ফাতেমার আ. মৃত্যু ও নানাবিধ গোপণ রহস্যপ্রশ্ন: উৎসুক হৃদয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এমন হতে পারে যে, কী কারণে হযরত ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহা নবী স. এর ওফাতের মাত্র তিন মাসের মধ্যে মারা যান? তবে কি তিনি কোন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, নাকি তাঁর সাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। যদি সাভাবিক মৃত্যু না হয়ে থাকে, তবে কেন আমরা সুন্নি আলেম ওলামাদের মুখ থেকে তার কারণ সম্পর্কে কিছু শুনতে পাই না?উত্তর: এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে একটি ভূমিকা দেয়া প্রয়োজন মনে করছি। আর ভূমিকাটি হল আমার জীবনের বাস্তক একটি ঘটনা। ঘটনাটি এরূপ:ভূমিকানবীর স. আহলে বাইতকে ভালবাসার কারণে অনেক বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছে। একদিন আমার বড় ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করে বলল যে, তুই যে মাযহাবের অনুসরণ করিস, আলেম ওলামারা কেন তার বিরোধিতা করে? আমি বললাম : ভাই জান! যে আলেম ওলামারা আমার মাযহাবের বিরেধিতা করে, তাদেরকে প্রশ্ন করো যে, হযরত ফাতেমা জাহরা কত বছর বয়সে মারা গিয়েছেন? তাঁর মৃত্যুর কোন কারণ ছিল কি? নাকি তিনি সাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছিলেন। যদি তুমি আমার এসব প্রশ্নের উত্তর এনে দিতে পার, তবে আমি তোমাকে বলব যে, এসব আলেমরা কেন আমাদের বিরোধিতা করে।আমার সেই ভাই ১৮ মাস হল মারা গেছেন, কিন্তু তিনি আমাকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে পারেন নি; হয়তো আলেমদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য কোন উত্তর পান নি। তবে এ কথা সত্য যে, তারপর থেকে আমার ভাই কখনো আমার সাথে বিরোধিতা করেন নি। আমি নিজেও যখন উপরোক্ত প্রশ্নাদির উত্তর জানতে পেরেছি, তখন থেকেই আমি আহলে বাইতকে ভালবাসতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি এবং আমি মনে করি: যেকোন বিবেকবান মুসলমানই এসব প্রশ্নের উত্তর জানলে নবীর আহলে বাইতকে আগের চেয়ে আরো বেশি ভাল বাসবে।যেহেতু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে ভূমিকা টেনে পাঠকবর্গকে বিরক্ত করেছি, তাই এ পর্যায়ে উপরোক্ত প্রশ্নাদির জবাব সংক্ষেপে উল্লেখ করব তার পর সম্ভব হলে প্রতিটি প্রশ্নে জবাব বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করব ইনশা আল্লাহ।সংক্ষিপ্ত উত্তরঠিক যেভাবে প্রশ্নে উল্লেখ করেছি যে, নবী স. এর ওফাতের তিনমাসের মধ্যেই ফাতেমা জাহরা মুত্যু বরণ করেছিলেন, তার এ মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। রাসূল স. এর ওফাতের পর হযরত আলীকে জোর করে বাইয়াত করানোর জন্য তাকে যখন বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে আসা হয়, তখন হযরত ফাতেমা সা. বাধা দেন এবং আগন্তক লোকদের সামনে তিনি যান। যাতে তারা আলীকে নিতে না পারে। কিন্তু এই বাধাই অবশেষে ফাতেমার মৃত্যুর কারণ হয়ে যায়। এ জন্য বলা যায় যে, নবী স. এর মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া বেলায়াতের রক্ষক হিসেবে প্রথম শহীদ হল হযরত ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহা।অথচ সুন্নি আলেম ওলামারা এ বিষয়ে কোন কথা বলেন না। হয়তো কেউ কেউ তার কারণ জানেন না, অথবা জেনে বুঝেও তা বলেন না। কারণ তখন হয়তো সুন্নি মতাদর্শ প্রশ্নের সম্মুখিন হবে!ফাতেমার আ. মৃত্যুর মূল রহস্যপ্রশ্ন ৩ : ফাতেমা আ. এর মৃত্যুর মূল রহস্য কী?উত্তর : এ পশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে তার দৈহিক আঘাতের কারনাদি সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন।ফাতেমা আ. এর দৈহিক আঘাত প্রাপ্তির মূল কারণ সমূহফাতেমা আ. এর দৈহিক আঘাত প্রাপ্তির মূল কারণ সমূহ নিম্নরূপ:১- নবীর মৃত্যুতে গভীর শোক, সবেদনা ও কান্না।২- নবীর ওসি অর্থাৎ হযরত আলীর মজদুরিয়াত ও নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মিক শোক ও প্রতিরক্ষা ছিল দৈহিক আঘাতের দ্বিতীয় কারণ।ইবনে শাহর অশুব (মৃ: ৫৯৯ হি.) বর্ণনা করেছেন :“উম্মে সালমা ফাতেমার ঘরে প্রবেশ করে বলল : ওহে নবী কন্যা! কিভাবে রাত কাটালেন।ফাতেমা বললেন : শোক ও দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে রাত কাটিয়েছি। শোক এই কারণে যে, প্রিয় নবীকে হারিয়েছি ও দুঃখ এই জন্য যে, তাঁর স্থলাভিষিক্তের উপর আরোপিত জুলুম। আল্লাহর কসম করে বলছি: এতে নবীর উত্তরসূরীর প্রতি অবমাননা হয়েছে (মানাকিবু অলে আবি তালিব, ২/২০৫।)।[1]৩- ফাতেমা সা. এর পবিত্র পদ ও মর্যাদার অবমাননা ছিল তৃতীয় কারণ (নাহজুল বালাগার শারহ, ইবনে আবিল হাদিদ, ১৬/২১৪) ।আল্লামা তাবারসি (মৃ: ষষ্ট হিজরি) বর্ণনা করেছিন:[ফাদাকের খোৎবা সমাপ্তির পর ফাতেমা বলেছিলেন :لَیتَنِی مِتُّ قَبلَ هینَـتِی وَ دُونَ ذِلَّتِی...হায়, যদি এমন জুলুমের স্বীকার হবার পূর্বে মারা যেতাম! (এহতিজাজ, খন্ড ১, পৃ ১০৭)।অতএব, বলা যায় যে, ফাতেমার শোকের কারণ শুধু পিতার মৃত্যুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তার সাথে আরে দু’টি ব্যাথা যোগ হয়েছিল।৪- ফাতেমার বাড়িতে হামলার সময় তাঁর দেহে মারাত্মক আঘাত হানা হয়েছিল। অন্য ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় : তার পিতার বিরহ বিচ্ছেদের সাথে সাথে তাকে এমন আঘাত করা হয়েছিল, যার ফলে তিনি ধরাশায়ি হয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না।কাজি নোমানি মাগরিবি বর্ণনা করেছেন :[عَن أبِی عَبدِاللهِ جَعفَرِبنِ مُحَمَّدٍ الصادِقِعلیهالسّلام عَن أبِیهِعلیهالسّلام: قالَ:]إنَّ رَسُولَ اللهِصلّیاللهعلیهوآله أسَرَّ إلی فاطِمَةَعلیهاالسّلام أنَّها أولی(أوَّلُ) مَن یَلحَقُ بِهِ مِن أهلِ بَـیتِهِ فَلَمّا قُبِضَ وَ نالَها مِن القَومِ ما نالَها لَزِمَت الفِراشَ وَ نَحَلَ جِسمُها وَ ذابَ لَحمُها وَ صارَت کَالخَیالِ. *ইমাম জাফর সাদিক আ. তাঁর পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন : রাসূল স. ফাতেমাকে চুপিসারে বললেন : তাঁর ওফাতের পর তার আহলে বাইতের মধ্য থেকে সর্ব প্রথম যে তাঁর সাথে গিয়ে মিলিত হবে, সে হল ফাতেমা আ.। অতঃপর যখন নবী স. মৃত্যু বরণ করলেন এবং তার ঘরে হামলা করে তাকে আহত করা হল, তখন তিনি শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন, ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়লেন ও এমন ভাবে শুকিয়ে গেলেন যেন মনে হয়েছিল শুকনো কাঠি হয়ে গেছেন (দায়ায়িমুল ইসলাম, ১/২৩২)।শেখ তুসি বর্ণনা করেন :وَ المَشهُورُ الَّذِی لاخِلافَ فِیهِ بَـینَ الشِیعَةِ أنَّ عُمَرَ ضَرَبَ عَلی بَطنِها حَتّی أسـقَطَت...শিয়াদের মধ্যে এ বিষয়ে প্রসিদ্ধি রয়েছে ও কোনরূপ মতপার্থক্য নেই যে, ফাতেমার পেটে ওমর এমন আঘাত হেনেছিল যে কারণে গর্ভের সন্তান পড়ে যায় (তালখিছুশ শাফি, ৩/১৫৬)।মুহাম্মদ ইবনে জারির ইবনে রুস্তম তাবারি (মৃ: চতূর্থ হিজরি) বর্ণনা করেন:فَلَمّا قُبِضَ رَسُولُ اللهِصلّیاللهعلیهوآله وَ جَری ما جَری فِی یَومِ دُخُولِ القَومِ عَلَیها دارَها وَ إخراجِ ابنِ عَمِّها اَمِیرِالمُؤمِنِینَ علیهالسّلام وَ ما لَحِقَها مِن الرَجُلِ أسـقَطَت بِهِ وَلَداً تَماماً وَ کانَ ذلِکَ أصلَ مَرَضِها وَ وَفاتِها. নবী স. যখন মারা গেলেন, তারপর যেদিন ফাতেমার ঘরে হামলার ঘটনা ঘটল, আমিরুল মুমিনিনকে জোরপূর্বক বের করে আনা হল এবং ঐ পুরুষের দ্বারা যে বালা ফাতেমার উপর আসল, যে কারণে তাঁর গর্ভের পূর্ণ ছেলে-সন্তানের গর্ভপাত ঘটল। আর এটাই ছিল তাঁর অসুস্থতা ও মৃত্যুর মূল কারণ (দালায়েল উল ইমামাহ/২৭)।আল্লামা হিল্লি (মৃ: ৭২৬ হি.) বর্ণনা করেন,وَ ضُرِبَت فاطِمَةُعلیهاالسّلام فَألقَت جَنِیناً اسمُهُ مُحسِنٌ... ফাতেমাকে আ. এমন আঘাত হানা হল, যে কারণে তার গর্ভের সন্তান ‘মোহসেন’ পড়ে গেল ... (শারহুত তাজরিদ/৩৭৬)।অতএব, উপরোক্ত কারণাদি পর্যালোচনা করার পর প্রমাণিত হয় যে, ফাতেমা জাহরা সা. আমিরুল মুমিনিন হযরত আলীর পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে আত্মিক ও দৈহিক ভাবে মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হন। আর তাই ছিল তাঁর মৃত্যু ও অসুস্থতার মূল কারণ। যে আঘাত খলিফার দরবারি লোকদের পক্ষ থেকে ফাতেমার ঘরে হানা হয়েছিল।মুহাম্মদ ইবনে জারির ইবনে রুস্তম তাবারি (মৃ: চতূর্থ হিজরি) বর্ণনা করেন:[عَن أبِیبَصِیرٍ عَن أبِی عَبدِاللهِعلیهالسّلام: قالَ:]وَ کانَ سَبَبُ وَفاتِها أنَّ قُنفُذاً مَولی عُمَرَ لَکَزَها بِنَعلِ السَیفِ بِأمرِهِ، فَأسـقَطَت مُحسِناً وَ مَرِضَت مِن ذلِکَ مَرَضاً شَدِیداً...ইমাম আবু আব্দিল্লাহের কাছ থেকে আবু বাছির বর্ণনা করেছেন : ওমরের নির্দেশে তার ভৃত্য ‘কুনফুয’ তরবারির গিলাফ দিয়ে ফাতেমাকে আঘাত হেনেছিল, যে কারণে মুহসিনের গর্ভপাত ঘটে এবং সে কারণেই ফাতেমা আ. মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন… (দালায়েল উল ইমামাহ/৪৫)।কাফয়ামি (মৃ: ৯০৫ হি.) বর্ণনা করেছেন :إنَّ سَبَبَ وَفاتِهاعلیهاالسّلام هُوَ أنَّها ضُرِبَت وَ أسـقَطَت.নিশ্চয় ফাতেমার মৃত্যুর কারণ হল: তিনি আঘাত প্রাপ্ত হলেন ও তাতে গর্ভপাত হল (মেসবাহ/৫২২)।প্রিয় পাঠকবর্গ! উপরোক্ত বিষয়াদি থেকে সত্যই কি বলা যায় না যে, ফাতেমা জাহরার মৃত্যু ছিল শাহাদাতের মৃত্যু?তাবারসি বর্ণনা করেন :وَ حالَت فاطِمَةُعلیهاالسّلام بَـینَ زَوجِها وَ بَـینَهُم عِندَ بابِ البَیتِ فَضَرَبَها قُنفُذٌ بِالسَوطِ عَلی عَضُدِها، فَبَـقِیَ أثَرُهُ فِی عَضُدِها مِن ذلِکَ مِثلَ الدُملُوجِ مِن ضَربِ قُنفُذٍ إیّاها فَأرسَلَ أبوبَکرٍ إلی قُنفُذٍ إضرِبها، فَألجَـأها إلی عِضادَةِ بَـیتـِها، فَدَفَعَها فَکَسَرَ ضِلعاً مِن جَنبِها وَ ألقَت جَنِیناً مِن بَطنِها، فَلَم تَزَل صاحِبَةَ فِراشٍ حَتّی ماتَت مِن ذلِکَ شَهِیدَه ...হযরত ফাতেমা তাঁর স্বামি ও আক্রমনকারী ব্যক্তিদের মাঝে দাড়িয়ে প্রতিরোধ করেছিলেন, তখন ‘কুনফুয’ ফাতেমার উরুতে এমন আঘাত হানল যে, তার দাগ বেন্ডেজের আকার ধারণ করল। আবুবকর কুনফুযকে ফাতেমাকে মারার জন্য পাঠিয়েছিল! তাই কুনফুয ফাতেমাকে ঘর থেকে আছার দিয়ে ফেলে দিল, তখন তাঁর উরুর হাড় ভেঙ্গে গেল ও পেটের সন্তানের গর্ভপাত ঘটল। অতঃপর দীর্ঘ শহ্যাশায়ী হল এবং সে অবস্থাতেই শহীদি মৃত্যু বরণ করলেন …(এহতেজাজ, ১/৮৩)।নিবেদক মোঃ জাহিদ হুসাইন
ফাতেমার আ. মৃত্যু ও নানাবিধ গোপণ রহস্য
প্রশ্ন: উৎসুক হৃদয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এমন হতে পারে যে, কী কারণে হযরত ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহা নবী স. এর ওফাতের মাত্র তিন মাসের মধ্যে মারা যান? তবে কি তিনি কোন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, নাকি তাঁর সাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। যদি সাভাবিক মৃত্যু না হয়ে থাকে, তবে কেন আমরা সুন্নি আলেম ওলামাদের মুখ থেকে তার কারণ সম্পর্কে কিছু শুনতে পাই না?
উত্তর: এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে একটি ভূমিকা দেয়া প্রয়োজন মনে করছি। আর ভূমিকাটি হল আমার জীবনের বাস্তক একটি ঘটনা। ঘটনাটি এরূপ:
ভূমিকা
নবীর স. আহলে বাইতকে ভালবাসার কারণে অনেক বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছে। একদিন আমার বড় ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করে বলল যে, তুই যে মাযহাবের অনুসরণ করিস, আলেম ওলামারা কেন তার বিরোধিতা করে? আমি বললাম : ভাই জান! যে আলেম ওলামারা আমার মাযহাবের বিরেধিতা করে, তাদেরকে প্রশ্ন করো যে, হযরত ফাতেমা জাহরা কত বছর বয়সে মারা গিয়েছেন? তাঁর মৃত্যুর কোন কারণ ছিল কি? নাকি তিনি সাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছিলেন। যদি তুমি আমার এসব প্রশ্নের উত্তর এনে দিতে পার, তবে আমি তোমাকে বলব যে, এসব আলেমরা কেন আমাদের বিরোধিতা করে।
আমার সেই ভাই ১৮ মাস হল মারা গেছেন, কিন্তু তিনি আমাকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে পারেন নি; হয়তো আলেমদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য কোন উত্তর পান নি। তবে এ কথা সত্য যে, তারপর থেকে আমার ভাই কখনো আমার সাথে বিরোধিতা করেন নি। আমি নিজেও যখন উপরোক্ত প্রশ্নাদির উত্তর জানতে পেরেছি, তখন থেকেই আমি আহলে বাইতকে ভালবাসতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি এবং আমি মনে করি: যেকোন বিবেকবান মুসলমানই এসব প্রশ্নের উত্তর জানলে নবীর আহলে বাইতকে আগের চেয়ে আরো বেশি ভাল বাসবে।
যেহেতু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে ভূমিকা টেনে পাঠকবর্গকে বিরক্ত করেছি, তাই এ পর্যায়ে উপরোক্ত প্রশ্নাদির জবাব সংক্ষেপে উল্লেখ করব তার পর সম্ভব হলে প্রতিটি প্রশ্নে জবাব বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করব ইনশা আল্লাহ।
সংক্ষিপ্ত উত্তর
ঠিক যেভাবে প্রশ্নে উল্লেখ করেছি যে, নবী স. এর ওফাতের তিনমাসের মধ্যেই ফাতেমা জাহরা মুত্যু বরণ করেছিলেন, তার এ মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। রাসূল স. এর ওফাতের পর হযরত আলীকে জোর করে বাইয়াত করানোর জন্য তাকে যখন বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে আসা হয়, তখন হযরত ফাতেমা সা. বাধা দেন এবং আগন্তক লোকদের সামনে তিনি যান। যাতে তারা আলীকে নিতে না পারে। কিন্তু এই বাধাই অবশেষে ফাতেমার মৃত্যুর কারণ হয়ে যায়। এ জন্য বলা যায় যে, নবী স. এর মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া বেলায়াতের রক্ষক হিসেবে প্রথম শহীদ হল হযরত ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহা।
অথচ সুন্নি আলেম ওলামারা এ বিষয়ে কোন কথা বলেন না। হয়তো কেউ কেউ তার কারণ জানেন না, অথবা জেনে বুঝেও তা বলেন না। কারণ তখন হয়তো সুন্নি মতাদর্শ প্রশ্নের সম্মুখিন হবে!
ফাতেমার আ. মৃত্যুর মূল রহস্য
প্রশ্ন ৩ : ফাতেমা আ. এর মৃত্যুর মূল রহস্য কী?
উত্তর : এ পশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে তার দৈহিক আঘাতের কারনাদি সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন।
ফাতেমা আ. এর দৈহিক আঘাত প্রাপ্তির মূল কারণ সমূহ
ফাতেমা আ. এর দৈহিক আঘাত প্রাপ্তির মূল কারণ সমূহ নিম্নরূপ:
১- নবীর মৃত্যুতে গভীর শোক, সবেদনা ও কান্না।
২- নবীর ওসি অর্থাৎ হযরত আলীর মজদুরিয়াত ও নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মিক শোক ও প্রতিরক্ষা ছিল দৈহিক আঘাতের দ্বিতীয় কারণ।
ইবনে শাহর অশুব (মৃ: ৫৯৯ হি.) বর্ণনা করেছেন :
“উম্মে সালমা ফাতেমার ঘরে প্রবেশ করে বলল : ওহে নবী কন্যা! কিভাবে রাত কাটালেন।
ফাতেমা বললেন : শোক ও দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে রাত কাটিয়েছি। শোক এই কারণে যে, প্রিয় নবীকে হারিয়েছি ও দুঃখ এই জন্য যে, তাঁর স্থলাভিষিক্তের উপর আরোপিত জুলুম। আল্লাহর কসম করে বলছি: এতে নবীর উত্তরসূরীর প্রতি অবমাননা হয়েছে (মানাকিবু অলে আবি তালিব, ২/২০৫।)।[1]
৩- ফাতেমা সা. এর পবিত্র পদ ও মর্যাদার অবমাননা ছিল তৃতীয় কারণ (নাহজুল বালাগার শারহ, ইবনে আবিল হাদিদ, ১৬/২১৪) ।
আল্লামা তাবারসি (মৃ: ষষ্ট হিজরি) বর্ণনা করেছিন:
[ফাদাকের খোৎবা সমাপ্তির পর ফাতেমা বলেছিলেন :
لَیتَنِی مِتُّ قَبلَ هینَـتِی وَ دُونَ ذِلَّتِی...
হায়, যদি এমন জুলুমের স্বীকার হবার পূর্বে মারা যেতাম! (এহতিজাজ, খন্ড ১, পৃ ১০৭)।
অতএব, বলা যায় যে, ফাতেমার শোকের কারণ শুধু পিতার মৃত্যুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তার সাথে আরে দু’টি ব্যাথা যোগ হয়েছিল।
৪- ফাতেমার বাড়িতে হামলার সময় তাঁর দেহে মারাত্মক আঘাত হানা হয়েছিল। অন্য ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় : তার পিতার বিরহ বিচ্ছেদের সাথে সাথে তাকে এমন আঘাত করা হয়েছিল, যার ফলে তিনি ধরাশায়ি হয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না।
কাজি নোমানি মাগরিবি বর্ণনা করেছেন :
[عَن أبِی عَبدِاللهِ جَعفَرِبنِ مُحَمَّدٍ الصادِقِعلیهالسّلام عَن أبِیهِعلیهالسّلام: قالَ:]
إنَّ رَسُولَ اللهِصلّیاللهعلیهوآله أسَرَّ إلی فاطِمَةَعلیهاالسّلام أنَّها أولی(أوَّلُ) مَن یَلحَقُ بِهِ مِن أهلِ بَـیتِهِ فَلَمّا قُبِضَ وَ نالَها مِن القَومِ ما نالَها لَزِمَت الفِراشَ وَ نَحَلَ جِسمُها وَ ذابَ لَحمُها وَ صارَت کَالخَیالِ. *
ইমাম জাফর সাদিক আ. তাঁর পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন : রাসূল স. ফাতেমাকে চুপিসারে বললেন : তাঁর ওফাতের পর তার আহলে বাইতের মধ্য থেকে সর্ব প্রথম যে তাঁর সাথে গিয়ে মিলিত হবে, সে হল ফাতেমা আ.। অতঃপর যখন নবী স. মৃত্যু বরণ করলেন এবং তার ঘরে হামলা করে তাকে আহত করা হল, তখন তিনি শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন, ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়লেন ও এমন ভাবে শুকিয়ে গেলেন যেন মনে হয়েছিল শুকনো কাঠি হয়ে গেছেন (দায়ায়িমুল ইসলাম, ১/২৩২)।
শেখ তুসি বর্ণনা করেন :
وَ المَشهُورُ الَّذِی لاخِلافَ فِیهِ بَـینَ الشِیعَةِ أنَّ عُمَرَ ضَرَبَ عَلی بَطنِها حَتّی أسـقَطَت...
শিয়াদের মধ্যে এ বিষয়ে প্রসিদ্ধি রয়েছে ও কোনরূপ মতপার্থক্য নেই যে, ফাতেমার পেটে ওমর এমন আঘাত হেনেছিল যে কারণে গর্ভের সন্তান পড়ে যায় (তালখিছুশ শাফি, ৩/১৫৬)।
মুহাম্মদ ইবনে জারির ইবনে রুস্তম তাবারি (মৃ: চতূর্থ হিজরি) বর্ণনা করেন:
فَلَمّا قُبِضَ رَسُولُ اللهِصلّیاللهعلیهوآله وَ جَری ما جَری فِی یَومِ دُخُولِ القَومِ عَلَیها دارَها وَ إخراجِ ابنِ عَمِّها اَمِیرِالمُؤمِنِینَ علیهالسّلام وَ ما لَحِقَها مِن الرَجُلِ أسـقَطَت بِهِ وَلَداً تَماماً وَ کانَ ذلِکَ أصلَ مَرَضِها وَ وَفاتِها.
নবী স. যখন মারা গেলেন, তারপর যেদিন ফাতেমার ঘরে হামলার ঘটনা ঘটল, আমিরুল মুমিনিনকে জোরপূর্বক বের করে আনা হল এবং ঐ পুরুষের দ্বারা যে বালা ফাতেমার উপর আসল, যে কারণে তাঁর গর্ভের পূর্ণ ছেলে-সন্তানের গর্ভপাত ঘটল। আর এটাই ছিল তাঁর অসুস্থতা ও মৃত্যুর মূল কারণ (দালায়েল উল ইমামাহ/২৭)।
আল্লামা হিল্লি (মৃ: ৭২৬ হি.) বর্ণনা করেন,
وَ ضُرِبَت فاطِمَةُعلیهاالسّلام فَألقَت جَنِیناً اسمُهُ مُحسِنٌ...
ফাতেমাকে আ. এমন আঘাত হানা হল, যে কারণে তার গর্ভের সন্তান ‘মোহসেন’ পড়ে গেল ... (শারহুত তাজরিদ/৩৭৬)।
অতএব, উপরোক্ত কারণাদি পর্যালোচনা করার পর প্রমাণিত হয় যে, ফাতেমা জাহরা সা. আমিরুল মুমিনিন হযরত আলীর পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে আত্মিক ও দৈহিক ভাবে মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হন। আর তাই ছিল তাঁর মৃত্যু ও অসুস্থতার মূল কারণ। যে আঘাত খলিফার দরবারি লোকদের পক্ষ থেকে ফাতেমার ঘরে হানা হয়েছিল।
মুহাম্মদ ইবনে জারির ইবনে রুস্তম তাবারি (মৃ: চতূর্থ হিজরি) বর্ণনা করেন:
[عَن أبِیبَصِیرٍ عَن أبِی عَبدِاللهِعلیهالسّلام: قالَ:]
وَ کانَ سَبَبُ وَفاتِها أنَّ قُنفُذاً مَولی عُمَرَ لَکَزَها بِنَعلِ السَیفِ بِأمرِهِ، فَأسـقَطَت مُحسِناً وَ مَرِضَت مِن ذلِکَ مَرَضاً شَدِیداً...
ইমাম আবু আব্দিল্লাহের কাছ থেকে আবু বাছির বর্ণনা করেছেন : ওমরের নির্দেশে তার ভৃত্য ‘কুনফুয’ তরবারির গিলাফ দিয়ে ফাতেমাকে আঘাত হেনেছিল, যে কারণে মুহসিনের গর্ভপাত ঘটে এবং সে কারণেই ফাতেমা আ. মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন… (দালায়েল উল ইমামাহ/৪৫)।
কাফয়ামি (মৃ: ৯০৫ হি.) বর্ণনা করেছেন :
إنَّ سَبَبَ وَفاتِهاعلیهاالسّلام هُوَ أنَّها ضُرِبَت وَ أسـقَطَت.
নিশ্চয় ফাতেমার মৃত্যুর কারণ হল: তিনি আঘাত প্রাপ্ত হলেন ও তাতে গর্ভপাত হল (মেসবাহ/৫২২)।
প্রিয় পাঠকবর্গ! উপরোক্ত বিষয়াদি থেকে সত্যই কি বলা যায় না যে, ফাতেমা জাহরার মৃত্যু ছিল শাহাদাতের মৃত্যু?
তাবারসি বর্ণনা করেন :
وَ حالَت فاطِمَةُعلیهاالسّلام بَـینَ زَوجِها وَ بَـینَهُم عِندَ بابِ البَیتِ فَضَرَبَها قُنفُذٌ بِالسَوطِ عَلی عَضُدِها، فَبَـقِیَ أثَرُهُ فِی عَضُدِها مِن ذلِکَ مِثلَ الدُملُوجِ مِن ضَربِ قُنفُذٍ إیّاها فَأرسَلَ أبوبَکرٍ إلی قُنفُذٍ إضرِبها، فَألجَـأها إلی عِضادَةِ بَـیتـِها، فَدَفَعَها فَکَسَرَ ضِلعاً مِن جَنبِها وَ ألقَت جَنِیناً مِن بَطنِها، فَلَم تَزَل صاحِبَةَ فِراشٍ حَتّی ماتَت مِن ذلِکَ شَهِیدَه ...
হযরত ফাতেমা তাঁর স্বামি ও আক্রমনকারী ব্যক্তিদের মাঝে দাড়িয়ে প্রতিরোধ করেছিলেন, তখন ‘কুনফুয’ ফাতেমার উরুতে এমন আঘাত হানল যে, তার দাগ বেন্ডেজের আকার ধারণ করল। আবুবকর কুনফুযকে ফাতেমাকে মারার জন্য পাঠিয়েছিল! তাই কুনফুয ফাতেমাকে ঘর থেকে আছার দিয়ে ফেলে দিল, তখন তাঁর উরুর হাড় ভেঙ্গে গেল ও পেটের সন্তানের গর্ভপাত ঘটল। অতঃপর দীর্ঘ শহ্যাশায়ী হল এবং সে অবস্থাতেই শহীদি মৃত্যু বরণ করলেন …(এহতেজাজ, ১/৮৩)।
নিবেদক মোঃ জাহিদ হুসাইন
মন্তব্যসমূহ