বেলায়েতের আয়াতের ব্যাকরণগত দিক সম্পর্কে একটি গবেষণামূলক ও বিশ্লেষণমূলক পোস্টপর্ব (((((৫)))))রুকুর প্রকৃত অর্থ :কুশচীর পূর্বে আহলে সুন্নাতের আরো অনেক আলেম ও মনীষী “রুকু” কে বিনয়ী অর্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। যেন এর দ্বারা তারা দাবি করতে পারেন যে, এই সিফাত অর্থাৎ রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান একজন ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং সকল মু’মিনই এর অন্তর্ভুক্ত। অথচ রুকুর প্রকৃত অর্থ বিনয়ী নয়। কেননা :ভাষাবিদদের অনেকেই বলেছেন যে রুকুর প্রকৃত অর্থ হল “উপুড় হওয়া” বা “বাঁকা হওয়া”। যামাখশারী তার আসাসুল বালাগা গ্রন্থটিতে, যা শব্দের প্রকৃত অর্থ থেকে রূপক অর্থকে আলাদা করার জন্য নিমিত্তে রচনা করেছেন, লিখেছেন “রুকু” এর অর্থ হল “ঝুকে পড়া”।(যামাখশারী, আসাসুল বালাগ, পৃ.-১৭৬)তাজুল আরুস (যুবাইদি, তাজুল আরুস মিন জাওয়াহিরুল ক্বামূস, ৫ম খণ্ড, পৃ.-৩৬২) এবং মাজমাউল বাহরাইন (তুরাইহী, মাজমাউল বাহরাইন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩৩৯) এর লেখকবৃন্দও বলেছেন রুকুর অর্থ বাঁকা হওয়া বা ন্যুব্জ হয়ে পড়া।তাজুল আরুসে এভাবে এসেছে:«رکع الشیخ» : এ বৃদ্ধ ব্যক্তি ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে রুকুর প্রকৃত অর্থ এটিই আর এখান থেকেই নামাজের রুকুর অর্থ নেয়া হয়েছে।ইবনে ফারেস লিখেছেন:“রাকাআ” শব্দটি মানুষ ছাড়াও অন্যান্য যে কোন কিছুর ক্ষেত্রে উপুড় ও নত হওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেক বক্র ও নুব্জ বস্তুকে রুকুকারী বলা হয়। আর নামাজের রুকুর অর্থও এটাই। (ইবনে ফারেস, মুকায়িসুল লুগাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৩৪)রাগেব ইসফাহানীও বলেছেন যে, রুকুর অর্থ উপুড় হওয়া। (ইসফাহানী, মুফরাদাতু আলফাজিল কোরআন, ৩৬৪)ফাইয়ুমি লিখেছেন: رکع رکوعا : উপুড় হওয়া, যে বৃদ্ধলোক বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছে তাকে «رکع الشیخ» বলা হয় অর্থাৎ বয়স্ক লোকটি বাঁকা হয়ে গেছে। (ফাইয়ুমি, আল মিসবাহুল মুনির, পৃ.-২৩৭)অতএব প্রকৃত অর্থে রুকু হচ্ছে বিশেষ পদ্ধতিতে মাথা নোয়ানো আর ইসলামি শরীয়তেও তা এই একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কারণে “বিনয়ী ও নমনীয়” হচ্ছে রুকুর রূপক অর্থ। (সাইয়েদ মুরতাজা, প্রগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ.-২৩১) আর তাই কোন কারিনা অর্থাৎ সমর্থক দলীল বা রূপক অর্থ নির্দেশক সহযোগী প্রমাণ ছাড়া এ শব্দটিকে “বিনয়ী ও নমনীয়” অর্থে ব্যবহার করা ঠিক নয়।বেলায়াতের আয়াতে “রুকু” যে তার রূপক অর্থ অর্থাৎ “বিনয়ী ও নমনীয়” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এমন কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং রুকু তার প্রকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।ولی শব্দটির অর্থ :আলোচ্য আয়াতে আহলে সুন্নাত এবং ইমামীয়া কালামশাস্ত্রবীদদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে ولی শব্দটির অর্থ নিয়ে।আহলে সুন্নাতের অনেক আলেম যেমন: ইজি এবং কুশচী (কুশচী, প্রাগুক্ত,পৃ.৩৬৮ ইজি, প্রাগুক্ত, পৃ.-৬০২) মনে করেন এই আয়াতে “ওয়ালি” শব্দটির অর্থ ‘কর্তৃত্বে ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতম’ নয়। কেননা :প্রথম দলীল : আয়াতের অবস্থানজনিত ভাব বা বাচনিক ধারাএই আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍঅর্থাৎ হে মুমিনগণ তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না, তারা একে অপরের বন্ধু। (সূরা মায়েদা-৫১) “ওয়ালি” র অর্থ বন্ধু বা সাহায্যকারী। কেননা এই আয়াতে ইহুদী এবং খ্রীষ্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করতে না করা হয়েছে সুতরাং “ওয়ালি” শব্দটি এখানে নেতৃত্ব বা ইমামত অর্থে ববহৃত হয় নি। বরং উদ্দেশ্য হল বন্ধু এবং সাহায্যকারী। অনুরূপভাবে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে:وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَঅর্থাৎ আর যারা আল্লাহ তার রাসূল এবং বিশ্বাসীদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহর দল এবং তারাই বিজয়ী। (মায়েদা-৫৬) এখানে تَوَلّ শব্দটির অর্থ বন্ধুত্ব এবং সাহায্যকারী, ইমামত নয়। সুতরাং আলোচ্য আয়াতের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আয়াত থেকেও বোঝা যায় যে এই আয়াতের “ওয়ালি” র অর্থ বন্ধু এবং সাহায্যকারী। তাই এ ক্ষেত্রে গ্রহণ উপযুক্ত নয়।তাদের বক্তব্যের সারমর্ম হল এই আয়াতের পূর্ব ও পরবর্তী আয়াতের বাচনিক রূপ ও ধারাই বলে দিচ্ছে যে, ওয়ালি শব্দের অর্থ বন্ধু এবং সাহায্যকারী আর তা ওয়ালি শব্দকে ইমামত বা কর্তৃত্ব অর্থে গ্রহণের যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে।দ্বিতীয় দলীল: হাসর অনুপস্থিতহাসর দ্বিধা, সন্দেহ দূরীভূত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এটা স্পষ্ট যে এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় খেলাফতের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়নি এবং ইমামতের ব্যাপারে কোন বিতর্কও ছিলনা। অন্যদিকে এই আয়াতে “ইন্নামা” সীমাবদ্ধতার জন্যও ব্যবহৃত হয়নি। পূর্বেই এই আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে।সমালোচনা ও পর্যালোচনা :কুশচী “ওয়ালি” শব্দের আরেক অর্থ যে “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” তা মেনে নিয়েছেন। এতদসত্বেও বলেছেন: ‘এই আয়াত সম্পর্কে যেসব যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, তাতে ‘ওয়ালি’ শব্দটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।’ কিন্তু তিনি তার মতকে প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা তার তিনটি দলীলই প্রত্যাখ্যাত।প্রথম আপত্তির জবাব:যদিও বেলায়াতের আয়াতে “ওয়ালি” শব্দটির অর্থ “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” হয় তবুও পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে অসামঞ্জস্য তো নয়ই বরং পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে। কেননা মহান আল্লাহ তাআলা বেলায়েতের আয়াতের পূর্বে এরশাদ করেছেন:হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়ী ও নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবেনা। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যদানকারী, মহাজ্ঞানী।এই আয়াত হযরত আলী (আ.) এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে। (শেখ মুফিদ, আল ইফসাহ ফি ইমামাতি আমিরিল মুমিনিন, পৃ.-১৩২) যেমনিভাবে হযরত আলী (আ.) উষ্ট্রের যুদ্ধে এব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছেন এবং ইমাম বাকের ও ইমাম সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত অসংখ্য রেওয়ায়েতে এর সত্যতার প্রমাণ মেলে। (তাবারসী, প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ.-৩২১) এই রেওয়াইয়াত আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। (রাযী, প্রাগুক্ত, পৃ.-৩৭৮) এই ব্যাপারে আহলে বাইতের অনুসারীদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির।এই হাদীসের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা হযরত আলী (আ.) এর বেলায়াতের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন এবং বেলায়াতের আয়াতে এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। সুতরাং বেলায়াতের আয়াতে ওয়ালি শব্দটিকে “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” অর্থে গ্রহণ করলেও তার পূর্ববর্তী আয়াতের বাচনভঙ্গি বা ধারার সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে।ওয়ালি র প্রকৃত অর্থ :،وِلاء، وِلایت، وَلایت وَلاء, ولی، مولی، اولی এই শব্দগুলো ولی শব্দমূল থেকে গৃহীত হয়েছে। মুকায়িসুল লুগাহ এর গ্রন্থকার ইবনে ফারেস বলেছেন ولی শব্দটির মূল হচ্ছে وَلی অর্থ-নিকটবর্তী।( ইবনে ফারেস, মুকায়িসুল লুগাহ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৪১)আল মিসবাহুল মুনির এর প্রণেতা ফাইয়ুমির মতেও ওয়ালি শব্দটির অর্থ নিকটবর্তী, কাছাকাছি।«ولی» فعیل এর ওজনে (গঠনরূপে) فاعل (কর্তাবাচক) অর্থ দান করে। (ফাইয়ুমি, আল মিসবাহুল মুনির,পৃ. ৬৭২) ওয়ালি শব্দটির প্রকৃত ও আসল অর্থ হচ্ছে নিকটাত্মীয়, কাছাকাছি যা তার অন্যান্য অর্থ যেমন-কর্তৃত্বশীল, মুক্তকারী, চাচাতো ভাই, সাহায্যকারী, রক্ষক এবং বন্ধু এসবের সাথেও সামঞ্জস্যশীল।আল্লামা রাগেব তার মুফরাদাত নামক অভিধানে লিখেছেন : ولي শব্দটির প্রকৃত অর্থ হল দুটি জিনিসের এমনভাবে পাশাপাশি অবস্থান যেন তাদের মাঝে কোন ফাঁক না থাকে। ‘ওয়ালি’ র অন্যান্য যেসব অর্থ তিনি উল্লেখ করেছেন সেগুলোকে তিনি এ অর্থের দিকেই প্রত্যাবর্তন করিয়েছেন। ( আল্লামা রাগেব ইসফাহানী, আল মুফরাদাত, পৃ.-৮৮৫)জালাল উদ্দিন সূয়ুতীও «ولی ، یلی» এবং তার থেকে নির্গত সকল শব্দকে «وقع بعد» তার পরেই রয়েছে বা অবস্থান করছে অর্থ করেছেন। (জালাল উদ্দিন সূয়ুতী, আল বাহজাতুল মারজিয়্যাহ ফি শারহিল আলফিয়্যাহ, পৃ.-২৯, ৬১ ও ৯৮)আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খলীফাতুল বিলা ফাশালনিবেদক________ মোঃ আলী হুসাইনচলবে
বেলায়েতের আয়াতের ব্যাকরণগত দিক সম্পর্কে একটি গবেষণামূলক ও বিশ্লেষণমূলক পোস্ট
পর্ব (((((৫)))))
রুকুর প্রকৃত অর্থ :
কুশচীর পূর্বে আহলে সুন্নাতের আরো অনেক আলেম ও মনীষী “রুকু” কে বিনয়ী অর্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। যেন এর দ্বারা তারা দাবি করতে পারেন যে, এই সিফাত অর্থাৎ রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান একজন ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং সকল মু’মিনই এর অন্তর্ভুক্ত। অথচ রুকুর প্রকৃত অর্থ বিনয়ী নয়। কেননা :
ভাষাবিদদের অনেকেই বলেছেন যে রুকুর প্রকৃত অর্থ হল “উপুড় হওয়া” বা “বাঁকা হওয়া”। যামাখশারী তার আসাসুল বালাগা গ্রন্থটিতে, যা শব্দের প্রকৃত অর্থ থেকে রূপক অর্থকে আলাদা করার জন্য নিমিত্তে রচনা করেছেন, লিখেছেন “রুকু” এর অর্থ হল “ঝুকে পড়া”।(যামাখশারী, আসাসুল বালাগ, পৃ.-১৭৬)
তাজুল আরুস (যুবাইদি, তাজুল আরুস মিন জাওয়াহিরুল ক্বামূস, ৫ম খণ্ড, পৃ.-৩৬২) এবং মাজমাউল বাহরাইন (তুরাইহী, মাজমাউল বাহরাইন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩৩৯) এর লেখকবৃন্দও বলেছেন রুকুর অর্থ বাঁকা হওয়া বা ন্যুব্জ হয়ে পড়া।
তাজুল আরুসে এভাবে এসেছে:«رکع الشیخ» : এ বৃদ্ধ ব্যক্তি ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে রুকুর প্রকৃত অর্থ এটিই আর এখান থেকেই নামাজের রুকুর অর্থ নেয়া হয়েছে।
ইবনে ফারেস লিখেছেন:
“রাকাআ” শব্দটি মানুষ ছাড়াও অন্যান্য যে কোন কিছুর ক্ষেত্রে উপুড় ও নত হওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেক বক্র ও নুব্জ বস্তুকে রুকুকারী বলা হয়। আর নামাজের রুকুর অর্থও এটাই। (ইবনে ফারেস, মুকায়িসুল লুগাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৩৪)
রাগেব ইসফাহানীও বলেছেন যে, রুকুর অর্থ উপুড় হওয়া। (ইসফাহানী, মুফরাদাতু আলফাজিল কোরআন, ৩৬৪)
ফাইয়ুমি লিখেছেন: رکع رکوعا : উপুড় হওয়া, যে বৃদ্ধলোক বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছে তাকে «رکع الشیخ» বলা হয় অর্থাৎ বয়স্ক লোকটি বাঁকা হয়ে গেছে। (ফাইয়ুমি, আল মিসবাহুল মুনির, পৃ.-২৩৭)
অতএব প্রকৃত অর্থে রুকু হচ্ছে বিশেষ পদ্ধতিতে মাথা নোয়ানো আর ইসলামি শরীয়তেও তা এই একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কারণে “বিনয়ী ও নমনীয়” হচ্ছে রুকুর রূপক অর্থ। (সাইয়েদ মুরতাজা, প্রগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ.-২৩১) আর তাই কোন কারিনা অর্থাৎ সমর্থক দলীল বা রূপক অর্থ নির্দেশক সহযোগী প্রমাণ ছাড়া এ শব্দটিকে “বিনয়ী ও নমনীয়” অর্থে ব্যবহার করা ঠিক নয়।
বেলায়াতের আয়াতে “রুকু” যে তার রূপক অর্থ অর্থাৎ “বিনয়ী ও নমনীয়” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এমন কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং রুকু তার প্রকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
ولی শব্দটির অর্থ :
আলোচ্য আয়াতে আহলে সুন্নাত এবং ইমামীয়া কালামশাস্ত্রবীদদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে ولی শব্দটির অর্থ নিয়ে।
আহলে সুন্নাতের অনেক আলেম যেমন: ইজি এবং কুশচী (কুশচী, প্রাগুক্ত,পৃ.৩৬৮ ইজি, প্রাগুক্ত, পৃ.-৬০২) মনে করেন এই আয়াতে “ওয়ালি” শব্দটির অর্থ ‘কর্তৃত্বে ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠতম’ নয়। কেননা :
প্রথম দলীল : আয়াতের অবস্থানজনিত ভাব বা বাচনিক ধারা
এই আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ
অর্থাৎ হে মুমিনগণ তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না, তারা একে অপরের বন্ধু। (সূরা মায়েদা-৫১) “ওয়ালি” র অর্থ বন্ধু বা সাহায্যকারী। কেননা এই আয়াতে ইহুদী এবং খ্রীষ্টানদের সাথে বন্ধুত্ব করতে না করা হয়েছে সুতরাং “ওয়ালি” শব্দটি এখানে নেতৃত্ব বা ইমামত অর্থে ববহৃত হয় নি। বরং উদ্দেশ্য হল বন্ধু এবং সাহায্যকারী। অনুরূপভাবে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে:
وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ
অর্থাৎ আর যারা আল্লাহ তার রাসূল এবং বিশ্বাসীদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহর দল এবং তারাই বিজয়ী। (মায়েদা-৫৬) এখানে تَوَلّ শব্দটির অর্থ বন্ধুত্ব এবং সাহায্যকারী, ইমামত নয়। সুতরাং আলোচ্য আয়াতের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আয়াত থেকেও বোঝা যায় যে এই আয়াতের “ওয়ালি” র অর্থ বন্ধু এবং সাহায্যকারী। তাই এ ক্ষেত্রে গ্রহণ উপযুক্ত নয়।
তাদের বক্তব্যের সারমর্ম হল এই আয়াতের পূর্ব ও পরবর্তী আয়াতের বাচনিক রূপ ও ধারাই বলে দিচ্ছে যে, ওয়ালি শব্দের অর্থ বন্ধু এবং সাহায্যকারী আর তা ওয়ালি শব্দকে ইমামত বা কর্তৃত্ব অর্থে গ্রহণের যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে।
দ্বিতীয় দলীল: হাসর অনুপস্থিত
হাসর দ্বিধা, সন্দেহ দূরীভূত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এটা স্পষ্ট যে এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় খেলাফতের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়নি এবং ইমামতের ব্যাপারে কোন বিতর্কও ছিলনা। অন্যদিকে এই আয়াতে “ইন্নামা” সীমাবদ্ধতার জন্যও ব্যবহৃত হয়নি। পূর্বেই এই আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে।
সমালোচনা ও পর্যালোচনা :
কুশচী “ওয়ালি” শব্দের আরেক অর্থ যে “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” তা মেনে নিয়েছেন। এতদসত্বেও বলেছেন: ‘এই আয়াত সম্পর্কে যেসব যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, তাতে ‘ওয়ালি’ শব্দটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।’ কিন্তু তিনি তার মতকে প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা তার তিনটি দলীলই প্রত্যাখ্যাত।
প্রথম আপত্তির জবাব:
যদিও বেলায়াতের আয়াতে “ওয়ালি” শব্দটির অর্থ “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” হয় তবুও পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে অসামঞ্জস্য তো নয়ই বরং পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে। কেননা মহান আল্লাহ তাআলা বেলায়েতের আয়াতের পূর্বে এরশাদ করেছেন:
হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়ী ও নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবেনা। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যদানকারী, মহাজ্ঞানী।
এই আয়াত হযরত আলী (আ.) এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে। (শেখ মুফিদ, আল ইফসাহ ফি ইমামাতি আমিরিল মুমিনিন, পৃ.-১৩২) যেমনিভাবে হযরত আলী (আ.) উষ্ট্রের যুদ্ধে এব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছেন এবং ইমাম বাকের ও ইমাম সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত অসংখ্য রেওয়ায়েতে এর সত্যতার প্রমাণ মেলে। (তাবারসী, প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ.-৩২১) এই রেওয়াইয়াত আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। (রাযী, প্রাগুক্ত, পৃ.-৩৭৮) এই ব্যাপারে আহলে বাইতের অনুসারীদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির।
এই হাদীসের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা হযরত আলী (আ.) এর বেলায়াতের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন এবং বেলায়াতের আয়াতে এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। সুতরাং বেলায়াতের আয়াতে ওয়ালি শব্দটিকে “কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত” অর্থে গ্রহণ করলেও তার পূর্ববর্তী আয়াতের বাচনভঙ্গি বা ধারার সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে।
ওয়ালি র প্রকৃত অর্থ :
،وِلاء، وِلایت، وَلایت وَلاء, ولی، مولی، اولی এই শব্দগুলো ولی শব্দমূল থেকে গৃহীত হয়েছে। মুকায়িসুল লুগাহ এর গ্রন্থকার ইবনে ফারেস বলেছেন ولی শব্দটির মূল হচ্ছে وَلی অর্থ-নিকটবর্তী।( ইবনে ফারেস, মুকায়িসুল লুগাহ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৪১)
আল মিসবাহুল মুনির এর প্রণেতা ফাইয়ুমির মতেও ওয়ালি শব্দটির অর্থ নিকটবর্তী, কাছাকাছি।«ولی» فعیل এর ওজনে (গঠনরূপে) فاعل (কর্তাবাচক) অর্থ দান করে। (ফাইয়ুমি, আল মিসবাহুল মুনির,পৃ. ৬৭২) ওয়ালি শব্দটির প্রকৃত ও আসল অর্থ হচ্ছে নিকটাত্মীয়, কাছাকাছি যা তার অন্যান্য অর্থ যেমন-কর্তৃত্বশীল, মুক্তকারী, চাচাতো ভাই, সাহায্যকারী, রক্ষক এবং বন্ধু এসবের সাথেও সামঞ্জস্যশীল।
আল্লামা রাগেব তার মুফরাদাত নামক অভিধানে লিখেছেন : ولي শব্দটির প্রকৃত অর্থ হল দুটি জিনিসের এমনভাবে পাশাপাশি অবস্থান যেন তাদের মাঝে কোন ফাঁক না থাকে। ‘ওয়ালি’ র অন্যান্য যেসব অর্থ তিনি উল্লেখ করেছেন সেগুলোকে তিনি এ অর্থের দিকেই প্রত্যাবর্তন করিয়েছেন। ( আল্লামা রাগেব ইসফাহানী, আল মুফরাদাত, পৃ.-৮৮৫)
জালাল উদ্দিন সূয়ুতীও «ولی ، یلی» এবং তার থেকে নির্গত সকল শব্দকে «وقع بعد» তার পরেই রয়েছে বা অবস্থান করছে অর্থ করেছেন। (জালাল উদ্দিন সূয়ুতী, আল বাহজাতুল মারজিয়্যাহ ফি শারহিল আলফিয়্যাহ, পৃ.-২৯, ৬১ ও ৯৮)
আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খলীফাতুল বিলা ফাশাল
নিবেদক________ মোঃ আলী হুসাইন
চলবে
মন্তব্যসমূহ