ঈদ মোবারকআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদসর্বোত্তম মহামানব ও তাঁরই নুরের এক অনন্য নক্ষত্রের জন্ম-বার্ষিকীহযরত মাওলা মুহাম্মাদ (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। তাঁর শুভ জন্মদিন তাই মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন এবং এই দিন মুসলমানদের ঐক্যের সবচেয়ে বড় শুভ-লগ্ন। এই মহাখুশির দিন উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি অশেষ মুবারকবাদ, মহান আল্লাহর প্রতি জানাচ্ছি অশেষ শুকরিয়া এবং হযরত মাওলা মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি অশেষ দরুদ ও সালাম।গভীর আঁধার কেটে ভেসে ওঠে আলোকের গোলক,/সমস্ত পৃথিবী যেন গায়ে মাখে জ্যোতির পরাগ;/তাঁর পদপ্রান্তে লেগে নড়ে ওঠে কালের দোলক/বিশ্বাসে নরম হয় আমাদের বিশাল ভূভাগ।/হেরার বিনীত মুখে বেহেস্তের বিচ্ছুরিত স্বেদ/শান্তির সোহাগ যেন তাঁর সেই ললিত আহ্বান/তারই করাঘাতে ভাঙ্গে জীবিকার কুটিল প্রভেদ/দুঃখীর সমাজ যেন হয়ে যাবে ফুলের বাগান।/লাত-মানাতের বুকে বিদ্ধ হয় দারুণ শায়ক/যে সব পাষাণ ছিল গঞ্জনার গৌরবে পাথর/একে একে ধ্বসে পড়ে ছলনার নকল নায়ক/পাথর চৌচির করে ভেসে আসে ঈমানের স্বর।/লাঞ্ছিতের আসমানে তিনি যেন সোনালী ঈগল/ডানার আওয়াজে তাঁর কেপে ওঠে বন্দীর দুয়ার;/ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জাহেলের সামান্য শিকল/আদিগন্ত ভেদ করে চলে সেই আলোর জোয়ার।...../মোহাম্মাদ- এ নামেই বাতাস বয়,/মোহাম্মাদ- এ শব্দে জুড়ায় দেহ/মোহাম্মাদ- এ প্রেমেই আল্লা খুশী/দোযখ বুঝিবা নিভে যায় এই নামে।/ঐ নামে কত নিপীড়িত তোলে মাথা/কত মাথা দেয় শহীদেরা নির্ভয়ে,/রক্তের সীমা, বর্ণের সীমা ভেঙ্গে/মানুষেরা হয় সীমাহীন ইয়াসীন।/এই নামে ফোটে হৃদয়ে গোলাপ কলি/যেন অদৃশ্য গন্ধে মাতাল মন,যেন ঘনঘোর আঁধারে আলোর কলি/অকুল পাথারে আল্লার আয়োজন। (কবি আলমাহমুদ)আজ মাওলা মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)'রও শুভ জন্মদিন। তাই এ উপলক্ষেও সবাইকে জানাচ্ছি মুবারকবাদ এবং এই মহান ইমামের উদ্দেশে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম। ইসলামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ও এ ধর্মকে সাংস্কৃতিক বা চিন্তাগত হামলাসহ সার্বিক ক্ষতিকর দিক থেকে সুরক্ষার জন্য যা যা করার দরকার তার সবই তিনি করেছিলেন। ইমাম জাফর আস সাদিক ৮৩ হিজরির ১৭ ই রবিউল আউয়াল মদীনায় ভূমিষ্ঠ হন। তিনি ১৪৭ হিজরির ২৫ শে শাওয়াল শাহাদত বরণ করেন। আব্বাসিয় শাসক মনসুর দাওয়ানিকি বিষ প্রয়োগ করে এই মহান ইমামকে শহীদ করে। এই মহান ইমাম সম্পর্কে আমরা আরও কথা বলব আরও কিছুক্ষণ পর।মাওলা মুহাম্মাদে আবির্ভাবের অনেক আগ থেকেই সারা বিশ্বই ভরে গিয়েছিল জুলুম, শোষণ, অনাচার, কুসংস্কার, অশান্তি, সংঘাত এবং সব ধরনের পাপাচারে। এ অবস্থায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.)'র আবির্ভাব ছিল ঘন অমাবস্যার রাতে সূর্যের প্রদীপ্ত উন্মেষের মতই অফুরন্ত কল্যাণ আর আলোর বন্যার ছড়াছড়ির সমতুল্য এবং তাঁর বাণী স্বাধীকারহারা মানুষের মনে জাগিয়ে তোলে অধিকার ফিরে পাওয়ার দূর্বার বাসনা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি সঞ্চালন করেন সততা, সৌন্দর্য, ন্যায়বিচার, সুধর্ম এবং সব ধরনের সৎগুণ ও নীতির জোয়ার। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ বিশ্ব-সভ্যতার চরম উন্নতির পরিবেশ তৈরি হয়। মহানবী (সা) হচ্ছেন প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন বিশ্বের প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র বা সংবিধান যা ঐতিহাসিক মদীনা সনদ হিসেবে খ্যাত।শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। মানবজাতিকে নিয়মের অনুসারী ও সুশৃঙ্খল করতে শাসনতন্ত্র বা সংবিধান জরুরি। বিশ্বের সবচেয়ে উচ্ছৃঙ্খল, যুদ্ধবাজ এবং অনিয়ম ও রক্তপাতে অভ্যস্ত আরব গোত্রগুলো মহান ইসলামী আদর্শের ছায়াতলে এই মদীনা সনদের আওতায় এসে হয়ে পড়ে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত জাতিতে। মহানবী (সা) মদীনা সনদের মাধ্যমে নির্যাতন-উৎপীড়ন, নারীদের প্রতি অবিচার, কলহ-বিদ্বেষ, উঁচু-নিচুর বিভেদসহ সব ধরনের অন্যায় দুর করতে মদীনা সনদের মাধ্যমে মানবতার সব কল্যাণের পথ দেখিয়েছেন ও উদারতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ সনদের মাধ্যমে সকল ঐশী ধর্মের অনুসারীদের প্রতি শ্রদ্ধাব্যঞ্জক ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথও তিনি দেখিয়েছেন। এর মাধ্যমে মহানবী -সা. ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এবং আশরাফের কৌলীন্যও বন্ধ করেছেন। মানবজাতির জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর উপদেশমালা দিয়ে গেছেন মাওলা মুহাম্মাদ (সা)। ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণ এ ধরনেরই উপদেশমালার অন্যতম। এতেও রয়েছে পবিত্র কুরআনের নীতিমালার আলোকে প্রণীত মদিনা সনদের প্রতিফলন। মদিনা সনদের ৪৭টি ধারার মধ্যে মানবতা স্থান পেয়েছে সর্বাগ্রে। আধুনিক যুগে আমরা মানবতার যেসব শ্লোগান শুনি ও সেসবের বাস্তবায়ন খুব কমই দেখি সেই মানবতার নীতিমালার সর্বোত্তম শিক্ষক ছিলেন মহানবী (সা) এবং তিনি কেবল কথায় নয় কাজের মাধ্যমেই সেইসব নীতির বাস্তবায়ন দেখিয়ে গেছেন। -মহানবীর আদর্শ রাষ্ট্র ও ইসলামী ব্যবস্থায় দাসরা হয়ে পড়ে স্বাধীন মানুষের মর্যাদাসম্পন্ন এবং নারীও পায় সর্বোচ্চ ন্যায়-বিচার-ভিত্তিক সম্মান। হিংসা-বিদ্বেষ এবং ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ বিলুপ্ত হয়ে সবাই হয় ভাইভাই। প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে মহানবী (সা) এমন সুন্দর, আন্তরিক ও মহানুভব আচরণ করতেন যেন সবাই তাঁর আপন পরিবারেরই সদস্য। মহানবীর সাম্যবাদ ফুটে উঠেছে কবি নজরুলের ভাষায় এভাবে:ইসলামে নাই ছোট বড় আর আশরাফ, আতরাফ/নিষ্ঠুর হাতে এই ভেদজাল কর মিসমার খাক।চাকর সাজিতে, চাকরি করিতে/ইসলাম আনে নাই পৃথিবীতে।মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন/কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন/হাতে হাত দিয়ে আগে চল।.. খোদার সৃষ্ট মানুষের ভালোবাসিতে পারে না যারাজানিনা কেমনে জনগণ নেতা হতে চায় হায় তারা .... মানুষে মানুষের অধিকার দিল যে জন/‘এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই’- কহিল যে জন,/মানুষের লাগি চির দীন-হীন বেশ ধরিল যে- জন।/বাদশাহ-ফকিরে এক শামিল করিল যেজন-এল ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী/ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবিআজি মাতিল বিশ্ব-নিখিল মুক্তি কলরোলে/তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলেবিশিষ্ট গবেষক মুহাম্মাদ শফি চাকলাদার লিখেছেন: বিশ্বের প্রথম যে শাসনতন্ত্র দিয়ে গেছেন মহানবী (সা) সে সম্পর্কেই আমরা কতটুকু জানি বা জানবার চেষ্টা করি? যেখানে ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের সভ্য বলে দাবি করে, সেই ইউরোপ-আমেরিকায় নারীদের জন্য কোন স্থান ধর্মে- ইবাদতে কোথাও ছিল না। রোমের সংসদে নারীদের স্থান ছিল অপবিত্র জানোয়ার হিসেবে। এটা জানা যায় যে, রাসূল (সা.)-এর নবুওত লাভের পূর্বে ৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসীরা নারীদের প্রতি অনুগ্রহ করে স্বীকৃতি দেয় যে, নারী প্রাণী হবে হয়তো, তবে শুধু পুরুষদের সেবার উদ্দেশ্যেই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ‘মদীনা সনদ’ যে ভূমিকা রাখল বা প্রবর্তন করল তারই ধারায় ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। রাসূল (সা.)-এর মানবাধিকার ৬২৪ খৃ. আর ১৯৪৮ খৃ. মাঝে প্রায় ১৪০০ বছর পার হল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর যখন জাতিসংঘের আদলে ‘লীগ অব নেশন্স’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে সম্পর্কে ‘চোর-ডাকাত’ কবিতায় কবি নজরুল লিখেছেন:যারা বড় ডাকাত দস্যু জোচ্চোর দাগাবাজতারা তত বড় সম্মানী গুণী জাতিসংঘেতে আজ॥আজ বিশ্বের নানা অঞ্চলে বিশেষ করে ফিলিস্তিনে, ইয়েমেনে, মিয়ানমারে ও আফগানিস্তানে যেসব হত্যাযজ্ঞ হচ্ছে এবং এসব দেশের নারী ও শিশুসহ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার নীতিমালা লঙ্ঘন করে, আর নীরব দর্শক হয়ে বা সবুজ সংকেত দিয়ে জাতিসংঘ যে কখনও তার মেরুদণ্ডহীনতা ও কখনও অনিরপেক্ষতা দেখাচ্ছে তাঁর কারণও হচ্ছে মহানবীর ইসলামী আদর্শ ও মানবতার নীতি বাস্তবায়নের মত যোগ্য বিশ্ব-নেতৃত্বের অভাব। তাই বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত মানবতা যেন কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের সঙ্গেই সুর মিলিয়ে মহানবীর যোগ্য উত্তরসূরির হাতে তথা ইমাম মাহদির হাতে মানবতার পুনমুক্তির প্রত্যাশায় বলতে চায়: পাঠাও বেহেশত হতে হযরত পুনঃসাম্যের বাণী/আর দেখিতে পারিনা মানুষে মানুষে এই হীন হানাহানি॥বলিয়া পাঠাও হে হযরত, যাহারা তোমার প্রিয় উম্মত/সকল মানুষে বাসে তারা ভালো খোদার সৃষ্টি জানি সবারে খোদারই সৃষ্টি জানি॥আধেক পৃথিবী আনিল ঈমান যে উদারতা গুণে/ তোমার যে উদারতা গুণেশিখিনি আমরা সে উদারতা কেবলি গেলাম শুনে/কোরানে হাদিসে কেবলি গেলাম শুনে।তোমার আদেশ অমান্য করে/লাঞ্ছিত মোরা ত্রিভুবন ভরে।/আতুর মানুষে হেলা করে বলি, ‘আমরা খোদারে মানি’।বৃথা বলি ‘আমরা খোদারে মানি’॥মুসলমানদের মধ্যে মহানবীর আদর্শের অনুসরণ ম্লান ও অতি-দুর্বল হয়ে পড়ায় ইসলামের পুনর্জাগরণের প্রত্যাশী সাম্যবাদের কবি নজরুল আক্ষেপ করে বলেছিলেন: আল্লাহতে যার পূর্ণ ইমান কোথা সে মুসলমান! আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম
ঈদ মোবারক
আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ
সর্বোত্তম মহামানব ও তাঁরই নুরের এক অনন্য নক্ষত্রের জন্ম-বার্ষিকী
হযরত মাওলা মুহাম্মাদ (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। তাঁর শুভ জন্মদিন তাই মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন এবং এই দিন মুসলমানদের ঐক্যের সবচেয়ে বড় শুভ-লগ্ন। এই মহাখুশির দিন উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি অশেষ মুবারকবাদ, মহান আল্লাহর প্রতি জানাচ্ছি অশেষ শুকরিয়া এবং হযরত মাওলা মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি অশেষ দরুদ ও সালাম।
গভীর আঁধার কেটে ভেসে ওঠে আলোকের গোলক,/
সমস্ত পৃথিবী যেন গায়ে মাখে জ্যোতির পরাগ;
/তাঁর পদপ্রান্তে লেগে নড়ে ওঠে কালের দোলক/
বিশ্বাসে নরম হয় আমাদের বিশাল ভূভাগ।
/হেরার বিনীত মুখে বেহেস্তের বিচ্ছুরিত স্বেদ/
শান্তির সোহাগ যেন তাঁর সেই ললিত আহ্বান/
তারই করাঘাতে ভাঙ্গে জীবিকার কুটিল প্রভেদ/
দুঃখীর সমাজ যেন হয়ে যাবে ফুলের বাগান।/
লাত-মানাতের বুকে বিদ্ধ হয় দারুণ শায়ক/
যে সব পাষাণ ছিল গঞ্জনার গৌরবে পাথর/
একে একে ধ্বসে পড়ে ছলনার নকল নায়ক/
পাথর চৌচির করে ভেসে আসে ঈমানের স্বর।/
লাঞ্ছিতের আসমানে তিনি যেন সোনালী ঈগল/
ডানার আওয়াজে তাঁর কেপে ওঠে বন্দীর দুয়ার;
/ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জাহেলের সামান্য শিকল
/আদিগন্ত ভেদ করে চলে সেই আলোর জোয়ার।
...../মোহাম্মাদ- এ নামেই বাতাস বয়,
/মোহাম্মাদ- এ শব্দে জুড়ায় দেহ
/মোহাম্মাদ- এ প্রেমেই আল্লা খুশী
/দোযখ বুঝিবা নিভে যায় এই নামে।
/ঐ নামে কত নিপীড়িত তোলে মাথা
/কত মাথা দেয় শহীদেরা নির্ভয়ে,
/রক্তের সীমা, বর্ণের সীমা ভেঙ্গে
/মানুষেরা হয় সীমাহীন ইয়াসীন।
/এই নামে ফোটে হৃদয়ে গোলাপ কলি
/যেন অদৃশ্য গন্ধে মাতাল মন,
যেন ঘনঘোর আঁধারে আলোর কলি
/অকুল পাথারে আল্লার আয়োজন। (কবি আলমাহমুদ)
আজ মাওলা মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (আ.)'রও শুভ জন্মদিন। তাই এ উপলক্ষেও সবাইকে জানাচ্ছি মুবারকবাদ এবং এই মহান ইমামের উদ্দেশে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম। ইসলামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ও এ ধর্মকে সাংস্কৃতিক বা চিন্তাগত হামলাসহ সার্বিক ক্ষতিকর দিক থেকে সুরক্ষার জন্য যা যা করার দরকার তার সবই তিনি করেছিলেন। ইমাম জাফর আস সাদিক ৮৩ হিজরির ১৭ ই রবিউল আউয়াল মদীনায় ভূমিষ্ঠ হন। তিনি ১৪৭ হিজরির ২৫ শে শাওয়াল শাহাদত বরণ করেন। আব্বাসিয় শাসক মনসুর দাওয়ানিকি বিষ প্রয়োগ করে এই মহান ইমামকে শহীদ করে। এই মহান ইমাম সম্পর্কে আমরা আরও কথা বলব আরও কিছুক্ষণ পর।
মাওলা মুহাম্মাদে আবির্ভাবের অনেক আগ থেকেই সারা বিশ্বই ভরে গিয়েছিল জুলুম, শোষণ, অনাচার, কুসংস্কার, অশান্তি, সংঘাত এবং সব ধরনের পাপাচারে। এ অবস্থায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.)'র আবির্ভাব ছিল ঘন অমাবস্যার রাতে সূর্যের প্রদীপ্ত উন্মেষের মতই অফুরন্ত কল্যাণ আর আলোর বন্যার ছড়াছড়ির সমতুল্য এবং তাঁর বাণী স্বাধীকারহারা মানুষের মনে জাগিয়ে তোলে অধিকার ফিরে পাওয়ার দূর্বার বাসনা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি সঞ্চালন করেন সততা, সৌন্দর্য, ন্যায়বিচার, সুধর্ম এবং সব ধরনের সৎগুণ ও নীতির জোয়ার। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ বিশ্ব-সভ্যতার চরম উন্নতির পরিবেশ তৈরি হয়।
মহানবী (সা) হচ্ছেন প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন বিশ্বের প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র বা সংবিধান যা ঐতিহাসিক মদীনা সনদ হিসেবে খ্যাত।
শাসনতন্ত্র ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। মানবজাতিকে নিয়মের অনুসারী ও সুশৃঙ্খল করতে শাসনতন্ত্র বা সংবিধান জরুরি। বিশ্বের সবচেয়ে উচ্ছৃঙ্খল, যুদ্ধবাজ এবং অনিয়ম ও রক্তপাতে অভ্যস্ত আরব গোত্রগুলো মহান ইসলামী আদর্শের ছায়াতলে এই মদীনা সনদের আওতায় এসে হয়ে পড়ে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত জাতিতে।
মহানবী (সা) মদীনা সনদের মাধ্যমে নির্যাতন-উৎপীড়ন, নারীদের প্রতি অবিচার, কলহ-বিদ্বেষ, উঁচু-নিচুর বিভেদসহ সব ধরনের অন্যায় দুর করতে মদীনা সনদের মাধ্যমে মানবতার সব কল্যাণের পথ দেখিয়েছেন ও উদারতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ সনদের মাধ্যমে সকল ঐশী ধর্মের অনুসারীদের প্রতি শ্রদ্ধাব্যঞ্জক ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথও তিনি দেখিয়েছেন। এর মাধ্যমে মহানবী -সা. ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এবং আশরাফের কৌলীন্যও বন্ধ করেছেন।
মানবজাতির জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর উপদেশমালা দিয়ে গেছেন মাওলা মুহাম্মাদ (সা)। ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণ এ ধরনেরই উপদেশমালার অন্যতম। এতেও রয়েছে পবিত্র কুরআনের নীতিমালার আলোকে প্রণীত মদিনা সনদের প্রতিফলন। মদিনা সনদের ৪৭টি ধারার মধ্যে মানবতা স্থান পেয়েছে সর্বাগ্রে। আধুনিক যুগে আমরা মানবতার যেসব শ্লোগান শুনি ও সেসবের বাস্তবায়ন খুব কমই দেখি সেই মানবতার নীতিমালার সর্বোত্তম শিক্ষক ছিলেন মহানবী (সা) এবং তিনি কেবল কথায় নয় কাজের মাধ্যমেই সেইসব নীতির বাস্তবায়ন দেখিয়ে গেছেন। -
মহানবীর আদর্শ রাষ্ট্র ও ইসলামী ব্যবস্থায় দাসরা হয়ে পড়ে স্বাধীন মানুষের মর্যাদাসম্পন্ন এবং নারীও পায় সর্বোচ্চ ন্যায়-বিচার-ভিত্তিক সম্মান। হিংসা-বিদ্বেষ এবং ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ বিলুপ্ত হয়ে সবাই হয় ভাইভাই। প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে মহানবী (সা) এমন সুন্দর, আন্তরিক ও মহানুভব আচরণ করতেন যেন সবাই তাঁর আপন পরিবারেরই সদস্য। মহানবীর সাম্যবাদ ফুটে উঠেছে কবি নজরুলের ভাষায় এভাবে:
ইসলামে নাই ছোট বড় আর আশরাফ, আতরাফ/
নিষ্ঠুর হাতে এই ভেদজাল কর মিসমার খাক।
চাকর সাজিতে, চাকরি করিতে
/ইসলাম আনে নাই পৃথিবীতে।
মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন/
কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন/
হাতে হাত দিয়ে আগে চল।
.. খোদার সৃষ্ট মানুষের ভালোবাসিতে পারে না যারা
জানিনা কেমনে জনগণ নেতা হতে চায় হায় তারা ....
মানুষে মানুষের অধিকার দিল যে জন/
‘এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই’- কহিল যে জন,/
মানুষের লাগি চির দীন-হীন বেশ ধরিল যে- জন।
/বাদশাহ-ফকিরে এক শামিল করিল যেজন-
এল ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী
/ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি
আজি মাতিল বিশ্ব-নিখিল মুক্তি কলরোলে/
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
বিশিষ্ট গবেষক মুহাম্মাদ শফি চাকলাদার লিখেছেন: বিশ্বের প্রথম যে শাসনতন্ত্র দিয়ে গেছেন মহানবী (সা) সে সম্পর্কেই আমরা কতটুকু জানি বা জানবার চেষ্টা করি? যেখানে ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের সভ্য বলে দাবি করে, সেই ইউরোপ-আমেরিকায় নারীদের জন্য কোন স্থান ধর্মে- ইবাদতে কোথাও ছিল না। রোমের সংসদে নারীদের স্থান ছিল অপবিত্র জানোয়ার হিসেবে। এটা জানা যায় যে, রাসূল (সা.)-এর নবুওত লাভের পূর্বে ৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসীরা নারীদের প্রতি অনুগ্রহ করে স্বীকৃতি দেয় যে, নারী প্রাণী হবে হয়তো, তবে শুধু পুরুষদের সেবার উদ্দেশ্যেই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ‘মদীনা সনদ’ যে ভূমিকা রাখল বা প্রবর্তন করল তারই ধারায় ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। রাসূল (সা.)-এর মানবাধিকার ৬২৪ খৃ. আর ১৯৪৮ খৃ. মাঝে প্রায় ১৪০০ বছর পার হল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর যখন জাতিসংঘের আদলে ‘লীগ অব নেশন্স’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে সম্পর্কে ‘চোর-ডাকাত’ কবিতায় কবি নজরুল লিখেছেন:
যারা বড় ডাকাত দস্যু জোচ্চোর দাগাবাজ
তারা তত বড় সম্মানী গুণী জাতিসংঘেতে আজ॥
আজ বিশ্বের নানা অঞ্চলে বিশেষ করে ফিলিস্তিনে, ইয়েমেনে, মিয়ানমারে ও আফগানিস্তানে যেসব হত্যাযজ্ঞ হচ্ছে এবং এসব দেশের নারী ও শিশুসহ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার নীতিমালা লঙ্ঘন করে, আর নীরব দর্শক হয়ে বা সবুজ সংকেত দিয়ে জাতিসংঘ যে কখনও তার মেরুদণ্ডহীনতা ও কখনও অনিরপেক্ষতা দেখাচ্ছে তাঁর কারণও হচ্ছে মহানবীর ইসলামী আদর্শ ও মানবতার নীতি বাস্তবায়নের মত যোগ্য বিশ্ব-নেতৃত্বের অভাব। তাই বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত মানবতা যেন কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের সঙ্গেই সুর মিলিয়ে মহানবীর যোগ্য উত্তরসূরির হাতে তথা ইমাম মাহদির হাতে মানবতার পুনমুক্তির প্রত্যাশায় বলতে চায়:
পাঠাও বেহেশত হতে হযরত পুনঃসাম্যের বাণী/
আর দেখিতে পারিনা মানুষে মানুষে এই হীন হানাহানি॥
বলিয়া পাঠাও হে হযরত, যাহারা তোমার প্রিয় উম্মত/
সকল মানুষে বাসে তারা ভালো খোদার সৃষ্টি জানি
সবারে খোদারই সৃষ্টি জানি॥
আধেক পৃথিবী আনিল ঈমান যে উদারতা গুণে/
তোমার যে উদারতা গুণে
শিখিনি আমরা সে উদারতা কেবলি গেলাম শুনে
/কোরানে হাদিসে কেবলি গেলাম শুনে।
তোমার আদেশ অমান্য করে/লাঞ্ছিত মোরা ত্রিভুবন ভরে।
/আতুর মানুষে হেলা করে বলি, ‘আমরা খোদারে মানি’।
বৃথা বলি ‘আমরা খোদারে মানি’॥
মুসলমানদের মধ্যে মহানবীর আদর্শের অনুসরণ ম্লান ও অতি-দুর্বল হয়ে পড়ায় ইসলামের পুনর্জাগরণের প্রত্যাশী সাম্যবাদের কবি নজরুল আক্ষেপ করে বলেছিলেন: আল্লাহতে যার পূর্ণ ইমান কোথা সে মুসলমান!
আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম
মন্তব্যসমূহ