কাগজ ও কলম নিয়ে এসো” : মহানবী (সা.)খেলাফত কুক্ষিগত করার জন্য তাঁর ঘরের বাইরে যে সব তৎপরতা চলছিল, সে ব্যাপারে মহানবী (সা.) সম্পূর্ণ ওয়াকিব ছিলেন। এ কারণে তিনি মতবিরোধের উদ্ভব ঠেকানো এবং তাঁর মূল ধারা থেকে বিচ্যুতি ঘটার আগেই তা রোধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এবং তাঁর আহলে বাইতের খিলাফতের ভিত্তি লিখিত আকারে মজবুত করবেন এবং খিলাফত প্রসঙ্গে একখানা জীবন্ত দলিল রেখে যাবেন।এ কারণেই যেদিন নেতৃত্বাস্থানীয় সাহাবীগণ তাঁকে দেখার জন্য আসেন, সেদিন তিনি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। অতঃপর তিনি তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন : “আমার জন্য কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো, যাতে আমি তোমাদের জন্য কিছু বিষয় লিখে দিতে পারি যেটা দিয়ে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।”১ইবনে আব্বাস এ ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন : “এটাই ছিল ইসলামের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ যে একদল সাহাবীর মত-পার্থক্য ও ঝগড়া-বিবাদ মহানবী (সা.)-এর কাঙ্ক্ষিত পত্র লেখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।”২বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, এর অর্থ ছিল তিনি পত্রের বিষয়বস্তু মুখে বলবেন এবং তাঁর একজন লেখক তা লিপিবদ্ধ করবেন। আর তা না হলে মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কখনো কলম হাতে নেন নি এবং এক লাইনও লিখেন নি। অধিক স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমার প্রণীত ‘দার মাকতাবে ওয়াহী’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করুন।এ ঐতিহাসিক ঘটনা একদল সুন্নী ও শিয়া হাদীসবিদ ও ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসবিদ্যার নীতিমালার দৃষ্টিকোণ থেকে তা নির্ভরযোগ্য ও সহীহ বর্ণনাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। একটি বিষয় আছে। আর তা হলো, আহলে সুন্নাতের মুহাদ্দিসগণ প্রধানত হযরত উমরের উক্তি অর্থগতভাবে উদ্ধৃত করেছেন অর্থাৎ তাঁরা তাঁর ধৃষ্টতামূলক উক্তির মূল পাঠ ব্যক্ত করেন নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, হযরত উমরের উক্তি উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকা এজন্য নয় যে, ধৃষ্টতার কথা উল্লেখ করা আসলে মহানবী (সা.)-এর প্রতি এক ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন; বরং দ্বিতীয় খলীফার মর্যাদা রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তাঁর উক্তিতে হাত দেয়া হয়েছে এবং পরিবর্তন করা হয়েছে, পাছে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁর অবমাননাকর উক্তি শুনে তাঁর ব্যাপারে হতাশ না হয় (এবং কুধারণা পোষণ না করে)।এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ‘আস সাকীফাহ্’ গ্রন্থের রচয়িতা আবু বকর জওহারী যখন তাঁর গ্রন্থে এ অধ্যায়ে উপনীত হন, তখন তিনি হযরত উমরের উক্তিটি এভাবে বর্ণনা করেন :و قال عمر كلمة معناها أنّ الوجع قد غلب علي رسول الله“এবং হযরত উমর একটি কথা বলেন, যার অর্থ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর ওপর রোগ-যন্ত্রণা প্রবল হয়েছে।”৩তবে আহলে সুন্নাতের হাদীসবেত্তাদের মধ্য থেকে যখন কেউ কেউ দ্বিতীয় খলীফার উক্তির মূল পাঠ হুবহু উদ্ধৃত করতে চান, তখন তাঁরা তাঁর সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ থেকে বিরত থাকেন এবং এতটুকু লিখেন : فقالوا هجر رسول الله “অতঃপর তারা বলল : রাসূলুল্লাহ্ রোগের কারণে প্রলাপ বকেছেন।”৪নিশ্চিতভাবে এ ধরনের অশালীন ও জঘন্য উক্তি যে কোন ব্যক্তিরই হয়ে থাকুক না কেন, তা কখনো ক্ষমার যোগ্য নয়। কারণ পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য অনুসারে মহানবী (সা.) সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত এবং তিনি ওহী ছাড়া কোন কথা বলেন না।নিষ্পাপ নবীর সান্নিধ্যে সাহাবীদের বিবাদ এতটা বিরক্তিকর ও মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কয়েকজন স্ত্রী পর্দার অন্তরাল থেকে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন : “কেন আপনারা মহানবীর নির্দেশ অমান্য করছেন?” দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর তাঁদেরকে চুপ করানোর জন্য বলেছিলেন : “আপনারা হযরত ইউসুফের সঙ্গীদের স্ত্রীদের সদৃশ। যখন মহানবী অসুস্থ হন, তখন আপনারা তাঁর জন্য নিজেদের নয়নগুলোয় চাপ দেন (অশ্রুপাত করেন) এবং যখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন, তখন আপনারা তাঁর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।”৫কতিপয় গোঁড়া ব্যক্তি বাহ্যত দ্বিতীয় খলীফার বিরুদ্ধাচরণের পক্ষে কিছু অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন।৬ তবে যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে আসলে তাঁরা তাঁকে এ কাজের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলেছেন এবং حسبنا كتاب الله (মহান আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ পবিত্র কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট)- তাঁর এ উক্তিকে তাঁরা অসার গণ্য করেছেন এবং সবাই স্বীকার করেছেন, ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর সুন্নাত এবং পবিত্র কুরআন কখনোই উম্মতকে মহানবীর হাদীস ও বাণীসমূহের ব্যাপারে অমুখাপেক্ষী করে নি।তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ‘মুহাম্মদের জীবনী’ গ্রন্থের রচয়িতা ড. হাসানাইন হাইকাল ইশারা-ইঙ্গিতে দ্বিতীয় খলীফার এ কাজ সমর্থন করে লিখেছেন : “এ ঘটনার পর ইবনে আব্বাস বিশ্বাস করতেন, মহানবী (সা.) যে বিষয়টি লিখে দিতে চাচ্ছিলেন, তা লেখার ক্ষেত্রে বাধা দান করে মুসলমানরা আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে হারিয়েছে। কিন্তু হযরত উমর তাঁর বিশ্বাসের ওপর বহাল থেকেছেন। কারণ মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন :)ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء(“আমরা পবিত্র কুরআনে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ সবকিছু এ গ্রন্থে বর্ণনা করেছি)।”৭তিনি যদি এ আয়াতের আগের ও পরের অংশের দিকে দৃষ্টি দিতেন, তা হলে তিনি কখনোই এ আয়াতের এ রকম অপব্যাখ্যা করতেন না এবং নিষ্পাপ মহানবীর বিপরীতে হযরত উমরের এ কাজ সমর্থন করতেন না। কারণ আয়াতে উল্লিখিত কিতাব বা গ্রন্থের অর্থ বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ এবং অস্তিত্বের পত্রসমূহকে বোঝানো হয়েছে। আর এ অস্তিত্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টি আসলে সৃষ্টিগ্রন্থের এক একটি পৃষ্ঠা এবং সমগ্র সৃষ্টি এ সৃষ্টিগ্রন্থের সমুদয় পৃষ্ঠাতুল্য।)و ما من دابّة فِى الأرض و لا طائر يطير بجناحيه الّا أمم أمثالكم ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء ثمّ الى ربّهم يُحشرون(“পৃথিবীতে (বিচরণকারী) প্রতিটি জীব-জন্তু এবং (আকাশে) স্বীয় ডানা মেলে উড্ডয়নকারী প্রতিটি বিহঙ্গ তোমাদের মতোই এক একটা প্রজাতি (أمم), আমরা (সৃষ্টি) গ্রন্থে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ আমরা এ সৃষ্টিলোকে যা যা সৃষ্টি করা সম্ভব, সেগুলো সবই সৃষ্টি করেছি) এবং সব কিছুই তাদের প্রভুর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে।” (সূরা আনআম : ৩৮)যেহেতু ‘আমরা এ গ্রন্থের মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি’- এ বাক্যের আগের বাক্য ‘জীবকূল ও পক্ষীকূল’ সৃষ্টি করার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এর পরের বাক্য কিয়ামত দিবসে পুনরুজ্জীবিত করণ প্রক্রিয়া বা হাশরের সাথে সম্পর্কিত, সেহেতু নিশ্চিত করে বলা যায়, আয়াতে উল্লিখিত ‘গ্রন্থ’ যার মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করা হয় নি, তা বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ (সৃষ্টিগ্রন্থ) এবং অস্তিত্বের পত্রকেই বোঝানো হয়েছে।অধিকন্তু আমরা যদি মেনেও নিই যে, আয়াতের ‘গ্রন্থ’ শব্দ আসলে পবিত্র কুরআন, তা হলে পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট উক্তি অনুসারে এ গ্রন্থ বোঝার জন্য মহানবী (সা.)-এর ব্যাখ্যা ও দিক-নির্দেশনা আবশ্যক।)و أنزلنا إليك الذّكر لتبيّن للنّاس ما نزل إليهم(“আর আমরা আপনার কাছে এ ‘স্মরণ’ অর্থাৎ পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে আপনি জনগণের কাছে তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করেন।” (সূরা নাহল : ৪৪)এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, মহান আল্লাহ্ এ আয়াতে لتقرأ অর্থাৎ ‘যাতে আপনি পাঠ করেন’ বলেন নি, বরং তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন لتبيّن অর্থাৎ ‘যাতে আপনি ব্যাখ্যা করেন’। সুতরাং মহান আল্লাহর গ্রন্থই যদি মুসলিম উম্মাহর জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে, তবুও মহানবী (সা.) প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি এ গ্রন্থের তীব্র প্রয়োজন রয়েছে।৮উম্মত যদি এ ধরনের দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্রের মুখাপেক্ষী না-ই হতো, তা হলে যখন ইসলাম ধর্মের প্রখ্যাত বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ইবনে আব্বাস (রা.)-এর গণ্ডদেশ বেয়ে মুক্তার মতো অশ্রুবিন্দু ঝরতে থাকত, তখন কেন তিনি বলতেন :يوم الخميس و ما يوم الخميس ثمّ جعل تسيل دموعه حتّي رؤيت علي خدّيه كأنها نظام اللؤلؤ قال رسول الله : ايتونِى بالكتف و الدّواة أو اللوح و الدّواة اكتب لكم كتاباً لن تضلّوا بعده ابداً فقالوا...“হায় বৃহস্পতিবার! হায় বৃহস্পতিবার! এরপর তাঁর অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল; আর তাঁর গণ্ডদেশদ্বয়ের উপর তা মুক্তার মতো দেখা যাচ্ছিল। তিনি বললেন : মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার কাছে তোমরা কাঁধের হাড় ও দোয়াত বা কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো। তা হলে আমি তোমাদের জন্য এমন একটি পত্র (নির্দেশনামা) লিখে দেব যে, এরপর তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। অতঃপর একদল লোক বলল : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)”৯ ...এ ধরনের তীব্র শোক যা ইবনে আব্বাস প্রকাশ করেছেন, তা সত্বেও এবং মহানবী (সা.) নিজেই যে তাকীদ দিয়েছেন তার ভিত্তিতে কিভাবে এ কথা বলা সম্ভব যে, পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর এ পত্রের প্রতি মুসলিম উম্মাহকে অমুখাপেক্ষী করেছে?এখন যখন মহানবী (সা.) এ ধরনের একটি নির্দেশনামা লিপিবদ্ধ করাতে পারলেন না, তখন অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দলিলের ভিত্তিতে কি ধারণা করা সম্ভব যে, এ নির্দেশনা লেখানোর পেছনে মহানবীর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? এ পত্রের বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য কী ছিল?পবিত্র কুরআন তাফসীর করার ক্ষেত্রে নতুন অথচ দৃঢ় পদ্ধতি,- যা বর্তমানে সকল গবেষক ও আলেমের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে,- হচ্ছে কোন একটি বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতের দ্ব্যর্থবোধকতা ও সংক্ষিপ্ততা ঐ একই বিষয়ে অবতীর্ণ অপর কোন আয়াতের মাধ্যমে দূর করা হয়, যা অর্থ নির্দেশের ক্ষেত্রে প্রথমটির চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর পারিভাষিক অর্থে আমরা এভাবে পবিত্র কুরআনের আয়াতকে অপর এক আয়াতের সাহায্যে তাফসীর (ব্যাখ্যা) করি।এ পদ্ধতি পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ ব্যাখ্যার সাথেই একান্তভাবে শুধু সংশ্লিষ্ট নয়, বরং হাদীসসমূহের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তাই এক হাদীসের সাহায্যে অনুরূপ আরেক হাদীসের সংক্ষিপ্ততা ও দ্ব্যর্থবোধকতা দূর করা যায়। কারণ আমাদের মহান ইমামগণ সংবেদনশীল ও দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপকারী ও পুনরাবৃত্তিমূলক অনেক বক্তব্য ও ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যার সবই অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশের ক্ষেত্রে একই ধাঁচের ও একই পর্যায়ের নয়; কখনো কখনো সেসব অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশ করার ক্ষেত্রে পরিষ্কার; আবার কখনো কখনো পরিবেশ-পরিস্থতির কারণে কাঙ্ক্ষিত অর্থ ও লক্ষ্য ইশারা-ইঙ্গিতে বর্ণনা করতে হয়েছে।বলা হয়েছে, মহানবী (সা.) রোগশয্যায় শায়িতাবস্থায় একটি বিষয় লিখে দেয়ার জন্য সাহাবীগণকে কাগজ-কলম আনার নির্দেশ দেন এবং তিনি তাঁদের স্মরণ করিয়েও দেন, এ নির্দেশনামার কারণে তারা কখনো পথভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়বে না।১০ অতঃপর মহানবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তিনি ঐ চিঠি বা প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্র লেখানো থেকে বিরত থাকেন।এ ক্ষেত্রে কেউ হয় তো প্রশ্ন করতে পারে, যে পত্র মহানবী (সা.) লেখাতে চেয়েছিলেন, তা কী প্রসঙ্গে ছিল। এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট। কারণ আলোচনার শুরুতে আমরা যে মূলনীতি উল্লেখ করেছি, তার আলোকে অবশ্যই বলা যায়, আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর ওয়াসায়াত এবং খিলাফত দৃঢ়ীকরণ এবং তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার অপরিহার্যতা তুলে ধরা ছাড়া মহানবীর আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। আর এ বিষয় হাদীসে সাকালাইন বিবেচনায় আনলে স্পষ্ট হয়ে যায়। উল্লেখ্য, হাদীসে সাকালাইনের ব্যাপারে শিয়া-সুন্নী সকল হাদীসবিশারদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। কারণ মহানবী (সা.) যে পত্র লিখাতে চেয়েছিলেন, সে ব্যাপারে বলেছেন : “যাতে তোমরা আমার পরে পথভ্রষ্ট না হও, সেজন্য আমি এ পত্রটি লিখাচ্ছি।” আর হাদীসে সাকালাইনেও তিনি হুবহু এ বাক্যই (অর্থাৎ আমার পরে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না) বলেছেন এবং কিতাব ও তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার কারণ তিনি এটাই বিবেচনা করেছেন যে, এ দুই মূল্যবান ও ভারী বিষয়ের অনুসরণই হচ্ছে পথভ্রষ্ট না হবার কারণ।انّى تارك فيكم الثّقلين ما ان تمسّكتم بِهما لن تضلّوا : كتاب الله و عترتى اهل بيتِى“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু’টি অতি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত এ দু’টি তোমরা আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন পর্যন্ত তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। এ দুই অতি মূল্যবান জিনিস হচ্ছে : মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধর (ইতরাত)।”এ দুই হাদীসের১১ শব্দমালা এবং এদের মধ্যে বিদ্যমান সাদৃশ্য বিবেচনায় আনলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা সম্ভব নয় কি যে, কাগজ ও কলম চাওয়ার পেছনে মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল হাদীসে সাকালাইনের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বা এর অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুর চেয়েও উন্নত কিছু লিপিবদ্ধ করা; আর তা ছিল মহানবীর প্রত্যক্ষ ওয়াসী ও উত্তরাধিকারীর বেলায়েত (নেতৃত্ব) এবং ওয়াসায়াত দৃঢ়ীকরণ যা ১৮ যিলহজ্ব ইরাক, মিশর ও হিজাযের হাজীগণের পৃথক হবার স্থান গাদীরে খুমের মহাসমাবেশে মৌখিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল?এছাড়াও যে ব্যক্তি মহানবীর ওফাতের পরপর সাকীফায়ে বনী সায়েদায় খিলাফতের জন্য শূরা বা পরামর্শসভার আয়োজন করে নিজের পুরনো বন্ধুকে বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে খিলাফতের জন্য প্রার্থী করেছিলেন এবং তাঁর বন্ধু নিজের মৃত্যুকালে তাঁকে তাঁর সেবার নগদ পুরস্কারও দিয়েছিলেন এবং তাঁকে সকল মূলনীতির বিপরীতে খিলাফতের জন্য মনোনীত করেছিলেন, সেই ব্যক্তির দুর্দমনীয় বিরোধিতা এ বিষয়ের সাক্ষী যে, মহানবী (সা.)-এর কথাবার্তা এবং তাঁর কাছে সাহাবীগণের এ সমাবেশে এমন কিছু প্রমাণ বিদ্যমান ছিল, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, মহানবী (সা.) খিলাফত ও মুসলিম উম্মাহর সার্বিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্বভারের ব্যাপারে কিছু কথা লিখাতে চাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি (হযরত উমর) কাগজ-কলম আনার ব্যাপারে বিরোধিতা করেন। আর তা না হলে এতটা জবরদস্তির কোন কারণ থাকত না। মহানবী (সা.) কেন এ পত্র লেখার ব্যাপারে আর তাকীদ দিলেন না?মহানবী (সা.) যিনি তাদের বিরোধিতা সত্বেও নিজ সচিবকে ডেকে এ পত্র লেখাতে পারতেন, তিনি কেন (ঐ পত্র লেখানোর ক্ষেত্রে) শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলেন?এ প্রশ্নের উত্তরও সুস্পষ্ট। কারণ মহানবী (সা.) যদি এ পত্র লেখার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করতেন, তা হলে যারা বলেছিলেন যে, ‘রোগযন্ত্রণা মহানবীর ওপর প্রবল হয়েছে’, তারাই মহানবীর সাথে আরো বেয়াদবীর চরম স্পর্ধা প্রদর্শন করত এবং তাদের সমর্থকরাও জনগণের মধ্যে তা রটনা করে তাদের দাবী প্রমাণ করার চেষ্টা করত। এ অবস্থায় মহানবীর শানে বেয়াদবীপূর্ণ আচরণের মাত্রা যেমন বৃদ্ধি পেত ও অব্যাহত থাকত, তেমনি মহানবীর পত্রের কার্যকারিতাও আর থাকত না। এ কারণেই কেউ কেউ যখন তাদের বেয়াদবী ও মন্দ আচরণ লাঘব করার জন্য মহানবীর কাছে বলেছিলেন : “আপনি কি ইচ্ছা করেন যে, আমরা কাগজ-কলম নিয়ে আসি?” তখন তাঁর চেহারা প্রচণ্ড উষ্মায় ফেটে পড়ছিল, তা রক্তিম হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি তাদের বলেছিলেন : “এতসব কথা-বার্তার পর তোমরা কাগজ-কলম আনতে চাচ্ছ? কেবল এতটুকু তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে, আমার বংশধরদের সাথে সদাচরণ করবে।” এ কথা বলে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং আলী, আব্বাস ও ফযল ব্যতীত তারা সবাই সেখান থেকে উঠে চলে যায়।১২ অন্তিম পত্র লিখতে না পারার ক্ষতিপূরণ প্রচেষ্টাকতিপয় সাহাবীর প্রকাশ্য বিরোধিতা যদিও মহানবীকে পত্র লেখার অভিপ্রায় পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল, তবুও তিনি ভিন্ন এক পদ্ধতিতে তাঁর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিলেন এবং ইতিহাসের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) রোগযন্ত্রণায় প্রচণ্ড কষ্ট পাওয়া সত্বেও এক হাত আলীর কাঁধে এবং অন্য হাত মায়মুনার কাঁধের উপর রেখে মসজিদের দিকে গমন করেন এবং প্রাণশক্তি নিঃশেষকারী তীব্র কষ্ট সহ্য করেও তিনি মিম্বারে আরোহণ করেন। জনতার নয়ন অশ্রুজলে ভিজে গিয়েছিল এবং মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছিল। জনতা তখন মহানবীর সর্বশেষ বাণী ও উপদেশাবলী শোনার অপেক্ষা করছিল। মহানবী (সা.) সভাস্থলের নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন : “আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি।” ঐ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল : “ঐ দুই মূল্যবান জিনিস কী?” (উষ্মায়) মহানবীর মুখমণ্ডল প্রজ্বলিত হয়ে উঠল এবং তিনি বললেন : “আমি নিজেই এর ব্যাখ্যা দেব; তাই প্রশ্ন করার কোন কারণ নেই।” অতঃপর তিনি বললেন : “এক হচ্ছে পবিত্র কুরআন এবং অন্যটি আমার বংশধর।”১৩ইবনে হাজর আসকালানী ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন এবং এ দু’টি বর্ণনাই১৪ সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই। তিনি লিখেছেন : “মহানবী (সা.) যখন অসুস্থ তখন কোন একদিন যখন সাহাবীগণ তাঁর বিছানার চারপাশ ঘিরে রেখেছিলেন, তখন তিনি তাঁদের দিকে মুখ করে বলেছিলেন : হে লোকসকল! আমার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে এবং খুব শীঘ্রই আমি তোমাদের মধ্য থেকে বিদায় নেব। তোমরা জেনে রাখ, আমি তোমাদের মধ্যে মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধরদের রেখে যাচ্ছি। এরপর তিনি হযরত আলীর হাত ধরে তা উঁচুতে তুলে বললেন :هذا علىّ مع القرآن و القرآن مع علىّ لا يفترقان-এই আলী পবিত্র কুরআনের সাথে এবং পবিত্র কুরআন আলীর সাথে আছে। এরা কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।”১৫মহানবী (সা.) যদিও তাঁর অসুস্থ হওয়ার আগে একাধিক উপলক্ষে১৬ হাদীসে সাকালাইন বিভিন্ন আঙ্গিক ও ভাষাগত অবয়বে বর্ণনা করেছিলেন এবং এ দুই অতি মূল্যবান বিষয়ের প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তবু যেহেতু তিনি রোগশয্যায় শায়িত হয়ে আবারও পবিত্র কুরআন ও তাঁর বংশধরদের (ইতরাত) আঁকড়ে ধরে থাকার ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেছেন এবং যেসব ব্যক্তি তাঁর অন্তিম পত্র লেখার ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই উপস্থিতিতে তিনি পবিত্র কুরআন ও ইতরাতের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সেহেতু ধারণা করা যায়, হাদীসে সাকালাইনের পুনরাবৃত্তিই ছিল ঐ অন্তিম পত্রের শূন্যতা পূরণ করা, যা তিনি লিখতে পারেন নি। তথ্যসূত্র :১. ايتونِى بدواة و صحيفة اكتب لكم كتابا لا تضلّون بعده২. সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২ এবং ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪; সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪; মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৫ এবং আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৪৩. ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৪. সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪ এবং মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫৫. কানযুল উম্মাল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩৮ এবং আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৪৬. মরহুম মুজাহিদ আল্লামা সাইয়্যেদ শারাফুদ্দীন তাঁর ‘আল মুরাজায়াত’ গ্রন্থে তাঁদের সকল অজুহাত উল্লেখ করে সেগুলো আকর্ষণীয়ভাবে খণ্ডন করেছেন।৭. মুহাম্মদের জীবনী, পৃ. ৪৭৫৮. মহানবী (সা.) প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি পবিত্র কুরআনের মুখাপেক্ষিতার সীমা বর্ণনা করা আমাদের এ আলোচনার গণ্ডির বাইরে। আমরা ‘পবিত্র কুরআনের জটিল আয়াতসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা’ এবং মানসূরে জভীদ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে এ সংক্রান্ত আলোচনা করেছি।৯. মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫১০. اكتب لكم كتاباً لن تضلّوا بعده ابداً আমি তোমাদের একটি পত্র লিখে দেব যার পরে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আপনারা যদি লক্ষ্য করেন, তা হলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, মহানবী (সা.) لن تضلّوا (তোমরা আর কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না)-এ বাক্যের দ্বারা তাঁর পত্র লেখার কারণ ব্যক্ত করেছেন।১১. হাদীসে সাকালাইন ও কাগজ-কলমের হাদীস১২. বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৬৯ এবং শেখ মুফীদ প্রণীত কিতাব আল ইরশাদ এবং তাবারসী প্রণীত আলামুল ওয়ারা১৩. বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৭৬১৪. প্রথম বর্ণনা ও রেওয়ায়েত বিহারুল আনওয়ারের ২২তম খণ্ডের ৪৭৬ পৃ. থেকে উদ্ধৃত এবং দ্বিতীয় বর্ণনা ইবনে হাজর আসকালানী বর্ণিত।১৫. আসসাওয়ায়েক আল মুহরিকাহ্, ৯ম অধ্যায়, পৃ. ৫৭ এবং কাশফুল গাম্মাহ্, পৃ. ৪৩১৬. হাদীসে সাকালাইন শিয়া-সুন্নী হাদীসবিদগণ যে সব হাদীস ও রেওয়ায়েতের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, সেসবের অন্তর্ভুক্ত। এ হাদীস ৬০টিরও অধিক সূত্রে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে হাজার আসকালানী আস সাওয়ায়েক আল মুহরিকাহ্ গ্রন্থের ১৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : “মহানবী (সা.) বিভিন্ন উপলক্ষ, যেমন আরাফাতের দিবসে, গাদীরে খুমের দিবসে, তায়েফ নগরী থেকে প্রত্যাবর্তনের পর, এমনকি রোগশয্যায় শায়িত অবস্থায়ও পবিত্র কুরআন ও তাঁর ইতরাতের সাথে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।”মরহুম মীর হামেদ হুসাইন হিন্দী তাঁর গ্রন্থের একটি অংশে হাদীসে সাকালাইনের সনদসমূহ এবং এর অর্থের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রেখেছেন এবং এসবের সমগ্র সম্প্রতি ৬ খণ্ডে ইসফাহান থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। মিশরের ‘দারুত তাকরীব’ সংস্থার (ইসলামী মাযহাবসমূহকে নিকটবর্তী করার সংস্থা) পক্ষ থেকে ১৩৭৪ হিজরীতে এ হাদীস সংক্রান্ত একটি সন্দর্ভ প্রকাশ করা হয়েছিল। এ সন্দর্ভে সনদের দৃষ্টিকোণ থেকে এ হাদীসের গুরুত্ব এবং সকল শতকে এ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের বিশেষ দৃষ্টি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।লা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিনবেশুমার লানত বর্ষিত হোকনিবেদক_____ রাকিব আলী ইমামি

কাগজ ও কলম নিয়ে এসো” : মহানবী (সা.)
খেলাফত কুক্ষিগত করার জন্য তাঁর ঘরের বাইরে যে সব তৎপরতা চলছিল, সে ব্যাপারে মহানবী (সা.) সম্পূর্ণ ওয়াকিব ছিলেন। এ কারণে তিনি মতবিরোধের উদ্ভব ঠেকানো এবং তাঁর মূল ধারা থেকে বিচ্যুতি ঘটার আগেই তা রোধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এবং তাঁর আহলে বাইতের খিলাফতের ভিত্তি লিখিত আকারে মজবুত করবেন এবং খিলাফত প্রসঙ্গে একখানা জীবন্ত দলিল রেখে যাবেন।

এ কারণেই যেদিন নেতৃত্বাস্থানীয় সাহাবীগণ তাঁকে দেখার জন্য আসেন, সেদিন তিনি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। অতঃপর তিনি তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন : “আমার জন্য কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো, যাতে আমি তোমাদের জন্য কিছু বিষয় লিখে দিতে পারি যেটা দিয়ে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।”১

ইবনে আব্বাস এ ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন : “এটাই ছিল ইসলামের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ যে একদল সাহাবীর মত-পার্থক্য ও ঝগড়া-বিবাদ মহানবী (সা.)-এর কাঙ্ক্ষিত পত্র লেখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।”২

বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, এর অর্থ ছিল তিনি পত্রের বিষয়বস্তু মুখে বলবেন এবং তাঁর একজন লেখক তা লিপিবদ্ধ করবেন। আর তা না হলে মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কখনো কলম হাতে নেন নি এবং এক লাইনও লিখেন নি। অধিক স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমার প্রণীত ‘দার মাকতাবে ওয়াহী’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করুন।

এ ঐতিহাসিক ঘটনা একদল সুন্নী ও শিয়া হাদীসবিদ ও ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসবিদ্যার নীতিমালার দৃষ্টিকোণ থেকে তা নির্ভরযোগ্য ও সহীহ বর্ণনাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। একটি বিষয় আছে। আর তা হলো, আহলে সুন্নাতের মুহাদ্দিসগণ প্রধানত হযরত উমরের উক্তি অর্থগতভাবে উদ্ধৃত করেছেন অর্থাৎ তাঁরা তাঁর ধৃষ্টতামূলক উক্তির মূল পাঠ ব্যক্ত করেন নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, হযরত উমরের উক্তি উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকা এজন্য নয় যে, ধৃষ্টতার কথা উল্লেখ করা আসলে মহানবী (সা.)-এর প্রতি এক ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন; বরং দ্বিতীয় খলীফার মর্যাদা রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তাঁর উক্তিতে হাত দেয়া হয়েছে এবং পরিবর্তন করা হয়েছে, পাছে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁর অবমাননাকর উক্তি শুনে তাঁর ব্যাপারে হতাশ না হয় (এবং কুধারণা পোষণ না করে)।

এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ‘আস সাকীফাহ্’ গ্রন্থের রচয়িতা আবু বকর জওহারী যখন তাঁর গ্রন্থে এ অধ্যায়ে উপনীত হন, তখন তিনি হযরত উমরের উক্তিটি এভাবে বর্ণনা করেন :

و قال عمر كلمة معناها أنّ الوجع قد غلب علي رسول الله

“এবং হযরত উমর একটি কথা বলেন, যার অর্থ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর ওপর রোগ-যন্ত্রণা প্রবল হয়েছে।”৩

তবে আহলে সুন্নাতের হাদীসবেত্তাদের মধ্য থেকে যখন কেউ কেউ দ্বিতীয় খলীফার উক্তির মূল পাঠ হুবহু উদ্ধৃত করতে চান, তখন তাঁরা তাঁর সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ থেকে বিরত থাকেন এবং এতটুকু লিখেন : فقالوا هجر رسول الله “অতঃপর তারা বলল : রাসূলুল্লাহ্ রোগের কারণে প্রলাপ বকেছেন।”৪

নিশ্চিতভাবে এ ধরনের অশালীন ও জঘন্য উক্তি যে কোন ব্যক্তিরই হয়ে থাকুক না কেন, তা কখনো ক্ষমার যোগ্য নয়। কারণ পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য অনুসারে মহানবী (সা.) সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত এবং তিনি ওহী ছাড়া কোন কথা বলেন না।

নিষ্পাপ নবীর সান্নিধ্যে সাহাবীদের বিবাদ এতটা বিরক্তিকর ও মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কয়েকজন স্ত্রী পর্দার অন্তরাল থেকে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন : “কেন আপনারা মহানবীর নির্দেশ অমান্য করছেন?” দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর তাঁদেরকে চুপ করানোর জন্য বলেছিলেন : “আপনারা হযরত ইউসুফের সঙ্গীদের স্ত্রীদের সদৃশ। যখন মহানবী অসুস্থ হন, তখন আপনারা তাঁর জন্য নিজেদের নয়নগুলোয় চাপ দেন (অশ্রুপাত করেন) এবং যখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন, তখন আপনারা তাঁর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।”৫

কতিপয় গোঁড়া ব্যক্তি বাহ্যত দ্বিতীয় খলীফার বিরুদ্ধাচরণের পক্ষে কিছু অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন।৬ তবে যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে আসলে তাঁরা তাঁকে এ কাজের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলেছেন এবং حسبنا كتاب الله (মহান আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ পবিত্র কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট)- তাঁর এ উক্তিকে তাঁরা অসার গণ্য করেছেন এবং সবাই স্বীকার করেছেন, ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর সুন্নাত এবং পবিত্র কুরআন কখনোই উম্মতকে মহানবীর হাদীস ও বাণীসমূহের ব্যাপারে অমুখাপেক্ষী করে নি।

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ‘মুহাম্মদের জীবনী’ গ্রন্থের রচয়িতা ড. হাসানাইন হাইকাল ইশারা-ইঙ্গিতে দ্বিতীয় খলীফার এ কাজ সমর্থন করে লিখেছেন : “এ ঘটনার পর ইবনে আব্বাস বিশ্বাস করতেন, মহানবী (সা.) যে বিষয়টি লিখে দিতে চাচ্ছিলেন, তা লেখার ক্ষেত্রে বাধা দান করে মুসলমানরা আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে হারিয়েছে। কিন্তু হযরত উমর তাঁর বিশ্বাসের ওপর বহাল থেকেছেন। কারণ মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন :

)ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء(

“আমরা পবিত্র কুরআনে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ সবকিছু এ গ্রন্থে বর্ণনা করেছি)।”৭

তিনি যদি এ আয়াতের আগের ও পরের অংশের দিকে দৃষ্টি দিতেন, তা হলে তিনি কখনোই এ আয়াতের এ রকম অপব্যাখ্যা করতেন না এবং নিষ্পাপ মহানবীর বিপরীতে হযরত উমরের এ কাজ সমর্থন করতেন না। কারণ আয়াতে উল্লিখিত কিতাব বা গ্রন্থের অর্থ বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ এবং অস্তিত্বের পত্রসমূহকে বোঝানো হয়েছে। আর এ অস্তিত্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টি আসলে সৃষ্টিগ্রন্থের এক একটি পৃষ্ঠা এবং সমগ্র সৃষ্টি এ সৃষ্টিগ্রন্থের সমুদয় পৃষ্ঠাতুল্য।

)و ما من دابّة فِى الأرض و لا طائر يطير بجناحيه الّا أمم أمثالكم ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء ثمّ الى ربّهم يُحشرون(

“পৃথিবীতে (বিচরণকারী) প্রতিটি জীব-জন্তু এবং (আকাশে) স্বীয় ডানা মেলে উড্ডয়নকারী প্রতিটি বিহঙ্গ তোমাদের মতোই এক একটা প্রজাতি (أمم), আমরা (সৃষ্টি) গ্রন্থে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ আমরা এ সৃষ্টিলোকে যা যা সৃষ্টি করা সম্ভব, সেগুলো সবই সৃষ্টি করেছি) এবং সব কিছুই তাদের প্রভুর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে।” (সূরা আনআম : ৩৮)

যেহেতু ‘আমরা এ গ্রন্থের মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি’- এ বাক্যের আগের বাক্য ‘জীবকূল ও পক্ষীকূল’ সৃষ্টি করার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এর পরের বাক্য কিয়ামত দিবসে পুনরুজ্জীবিত করণ প্রক্রিয়া বা হাশরের সাথে সম্পর্কিত, সেহেতু নিশ্চিত করে বলা যায়, আয়াতে উল্লিখিত ‘গ্রন্থ’ যার মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করা হয় নি, তা বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ (সৃষ্টিগ্রন্থ) এবং অস্তিত্বের পত্রকেই বোঝানো হয়েছে।

অধিকন্তু আমরা যদি মেনেও নিই যে, আয়াতের ‘গ্রন্থ’ শব্দ আসলে পবিত্র কুরআন, তা হলে পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট উক্তি অনুসারে এ গ্রন্থ বোঝার জন্য মহানবী (সা.)-এর ব্যাখ্যা ও দিক-নির্দেশনা আবশ্যক।

)و أنزلنا إليك الذّكر لتبيّن للنّاس ما نزل إليهم(

“আর আমরা আপনার কাছে এ ‘স্মরণ’ অর্থাৎ পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে আপনি জনগণের কাছে তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করেন।” (সূরা নাহল : ৪৪)

এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, মহান আল্লাহ্ এ আয়াতে لتقرأ অর্থাৎ ‘যাতে আপনি পাঠ করেন’ বলেন নি, বরং তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন لتبيّن অর্থাৎ ‘যাতে আপনি ব্যাখ্যা করেন’। সুতরাং মহান আল্লাহর গ্রন্থই যদি মুসলিম উম্মাহর জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে, তবুও মহানবী (সা.) প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি এ গ্রন্থের তীব্র প্রয়োজন রয়েছে।৮

উম্মত যদি এ ধরনের দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্রের মুখাপেক্ষী না-ই হতো, তা হলে যখন ইসলাম ধর্মের প্রখ্যাত বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ইবনে আব্বাস (রা.)-এর গণ্ডদেশ বেয়ে মুক্তার মতো অশ্রুবিন্দু ঝরতে থাকত, তখন কেন তিনি বলতেন :

يوم الخميس و ما يوم الخميس ثمّ جعل تسيل دموعه حتّي رؤيت علي خدّيه كأنها نظام اللؤلؤ قال رسول الله : ايتونِى بالكتف و الدّواة أو اللوح و الدّواة اكتب لكم كتاباً لن تضلّوا بعده ابداً فقالوا...

“হায় বৃহস্পতিবার! হায় বৃহস্পতিবার! এরপর তাঁর অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল; আর তাঁর গণ্ডদেশদ্বয়ের উপর তা মুক্তার মতো দেখা যাচ্ছিল। তিনি বললেন : মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার কাছে তোমরা কাঁধের হাড় ও দোয়াত বা কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো। তা হলে আমি তোমাদের জন্য এমন একটি পত্র (নির্দেশনামা) লিখে দেব যে, এরপর তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। অতঃপর একদল লোক বলল : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)”৯ ...

এ ধরনের তীব্র শোক যা ইবনে আব্বাস প্রকাশ করেছেন, তা সত্বেও এবং মহানবী (সা.) নিজেই যে তাকীদ দিয়েছেন তার ভিত্তিতে কিভাবে এ কথা বলা সম্ভব যে, পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর এ পত্রের প্রতি মুসলিম উম্মাহকে অমুখাপেক্ষী করেছে?

এখন যখন মহানবী (সা.) এ ধরনের একটি নির্দেশনামা লিপিবদ্ধ করাতে পারলেন না, তখন অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দলিলের ভিত্তিতে কি ধারণা করা সম্ভব যে, এ নির্দেশনা লেখানোর পেছনে মহানবীর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

 

এ পত্রের বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য কী ছিল?

পবিত্র কুরআন তাফসীর করার ক্ষেত্রে নতুন অথচ দৃঢ় পদ্ধতি,- যা বর্তমানে সকল গবেষক ও আলেমের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে,- হচ্ছে কোন একটি বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতের দ্ব্যর্থবোধকতা ও সংক্ষিপ্ততা ঐ একই বিষয়ে অবতীর্ণ অপর কোন আয়াতের মাধ্যমে দূর করা হয়, যা অর্থ নির্দেশের ক্ষেত্রে প্রথমটির চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর পারিভাষিক অর্থে আমরা এভাবে পবিত্র কুরআনের আয়াতকে অপর এক আয়াতের সাহায্যে তাফসীর (ব্যাখ্যা) করি।

এ পদ্ধতি পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ ব্যাখ্যার সাথেই একান্তভাবে শুধু সংশ্লিষ্ট নয়, বরং হাদীসসমূহের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তাই এক হাদীসের সাহায্যে অনুরূপ আরেক হাদীসের সংক্ষিপ্ততা ও দ্ব্যর্থবোধকতা দূর করা যায়। কারণ আমাদের মহান ইমামগণ সংবেদনশীল ও দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপকারী ও পুনরাবৃত্তিমূলক অনেক বক্তব্য ও ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যার সবই অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশের ক্ষেত্রে একই ধাঁচের ও একই পর্যায়ের নয়; কখনো কখনো সেসব অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশ করার ক্ষেত্রে পরিষ্কার; আবার কখনো কখনো পরিবেশ-পরিস্থতির কারণে কাঙ্ক্ষিত অর্থ ও লক্ষ্য ইশারা-ইঙ্গিতে বর্ণনা করতে হয়েছে।

বলা হয়েছে, মহানবী (সা.) রোগশয্যায় শায়িতাবস্থায় একটি বিষয় লিখে দেয়ার জন্য সাহাবীগণকে কাগজ-কলম আনার নির্দেশ দেন এবং তিনি তাঁদের স্মরণ করিয়েও দেন, এ নির্দেশনামার কারণে তারা কখনো পথভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়বে না।১০ অতঃপর মহানবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তিনি ঐ চিঠি বা প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্র লেখানো থেকে বিরত থাকেন।

এ ক্ষেত্রে কেউ হয় তো প্রশ্ন করতে পারে, যে পত্র মহানবী (সা.) লেখাতে চেয়েছিলেন, তা কী প্রসঙ্গে ছিল। এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট। কারণ আলোচনার শুরুতে আমরা যে মূলনীতি উল্লেখ করেছি, তার আলোকে অবশ্যই বলা যায়, আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর ওয়াসায়াত এবং খিলাফত দৃঢ়ীকরণ এবং তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার অপরিহার্যতা তুলে ধরা ছাড়া মহানবীর আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। আর এ বিষয় হাদীসে সাকালাইন বিবেচনায় আনলে স্পষ্ট হয়ে যায়। উল্লেখ্য, হাদীসে সাকালাইনের ব্যাপারে শিয়া-সুন্নী সকল হাদীসবিশারদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। কারণ মহানবী (সা.) যে পত্র লিখাতে চেয়েছিলেন, সে ব্যাপারে বলেছেন : “যাতে তোমরা আমার পরে পথভ্রষ্ট না হও, সেজন্য আমি এ পত্রটি লিখাচ্ছি।” আর হাদীসে সাকালাইনেও তিনি হুবহু এ বাক্যই (অর্থাৎ আমার পরে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না) বলেছেন এবং কিতাব ও তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার কারণ তিনি এটাই বিবেচনা করেছেন যে, এ দুই মূল্যবান ও ভারী বিষয়ের অনুসরণই হচ্ছে পথভ্রষ্ট না হবার কারণ।

انّى تارك فيكم الثّقلين ما ان تمسّكتم بِهما لن تضلّوا : كتاب الله و عترتى اهل بيتِى

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু’টি অতি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত এ দু’টি তোমরা আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন পর্যন্ত তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। এ দুই অতি মূল্যবান জিনিস হচ্ছে : মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধর (ইতরাত)।”

এ দুই হাদীসের১১ শব্দমালা এবং এদের মধ্যে বিদ্যমান সাদৃশ্য বিবেচনায় আনলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা সম্ভব নয় কি যে, কাগজ ও কলম চাওয়ার পেছনে মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল হাদীসে সাকালাইনের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বা এর অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুর চেয়েও উন্নত কিছু লিপিবদ্ধ করা; আর তা ছিল মহানবীর প্রত্যক্ষ ওয়াসী ও উত্তরাধিকারীর বেলায়েত (নেতৃত্ব) এবং ওয়াসায়াত দৃঢ়ীকরণ যা ১৮ যিলহজ্ব ইরাক, মিশর ও হিজাযের হাজীগণের পৃথক হবার স্থান গাদীরে খুমের মহাসমাবেশে মৌখিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল?

এছাড়াও যে ব্যক্তি মহানবীর ওফাতের পরপর সাকীফায়ে বনী সায়েদায় খিলাফতের জন্য শূরা বা পরামর্শসভার আয়োজন করে নিজের পুরনো বন্ধুকে বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে খিলাফতের জন্য প্রার্থী করেছিলেন এবং তাঁর বন্ধু নিজের মৃত্যুকালে তাঁকে তাঁর সেবার নগদ পুরস্কারও দিয়েছিলেন এবং তাঁকে সকল মূলনীতির বিপরীতে খিলাফতের জন্য মনোনীত করেছিলেন, সেই ব্যক্তির দুর্দমনীয় বিরোধিতা এ বিষয়ের সাক্ষী যে, মহানবী (সা.)-এর কথাবার্তা এবং তাঁর কাছে সাহাবীগণের এ সমাবেশে এমন কিছু প্রমাণ বিদ্যমান ছিল, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, মহানবী (সা.) খিলাফত ও মুসলিম উম্মাহর সার্বিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্বভারের ব্যাপারে কিছু কথা লিখাতে চাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি (হযরত উমর) কাগজ-কলম আনার ব্যাপারে বিরোধিতা করেন। আর তা না হলে এতটা জবরদস্তির কোন কারণ থাকত না।

 

মহানবী (সা.) কেন এ পত্র লেখার ব্যাপারে আর তাকীদ দিলেন না?

মহানবী (সা.) যিনি তাদের বিরোধিতা সত্বেও নিজ সচিবকে ডেকে এ পত্র লেখাতে পারতেন, তিনি কেন (ঐ পত্র লেখানোর ক্ষেত্রে) শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলেন?

এ প্রশ্নের উত্তরও সুস্পষ্ট। কারণ মহানবী (সা.) যদি এ পত্র লেখার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করতেন, তা হলে যারা বলেছিলেন যে, ‘রোগযন্ত্রণা মহানবীর ওপর প্রবল হয়েছে’, তারাই মহানবীর সাথে আরো বেয়াদবীর চরম স্পর্ধা প্রদর্শন করত এবং তাদের সমর্থকরাও জনগণের মধ্যে তা রটনা করে তাদের দাবী প্রমাণ করার চেষ্টা করত। এ অবস্থায় মহানবীর শানে বেয়াদবীপূর্ণ আচরণের মাত্রা যেমন বৃদ্ধি পেত ও অব্যাহত থাকত, তেমনি মহানবীর পত্রের কার্যকারিতাও আর থাকত না। এ কারণেই কেউ কেউ যখন তাদের বেয়াদবী ও মন্দ আচরণ লাঘব করার জন্য মহানবীর কাছে বলেছিলেন : “আপনি কি ইচ্ছা করেন যে, আমরা কাগজ-কলম নিয়ে আসি?” তখন তাঁর চেহারা প্রচণ্ড উষ্মায় ফেটে পড়ছিল, তা রক্তিম হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি তাদের বলেছিলেন : “এতসব কথা-বার্তার পর তোমরা কাগজ-কলম আনতে চাচ্ছ? কেবল এতটুকু তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে, আমার বংশধরদের সাথে সদাচরণ করবে।” এ কথা বলে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং আলী, আব্বাস ও ফযল ব্যতীত তারা সবাই সেখান থেকে উঠে চলে যায়।১২

 

অন্তিম পত্র লিখতে না পারার ক্ষতিপূরণ প্রচেষ্টা

কতিপয় সাহাবীর প্রকাশ্য বিরোধিতা যদিও মহানবীকে পত্র লেখার অভিপ্রায় পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল, তবুও তিনি ভিন্ন এক পদ্ধতিতে তাঁর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিলেন এবং ইতিহাসের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) রোগযন্ত্রণায় প্রচণ্ড কষ্ট পাওয়া সত্বেও এক হাত আলীর কাঁধে এবং অন্য হাত মায়মুনার কাঁধের উপর রেখে মসজিদের দিকে গমন করেন এবং প্রাণশক্তি নিঃশেষকারী তীব্র কষ্ট সহ্য করেও তিনি মিম্বারে আরোহণ করেন। জনতার নয়ন অশ্রুজলে ভিজে গিয়েছিল এবং মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছিল। জনতা তখন মহানবীর সর্বশেষ বাণী ও উপদেশাবলী শোনার অপেক্ষা করছিল। মহানবী (সা.) সভাস্থলের নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন : “আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি।” ঐ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল : “ঐ দুই মূল্যবান জিনিস কী?” (উষ্মায়) মহানবীর মুখমণ্ডল প্রজ্বলিত হয়ে উঠল এবং তিনি বললেন : “আমি নিজেই এর ব্যাখ্যা দেব; তাই প্রশ্ন করার কোন কারণ নেই।” অতঃপর তিনি বললেন : “এক হচ্ছে পবিত্র কুরআন এবং অন্যটি আমার বংশধর।”১৩

ইবনে হাজর আসকালানী ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন এবং এ দু’টি বর্ণনাই১৪ সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই। তিনি লিখেছেন : “মহানবী (সা.) যখন অসুস্থ তখন কোন একদিন যখন সাহাবীগণ তাঁর বিছানার চারপাশ ঘিরে রেখেছিলেন, তখন তিনি তাঁদের দিকে মুখ করে বলেছিলেন : হে লোকসকল! আমার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে এবং খুব শীঘ্রই আমি তোমাদের মধ্য থেকে বিদায় নেব। তোমরা জেনে রাখ, আমি তোমাদের মধ্যে মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধরদের রেখে যাচ্ছি। এরপর তিনি হযরত আলীর হাত ধরে তা উঁচুতে তুলে বললেন :

هذا علىّ مع القرآن و القرآن مع علىّ لا يفترقان

-এই আলী পবিত্র কুরআনের সাথে এবং পবিত্র কুরআন আলীর সাথে আছে। এরা কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।”১৫

মহানবী (সা.) যদিও তাঁর অসুস্থ হওয়ার আগে একাধিক উপলক্ষে১৬ হাদীসে সাকালাইন বিভিন্ন আঙ্গিক ও ভাষাগত অবয়বে বর্ণনা করেছিলেন এবং এ দুই অতি মূল্যবান বিষয়ের প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তবু যেহেতু তিনি রোগশয্যায় শায়িত হয়ে আবারও পবিত্র কুরআন ও তাঁর বংশধরদের (ইতরাত) আঁকড়ে ধরে থাকার ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেছেন এবং যেসব ব্যক্তি তাঁর অন্তিম পত্র লেখার ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই উপস্থিতিতে তিনি পবিত্র কুরআন ও ইতরাতের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সেহেতু ধারণা করা যায়, হাদীসে সাকালাইনের পুনরাবৃত্তিই ছিল ঐ অন্তিম পত্রের শূন্যতা পূরণ করা, যা তিনি লিখতে পারেন নি।

 

তথ্যসূত্র :

১.   ايتونِى بدواة و صحيفة اكتب لكم كتابا لا تضلّون بعده

২. সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২ এবং ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪; সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪; মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৫ এবং আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৪

৩. ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০

৪. সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪ এবং মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫

৫. কানযুল উম্মাল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩৮ এবং আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৪

৬. মরহুম মুজাহিদ আল্লামা সাইয়্যেদ শারাফুদ্দীন তাঁর ‘আল মুরাজায়াত’ গ্রন্থে তাঁদের সকল অজুহাত উল্লেখ করে সেগুলো আকর্ষণীয়ভাবে খণ্ডন করেছেন।

৭. মুহাম্মদের জীবনী, পৃ. ৪৭৫

৮. মহানবী (সা.) প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি পবিত্র কুরআনের মুখাপেক্ষিতার সীমা বর্ণনা করা আমাদের এ আলোচনার গণ্ডির বাইরে। আমরা ‘পবিত্র কুরআনের জটিল আয়াতসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা’ এবং মানসূরে জভীদ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে এ সংক্রান্ত আলোচনা করেছি।

৯. মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫

১০.  اكتب لكم كتاباً لن تضلّوا بعده ابداً আমি তোমাদের একটি পত্র লিখে দেব যার পরে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আপনারা যদি লক্ষ্য করেন, তা হলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, মহানবী (সা.) لن تضلّوا (তোমরা আর কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না)-এ বাক্যের দ্বারা তাঁর পত্র লেখার কারণ ব্যক্ত করেছেন।

১১. হাদীসে সাকালাইন ও কাগজ-কলমের হাদীস

১২. বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৬৯ এবং শেখ মুফীদ প্রণীত কিতাব আল ইরশাদ এবং তাবারসী প্রণীত আলামুল ওয়ারা

১৩. বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৭৬

১৪. প্রথম বর্ণনা ও রেওয়ায়েত বিহারুল আনওয়ারের ২২তম খণ্ডের ৪৭৬ পৃ. থেকে উদ্ধৃত এবং দ্বিতীয় বর্ণনা ইবনে হাজর আসকালানী বর্ণিত।

১৫. আসসাওয়ায়েক আল মুহরিকাহ্, ৯ম অধ্যায়, পৃ. ৫৭ এবং কাশফুল গাম্মাহ্, পৃ. ৪৩

১৬. হাদীসে সাকালাইন শিয়া-সুন্নী হাদীসবিদগণ যে সব হাদীস ও রেওয়ায়েতের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, সেসবের অন্তর্ভুক্ত। এ হাদীস ৬০টিরও অধিক সূত্রে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে হাজার আসকালানী আস সাওয়ায়েক আল মুহরিকাহ্ গ্রন্থের ১৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : “মহানবী (সা.) বিভিন্ন উপলক্ষ, যেমন আরাফাতের দিবসে, গাদীরে খুমের দিবসে, তায়েফ নগরী থেকে প্রত্যাবর্তনের পর, এমনকি রোগশয্যায় শায়িত অবস্থায়ও পবিত্র কুরআন ও তাঁর ইতরাতের সাথে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।”

মরহুম মীর হামেদ হুসাইন হিন্দী তাঁর গ্রন্থের একটি অংশে হাদীসে সাকালাইনের সনদসমূহ এবং এর অর্থের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রেখেছেন এবং এসবের সমগ্র সম্প্রতি ৬ খণ্ডে ইসফাহান থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। মিশরের ‘দারুত তাকরীব’ সংস্থার (ইসলামী মাযহাবসমূহকে নিকটবর্তী করার সংস্থা) পক্ষ থেকে ১৩৭৪ হিজরীতে এ হাদীস সংক্রান্ত একটি সন্দর্ভ প্রকাশ করা হয়েছিল। এ সন্দর্ভে সনদের দৃষ্টিকোণ থেকে এ হাদীসের গুরুত্ব এবং সকল শতকে এ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের বিশেষ দৃষ্টি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

লা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিন
বেশুমার লানত বর্ষিত হোক

নিবেদক_____ রাকিব আলী ইমামি

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদপবিত্র কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর হাদিস থেকে আমিরুল মোমেনীন আলী ইবনে আবি তালিব আঃ এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিসমহানবী হযরত মুহাম্মদ ‎(সা.)-এর উত্তরাধিকারী,তাঁর নবুওয়াতের মিশনের প্রধান সাহায্যকারী এবং দুনিয়া ও আখেরাতে রাসূলের ভ্রাতা আলী ‎(আ.) ‏আবরাহার পবিত্র মক্কা আক্রমণের ৩৩ বছর পর ১৩ রজব পবিত্র কা’বা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। মহান আল্লাহর আদেশে তাঁর নাম রাখা হয় আলী।শিশুকাল থেকেই মহানবী ‎(সা.)-এর সাথে হযরত আলীর বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কে আলী ‎(আ.) ‏নিজেই বলেছেন ‎: ‘...তিনি আমাকে তাঁর কোলে রাখতেন যখন আমি শিশু ছিলাম। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং তাঁর বিছানায় শুইয়ে রাখতেন। তাঁর পবিত্র দেহ আমার দেহকে স্পর্শ করত এবং তিনি আমাকে তাঁর শরীরের সুগন্ধির ঘ্রাণ নেওয়াতেন। তিনি খাদ্য-দ্রব্য চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন।...’১হযরত আবু তালিবের সংসারের ব্যয়ভার কমানোর জন্য হযরত আলীর বালক বয়সেই মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখন থেকে তিনি রাসূলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে যান। রাসূল হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহর ইবাদাত করতে গেলেও তাঁকে সাথে নিয়ে যেতেন। হযরত আলী বলেন ‎: ‘তিনি ‎(মহানবী) ‏প্রতি বছর হেরাগুহায় একান্ত নির্জনে বাস করতেন। আমি তাঁকে দেখতাম। আমি ব্যতীত আর কোন লোকই তাঁকে দেখতে পেত না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ্ ও খাদীজাহ্ ব্যতীত কোন মুসলিম পরিবারই পৃথিবীর বুকে ছিল না। আমি ছিলাম তাঁদের পরিবারের তৃতীয় সদস্য। আমি ওহী ও রেসালতের আলো প্রত্যক্ষ করেছি এবং নবুওয়াতের সুবাস ও সুঘ্রাণ অনুভব করেছি।’২তিনি মহানবীর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করতেন। তিনি বলেন ‎: ‘উষ্ট্র শাবক যেমনভাবে উষ্ট্রীকে অনুসরণ করে ঠিক সেভাবে আমি তাঁকে অনুসরণ করতাম। তিনি প্রতিদিন তাঁর উন্নত চরিত্র থেকে একটি নিদর্শন আমাকে শিক্ষা দিতেন এবং আমাকে তা পালন করার নির্দেশ দিতেন।... ‏তাঁর ওপর যখন ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল তখন আমি শয়তানের ক্রন্দন ধ্বনি শুনেছিলাম। তাই আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‎: ‏হে রাসূলুল্লাহ্! ‏এ ক্রন্দন ধ্বনি কার? ‏তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন ‎: ‏এই শয়তান এখন থেকে তার পূজা ‎(ইবাদাত) ‏করা হবে না বলে হতাশ হয়ে গেছে। নিশ্চয় আমি যা শুনি তুমি তা শোন এবং আমি যা দেখি তা দেখ। তবে তুমি নবী নও,কিন্তু ‎[নবীর] ‏সহকারী এবং নিঃসন্দেহে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণের ওপরই আছ।’৩আর তাই মহানবী ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পর তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর ওপর ঈমান আনেন এবং তিনিই তাঁর সাথে নামায আদায় করা প্রথম ব্যক্তি। ইমাম মালেক বর্ণনা করেছেন ‎: ‘মহানবী ‎(সা.) ‏সোমবারে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন এবং আলী মঙ্গলবারে তাঁর ওপর ঈমান আনেন।’৪হযরত আলী নিজেই বলেন ‎: ‘আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূলের ভ্রাতা এবং তাঁর নবুওয়াতের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসস্থাপনকারী। একমাত্র মিথ্যাবাদী ছাড়া আমার পর কেউ এ দাবি করবে না। অন্য লোকদের নামায পড়ারও ৭ বছর আগে থেকে আমি নামায পড়েছি।’৫হযরত আলী ‎(আ.)-এর প্রসিদ্ধ উপাধিরাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে সিদ্দিকে আকবার,ফারুকে আযম,আসাদুল্লাহ ও মুরতাজা।পবিত্র কুরআনে হযরত আলী ‎(আ.)-এর মর্যাদাহযরত আলীর শানে পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত নাযিল হয়েছে। ইবনে আসাকির হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,কোন ব্যক্তির গুণ বর্ণনায় এত অধিক কুরআনের বাণী অবতীর্ণ হয়নি যা হযরত আলী সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস আরও বলেছেন যে,হযরত আলীর শানে তিনশ’ ‏আয়াত নাযিল হয়েছে এবং তাঁর গুণাবলি অত্যধিক ও প্রসিদ্ধ।৬ পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত আয়াতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াতوَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ‘এবং মানুষের মধ্যে এমনও আছে,যে আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিক্রয় করে দেয় এবং আল্লাহ ‎(এরূপ) ‏বান্দাদের প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল।’সালাবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏যখন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিলেন সেই সময় হযরত আলীকে তাঁর বিছানায় শুয়ে থাকার নির্দেশ দেন যাতে কাফির-মুশরিকরা মনে করে যে,রাসূল তাঁর নিজ ঘরেই রয়েছেন। আলী ‎(আ.) ‏নির্দ্বিধায় এ নির্দেশ পালন করলে মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন।৭ ২. ‏সূরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াতفَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ‘অতঃপর তোমার নিকট যখন জ্ঞান ‎(কুরআন) ‏এসে গেছে,এরপরও যদি কেউ ‎(খ্রিস্টান) ‏তোমার সাথে তার ‎(ঈসার) ‏সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করে,তবে বল,‘(ময়দানে) ‏এস,আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের ও তোমাদের পুত্রদের,আমাদের নারীদের ও তোমাদের নারীদের এবং আমাদের সত্তাদের ও তোমাদের সত্তাদের;’ ‏অতঃপর সকলে মিলে ‎(আল্লাহর দরবারে) ‏নিবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি।’ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের সত্যতা যাচাই করার জন্য নাজরানের একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল মদীনায় আসল। তাদের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ হলো না। রাসূল ‎(সা.) ‏হযরত ঈসা ‎(আ.) ‏সম্বন্ধে প্রতিনিধিদের বললেন যে,তিনি আল্লাহর পুত্র নন,বরং আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। রাসূলুল্লাহ্ হযরত ঈসার জন্মের ব্যাপারে হযরত আদমের উদাহরণও দিলেন। কিন্তু তারা কোন কথাই শুনল না। অবশেষে তিনি আল্লাহর আদেশে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোয়া ও মিথ্যাবাদীদের ওপর অভিশাপ বর্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন,যাকে ‎‘মুবাহিলা’ ‏বলে। স্থির করা হল যে,নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে উভয়ে নিজ নিজ পুত্রদের,নারীদের ‎(কন্যা সন্তানদের) ‏এবং তাদের নিজেদের ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে একত্র হবে এবং প্রত্যেকে অপরের প্রতি অভিসম্পাত ও আল্লাহর শাস্তি কামনা করবে। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হুসাইনকে কোলে নিয়ে ইমাম হাসানের হাত ধরলেন এবং হযরত ফাতিমাকে নিজের পেছনে,আর হযরত আলীকে তাঁর পেছনে রাখলেন। অর্থাৎ ছেলেদের স্থানে তিনি নাতিদের,নারীদের স্থানে নিজ কন্যাকে এবং ‎‘সত্তা’ ‏বলে গণ্যদের স্থানে আলীকে নিলেন এবং দোয়া করলেন,‘হে আল্লাহ! ‏প্রত্যেক নবীর আহলে বাইত থাকে,এরা আমার আহলে বাইত। এদের সকল দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত ও পাক-পবিত্র রেখ।’ ‏তিনি এভাবে ময়দানে পৌঁছলে খ্রিস্টানদের নেতা আকব তা দেখে বলল,‘আল্লাহর কসম,আমি এমন নূরানী চেহারা দেখছি যে,যদি এ পাহাড়কে নিজ স্থান হতে সরে যেতে বলেন,তবে অবশ্যই সরে যাবে। সুতরাং মুবাহিলা হতে হাত গুটিয়ে নেওয়াই কল্যাণকর,অন্যথায় কিয়ামত অবধি খ্রিস্টানদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।’ ‏পরিশেষে তারা জিযিরা কর দিতে সম্মত হল। এটা হযরত আলীর একটি উঁচু স্তরের ফযিলত যে,তিনি আল্লাহর আদেশে রাসূলের ‎‘নাফ্স’ (অনুরূপ সত্তা) ‏সাব্যস্ত হলেন এবং সমুদয় নবীর থেকে শ্রেষ্ঠ হলেন।৮৩. ‏সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াত ‎يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ‘হে বিশ্বাসিগণ! ‏তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল ও তোমাদের মধ্যে যারা নির্দেশের অধিকর্তা,তাদের আনুগত্য কর...।’ইমাম জাফর সাদিক ‎(আ.)- ‏কে জিজ্ঞেস করা হলো যে,উত্তরাধিকারীর আদেশ মান্য করা কি অবশ্যই কর্তব্য? ‏তিনি বললেন ‎: ‏হ্যাঁ,তাঁরা ঐসব ব্যক্তি যাঁদের আদেশ পালন করা এ আয়াতে ওয়াজিব করা হয়েছে...। এ আয়াত হযরত আলী বিন আবি তালিব,হযরত হাসান ও হযরত হুসাইন ‎(আ.)-এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে।৯ ৪. ‏সূরা মায়েদার ৫৫ নং আয়াতإِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ‘(হে বিশ্বাসিগণ!) ‏তোমাদের অভিভাবক তো কেবল আল্লাহ,তাঁর রাসূল এবং সেই বিশ্বাসীরা যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করে।’শীয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের তফসীরকাররা একমত যে,আয়াতটি হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে। যেমন ইবনে মারদুইয়া এবং খাতীব বাগদাদী ইবনে আব্বাস সূত্রে এবং তাবরানী ও ইবনে মারদুইয়া আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আলী ইবনে আবি তালিব সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি আলী ইবনে আবি তালিব ‎(আ.) ‏সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে যখন তিনি রুকু অবস্থায় যাকাত দেন।ঘটনাটি এরূপ ‎: ‏একদিন হযরত আলী ‎(আ.) ‏মদীনার মসজিদে নামায পড়ছিলেন। এমন সময় একজন ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইল। কিন্তু কোন ভিক্ষা না পাওয়ায় সে ফরিয়াদ করল যে,রাসূলের মসজিদ থেকে সে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে। এ সময় হযরত আলী রুকু অবস্থায় ছিলেন। তিনি সেই অবস্থায় তাঁর ডান হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নেওয়ার জন্য ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করেন। ভিক্ষুক তাঁর হাত থেকে আংটি খুলে নেয়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে উপরিউক্ত আয়াত নাযিল হয়।১০৫. ‏সূরা মায়েদার ৬৭ নং আয়াতيَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ‘হে রাসূল! ‏যা ‎(যে আদেশ) ‏তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দাও,আর যদি তুমি তা না কর,তবে তুমি ‎(যেন) ‏তার কোন বার্তাই পৌঁছাওনি,এবং ‎(তুমি ভয় কর না) ‏আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন;এবং নিশ্চয় আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সঠিক পথে পরিচালিত করেন না।’যখন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏দশম হিজরিতে বিদায় হজ্ব থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন সে সময় আল্লাহ্ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। ইবনে আবী হাতিম ও ইবনে আসাকির আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণনা করেছেন যে,এ আয়াত গাদীরে খুম প্রান্তরে হযরত আলী ‎(আ.)-এর শানে নাযিল হয়েছে।বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করার সময় গাদীরে খুম নামক স্থানে মহানবী ‎(সা.) ‏হযরত আলীকে তাঁর পরে সকল মুমিনের অভিভাবক বলে ঘোষণা দেন।১১এ ঘোষণা দেয়ার পর হযরত ওমর হযরত আলীর সাথে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানান এবং বলেন ‎: ‘হে আলী ইবনে আবি তালিব! ‏আপনি আজ হতে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর মাওলা হয়ে গেলেন।’১২৬. ‏সূরা রাদের ৭ নং আয়াতإِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ‘(হে রাসূল!) ‏তুমি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে এক পথ প্রদর্শক।’ইবনে মারদুইয়্যা,ইবনে জারীর,আবু নাঈম তাঁর ‎‘মারেফাত’ ‏গ্রন্থে,ইবনে আসাকির,দাইলামী ও ইবনে নাজ্জার তাঁদের স্ব স্ব গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,আয়াতটি নাযিল হলে মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁর হাত নিজের বুকে রেখে বললেন,‘আমিই সতর্ককারী।’ ‏অতঃপর আলীর কাঁধের প্রতি তাঁর হাত দ্বারা ইশারা করে বললেন,‘হে আলী! ‏তুমিই পথপ্রদর্শক এবং মানুষ আমার পর তোমার মাধ্যমে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।’ ‏উক্ত রেওয়ায়েতটি শব্দের তারতম্যে ইবনে মারদুইয়্যা সাহাবী আবু বারযাহ আসলামী হতে,জীয়াফীল হযরত ইবনে আব্বাস হতে,ইবনে আহমাদ তাঁর মুসনাদে এবং ইবনে মারদুইয়্যা ও ইবনে আসাকির স্বয়ং হযরত আলী ‎(আ.) ‏হতে বর্ণনা করেছেন।১৩৭. ‏সূরা রাদের ৪৩ নং আয়াতوَيَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَسْتَ مُرْسَلًا قُلْ كَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَمَنْ عِنْدَهُ عِلْمُ الْكِتَابِযারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে,‘তুমি আল্লাহর রাসূল নও।’ ‏তুমি বল,‘আমার ও তোমাদের মধ্যে ‎(রেসালাতের) ‏সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সেই ব্যক্তি যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান রয়েছে।’অধিকাংশ তাফসীরকার স্বীকার করেছেন যে,আয়াতে বর্ণিত সেই ব্যক্তি হলেন হযরত আলী ‎(আ.)। যেমন আসমী ‎‘যায়নুল ফাতা’ ‏নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং সা’লাবী আবদুল্লাহ ইবনে আতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,আবদুল্লাহ বিন সালাম বলতেন,‘যার কাছে গ্রন্থের পূর্ণ জ্ঞান আছে’-এর উদ্দিষ্ট হযরত আলী ‎(আ.)। এজন্যই হযরত আলী ‎(আ.) ‏বারবার বলতেন,‘আমার কাছে আমার মৃত্যুর পূর্বে যা চাও জিজ্ঞেস কর।’১৪৮. ‏সূরা নাহলের ৪৩ নং আয়াতوَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَতোমার পূর্বেও আমরা কেবল পুরুষদেরই ‎(রাসূল করে) ‏প্রেরণ করেছি যাদের প্রতি আমরা প্রত্যাদেশ প্রেরণ করতাম;যদি তোমরা না জেনে থাক তবে যারা জানে তাদের জিজ্ঞেস কর।আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন ‎: ‏জ্ঞানী ব্যক্তিরা অর্থাৎ আহলুয যিকর হলেন হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.),হযরত আলী ‎(আ.),হযরত ফাতেমা ‎(আ.),হযরত হাসান ও হুসাইন ‎(আ.)। যাবের ইবনে আবদুল্লাহ বলেছেন ‎: ‏যখন এই আয়াত নাযিল হল তখন হযরত আলী বললেন ‎: ‏আমরাই হলাম জ্ঞানের ভাণ্ডার।১৫৯. ‏সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতوَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا‘হে নবী পরিবার! ‏আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামার ঘরে এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏হযরত ফাতিমা,ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন ‎(আ.)-কে ডাকেন এবং তাঁদেরকে একটি চাদরে ঢেকে নেন। হযরত আলী তাঁর পেছনে ছিলেন। তিনি তাঁকেও চাদরে ঢেকে নেন। অতঃপর বলেন ‎: ‘হে আল্লাহ্! ‏এরা আমার আহলে বাইত। অতএব,তুমি তাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করে দাও এবং তাদেরকে উত্তমরূপে পবিত্র কর।’ ‏তখন উম্মে সালামা বলেন ‎: ‘হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমিও কি তাদের অন্তর্ভুক্ত?’ ‏তিনি বলেন ‎: ‘তুমি স্ব স্থানে আছ এবং তুমি কল্যাণের মধ্যেই আছ।’১৬হযরত উম্মে সালামা ছাড়াও হযরত আবু সাঈদ খুদরী ও আনাস ইবনে মালিক কর্তৃক এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।১৭১০. ‏সূরা শূরার ২৩ নং আয়াতقُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى‘বল,আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা ছাড়া আর কোন প্রতিদান চাই না।’রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নিকটাত্মীয় আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি ভালবাসা পোষণকে এ আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য ফরয বলে ঘোষণা করেন।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন ‎: ‏যখন এ আয়াত নাযিল হল তখন সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন,হে রাসূলুল্লাহ! ‏আপনার নিকটাত্মীয়,যাদেরকে ভালবাসা আমাদের ওপর ওয়াজিব করা হয়েছে তারা কারা? ‏রাসূল ‎(সা.) ‏বললেন ‎: ‏আলী,ফাতেমা,হাসান ও হুসাইন।১৮রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর হাদীসে আলী ‎(আ.)হযরত আলীর মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী ‎(সা.)-এর নিকট থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হল ‎:১. ‏সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বলেন,নবী ‎(সা.) ‏তাবুক যুদ্ধের সময় আলীকে লক্ষ্য করে বলেছেন ‎: ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে,মর্যাদার দিক থেকে মূসার নিকট হারুন যে পর্যায়ে ছিলেন,তুমিও আমার নিকট ঐ পর্যায়ে রয়েছ?’১৯২. ‏অন্য একটি হাদীসে এসেছে ‎: ‏রাসূল বলেন ‎: ‘তুমি তো আমার নিকট তদ্রূপ যেরূপ হারুনের স্থান মূসার নিকট। পার্থক্য এতটুকু যে,আমার পরে কোন নবী নেই।’২০৩. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ইমাম হাসান ও হুসাইনের হাত ধরে বলেন ‎: ‘যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসে এবং এ দু’জন ও তাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসে,সে কিয়ামতের দিন আমার সাথে একই মর্যাদায় অবস্থান করবে।’২১৪. ‏আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত। রাসূল বলেছেন ‎: ‘আলীর চেহারার দিকে তাকানোও ইবাদত।’২২৫. ‏রাসূলুল্লাহ্ ‎(সা.) ‏আলী ‎(আ.)-কে সম্বোধন করে বলেছিলেন ‎: ‘মুমিনরাই তোমাকে মহব্বত করবে এবং মুনাফিকরাই তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে।’২৩৬. ‏তিরমিযী,নাসাঈ ও ইবনে মাযাহ হুবশী ইবনে জুনাদাহ্ ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূল ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘আলী আমা থেকে এবং আমি আলী থেকে। যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আমাকে ভালোবেসেছে। আর যে ব্যক্তি আলীকে ভালবেসেছে,সে আল্লাহকে ভালবেসেছে। যে ব্যক্তি আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে সে আমার সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে। আর যে আমার শত্রু সে আল্লাহর শত্রু। যে ব্যক্তি আলীকে কষ্ট দিয়েছে,সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে।’২৪৭. ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‘(হে আলী!) ‏দুনিয়া ও আখেরাতে তুমি আমারই ভাই।’২৫৮. ‏আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা ‎(র.) ‏থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎: ‘চার ব্যক্তিকে ভালবাসতে আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন এবং তিনি আমাকে এও অবহিত করেছেন যে,তিনিও তাদের ভালবাসেন। বলা হল ‎: ‏হে আল্লাহর রাসূল! ‏আমাদের তাদের নামগুলো বলুন। তিনি বলেন ‎: ‏আলীও তাদের অন্তর্ভুক্ত। এ কথা তিনি তিনবার বলেন। ‎(অবশিষ্ট তিনজন হলেন) ‏আবু যার,মিকদাদ ও সালমান।...’২৬৯. ‏জাবির ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ‎: ‏তায়েফ অভিযানের দিন রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏আলীকে কাছে ডেকে তার সাথে চুপিসারে আলাপ করেন। লোকেরা বলল ‎: ‏তিনি তাঁর চাচাত ভাইয়ের সাথে দীর্ঘক্ষণ চুপিসারে কথা বললেন। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেন ‎: ‏আমি তার সাথে চুপিসারে কথা বলিনি;বরং আল্লাহই তার সাথে চুপিসারে কথা বলেছেন। ‎(অর্থাৎ তার সাথে চুপিসারে কথা বলার জন্য আল্লাহ্ই আমাকে আদেশ করেছেন।)২৭হযরত আলী সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীহযরত আবু বকর প্রায়ই হয়রত আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। হযরত আয়েশা এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন ‎: ‘আমি রাসূলে করীমকে বলতে শুনেছি,আলীর মুখ দেখা ইবাদাতের শামিল।’২৮হযরত উমর বিন খাত্তাব বলতেন,হযরত আলী বিন আবি তালিবের তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল। যদি তার একটি আমার থাকত তাহলে আমি বলতাম যে,আমাকে লাল রঙের একটি উট দেয়া হলে তা অপেক্ষাও আমি তা পছন্দ করতাম। তাঁকে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ‎: ‏১.তাঁর বিয়ে হয় রাসূল ‎(সা.)-এর কন্যার সাথে,২. ‏তাঁর সঙ্গে রাসূলে করীমের মসজিদে অবস্থান এবং যা রাসূলে করিমের জন্য বৈধ ছিল তার জন্যও তা বৈধ ছিল এবং ৩. ‏খায়বার যুদ্ধের পতাকা বহনের দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল।২৯হযরত উমর বলেছেন,হে আল্লাহ! ‏আমার ওপর এমন কোন বিপদ দিও না যখন আবুল হাসান ‎(আলী) ‏আমার নিকট উপস্থিত না থাকে। কারণ,তিনি আমার নিকট উপস্থিত থাকলে আমাকে সে বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দেবেন।’৩০তাবরানী হযরত ইবনে আব্বাস থেকে রেওয়ায়াত করেছেন যে,হযরত আলীর আঠারটি বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যা সমগ্র উম্মতের কারও ছিল না।’৩১তথ্যসূত্র১. ‏মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত নাহজ আল বালাঘা,২য় মুদ্রণ,আল খুতবাতুল কাসেয়াহ্,খুতবা নং ১৯১২. ‏প্রাগুক্ত৩. ‏প্রাগুক্ত৪. ‏মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১১২;এটি ইমাম মালেক কর্তৃক বর্ণিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হেরা গুহায় জিবরাঈল ‎(আ.) ‏কর্তৃক রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর নবুওয়াত ঘোষণার পর পরই হযরত আলী ‎(আ.) ‏তাঁর ঈমান আনার বিষয়টি প্রকাশ করেন।৫. ‏সুনানে ইবনে মাজাহ্,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৪৪৬. ‏নূর-এ-সাকালাইন কর্তৃক প্রকাশিত,সাইয়্যেদ আলী জাফরী প্রণীত আল মুরতাজা,পৃ. ‏৩০।৭. ‏এহইয়াউ উলুমিদ্দীন,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২৩৮;নুরুল আবসার,পৃ. ‏৮৬,মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৭১;তাযকিরাতু সিবতে ইবনে যাওযী,পৃ. ‏২১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏৯২।৮. ‏তাফসীরে জালালাইন,১ম খণ্ড,পৃ.৬০;বায়দ্বাভী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১১৮,তাফসীরে দুররুল মানসুর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৯,মিশর মুদ্রণ;মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৫;৯. ‏মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;তাফসীরে কুমী,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪১;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ‏২১;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪৮;তাফসীরে ফুরাত,পৃ.২৮১০. ‏তাফসীরে তাবারী,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৬৫;তাফসীরে রাযী,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏৪৩১;মানাকেবে খাওয়ারেযমী,পৃ. ‏১৭৮;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏১০২;তাফসীরে ইবনে কাসীর,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৭১;আল- ‏বেদায়া ওয়ান নেহায়া,৭ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৫৭;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏২৫;১১. ‏মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৩৭২;ইমাম নাসাঈ প্রণীত খাসায়েসে আমীরুল মুমিনীন,পৃ. ‏২১;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১০৯;আল গাদীর,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২১৪ ও ২২৯;শাওয়াহেদুত তানযিল,১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৮৭ ।১২. ‏তাফসীরে তাবারী,৩য় খণ্ড,মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল,৩য় খণ্ড,দারে কুতনী।১৩. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৪৫ দ্রষ্টব্য।১৪. ‏তাফসীরে দুররে মানসুর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ‏৬৯ ।১৫. ‏কেফাইয়াতুল মুওয়াহহিদীন,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৬৫০;মাজমাউল বায়ান,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৪১৩;কানযুল উম্মাল,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏১৫৬;তাফসীরে তাবারী,১৪তম খণ্ড,পৃ. ‏১০৮ ।১৬. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৭২৫,পৃ. ‏৩৫৯ ।১৭. ‏মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏৩৩১;যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏২১,তাফসীরে তাবারী,২২তম খণ্ড,পৃ. ‏৮;মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏২০৮;ফাজায়েলে খামসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৪;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏১০ ।১৮. ‏যাখায়েরুল উকবা,পৃ. ‏৯ ও ১২;তাফসীরে যামাখশারী,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩৩৯;সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১০১,তাফসীরে দুররুল মানসূর,৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ‏৭;মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ‏২২৯;আল গাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ‏১৭২;শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খণ্ড,পৃ. ‏৩০ ।১৯. ‏আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী,৩য় খণ্ড,হাদীস নং ৩৪৩১;বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪২ ।২০. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম,৭ম খণ্ড,হাদীস নং ৬০৪০ ও জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৬৮ ।২১. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭০২২. ‏এমদাদীয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ইবনে আবি তালিব ‎(রা.),পৃ. ‏১৫ ।২৩. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৭৩ ।২৪. ‏এমদাদিয়া লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হযরত আলী ‎(রা.),পৃ. ‏১৫-১৬ ।২৫. ‏বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত জামে আত-তিরমিযী,৬ষ্ঠ খণ্ড,হাদীস নং ৩৬৫৮;২৬. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৫৬;২৭. ‏প্রাগুক্ত,হাদীস নং ৩৬৬৪২৮. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,পৃ. ‏১৭৫ ।২৯. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ,৩য় খণ্ড,এবং মুসতাদরাকে হাকেম,৩য় খণ্ড ।৩০. ‏মুনতাখাবে কানজুল উম্মাল,৩য় খণ্ড ।৩১. ‏সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ ১১৩ ।(প্রত্যাশা,৩য় বর্ষ, ‏১ম সংখ্যাপ্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

শিশু ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ.)'র জন্মবার্ষিকীসকল মোমিন মোমিনা কে জানাই ঈদ মোবারক🎂🎂🎂🎂🎂(((পর্ব ১)))🎂🎂🎂🎂🎂দশই রজব ইসলামের মহাখুশির দিন। এই দিনে পৃথিবীতে এসেছিলেন মাওলা মোহাম্মদ (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য নবম ইমাম হযরত জাওয়াদ বা তাকি(আ)। নবীজীর আহলে বাইতের সদস্যরা কেবল মুসলমানদেরই ধর্মীয় নেতা নন বরং যারাই সত্য পথের সন্ধানী কিংবা কল্যাণকামী-তাদের সবারই নেতা।আহলে বাইতের এই মহান ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ) এর জন্ম-বার্ষিকীতে আপনাদের সবার প্রতি রইলো অশেষ অভিনন্দন ও প্রাণঢালা মোবারকবাদ এবং মাওলা মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম ।ইমাম জাওয়াদের জন্ম হয়েছিল ১৯৫ হিজরিতে তথা ৮১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল পবিত্র মদীনায়। মজলুম ও দরিদ্রদের প্রতি ব্যাপক দানশীলতা ও দয়ার জন্য তিনি 'জাওয়াদ' উপাধি পেয়েছিলেন। তাকি বা খোদাভীরু ছিল তাঁর আরেকটি উপাধি। জগত-বিখ্যাত মহাপুরুষ ইমাম রেজা (আ) ছিলেন তাঁর বাবা। আর তাঁর মায়ের নাম ‘সাবিকাহ’ বলে জানা যায়। ইমাম রেজা (আ) তাঁর এই স্ত্রীর নাম রেখেছিলেন খিইজরান। তিনি ছিলেন মহানবীর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনিন হযরত মারিয়া কিবতির (আ) বংশধর। ইমাম জাওয়াদ (আ) ১৭ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালনের পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন। তিনিই হলেন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়স্ক ইমাম। আহলে বাইতের অন্য ইমামগণের মত ইমাম জাওয়াদ (আ.)ও ছিলেন উচ্চতর নৈতিক গুণ, জ্ঞান ও পরিপূর্ণতার অধিকারী। ইসলামের মূল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন এবং বিকাশ ছিল তাঁর তৎপরতার মূল লক্ষ্য বা কেন্দ্রবিন্দু। সেযুগের সব মাজহাবের জ্ঞানী-গুণীরা ইমাম জাওয়াদ (আ.)'র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।সমসাময়িক যুগের প্রখ্যাত সুন্নি চিন্তাবিদ কামালউদ্দিন শাফেয়ি ইমাম জাওয়াদ (আ.) সম্পর্কে বলেছেন, "মুহাম্মাদ বিন আলী তথা ইমাম জাওয়াদ (আ.) ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মর্যাদা ও গুণের অধিকারী। মানুষের মুখে মুখে ফিরতো তাঁর প্রশংসা। তাঁর উদারতা, প্রশস্ত দৃষ্টি ও সুমিষ্ট কথা সবাইকে আকৃষ্ট করত। যে-ই তাঁর কাছে আসতো নিজের অজান্তেই এই মহামানবের অনুরাগী হয়ে পড়ত এবং তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করত।" ইমাম জাওয়াদ (আ) মাত্র সাত বা আট বছর বয়সে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতো অল্প বয়সে তাঁর ইমামতিত্বের বিষয়টি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়কর। ফলে অনেকেই এ বিষয়ে সন্দেহ করতেন। অথচ আল্লাহর তো এই শক্তি আছে যে তিনি মানুষকে তার বয়সের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন। কোরানের আয়াতের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যেও এরকম উদাহরণ বহু আছে। যেমন শিশুকালে হযরত ইয়াহিয়া (আ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তি, মায়ের কোলে নবজাতক ঈসা (আ) এর কথা বলা ইত্যাদি সর্বশক্তিমান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতারই নিদর্শন। ইমাম জাওয়াদ (আ) শৈশব-কৈশোরেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, ধৈর্য ও সহনশীলতায়, ইবাদত-বন্দেগিতে, সচেতনতায়, কথাবার্তায় শীর্ষস্থানীয় মহামানব। একবার হজ্জ্বের সময় বাগদাদ এবং অন্যান্য শহরের বিখ্যাত ফকীহদের মধ্য থেকে আশি জন মদীনায় ইমাম জাওয়াদ (আ) এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা ইমামকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞেস করে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সন্তোষজনক জবাব পেলেন। ফলে জাওয়াদ (আ)’র ইমামতিত্বের ব্যাপারে তাদের মনে যেসব সন্দেহ ছিল-তা দূর হয়ে যায়।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম‌লা'নাতুল্লাহি আলাল কাজেবিন🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂🎂