হযরত আলী (আ.)এর ফযিলত ও মর্যাদা🎂🎂🎂🎂🎂(((পর্ব ১)))🎂🎂🎂🎂🎂হযরত আলী ইবন আবী তালিব (আ.) কোরায়েশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন আবু তালিব (আ.) আর মাতার ফাতিমা বিনতে আসাদ । শিশু বয়স থেকেই তিনি হযরত মুহাম্মদের কাছে লালিত-পালিত হন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি নবুয়তের ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন।তার ফযিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সা.)থেকে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে নিম্নে তার কিছু আলোচনা করা হল।১। রাসূল (সা.) আলী (আ.)-এর কাঁধে হাত রেখে বলেছেন :هذا إمام البررة قاتل الفجرة منصور من نصره,مخذول من خذله“এই আলী সৎ কর্মশীলদের ইমাম,অন্যায়কারীদের হন্তা,যে তাকে সাহায্য করবে সে সাফল্য লাভ করবে (সাহায্য প্রাপ্ত হবে) এবং যে তাকে হীন করার চেষ্টা করবে সে নিজেই হীন হবে।”হাদীসটি হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় জাবের বিন আবদুল্লাহ্ আনসারী হতে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন,“এই হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।”২। নবী (সা.) বলেছেন,“আলী সম্পর্কে আমার প্রতি তিনটি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে :إِنَّهٌ سيّد الْمسلمين و إمام الْمتّقين و قائد الغرّ الْمُحجّلينনিশ্চয়ই সে মুসলমানদের নেতা,মুত্তাকীদের ইমাম এবং নূরানী ও শুভ্র মুখমণ্ডলের অধিকারীদের সর্দার।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩৮ পৃষ্ঠায় হাদীসটি এনেছেন ও বলেছেন,“হাদীসটি সনদের দিক হতে বিশুদ্ধ কিন্তু বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।”৩। নবী (সা.) বলেছেন,“আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে যে,আলী মুসলমানদের নেতা,মুত্তাকীদের অভিভাবক এবং শুভ্র ও উজ্জ্বল কপালের অধিকারীদের (সৌভাগ্যবানদের) সর্দার।” ইবনে নাজ্জার ও অন্যান্য সুনান লেখকগণ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।৪। নবী হযরত আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,مرحبا بسيّد المسلمين و إمام المتقين“হে মুসলমানদের নেতা ও মুত্তাকীদের ইমাম! তোমাকে সাধুবাদ।” আবু নাঈম তাঁর ‘হুলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে এটি বর্ণনা করেছেন।৫। একদিন রাসূল (সা.) ঘোষণা করলেন,“প্রথম যে ব্যক্তি এ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে সে মুত্তাকীদের ইমাম,মুসলমানদের নেতা,দীনের মধুমক্ষিকা (সংরক্ষণকারী),সর্বশেষ নবীর প্রতিনিধি ও উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের অধিকারীদের সর্দার।” তখন আলী ঐ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে নবী (সা.) তাঁকে এ সুসংবাদ দানের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করলেন ও তাঁর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,“তুমি আমার ঋণ পরিশোধ করবে,আমার বাণী মানুষের নিকট পৌঁছে দেবে,যে বিষয়ে তারা মতদ্বৈততা করবে তুমি তা ব্যাখ্যা করে বোঝাবে।৬। নবী (সা.) বলেছেন,“আল্লাহ্ আমার নিকট আলীকে এভাবে বর্ণনা করেছেন-আলী হেদায়েতের ধ্বজাধারী,আমার আউলিয়া অর্থাৎ বন্ধুদের ইমাম,আমার আনুগত্যকারীদের আলোকবর্তিকা এবং সে এমন এক আদর্শ মুত্তাকীদের উচিত অপরিহার্যরূপে যার পদাঙ্কনুবর্তী হওয়া।”লক্ষ্য করুন এই ছয়টি সহীহ হাদীস তাঁর ইমামত ও আনুগত্যের অপরিহার্যতাকে কিরূপে সুস্পষ্ট করছে! তাঁর ওপর সালাম বর্ষিত হোক।৭। নবী (সা.) আলীর প্রতি ইশারা করে বলেন,“এই প্রথম ব্যক্তি যে আমার প্রতি ঈমান এনেছে ও প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সে কিয়ামতে আমার সঙ্গে হাত মিলাবে,সে সিদ্দীকে আকবর ও ফারুক (এই উম্মতের সত্যপন্থী ও অসত্যপন্থীদের মধ্যে পার্থক্যকারী),সে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সীমারেখা টানবে এবং সে মুমিনদের সংরক্ষণকারী।”৮। নবী বলেছেন,“হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা কি চাও তোমাদের আমি এমন বিষয়ের প্রতি নির্দেশনা দেব যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনো গোমরাহ ও বিপথগামী হবে না? সেটি হলো আলী। আমাকে তোমরা যেরূপ ভালবাস তাকেও সেরূপ ভালবাস। আমাকে যেরূপ শ্রদ্ধা কর তাকেও সেরূপ শ্রদ্ধা ও সম্মান কর এবং আমি তোমাদের যা বলছি তা আল্লাহ্ জিবরাঈলের মাধ্যমে আমাকে বলতে নির্দেশ দিয়েছেন।”৯। নবী (সা.) বলেছেন,أنا مدينة العلم و عليّ بابُها فمن أراد المدينة فليأت الباب“আমি জ্ঞানের শহর ও আলী তার দ্বার এবং যে কেউ শহরে প্রবেশ করতে চাইলে দ্বার দিয়েই প্রবেশ করবে।”১০। নবী (সা.) বলেছেন,أنا دار الحكمة و عليّ بابُها “আমি প্রজ্ঞার ঘর আলী তার দরজা।”১১। নবী (সা.) বলেছেন,“আলী আমার জ্ঞানের প্রবেশ দ্বার ও আমি যে বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি আমার পরে আমার উম্মতের জন্য সে তার ব্যাখ্যাকারী। তার ভালবাসা ও বন্ধুত্বই ঈমান এবং তার শত্রুতাই নিফাক।”১২। নবী (সা.) আলীকে বলেন,“তুমি আমার পর উম্মত যে বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২২ পৃষ্ঠায় আনাস ইবনে মালিক হতে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যে,বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি বিশুদ্ধ তদুপরি তাঁরা তা বর্ণনা করেন নি।আমার মতে যে কেউ এই হাদীস এবং এর অনুরূপ অন্যান্য হাদীস নিয়ে চিন্তা করলে দেখবেন (বুঝবেন),আলী (আ.)-এর সঙ্গে রাসূলের সম্পর্ক রাসূলের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্কের ন্যায়। কারণ নবীকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,“আমি আপনার প্রতি এ জন্যই গ্রন্থ নাযিল করেছি যাতে আপনি সরল পথ প্রদর্শনের জন্য যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে সে বিষয় পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেন এবং এই কোরআন মুমিনদের জন্য রহমত ও হেদায়েতের উপকরণ।” নবীও আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,“তুমি আমার পর যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী (তাদের জন্য পরিষ্কারভাবে তা বর্ণনাকারী)।”১৩। নবী (সা.) হতে আরেকটি হাদীস যা মারফু (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে ইবনে সাম্মাক আবু বকর হতে বর্ণনা করেছেন,عليّ منّي بِمنْزلتي من ربّي অর্থাৎ আলীর স্থান আমার নিকট আমার প্রতিপালকের নিকট আমার স্থান ও মর্যাদার ন্যায়।১৪। দারে কুতনী তাঁর ‘কিতাবুল আফরাদ’ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস সূত্রে রাসূল হতে বর্ণনা করেছেন,“আলী ইবনে আবি তালিব ক্ষমার দ্বার। যে কেউ এ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে সে মুমিন,আর কেউ তা হতে বের হয়ে গেলে সে কাফের।”১৫। নবী (সা.) বিদায় হজ্বের সময় আরাফাতের ময়দানে বলেন,“আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। আমার পক্ষ হতে ঐশী বাণী পৌঁছানোর অধিকার কারো নেই একমাত্র আলী ব্যতীত।”এই হলো সম্মানিত রাসূলের কথা যিনি শক্তিমান ও আরশের অধিপতির নিকট বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ্ তাঁর সম্পর্কে যেমনটি বলেছেন,তিনি বিশ্বস্ত,তোমাদের নবী উন্মাদ নন,তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কিছু বলেন না,বরং তিনি তাই বলেন যা তাঁর প্রতি ওহী হিসেবে অবতীর্ণ হয়। যেহেতু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই সেহেতু এই সহীহ হাদীস সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? এ বিষয়ে আর কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ আছে কি? যদি আল্লাহর মহান বাণী প্রচারের এই গুরু দায়িত্বের বিষয়ে আপনি চিন্তা করেন এবং বড় হজ্বের সময়ে তা বর্ণনার পেছনে যে হেকমত লুকিয়ে রয়েছে সে বিষয়ে যথাযথ দৃষ্টি দেন তাহলে সত্য আপনার নিকট তার প্রকৃতরূপে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।যদি এই বাণীর শব্দগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেন,দেখবেন বাণীটি কতটা অর্থবহ এবং উন্নত ও গভীর। কারণ রাসূল (সা.) সবদিক বিবেচনা করে দেখেছেন বিষয়টির গুরুত্বের কারণে আলী ব্যতীত অন্য কেউ সঠিকভাবে এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয় এবং নবীর পক্ষ হতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি,খলীফা ও প্রশাসনিক দায়িত্বসম্পন্ন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নন।সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর যিনি আমাদের হেদায়েত করেছেন এবং তিনি হেদায়েত না করলে আমরা কখনো হেদায়েত পেতাম না।১৬। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,“যে আমার আনুগত্য করলো সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো,আর যে আমার বিরোধিতা করলো সে আল্লাহরই বিরোধিতা করলো। আর যে আলীর আনুগত্য করেছে সে যেন আমারই আনুগত্য করেছে,আর যে তার বিরোধিতা করেছে সে আমারই বিরোধিতা করেছে।” হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২১ পৃষ্ঠায় এবং যাহাবী তাঁর ‘তালখিসে মুসতাদরাক’-এ হাদীসটি এনে বলেছেন যে,বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ।১৭। নবী (সা.) বলেছেন,“হে আলী! যে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হলো সে আল্লাহ্ হতেই বিচ্ছিন্ন হলো আর যে আলী হতে বিচ্ছিন্ন হলো সে আমা হতেই বিচ্ছিন্ন হলো।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাকুস্ সহীহাইন’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৪ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যদিও হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেননি।১৮। উম্মে সালামাহ্ রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“যে কেউ আলীকে মন্দ নামে সম্বোধন করলো সে যেন আমাকেই মন্দ নামে সম্বোধন করলো।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২১ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি বিশুদ্ধ বলেছেন। যাহাবীও তাঁর ‘তালখিস’ গ্রন্থে হাদীসটি বিশুদ্ধ বলে স্বীকার করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৩২৩ পৃষ্ঠায় এবং নাসায়ী তাঁর ‘খাসায়েসুল আলাভীয়া’ গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় উম্মে সালামাহ্ হতে এবং অন্যান্য হাদীসবিদগণও এটি বর্ণনা করেছেন। এরূপ অপর একটি হাদীস যা আমর ইবনে শাশ নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন তা হলো : যে কেউ আলীকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল।১৯। নবী (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আলীকে ভালবাসে সে যেন আমাকেই ভালবেসেছে,আর যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে সে আমার সঙ্গেই শত্রুতা পোষণ করেছে।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩০ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ বলেছেন। যাহাবীও তাঁর ‘তালখিস’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে বিশুদ্ধ বলেছেন।আলী নিজেও বলেছেন,“সেই সত্তার শপথ,যিনি বীজ অঙ্কুরিত এবং মানুষের আত্মাকে সৃষ্টি করেন,উম্মী নবী (সা.) এই কথা বলেছেন যে,মুমিন ব্যতীত আমাকে (আলীকে) কেউ ভালবাসবে না এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ আমার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে না।”২০। নবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বলেন,يا عليّ أنت سيّد في الدّنيا و سيّد في الآخرة,حبيبك حبِيبِي و حبيبِي حبيب الله و عدوّك عدوّي و عدوّي عدوّ الله و الويل لمن أبغضك بعدي“হে আলী! তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে নেতা,তোমার বন্ধু আমার বন্ধু এবং আমার বন্ধু আল্লাহর বন্ধু। তোমার শত্রু আমার শত্রু এবং আমার শত্রু আল্লাহর শত্রু। ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য যে আমার পর তোমার সঙ্গে শত্রুতা করবে।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৮ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।
হযরত আলী (আ.)এর ফযিলত ও মর্যাদা
🎂🎂🎂🎂🎂(((পর্ব ১)))🎂🎂🎂🎂🎂
হযরত আলী ইবন আবী তালিব (আ.) কোরায়েশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন আবু তালিব (আ.) আর মাতার ফাতিমা বিনতে আসাদ । শিশু বয়স থেকেই তিনি হযরত মুহাম্মদের কাছে লালিত-পালিত হন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি নবুয়তের ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন।
তার ফযিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সা.)থেকে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে নিম্নে তার কিছু আলোচনা করা হল।
১। রাসূল (সা.) আলী (আ.)-এর কাঁধে হাত রেখে বলেছেন :
هذا إمام البررة قاتل الفجرة منصور من نصره,مخذول من خذله
“এই আলী সৎ কর্মশীলদের ইমাম,অন্যায়কারীদের হন্তা,যে তাকে সাহায্য করবে সে সাফল্য লাভ করবে (সাহায্য প্রাপ্ত হবে) এবং যে তাকে হীন করার চেষ্টা করবে সে নিজেই হীন হবে।”
হাদীসটি হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় জাবের বিন আবদুল্লাহ্ আনসারী হতে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন,“এই হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।”
২। নবী (সা.) বলেছেন,“আলী সম্পর্কে আমার প্রতি তিনটি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে :
إِنَّهٌ سيّد الْمسلمين و إمام الْمتّقين و قائد الغرّ الْمُحجّلين
নিশ্চয়ই সে মুসলমানদের নেতা,মুত্তাকীদের ইমাম এবং নূরানী ও শুভ্র মুখমণ্ডলের অধিকারীদের সর্দার।”
হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩৮ পৃষ্ঠায় হাদীসটি এনেছেন ও বলেছেন,“হাদীসটি সনদের দিক হতে বিশুদ্ধ কিন্তু বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।”
৩। নবী (সা.) বলেছেন,“আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে যে,আলী মুসলমানদের নেতা,মুত্তাকীদের অভিভাবক এবং শুভ্র ও উজ্জ্বল কপালের অধিকারীদের (সৌভাগ্যবানদের) সর্দার।” ইবনে নাজ্জার ও অন্যান্য সুনান লেখকগণ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
৪। নবী হযরত আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
مرحبا بسيّد المسلمين و إمام المتقين
“হে মুসলমানদের নেতা ও মুত্তাকীদের ইমাম! তোমাকে সাধুবাদ।” আবু নাঈম তাঁর ‘হুলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে এটি বর্ণনা করেছেন।
৫। একদিন রাসূল (সা.) ঘোষণা করলেন,“প্রথম যে ব্যক্তি এ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে সে মুত্তাকীদের ইমাম,মুসলমানদের নেতা,দীনের মধুমক্ষিকা (সংরক্ষণকারী),সর্বশেষ নবীর প্রতিনিধি ও উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের অধিকারীদের সর্দার।” তখন আলী ঐ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে নবী (সা.) তাঁকে এ সুসংবাদ দানের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করলেন ও তাঁর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,“তুমি আমার ঋণ পরিশোধ করবে,আমার বাণী মানুষের নিকট পৌঁছে দেবে,যে বিষয়ে তারা মতদ্বৈততা করবে তুমি তা ব্যাখ্যা করে বোঝাবে।
৬। নবী (সা.) বলেছেন,“আল্লাহ্ আমার নিকট আলীকে এভাবে বর্ণনা করেছেন-আলী হেদায়েতের ধ্বজাধারী,আমার আউলিয়া অর্থাৎ বন্ধুদের ইমাম,আমার আনুগত্যকারীদের আলোকবর্তিকা এবং সে এমন এক আদর্শ মুত্তাকীদের উচিত অপরিহার্যরূপে যার পদাঙ্কনুবর্তী হওয়া।”
লক্ষ্য করুন এই ছয়টি সহীহ হাদীস তাঁর ইমামত ও আনুগত্যের অপরিহার্যতাকে কিরূপে সুস্পষ্ট করছে! তাঁর ওপর সালাম বর্ষিত হোক।
৭। নবী (সা.) আলীর প্রতি ইশারা করে বলেন,“এই প্রথম ব্যক্তি যে আমার প্রতি ঈমান এনেছে ও প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সে কিয়ামতে আমার সঙ্গে হাত মিলাবে,সে সিদ্দীকে আকবর ও ফারুক (এই উম্মতের সত্যপন্থী ও অসত্যপন্থীদের মধ্যে পার্থক্যকারী),সে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সীমারেখা টানবে এবং সে মুমিনদের সংরক্ষণকারী।”
৮। নবী বলেছেন,“হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা কি চাও তোমাদের আমি এমন বিষয়ের প্রতি নির্দেশনা দেব যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনো গোমরাহ ও বিপথগামী হবে না? সেটি হলো আলী। আমাকে তোমরা যেরূপ ভালবাস তাকেও সেরূপ ভালবাস। আমাকে যেরূপ শ্রদ্ধা কর তাকেও সেরূপ শ্রদ্ধা ও সম্মান কর এবং আমি তোমাদের যা বলছি তা আল্লাহ্ জিবরাঈলের মাধ্যমে আমাকে বলতে নির্দেশ দিয়েছেন।”
৯। নবী (সা.) বলেছেন,
أنا مدينة العلم و عليّ بابُها فمن أراد المدينة فليأت الباب
“আমি জ্ঞানের শহর ও আলী তার দ্বার এবং যে কেউ শহরে প্রবেশ করতে চাইলে দ্বার দিয়েই প্রবেশ করবে।”
১০। নবী (সা.) বলেছেন,أنا دار الحكمة و عليّ بابُها “আমি প্রজ্ঞার ঘর আলী তার দরজা।”
১১। নবী (সা.) বলেছেন,“আলী আমার জ্ঞানের প্রবেশ দ্বার ও আমি যে বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি আমার পরে আমার উম্মতের জন্য সে তার ব্যাখ্যাকারী। তার ভালবাসা ও বন্ধুত্বই ঈমান এবং তার শত্রুতাই নিফাক।”
১২। নবী (সা.) আলীকে বলেন,“তুমি আমার পর উম্মত যে বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী।”
হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২২ পৃষ্ঠায় আনাস ইবনে মালিক হতে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যে,বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি বিশুদ্ধ তদুপরি তাঁরা তা বর্ণনা করেন নি।
আমার মতে যে কেউ এই হাদীস এবং এর অনুরূপ অন্যান্য হাদীস নিয়ে চিন্তা করলে দেখবেন (বুঝবেন),আলী (আ.)-এর সঙ্গে রাসূলের সম্পর্ক রাসূলের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্কের ন্যায়। কারণ নবীকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,“আমি আপনার প্রতি এ জন্যই গ্রন্থ নাযিল করেছি যাতে আপনি সরল পথ প্রদর্শনের জন্য যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে সে বিষয় পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেন এবং এই কোরআন মুমিনদের জন্য রহমত ও হেদায়েতের উপকরণ।” নবীও আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,“তুমি আমার পর যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী (তাদের জন্য পরিষ্কারভাবে তা বর্ণনাকারী)।”
১৩। নবী (সা.) হতে আরেকটি হাদীস যা মারফু (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে ইবনে সাম্মাক আবু বকর হতে বর্ণনা করেছেন,عليّ منّي بِمنْزلتي من ربّي অর্থাৎ আলীর স্থান আমার নিকট আমার প্রতিপালকের নিকট আমার স্থান ও মর্যাদার ন্যায়।
১৪। দারে কুতনী তাঁর ‘কিতাবুল আফরাদ’ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস সূত্রে রাসূল হতে বর্ণনা করেছেন,“আলী ইবনে আবি তালিব ক্ষমার দ্বার। যে কেউ এ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে সে মুমিন,আর কেউ তা হতে বের হয়ে গেলে সে কাফের।”
১৫। নবী (সা.) বিদায় হজ্বের সময় আরাফাতের ময়দানে বলেন,“আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। আমার পক্ষ হতে ঐশী বাণী পৌঁছানোর অধিকার কারো নেই একমাত্র আলী ব্যতীত।”
এই হলো সম্মানিত রাসূলের কথা যিনি শক্তিমান ও আরশের অধিপতির নিকট বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ্ তাঁর সম্পর্কে যেমনটি বলেছেন,তিনি বিশ্বস্ত,তোমাদের নবী উন্মাদ নন,তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কিছু বলেন না,বরং তিনি তাই বলেন যা তাঁর প্রতি ওহী হিসেবে অবতীর্ণ হয়। যেহেতু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই সেহেতু এই সহীহ হাদীস সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? এ বিষয়ে আর কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ আছে কি? যদি আল্লাহর মহান বাণী প্রচারের এই গুরু দায়িত্বের বিষয়ে আপনি চিন্তা করেন এবং বড় হজ্বের সময়ে তা বর্ণনার পেছনে যে হেকমত লুকিয়ে রয়েছে সে বিষয়ে যথাযথ দৃষ্টি দেন তাহলে সত্য আপনার নিকট তার প্রকৃতরূপে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
যদি এই বাণীর শব্দগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেন,দেখবেন বাণীটি কতটা অর্থবহ এবং উন্নত ও গভীর। কারণ রাসূল (সা.) সবদিক বিবেচনা করে দেখেছেন বিষয়টির গুরুত্বের কারণে আলী ব্যতীত অন্য কেউ সঠিকভাবে এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয় এবং নবীর পক্ষ হতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি,খলীফা ও প্রশাসনিক দায়িত্বসম্পন্ন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নন।
সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর যিনি আমাদের হেদায়েত করেছেন এবং তিনি হেদায়েত না করলে আমরা কখনো হেদায়েত পেতাম না।
১৬। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,“যে আমার আনুগত্য করলো সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো,আর যে আমার বিরোধিতা করলো সে আল্লাহরই বিরোধিতা করলো। আর যে আলীর আনুগত্য করেছে সে যেন আমারই আনুগত্য করেছে,আর যে তার বিরোধিতা করেছে সে আমারই বিরোধিতা করেছে।” হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২১ পৃষ্ঠায় এবং যাহাবী তাঁর ‘তালখিসে মুসতাদরাক’-এ হাদীসটি এনে বলেছেন যে,বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ।
১৭। নবী (সা.) বলেছেন,“হে আলী! যে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হলো সে আল্লাহ্ হতেই বিচ্ছিন্ন হলো আর যে আলী হতে বিচ্ছিন্ন হলো সে আমা হতেই বিচ্ছিন্ন হলো।”
হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাকুস্ সহীহাইন’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৪ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যদিও হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেননি।
১৮। উম্মে সালামাহ্ রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“যে কেউ আলীকে মন্দ নামে সম্বোধন করলো সে যেন আমাকেই মন্দ নামে সম্বোধন করলো।”
হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২১ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি বিশুদ্ধ বলেছেন। যাহাবীও তাঁর ‘তালখিস’ গ্রন্থে হাদীসটি বিশুদ্ধ বলে স্বীকার করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৩২৩ পৃষ্ঠায় এবং নাসায়ী তাঁর ‘খাসায়েসুল আলাভীয়া’ গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় উম্মে সালামাহ্ হতে এবং অন্যান্য হাদীসবিদগণও এটি বর্ণনা করেছেন। এরূপ অপর একটি হাদীস যা আমর ইবনে শাশ নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন তা হলো : যে কেউ আলীকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল।
১৯। নবী (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আলীকে ভালবাসে সে যেন আমাকেই ভালবেসেছে,আর যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে সে আমার সঙ্গেই শত্রুতা পোষণ করেছে।”
হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩০ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ বলেছেন। যাহাবীও তাঁর ‘তালখিস’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে বিশুদ্ধ বলেছেন।
আলী নিজেও বলেছেন,“সেই সত্তার শপথ,যিনি বীজ অঙ্কুরিত এবং মানুষের আত্মাকে সৃষ্টি করেন,উম্মী নবী (সা.) এই কথা বলেছেন যে,মুমিন ব্যতীত আমাকে (আলীকে) কেউ ভালবাসবে না এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ আমার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে না।”
২০। নবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বলেন,
يا عليّ أنت سيّد في الدّنيا و سيّد في الآخرة,حبيبك حبِيبِي و حبيبِي حبيب الله و عدوّك عدوّي و عدوّي عدوّ الله و الويل لمن أبغضك بعدي
“হে আলী! তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে নেতা,তোমার বন্ধু আমার বন্ধু এবং আমার বন্ধু আল্লাহর বন্ধু। তোমার শত্রু আমার শত্রু এবং আমার শত্রু আল্লাহর শত্রু। ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য যে আমার পর তোমার সঙ্গে শত্রুতা করবে।”
হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৮ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।
মন্তব্যসমূহ