সানাইন (আ.)

العربيةفارسیاردو中国的ภาษาไทยहिंदीবাংলাIndonesiaAzəriSwahiliHausaTürkçeBosnianPусскийFrançaisEnglish

নীড়পাতাইসলামী গ্রন্থাগারপ্রবন্ধঅডিও ভিডিওফটো গ্যালারিঅনুসন্ধান

 

ওহি-গৃহে আক্রমণসূচিপত্রঅনুসন্ধানওহি-গৃহে আক্রমণ

: মুহম্মদ রিজওয়ানুস সালাম খান
প্রকাশক: মাজমা-এ-যাখায়েরে ইসলামী কুম,ইরান
বিভাগ:

গ্রন্থাগর ›আহলে বাইত ›হযরত ফাতেমা (সা.আ.)

ভিজিট: 5834
ডাউনলোড: 1970
 

ওহি - গৃহে আক্রমণ১) রাসূল (সা.) এর বাণীতে হজরত ফাতিমা জাহরা (আ.) এর ইসমত (পাপশূন্যতা)২) কুরআন ও সুন্নতের আলোকে ফাতিমা (আ.)এর গৃহ সম্মানিত৩) ফাতিমা (আ.) এর ঘরের সম্মান হানিতথ্যসূত্র

৩) ফাতিমা (আ.) এর ঘরের সম্মান হানি

হ্যাঁ ,এতটা তাগিদ ও সুপারিশ করার পরেও আফসোস যে এমন কিছু অসম্মানজনক ব্যবহার নবী নন্দিনীর সাথে করা হয়েছে যে তা সহ্য করার মত নয়। আর এ এমন একটা সমস্যা যে কারো দোষ আড়াল করা ঠিক নয়।

আমি এই ব্যাপারে সমস্ত উক্তি আহলে সুন্নত ওয়াল জমায়েতের গ্রন্থসমূহ হতে উল্লেখ করব ,যাতে এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে হজরত ফাতিমা জাহরা (সা.) এর গৃহের সম্মানহানি ও পরবর্তী ঘটনাগুলি ঐতিহাসিকভাবে অকাট্য সত্য এবং এটি কোন অসত্য ঘটনা নয়! যদিও খলিফাদের যুগে ব্যাপকভাবে আহলে বাইতের গুণ ও মর্যাদাকে গোপন করা হয়েছে ,কিন্তু ইতিহাসের পাতায় ও হাদীসের গ্রন্থসমূহে এখনও পর্যন্ত তা জীবন্ত ও রক্ষিত আছে। আর আমি প্রথম শতাব্দী থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত এ সম্পর্কে লেখা গ্রন্থের নাম ও লেখকের নাম উল্লেখ করব।

১। ইবনে আবি শায়বা ও তার“ আল মুসান্নিফ ” পুস্তক

আবুবকর ইবনে আবি শায়বা (১৫৯-২৩৫) আল মুসান্নিফ গ্রন্থের লেখক সহিহ সনদের সাথে এইভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন:

إنه حين بويع لابي بكر بعد رسول الله (ص) كان علي والزبير يدخلان علی فاطمة بنت رسول الله (ص)، فيشاورونها و يرتجعون في أمرهم، فلما بلغ ذلك عمر بن خطاب خرج حتي دخل علی فاطمة،

فقال: يا بنت رسول الله (ص) والله ما أحدٌ أحب إلينا من أبيك وما من أحد أحب إلينا بعد أبيك منك، وأيم الله ما ذاك بمانعي إن اجتمع هؤلاء النفر عندك إن أمرتهم أن يحرق عليهم البيت

قال: فلما خرج عمر جاؤوها، فقالت (ع): تعلمون أنّ عمر قد جاءني، وقد حلف بالله لئن عدتم ليحرقنّ عليكم البيت، وايم الله ليمضين لمّا حلف عليه

অর্থাৎ: যখন জনগণ আবুবকরের হাতে বাইয়াত করলেন ,হজরত আলী (আ.) ও যোবায়ের হজরত ফাতিমা (আ.) এর গৃহে পরামর্শ ও আলোচনা করছিলেন ,এই খবর উমর ইবনে খাত্তাবের কর্ণগোচর হল অতঃপর সে ফাতিমা (আ.) এর গৃহে এসে বলল: হে নবী নন্দিনী! আমার প্রিয়তম ব্যক্তি তোমার পিতা ,তোমার পিতার পর তুমি নিজে ; কিন্তু আল্লাহর কসম তোমাদের এই ভালোবাসা আমার জন্য বাধা সৃষ্টি করবে না তোমার এই ঘরে একত্রিত হওয়া ব্যক্তিদের উপর আগুন লাগানোর আদেশ দেওয়া থেকে যাতে তারা দগ্ধ হয়ে যায়। এই কথা বলে উমর চলে যায় ,অতঃপর হজরত আলী ও যোবায়ের গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন ,হজরত ফাতিমা (আ.) আলী (আ.) ও যোবায়েরকে বললেন: উমর আমার নিকটে এসেছিল আল্লার কসম খেয়ে বলছিল যে যদি তোমাদের এই“ ইজতেমা ” সমাবেশ বন্ধ না হয় ,দ্বিতীয় বার অব্যাহত থাকে তাহলে তোমাদের গৃহকে জ্বালিয়ে দেব। আল্লার কসম! যার জন্য আমি কসম খেয়েছি অবশ্যই আমি সেটা করব।১১

উল্লেখ্য এই ঘটনাকে“ আল মুসান্নিফ ” গ্রন্থে সহিহ সনদের সাথে উল্লেখ করেছে।

২। বালাজুরী ও তার“ আনসাবুল আশরাফ ” গ্রন্থ

আহমাদ বিন ইয়াহিয়া জাবির বাগদাদী বালাজুরী (মৃত্যু:২৭০) বিখ্যাত লেখক ও মহান ঐতিহাসিক এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে নিজের গ্রন্থ“ আনসাবুল আশরাফ ” এ এই ভাবে উল্লেখ করেছেন:

إنّ أبابكر أرسل إلى علي يريد البيعة فلم يبايع، فجاء عمر و معه فتيلة: فتلقّته فاطمة علی الباب

فقالت فاطمة: بإبن الخطّاب: أتراك محرقاً عليّ بابي؟ قال: نعم و ذلك أقوى فيما جاء به أبوك

অর্থাৎ: আবুবকর হজরত আলী (আ.) এর বাইয়াত নেওয়ার জন্য (লোক) পাঠায় কিন্তু হজরত আলী (আ.) অস্বীকার করার ফলে উমর আগুনের ফলতে নিয়ে আসল ,দ্বারেই হজরত ফাতিমা (আ.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। হজরত ফাতিমা (আ.) বললেন: হে খাত্তাবের পুত্র! আমিতো দেখছি তুমি আমার ঘর জ্বালানোর পরিকল্পনা নিয়েছ ? উত্তরে উমর বলল: হ্যাঁ ,তোমার পিতা যার জন্য প্রেরিত হয়েছে (সেই কাজের সহযোগিতা ছাড়া অন্যকিছু নয়) আর এটা তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।১২

৩। ইবনে কুতাইবা ও তার“ আল ইমামাত ওয়াস সিয়াসাত ” গ্রন্থ

বিখ্যাত ঐতিহাসিক আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন কুতাইবা দিনাওয়ারী (২১২-২৭৬) তিনি সাহিত্যিকদের অন্যতম প্রধান ও ইসলামী ইতিহাস লেখকদের মধ্যে একজন ,তাঁর সংকলিত পুস্তক“ তাভিলে মুখতালাফুল হাদীছ ” ও“ আদাবুল কাতিব ” ইত্যাদি। তিনি তাঁর“ আল ইমামাত ওয়া সেয়াসাত ” গ্রন্থে এমনি লিপিবদ্ধ করেছেন:

إنّ أبا بكر رضي الله عنه تفقد قوماً تخلّفوا عن بيعته عند علي كرّم الله وجهه فبعث إليهم عمر فجاء فناداهم وهم في دار علي، فأبوا أن يخرجوا فدعا بالحطب و قال: والّذي نفس عمر بيده لتخرجنّ أو لأحرقنّها علی من فيها، فقيل له: يا أبا حفص إنّ فيها فاطمة، فقال: وإن !

অর্থাৎ: যাঁরা আবুবকরের হাতে বাইয়াত করেন নি তাঁরা হজরত আলী (আ.) এর গৃহে একত্রিত হয়ে ছিলেন ,আবুবকর খবর পাওয়ায় ওমরকে অনুসন্ধানের জন্য তাঁদের নিকটে পাঠাল ,সে হজরত আলী (আ.) এর গৃহে এসে সকলকে উচ্চস্বরে বলল ঘর থেকে বের হয়ে এস ,তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন ,ফলে উমর কাঠ তলব করল এবং বলল: তাঁর কসম যার হাতে উমরের জীবন আছে সকলে বাইরে এস নইলে যে ঘরে তোমরা আছ আগুন লাগিয়ে দেব। এক ব্যক্তি উমরকে বলল: হে হাফসার পিতা এই ঘরে রাসুলের কন্যা ফাতিমা (আ.) আছেন ,উমর বলল: থাকে থাকুক!১৩

ইবনে কুতাইবা এই ঘটনাকে সবথেকে বেদনা দায়ক এবং কষ্ট দায়ক বলে উল্লেখ করেছেন ,তিনি বলেন:

ثمّ قام عمر فمشى معه جماعة حتى أتوا فاطمة فدقوا الباب، فلمّا سمعت أصواتهم نادت بأعلى صوتها يا أبتاه رسول الله ماذا لقيناك بعدك من إبن الخطّاب وإبن أبي قحافة فلمّا سمع القوم صوتها و بكائها إنصرفوا. وبقى عمر ومعه قوم فأخرجوا علياً فمضوا به إلي أبي بكر فقالوا له بايع، فقال: إنّ أنا أفعل فمه؟ فقالوا: إذاً والله الذي لا إله إلا هو نضرب عنقك

অর্থাৎ: উমর একদল লোকের সাথে হজরত ফাতিমা (আ.) এর গৃহে এসে ঘরের দরজা করাঘাত করল ,যখন ফাতিমা (আ.) এদের শব্দ শুনলেন উচ্চস্বরে বললেন: হে রাসুলুল্লাহ আপনার পর আমাদের উপর খাত্তাবের ছেলে এবং আবি কুহাফার পুত্র কি যে মুসিবত নিয়ে এসেছে! যখন উমরের সাথিরা হজরত জাহরা (আ.) এর চিৎকার ও কান্না শুনলেন ,ফিরে গেলেন ,কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক উমরের সাথে ছিল ,তারা হজরত আলী (আ.) কে ঘর থেকে বের করে আনল। আবুবকরের নিকটে নিয়ে এসে তাঁকে বলল: বাইয়াত করুন ,আলী (আ.) বললেন: যদি বাইয়াত না করি কি হবে ? তারা বলল: সেই খোদার শপথ যিনি ছাড়া কোন প্রতিপালক নেই ,তোমার শির গর্দান থেকে আলাদা করে দেব।১৪

সুনিশ্চিতভাবে দুই খলীফার প্রেমিকদের জন্য ইতিহাসের এই অংশটুকু খুবই অসহনীয় ও অরুচিকর ,তাই কিছু সংখ্যক ব্যক্তি পরিকল্পনা নিয়ে বললেন যে ইবনে কুতাইবার পুস্তক অগ্রহণীয় কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন এ গ্রন্থ ইবনে কুতাইবার নয়। কিন্তু এ সত্ত্বেও যে ইবনে আবিল হাদীদ যিনি ইতিহাসের অভিজ্ঞ এক শিক্ষক এই পুস্তককে ইবনে কুতাইবার রচিত বলে স্বীকার করেন এবং সর্বদা এই পুস্তক থেকে প্রয়োজনে প্রচুর বর্ণনা করেছেন। আফসোসের বিষয় যে এই পুস্তক বিকৃত করা হয়েছে এবং কিছু অংশকে বাদ দিয়ে মুদ্রণ করা হয়েছে কিন্তু সেই মূল ও অবিকৃত অংশটি ইবনে আবিল হাদীদ তাঁর শরহ্ নাহজুল বালাগা গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

“ জরকলি ” এই পুস্তককে ইবনে কুতাইবার রচিত বলে মনে করেন,অতপর তিনি বলেন: কিছু সংখক আলেম এই ব্যপারে ভিন্ন মত রাখেন। অর্থাৎ এ গ্রন্থের বিষয়ে অন্যদের সংশয় ও সন্দেহ আছে বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু নিজেরা বলেননি যে তা ইবনে কুতাইবার রচিত নয়। যেমন ইলিয়াছ সারকিস১৫ এই পুস্তককে ইবনে কুতাইবার রচনা বলে গণ্য করেন।

৪। তাবারী ও তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ

মুহাম্মাদ বিন তাবারী (মৃত: ৩১০ হি:) নিজের ইতিহাসে ওহি-গৃহের সম্মানহানির ঘটনাকে এরূপ বর্ণনা করেছেন:

أتي عمر بن الخطاب منزل علي و فيه طلحة و الزبير و رجالٌ من المحاجرين. فقال والله لأحرقنّ عليكم أو لتخرجنّ إلی البيعة. فخرج عليه الزبير مصلتاً بالسيف فعثر فسقط السيف من يده. فوثبوا عليه فأخذوه

অর্থাৎ: উমর ইবনে খাত্তাব হজরত আলী (আ.) এর গৃহে আসে সে সময় সেই গৃহে তালহা জুবায়ের ও মুহাজিরদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোকও ছিল ,সে তাদের সম্বোধন করে বলল: যদি বাইয়াতের জন্য ঘর থেকে বের না হও তাহলে আল্লাহর কসম ঘরে আগুন লাগিয়ে দেব ,জুবায়ের হাতে তলোয়ার নিয়ে ঘর থেকে বাইরে আসে ,হঠাৎ তার পা পিছলে যায় এবং তার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে যায় ,সেই সময় সকলে তার উপর আক্রমণ করে এবং তলোয়ার তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়।১৬

ইতিহাস এই অংশটুকু দ্বারা প্রমাণ করে দিয়েছে যে প্রথম খলিফার বাইয়াত হুমকি ও ধমকি দিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে ,এই রকম বাইয়াতের কি মূল্য আছে ? পাঠকগণ নিজেরা ফয়সালা করুন।

৫। ইব্নে আবদে রাব্বাহ ও তাঁর গ্রন্থ“ আল আক্বদুল ফরিদ ”

শাহাবুদ্দীন আহমদ ওরফে“ ইবনে আবদে রাব্বাহ আন্দালুসী ”“ আল আক্বদুল ফরিদ ” গ্রন্থের লেখক (মৃত: ৪৬৩ হি:) নিজের গ্রন্থে একটি অংশে সাক্বিফার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে সেই ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করেছেন যারা আবুবকরের বাইয়াত অস্বীকার করেছেন:

فأمّا علي والعباس والزبير فعقدوا في بيت فاطمة حتي بعثت إليهم أبوبكر عمر بن خطّاب ليخرجهم من بيت فاطمة وقال له: إن أبوا فقاتلهم، فأقبل بقبس من نار أن يضرم عليهم الدار، فلقيته فاطمة فقال: يابن الخطاب أجئت لتحرق دارنا؟ قال: نعم، أو تدخلوا فيما دخلت فيه الأمة

অর্থাৎ: হজরত আলী (আ.) ,আব্বাস (রা.) ও জোবায়ের ফাতিমা (আ.) এর গৃহে বসেছিলেন। আবুবকর উমরকে পাঠায় যাতে ওদেরকে গৃহ থেকে বের করে আনে আর বলে পাঠায় যে: যদি তারা গৃহ থেকে বের না হয় তালে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে! সেই সময় উমর বিন খাত্তাব সামান্য আগুন নিয়ে ফাতিমা (আ.) এর গৃহ জ্বালানোর জন্য অগ্রসর হল ,সেই সময় ফাতিমা (আ.) এর সাথে সাক্ষাৎ হয় ,রাসুলের কন্যা বলেন: হে খাত্তাবের পুত্র আমার ঘর জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছ ? সে উত্তরে বলল: হ্যাঁ ,কিন্তু! যদি তোমরা নিজেরা তার মধ্যে (প্রথম খলিফার আনুগত্যের ছায়ায়) প্রবেশ করো যাতে উম্মত (অন্যরা) প্রবেশ করেছে তাহলে ভিন্ন কথা।১৭

এই পর্যন্ত ফাতিমা (আ.) এর গৃহের সম্মানহানির বিষয়ে আলোচনা করলাম এ ব্যাপারে এইখানে শেষ করছি এবার দ্বিতীয় বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চাই যাতে এই অমানবিক ও অসৎ কর্মকে কার্যে পরিণত করা হয়েছে।

যাইহোক এতক্ষণে এই বোঝা গেল যে তাদের ইচ্ছা ছিল হজরত আলী (আ.) ও তাঁর সঙ্গী সাথিদের ভয় ও হুমকি দিয়ে বাইয়াত করতে বাধ্য করা ,কিন্তু এই হুমকিকে কার্যে পরিণত করার কথাও ইতিহাসে প্রমানিত। এবার সেই কার্যগুলি বর্ণনা করতে চাই যে ,তারা এই মহা অপরাধে লিপ্তও হয়েছে।

এ পর্যন্ত শুধুমাত্র খলিফা ও তার সহচরদের কু’ নিয়তকে (অসৎ উদ্দেশ্যের প্রতি) ইঙ্গিত করে শেষ করা হয়েছে। এক শ্রেণীর লোক এই ঘটনার উপর পরিষ্কার ভাবে আলোকপাত করতে পারে না কিংবা করতে চায়না। এ সত্যেও কিছু লোক আসল ঘটনা অর্থাৎ গৃহে আক্রমণ এর উপর ইঙ্গিত করেছেন এবং কিছু পরিমান সত্যের উপর থেকে মুখাবরণ তুলেছেন এবং সত্যকে ফাঁস করেছেন। এখানে সম্মানহানি ও আক্রমণের বিষয়ে ইশারা করব।

এখানেও বিষয় বর্ণনার ক্ষেত্রে সময়ের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক বর্ণনাক্রমের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা হবে৷

৬। আবু ওবায়েদ এবং তার“ আল আমওয়াল ” পুস্তক

আবু ওবায়েদ ক্বাসিম বিন সালাম (মৃত: ২২৪ হি:) তাঁর“ আল আমওয়াল ” (যার বিশ্বস্ততার ব্যপারে ইসলামী বিশেষজ্ঞরা একমত) পুস্তকে বর্ণনা করেছেন:

আব্দুর রহমান বিন আউফ বলেন: আমি আবুবকরের মৃত্যুশয্যায় তার সাথে সাক্ষাত করতে তার বাড়ি যাই অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর আমাকে বলল: কামনা করি হায়! তিনটি কাজ যা আমি করেছি যদি না করতাম ,অনুরূপ আশাকরি হায়! তিনটি কাজ যা আমি করিনি যদি করতাম ,অনুরূপ ইচ্ছাহয় যে হায়! তিনটি জিনিস যদি রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করতাম।

সেই তিনটি জিনিস যা আমি করেছি আর আফসোস করছি যে যদি না করতাম সে তিনটি হল এই যে:

وددت إنّي لم أكشف بيت فاطمة تركته وإن أغلق علی الحرب

অর্থাৎ: হায় আফসোস! ফাতিমা (আ.) এর গৃহের সম্মানকে রক্ষা করতাম আর অসম্মানিত না করে তাঁর নিজের অবস্থায় ছেড়ে দিতাম যদিও তা যুদ্ধের জন্য বন্ধ করা হয়ে ছিল।১৮

আবু ওবায়েদ যখন বর্ণনায় এই স্থানে পৌছান” لم أكشف بيت فاطمة وتركته “ এই বাক্যকে বর্ণনা না করে” كذا و كذا “ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ সম্পূর্ণ ঘটনাকে বর্ণনা করেন নি এবং বলেন যে আমি এই ঘটনাকে উল্লেখ করতে চাইনা!

কিন্তু যাইহোক“ আবু ওবায়েদ ” মাযহাবী পক্ষপাতিত্বের জন্য কিংবা অন্য কোন কারণে এই সত্যকে বর্ণনা করেন নি ; কিন্তু“ আল আমওয়াল ” পুস্তকের গবেষকেরা পাদটীকাতে লিখেছেন যে বাক্যকে সে বাদ দিয়েছে তা“ মিযানুল এ’ তেদাল ” গ্রন্থে এই রকম (যেমনটি আমরা বর্ণনা করেছি তেমনটি) জাহাবী বর্ণনা করেছেন ,তাছাড়া“ তিবরানী ” নিজের“ মো’ জামে ” এবং“ ইবনে আব্দু রাব্বাহ ”“ আকদুল ফরিদে ” এবং অন্যরা স্ব স্ব গ্রন্থে উপরোক্ত বাক্যটি বর্ণনা করেছেন। (চিন্তা করুন!)

৭। তাবরানী ও মো’ জামে কবীর

আবুল ক্বাসিম সোলেমান বিন আহমদ তাবরানী (২৬০ -৩৬০) (জাহাবী তার সম্পর্কে“ মিজানুল এ’ তেদালে ” বলেন যে তিনি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। )“ আল মো’ জামুল কবীর ” পুস্তকে (যার মুদ্রণ বহুবার হয়েছে) যেখানে আবুবকরের মৃত্যু ও তার বাণী সম্পর্কে লিখেছেন উল্লেখ্য যে ,

আবুবকর মৃত্যুর সময় কিছু জিনিসের আশা করেছিল!

হায় আফসোস! তিনটি কাজকে যদি না করতাম!

হায় আফসোস! তিনটি কাজ যদি করতাম!

হায় আফসোস! তিনটি জিনিস যদি রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করতাম! যে তিনটি কাজের ব্যাপারে বলেছিল ; যে যদি না করতাম ,সে তিনটি হল:

أمّا الثلاث اللائي وددت أنّي لم أفعلهنّ، فوددت إني لم أكن أكشف بيت فاطمة و تركته

যে তিনটি কাজের জন্য আফসোস করছি তা হল যে হায় আফসোস যদি ফাতিমা (আ.) এর ঘরের অসম্মান না করতাম এবং তাকে তার অবস্থায় ছেড়ে দিতাম!১৯

এই আকাঙ্খা ব্যক্ত করাতে বোঝা যায় যে উমরের হুমকিকে বাস্তবে রূপ দেয়া হয়েছিল।

৮। ইব্নে আব্দু রাব্বাহ ও“ আল আক্বদুল ফরিদ ”

ইবনে আব্দু রাব্বাহ আন্দালুসী -“ আল আকদুল ফরীদ ” এর লেখক (মৃত: ৪৬৩ হিঃ) নিজের পুস্তকে আব্দুর রহমান বিন আওফ থেকে বর্ণনা করেছেন:

আমি আবুবকরের অসুস্থতার সময় তাকে দেখতে যাই ,তিনি বলেন: হায় আফসোস! যদি তিনটি কাজ না করতাম আর তার মধ্যে একটি কাজ হল যে:

وددت إني لم أكن أكشف بيت فاطمة عن شيئ و إن كانوا غلقوه علی الحرب

অর্থাৎ হায় আফসোস! যদি ফাতিমা (আ.) এর গৃহকে উন্মোচন না করতাম যদিও তারা লড়াই করার জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকুক না কেন ৷২০

এছাড়াও তাঁদের নাম উল্লেখ করব যাঁরা খলীফার এই বাক্যকে বর্ণনা করেছেন।

৯।“ আল ওয়াফী বিল ওয়াফাইয়াত“ পুস্তকে নাজ্জামের কথা

ইব্রাহীম বিন সাইয়ার নাজ্জাম মো’ তিজালী (১৬০ -২৩১) যিনি আরবী পদ্য ও গদ্যে বাক্যের সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত তার রচিত বিভিন্ন পুস্তকে ,ফাতিমা (আ.) এর ঘরে অন্যদের উপস্থিতির পরের ঘটনাকে বর্ণনা করে বলেন:

إنّ عمر ضرب بطن فاطمة يوم البيعة حتي ألقت المحسن من بطنها

অর্থাৎ আবুবকরের বাইয়াতের দিনে ওমর ফাতেমা (আ.) এর উদরে আঘাত করে ,তাঁর গর্ভের শিশু (মহসিন) গর্ভপাত হয়ে যায়। (চিন্তা করুন!)

১০। মোবররিদ্“ আল কামিল ” গ্রন্থে

মুহম্মদ বিন এজীদ বিন আব্দুল আকবর বাগদাদী (২১০ -২৮৫) বিখ্যাত সাহিত্যিক ও লেখক তাঁর মুল্যবান পুস্তক“ আল কামিল ” এ প্রথম খলিফার আকাঙ্খার কথা আব্দুর রহমান থেকে বর্ণনা করেছেন ,তিনি লেখেন:

وددت إني لم أكن أكشف عن بيت فاطمة و تركته و لوأغلق علي الحرب

অর্থাৎ: হায় ফাতিমা (আ.) এর ঘরের উপর আক্রমন না করতাম বরং তাঁকে তার নিজের অবস্থায় ছেড়ে দিতাম যদিও তা যুদ্ধের জন্য রুদ্ধ করা হয়েছিল।২১

১১। মাসউদী ও“ মরুজুয্যাহাব ”

মাসউদী (মৃত:৩২৫) তার মরুজুয্যাহাব গ্রন্থে লেখেন:

আবুবকর মৃত্যুর পূর্বে যা কিছু বলেছে তা নিম্নে দেওয়া হল:

তিনটি কাজ করেছি যদি না করতাম ,তার মধ্যে একটি এই যে:

فوددت إني لم أكن فتشت بيت فاطمة و ذكر في ذلك كلاماً كثيراً

অর্থাৎ: হায় আফসোস! ফাতিমার ঘরের উপর আক্রমণ না করতাম। আর এ ব্যাপারে সে অনেক কিছু বলেছে।২২

মাসউদীর যদিও মহানবী (সা.) এর আহলেবায়েত (আ.) এর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে ; কিন্তু এখানে খলিফার বার্তাকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করেছেন এবং শুধুমাত্র ইশারা করে ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ এ বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে জানেন ও আল্লাহর বান্দারাও মোটামুটিভাবে জানেন।

১২। ইবনে আবী দারেম্ ও“ মীজানুল এ’ তেদাল ” পুস্তক

“ আহমদ বিন মুহম্মদ ” ওরফে“ ইবনে আবী দারেম্ ” মুহাদ্দীসে কুফী (মৃত: ৩৬৫ হিঃ) মুহম্মদ বিন আহমদ বিন হাম্মদ কুফী তার সম্পর্কে বলেছেন যে:” كان مستقيم الأمر، عامة دهره “ অর্থাৎ: উনি সারা জীবন সঠিক পথের পথিক ছিলেন।

তার সামনে এই ঘটনাকে এভাবে বর্ণনা করা হল যে:

إنّ عمر رفس فاطمة حتي أسقطت بمحسن

অর্থাৎ: উমর হজরত ফাতিমা (আ.) এর গর্ভে লাথিমারে তাঁর গর্ভে মহসিন (নামে বাচ্চা) ছিল সে গর্ভপাত হয়ে যায়।২৩ (চিন্তা করুন!)

১৩। আব্দুল ফাত্তাহ আব্দুল মকছুদ ও“ আল ইমাম আলী ” পুস্তক

তিনি তাঁর গ্রন্থে হজরত ফাতিমা (আ.) এর গৃহে আক্রমণের ঘটনাকে দু’ দুবার বর্ণনা করেছেন ,কিন্তু আমি তার মধ্যে একটি বর্ণনা করছি:-

والذي نفس عمر بيده، ليخرجنّ أو لأحرقنّها علي من فيها ...!

قالت له طائفة خانت الله، ورعت الرسول في عقبه

يا أبا حفص، إنّ فيها فاطمة

فصاح لايبالي: و إن

واقترب وقرع الباب، ثمّ ضربه واقتحمه ...!

অর্থাৎ: যার হাতে উমরের জান আছে তার কসম খেয়ে বলছি তোমরা ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে এস ,নইলে ঘরে যারা আছে তাদের সহ ঘরকে জ্বালিয়ে দেব।

খোদাভীরু কিছু লোক আল্লাহর ভয়ে এবং রসুলের ঘরের সম্মান রক্ষার জন্য উমরের উদ্দেশ্যে বলল:

“ হে হাফসার পিতা! এই ঘরে ফাতিমা (আ.) আছেন ”

সে চিৎকার করে বলল:“ থাকে থাকুক!!”

দরজার নিকট গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল ,অতঃপর ঘুঁসি ও লাথি মেরে দরজা ভেঙে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

হজরত আলী (আ.) কে গ্রেফতার করে ।

হজরত ফাতিমা (আ.) এর আর্তনাদও চিৎকার প্রবেশদ্বার থেকে শোনাগেল আর তিনি আর্তনাদ করে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন।২৪

এই আলোচনাকে আর একটি হাদীস“ মাকাতিল ইব্নে আতীয়া ” এর আল ইমামাত ওয়াস সিয়াসাত গ্রন্থ থেকে বর্ণনা করে সমাপ্ত করব ,(এছাড়াও এখন অনেক কিছু আছে যা বলা এখন সম্ভব নয় বলে রয়ে গেল)

তিনি তাঁর পুস্তকে এমনি লিপিবদ্ধ করেছেন:

إنّ أبابكر بعد ما أخذ البيعة لنفسه من الناس بالإرهاب والسيف والقوّه أرسل عمر، وقنفذاً وجماعة إلي دار علي وفاطمة عليهماالسلام وجمع عمر الحطاب علي دار فاطمة وأحرق باب الدار

অর্থাৎ: যখন আবুবকর জনগণকে হুমকি দিয়ে তলোয়ার দিয়ে বলপূর্বক বাইয়াত নিল ; উমর ,কুনফুজ ও একদল লোককে হজরত আলী ও হজরত ফাতিমার গৃহে পাঠাল ,উমর কাঠ একত্র করে ঘরের দ্বারকে আগুন দ্বারা জ্বালিয়ে দিল ।২৫

এ রেওয়ায়েতের শেষে এমন কিছু কথা এসেছে যা এ কলম লিখতে অক্ষম।

*****

ফল : এতগুলো উজ্জল প্রমাণ ও দলিল তাদেরই গ্রন্থসমূহে বর্ণিত“‘ হওয়ার পরেও বলছে“ শাহাদাতের কল্পকাহিনী...!”

এনসাফ কোথায় ?!

এই সামান্য সনদযুক্ত প্রবন্ধটি যে পড়বে অবশ্যই সে বুঝতে পারবে যে রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর তাঁর শত্রুরা কেমন বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল ,শাসন ক্ষমতা ও খেলাফতকে অর্জন করার জন্য কি না করেছে ,সমস্ত স্বাধীন চিন্তাবিদ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের জন্য চুড়ান্ত যুক্তি-প্রমান পেশ করে দিলাম। কেন না আমি নিজের থেকে কোন কিছু লিখিনি আমি যাকিছু লিখেছি তা তাদের নিকট গ্রহণীয় পুস্তক সমূহ থেকে বর্ণনা ছাড়া অন্য কিছু করিনি।

*****

হে আল্লাহ তুমি তোমার সর্বশেষ খলিফা হজরত ফাতিমার সন্তান ইউসুফকে (ইমাম মাহ্দী (আ.) কে) শীঘ্র আবির্ভূব করুন এবং জগৎ কে অন্যায় থেকে মুক্তি দিন ,আমাদের সকলকে তাঁর প্রকৃত অনুসারীতে পরিণত করুন আমিন -।

__________

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202