একত্ববাদ সম্পর্কে আলী (আ.)'র কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র হাদিস অনুযায়ী তাঁর পবিত্র আহলে বাইত (আ.) ছিলেন মহানবীর পর মানুষের জন্য নুহ (আ.)'র কিশতির সমতুল্য। ইসলামকে জানা ও বোঝার জন্য মূল্যবান তথ্যসহ মানুষের জন্য আত্ম-সংশোধন, সর্বোত্তম চরিত্র গঠনের ও চিরস্থায়ী সুখ বা সৌভাগ্যের পথ-নির্দেশনা পাওয়া যায় তাঁদের বাণীতে।বিশেষ করে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আমি জ্ঞানের শহর আর আলী এর দরজা। অর্থাৎ যে আমার জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাকে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। তাই আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.)'র কিছু অমূল্য বাণী ওদিক-নির্দেশনা তুল ধরব । আজ আমরা শুনব খাঁটি একত্ববাদ সম্পর্কে আলী (আ.)'র কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য। আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.) বলেছেন: আল্লাহর ইবাদতের বা ধর্মের সর্বসূচনা হলো তাঁকে চেনা। আর তাঁর পরিচিতির মূল হলো তাঁর একত্বে বিশ্বাস করা। আর তাঁর একত্বের মূলকথা হলো তাঁর সৃষ্টিকূলের সকল সিফাত বা গুণ থেকে আল্লাহকে পৃথক জানা। কেননা, বুদ্ধিবৃত্তি সাক্ষ্য দেয় যে, প্রত্যেক সিফাত এবং মওসূফ (যার ওপর গুণ আরোপ করা হয়) উভয়ই সৃষ্ট ও পৃথক অস্তিত্ব। আর প্রত্যেক সৃষ্ট সাক্ষ্য দেয় যে, তার স্রষ্টা রয়েছে যিনি গুণও নন, গুণের পাত্রও নন। আর প্রত্যেক গুণ ও তার পাত্র সাক্ষ্য দেয় তারা এ দুইয়ের মিশ্রিত শঙ্কর বা যৌগ, অর্থাৎ মৌল কিছু নয়। (যেমন, লবন ও লবনাক্ততা দুই ভিন্ন অস্তিত্ব, আর লবন হচ্ছে কয়েকটি মৌলিক পদার্থের মিশ্রণ)। যৌগিক কোনো কিছুর সংযুক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, সে উদ্ভূত হয়েছে কোনো কিছু থেকে বা তার উৎপত্তি ঘটেছে কোনো কিছু থেকে। উৎপত্তি সাক্ষ্য দেয় তা আদি হতে পারে না। যিনি আদি অস্তিত্ব তার সৃষ্ট হওয়া অসম্ভব হবে। কাজেই যারা আল্লাহর ওপর সৃষ্টির গুণ আরোপের মাধ্যমে আল্লাহর সত্তাকে চিনেছে বলে মনে করে সে প্রকৃতপক্ষে তাঁকে চেনেনি। কারণ তারা সৃষ্টির গুণের সঙ্গে আল্লাহকে সংশ্লিষ্ট করে আসলে তাঁকে দুই সত্তা বলেই তুলে ধরল। আর যে আল্লাহর জন্য অন্ত বা সমাপ্তি রয়েছে বলে ধারণা করে সে তাঁকে এক বলে মানল না।আলী (আ.) বলেন, যে আল্লাহর জন্য (যৌগিক বা) একাধিক সত্তার কোনো দৃষ্টান্তকে কিংবা কোনো দৃষ্টান্তকে কল্পনা করে সে তাঁকে বিশ্বাস করলো না ও তাঁকে চিনতে পারল না। (অন্য কথায়) যে তাঁর জন্য কোনো সমকক্ষ বা সদৃশকে কল্পনা করে সে তাঁর সারসত্যে উপনীত হয় নি।আলী (আ.) বলেছেন: যে আল্লাহকে ইশারা করে দেখায় সে তাঁকে সীমিত করে ও তাঁকে সংখ্যা বা গণনার মধ্যে নামিয়ে আনে। যে তাঁকে সীমাবদ্ধ করে সে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করে নি। যে তাঁর জন্য অংশ বা অঙ্গে বিশ্বাস করে সে তাঁর তথা আল্লাহর বন্দেগির অধিকার পালন করে নি। যা কিছু নিজের (অংশের) ওপর নির্ভর করে বিরাজ করে তা সৃষ্ট। আর যা কিছু নিজ ভিন্ন অন্য কিছুর কারণে বিদ্যমান তা নির্ভরশীল অস্তিত্ব এবং কারণের ফলস্বরূপ।আল্লাহর সৃষ্টিই তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষ্য। বুদ্ধি-বিবেকের মাধ্যমে তাঁর পরিচিতিতে বিশ্বাস আসে। চিন্তার মাধ্যমে তাঁর হুজ্জাত (দলিল) প্রমাণিত হয়। আর তিনি নিজ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির ওপর হুজ্জাত বা দলিল প্রতিষ্ঠা করেন।আলী (আ.) বলেছেন: আল্লাহ্ সৃষ্টিরাজিকে সৃষ্টি করেছেন এবং নিজের ও তাদের মাঝে পর্দা টেনে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের থেকে তাঁর বিচ্ছিন্নতা এটাই যে, তাদের সত্তা থেকে তিনি পৃথক। সেগুলোকে (প্রথমবার) সৃষ্টিই সাক্ষ্য দেয় যে, সৃষ্টির জন্য তাঁর কোনো উপকরণ নেই। কারণ, উপকরণ, উপকরণের অধিকারীর কাছে তার অভাবের কথা তুলে ধরে। আর এই যে, প্রথমবার তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এটা সাক্ষ্য দেয় যে, তাঁর নিজের কোনো সূচনা নেই। কারণ, যার নিজেরই শুরু থাকে, সে অন্যকে সৃষ্টি করতে অপারগ হয়।আল্লাহর ৯৯ নামআল্লাহর নামগুলো তাঁর প্রতিফলক। আর তাঁর কাজগুলো তাঁর অস্তিত্বকে নির্দেশ করে। তাঁর সত্তা হলো নিখাঁদ সারসত্য। আর তাঁর মূলসত্তা তাঁর এবং তাঁর সৃষ্টির মাঝে পার্থক্য। যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কোনো সিফাত (গুণ)কে আরোপ করে সে আল্লাহকে জানে না। আর যে আল্লাহর জন্য কোনো দৃষ্টান্তকে ধারণা করে সে তাঁকে অতিক্রম বা ত্যাগ করেছে। আর যে তাঁর মূল সত্তাকে খোঁজে সে ভুল পথে পা বাড়িয়েছে।মুমিনদের নেতা আলী (আ.) আরো বলেছেন: যদি কেউ বলে আল্লাহ কোথায়? তা হলে সে তাঁকে স্থানাবদ্ধ করে ফেলেছে। আর যদি কেউ বলে, তিনি কিসের মধ্যে, তা হলে সে তাঁকে অন্য কিছুর অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করেছে। আর যদি কেউ বলে, তিনি কোন্ পর্যন্ত, তা হলে সে তাঁর জন্য অন্ত নির্ধারণ করলো। আর যদি কেউ বলে কেনো তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে, তা হলে সে তাঁর জন্য কারণ দাঁড় করিয়েছে। আর কেউ যদি বলে, তিনি কিভাবে রয়েছেন, তা হলে তাঁর জন্য সদৃশ দাঁড় করিয়েছে। যদি কেউ বলে, সেই সময় থেকে ছিলেন, তা হলে তাঁকে সময়ের অধীন করেছে। যদি কেউ বলে, তিনি কোন্ সময় অবধি থাকবেন, তা হলে সে তাঁকে শেষযুক্ত বলে মনে করেছে। যে তাঁর জন্য কোনো শেষ রয়েছে বলে মনে করেছে সে তাঁর অংশ রয়েছে বলে মনে করলো। যে তাঁকে অংশের অধিকারী বলে মনে করে সে তাঁর জন্য গুণ বা সিফাত তুলে ধরলো। যে তাঁর জন্য সিফাতকে ধারণা করে সে তাঁর সম্পর্কে অযাচিত বলেছে তথা তাঁকে বিভক্ত করেছে। আর যে তাঁকে বিভক্ত জ্ঞান করেছে সে তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।আলী (আ.) আরো বলেছেন: আল্লাহ্ সৃষ্টির পরিবর্তনের কারণে পরিবর্তিত হন না। তদ্রুপ যে কোনো সৃষ্টির সীমাবদ্ধকরণের ফলে সীমাবদ্ধ হন না। তিনি এক তবে সংখ্যার হিসাবে নয় (অর্থাৎ তিনি সংখ্যার ঊর্ধ্বে)। তিনি নিরঙ্কুশভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি অভ্যন্তর কিন্তু কোনো কিছুর সাথে মিশে নয়। তিনি বাহির কিন্তু কোনো কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়। তিনি প্রকাশমান তবে চোখে পড়ার নয়। তিনি সূক্ষ্ম তবে (সেই সূক্ষ্মতা) দৃশ্যমান নয়। তিনি কর্মের কর্তা তবে নড়াচড়ার (গতি) আশ্রয়ী হয়ে নন। তিনি পরিমাপ করেন তবে চিন্তা সঞ্চালনের মাধ্যমে তা করেন না।আল্লাহ পরিচালনা করেন তবে চলাচলের মাধ্যমে নন। তিনি শোনেন তবে অঙ্গের মাধ্যমে নয়। তিনি দেখেন তবে উপকরণের মাধ্যমে নয়। তিনি কাছে তবে দূরত্বের স্বল্পতার কারণে তা নন। তিনি দূরে তবে ব্যবধানের কারণে নয়।আলী (আ.) আরো বলেছেন: তিনি বিদ্যমান তবে না থাকার (অনস্তিত্বের) পরে নয়। সময় তাঁর সঙ্গী হয় না। স্থান তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করে না। নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করে না আর সিফাত বা গুণ তাঁকে সীমাবদ্ধ করে না। কোনো উপকরণ তাঁকে আবদ্ধ করে না। তাঁর অস্তিত্ব সব সময়ের পূর্বে। আর তাঁর অস্তিত্ব শূন্যতার (অনস্তিত্বের) পূর্বে এবং তাঁর আদিত্ব সূচনার চেয়ে অগ্রবর্তী (অর্থাৎ তিনি অনাদি)।আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.) আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেছেন, আল্লাহর সৃষ্ট সৃষ্টিগুলোর ইন্দ্রিয়ের (সীমাবদ্ধতা) থেকে জানা যায় যে, তাঁর কোনো ইন্দ্রিয় নেই। তাঁর সৃষ্ট বস্তুসত্তা থেকেই জানা যায় যে, তাঁর কোনো বস্তুসত্তা নেই। আর প্রাণীকুলের সৃষ্টি থেকেই জানা যায় যে, তাঁর কোনো প্রাণদাতা নেই। আর তাঁর সৃষ্ট বিপরীত বৈশিষ্ট্যের বস্তুগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব থেকে জানা যায় যে, তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আর সব জিনিসের মধ্যে তিনি যে সমন্বয় সাধন করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, তাঁর কোনো সঙ্গী নেই। তিনি আলোকে আঁধারের বিপরীত আর গরমকে শীতের বিপরীত নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ দ্রব্যগুলোর সৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন উপাদানগুলোকে জোড়া দিয়েছেন আর পৃথকগুলোকে পরস্পর মিশিয়ে দিয়েছেন। যাতে সেগুলোর বিভাজন, বিভাগকারীর এবং মিশ্রণ (সংযুক্তি) মিশ্রিতকারীর (সংযুক্তিকারী) অস্তিত্বের প্রমাণ ফুটে উঠে। পুত-পবিত্র (আল্লাহ্) সেগুলোকে তাঁর প্রতিপালকত্বের দলিল এবং তাঁর অদৃশ্যতার সাক্ষ্য হিসেবে ধার্য করেছেন। আর এসবকে করেছেন তাঁর হিকমত তথা প্রজ্ঞার নিদর্শন। কারণ, তাদের সৃষ্টি হওয়া তাদের উৎপত্তি ঘটার এবং তাদের অস্তিত্ব তাদের এক সময়কার অনস্তিত্বের বার্তা তুলে ধরে। আর তাদের নানা রূপের পরিবর্তন জানায় যে, তারা ধ্বংসশীল।আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.) মহান আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেছেন: আর সৃষ্টির নিজের অদৃশ্য হওয়া এটা জানায় যে, তাদের স্রষ্টা অনস্তিত্ব ও অস্তমিত হওয়ার নন। আর এটাই হলো মহান আল্লাহর বাণীর তাৎপর্য। ইরাশাদ হচ্ছে : “আমি প্রত্যেক জিনিসকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি যাতে তোমরা স্মরণ করো।” আর এ দুই জোড়ার মধ্যে (তা সংযুক্ত হওয়ার) পূর্বে এবং পরে বিচ্ছিন্নতা দান করেছেন যাতে জানা যায় যে, তাঁর নিজের অগ্র ও পশ্চাৎ নেই। সেগুলোর বিভিন্ন রকমের প্রকৃতি সাক্ষ্য দেয় যে, তাদের প্রকৃতি দানকারীর কোনো প্রকৃতি নেই। আর সেগুলোর পরস্পর ভিন্নতা নির্দেশ করে যে, তাদের ভিন্নতাদানকারীর (স্র্রষ্টার) কোনো ভিন্নতা নেই। আর সেগুলোর সময়সম্পৃক্ত থাকা নির্দেশ করে যে, তাদের সময়সম্পৃক্তকারী সত্তা সময়সম্পৃক্ত নন। সেগুলোকে একে অপর থেকে পর্দাবৃত করেছেন যাতে জানা যায় যে, তাঁর নিজের এবং তাদের মধ্যে কোনো পর্দা নেই। যখন কোনো প্রতিপালিত ছিল না তখন তিনি প্রতিপালকের মর্যাদায় সমাসীন ছিলেন। তিনি তখনও ইলাহ (উপাস্য) ছিলেন যখন কোন উপাসক ছিল না। তিনি শ্রোতা ছিলেন যখন কোন শ্রাব্য ছিল না। আর তিনি তখনও জানতেন যখন জ্ঞাত কিছুই ছিল না। আর তিনি তখনও ক্ষমতাধারী ছিলেন যখন ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো ক্ষেত্র ছিল না।আলী (আ.) আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেন: এমন নয় যে, আল্লাহ যখন থেকে সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই স্রষ্টার উপাধি লাভ করেছেন। আর এমনও নয় যে, যখন থেকে উদ্ভাবিত বস্তুগুলোকে উদ্ভাবন করেছেন তখন থেকে ‘বারী’ (বা উদ্ভাবন কর্তা) উপাধি লাভ করেছেন। তিনি সব জিনিসকেই পরস্পর বিচ্ছিন্ন করেছেন তবে কোনো কিছু থেকে নয়। সব জিনিসকেই পরস্পর মিশিয়ে দিয়েছেন তবে কোনো জিনিসের মাধ্যমে নয়। তাদের পরিমাপ করেছেন তবে চিন্তা ও কল্পনা দিয়ে নয়। তাঁর মূল সত্তার ওপর কোনো কল্পনাশক্তিরই নাগাল নেই। আর তাঁর সত্তা বোধশক্তিগুলোয় স্থান সংকুলান পায় না। (অর্থাৎ আল্লাহকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।) আল্লাহর মধ্যে ‘কখন এবং কোন্ সময়’-এর কোনো স্থান নেই। আর (পুরাঘটিত অতীত বাচক) ‘কদ’ তাঁকে নিকটবর্তী করে না। আর (সংশয় ও সন্দেহবাচক) ‘হয়তোবা’ তাঁকে পর্দার আড়াল করতে পারে না। আর ‘মাআ’ তথা সাথে বা সঙ্গে- বাচক অব্যয় তাঁর সাথে যুক্ত হয় না । অর্থাৎ ‘তাঁর সাথে’ বাক্যাংশটি তাঁর জন্য ব্যবহার করা যায় না। আর ‘হুয়া’ (সে বা তিনি বাচক সর্বনাম) তাঁকে (তাঁর পরিচয়কে পুরোপুরি) তুলে ধরে না। উপকরণগুলো নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। আর প্রত্যেক উপকরণই তার নিজের সদৃশের ইঙ্গিত দেয়।আলী (আ.) মহান আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেছেন: প্রত্যেক জিনিসের তৎপরতা সেগুলোর নিজের পরিমণ্ডলের মধ্যেই থাকে। উপকরণগুলোর সাহায্য গ্রহণ অভাবের প্রমাণ বহন করে। দু’টি জিনিসের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিপরীত জিনিস থাকার প্রমাণ। মিল বা সদৃশ, সাদৃশ্যকে নির্দেশ করে। প্রত্যেক সৃষ্ট তার সময়ের (অধীন হওয়ার) প্রমাণবাহী। নামগুলোর মাধ্যমেই তাদের সিফাত (বা গুণগুলো) পরস্পর পৃথক হয়। আর তাদের থেকেই তাদের নিদর্শনগুলো আলাদা হয়। আর তাদের ঘটনাগুলো তাদের দিকেই ফিরে যায়। কখন তার উৎপত্তি ঘটেছে- এ প্রশ্ন সেটাকে আদি হওয়া থেকে বিরত রাখে। আর ‘কখনো কখনো’ এর প্রয়োগযোগ্যতা সেটার অনন্ত হওয়াকে নাকচ করে দেয়। কারণের ওপর নির্ভরশীলতা তার অপরিহার্য অস্তিত্ব হওয়াকে নাকচ করে দেয়।আলী (আ.) মহান আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেছেন: সৃষ্ট বিষয়গুলো পরস্পর থেকে আলাদা এবং নিজের পৃথককারীর স্মারক। আর পরস্পর থেকে অপসারিত বিষয় নিজের অপসারণকারীর নির্দেশক। এইসব বিষয় তাদের মাধ্যমেই বুদ্ধিবৃত্তির সামনে তাদের স্রষ্টার প্রকাশ তুলে ধরে। আর তাদের মাধ্যমেই তিনি (আল্লাহ) দৃষ্টি থেকে আড়াল। এ সব ঘটনা দিয়েই কল্পনাগুলো বিচার করে। আর সেগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা। সেগুলো থেকে প্রমাণের সূত্র বের হয় এবং সুশৃঙ্খল হয়। আর বুদ্ধিবৃত্তিগুলোর মাধ্যমে আল্লাহকে বিশ্বাস পোষণ করাটা হৃদয়ে গেঁথে যায় এবং স্বীকার করার মাধ্যমে ঈমান বাস্তব রূপ নেয়।
একত্ববাদ সম্পর্কে আলী (আ.)'র কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য
হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র হাদিস অনুযায়ী তাঁর পবিত্র আহলে বাইত (আ.) ছিলেন মহানবীর পর মানুষের জন্য নুহ (আ.)'র কিশতির সমতুল্য। ইসলামকে জানা ও বোঝার জন্য মূল্যবান তথ্যসহ মানুষের জন্য আত্ম-সংশোধন, সর্বোত্তম চরিত্র গঠনের ও চিরস্থায়ী সুখ বা সৌভাগ্যের পথ-নির্দেশনা পাওয়া যায় তাঁদের বাণীতে।
বিশেষ করে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আমি জ্ঞানের শহর আর আলী এর দরজা। অর্থাৎ যে আমার জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাকে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। তাই আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.)'র কিছু অমূল্য বাণী ওদিক-নির্দেশনা তুল ধরব । আজ আমরা শুনব খাঁটি একত্ববাদ সম্পর্কে আলী (আ.)'র কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য।
আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.) বলেছেন: আল্লাহর ইবাদতের বা ধর্মের সর্বসূচনা হলো তাঁকে চেনা। আর তাঁর পরিচিতির মূল হলো তাঁর একত্বে বিশ্বাস করা। আর তাঁর একত্বের মূলকথা হলো তাঁর সৃষ্টিকূলের সকল সিফাত বা গুণ থেকে আল্লাহকে পৃথক জানা। কেননা, বুদ্ধিবৃত্তি সাক্ষ্য দেয় যে, প্রত্যেক সিফাত এবং মওসূফ (যার ওপর গুণ আরোপ করা হয়) উভয়ই সৃষ্ট ও পৃথক অস্তিত্ব। আর প্রত্যেক সৃষ্ট সাক্ষ্য দেয় যে, তার স্রষ্টা রয়েছে যিনি গুণও নন, গুণের পাত্রও নন। আর প্রত্যেক গুণ ও তার পাত্র সাক্ষ্য দেয় তারা এ দুইয়ের মিশ্রিত শঙ্কর বা যৌগ, অর্থাৎ মৌল কিছু নয়। (যেমন, লবন ও লবনাক্ততা দুই ভিন্ন অস্তিত্ব, আর লবন হচ্ছে কয়েকটি মৌলিক পদার্থের মিশ্রণ)। যৌগিক কোনো কিছুর সংযুক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, সে উদ্ভূত হয়েছে কোনো কিছু থেকে বা তার উৎপত্তি ঘটেছে কোনো কিছু থেকে। উৎপত্তি সাক্ষ্য দেয় তা আদি হতে পারে না। যিনি আদি অস্তিত্ব তার সৃষ্ট হওয়া অসম্ভব হবে। কাজেই যারা আল্লাহর ওপর সৃষ্টির গুণ আরোপের মাধ্যমে আল্লাহর সত্তাকে চিনেছে বলে মনে করে সে প্রকৃতপক্ষে তাঁকে চেনেনি। কারণ তারা সৃষ্টির গুণের সঙ্গে আল্লাহকে সংশ্লিষ্ট করে আসলে তাঁকে দুই সত্তা বলেই তুলে ধরল। আর যে আল্লাহর জন্য অন্ত বা সমাপ্তি রয়েছে বলে ধারণা করে সে তাঁকে এক বলে মানল না।
আলী (আ.) বলেন, যে আল্লাহর জন্য (যৌগিক বা) একাধিক সত্তার কোনো দৃষ্টান্তকে কিংবা কোনো দৃষ্টান্তকে কল্পনা করে সে তাঁকে বিশ্বাস করলো না ও তাঁকে চিনতে পারল না। (অন্য কথায়) যে তাঁর জন্য কোনো সমকক্ষ বা সদৃশকে কল্পনা করে সে তাঁর সারসত্যে উপনীত হয় নি।
আলী (আ.) বলেছেন: যে আল্লাহকে ইশারা করে দেখায় সে তাঁকে সীমিত করে ও তাঁকে সংখ্যা বা গণনার মধ্যে নামিয়ে আনে। যে তাঁকে সীমাবদ্ধ করে সে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করে নি। যে তাঁর জন্য অংশ বা অঙ্গে বিশ্বাস করে সে তাঁর তথা আল্লাহর বন্দেগির অধিকার পালন করে নি। যা কিছু নিজের (অংশের) ওপর নির্ভর করে বিরাজ করে তা সৃষ্ট। আর যা কিছু নিজ ভিন্ন অন্য কিছুর কারণে বিদ্যমান তা নির্ভরশীল অস্তিত্ব এবং কারণের ফলস্বরূপ।
আল্লাহর সৃষ্টিই তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষ্য। বুদ্ধি-বিবেকের মাধ্যমে তাঁর পরিচিতিতে বিশ্বাস আসে। চিন্তার মাধ্যমে তাঁর হুজ্জাত (দলিল) প্রমাণিত হয়। আর তিনি নিজ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির ওপর হুজ্জাত বা দলিল প্রতিষ্ঠা করেন।
আলী (আ.) বলেছেন: আল্লাহ্ সৃষ্টিরাজিকে সৃষ্টি করেছেন এবং নিজের ও তাদের মাঝে পর্দা টেনে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের থেকে তাঁর বিচ্ছিন্নতা এটাই যে, তাদের সত্তা থেকে তিনি পৃথক। সেগুলোকে (প্রথমবার) সৃষ্টিই সাক্ষ্য দেয় যে, সৃষ্টির জন্য তাঁর কোনো উপকরণ নেই। কারণ, উপকরণ, উপকরণের অধিকারীর কাছে তার অভাবের কথা তুলে ধরে। আর এই যে, প্রথমবার তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এটা সাক্ষ্য দেয় যে, তাঁর নিজের কোনো সূচনা নেই। কারণ, যার নিজেরই শুরু থাকে, সে অন্যকে সৃষ্টি করতে অপারগ হয়।
আল্লাহর ৯৯ নাম
আল্লাহর নামগুলো তাঁর প্রতিফলক। আর তাঁর কাজগুলো তাঁর অস্তিত্বকে নির্দেশ করে। তাঁর সত্তা হলো নিখাঁদ সারসত্য। আর তাঁর মূলসত্তা তাঁর এবং তাঁর সৃষ্টির মাঝে পার্থক্য। যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কোনো সিফাত (গুণ)কে আরোপ করে সে আল্লাহকে জানে না। আর যে আল্লাহর জন্য কোনো দৃষ্টান্তকে ধারণা করে সে তাঁকে অতিক্রম বা ত্যাগ করেছে। আর যে তাঁর মূল সত্তাকে খোঁজে সে ভুল পথে পা বাড়িয়েছে।
মুমিনদের নেতা আলী (আ.) আরো বলেছেন: যদি কেউ বলে আল্লাহ কোথায়? তা হলে সে তাঁকে স্থানাবদ্ধ করে ফেলেছে। আর যদি কেউ বলে, তিনি কিসের মধ্যে, তা হলে সে তাঁকে অন্য কিছুর অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করেছে। আর যদি কেউ বলে, তিনি কোন্ পর্যন্ত, তা হলে সে তাঁর জন্য অন্ত নির্ধারণ করলো। আর যদি কেউ বলে কেনো তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে, তা হলে সে তাঁর জন্য কারণ দাঁড় করিয়েছে। আর কেউ যদি বলে, তিনি কিভাবে রয়েছেন, তা হলে তাঁর জন্য সদৃশ দাঁড় করিয়েছে। যদি কেউ বলে, সেই সময় থেকে ছিলেন, তা হলে তাঁকে সময়ের অধীন করেছে। যদি কেউ বলে, তিনি কোন্ সময় অবধি থাকবেন, তা হলে সে তাঁকে শেষযুক্ত বলে মনে করেছে। যে তাঁর জন্য কোনো শেষ রয়েছে বলে মনে করেছে সে তাঁর অংশ রয়েছে বলে মনে করলো। যে তাঁকে অংশের অধিকারী বলে মনে করে সে তাঁর জন্য গুণ বা সিফাত তুলে ধরলো। যে তাঁর জন্য সিফাতকে ধারণা করে সে তাঁর সম্পর্কে অযাচিত বলেছে তথা তাঁকে বিভক্ত করেছে। আর যে তাঁকে বিভক্ত জ্ঞান করেছে সে তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
আলী (আ.) আরো বলেছেন: আল্লাহ্ সৃষ্টির পরিবর্তনের কারণে পরিবর্তিত হন না। তদ্রুপ যে কোনো সৃষ্টির সীমাবদ্ধকরণের ফলে সীমাবদ্ধ হন না। তিনি এক তবে সংখ্যার হিসাবে নয় (অর্থাৎ তিনি সংখ্যার ঊর্ধ্বে)। তিনি নিরঙ্কুশভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি অভ্যন্তর কিন্তু কোনো কিছুর সাথে মিশে নয়। তিনি বাহির কিন্তু কোনো কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়। তিনি প্রকাশমান তবে চোখে পড়ার নয়। তিনি সূক্ষ্ম তবে (সেই সূক্ষ্মতা) দৃশ্যমান নয়। তিনি কর্মের কর্তা তবে নড়াচড়ার (গতি) আশ্রয়ী হয়ে নন। তিনি পরিমাপ করেন তবে চিন্তা সঞ্চালনের মাধ্যমে তা করেন না।
আল্লাহ পরিচালনা করেন তবে চলাচলের মাধ্যমে নন। তিনি শোনেন তবে অঙ্গের মাধ্যমে নয়। তিনি দেখেন তবে উপকরণের মাধ্যমে নয়। তিনি কাছে তবে দূরত্বের স্বল্পতার কারণে তা নন। তিনি দূরে তবে ব্যবধানের কারণে নয়।
আলী (আ.) আরো বলেছেন: তিনি বিদ্যমান তবে না থাকার (অনস্তিত্বের) পরে নয়। সময় তাঁর সঙ্গী হয় না। স্থান তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করে না। নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করে না আর সিফাত বা গুণ তাঁকে সীমাবদ্ধ করে না। কোনো উপকরণ তাঁকে আবদ্ধ করে না। তাঁর অস্তিত্ব সব সময়ের পূর্বে। আর তাঁর অস্তিত্ব শূন্যতার (অনস্তিত্বের) পূর্বে এবং তাঁর আদিত্ব সূচনার চেয়ে অগ্রবর্তী (অর্থাৎ তিনি অনাদি)।
আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.) আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেছেন, আল্লাহর সৃষ্ট সৃষ্টিগুলোর ইন্দ্রিয়ের (সীমাবদ্ধতা) থেকে জানা যায় যে, তাঁর কোনো ইন্দ্রিয় নেই। তাঁর সৃষ্ট বস্তুসত্তা থেকেই জানা যায় যে, তাঁর কোনো বস্তুসত্তা নেই। আর প্রাণীকুলের সৃষ্টি থেকেই জানা যায় যে, তাঁর কোনো প্রাণদাতা নেই। আর তাঁর সৃষ্ট বিপরীত বৈশিষ্ট্যের বস্তুগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব থেকে জানা যায় যে, তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আর সব জিনিসের মধ্যে তিনি যে সমন্বয় সাধন করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, তাঁর কোনো সঙ্গী নেই। তিনি আলোকে আঁধারের বিপরীত আর গরমকে শীতের বিপরীত নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ দ্রব্যগুলোর সৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন উপাদানগুলোকে জোড়া দিয়েছেন আর পৃথকগুলোকে পরস্পর মিশিয়ে দিয়েছেন। যাতে সেগুলোর বিভাজন, বিভাগকারীর এবং মিশ্রণ (সংযুক্তি) মিশ্রিতকারীর (সংযুক্তিকারী) অস্তিত্বের প্রমাণ ফুটে উঠে। পুত-পবিত্র (আল্লাহ্) সেগুলোকে তাঁর প্রতিপালকত্বের দলিল এবং তাঁর অদৃশ্যতার সাক্ষ্য হিসেবে ধার্য করেছেন। আর এসবকে করেছেন তাঁর হিকমত তথা প্রজ্ঞার নিদর্শন। কারণ, তাদের সৃষ্টি হওয়া তাদের উৎপত্তি ঘটার এবং তাদের অস্তিত্ব তাদের এক সময়কার অনস্তিত্বের বার্তা তুলে ধরে। আর তাদের নানা রূপের পরিবর্তন জানায় যে, তারা ধ্বংসশীল।
আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.) মহান আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেছেন: আর সৃষ্টির নিজের অদৃশ্য হওয়া এটা জানায় যে, তাদের স্রষ্টা অনস্তিত্ব ও অস্তমিত হওয়ার নন। আর এটাই হলো মহান আল্লাহর বাণীর তাৎপর্য। ইরাশাদ হচ্ছে : “আমি প্রত্যেক জিনিসকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি যাতে তোমরা স্মরণ করো।” আর এ দুই জোড়ার মধ্যে (তা সংযুক্ত হওয়ার) পূর্বে এবং পরে বিচ্ছিন্নতা দান করেছেন যাতে জানা যায় যে, তাঁর নিজের অগ্র ও পশ্চাৎ নেই। সেগুলোর বিভিন্ন রকমের প্রকৃতি সাক্ষ্য দেয় যে, তাদের প্রকৃতি দানকারীর কোনো প্রকৃতি নেই। আর সেগুলোর পরস্পর ভিন্নতা নির্দেশ করে যে, তাদের ভিন্নতাদানকারীর (স্র্রষ্টার) কোনো ভিন্নতা নেই। আর সেগুলোর সময়সম্পৃক্ত থাকা নির্দেশ করে যে, তাদের সময়সম্পৃক্তকারী সত্তা সময়সম্পৃক্ত নন। সেগুলোকে একে অপর থেকে পর্দাবৃত করেছেন যাতে জানা যায় যে, তাঁর নিজের এবং তাদের মধ্যে কোনো পর্দা নেই। যখন কোনো প্রতিপালিত ছিল না তখন তিনি প্রতিপালকের মর্যাদায় সমাসীন ছিলেন। তিনি তখনও ইলাহ (উপাস্য) ছিলেন যখন কোন উপাসক ছিল না। তিনি শ্রোতা ছিলেন যখন কোন শ্রাব্য ছিল না। আর তিনি তখনও জানতেন যখন জ্ঞাত কিছুই ছিল না। আর তিনি তখনও ক্ষমতাধারী ছিলেন যখন ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো ক্ষেত্র ছিল না।
আলী (আ.) আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেন: এমন নয় যে, আল্লাহ যখন থেকে সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন তখন থেকেই স্রষ্টার উপাধি লাভ করেছেন। আর এমনও নয় যে, যখন থেকে উদ্ভাবিত বস্তুগুলোকে উদ্ভাবন করেছেন তখন থেকে ‘বারী’ (বা উদ্ভাবন কর্তা) উপাধি লাভ করেছেন। তিনি সব জিনিসকেই পরস্পর বিচ্ছিন্ন করেছেন তবে কোনো কিছু থেকে নয়। সব জিনিসকেই পরস্পর মিশিয়ে দিয়েছেন তবে কোনো জিনিসের মাধ্যমে নয়। তাদের পরিমাপ করেছেন তবে চিন্তা ও কল্পনা দিয়ে নয়। তাঁর মূল সত্তার ওপর কোনো কল্পনাশক্তিরই নাগাল নেই। আর তাঁর সত্তা বোধশক্তিগুলোয় স্থান সংকুলান পায় না। (অর্থাৎ আল্লাহকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।) আল্লাহর মধ্যে ‘কখন এবং কোন্ সময়’-এর কোনো স্থান নেই। আর (পুরাঘটিত অতীত বাচক) ‘কদ’ তাঁকে নিকটবর্তী করে না। আর (সংশয় ও সন্দেহবাচক) ‘হয়তোবা’ তাঁকে পর্দার আড়াল করতে পারে না। আর ‘মাআ’ তথা সাথে বা সঙ্গে- বাচক অব্যয় তাঁর সাথে যুক্ত হয় না । অর্থাৎ ‘তাঁর সাথে’ বাক্যাংশটি তাঁর জন্য ব্যবহার করা যায় না। আর ‘হুয়া’ (সে বা তিনি বাচক সর্বনাম) তাঁকে (তাঁর পরিচয়কে পুরোপুরি) তুলে ধরে না। উপকরণগুলো নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। আর প্রত্যেক উপকরণই তার নিজের সদৃশের ইঙ্গিত দেয়।
আলী (আ.) মহান আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেছেন: প্রত্যেক জিনিসের তৎপরতা সেগুলোর নিজের পরিমণ্ডলের মধ্যেই থাকে। উপকরণগুলোর সাহায্য গ্রহণ অভাবের প্রমাণ বহন করে। দু’টি জিনিসের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিপরীত জিনিস থাকার প্রমাণ। মিল বা সদৃশ, সাদৃশ্যকে নির্দেশ করে। প্রত্যেক সৃষ্ট তার সময়ের (অধীন হওয়ার) প্রমাণবাহী। নামগুলোর মাধ্যমেই তাদের সিফাত (বা গুণগুলো) পরস্পর পৃথক হয়। আর তাদের থেকেই তাদের নিদর্শনগুলো আলাদা হয়। আর তাদের ঘটনাগুলো তাদের দিকেই ফিরে যায়। কখন তার উৎপত্তি ঘটেছে- এ প্রশ্ন সেটাকে আদি হওয়া থেকে বিরত রাখে। আর ‘কখনো কখনো’ এর প্রয়োগযোগ্যতা সেটার অনন্ত হওয়াকে নাকচ করে দেয়। কারণের ওপর নির্ভরশীলতা তার অপরিহার্য অস্তিত্ব হওয়াকে নাকচ করে দেয়।
আলী (আ.) মহান আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে আরো বলেছেন: সৃষ্ট বিষয়গুলো পরস্পর থেকে আলাদা এবং নিজের পৃথককারীর স্মারক। আর পরস্পর থেকে অপসারিত বিষয় নিজের অপসারণকারীর নির্দেশক। এইসব বিষয় তাদের মাধ্যমেই বুদ্ধিবৃত্তির সামনে তাদের স্রষ্টার প্রকাশ তুলে ধরে। আর তাদের মাধ্যমেই তিনি (আল্লাহ) দৃষ্টি থেকে আড়াল। এ সব ঘটনা দিয়েই কল্পনাগুলো বিচার করে। আর সেগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা। সেগুলো থেকে প্রমাণের সূত্র বের হয় এবং সুশৃঙ্খল হয়। আর বুদ্ধিবৃত্তিগুলোর মাধ্যমে আল্লাহকে বিশ্বাস পোষণ করাটা হৃদয়ে গেঁথে যায় এবং স্বীকার করার মাধ্যমে ঈমান বাস্তব রূপ নেয়।
মন্তব্যসমূহ