী (সা.)-এর তিরোধানের মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগতের সাথে মানুষের সম্পর্ক কর্তিত হয়ে গেছে এবং মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় পৌঁছেছে। এখন তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে কোরআনকে বুঝতে ও তাদের পথকে চিনে নিতে পারে। তাই তাদের পথপ্রদর্শনের জন্য ঐশী কোন ব্যক্তির আর প্রয়োজন নাই। আর নবী (সা.) এর পর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্বও তাদের উপরই অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি আহলে সুন্নাতের কোন কোন বিজ্ঞজন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যদি কেউ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তবে তার আনুগত্য করাও অন্যান্যদের জন্যে অপরিহার্য!১ স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী, অত্যাচারী ও প্রতারকদের অপরাধের জন্যে কতটা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের অবক্ষয় ও বিভেদের পথে কতটা সহায়ক হয়েছে!

প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ঐশী সস্পর্কহীন ইমামতের বৈধতা দিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর শিয়া মাযহাবের বিশ্বাস, এটিই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সত্য সুন্দর পথ থেকে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুতির মূল কারণ। অনুরূপ শতসহস্র ধরনের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার সূতিকাগারও এখানেই, যেগুলো মহানবী (সা.) এর পরলোক গমনের পর থেকে মুসলমানদের মাঝে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং করবে।

অতএব প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই কোন প্রকার অন্ধ অনুকরণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যতিরেকে এ বিষয়টির উপর পরিপূর্ণ গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য।২ আর সেই সাথে সত্য ও সঠিক মাযহাবের শনাক্তকরণের মাধ্যমে এর প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।

উল্লেখ্য এ ব্যাপোরে ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রুদের জন্যে সুযোগ করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না যা ইসলামী সমাজে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হবে। আর এ ক্ষতির অংশীদার মুসলমানরাই হবে, যার ফলশ্রুতি মুসলিম সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা বৃদ্ধি ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য সংরক্ষণ যেন, সঠিক ও সত্য মাযহাবের অনুসন্ধান ও শনাক্তকরণের জন্যে, অনুসন্ধান ও গবেষণার সুষ্ঠ পথকে রুদ্ধ না করে ফেলে। আর ইমামতের বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুষ্ঠ পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধানের উপর মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে।

ইমামতের তাৎপর্য

ইমামতের আভিধানিক অর্থ হল নেতা, পথপ্রদর্শক এবং যে কেউ কোন জনসমষ্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহন করবে তাকেই ইমাম (امام) বলা হয়ে থাকে -হোক সে সত্য পথের অনুসারী কিংবা মিথ্যা পথের অনুসারী। যেমন: পবিত্র কোরানে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে (ائمة الكفر) অর্থাৎ কাফেরদের নেতারা (সূরা তওবাহ-১২) কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তদনুরূপ মুসুল্লীরা নামাজের জন্যে যার পিছনে সমবেত হয়ে থাকেন, তাকে ‘ইমামুল জামা’ত’ নামকরণ করা হয়।

কিন্তু কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ইমামত হল ইহ ও পরলৌকিক সকল বিষয়ে ইসলামী সমাজের সর্বময় ও বিস্তৃত নেতৃত্ব প্রদান। ইহলৌকিক শব্দটি ইমামতের পরিসীমার ব্যাপকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা ইসলামী সমাজে ইহলৌকিক বিষয়াদিও দ্বীন ইসলামেরই অন্তর্ভুক্ত।

শিয়া মাযহাবের মতে এ ধরনের নেতৃত্ব কেবলমাত্র তখনই বৈধ হবে, যখন তা মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অনুমোদিত হবে। আর প্রকৃতপক্ষে যিনি এ মর্যাদার অধিকারী হবেন, তিনি আহকাম ও ইসলাম পরিচিতির বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত থাকবেন। অনুরূপ তিনি সকল প্রকার গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবেন। বস্তুতঃ পবিত্র ইমাম, একমাত্র নবুয়্যত ও রিসালাত ব্যতীত মহানবীকে (সা.), মহান আল্লাহ্‌ প্রদত্ত সকল মর্যাদার অধিকারী হবেন। ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য যেমন নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য, তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়েও তাঁর আদেশ পালন করাও অপরিহার্য।

এভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:

প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

তৃতীয়তঃ ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে।

তবে মা’সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও (সালামুল্লাহ আলাইহা) মা’সুম ছিলেন, যদিও তিনি ইমামতের অধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম (আ.) ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহ্‌র ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, যদিও আমরা তাঁদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা’সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ্‌ কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাঁদেরকে চিনা সম্ভব নয়।

একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

বিশ্বাসগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন না এমন অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে, শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামত প্রসঙ্গে বিরোধ এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে শিয়াদের বিশ্বাস হলঃ মহানবী (সা.) ‘আলী ইবনে আবি তালিবকে’ (আ.) ইসলামী সমাজের পরিচালনার জন্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস যে, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং রাসূল (সা.) উম্মতকে কোন নেতা মনোনীত করা ছাড়াই ত্যাগ করেছিলেন। আর তাই তাঁর মৃত্যুর পর জনগণ নিজেদের পছন্দ মত প্রথম খলিফাকে নেতা নির্বাচন করেছিল। প্রথম খলিফা যদিও নিজে জনগণ কর্তৃক নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীকে নিজেই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব ছয় সদস্য বিশিষ্ট গোষ্ঠীর নিকট অর্পণ করা হয়েছিল। অপরদিকে চতুর্থ খলিফাও আবার প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন পন্থা ছিল না। ফলে চতুর্থ খলিফার পর যার সামরিক শক্তি অধিক ছিল, সে-ই এ স্থান দখল করেছিল, যেমন: অনৈসলামিক দেশসমূহেও মোটামুটি এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।

অন্যকথায়ঃ তারা এ রকম মনে করেন যে, প্রথম ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শীয়াদের বিশ্বাস সেরূপ, যেরূপ আহলে সুন্নাত প্রথম খলিফা কর্তৃক দ্বিতীয় খলিফার নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেন, পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, মহানবী (সা.) এর বক্তব্য মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, কিন্তু প্রথম খলিফার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল!

কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রথম খলিফা এ অধিকার কোথা থেকে পেয়েছিলেন? আল্লাহ্‌র রাসূল (সা.) (আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস মতে) ইসলামের জন্যে কেন তার (প্রথম খলিফা) মত আন্তরিকতা প্রদর্শন করেননি এবং নব গঠিত ইসলামী সমাজকে অভিভাবকহীন অবস্থায় রেখে গেলেন অথচ যুদ্ধের জন্যে মদীনা থেকে অন্যত্র যাওয়ার সময়ও একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এবং যেখানে স্বয়ং তিনিই (এ বিষয়ের উপর) তাঁর উম্মতদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তির সংবাদ দিয়েছিলেন? এছাড়া ও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূলতঃ মতবিরোধ সর্বাগ্রে এখানেই যে, ইমামত কি এক ধর্মীয় মর্যাদা, যা ঐশী বিধানের অনুগামী ও আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়? নাকি পার্থিব রাজকীয় বা অন্য কোন পদ মর্যাদা, যা সামাজিক নীতিমালার অনুগামী? শিয়াদের বিশ্বাস যে, স্বয়ং মহানবীও (সা.) নিজ থেকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেননি। বরং মহান আল্লাহ্‌ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েই এ কর্ম সম্পাদন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন পবিত্র ইমামগণের নিয়োগদানের সাথে সস্পর্কযুক্ত। আর এ ধরনের ইমামের উপস্থিতিতেই রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী সমাজের অপরিহার্য বিষয়াদির নিশ্চয়তা প্রদান করা যেতে পারে।

এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কেন শিয়া মাযহাবের মতে ইমামত ‘মূল বিশ্বাসগত’ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয় -শুধুমাত্র একটি ফিকাহ্‌গত গৌণ বিষয় নয়। আর সেই সাথে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কেন তারা তিনটি শর্ত (ঐশী জ্ঞান, ইসমাত ও আল্লাহ্‌ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) বিবেচ্য বলে মনে করেন এবং কেন শিয়া সাধারণের মধ্যে এ ভাবার্থগুলো ঐশী আহকাম, প্রশাসন ও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃত্বের ধারনার সাথে এমনভাবে মিশে আছে, যেন ইমামত শব্দটি এ ভাবার্থগুলোর সবগুলোকেই সমন্বিত করে।

এখন শিয়াদের সামগ্রিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, ইমামতের তাৎপর্য ও মর্যাদার আলোকে এর বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা

আমরা জানি খতমে নবুওয়াতের দর্শন হল এই যে, ইসলাম হল পবিত্র, চিরন্তন, সার্বজনীন ও অবিস্মৃত ধর্ম এবং ইসলামের নবী (সা.)-এর পর আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না। নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন, তখনই কেবলমাত্র নবীগণের আবির্ভাবের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে, যখন সর্বশেষ ঐশী শরীয়ত মানব মাযহাবের সকল প্রশ্নের জবাব প্রদানে সক্ষম হবে এবং বিশ্বের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এ শরীয়তের অটুট থাকার নিশ্চয়তা থাকবে।

উল্লেখিত নিশ্চয়তা পবিত্র কোরআনে রয়েছে এবং মহান আল্লাহ্‌ স্বয়ং সকল প্রকার বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে প্রিয় গ্রন্থের সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের সকল বিধি-বিধান কোরানের আয়াতের বাহ্যিক যুক্তি থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন: নামাযের রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি এবং আবশ্যকীয় ও অনাবশ্যকীয় এমন অসংখ্য বিধান রয়েছে, যেগুলোকে পবিত্র কোরান থেকে উদঘাটন করা অসম্ভব। সাধারণতঃ পবিত্র কোরানে আহকাম ও কানুন বিশদভাবে বর্ণিত হয়নি। ফলে এগুলোর প্রশিক্ষণ ও সুস্পষ্ট বর্ণনার দায়িত্ব মহানবী (সা.)-এর উপর অর্পণ করা হয়েছে, যাতে তিনি মহান আল্লাহ্‌ প্রদত্ত জ্ঞানের (কোরআনের ওহী ব্যতীত) মাধ্যমে ঐগুলোকে মানুষের জন্যে বর্ণনা করেন।৩ আর এভাবে ইসলাম পরিচিতির প্রকৃত উৎস হিসেবে তাঁর সুন্নাহ বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিন্তু হযরত (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রচার কর্ম শুরুর পর দশ বছর ধরে নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে ছিলেন, অতঃপর আবি তালিবের উপত্যকায় কয়েক বছরের বন্দীদশা কাটিয়েছেন, মদীনায় হিজরতের পর শত্রুদের সাথে দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ ইত্যাদির মত জীবনের সংকটময় মুহূর্তগুলো সাধারণ মানুষের জন্যে ইসলামের বিভিন্ন আহ‌কাম, বর্ণনার পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। অপর দিকে সাহাবাগণ যা শিখতেন তা সংরক্ষিত থাকারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এমন কি অজু করার প্রক্রিয়া যা তেইশ বছর ধরে সাহাবাদের চোখের সামনে সম্পাদিত হয়েছে তাও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতএব যেখানে এ সুস্পষ্ট বিষয়টি (যা মুসলমানদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বা আছে এবং এর পরিবর্তন ও বিকৃতির মধ্যে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য জড়িত ছিল না) বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ও গোত্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জটিল ও সূক্ষ্ম নিয়মসমূহের বর্ণনার ক্ষেত্রে বিকৃতি ও ভ্রান্তির সম্ভাবনা অবশ্যই অধিকতর।৪

এ বিষয়টির আলোকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলাম ধর্ম কেবলমাত্র তখনই এক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে পৃথিবীর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত মানুষের সকল প্রয়োজন ও প্রশ্নের জবাবদানে সক্ষম হবে যখন দ্বীনের মূলভাষ্যে, সমাজের এ সকল কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধিত হবে, যেগুলো মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর সংকট ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আর এ নিশ্চয়তা বিধানের পথ মহানবী (সা.)-এর যোগ্য উত্তরসুরি নির্বাচন ব্যতীত কিছুই নয়। এ উত্তরসুরিকে একদিকে যেমন ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে, যাতে দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন। অপরদিকে তেমনি দৃঢ়রূপে পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে,যাতে কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানী প্ররোচনায় প্রভাবিত না হন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীনের বিকৃতিতে লিপ্ত না হন। অনুরূপ মানব জাতির আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর দায়িত্ব স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিয়ে, উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে পৌঁছে দিতেও তাঁরা বদ্ধপরিকর। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে সমাজের শাসন, পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তাঁরা গ্রহণ করে থাকেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি কেবলমাত্র তখনই প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে, যখন এমন পবিত্র ইমামগণকে নিয়োগ করা হবে, যাঁরা একমাত্র নবুয়্যত ব্যতীত মহানবী (সা.)-এর সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন।

আর এভাবেই একদিকে যেমন সমাজে ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হয়, অপরদিকে তেমনি তাঁদের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্র মর্যাদাও। অনুরূপ মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন এ ধরনের জ্ঞান ও মর্যাদা কাকে দিয়েছেন এবং তিনিই বস্তুতঃ তাঁর বান্দাগণের উপর বিলায়াত ও কর্তৃত্বের অধিকার রাখেন। আর তিনিই এর অধিকার অপেক্ষাকৃত হ্রাসকৃত মাত্রায় উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে প্রদান করতে সক্ষম।

এখানে স্মরণযোগ্য যে, আহলে সুন্নাত কোন খলিফার ক্ষেত্রেই উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিকেই স্বীকার করেন না। মহান আল্লাহ্‌ ও রাসূলের (সা.) পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়ার দাবি যেমন তারা তুলেন না, তেমনি খলিফাগণের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রসঙ্গও তুলেন না। বরং মানুষের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দানের ক্ষেত্রে তাদের অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি ও অযোগ্যতার দৃষ্টান্ত তারা তাদের বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহে তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ প্রথম খলিফা প্রসঙ্গে ইবনে কুতাইবা রচিত ‘আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, তিনি বলেছিলেন:

«انّ لي شيطانا يعتريني»

‘আমার পশ্চাতে এমন এক শয়তান বিদ্যমান যে আমাকে বিভ্রান্ত করে।’

অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তিনি প্রথম খলিফার আনুগত্য স্বীকারকে ‘فلته’  অর্থাৎ অবিলম্বকর্ম ও অবিবেচনাপূর্ণ কর্ম নামকরণ করেছেন।৫ অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা অসংখ্যবার এ বাক্যটি স্বীয় কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন:

«لولاعليّ لهلك عمر»

‘যদি আলী না থাকতেন, তবে আমি ওমর ধ্বংস হয়ে যেতাম।’

অর্থাৎ যদি আলী (আ.) না থাকতেন তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেতেন।৬ এছাড়া তৃতীয় খলিফা৭ এবং বনি উমাইয়্যা ও বনি আব্বাসের ভুল-ভ্রান্তির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখেনা। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে কেউ ন্যূনতম ধারণা নিলেই এ সম্পর্কে উত্তমরূপে পরিজ্ঞাত হতে পারবেন।

একমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ই দ্বাদশ ইমামের ক্ষেত্রে এ শর্তত্রয়ে বিশ্বাসী। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইমামত প্রসঙ্গে তাদের বিশ্বাসের বৈধতা প্রমাণিত হয়। #আল-বাসাইর

মূল: আয়াতুল্লাহ্‌ মিসবাহ্‌ ইয়াজদির অমুজেশে আকায়েদ গ্রন্থ

অনুবাদ: মোহাম্মাদ মাঈনুদ্দীন

সঙ্কলন ও সম্পাদন: আবুল কাসেম

তথ্যসূত্র

১. আল আহ্‌কামুল সোলতানিয়াহ্‌, লিখেছেন আবু ইয়ালা এবং ‘আস সাওয়াদুল আ’যাম’ লিখেছেন আবুল কাশিম সামারক্বান্দি, পৃঃ ৪০-৪২।

২. সৌভাগ্যবশতঃ বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ের উপর একাধিক ভাষায় ও একাধিক পদ্ধতিতে শতসহস্র গ্রন্থ রচনা করে সত্যানুসন্ধিৎসুগণের জন্যে গবেষণার পথকে বিস্তৃত করেছেন। উদাহরণতঃ আবাক্বাতুল আনওয়ার, আল গাদির, দালায়িলুস সিদক্ব, গায়াতুল মারাম এবং ইসবাতুল হুদাহ ইত্যাদি গ্রন্থের নাম উল্লেখ যোগ্য।

যারা পড়াশুনার যথেষ্ট সুযোগ পান না তারা ‘আল মুরাজিয়াত’ নামক একটি বই, যা শিয়া ও সুন্নী দু’জন মনীষীর মধ্যে বিনিময়কৃত পত্রসমূহের সমাহার, তা পড়তে পারেন। সৌভাগ্যবশতঃ বইটি বাংলায় অনুদিত করা হয়েছে।

৩. বাকারাঃ ১৫১, আলে-ইমরান-১৬৪, জুমুআ’-২, নাহল -৬৪, ৬৪, আহযাব- ২১, হাশর -৭।

৪. আল্লামা আমিনি (র.) সাতশতজন মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীর নাম তার "আল গাদীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক লক্ষেরও অধিক হাদীসের বর্ণনাকারী রয়েছে (আল গাদীর, খণ্ড-৫ পৃঃ-২০৮)।

৫. শারহে নাহজুল বালাগাহ : ইবনে আবিল হাদিদ, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা-৮৫ খণ্ড-৪, পৃঃ-২৩১-২৬২, এবং আল গাদীর : খণ্ড -৭, পৃঃ-১০২-১৮০।

৬. ইবনে আবদুল বার, আলইসতিয়াব, ৩য় খণ্ড, পৃ.১১০৩; শারহে নাহজুল বালাগাহ : খণ্ড -১, পৃঃ-১৪২-১৫৮ , খণ্ড-৩, পৃঃ-৫৭।

৭. আল গাদীর : খণ্ড - ৬, পৃঃ -৯৩ ও পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদপবিত্র কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর হাদিস থেকে আমিরুল মোমেনীন আলী ইবনে আবি তালিব আঃ এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিসমহানবী হযরত মুহাম্মদ ‎(সা.)-এর উত্তরাধিকারী,তাঁর নবুওয়াতের মিশনের প্রধান সাহায্যকারী এবং দুনিয়া ও আখেরাতে রাসূলের ভ্রাতা আলী ‎(আ.) ‏আবরাহার পবিত্র মক্কা আক্রমণের ৩৩ বছর পর ১৩ রজব পবিত্র কা’বা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। মহান আল্লাহর আদেশে তাঁর নাম রাখা হয় আলী।শিশুকাল থেকেই মহানবী ‎(সা.)-এর সাথে হযরত আলীর বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কে আলী ‎(আ.) ‏নিজেই বলেছেন ‎: ‘...তিনি আমাকে তাঁর কোলে রাখতেন যখন আমি শিশু ছিলাম। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং তাঁর বিছানায় শুইয়ে রাখতেন। তাঁর পবিত্র দেহ আমার দেহকে স্পর্শ করত এবং তিনি আমাকে তাঁর শরীরের সুগন্ধির ঘ্রাণ নেওয়াতেন। তিনি খাদ্য-দ্রব্য চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন।...’১হযরত আবু তালিবের সংসারের ব্যয়ভার কমানোর জন্য হযরত আলীর বালক বয়সেই মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখন থেকে তিনি রাসূলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে যান। রাসূল হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর ইবাদাত করতে গেলেও তাঁকে সাথে নিয়ে যেতেন। হযরত আলী বলেন ‎: ‘তিনি ‎(মহানবী) ‏প্রতি বছর হেরাগুহায় একান্ত নির্জনে বাস করতেন। আমি তাঁকে দেখতাম। আমি ব্যতীত আর কোন লোকই তাঁকে দেখতে পেত না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ ও খাদীজাহ্ ব্যতীত কোন মুসলিম পরিবারই পৃথিবীর বুকে ছিল না। আমি ছিলাম তাঁদের পরিবারের তৃতীয় সদস্য। আমি ওহী ও রেসালতের আলো প্রত্যক্ষ করেছি এবং নবুওয়াতের সুবাস ও সুঘ্রাণ অনুভব করেছি।’২তিনি মহানবীর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করতেন। তিনি বলেন ‎: ‘উষ্ট্র শাবক যেমনভাবে উষ্ট্রীকে অনুসরণ করে ঠিক সেভাবে আমি তাঁকে অনুসরণ করতাম। তিনি প্রতিদিন তাঁর উন্নত চরিত্র থেকে একটি নিদর্শন আমাকে শিক্ষা দিতেন এবং আমাকে তা পালন করার নির্দেশ দিতেন।... ‏তাঁর ওপর যখন ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল তখন আমি শয়তানের ক্রন্দন ধ্বনি শুনেছিলাম। তাই আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‎: ‏হে রাসূলুল্লাহ্! ‏এ ক্রন্দন ধ্বনি কার? ‏তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন ‎: ‏এই শয়তান এখন থেকে তার পূজা ‎(ইবাদাত) ‏করা হবে না বলে হতাশ হয়ে গেছে। নিশ্চয় আমি যা শুনি তুমি তা শোন এবং আমি যা দেখি তা দেখ। তবে তুমি নবী নও,কিন্তু ‎[নবীর] ‏সহকারী এবং নিঃসন্দেহে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণের ওপরই আছ।’৩আর তাই মহানবী ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর ওপর ঈমান আনেন এবং তিনিই তাঁর সাথে নামায আদায় করা প্রথম ব্যক্তি। ইমাম মালেক বর্ণনা করেছেন ‎: ‘মহানবী ‎(সা.) ‏সোমবারে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন এবং আলী মঙ্গলবারে তাঁর ওপর ঈমান আনেন।’৪হযরত আলী নিজেই বলেন ‎: ‘আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূলের ভ্রাতা এবং তাঁর নবুওয়াতের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসস্থাপনকারী। একমাত্র মিথ্যাবাদী ছাড়া আমার পর কেউ এ দাবি করবে না। অন্য লোকদের নামায পড়ারও ৭ বছর আগে থেকে আমি নামায পড়েছি।’৫হযরত আলী ‎(আ.)-এর প্রসিদ্ধ উপাধিরাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে সিদ্দিকে আকবার,ফারুকে আযম,আসাদুল্লাহ ও মুরতাজা।পবিত্র কুরআনে হযরত আলী ‎(আ.)-এর মর্যাদাহযরত আলীর শানে পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,কোন ব্যক্তির গুণ বর্ণনায় এত অধিক কুরআনের বাণী অবতীর্ণ হয়নি যা হযরত আলী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস আরও বলেছেন যে,হযরত আলীর শানে তিনশ’ ‏আয়াত নাযিল হয়েছে এবং তাঁর গুণাবলি অত্যধিক ও প্রসিদ্ধ।৬ পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত আয়াতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াতوَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ‘এবং মানুষের মধ্যে এমনও আছে,যে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিক্রয় করে দেয় এবং আল্লাহ ‎(এরূপ) ‏বান্দাদের প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল।’সালাবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিলেন সেই সময় হযরত আলীকে তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকার নির্দেশ দেন যাতে কাফির-মুশরিকরা মনে করে যে,রাসূল তাঁর নিজ ঘরেই রয়েছেন। আলী ‎(আ.) ‏নির্দ্বিধায় এ নির্দেশ পালন করলে মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন।৭ ২. ‏সূরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াতفَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ‘অতঃপর তোমার নিকট যখন জ্ঞান ‎(কুরআন) ‏এসে গেছে,এরপরও যদি কেউ ‎(খ্রিস্টান) ‏তোমার সাথে তার ‎(ঈসার) ‏সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করে,তবে বল,‘(ময়দানে) ‏এস,আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের ও তোমাদের পুত্রদের,আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের সত্তাদের ও তোমাদের সত্তাদের;’ ‏অতঃপর সকলে মিলে ‎(আল্লাহর দরবারে) ‏নিবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি।’ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের সত্যতা যাচাই করার জন্য নাজরানের একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল মদীনায় আসল। তাদের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ হলো না। রাসূল ‎(সা.) ‏হযরত ঈসা ‎(আ.) ‏সম্বন্ধে প্রতিনিধিদের বললেন যে,তিনি আল্লাহর পুত্র নন,বরং আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। রাসূলুল্লাহ্ হযরত ঈসার জন্মের ব্যাপারে হযরত আদমের উদাহরণও দিলেন। কিন্তু তারা কোন কথাই শুনল না। অবশেষে তিনি আল্লাহর আদেশে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোয়া ও মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিশাপ বর্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন,যাকে ‎‘মুবাহিলা’ ‏বলে। স্থির করা হল যে,নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে উভয়ে নিজ নিজ পুত্রদের,নারীদের ‎(কন্যা সন্তানদের) ‏এবং তাদের নিজেদের ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে একত্র হবে এবং প্রত্যেকে অপরের প্রতি অভিসম্পাত ও আল্লাহর শাস্তি কামনা করবে। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হুসাইনকে কোলে নিয়ে ইমাম হাসানের হাত ধরলেন এবং হযরত ফাতিমাকে নিজের পেছনে,আর হযরত আলীকে তাঁর পেছনে রাখলেন। অর্থাৎ ছেলেদের স্থানে তিনি নাতিদের,নারীদের স্থানে নিজ কন্যাকে এবং ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্যদের স্থানে আলীকে নিলেন এবং দোয়া করলেন,‘হে আল্লাহ! ‏প্রত্যেক নবীর আহলে বাইত থাকে,এরা আমার আহলে বাইত। এদের সকল দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত ও পাক-পবিত্র রেখ।’ ‏তিনি এভাবে ময়দানে পৌঁছলে খ্রিস্টানদের নেতা আকব তা দেখে বলল,‘আল্লাহর কসম,আমি এমন নূরানী চেহারা দেখছি যে,যদি এ পাহাড়কে নিজ স্থান হতে সরে যেতে বলেন,তবে অবশ্যই সরে যাবে। সুতরাং মুবাহিলা হতে হাত গুটিয়ে নেওয়াই কল্যাণকর,অন্যথায় কিয়ামত অবধি খ্রিস্টানদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।’ ‏পরিশেষে তারা জিযিরা কর দিতে সম্মত হল। এটা হযরত আলীর একটি উঁচু স্তরের ফযিলত যে,তিনি আল্লাহর আদেশে রাসূলের ‎‘নাফ্স’ (অনুরূপ সত্তা) ‏সাব্যস্ত হলেন এবং সমুদয় নবীর থেকে শ্রেষ্ঠ হলেন।৮৩. ‏সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াত ‎يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ‘হে বিশ্বাসিগণ! ‏তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যে যারা নির্দেশের অধিকর্তা,তাদের আনুগত্য কর...।’ইমাম জাফর সাদিক ‎(আ.)- ‏কে জিজ্ঞেস করা হলো যে,উত্তরাধিকারীর আদেশ মান্য করা কি অবশ্যই কর্তব্য? ‏তিনি বললেন ‎: ‏হ্যাঁ,তাঁরা ঐসব ব্যক্তি যাঁদের আদেশ পালন করা এ আয়াতে ওয়াজিব করা হয়েছে...। এ আয়াত হযরত আলী বিন আবি তালিব,হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন ‎(আ.)-এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে।৯ ৪. ‏সূরা মায়েদার ৫৫ নং আয়াতإِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ‘(হে বিশ্বাসিগণ!) ‏তোমাদের অভিভাবক তো কেবল আল্লাহ,তাঁর রাসূল এবং সেই বিশ্বাসীরা যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করে।’শীয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের তফসীরকাররা একমত যে,আয়াতটি হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে। যেমন ইবনে মারদুইয়া এবং খাতীব বাগদাদী ইবনে আব্বাস সূত্রে এবং তাবরানী ও ইবনে মারদুইয়া আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আলী ইবনে আবি তালিব সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি আলী ইবনে আবি তালিব ‎(আ.) ‏সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে যখন তিনি রুকু অবস্থায় যাকাত দেন।ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏একদিন হযরত আলী ‎(আ.) ‏মদীনার মসজিদে নামায পড়ছিলেন। এমন সময় একজন ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইল। কিন্তু কোন ভিক্ষা না পাওয়ায় সে ফরিয়াদ করল যে,রাসূলের মসজিদ থেকে সে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। এ সময় হযরত আলী রুকু অবস্থায় ছিলেন। তিনি সেই অবস্থায় তাঁর ডান হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নেওয়ার জন্য ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করেন। ভিক্ষুক তাঁর হাত থেকে আংটি খুলে নেয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে উপরিউক্ত আয়াত নাযিল হয়।১০৫. ‏সূরা মায়েদার ৬৭ নং আয়াতيَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ‘হে রাসূল! ‏যা ‎(যে আদেশ) ‏তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দাও,আর যদি তুমি তা না কর,তবে তুমি ‎(যেন) ‏তার কোন বার্তাই পৌঁছাওনি,এবং ‎(তুমি ভয় কর না) ‏আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন;এবং নিশ্চয় আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালিত করেন না।’যখন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏দশম হিজরিতে বিদায় হজ্ব থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন সে সময় আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। ইবনে আবী হাতিম ও ইবনে আসাকির আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণনা করেছেন যে,এ আয়াত গাদীরে খুম প্রান্তরে হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে।বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করার সময় গাদীরে খুম নামক স্থানে মহানবী ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে তাঁর পরে সকল মুমিনের অভিভাবক বলে ঘোষণা দেন।১১এ ঘোষণা দেয়ার পর হযরত ওমর হযরত আলীর সাথে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানান এবং বলেন ‎: ‘হে আলী ইবনে আবি তালিব! ‏আপনি আজ হতে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর মাওলা হয়ে গেলেন।’১২৬. ‏সূরা রাদের ৭ নং আয়াতإِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ‘(হে রাসূল!) ‏তুমি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে এক পথ প্রদর্শক।’ইবনে মারদুইয়্যা,ইবনে জারীর,আবু নাঈম তাঁর ‎‘মারেফাত’ ‏গ্রন্থে,ইবনে আসাকির,দাইলামী ও ইবনে নাজ্জার তাঁদের স্ব স্ব গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি নাযিল হলে মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁর হাত নিজের বুকে রেখে বললেন,‘আমিই সতর্ককারী।’ ‏অতঃপর আলীর কাঁধের প্রতি তাঁর হাত দ্বারা ইশারা করে বললেন,‘হে আলী! ‏তুমিই পথপ্রদর্শক এবং মানুষ আমার পর তোমার মাধ্যমে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।’ ‏উক্ত রেওয়ায়েতটি শব্দের তারতম্যে ইবনে মারদুইয়্যা সাহাবী আবু বারযাহ আসলামী হতে,জীয়াফীল হযরত ইবনে আব্বাস হতে,ইবনে আহমাদ তাঁর মুসনাদে এবং ইবনে মারদুইয়্যা ও ইবনে আসাকির স্বয়ং হযরত আলী ‎(আ.) ‏হতে বর্ণনা করেছেন।১৩৭. ‏সূরা রাদের ৪৩ নং আয়াতوَيَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَسْتَ مُرْسَلًا قُلْ كَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَمَنْ عِنْدَهُ عِلْمُ الْكِتَابِযারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে,‘তুমি আল্লাহর রাসূল নও।’ ‏তুমি বল,‘আমার ও তোমাদের মধ্যে ‎(রেসালাতের) ‏সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সেই ব্যক্তি যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান রয়েছে।’অধিকাংশ তাফসীরকার স্বীকার করেছেন যে,আয়াতে বর্ণিত সেই ব্যক্তি হলেন হযরত আলী ‎(আ.)। যেমন আসমী ‎‘যায়নুল ফাতা’ ‏নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং সা’লাবী আবদুল্লাহ ইবনে আতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,আবদুল্লাহ বিন সালাম বলতেন,‘যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান আছে’-এর উদ্দিষ্ট হযরত আলী ‎(আ.)। এজন্যই হযরত আলী ‎(আ.) ‏বারবার বলতেন,‘আমার কাছে আমার মৃত্যুর পূর্বে যা চাও জিজ্ঞেস কর।’১৪৮. ‏সূরা নাহলের ৪৩ নং আয়াতوَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَতোমার পূর্বেও আমরা কেবল পুরুষদেরই ‎(রাসূল করে) ‏প্রেরণ করেছি যাদের প্রতি আমরা প্রত্যাদেশ প্রেরণ করতাম;যদি তোমরা না জেনে থাক তবে যারা জানে তাদের জিজ্ঞেস কর।আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন ‎: ‏জ্ঞানী ব্যক্তিরা অর্থাৎ আহলুয যিকর হলেন হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.),হযরত আলী ‎(আ.),হযরত ফাতেমা ‎(আ.),হযরত হাসান ও হুসাইন ‎(আ.)। যাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেছেন ‎: ‏যখন এই আয়াত নাযিল হল তখন হযরত আলী বললেন ‎: ‏আমরাই হলাম জ্ঞানের ভাণ্ডার।১৫৯. ‏সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতوَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا‘হে নবী পরিবার! ‏আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামার ঘরে এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত ফাতিমা,ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ‎(আ.)-কে ডাকেন এবং তাঁদেরকে একটি চাদরে ঢেকে নেন। হযরত আলী তাঁর পেছনে ছিলেন। তিনি তাঁকেও চাদরে ঢেকে নেন। অতঃপর বলেন ‎: ‘হে আল্লাহ্! ‏এরা আমার আহলে বাইত। অতএব,তুমি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে দাও এবং তাদেরকে উত্তমরূপে পবিত্র কর।’ ‏তখন উম্মে সালামা বলেন ‎: ‘হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমিও কি তাদের অন্তর্ভুক্ত?’ ‏তিনি বলেন ‎: ‘তুমি স্ব স্থানে আছ এবং তুমি কল্যাণের মধ্যেই আছ।’১৬হযরত উম্মে সালামা ছাড়াও হযরত আবু সাঈদ খুদরী ও আনাস ইবনে মালিক কর্তৃক এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।১৭১০. ‏সূরা শূরার ২৩ নং আয়াতقُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى‘বল,আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা ছাড়া আর কোন প্রতিদান চাই না।’রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নিকটাত্মীয় আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি ভালবাসা পোষণকে এ আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য ফরয বলে ঘোষণা করেন।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন ‎: ‏যখন এ আয়াত নাযিল হল তখন সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন,হে রাসূলুল্লাহ! ‏আপনার নিকটাত্মীয়,যাদেরকে ভালবাসা আমাদের ওপর ওয়াজিব করা হয়েছে তারা কারা? ‏রাসূল ‎(সা.) ‏বললেন ‎: ‏আলী,ফাতেমা,হাসান ও হুসাইন।১৮রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর হাদীসে আলী ‎(আ.)হযরত আলীর মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী ‎(সা.)-এর নিকট থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বলেন,নবী ‎(সা.) ‏তাবুক যুদ্ধের সময় আলীকে লক্ষ্য করে বলেছেন ‎: ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে,মর্যাদার দিক থেকে মূসার নিকট হারুন যে পর্যায়ে ছিলেন,তুমিও আমার নিকট ঐ পর্যায়ে রয়েছ?’১৯২. ‏অন্য একটি হাদীসে এসেছে ‎: ‏রাসূল বলেন ‎: ‘তুমি তো আমার নিকট তদ্রূপ যেরূপ হারুনের স্থান মূসার নিকট। পার্থক্য এতটুকু যে,আমার পরে কোন নবী নেই।’২০৩. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হাসান ও হুসাইনের হাত ধরে বলেন ‎: ‘যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসে এবং এ দু’জন ও তাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসে,সে কিয়ামতের দিন আমার সাথে একই মর্যাদায় অবস্থান করবে।’২১৪. ‏আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত। রাসূল বলেছেন ‎: ‘আলীর চেহারার দিকে তাকানোও ইবাদত।’২২৫. ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.) ‏আলী ‎(আ.)-কে সম্বোধন করে বলেছিলেন ‎: ‘মুমিনরাই তোমাকে মহব্বত করবে এবং মুনাফিকরাই তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে।’২৩৬. ‏তিরমিযী,নাসাঈ ও ইবনে মাযাহ হুবশী ইবনে জুনাদাহ্ ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূল ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘আলী আমা থেকে এবং আমি আলী থেকে। যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আমাকে ভালোবেসেছে। আর যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আল্লাহকে ভালবেসেছে। যে ব্যক্তি আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে সে আমার সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে। আর যে আমার শত্রু সে আল্লাহর শত্রু। যে ব্যক্তি আলীকে কষ্ট দিয়েছে,সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে।’২৪৭. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‘(হে আলী!) ‏দুনিয়া ও আখেরাতে তুমি আমারই ভাই।’২৫৮. ‏আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা ‎(র.) ‏থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘চার ব্যক্তিকে ভালবাসতে আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন এবং তিনি আমাকে এও অবহিত করেছেন যে,তিনিও তাদের ভালবাসেন। বলা হল ‎: ‏হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমাদের তাদের নামগুলো বলুন। তিনি বলেন ‎: ‏আলীও তাদের অন্তর্ভুক্ত। এ কথা তিনি তিনবার বলেন। ‎(অবশিষ্ট তিনজন হলেন) ‏আবু যার,মিকদাদ ও সালমান।...’২৬৯. ‏জাবির ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏তায়েফ অভিযানের দিন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏আলীকে কাছে ডেকে তার সাথে চুপিসারে আলাপ করেন। লোকেরা বলল ‎: ‏তিনি তাঁর চাচাত ভাইয়ের সাথে দীর্ঘক্ষণ চুপিসারে কথা বললেন। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‏আমি তার সাথে চুপিসারে কথা বলিনি;বরং আল্লাহই তার সাথে চুপিসারে কথা বলেছেন। ‎(অর্থাৎ তার সাথে চুপিসারে কথা বলার জন্য আল্লাহ্ই আমাকে আদেশ করেছেন।)২৭হযরত আলী সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীহযরত আবু বকর প্রায়ই হয়রত আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। হযরত আয়েশা এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন ‎: ‘আমি রাসূলে করীমকে বলতে শুনেছি,আলীর মুখ দেখা ইবাদাতের শামিল।’২৮হযরত উমর বিন খাত্তাব বলতেন,হযরত আলী বিন আবি তালিবের তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল। যদি তার একটি আমার থাকত তাহলে আমি বলতাম যে,আমাকে লাল রঙের একটি উট দেয়া হলে তা অপেক্ষাও আমি তা পছন্দ করতাম। তাঁকে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ‎: ‏১.তাঁর বিয়ে হয় রাসূল ‎(সা.)-এর কন্যার সাথে,২. ‏তাঁর সঙ্গে রাসূলে করীমের মসজিদে অবস্থান এবং যা রাসূলে করিমের জন্য বৈধ ছিল তার জন্যও তা বৈধ ছিল এবং ৩. ‏খায়বার যুদ্ধের পতাকা বহনের দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল।২৯হযরত উমর বলেছেন,হে আল্লাহ! ‏আমার ওপর এমন কোন বিপদ দিও না যখন আবুল হাসান ‎(আলী) ‏আমার নিকট উপস্থিত না থাকে। কারণ,তিনি আমার নিকট উপস্থিত থাকলে আমাকে সে বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দেবেন।’৩০তাবরানী হযরত ইবনে আব্বাস থেকে রেওয়ায়াত করেছেন যে,হযরত আলীর আঠারটি বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যা সমগ্র উম্মতের কারও ছিল না।’৩১তথ্যসূত্র১. ‏মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত নাহজ আল বালাঘা,২য় মুদ্রণ,আল খুতবাতুল কাসেয়াহ্,খুতবা নং ১৯১২. ‏প্রাগুক্ত৩. ‏প্রাগুক্ত৪. ‏মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১১২;এটি ইমাম মালেক কর্তৃক বর্ণিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হেরা গুহায় জিবরাঈল ‎(আ.) ‏কর্তৃক রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নবুওয়াত ঘোষণার পর পরই হযরত আলী ‎(আ.) ‏তাঁর ঈমান আনার বিষয়টি প্রকাশ করেন।৫. ‏সুনানে ইবনে মাজাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৪৪৬. ‏নূর-এ-সাকালাইন কর্তৃক প্রকাশিত,সাইয়্যেদ আলী জাফরী প্রণীত আল মুরতাজা,পৃ. ‏৩০।৭. ‏এহইয়াউ উলুমিদ্দীন,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২৩৮;নুরুল আবসার,পৃ. ‏৮৬,মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৭১;তাযকিরাতু সিবতে ইবনে যাওযী,পৃ. ‏২১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏৯২।৮. ‏তাফসীরে জালালাইন,১ম খণ্ড,পৃ.৬০;বায়দ্বাভী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১১৮,তাফসীরে দুররুল মানসুর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৯,মিশর মুদ্রণ;মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৫;৯. ‏মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏২১;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪৮;তাফসীরে ফুরাত,পৃ.২৮১০. ‏তাফসীরে তাবারী,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৬৫;তাফসীরে রাযী,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪৩১;মানাকেবে খাওয়ারেযমী,পৃ. ‏১৭৮;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏১০২;তাফসীরে ইবনে কাসীর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৭১;আল- ‏বেদায়া ওয়ান নেহায়া,৭ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৫৭;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏২৫;১১. ‏মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৩৭২;ইমাম নাসাঈ প্রণীত খাসায়েসে আমীরুল মুমিনীন,পৃ. ‏২১;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১০৯;আল গাদীর,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২১৪ ও ২২৯;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৭ ।১২. ‏তাফসীরে তাবারী,৩য় খণ্ড,মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল,৩য় খণ্ড,দারে কুতনী।১৩. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৪৫ দ্রষ্টব্য।১৪. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৬৯ ।১৫. ‏কেফাইয়াতুল মুওয়াহহিদীন,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৬৫০;মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৪১৩;কানযুল উম্মাল,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৫৬;তাফসীরে তাবারী,১৪তম খণ্ড,পৃ. ‏১০৮ ।১৬. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৭২৫,পৃ. ‏৩৫৯ ।১৭. ‏মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৩১;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏২১,তাফসীরে তাবারী,২২তম খণ্ড,পৃ. ‏৮;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২০৮;ফাজায়েলে খামসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৪;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১০ ।১৮. ‏যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏৯ ও ১২;তাফসীরে যামাখশারী,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৩৯;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১০১,তাফসীরে দুররুল মানসূর,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏৭;মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৯;আল গাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১৭২;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩০ ।১৯. ‏আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী,৩য় খণ্ড,হাদীস নং ৩৪৩১;বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪২ ।২০. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪০ ও জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৬৮ ।২১. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭০২২. ‏এমদাদীয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ইবনে আবি তালিব ‎(রা.),পৃ. ‏১৫ ।২৩. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭৩ ।২৪. ‏এমদাদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ‎(রা.),পৃ. ‏১৫-১৬ ।২৫. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৫৮;২৬. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৫৬;২৭. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৬৪২৮. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১৭৫ ।২৯. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,৩য় খণ্ড,এবং মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড ।৩০. ‏মুনতাখাবে কানজুল উম্মাল,৩য় খণ্ড ।৩১. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ ১১৩ ।(প্রত্যাশা,৩য় বর্ষ, ‏১ম সংখ্যাপ্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

শিশু ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ.)'র জন্মবার্ষিকীসকল মোমিন মোমিনা কে জানাই ঈদ মোবারক🎂🎂🎂🎂🎂(((পর্ব ১)))🎂🎂🎂🎂🎂দশই রজব ইসলামের মহাখুশির দিন। এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন মাওলা মোহাম্মদ (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য নবম ইমাম হযরত জাওয়াদ বা তাকি(আ)। নবীজীর আহলে বাইতের সদস্যরা কেবল মুসলমানদেরই ধর্মীয় নেতা নন বরং যারাই সত্য পথের সন্ধানী কিংবা কল্যাণকামী-তাদের সবারই নেতা।আহলে বাইতের এই মহান ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ) এর জন্ম-বার্ষিকীতে আপনাদের সবার প্রতি রইলো অশেষ অভিনন্দন ও প্রাণঢালা মোবারকবাদ এবং মাওলা মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম ।ইমাম জাওয়াদের জন্ম হয়েছিল ১৯৫ হিজরিতে তথা ৮১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল পবিত্র মদীনায়। মজলুম ও দরিদ্রদের প্রতি ব্যাপক দানশীলতা ও দয়ার জন্য তিনি 'জাওয়াদ' উপাধি পেয়েছিলেন। তাকি বা খোদাভীরু ছিল তাঁর আরেকটি উপাধি। জগত-বিখ্যাত মহাপুরুষ ইমাম রেজা (আ) ছিলেন তাঁর বাবা। আর তাঁর মায়ের নাম ‘সাবিকাহ’ বলে জানা যায়। ইমাম রেজা (আ) তাঁর এই স্ত্রীর নাম রেখেছিলেন খিইজরান। তিনি ছিলেন মহানবীর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনিন হযরত মারিয়া কিবতির (আ) বংশধর। ইমাম জাওয়াদ (আ) ১৭ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালনের পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন। তিনিই হলেন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়স্ক ইমাম। আহলে বাইতের অন্য ইমামগণের মত ইমাম জাওয়াদ (আ.)ও ছিলেন উচ্চতর নৈতিক গুণ, জ্ঞান ও পরিপূর্ণতার অধিকারী। ইসলামের মূল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন এবং বিকাশ ছিল তাঁর তৎপরতার মূল লক্ষ্য বা কেন্দ্রবিন্দু। সেযুগের সব মাজহাবের জ্ঞানী-গুণীরা ইমাম জাওয়াদ (আ.)'র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।সমসাময়িক যুগের প্রখ্যাত সুন্নি চিন্তাবিদ কামালউদ্দিন শাফেয়ি ইমাম জাওয়াদ (আ.) সম্পর্কে বলেছেন, "মুহাম্মাদ বিন আলী তথা ইমাম জাওয়াদ (আ.) ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মর্যাদা ও গুণের অধিকারী। মানুষের মুখে মুখে ফিরতো তাঁর প্রশংসা। তাঁর উদারতা, প্রশস্ত দৃষ্টি ও সুমিষ্ট কথা সবাইকে আকৃষ্ট করত। যে-ই তাঁর কাছে আসতো নিজের অজান্তেই এই মহামানবের অনুরাগী হয়ে পড়ত এবং তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করত।" ইমাম জাওয়াদ (আ) মাত্র সাত বা আট বছর বয়সে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতো অল্প বয়সে তাঁর ইমামতিত্বের বিষয়টি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়কর। ফলে অনেকেই এ বিষয়ে সন্দেহ করতেন। অথচ আল্লাহর তো এই শক্তি আছে যে তিনি মানুষকে তার বয়সের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন। কোরানের আয়াতের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যেও এরকম উদাহরণ বহু আছে। যেমন শিশুকালে হযরত ইয়াহিয়া (আ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তি, মায়ের কোলে নবজাতক ঈসা (আ) এর কথা বলা ইত্যাদি সর্বশক্তিমান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতারই নিদর্শন। ইমাম জাওয়াদ (আ) শৈশব-কৈশোরেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, ধৈর্য ও সহনশীলতায়, ইবাদত-বন্দেগিতে, সচেতনতায়, কথাবার্তায় শীর্ষস্থানীয় মহামানব। একবার হজ্জ্বের সময় বাগদাদ এবং অন্যান্য শহরের বিখ্যাত ফকীহদের মধ্য থেকে আশি জন মদীনায় ইমাম জাওয়াদ (আ) এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা ইমামকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞেস করে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সন্তোষজনক জবাব পেলেন। ফলে জাওয়াদ (আ)’র ইমামতিত্বের ব্যাপারে তাদের মনে যেসব সন্দেহ ছিল-তা দূর হয়ে যায়।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম‌লা'নাতুল্লাহি আলাল কাজেবিন🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂