কাগজ ও কলম নিয়ে এসো” : মহানবী (সা.)খেলাফত কুক্ষিগত করার জন্য তাঁর ঘরের বাইরে যে সব তৎপরতা চলছিল, সে ব্যাপারে মহানবী (সা.) সম্পূর্ণ ওয়াকিব ছিলেন। এ কারণে তিনি মতবিরোধের উদ্ভব ঠেকানো এবং তাঁর মূল ধারা থেকে বিচ্যুতি ঘটার আগেই তা রোধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এবং তাঁর আহলে বাইতের খিলাফতের ভিত্তি লিখিত আকারে মজবুত করবেন এবং খিলাফত প্রসঙ্গে একখানা জীবন্ত দলিল রেখে যাবেন।এ কারণেই যেদিন নেতৃত্বাস্থানীয় সাহাবীগণ তাঁকে দেখার জন্য আসেন, সেদিন তিনি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। অতঃপর তিনি তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন : “আমার জন্য কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো, যাতে আমি তোমাদের জন্য কিছু বিষয় লিখে দিতে পারি যেটা দিয়ে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।”১ইবনে আব্বাস এ ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন : “এটাই ছিল ইসলামের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ যে একদল সাহাবীর মত-পার্থক্য ও ঝগড়া-বিবাদ মহানবী (সা.)-এর কাঙ্ক্ষিত পত্র লেখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।”২বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, এর অর্থ ছিল তিনি পত্রের বিষয়বস্তু মুখে বলবেন এবং তাঁর একজন লেখক তা লিপিবদ্ধ করবেন। আর তা না হলে মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কখনো কলম হাতে নেন নি এবং এক লাইনও লিখেন নি। অধিক স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমার প্রণীত ‘দার মাকতাবে ওয়াহী’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করুন।এ ঐতিহাসিক ঘটনা একদল সুন্নী ও শিয়া হাদীসবিদ ও ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসবিদ্যার নীতিমালার দৃষ্টিকোণ থেকে তা নির্ভরযোগ্য ও সহীহ বর্ণনাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। একটি বিষয় আছে। আর তা হলো, আহলে সুন্নাতের মুহাদ্দিসগণ প্রধানত হযরত উমরের উক্তি অর্থগতভাবে উদ্ধৃত করেছেন অর্থাৎ তাঁরা তাঁর ধৃষ্টতামূলক উক্তির মূল পাঠ ব্যক্ত করেন নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, হযরত উমরের উক্তি উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকা এজন্য নয় যে, ধৃষ্টতার কথা উল্লেখ করা আসলে মহানবী (সা.)-এর প্রতি এক ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন; বরং দ্বিতীয় খলীফার মর্যাদা রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তাঁর উক্তিতে হাত দেয়া হয়েছে এবং পরিবর্তন করা হয়েছে, পাছে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁর অবমাননাকর উক্তি শুনে তাঁর ব্যাপারে হতাশ না হয় (এবং কুধারণা পোষণ না করে)।এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ‘আস সাকীফাহ্’ গ্রন্থের রচয়িতা আবু বকর জওহারী যখন তাঁর গ্রন্থে এ অধ্যায়ে উপনীত হন, তখন তিনি হযরত উমরের উক্তিটি এভাবে বর্ণনা করেন :و قال عمر كلمة معناها أنّ الوجع قد غلب علي رسول الله“এবং হযরত উমর একটি কথা বলেন, যার অর্থ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর ওপর রোগ-যন্ত্রণা প্রবল হয়েছে।”৩তবে আহলে সুন্নাতের হাদীসবেত্তাদের মধ্য থেকে যখন কেউ কেউ দ্বিতীয় খলীফার উক্তির মূল পাঠ হুবহু উদ্ধৃত করতে চান, তখন তাঁরা তাঁর সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ থেকে বিরত থাকেন এবং এতটুকু লিখেন : فقالوا هجر رسول الله “অতঃপর তারা বলল : রাসূলুল্লাহ্ রোগের কারণে প্রলাপ বকেছেন।”৪নিশ্চিতভাবে এ ধরনের অশালীন ও জঘন্য উক্তি যে কোন ব্যক্তিরই হয়ে থাকুক না কেন, তা কখনো ক্ষমার যোগ্য নয়। কারণ পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য অনুসারে মহানবী (সা.) সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত এবং তিনি ওহী ছাড়া কোন কথা বলেন না।নিষ্পাপ নবীর সান্নিধ্যে সাহাবীদের বিবাদ এতটা বিরক্তিকর ও মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কয়েকজন স্ত্রী পর্দার অন্তরাল থেকে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন : “কেন আপনারা মহানবীর নির্দেশ অমান্য করছেন?” দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর তাঁদেরকে চুপ করানোর জন্য বলেছিলেন : “আপনারা হযরত ইউসুফের সঙ্গীদের স্ত্রীদের সদৃশ। যখন মহানবী অসুস্থ হন, তখন আপনারা তাঁর জন্য নিজেদের নয়নগুলোয় চাপ দেন (অশ্রুপাত করেন) এবং যখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন, তখন আপনারা তাঁর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।”৫কতিপয় গোঁড়া ব্যক্তি বাহ্যত দ্বিতীয় খলীফার বিরুদ্ধাচরণের পক্ষে কিছু অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন।৬ তবে যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে আসলে তাঁরা তাঁকে এ কাজের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলেছেন এবং حسبنا كتاب الله (মহান আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ পবিত্র কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট)- তাঁর এ উক্তিকে তাঁরা অসার গণ্য করেছেন এবং সবাই স্বীকার করেছেন, ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর সুন্নাত এবং পবিত্র কুরআন কখনোই উম্মতকে মহানবীর হাদীস ও বাণীসমূহের ব্যাপারে অমুখাপেক্ষী করে নি।তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ‘মুহাম্মদের জীবনী’ গ্রন্থের রচয়িতা ড. হাসানাইন হাইকাল ইশারা-ইঙ্গিতে দ্বিতীয় খলীফার এ কাজ সমর্থন করে লিখেছেন : “এ ঘটনার পর ইবনে আব্বাস বিশ্বাস করতেন, মহানবী (সা.) যে বিষয়টি লিখে দিতে চাচ্ছিলেন, তা লেখার ক্ষেত্রে বাধা দান করে মুসলমানরা আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে হারিয়েছে। কিন্তু হযরত উমর তাঁর বিশ্বাসের ওপর বহাল থেকেছেন। কারণ মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন :)ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء(“আমরা পবিত্র কুরআনে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ সবকিছু এ গ্রন্থে বর্ণনা করেছি)।”৭তিনি যদি এ আয়াতের আগের ও পরের অংশের দিকে দৃষ্টি দিতেন, তা হলে তিনি কখনোই এ আয়াতের এ রকম অপব্যাখ্যা করতেন না এবং নিষ্পাপ মহানবীর বিপরীতে হযরত উমরের এ কাজ সমর্থন করতেন না। কারণ আয়াতে উল্লিখিত কিতাব বা গ্রন্থের অর্থ বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ এবং অস্তিত্বের পত্রসমূহকে বোঝানো হয়েছে। আর এ অস্তিত্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টি আসলে সৃষ্টিগ্রন্থের এক একটি পৃষ্ঠা এবং সমগ্র সৃষ্টি এ সৃষ্টিগ্রন্থের সমুদয় পৃষ্ঠাতুল্য।)و ما من دابّة فِى الأرض و لا طائر يطير بجناحيه الّا أمم أمثالكم ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء ثمّ الى ربّهم يُحشرون(“পৃথিবীতে (বিচরণকারী) প্রতিটি জীব-জন্তু এবং (আকাশে) স্বীয় ডানা মেলে উড্ডয়নকারী প্রতিটি বিহঙ্গ তোমাদের মতোই এক একটা প্রজাতি (أمم), আমরা (সৃষ্টি) গ্রন্থে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ আমরা এ সৃষ্টিলোকে যা যা সৃষ্টি করা সম্ভব, সেগুলো সবই সৃষ্টি করেছি) এবং সব কিছুই তাদের প্রভুর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে।” (সূরা আনআম : ৩৮)যেহেতু ‘আমরা এ গ্রন্থের মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি’- এ বাক্যের আগের বাক্য ‘জীবকূল ও পক্ষীকূল’ সৃষ্টি করার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এর পরের বাক্য কিয়ামত দিবসে পুনরুজ্জীবিত করণ প্রক্রিয়া বা হাশরের সাথে সম্পর্কিত, সেহেতু নিশ্চিত করে বলা যায়, আয়াতে উল্লিখিত ‘গ্রন্থ’ যার মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করা হয় নি, তা বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ (সৃষ্টিগ্রন্থ) এবং অস্তিত্বের পত্রকেই বোঝানো হয়েছে।অধিকন্তু আমরা যদি মেনেও নিই যে, আয়াতের ‘গ্রন্থ’ শব্দ আসলে পবিত্র কুরআন, তা হলে পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট উক্তি অনুসারে এ গ্রন্থ বোঝার জন্য মহানবী (সা.)-এর ব্যাখ্যা ও দিক-নির্দেশনা আবশ্যক।)و أنزلنا إليك الذّكر لتبيّن للنّاس ما نزل إليهم(“আর আমরা আপনার কাছে এ ‘স্মরণ’ অর্থাৎ পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে আপনি জনগণের কাছে তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করেন।” (সূরা নাহল : ৪৪)এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, মহান আল্লাহ্ এ আয়াতে لتقرأ অর্থাৎ ‘যাতে আপনি পাঠ করেন’ বলেন নি, বরং তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন لتبيّن অর্থাৎ ‘যাতে আপনি ব্যাখ্যা করেন’। সুতরাং মহান আল্লাহর গ্রন্থই যদি মুসলিম উম্মাহর জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে, তবুও মহানবী (সা.) প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি এ গ্রন্থের তীব্র প্রয়োজন রয়েছে।৮উম্মত যদি এ ধরনের দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্রের মুখাপেক্ষী না-ই হতো, তা হলে যখন ইসলাম ধর্মের প্রখ্যাত বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ইবনে আব্বাস (রা.)-এর গণ্ডদেশ বেয়ে মুক্তার মতো অশ্রুবিন্দু ঝরতে থাকত, তখন কেন তিনি বলতেন :يوم الخميس و ما يوم الخميس ثمّ جعل تسيل دموعه حتّي رؤيت علي خدّيه كأنها نظام اللؤلؤ قال رسول الله : ايتونِى بالكتف و الدّواة أو اللوح و الدّواة اكتب لكم كتاباً لن تضلّوا بعده ابداً فقالوا...“হায় বৃহস্পতিবার! হায় বৃহস্পতিবার! এরপর তাঁর অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল; আর তাঁর গণ্ডদেশদ্বয়ের উপর তা মুক্তার মতো দেখা যাচ্ছিল। তিনি বললেন : মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার কাছে তোমরা কাঁধের হাড় ও দোয়াত বা কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো। তা হলে আমি তোমাদের জন্য এমন একটি পত্র (নির্দেশনামা) লিখে দেব যে, এরপর তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। অতঃপর একদল লোক বলল : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)”৯ ...এ ধরনের তীব্র শোক যা ইবনে আব্বাস প্রকাশ করেছেন, তা সত্বেও এবং মহানবী (সা.) নিজেই যে তাকীদ দিয়েছেন তার ভিত্তিতে কিভাবে এ কথা বলা সম্ভব যে, পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর এ পত্রের প্রতি মুসলিম উম্মাহকে অমুখাপেক্ষী করেছে?এখন যখন মহানবী (সা.) এ ধরনের একটি নির্দেশনামা লিপিবদ্ধ করাতে পারলেন না, তখন অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দলিলের ভিত্তিতে কি ধারণা করা সম্ভব যে, এ নির্দেশনা লেখানোর পেছনে মহানবীর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? এ পত্রের বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য কী ছিল?পবিত্র কুরআন তাফসীর করার ক্ষেত্রে নতুন অথচ দৃঢ় পদ্ধতি,- যা বর্তমানে সকল গবেষক ও আলেমের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে,- হচ্ছে কোন একটি বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতের দ্ব্যর্থবোধকতা ও সংক্ষিপ্ততা ঐ একই বিষয়ে অবতীর্ণ অপর কোন আয়াতের মাধ্যমে দূর করা হয়, যা অর্থ নির্দেশের ক্ষেত্রে প্রথমটির চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর পারিভাষিক অর্থে আমরা এভাবে পবিত্র কুরআনের আয়াতকে অপর এক আয়াতের সাহায্যে তাফসীর (ব্যাখ্যা) করি।এ পদ্ধতি পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ ব্যাখ্যার সাথেই একান্তভাবে শুধু সংশ্লিষ্ট নয়, বরং হাদীসসমূহের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তাই এক হাদীসের সাহায্যে অনুরূপ আরেক হাদীসের সংক্ষিপ্ততা ও দ্ব্যর্থবোধকতা দূর করা যায়। কারণ আমাদের মহান ইমামগণ সংবেদনশীল ও দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপকারী ও পুনরাবৃত্তিমূলক অনেক বক্তব্য ও ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যার সবই অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশের ক্ষেত্রে একই ধাঁচের ও একই পর্যায়ের নয়; কখনো কখনো সেসব অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশ করার ক্ষেত্রে পরিষ্কার; আবার কখনো কখনো পরিবেশ-পরিস্থতির কারণে কাঙ্ক্ষিত অর্থ ও লক্ষ্য ইশারা-ইঙ্গিতে বর্ণনা করতে হয়েছে।বলা হয়েছে, মহানবী (সা.) রোগশয্যায় শায়িতাবস্থায় একটি বিষয় লিখে দেয়ার জন্য সাহাবীগণকে কাগজ-কলম আনার নির্দেশ দেন এবং তিনি তাঁদের স্মরণ করিয়েও দেন, এ নির্দেশনামার কারণে তারা কখনো পথভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়বে না।১০ অতঃপর মহানবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তিনি ঐ চিঠি বা প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্র লেখানো থেকে বিরত থাকেন।এ ক্ষেত্রে কেউ হয় তো প্রশ্ন করতে পারে, যে পত্র মহানবী (সা.) লেখাতে চেয়েছিলেন, তা কী প্রসঙ্গে ছিল। এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট। কারণ আলোচনার শুরুতে আমরা যে মূলনীতি উল্লেখ করেছি, তার আলোকে অবশ্যই বলা যায়, আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর ওয়াসায়াত এবং খিলাফত দৃঢ়ীকরণ এবং তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার অপরিহার্যতা তুলে ধরা ছাড়া মহানবীর আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। আর এ বিষয় হাদীসে সাকালাইন বিবেচনায় আনলে স্পষ্ট হয়ে যায়। উল্লেখ্য, হাদীসে সাকালাইনের ব্যাপারে শিয়া-সুন্নী সকল হাদীসবিশারদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। কারণ মহানবী (সা.) যে পত্র লিখাতে চেয়েছিলেন, সে ব্যাপারে বলেছেন : “যাতে তোমরা আমার পরে পথভ্রষ্ট না হও, সেজন্য আমি এ পত্রটি লিখাচ্ছি।” আর হাদীসে সাকালাইনেও তিনি হুবহু এ বাক্যই (অর্থাৎ আমার পরে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না) বলেছেন এবং কিতাব ও তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার কারণ তিনি এটাই বিবেচনা করেছেন যে, এ দুই মূল্যবান ও ভারী বিষয়ের অনুসরণই হচ্ছে পথভ্রষ্ট না হবার কারণ।انّى تارك فيكم الثّقلين ما ان تمسّكتم بِهما لن تضلّوا : كتاب الله و عترتى اهل بيتِى“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু’টি অতি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত এ দু’টি তোমরা আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন পর্যন্ত তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। এ দুই অতি মূল্যবান জিনিস হচ্ছে : মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধর (ইতরাত)।”এ দুই হাদীসের১১ শব্দমালা এবং এদের মধ্যে বিদ্যমান সাদৃশ্য বিবেচনায় আনলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা সম্ভব নয় কি যে, কাগজ ও কলম চাওয়ার পেছনে মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল হাদীসে সাকালাইনের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বা এর অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুর চেয়েও উন্নত কিছু লিপিবদ্ধ করা; আর তা ছিল মহানবীর প্রত্যক্ষ ওয়াসী ও উত্তরাধিকারীর বেলায়েত (নেতৃত্ব) এবং ওয়াসায়াত দৃঢ়ীকরণ যা ১৮ যিলহজ্ব ইরাক, মিশর ও হিজাযের হাজীগণের পৃথক হবার স্থান গাদীরে খুমের মহাসমাবেশে মৌখিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল?এছাড়াও যে ব্যক্তি মহানবীর ওফাতের পরপর সাকীফায়ে বনী সায়েদায় খিলাফতের জন্য শূরা বা পরামর্শসভার আয়োজন করে নিজের পুরনো বন্ধুকে বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে খিলাফতের জন্য প্রার্থী করেছিলেন এবং তাঁর বন্ধু নিজের মৃত্যুকালে তাঁকে তাঁর সেবার নগদ পুরস্কারও দিয়েছিলেন এবং তাঁকে সকল মূলনীতির বিপরীতে খিলাফতের জন্য মনোনীত করেছিলেন, সেই ব্যক্তির দুর্দমনীয় বিরোধিতা এ বিষয়ের সাক্ষী যে, মহানবী (সা.)-এর কথাবার্তা এবং তাঁর কাছে সাহাবীগণের এ সমাবেশে এমন কিছু প্রমাণ বিদ্যমান ছিল, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, মহানবী (সা.) খিলাফত ও মুসলিম উম্মাহর সার্বিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্বভারের ব্যাপারে কিছু কথা লিখাতে চাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি (হযরত উমর) কাগজ-কলম আনার ব্যাপারে বিরোধিতা করেন। আর তা না হলে এতটা জবরদস্তির কোন কারণ থাকত না। মহানবী (সা.) কেন এ পত্র লেখার ব্যাপারে আর তাকীদ দিলেন না?মহানবী (সা.) যিনি তাদের বিরোধিতা সত্বেও নিজ সচিবকে ডেকে এ পত্র লেখাতে পারতেন, তিনি কেন (ঐ পত্র লেখানোর ক্ষেত্রে) শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলেন?এ প্রশ্নের উত্তরও সুস্পষ্ট। কারণ মহানবী (সা.) যদি এ পত্র লেখার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করতেন, তা হলে যারা বলেছিলেন যে, ‘রোগযন্ত্রণা মহানবীর ওপর প্রবল হয়েছে’, তারাই মহানবীর সাথে আরো বেয়াদবীর চরম স্পর্ধা প্রদর্শন করত এবং তাদের সমর্থকরাও জনগণের মধ্যে তা রটনা করে তাদের দাবী প্রমাণ করার চেষ্টা করত। এ অবস্থায় মহানবীর শানে বেয়াদবীপূর্ণ আচরণের মাত্রা যেমন বৃদ্ধি পেত ও অব্যাহত থাকত, তেমনি মহানবীর পত্রের কার্যকারিতাও আর থাকত না। এ কারণেই কেউ কেউ যখন তাদের বেয়াদবী ও মন্দ আচরণ লাঘব করার জন্য মহানবীর কাছে বলেছিলেন : “আপনি কি ইচ্ছা করেন যে, আমরা কাগজ-কলম নিয়ে আসি?” তখন তাঁর চেহারা প্রচণ্ড উষ্মায় ফেটে পড়ছিল, তা রক্তিম হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি তাদের বলেছিলেন : “এতসব কথা-বার্তার পর তোমরা কাগজ-কলম আনতে চাচ্ছ? কেবল এতটুকু তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে, আমার বংশধরদের সাথে সদাচরণ করবে।” এ কথা বলে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং আলী, আব্বাস ও ফযল ব্যতীত তারা সবাই সেখান থেকে উঠে চলে যায়।১২ অন্তিম পত্র লিখতে না পারার ক্ষতিপূরণ প্রচেষ্টাকতিপয় সাহাবীর প্রকাশ্য বিরোধিতা যদিও মহানবীকে পত্র লেখার অভিপ্রায় পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল, তবুও তিনি ভিন্ন এক পদ্ধতিতে তাঁর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিলেন এবং ইতিহাসের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) রোগযন্ত্রণায় প্রচণ্ড কষ্ট পাওয়া সত্বেও এক হাত আলীর কাঁধে এবং অন্য হাত মায়মুনার কাঁধের উপর রেখে মসজিদের দিকে গমন করেন এবং প্রাণশক্তি নিঃশেষকারী তীব্র কষ্ট সহ্য করেও তিনি মিম্বারে আরোহণ করেন। জনতার নয়ন অশ্রুজলে ভিজে গিয়েছিল এবং মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছিল। জনতা তখন মহানবীর সর্বশেষ বাণী ও উপদেশাবলী শোনার অপেক্ষা করছিল। মহানবী (সা.) সভাস্থলের নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন : “আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি।” ঐ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল : “ঐ দুই মূল্যবান জিনিস কী?” (উষ্মায়) মহানবীর মুখমণ্ডল প্রজ্বলিত হয়ে উঠল এবং তিনি বললেন : “আমি নিজেই এর ব্যাখ্যা দেব; তাই প্রশ্ন করার কোন কারণ নেই।” অতঃপর তিনি বললেন : “এক হচ্ছে পবিত্র কুরআন এবং অন্যটি আমার বংশধর।”১৩ইবনে হাজর আসকালানী ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন এবং এ দু’টি বর্ণনাই১৪ সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই। তিনি লিখেছেন : “মহানবী (সা.) যখন অসুস্থ তখন কোন একদিন যখন সাহাবীগণ তাঁর বিছানার চারপাশ ঘিরে রেখেছিলেন, তখন তিনি তাঁদের দিকে মুখ করে বলেছিলেন : হে লোকসকল! আমার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে এবং খুব শীঘ্রই আমি তোমাদের মধ্য থেকে বিদায় নেব। তোমরা জেনে রাখ, আমি তোমাদের মধ্যে মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধরদের রেখে যাচ্ছি। এরপর তিনি হযরত আলীর হাত ধরে তা উঁচুতে তুলে বললেন :هذا علىّ مع القرآن و القرآن مع علىّ لا يفترقان-এই আলী পবিত্র কুরআনের সাথে এবং পবিত্র কুরআন আলীর সাথে আছে। এরা কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।”১৫মহানবী (সা.) যদিও তাঁর অসুস্থ হওয়ার আগে একাধিক উপলক্ষে১৬ হাদীসে সাকালাইন বিভিন্ন আঙ্গিক ও ভাষাগত অবয়বে বর্ণনা করেছিলেন এবং এ দুই অতি মূল্যবান বিষয়ের প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তবু যেহেতু তিনি রোগশয্যায় শায়িত হয়ে আবারও পবিত্র কুরআন ও তাঁর বংশধরদের (ইতরাত) আঁকড়ে ধরে থাকার ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেছেন এবং যেসব ব্যক্তি তাঁর অন্তিম পত্র লেখার ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই উপস্থিতিতে তিনি পবিত্র কুরআন ও ইতরাতের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সেহেতু ধারণা করা যায়, হাদীসে সাকালাইনের পুনরাবৃত্তিই ছিল ঐ অন্তিম পত্রের শূন্যতা পূরণ করা, যা তিনি লিখতে পারেন নি। তথ্যসূত্র :১. ايتونِى بدواة و صحيفة اكتب لكم كتابا لا تضلّون بعده২. সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২ এবং ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪; সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪; মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৫ এবং আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৪৩. ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৪. সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪ এবং মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫৫. কানযুল উম্মাল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩৮ এবং আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৪৬. মরহুম মুজাহিদ আল্লামা সাইয়্যেদ শারাফুদ্দীন তাঁর ‘আল মুরাজায়াত’ গ্রন্থে তাঁদের সকল অজুহাত উল্লেখ করে সেগুলো আকর্ষণীয়ভাবে খণ্ডন করেছেন।৭. মুহাম্মদের জীবনী, পৃ. ৪৭৫৮. মহানবী (সা.) প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি পবিত্র কুরআনের মুখাপেক্ষিতার সীমা বর্ণনা করা আমাদের এ আলোচনার গণ্ডির বাইরে। আমরা ‘পবিত্র কুরআনের জটিল আয়াতসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা’ এবং মানসূরে জভীদ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে এ সংক্রান্ত আলোচনা করেছি।৯. মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫১০. اكتب لكم كتاباً لن تضلّوا بعده ابداً আমি তোমাদের একটি পত্র লিখে দেব যার পরে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আপনারা যদি লক্ষ্য করেন, তা হলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, মহানবী (সা.) لن تضلّوا (তোমরা আর কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না)-এ বাক্যের দ্বারা তাঁর পত্র লেখার কারণ ব্যক্ত করেছেন।১১. হাদীসে সাকালাইন ও কাগজ-কলমের হাদীস১২. বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৬৯ এবং শেখ মুফীদ প্রণীত কিতাব আল ইরশাদ এবং তাবারসী প্রণীত আলামুল ওয়ারা১৩. বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৭৬১৪. প্রথম বর্ণনা ও রেওয়ায়েত বিহারুল আনওয়ারের ২২তম খণ্ডের ৪৭৬ পৃ. থেকে উদ্ধৃত এবং দ্বিতীয় বর্ণনা ইবনে হাজর আসকালানী বর্ণিত।১৫. আসসাওয়ায়েক আল মুহরিকাহ্, ৯ম অধ্যায়, পৃ. ৫৭ এবং কাশফুল গাম্মাহ্, পৃ. ৪৩১৬. হাদীসে সাকালাইন শিয়া-সুন্নী হাদীসবিদগণ যে সব হাদীস ও রেওয়ায়েতের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, সেসবের অন্তর্ভুক্ত। এ হাদীস ৬০টিরও অধিক সূত্রে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে হাজার আসকালানী আস সাওয়ায়েক আল মুহরিকাহ্ গ্রন্থের ১৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : “মহানবী (সা.) বিভিন্ন উপলক্ষ, যেমন আরাফাতের দিবসে, গাদীরে খুমের দিবসে, তায়েফ নগরী থেকে প্রত্যাবর্তনের পর, এমনকি রোগশয্যায় শায়িত অবস্থায়ও পবিত্র কুরআন ও তাঁর ইতরাতের সাথে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।”মরহুম মীর হামেদ হুসাইন হিন্দী তাঁর গ্রন্থের একটি অংশে হাদীসে সাকালাইনের সনদসমূহ এবং এর অর্থের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রেখেছেন এবং এসবের সমগ্র সম্প্রতি ৬ খণ্ডে ইসফাহান থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। মিশরের ‘দারুত তাকরীব’ সংস্থার (ইসলামী মাযহাবসমূহকে নিকটবর্তী করার সংস্থা) পক্ষ থেকে ১৩৭৪ হিজরীতে এ হাদীস সংক্রান্ত একটি সন্দর্ভ প্রকাশ করা হয়েছিল। এ সন্দর্ভে সনদের দৃষ্টিকোণ থেকে এ হাদীসের গুরুত্ব এবং সকল শতকে এ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের বিশেষ দৃষ্টি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।লা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিনবেশুমার লানত বর্ষিত হোকনিবেদক_____ রাকিব আলী ইমামি

কাগজ ও কলম নিয়ে এসো” : মহানবী (সা.)
খেলাফত কুক্ষিগত করার জন্য তাঁর ঘরের বাইরে যে সব তৎপরতা চলছিল, সে ব্যাপারে মহানবী (সা.) সম্পূর্ণ ওয়াকিব ছিলেন। এ কারণে তিনি মতবিরোধের উদ্ভব ঠেকানো এবং তাঁর মূল ধারা থেকে বিচ্যুতি ঘটার আগেই তা রোধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এবং তাঁর আহলে বাইতের খিলাফতের ভিত্তি লিখিত আকারে মজবুত করবেন এবং খিলাফত প্রসঙ্গে একখানা জীবন্ত দলিল রেখে যাবেন।

এ কারণেই যেদিন নেতৃত্বাস্থানীয় সাহাবীগণ তাঁকে দেখার জন্য আসেন, সেদিন তিনি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। অতঃপর তিনি তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন : “আমার জন্য কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো, যাতে আমি তোমাদের জন্য কিছু বিষয় লিখে দিতে পারি যেটা দিয়ে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।”১

ইবনে আব্বাস এ ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন : “এটাই ছিল ইসলামের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ যে একদল সাহাবীর মত-পার্থক্য ও ঝগড়া-বিবাদ মহানবী (সা.)-এর কাঙ্ক্ষিত পত্র লেখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।”২

বলার অপেক্ষাই রাখে না যে, এর অর্থ ছিল তিনি পত্রের বিষয়বস্তু মুখে বলবেন এবং তাঁর একজন লেখক তা লিপিবদ্ধ করবেন। আর তা না হলে মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কখনো কলম হাতে নেন নি এবং এক লাইনও লিখেন নি। অধিক স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমার প্রণীত ‘দার মাকতাবে ওয়াহী’ গ্রন্থ অধ্যয়ন করুন।

এ ঐতিহাসিক ঘটনা একদল সুন্নী ও শিয়া হাদীসবিদ ও ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসবিদ্যার নীতিমালার দৃষ্টিকোণ থেকে তা নির্ভরযোগ্য ও সহীহ বর্ণনাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। একটি বিষয় আছে। আর তা হলো, আহলে সুন্নাতের মুহাদ্দিসগণ প্রধানত হযরত উমরের উক্তি অর্থগতভাবে উদ্ধৃত করেছেন অর্থাৎ তাঁরা তাঁর ধৃষ্টতামূলক উক্তির মূল পাঠ ব্যক্ত করেন নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, হযরত উমরের উক্তি উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকা এজন্য নয় যে, ধৃষ্টতার কথা উল্লেখ করা আসলে মহানবী (সা.)-এর প্রতি এক ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন; বরং দ্বিতীয় খলীফার মর্যাদা রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তাঁর উক্তিতে হাত দেয়া হয়েছে এবং পরিবর্তন করা হয়েছে, পাছে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁর অবমাননাকর উক্তি শুনে তাঁর ব্যাপারে হতাশ না হয় (এবং কুধারণা পোষণ না করে)।

এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ‘আস সাকীফাহ্’ গ্রন্থের রচয়িতা আবু বকর জওহারী যখন তাঁর গ্রন্থে এ অধ্যায়ে উপনীত হন, তখন তিনি হযরত উমরের উক্তিটি এভাবে বর্ণনা করেন :

و قال عمر كلمة معناها أنّ الوجع قد غلب علي رسول الله

“এবং হযরত উমর একটি কথা বলেন, যার অর্থ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর ওপর রোগ-যন্ত্রণা প্রবল হয়েছে।”৩

তবে আহলে সুন্নাতের হাদীসবেত্তাদের মধ্য থেকে যখন কেউ কেউ দ্বিতীয় খলীফার উক্তির মূল পাঠ হুবহু উদ্ধৃত করতে চান, তখন তাঁরা তাঁর সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ থেকে বিরত থাকেন এবং এতটুকু লিখেন : فقالوا هجر رسول الله “অতঃপর তারা বলল : রাসূলুল্লাহ্ রোগের কারণে প্রলাপ বকেছেন।”৪

নিশ্চিতভাবে এ ধরনের অশালীন ও জঘন্য উক্তি যে কোন ব্যক্তিরই হয়ে থাকুক না কেন, তা কখনো ক্ষমার যোগ্য নয়। কারণ পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য অনুসারে মহানবী (সা.) সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত এবং তিনি ওহী ছাড়া কোন কথা বলেন না।

নিষ্পাপ নবীর সান্নিধ্যে সাহাবীদের বিবাদ এতটা বিরক্তিকর ও মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কয়েকজন স্ত্রী পর্দার অন্তরাল থেকে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন : “কেন আপনারা মহানবীর নির্দেশ অমান্য করছেন?” দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর তাঁদেরকে চুপ করানোর জন্য বলেছিলেন : “আপনারা হযরত ইউসুফের সঙ্গীদের স্ত্রীদের সদৃশ। যখন মহানবী অসুস্থ হন, তখন আপনারা তাঁর জন্য নিজেদের নয়নগুলোয় চাপ দেন (অশ্রুপাত করেন) এবং যখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন, তখন আপনারা তাঁর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।”৫

কতিপয় গোঁড়া ব্যক্তি বাহ্যত দ্বিতীয় খলীফার বিরুদ্ধাচরণের পক্ষে কিছু অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন।৬ তবে যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে আসলে তাঁরা তাঁকে এ কাজের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলেছেন এবং حسبنا كتاب الله (মহান আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ পবিত্র কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট)- তাঁর এ উক্তিকে তাঁরা অসার গণ্য করেছেন এবং সবাই স্বীকার করেছেন, ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর সুন্নাত এবং পবিত্র কুরআন কখনোই উম্মতকে মহানবীর হাদীস ও বাণীসমূহের ব্যাপারে অমুখাপেক্ষী করে নি।

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ‘মুহাম্মদের জীবনী’ গ্রন্থের রচয়িতা ড. হাসানাইন হাইকাল ইশারা-ইঙ্গিতে দ্বিতীয় খলীফার এ কাজ সমর্থন করে লিখেছেন : “এ ঘটনার পর ইবনে আব্বাস বিশ্বাস করতেন, মহানবী (সা.) যে বিষয়টি লিখে দিতে চাচ্ছিলেন, তা লেখার ক্ষেত্রে বাধা দান করে মুসলমানরা আসলেই একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে হারিয়েছে। কিন্তু হযরত উমর তাঁর বিশ্বাসের ওপর বহাল থেকেছেন। কারণ মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন :

)ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء(

“আমরা পবিত্র কুরআনে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ সবকিছু এ গ্রন্থে বর্ণনা করেছি)।”৭

তিনি যদি এ আয়াতের আগের ও পরের অংশের দিকে দৃষ্টি দিতেন, তা হলে তিনি কখনোই এ আয়াতের এ রকম অপব্যাখ্যা করতেন না এবং নিষ্পাপ মহানবীর বিপরীতে হযরত উমরের এ কাজ সমর্থন করতেন না। কারণ আয়াতে উল্লিখিত কিতাব বা গ্রন্থের অর্থ বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ এবং অস্তিত্বের পত্রসমূহকে বোঝানো হয়েছে। আর এ অস্তিত্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টি আসলে সৃষ্টিগ্রন্থের এক একটি পৃষ্ঠা এবং সমগ্র সৃষ্টি এ সৃষ্টিগ্রন্থের সমুদয় পৃষ্ঠাতুল্য।

)و ما من دابّة فِى الأرض و لا طائر يطير بجناحيه الّا أمم أمثالكم ما فرّطنا فِى الكتاب من شىء ثمّ الى ربّهم يُحشرون(

“পৃথিবীতে (বিচরণকারী) প্রতিটি জীব-জন্তু এবং (আকাশে) স্বীয় ডানা মেলে উড্ডয়নকারী প্রতিটি বিহঙ্গ তোমাদের মতোই এক একটা প্রজাতি (أمم), আমরা (সৃষ্টি) গ্রন্থে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি (অর্থাৎ আমরা এ সৃষ্টিলোকে যা যা সৃষ্টি করা সম্ভব, সেগুলো সবই সৃষ্টি করেছি) এবং সব কিছুই তাদের প্রভুর কাছে প্রত্যাবর্তন করবে।” (সূরা আনআম : ৩৮)

যেহেতু ‘আমরা এ গ্রন্থের মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করি নি’- এ বাক্যের আগের বাক্য ‘জীবকূল ও পক্ষীকূল’ সৃষ্টি করার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এর পরের বাক্য কিয়ামত দিবসে পুনরুজ্জীবিত করণ প্রক্রিয়া বা হাশরের সাথে সম্পর্কিত, সেহেতু নিশ্চিত করে বলা যায়, আয়াতে উল্লিখিত ‘গ্রন্থ’ যার মধ্যে কোন কিছুই উপেক্ষা করা হয় নি, তা বলতে গ্রন্থবৎ প্রকৃতিজগৎ (সৃষ্টিগ্রন্থ) এবং অস্তিত্বের পত্রকেই বোঝানো হয়েছে।

অধিকন্তু আমরা যদি মেনেও নিই যে, আয়াতের ‘গ্রন্থ’ শব্দ আসলে পবিত্র কুরআন, তা হলে পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট উক্তি অনুসারে এ গ্রন্থ বোঝার জন্য মহানবী (সা.)-এর ব্যাখ্যা ও দিক-নির্দেশনা আবশ্যক।

)و أنزلنا إليك الذّكر لتبيّن للنّاس ما نزل إليهم(

“আর আমরা আপনার কাছে এ ‘স্মরণ’ অর্থাৎ পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে আপনি জনগণের কাছে তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করেন।” (সূরা নাহল : ৪৪)

এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এই যে, মহান আল্লাহ্ এ আয়াতে لتقرأ অর্থাৎ ‘যাতে আপনি পাঠ করেন’ বলেন নি, বরং তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন لتبيّن অর্থাৎ ‘যাতে আপনি ব্যাখ্যা করেন’। সুতরাং মহান আল্লাহর গ্রন্থই যদি মুসলিম উম্মাহর জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে, তবুও মহানবী (সা.) প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি এ গ্রন্থের তীব্র প্রয়োজন রয়েছে।৮

উম্মত যদি এ ধরনের দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্রের মুখাপেক্ষী না-ই হতো, তা হলে যখন ইসলাম ধর্মের প্রখ্যাত বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ইবনে আব্বাস (রা.)-এর গণ্ডদেশ বেয়ে মুক্তার মতো অশ্রুবিন্দু ঝরতে থাকত, তখন কেন তিনি বলতেন :

يوم الخميس و ما يوم الخميس ثمّ جعل تسيل دموعه حتّي رؤيت علي خدّيه كأنها نظام اللؤلؤ قال رسول الله : ايتونِى بالكتف و الدّواة أو اللوح و الدّواة اكتب لكم كتاباً لن تضلّوا بعده ابداً فقالوا...

“হায় বৃহস্পতিবার! হায় বৃহস্পতিবার! এরপর তাঁর অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল; আর তাঁর গণ্ডদেশদ্বয়ের উপর তা মুক্তার মতো দেখা যাচ্ছিল। তিনি বললেন : মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার কাছে তোমরা কাঁধের হাড় ও দোয়াত বা কাগজ ও দোয়াত নিয়ে এসো। তা হলে আমি তোমাদের জন্য এমন একটি পত্র (নির্দেশনামা) লিখে দেব যে, এরপর তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। অতঃপর একদল লোক বলল : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)”৯ ...

এ ধরনের তীব্র শোক যা ইবনে আব্বাস প্রকাশ করেছেন, তা সত্বেও এবং মহানবী (সা.) নিজেই যে তাকীদ দিয়েছেন তার ভিত্তিতে কিভাবে এ কথা বলা সম্ভব যে, পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর এ পত্রের প্রতি মুসলিম উম্মাহকে অমুখাপেক্ষী করেছে?

এখন যখন মহানবী (সা.) এ ধরনের একটি নির্দেশনামা লিপিবদ্ধ করাতে পারলেন না, তখন অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ ও দলিলের ভিত্তিতে কি ধারণা করা সম্ভব যে, এ নির্দেশনা লেখানোর পেছনে মহানবীর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

 

এ পত্রের বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য কী ছিল?

পবিত্র কুরআন তাফসীর করার ক্ষেত্রে নতুন অথচ দৃঢ় পদ্ধতি,- যা বর্তমানে সকল গবেষক ও আলেমের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে,- হচ্ছে কোন একটি বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতের দ্ব্যর্থবোধকতা ও সংক্ষিপ্ততা ঐ একই বিষয়ে অবতীর্ণ অপর কোন আয়াতের মাধ্যমে দূর করা হয়, যা অর্থ নির্দেশের ক্ষেত্রে প্রথমটির চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর পারিভাষিক অর্থে আমরা এভাবে পবিত্র কুরআনের আয়াতকে অপর এক আয়াতের সাহায্যে তাফসীর (ব্যাখ্যা) করি।

এ পদ্ধতি পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ ব্যাখ্যার সাথেই একান্তভাবে শুধু সংশ্লিষ্ট নয়, বরং হাদীসসমূহের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। তাই এক হাদীসের সাহায্যে অনুরূপ আরেক হাদীসের সংক্ষিপ্ততা ও দ্ব্যর্থবোধকতা দূর করা যায়। কারণ আমাদের মহান ইমামগণ সংবেদনশীল ও দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপকারী ও পুনরাবৃত্তিমূলক অনেক বক্তব্য ও ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যার সবই অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশের ক্ষেত্রে একই ধাঁচের ও একই পর্যায়ের নয়; কখনো কখনো সেসব অর্থ ও লক্ষ্য নির্দেশ করার ক্ষেত্রে পরিষ্কার; আবার কখনো কখনো পরিবেশ-পরিস্থতির কারণে কাঙ্ক্ষিত অর্থ ও লক্ষ্য ইশারা-ইঙ্গিতে বর্ণনা করতে হয়েছে।

বলা হয়েছে, মহানবী (সা.) রোগশয্যায় শায়িতাবস্থায় একটি বিষয় লিখে দেয়ার জন্য সাহাবীগণকে কাগজ-কলম আনার নির্দেশ দেন এবং তিনি তাঁদের স্মরণ করিয়েও দেন, এ নির্দেশনামার কারণে তারা কখনো পথভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়বে না।১০ অতঃপর মহানবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তিনি ঐ চিঠি বা প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা সম্বলিত পত্র লেখানো থেকে বিরত থাকেন।

এ ক্ষেত্রে কেউ হয় তো প্রশ্ন করতে পারে, যে পত্র মহানবী (সা.) লেখাতে চেয়েছিলেন, তা কী প্রসঙ্গে ছিল। এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট। কারণ আলোচনার শুরুতে আমরা যে মূলনীতি উল্লেখ করেছি, তার আলোকে অবশ্যই বলা যায়, আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর ওয়াসায়াত এবং খিলাফত দৃঢ়ীকরণ এবং তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার অপরিহার্যতা তুলে ধরা ছাড়া মহানবীর আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। আর এ বিষয় হাদীসে সাকালাইন বিবেচনায় আনলে স্পষ্ট হয়ে যায়। উল্লেখ্য, হাদীসে সাকালাইনের ব্যাপারে শিয়া-সুন্নী সকল হাদীসবিশারদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। কারণ মহানবী (সা.) যে পত্র লিখাতে চেয়েছিলেন, সে ব্যাপারে বলেছেন : “যাতে তোমরা আমার পরে পথভ্রষ্ট না হও, সেজন্য আমি এ পত্রটি লিখাচ্ছি।” আর হাদীসে সাকালাইনেও তিনি হুবহু এ বাক্যই (অর্থাৎ আমার পরে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না) বলেছেন এবং কিতাব ও তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার কারণ তিনি এটাই বিবেচনা করেছেন যে, এ দুই মূল্যবান ও ভারী বিষয়ের অনুসরণই হচ্ছে পথভ্রষ্ট না হবার কারণ।

انّى تارك فيكم الثّقلين ما ان تمسّكتم بِهما لن تضلّوا : كتاب الله و عترتى اهل بيتِى

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে দু’টি অতি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত এ দু’টি তোমরা আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন পর্যন্ত তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। এ দুই অতি মূল্যবান জিনিস হচ্ছে : মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধর (ইতরাত)।”

এ দুই হাদীসের১১ শব্দমালা এবং এদের মধ্যে বিদ্যমান সাদৃশ্য বিবেচনায় আনলে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা সম্ভব নয় কি যে, কাগজ ও কলম চাওয়ার পেছনে মহানবীর উদ্দেশ্য ছিল হাদীসে সাকালাইনের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বা এর অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুর চেয়েও উন্নত কিছু লিপিবদ্ধ করা; আর তা ছিল মহানবীর প্রত্যক্ষ ওয়াসী ও উত্তরাধিকারীর বেলায়েত (নেতৃত্ব) এবং ওয়াসায়াত দৃঢ়ীকরণ যা ১৮ যিলহজ্ব ইরাক, মিশর ও হিজাযের হাজীগণের পৃথক হবার স্থান গাদীরে খুমের মহাসমাবেশে মৌখিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল?

এছাড়াও যে ব্যক্তি মহানবীর ওফাতের পরপর সাকীফায়ে বনী সায়েদায় খিলাফতের জন্য শূরা বা পরামর্শসভার আয়োজন করে নিজের পুরনো বন্ধুকে বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে খিলাফতের জন্য প্রার্থী করেছিলেন এবং তাঁর বন্ধু নিজের মৃত্যুকালে তাঁকে তাঁর সেবার নগদ পুরস্কারও দিয়েছিলেন এবং তাঁকে সকল মূলনীতির বিপরীতে খিলাফতের জন্য মনোনীত করেছিলেন, সেই ব্যক্তির দুর্দমনীয় বিরোধিতা এ বিষয়ের সাক্ষী যে, মহানবী (সা.)-এর কথাবার্তা এবং তাঁর কাছে সাহাবীগণের এ সমাবেশে এমন কিছু প্রমাণ বিদ্যমান ছিল, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, মহানবী (সা.) খিলাফত ও মুসলিম উম্মাহর সার্বিক বিষয় পরিচালনার দায়িত্বভারের ব্যাপারে কিছু কথা লিখাতে চাচ্ছেন। এ কারণেই তিনি (হযরত উমর) কাগজ-কলম আনার ব্যাপারে বিরোধিতা করেন। আর তা না হলে এতটা জবরদস্তির কোন কারণ থাকত না।

 

মহানবী (সা.) কেন এ পত্র লেখার ব্যাপারে আর তাকীদ দিলেন না?

মহানবী (সা.) যিনি তাদের বিরোধিতা সত্বেও নিজ সচিবকে ডেকে এ পত্র লেখাতে পারতেন, তিনি কেন (ঐ পত্র লেখানোর ক্ষেত্রে) শক্তি প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলেন?

এ প্রশ্নের উত্তরও সুস্পষ্ট। কারণ মহানবী (সা.) যদি এ পত্র লেখার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করতেন, তা হলে যারা বলেছিলেন যে, ‘রোগযন্ত্রণা মহানবীর ওপর প্রবল হয়েছে’, তারাই মহানবীর সাথে আরো বেয়াদবীর চরম স্পর্ধা প্রদর্শন করত এবং তাদের সমর্থকরাও জনগণের মধ্যে তা রটনা করে তাদের দাবী প্রমাণ করার চেষ্টা করত। এ অবস্থায় মহানবীর শানে বেয়াদবীপূর্ণ আচরণের মাত্রা যেমন বৃদ্ধি পেত ও অব্যাহত থাকত, তেমনি মহানবীর পত্রের কার্যকারিতাও আর থাকত না। এ কারণেই কেউ কেউ যখন তাদের বেয়াদবী ও মন্দ আচরণ লাঘব করার জন্য মহানবীর কাছে বলেছিলেন : “আপনি কি ইচ্ছা করেন যে, আমরা কাগজ-কলম নিয়ে আসি?” তখন তাঁর চেহারা প্রচণ্ড উষ্মায় ফেটে পড়ছিল, তা রক্তিম হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি তাদের বলেছিলেন : “এতসব কথা-বার্তার পর তোমরা কাগজ-কলম আনতে চাচ্ছ? কেবল এতটুকু তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে, আমার বংশধরদের সাথে সদাচরণ করবে।” এ কথা বলে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং আলী, আব্বাস ও ফযল ব্যতীত তারা সবাই সেখান থেকে উঠে চলে যায়।১২

 

অন্তিম পত্র লিখতে না পারার ক্ষতিপূরণ প্রচেষ্টা

কতিপয় সাহাবীর প্রকাশ্য বিরোধিতা যদিও মহানবীকে পত্র লেখার অভিপ্রায় পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল, তবুও তিনি ভিন্ন এক পদ্ধতিতে তাঁর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিলেন এবং ইতিহাসের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) রোগযন্ত্রণায় প্রচণ্ড কষ্ট পাওয়া সত্বেও এক হাত আলীর কাঁধে এবং অন্য হাত মায়মুনার কাঁধের উপর রেখে মসজিদের দিকে গমন করেন এবং প্রাণশক্তি নিঃশেষকারী তীব্র কষ্ট সহ্য করেও তিনি মিম্বারে আরোহণ করেন। জনতার নয়ন অশ্রুজলে ভিজে গিয়েছিল এবং মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সুমসাম নীরবতা বিরাজ করছিল। জনতা তখন মহানবীর সর্বশেষ বাণী ও উপদেশাবলী শোনার অপেক্ষা করছিল। মহানবী (সা.) সভাস্থলের নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন : “আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান জিনিস রেখে যাচ্ছি।” ঐ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল : “ঐ দুই মূল্যবান জিনিস কী?” (উষ্মায়) মহানবীর মুখমণ্ডল প্রজ্বলিত হয়ে উঠল এবং তিনি বললেন : “আমি নিজেই এর ব্যাখ্যা দেব; তাই প্রশ্ন করার কোন কারণ নেই।” অতঃপর তিনি বললেন : “এক হচ্ছে পবিত্র কুরআন এবং অন্যটি আমার বংশধর।”১৩

ইবনে হাজর আসকালানী ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন এবং এ দু’টি বর্ণনাই১৪ সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই। তিনি লিখেছেন : “মহানবী (সা.) যখন অসুস্থ তখন কোন একদিন যখন সাহাবীগণ তাঁর বিছানার চারপাশ ঘিরে রেখেছিলেন, তখন তিনি তাঁদের দিকে মুখ করে বলেছিলেন : হে লোকসকল! আমার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে এবং খুব শীঘ্রই আমি তোমাদের মধ্য থেকে বিদায় নেব। তোমরা জেনে রাখ, আমি তোমাদের মধ্যে মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধরদের রেখে যাচ্ছি। এরপর তিনি হযরত আলীর হাত ধরে তা উঁচুতে তুলে বললেন :

هذا علىّ مع القرآن و القرآن مع علىّ لا يفترقان

-এই আলী পবিত্র কুরআনের সাথে এবং পবিত্র কুরআন আলীর সাথে আছে। এরা কিয়ামত দিবস পর্যন্ত কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।”১৫

মহানবী (সা.) যদিও তাঁর অসুস্থ হওয়ার আগে একাধিক উপলক্ষে১৬ হাদীসে সাকালাইন বিভিন্ন আঙ্গিক ও ভাষাগত অবয়বে বর্ণনা করেছিলেন এবং এ দুই অতি মূল্যবান বিষয়ের প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, তবু যেহেতু তিনি রোগশয্যায় শায়িত হয়ে আবারও পবিত্র কুরআন ও তাঁর বংশধরদের (ইতরাত) আঁকড়ে ধরে থাকার ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেছেন এবং যেসব ব্যক্তি তাঁর অন্তিম পত্র লেখার ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই উপস্থিতিতে তিনি পবিত্র কুরআন ও ইতরাতের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সেহেতু ধারণা করা যায়, হাদীসে সাকালাইনের পুনরাবৃত্তিই ছিল ঐ অন্তিম পত্রের শূন্যতা পূরণ করা, যা তিনি লিখতে পারেন নি।

 

তথ্যসূত্র :

১.   ايتونِى بدواة و صحيفة اكتب لكم كتابا لا تضلّون بعده

২. সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২ এবং ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪; সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৪; মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৫ এবং আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৪

৩. ইবনে আবীল হাদীদ প্রণীত শারহু নাহজিল বালাগাহ্, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০

৪. সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪ এবং মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫

৫. কানযুল উম্মাল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩৮ এবং আত তাবাকাতুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৪

৬. মরহুম মুজাহিদ আল্লামা সাইয়্যেদ শারাফুদ্দীন তাঁর ‘আল মুরাজায়াত’ গ্রন্থে তাঁদের সকল অজুহাত উল্লেখ করে সেগুলো আকর্ষণীয়ভাবে খণ্ডন করেছেন।

৭. মুহাম্মদের জীবনী, পৃ. ৪৭৫

৮. মহানবী (সা.) প্রদত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি পবিত্র কুরআনের মুখাপেক্ষিতার সীমা বর্ণনা করা আমাদের এ আলোচনার গণ্ডির বাইরে। আমরা ‘পবিত্র কুরআনের জটিল আয়াতসমূহের সঠিক ব্যাখ্যা’ এবং মানসূরে জভীদ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে এ সংক্রান্ত আলোচনা করেছি।

৯. মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৫

১০.  اكتب لكم كتاباً لن تضلّوا بعده ابداً আমি তোমাদের একটি পত্র লিখে দেব যার পরে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আপনারা যদি লক্ষ্য করেন, তা হলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, মহানবী (সা.) لن تضلّوا (তোমরা আর কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না)-এ বাক্যের দ্বারা তাঁর পত্র লেখার কারণ ব্যক্ত করেছেন।

১১. হাদীসে সাকালাইন ও কাগজ-কলমের হাদীস

১২. বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৬৯ এবং শেখ মুফীদ প্রণীত কিতাব আল ইরশাদ এবং তাবারসী প্রণীত আলামুল ওয়ারা

১৩. বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৪৭৬

১৪. প্রথম বর্ণনা ও রেওয়ায়েত বিহারুল আনওয়ারের ২২তম খণ্ডের ৪৭৬ পৃ. থেকে উদ্ধৃত এবং দ্বিতীয় বর্ণনা ইবনে হাজর আসকালানী বর্ণিত।

১৫. আসসাওয়ায়েক আল মুহরিকাহ্, ৯ম অধ্যায়, পৃ. ৫৭ এবং কাশফুল গাম্মাহ্, পৃ. ৪৩

১৬. হাদীসে সাকালাইন শিয়া-সুন্নী হাদীসবিদগণ যে সব হাদীস ও রেওয়ায়েতের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, সেসবের অন্তর্ভুক্ত। এ হাদীস ৬০টিরও অধিক সূত্রে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে হাজার আসকালানী আস সাওয়ায়েক আল মুহরিকাহ্ গ্রন্থের ১৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : “মহানবী (সা.) বিভিন্ন উপলক্ষ, যেমন আরাফাতের দিবসে, গাদীরে খুমের দিবসে, তায়েফ নগরী থেকে প্রত্যাবর্তনের পর, এমনকি রোগশয্যায় শায়িত অবস্থায়ও পবিত্র কুরআন ও তাঁর ইতরাতের সাথে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।”

মরহুম মীর হামেদ হুসাইন হিন্দী তাঁর গ্রন্থের একটি অংশে হাদীসে সাকালাইনের সনদসমূহ এবং এর অর্থের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রেখেছেন এবং এসবের সমগ্র সম্প্রতি ৬ খণ্ডে ইসফাহান থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। মিশরের ‘দারুত তাকরীব’ সংস্থার (ইসলামী মাযহাবসমূহকে নিকটবর্তী করার সংস্থা) পক্ষ থেকে ১৩৭৪ হিজরীতে এ হাদীস সংক্রান্ত একটি সন্দর্ভ প্রকাশ করা হয়েছিল। এ সন্দর্ভে সনদের দৃষ্টিকোণ থেকে এ হাদীসের গুরুত্ব এবং সকল শতকে এ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের বিশেষ দৃষ্টি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

লা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিন
বেশুমার লানত বর্ষিত হোক

নিবেদক_____ রাকিব আলী ইমামি

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202