সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতাআলী ইবনে আবি তালিবের শাহাদাতের পর ,একদা হামদান গোত্রের সাওদা (আম্মারের কন্যা) নামক এক নারী মুয়াবিয়ার নিকট গিয়েছিল। মুয়াবিয়া সাওদার কঠোর পরিশ্রমের কথা (যা সিফ্ফীনের যুদ্ধে হযরত আলী ও তাঁর সৈন্যদের জন্য করেছিল) স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে ভর্ৎসনা করল অতঃপর তার নিকট জানতে চাইল : কি জন্যে এখানে এসেছে ?সাওদা জবাবে বলল : হে মুয়াবিয়া! মহান আল্লাহ্ আমাদের অধিকার হরণের জন্য তোমাকে জিজ্ঞাসা করবেন ,তুমি সর্বদা আমাদের জন্য এমন শাসক নির্বাচন করছ ,যে আমাদেরকে ফসলের মত কর্তন করে ,এসপান্দের বীজের মত পদদলিত করে এবং আমাদেরকে হত্যা করে। এখন এই বুসর ইবনে আরতাতকে পাঠিয়েছ ,যে আমাদের লোকদেরকে হত্যা করে ,আমাদের সম্পদ ছিনেয়ে নেয় ;যদি কেন্দ্রীয় শাসনের অনুসরণ না করতে চাইতাম ,তবে এখন আমি সম্মান ও ক্ষমতার অধিকারী হতাম ;যদি ওকে পদচ্যুত কর ,তবে তো উত্তম ;আর যদি না কর ,তবে ‘ স্বয়ং আমরাই বিদ্রোহ ও অভ্যূত্থান করব...। মুয়াবিয়া অস্বস্থি বোধ করল এবং বলল : আমাকে স্বীয় গোত্রের ভয় দেখাচ্ছ ,তোমাকে নিকৃষ্টতম অবস্থায় ঐ বুসরের কাছেই প্রেরণ করব ,যাতে তোমার জন্য যা সে উপযুক্ত মনে করবে তাই করে।সাওদা কিছুক্ষণ নীরব থাকল ,যেন তার স্মৃতিপটে অতীতের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠল ;অতঃপর এ পংক্তিগুলো আবৃতি করল :প্রভু হে ! তাঁর উপর শান্তি কর বর্ষণযে শায়িত আজ কবরে ,যার মৃত্যুর সাথে যুগপৎন্যায় ও আদালতের হয়েছে সমাধি।সে তো সত্যের দিশারীসত্যকে কভু করেনি কোন কিছুর বিনিময়ে পরিহারসত্য ও বিশ্বাসের ,তাঁরই মাঝে ছিল সমাহারমুয়াবিয়া জিজ্ঞাসা করল : সে কে ?সাওদা জবাবে বলল : আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)। মনে পড়ে ,একদা যাকাত গ্রহণের জন্যে নিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্যে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছিলাম। আমি যখন পৌঁছলাম তখন তিনি নামাযে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু যখনই আমাকে দেখলেন নামায শুরু না করে উদার ও দয়াদ্র কন্ঠে আমাকে বললেন : কিছু বলবে কি ?বললাম : জী হ্যাঁ এবং আমার অভিযোগ উপস্থাপন করলাম। ঐ মহান ব্যক্তি স্বীয় নামাযের স্থানে দাঁড়িয়েই ক্রন্দন করলেন এবং মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললেন : ‘ প্রভু হে ,তুমি জেনে রাখ ও সাক্ষী থাক যে ,আমি কখনোই তাকে (আদিষ্ট) তোমার বান্দাদের প্রতি অত্যাচারের নির্দেশ দেইনি। অতঃপর তিনি ,অবিলম্বে এক চিলতে চামড়া বের করলেন এবং মহান আল্লাহর নাম ও কোরআনের আয়াত লিখার পর এরূপ লিখেছিলেন :আমার পত্র পাঠ করার সাথে সাথেই তোমার হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন কর ,যাতে কাউকে তোমার পরিবর্তে পাঠানোর পর ঐগুলো তোমার নিকট থেকে বুঝে নিতে পারে...।তিনি পত্রখানা আমাকে দিলেন। আল্লাহর শপথ ,ঐ পত্রখানা বন্ধ কিংবা মোহরাংকিতও ছিল না। পত্রখানা ঐ দায়িত্বশীলের নিকট পৌঁছালাম এবং সে পদচ্যুত হল ও আমাদের নিকট থেকে চলে গেল... । ’‘ মুয়াবিয়া এ কাহিনী শ্রবণান্তে নিরুপায় হয়ে আদেশ দিল ,“ যা সে চায় ,তা-ই তার জন্য লিখে দাও। ”আলী (আ.) ও খলিফাত্রয়মহানবী (সা.) যখন তাঁর দয়ালু আঁখিযুগল বাহ্যতঃ পৃথিবী থেকে নির্লিপ্ত করলেন এবং যখন তার অস্তিত্বের জ্যোতির্ময় নক্ষত্র মানুষের দৃষ্টিসীমা থেকে অস্তমিত হলো ,তখন কিছু কপট ‘ সাকিফায়ে বনি সায়েদায় ’ মিলিত হলো এবং মহানবী (সা.) যে হযরত আলীকে মহান আল্লাহর আদেশক্রমে স্বীয় উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন ,তা তারা আবু বকরের (আবু কোহাফার পুত্র) অধিকারে ন্যস্ত করল। তারপর যথাক্রমে ওমর ও ওসমান মোটামুটি একই ধরনের চক্রান্ত ও পরিকল্পনার মাধ্যমে খেলাফতের অধিকারী হয়েছিল। আর এভাবেই অবিরাম ২৫ বছর ধরে তারা নবী (সা.)-এর তিরোধানের পর মানুষের উপর হুকুমত করেছিল। স্বভাবতঃই এ সুদীর্ঘ সময় ব্যাপী অদ্বিতীয় ও সর্বাধিক যোগ্য ,ঐশী ও ইসলামী হুকুমতের প্রকৃত নেতা এবং নবী (সা.)-এর উত্তরাধিকারী অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ পথপ্রদর্শক হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ধৈর্য ও স্থৈর্যের আশ্রয় নিলেন ও নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখলেন। আর এ ঘটনাটি মানবতার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা দুঃখজনক কাহিনী। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা ,এমন কি যাদের কোন দীন নেই তারাও ইসলামের পথে হযরত আলীর অক্লান্ত শ্রম ও প্রচেষ্টা ,তাঁর সরলতা ,নির্মলতা ,বিরত্ব ,চিন্তা শক্তি ,জ্ঞানের বিস্তৃতি ,ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের কথা জানলে ,ইসলামী সমাজের ভাগ্যে তারা যে অন্যায় ও অত্যাচারের কালিমা লেপন করেছে তার জন্য অপ্রত্যাশিত ভাবে অনুতাপ ও পরিতাপ করে। তাহলে সুবিচারক মুসলমানদের ক্ষেত্রে কি ঘটবে! এ মর্মান্তিক ঘটনার জন্য আমাদের দুঃখ ও পরিতাপ সুদীর্ঘ পর্বত শ্রেণীর চেয়েও বিস্তৃততর ,সুউচ্চ পর্বত চূড়ার চেয়েও উচ্চতর।যাহোক ,আবু বকর দশম হিজরীতে খলিফা হলো এবং ত্রয়োদশ হিজরীতে ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করল। আর ইতোমধ্যেই তার খেলাফতের দু ’ বছর ,তিন মাস দশ দিন অতিবাহিত হলো। ১৭তার পর ওমর ইবনে খাত্তাব খেলাফত লাভ করল এবং জিলহজ মাসের শেষ দিকে তেইশ হিজরীতে ‘ আবু লুলু ফিরোজের ’ হাতে নিহত হয়েছিল। তার খেলাফত কাল ছিল দশ বছর ছয় মাস চার দিন। ১৮ওমর নিজের পর খলিফা নির্বাচনের জন্য একটি পরিষদ গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল ,যা ওসমান ইবনে আফফানের পক্ষে গিয়েছিল। সে ওমরের পর ,পরিষদের মাধ্যমে চব্বিশ হিজরীর মহরম মাসের প্রথম দিকে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। অতঃপর পয়ত্রিশ হিজরীর জিলহজ মাসে অন্যায় আচরণের কারণে একদল মুসলমানের হাতে নিহত হয়। তার খেলাফত কাল ছিল বার বছর (কয়েকদিন কম)। ১৯মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আলী (আ.) স্বেচ্ছাচারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন ,যারা তাঁর অধিকার পদদলিত করেছিল এবং ইসলামী বিধান যতটুকু অনুমতি দেয় ,তার সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত যথাসাধ্য প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। একই সাথে বক্তব্য ও দলিলের মাধ্যমে বিষয়টিকে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছিলেন এবং মানুষকে অবহিত করেছিলেন যে ,এরা হলো খেলাফতের অধিকার হরণকারী। বেহেশতে নারীদের নেত্রী হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) এ ক্ষেত্রে ইমাম আলীর সহকারী ও সহযোগী ছিলেন এবং কার্যক্ষেত্রে আবু বকরের হুকুমতকে অবৈধ বলে বর্ণনা করেছেন।সালমান ,আবু যার ,মেকদাদ ও আম্মার ইয়াসিরের মত প্রিয় নবীর একদল সম্মানিত সাহাবী আবেগময় বক্তব্যের মাধ্যমে আবু বকরের শাসন ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন এবং মহানবীর উত্তরসূরী হিসেবে হযরত আলীর অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছিলেন। তবে হযরত আলী (আ.) ইসলামের কল্যাণার্থে ,আর যেহেতু ইসলামের তখনো নব ও বিকাশমান অবস্থা ,এবং তখনও ইসলাম যথেষ্ট পরিমাণে সুস্থিত হয়নি ,সেহেতু তরবারি হাতে তুলে নেন নি বা সমরাগ্নি জ্বালানো থেকে বিরত থেকেছিলেন। (স্বভাবতই এর ফলে ইসলামেরই ক্ষতি হতো এবং মহানবীর সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারত) বরং অপরিহার্য পরিস্থিতিতে আলী (আ.) ইসলামের সম্মান অক্ষুন্ন রক্ষার্থে কোন প্রকার দিক নির্দেশনা ও পরামর্শ দিতে কুন্ঠাবোধ করেন নি। আর তাই দ্বিতীয় খলিফা প্রায়ই বলত :لو لا عليّ لهلك عمر‘ যদি আলী না থাকত তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত। ’ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কিংবা অন্য যে কোন সমস্যা যা তাদেরকে হতবুদ্ধি ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করত সেক্ষেত্রে হযরত আলীর সুনির্দেশনা ও সদুপদেশ ,তাদেরকে তা থেকে উদ্ধার করত। সকল ক্ষেত্রে তারা প্রায় আলীর দিকনির্দেশনা ,মহত্ব ও জ্ঞানের কথা তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এখন আমরা এ ধরনের কিছু ঘটনা উল্লেখ করব।হযরত আবু বকরের সময়ইহুদীদের কিছু আলেম আবু বকরের নিকট এসেছিল এবং তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল : আমরা তৌরাতে পড়েছি যে নবীর উত্তরসূরী হবে সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী ব্যক্তি ,যদি তুমি এ উম্মতের নবীর উত্তরসূরী হয়ে থাক ,তবে আমাদেরকে বল যে ,আল্লাহ্ কি আকাশে আছেন ,না ভূপৃষ্ঠে ?আবু বকর জবাব দিল : তিনি আকাশে আরশের উপর অধিষ্ঠিত আছেন।তারা বলল : তাহলে ভূপৃষ্ঠে তিনি নেই। সুতরাং জানা গেল যে ,তিনি কোথাও আছেন আবার কোথাও বা নেই।আবু বকর বলল : এটা কাফেরদের কথা। দূর হও ,নতুবা তোমাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিব।তারা ইসলামকে উপহাস করতে করতে ফিরে যাচ্ছিল। হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) তাদের একজনকে ডেকে বললেন : আমি জানি ,তোমরা কী জিজ্ঞাসা করেছ এবং কী জবাব পেয়েছ ;তবে জেনে রাখ যে ইসলাম বলে : মহান আল্লাহ্ স্বয়ং স্থানের অস্তিত্ব দানকারী ,সুতরাং তিনি কোন স্থানে সীমাবদ্ধ নন এবং কোন স্থান তাঁকে ধারণ করতে অক্ষম ;কোন প্রকার সংলগ্ন ও স্পর্শ ব্যতীতই তিনি সর্বত্র বিরাজমান এবং তাঁর জ্ঞান সবকিছুকেই পরিবেষ্টন করে আছে...।ইহুদী পণ্ডিতগণ ইসলামে বিশ্বাস স্থাপন করলেন এবং বললেন : ‘ আপনিই নবীর উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য ,অন্য কেউ নয়। ২০হযরত ওমরের সময়‘ কোদামাত ইবনে মাযয়ূন ’ নামক একব্যক্তি মদ পান করেছিল। ওমর তার উপর শরীয়তের বিধান প্রয়োগ করতে চেয়েছিল ( অর্থাৎ এক্ষেত্রে ৮০ টি চাবুক মারতে হবে ) । কোদামা বলল : আমার উপর চাবুক প্রয়োগ করা অপরিহার্য নয়। কারণ ,মহান আল্লাহ্ বলেন : যারা ঈমান এনেছে এবং সত্য কর্ম করেছে ,তারা যতক্ষণ পর্যন্ত তাকওয়া অবলম্বন ও সৎকর্ম করতে থাকবে ,তারা যা ভক্ষণ করে তার জন্য তাদের কোন আশঙ্কা বা ভয় নেই। ২১ওমর তাকে শাস্তি প্রযোগ থেকে বিরত থাকল। হযরত আলীর নিকট এ সংবাদ পৌঁছল। তিনি ওমরের নিকট গেলেন এবং ওমরের নিকট জানতে চাইলেন ,কেন আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করনি ?ওমর প্রাগুক্ত আয়াতটি পাঠ করল। ইমাম বললেন : কোদামাহ এ আয়াতের অন্তর্ভূক্ত নয়। কারণ ,যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ও কল্যাণকর্ম সম্পাদন করে ,তারা আল্লাহর হারামকে হালাল করে না ;কোদামাহকে ফিরিয়ে আন এবং ওকে তওবা করতে বল। যদি তওবা করে তবে তার উপর আল্লাহর বিধান প্রয়োগ কর। নতুবা তাকে হত্যা করতে হবে। কারণ মদ পানের নিষিদ্ধতাকে অস্বীকার করে সে ইসলাম থেকে বহিস্কৃত হয়েছে।কোদামাহ একথা শুনে ফিরে এসে তওবা করল এবং পাপাচার থেকে বিরত থাকল। কিন্তু ওমর জানতো না যে ,তার শাস্তির পরিমাণ কতটুতু হবে। সুতরাং ইমাম আলীর নিকট জিজ্ঞাসা করেছিল। তিনি বললেন : আশিটি চবুক। ২২হযরত ওসমানের সময়আল্লামা মাজলিসি কাশশাফ ,ছা ’ লাবী ও খতিবের ‘ আরবাইন ’ থেকে বর্ণনা করেছেন যে ,এক নারী ওসমানের সময় ছয় মাসে বাচ্চা জন্ম দিয়েছিল। ওসমান ব্যভিচারের হদ জারি করার হুকুম দিল। কারণ ,হতে পারে এ বাচ্চা তার স্বামী থেকে নয় এবং সে পূর্বেই কারো মাধ্যমে অন্তঃসত্তা হয়েছিল। তাই তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল।ইমাম এ ঘটনা শুনে ওসমানকে বললেন : আমি মহান আল্লাহর কিতাব নিয়ে এ ব্যাপারে তোমার সাথে বিতর্ক করতে চাই। কারণ মহান আল্লাহ্ এক আয়াতে অন্তঃসত্তা থেকে দুগ্ধ পান করানো পর্যন্ত ত্রিশ মাস সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন :) وحمله و فصاله ثلاثون شهرا (গর্ভ ধারণ থেকে স্তন্য পান সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত ,সময় হলো ত্রিশ মাস। (সূরা আহকাফ : ১৫)। অন্যত্র স্তন্য পানের সময়কাল ২৪ মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে।যেমন :) والوالدات يرضعن اولادهنّ حولين كاملين لمن اراد ان يتمّ الرّضاعة (‘ যে স্তন্য কাল পূর্ণ করতে চায় তার জন্য জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দুই বৎসর স্তন্য পান করাবে (সূরা বাকারা : ২৩৩)। ’অতএব ,যদি নিশ্চিতরূপে চব্বিশ মাস নির্ধারিত হয়ে থাকে ,তবে প্রথম আয়াতের মতে যে গর্ভধারণ ও স্তন্য প্রদানের মোট সময় কাল ত্রিশ মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে ,এতদুভয়ের অন্তর ছয় মাস হয়ে থাকে ,যা গর্ভধারণের সর্বনিম্নকাল। অতএব ,এ নারী কোরআনের মতে কোন প্রকার পাপাচারে লিপ্ত হয়নি...।অতঃপর ওসমানের আদেশে তাকে মুক্তি দেয়া হলো। জ্ঞানীগণ ও আমাদের ফকীহগণ এ দু ’ আয়াত ব্যবহার করেই গর্ভধারণের সর্বনিম্ন সময় কাল ছয় মাস বলে জানেন। অর্থাৎ স্বীয় বৈধ পিতার বীর্য থেকে ছয় মাসে বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তা অপেক্ষা কম সময়ে বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করতে পারে না। হযরত আলীর মতও এরকমই ছিল।হযরত আলীর (আ.)-এর শাহাদাতচল্লিশ হিজরীতে খারেজীদের একদল মক্কায় মিলিত হলো এবং চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা করেছিল যে ,হযরত আলীকে ,মুয়াবিয়াকে ও আমর ইবনে আসকে যথাক্রমে কুফা ,শাম ও মিশরে নির্দিষ্ট সময়ে হত্যা করবে। পবিত্র রমযান মাসের ১৯ তারিখের রাত্রে হত্যার তারিখ নির্ধারণ করা হলো। এ পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য নির্বাহীও যথাক্রমে এরূপে নির্দিষ্ট করা হলো : আবদুর রহমান (মুলজামের পুত্র) হযরত আলীকে হত্যা করবে ,মুয়াবিয়াকে হত্যা করবে হাজ্জাজ (আবদুল্লাহ্ সূরাইমীর পুত্র) এবং আমর আসকে হত্যা করবে আমর (বাকর তামীমীর পুত্র)।এ উদ্দেশ্যে ইবনে মুলজাম কুফায় আসল। কিন্তু কাউকেই সে তার স্বীয় নোংরা উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেনি। একদা একজন খারেজীর গৃহে আশ্রয় নিল। কোতামাহর (সুদর্শনা ও মনোহারীণী রমনী) সাথে সাক্ষাৎ লাভের পর ,তার প্রতি আকৃষ্ট হলো। অতঃপর তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করল। যখন তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিল ,সে বলল : ‘ আমার মোহরানা হবে তিন হাজার দেরহাম ,এক গোলাম এবং আলী ইবনে আবি তালিবের হত্যা। ’ কোতামাহ পূর্ব থেকেই নাহরাওয়ানের যুদ্ধে তার পিতা ও ভাই ,হযরত আলীর হাতে নিহত হওয়ার ফলে তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করত এবং চরম প্রতিহিংসায় জ্বলছিল। ইবনে মুলজাম ,কোতামাহর কাছে ব্যক্ত করেছিল যে ,ঘটনাক্রমে আমি এ কর্ম সম্পাদনের জন্যেই কুফায় এসেছি ?আর এভাবেই ইবনে মুলজামের পূর্ব পরিকল্পনা কোতামাহর কামাতুর প্রেমের ছোঁয়ায় দৃঢ়তর হলো।অবশেষে সে বিষাদ রজনী উপস্থিত হলো ইবনে মুলজাম তার দু ’ একজন একান্ত সহযোগীর সাথে ,এ কলুষ চিন্তা মাথায় নিয়ে মসজিদে রাত্রিযাপন করল...। ২৩এ বিষাদময় রজনীর ত্রিশ বছরের ও অধিক পূর্বে হযরত আলী (আ.) মহানবীর নিকটে জানতে পেরেছিলেন যে ,তিনি রমযান মাসে শহীদ হবেন। এ ব্যাপারটি হযরত আলীর নিকট শুনবো :...যখন মহানবী (সা.) রমযান মাসের ঐ বিখ্যাত খোতবাটি পাঠ করলেন ,আমি উঠে দাঁড়ালাম ও জানতে চাইলাম : হে আল্লাহর রসূল (সা.)! এ মাসের উৎকৃষ্ট কর্মসমূহ কি কি ?তিনি বললেন : পাপাচার থেকে দূরে থাকা। অতঃপর মহানবী (সা.) বেদনাগ্রস্থ হয়ে কাঁদলেন এবং এ মাসে আমার শাহাদাত সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করলেন...। ২৪ইমামের কথাবার্তা ও আচার-আচরণেও সুস্পষ্ট ছিল যে ,এ মাসে তিনি শাহাদাত বরণ করবেন ,একথা তিনি জানতেন। ঐ বছরেই তিনি বলেছিলেন : ‘ এ বছর হজের সময় আমি তোমাদের মাঝে থাকব না।অনুরূপ তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো : কেন ইফতারের সময় সল্প খাবার গ্রহণ করেন ?তখন তিনি বলতেন : খালি পেটে মহান আল্লাহর সাক্ষাতে যেতে চাই। ২৫কিন্তু ঊনিশের রাত্রিতে বিন্দুমাত্র নিদ্রা গ্রহণ করেন নি। অধিকাংশ সময় বলতেন : আল্লাহর শপথ ,মিথ্যা বলব না ও আমাকেও মিথ্যা বলা হয়নি ,‘ অদ্যরজনী সে প্রতিশ্রুত রজনী। ২৬অবশেষে ঐ প্রাতে যখন হযরত আলী (আ.) মসজিদে এলেন। ফজরের নামায পড়া অবস্থায় নিকৃষ্টতম ব্যক্তি ইবনে মুলজামের বিষাক্ত রক্তলোলুপ তরাবারি হযরত আলীর উপর হানা হলো। আর সেই সাথে সত্যের মেহরাবে রঞ্জিত হলো বিভাকর। এর দু ’ দিন পর একুশে রমযানের রাত্রিতে চল্লিশ হিজরী সনে অস্তমিত হলো রঞ্জিত রবি। ২৭তাঁর পবিত্র দেহ নাজাফের পবিত্র মাটিতে সমাহিত করা হলো ,যা আজ মুসলমানদের বিশেষ করে শিয়াদের হৃদয় মণিতে পরিণত হয়েছে।ইমাম যেরূপ আজীবন মহান আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে বেঁচে ছিলেন ,ঐ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার সময়ও আল্লাহর স্মরণেই ছিলেন। ...যখন ইবনে মুলজামের তরবারি তাঁর দীপ্তিময় মাথায় আঘাত হানল ,তখন প্রথম যে কথাটি তিনি উচ্চারণ করেছিলেন তা হলো :فزت وربّ الكعبة“ কাবার প্রভুর শপথ ,আমি সফলকাম হলাম। ”অতঃপর তাঁকে রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় গৃহে নিয়ে আসা হলো...। শাহাদাতের শয্যায় দু ’ দিন পর চির নিদ্রায় চক্ষু মুদন করলেন। ...তিনি প্রতিটি মুহূর্তে তারপরও মানুষের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের চিন্তায় ছিলেন। ...যদি ও ইমাম হাসান (আ.) এবং তদনুরূপ ইমাম হোসাইন (আ.) ও দ্বাদশ ইমাম পর্যন্ত তাঁর সন্তানগণের ইমামত সম্পর্কে নবী (সা.) ও আলী (আ.) থেকে পূর্বেও একাধিক বার বর্ণিত হয়েছিল ,তথাপি কর্তব্য সমাপনার্থে জীবনের অন্তিম লগ্নগুলোতে পুনরায় তা মানুষের জন্য বর্ণনা করলেন...। ২৮অন্তিম বাণীজীবনের শেষ লগ্নগুলোতে সন্তানসন্ততি ও পরিবার-পরিজন এবং মুসলমানদের জন্য এরূপ অসিয়ত করলেন :“ তোমাদেরকে সংযমের দিকে আহবান জানাব এবং তোমরা তোমাদের কর্মগুলোকে বিন্যস্ত কর। সর্বদা মুসলমানদের সংশোধন ও সংস্কারের চিন্তায় থেকো...। অনাথদেরকে বিস্মৃত হয়ো না ;প্রতিবেশীদের অধিকার সংরক্ষণ করো। কোরআনকে জীবনের কর্মসূচী হিসাবে গ্রহণ কর।الله الله في الصّلاة فانّها عمود دينكم“ নামাযকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করো ,যা তোমাদের দ্বীনের স্তম্ভ। ”মহান আল্লাহর পথে তোমাদের ধন-সম্পদ ,বক্তব্য ও জীবন দিয়ে জিহাদ ও ত্যাগ তিতীক্ষা করো।পরস্পর মিলেমিশে থেকো সৎ কর্মের আদেশ ও অসৎ কর্মে নিষেধ করা থেকে বিরত থেক না। কেননা ,যদি প্রভুর প্রদত্ত এ কর্তব্য পালনে অসচেতন থাক ,তবে সমাজে নিকৃষ্টজন তোমাদের উপর শাসন করবে ,আর তখন যতই তাদেরকে অভিশম্পাত কর না কেন ,তা গৃহিত হবে না। ২৯আল্লাহর সন্তুষ্টি বর্ষিত হোক এ মহান পবিত্র ইমামের উপর। আর অব্যাহত থাকুক তাঁর জন্য পবিত্রগণের ও সৎকর্মশীলদের দরূদ ,যিনি ছিলেন অসাধারণ। আর তিনি তো বিশ্বের বিস্ময় ,বিস্ময়কর তার জীবন ব্যবস্থা ,বিস্ময়কর তার বিদায়।তথ্যসূত্র১ . বিহারুল আনওয়ার ,৩৫তম খণ্ড ,পৃ. ৮।২ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ৩।৩ . নাহজুল বালাগা ,খোতবা নং ২৩৪- এর কিছু অংশ ,পৃ. ৮০২।৪ . সীরাতে ইবনে হিশাম ,১ম খণ্ড ,পৃ. ২৪৫। অনুরূপ আল গাদীর ,৩য় খণ্ড ,পৃ.২২০-২৪০ তে আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহ থেকে অনেক রেওয়ায়েত উল্লিখিত আছে।৫ . তারিখে তাবারি ,৩য় খণ্ড ,পৃ. ১১৭১-১১৭৪ ,এছাড়া মাজমায়ুল বায়ান ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ২০৬ দ্রষ্টব্য।৬ . তাবিখে তাবারি ,৩য় খণ্ড ,পৃ. ১২৩২-১২৩৪।৭ . প্রাগুক্ত ,পৃ. ১২৩২-১২৩৪।৮ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ২২-২৩।৯ .প্রাগুক্ত ,পৃ. ৪৩-৪৫।১০ .বিহারুল আনওয়ার ,২০তম খণ্ড ,পৃ. ২০৫।১১ .এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ৫৭- ৫৮১২ .প্রাগুক্ত ,পৃ. ১৫-১৬।১৩ . ( النبیُّ اولی بالمؤمنين من انفسهم ) সূরা আহযাব : ৬।১৪ . আল গাদীর ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৯-১১।১৫ . ওসায়েল ,১১তম খণ্ড ,পৃ. ৭৯।১৬ . প্রাগুক্ত ,পৃ. ৮০।১৭ .মুরুজুয যাহাব ,২য় খণ্ড ,পৃ. ২৯৮।১৮ .প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩০৪।১৯ .প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩৩১।২০ . ইহতিজাযে তাবরিসি ,নতুন সংস্করণ ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৩১২।২১ . সূরা মায়িদাহ : ৯৩।২২ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ৯৭ ।২৩ . প্রাগুক্ত ,পৃ. ৯।২৪ . উয়ুনু আখবারির রিজা ,১ম খণ্ড ,পৃ. ২৯৭।২৫ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ১৫১।২৬ . প্রাগুক্ত ,পৃ. ৮।২৭ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ৫ ;বিহারুল আনওয়ার ,৪২তম খণ্ড ,পৃ. ২৮১।২৮ . প্রাগুক্ত ।২৯ . নাহজুল বালাগাহ ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৪৭ ,দামেস্ক থেকে প্রকাশিত (লক্ষণীয় যে ,এ অসিয়তের মূলবক্তব্য সংক্ষিপ্তাকারে প্রাসঙ্গিকরূপে অনুবাদ করা হয়েছে)।

সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা
আলী ইবনে আবি তালিবের শাহাদাতের পর ,একদা হামদান গোত্রের সাওদা (আম্মারের কন্যা) নামক এক নারী মুয়াবিয়ার নিকট গিয়েছিল। মুয়াবিয়া সাওদার কঠোর পরিশ্রমের কথা (যা সিফ্ফীনের যুদ্ধে হযরত আলী ও তাঁর সৈন্যদের জন্য করেছিল) স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে ভর্ৎসনা করল অতঃপর তার নিকট জানতে চাইল : কি জন্যে এখানে  এসেছে ?সাওদা জবাবে বলল : হে মুয়াবিয়া! মহান আল্লাহ্ আমাদের অধিকার হরণের জন্য তোমাকে জিজ্ঞাসা করবেন ,তুমি সর্বদা আমাদের জন্য এমন শাসক নির্বাচন করছ ,যে আমাদেরকে ফসলের মত কর্তন করে ,এসপান্দের বীজের মত পদদলিত করে এবং আমাদেরকে হত্যা করে। এখন এই বুসর ইবনে আরতাতকে পাঠিয়েছ ,যে আমাদের লোকদেরকে হত্যা করে ,আমাদের সম্পদ ছিনেয়ে নেয় ;যদি কেন্দ্রীয় শাসনের অনুসরণ না করতে চাইতাম ,তবে এখন আমি সম্মান ও ক্ষমতার অধিকারী হতাম ;যদি ওকে পদচ্যুত কর ,তবে তো উত্তম ;আর যদি না কর ,তবে ‘ স্বয়ং আমরাই বিদ্রোহ ও অভ্যূত্থান করব...। মুয়াবিয়া অস্বস্থি বোধ করল এবং বলল : আমাকে স্বীয় গোত্রের ভয় দেখাচ্ছ ,তোমাকে নিকৃষ্টতম অবস্থায় ঐ বুসরের কাছেই প্রেরণ করব ,যাতে তোমার জন্য যা সে উপযুক্ত মনে করবে তাই করে।

সাওদা কিছুক্ষণ নীরব থাকল ,যেন তার স্মৃতিপটে অতীতের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠল ;অতঃপর এ পংক্তিগুলো আবৃতি করল :

প্রভু হে ! তাঁর উপর শান্তি কর বর্ষণ

যে শায়িত আজ কবরে ,

যার মৃত্যুর সাথে যুগপৎ

ন্যায় ও আদালতের হয়েছে সমাধি।

সে তো সত্যের দিশারী

সত্যকে কভু করেনি কোন কিছুর বিনিময়ে পরিহার

সত্য ও বিশ্বাসের ,তাঁরই মাঝে ছিল সমাহার

মুয়াবিয়া জিজ্ঞাসা করল : সে কে ?

সাওদা জবাবে বলল : আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)। মনে পড়ে ,একদা যাকাত গ্রহণের জন্যে নিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্যে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছিলাম। আমি যখন পৌঁছলাম তখন তিনি নামাযে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু যখনই আমাকে দেখলেন নামায শুরু না করে উদার ও দয়াদ্র কন্ঠে আমাকে বললেন : কিছু বলবে কি ?বললাম : জী হ্যাঁ এবং আমার অভিযোগ উপস্থাপন করলাম। ঐ মহান ব্যক্তি স্বীয় নামাযের স্থানে দাঁড়িয়েই ক্রন্দন করলেন এবং মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললেন : ‘ প্রভু হে ,তুমি জেনে রাখ ও সাক্ষী থাক যে ,আমি কখনোই তাকে (আদিষ্ট) তোমার বান্দাদের প্রতি অত্যাচারের নির্দেশ দেইনি। অতঃপর তিনি ,অবিলম্বে এক চিলতে চামড়া বের করলেন এবং মহান আল্লাহর নাম ও কোরআনের আয়াত লিখার পর এরূপ লিখেছিলেন :

আমার পত্র পাঠ করার সাথে সাথেই তোমার হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন কর ,যাতে কাউকে তোমার পরিবর্তে পাঠানোর পর ঐগুলো তোমার নিকট থেকে বুঝে নিতে পারে...।

তিনি পত্রখানা আমাকে দিলেন। আল্লাহর শপথ ,ঐ পত্রখানা বন্ধ কিংবা মোহরাংকিতও ছিল না। পত্রখানা ঐ দায়িত্বশীলের নিকট পৌঁছালাম এবং সে পদচ্যুত হল ও আমাদের নিকট থেকে চলে গেল... । ’

‘ মুয়াবিয়া এ কাহিনী শ্রবণান্তে নিরুপায় হয়ে আদেশ দিল ,“ যা সে চায় ,তা-ই তার জন্য লিখে দাও। ”

আলী (আ.) ও খলিফাত্রয়
মহানবী (সা.) যখন তাঁর দয়ালু আঁখিযুগল বাহ্যতঃ পৃথিবী থেকে নির্লিপ্ত করলেন এবং যখন তার অস্তিত্বের জ্যোতির্ময় নক্ষত্র মানুষের দৃষ্টিসীমা থেকে অস্তমিত হলো ,তখন কিছু কপট ‘ সাকিফায়ে বনি সায়েদায় ’ মিলিত হলো এবং মহানবী (সা.) যে হযরত আলীকে মহান আল্লাহর আদেশক্রমে স্বীয় উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন ,তা তারা আবু বকরের (আবু কোহাফার পুত্র) অধিকারে ন্যস্ত করল। তারপর যথাক্রমে ওমর ও ওসমান মোটামুটি একই ধরনের চক্রান্ত ও পরিকল্পনার মাধ্যমে খেলাফতের অধিকারী হয়েছিল। আর এভাবেই অবিরাম ২৫ বছর ধরে তারা নবী (সা.)-এর তিরোধানের পর মানুষের উপর হুকুমত করেছিল। স্বভাবতঃই এ সুদীর্ঘ সময় ব্যাপী অদ্বিতীয় ও সর্বাধিক যোগ্য ,ঐশী ও ইসলামী হুকুমতের প্রকৃত নেতা এবং নবী (সা.)-এর উত্তরাধিকারী অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণ পথপ্রদর্শক হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ধৈর্য ও স্থৈর্যের আশ্রয় নিলেন ও নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখলেন। আর এ ঘটনাটি মানবতার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা দুঃখজনক কাহিনী। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা ,এমন কি যাদের কোন দীন নেই তারাও ইসলামের পথে হযরত আলীর অক্লান্ত শ্রম ও প্রচেষ্টা ,তাঁর সরলতা ,নির্মলতা ,বিরত্ব ,চিন্তা শক্তি ,জ্ঞানের বিস্তৃতি ,ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের কথা জানলে ,ইসলামী সমাজের ভাগ্যে তারা যে অন্যায় ও অত্যাচারের কালিমা লেপন করেছে তার জন্য অপ্রত্যাশিত ভাবে অনুতাপ ও পরিতাপ করে। তাহলে সুবিচারক মুসলমানদের ক্ষেত্রে কি ঘটবে! এ মর্মান্তিক ঘটনার জন্য আমাদের দুঃখ ও পরিতাপ সুদীর্ঘ পর্বত শ্রেণীর চেয়েও বিস্তৃততর ,সুউচ্চ পর্বত চূড়ার চেয়েও উচ্চতর।

যাহোক ,আবু বকর দশম হিজরীতে খলিফা হলো এবং ত্রয়োদশ হিজরীতে ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করল। আর ইতোমধ্যেই তার খেলাফতের দু ’ বছর ,তিন মাস দশ দিন অতিবাহিত হলো। ১৭

তার পর ওমর ইবনে খাত্তাব খেলাফত লাভ করল এবং জিলহজ মাসের শেষ দিকে তেইশ হিজরীতে ‘ আবু লুলু ফিরোজের ’ হাতে নিহত হয়েছিল। তার খেলাফত কাল ছিল দশ বছর ছয় মাস চার দিন। ১৮

ওমর নিজের পর খলিফা নির্বাচনের জন্য একটি পরিষদ গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল ,যা ওসমান ইবনে আফফানের পক্ষে গিয়েছিল। সে ওমরের পর ,পরিষদের মাধ্যমে চব্বিশ হিজরীর মহরম মাসের প্রথম দিকে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। অতঃপর পয়ত্রিশ হিজরীর জিলহজ মাসে অন্যায় আচরণের কারণে একদল মুসলমানের হাতে নিহত হয়। তার খেলাফত কাল ছিল বার বছর (কয়েকদিন কম)। ১৯

মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আলী (আ.) স্বেচ্ছাচারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন ,যারা তাঁর অধিকার পদদলিত করেছিল এবং ইসলামী বিধান যতটুকু অনুমতি দেয় ,তার সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত যথাসাধ্য প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। একই সাথে বক্তব্য ও দলিলের মাধ্যমে বিষয়টিকে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছিলেন এবং মানুষকে অবহিত করেছিলেন যে ,এরা হলো খেলাফতের অধিকার হরণকারী। বেহেশতে নারীদের নেত্রী হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) এ ক্ষেত্রে ইমাম আলীর সহকারী ও সহযোগী ছিলেন এবং কার্যক্ষেত্রে আবু বকরের হুকুমতকে অবৈধ বলে বর্ণনা করেছেন।

সালমান ,আবু যার ,মেকদাদ ও আম্মার ইয়াসিরের মত প্রিয় নবীর একদল সম্মানিত সাহাবী আবেগময় বক্তব্যের মাধ্যমে আবু বকরের শাসন ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন এবং মহানবীর উত্তরসূরী হিসেবে হযরত আলীর অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছিলেন। তবে হযরত আলী (আ.) ইসলামের কল্যাণার্থে ,আর যেহেতু ইসলামের তখনো নব ও বিকাশমান অবস্থা ,এবং তখনও ইসলাম যথেষ্ট পরিমাণে সুস্থিত হয়নি ,সেহেতু তরবারি হাতে তুলে নেন নি বা সমরাগ্নি জ্বালানো থেকে বিরত থেকেছিলেন। (স্বভাবতই এর ফলে ইসলামেরই ক্ষতি হতো এবং মহানবীর সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারত) বরং অপরিহার্য পরিস্থিতিতে আলী (আ.) ইসলামের সম্মান অক্ষুন্ন রক্ষার্থে কোন প্রকার দিক নির্দেশনা ও পরামর্শ দিতে কুন্ঠাবোধ করেন নি। আর তাই দ্বিতীয় খলিফা প্রায়ই বলত :

لو لا عليّ لهلك عمر

‘ যদি আলী না থাকত তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত। ’

ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কিংবা অন্য যে কোন সমস্যা যা তাদেরকে হতবুদ্ধি ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করত সেক্ষেত্রে  হযরত আলীর সুনির্দেশনা ও সদুপদেশ ,তাদেরকে তা থেকে উদ্ধার করত। সকল ক্ষেত্রে তারা প্রায় আলীর দিকনির্দেশনা ,মহত্ব ও জ্ঞানের কথা তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এখন আমরা এ ধরনের কিছু ঘটনা  উল্লেখ করব।

হযরত আবু বকরের সময়
ইহুদীদের কিছু আলেম আবু বকরের নিকট এসেছিল এবং তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল : আমরা তৌরাতে পড়েছি যে নবীর উত্তরসূরী হবে সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী ব্যক্তি ,যদি তুমি এ উম্মতের নবীর উত্তরসূরী হয়ে থাক ,তবে আমাদেরকে বল যে ,আল্লাহ্ কি আকাশে আছেন ,না ভূপৃষ্ঠে ?

আবু বকর জবাব দিল : তিনি আকাশে আরশের উপর অধিষ্ঠিত আছেন।

তারা বলল : তাহলে ভূপৃষ্ঠে তিনি নেই। সুতরাং জানা গেল যে ,তিনি কোথাও আছেন আবার কোথাও বা নেই।

আবু বকর বলল : এটা কাফেরদের কথা। দূর হও ,নতুবা তোমাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিব।

তারা ইসলামকে উপহাস করতে করতে ফিরে যাচ্ছিল। হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) তাদের একজনকে ডেকে বললেন : আমি জানি ,তোমরা কী জিজ্ঞাসা করেছ এবং কী জবাব পেয়েছ ;তবে জেনে রাখ যে ইসলাম বলে : মহান আল্লাহ্ স্বয়ং স্থানের অস্তিত্ব দানকারী ,সুতরাং তিনি কোন স্থানে সীমাবদ্ধ নন এবং কোন স্থান তাঁকে ধারণ করতে অক্ষম ;কোন প্রকার সংলগ্ন ও স্পর্শ ব্যতীতই তিনি সর্বত্র বিরাজমান এবং তাঁর জ্ঞান সবকিছুকেই পরিবেষ্টন করে আছে...।

ইহুদী পণ্ডিতগণ ইসলামে বিশ্বাস স্থাপন করলেন এবং বললেন : ‘ আপনিই নবীর উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য ,অন্য কেউ নয়। ২০

হযরত ওমরের সময়
‘ কোদামাত ইবনে মাযয়ূন ’ নামক একব্যক্তি মদ পান করেছিল। ওমর তার উপর শরীয়তের বিধান প্রয়োগ করতে চেয়েছিল ( অর্থাৎ এক্ষেত্রে ৮০ টি চাবুক মারতে হবে ) । কোদামা বলল : আমার উপর চাবুক প্রয়োগ করা অপরিহার্য নয়। কারণ ,মহান আল্লাহ্ বলেন : যারা ঈমান এনেছে এবং সত্য কর্ম করেছে ,তারা যতক্ষণ পর্যন্ত তাকওয়া অবলম্বন ও সৎকর্ম করতে থাকবে ,তারা যা ভক্ষণ করে তার জন্য তাদের কোন আশঙ্কা বা ভয় নেই। ২১

ওমর তাকে শাস্তি প্রযোগ থেকে বিরত থাকল। হযরত আলীর নিকট এ সংবাদ পৌঁছল। তিনি ওমরের নিকট গেলেন এবং ওমরের নিকট জানতে চাইলেন ,কেন আল্লাহর বিধান প্রয়োগ করনি ?ওমর প্রাগুক্ত আয়াতটি পাঠ করল। ইমাম বললেন : কোদামাহ এ আয়াতের অন্তর্ভূক্ত নয়। কারণ ,যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ও কল্যাণকর্ম সম্পাদন করে ,তারা আল্লাহর হারামকে হালাল করে না ;কোদামাহকে ফিরিয়ে আন এবং ওকে তওবা করতে বল। যদি তওবা করে তবে তার উপর আল্লাহর বিধান প্রয়োগ কর। নতুবা তাকে হত্যা করতে হবে। কারণ মদ পানের নিষিদ্ধতাকে অস্বীকার করে সে ইসলাম থেকে বহিস্কৃত হয়েছে।

কোদামাহ একথা শুনে ফিরে এসে তওবা করল এবং পাপাচার থেকে বিরত থাকল। কিন্তু ওমর জানতো না যে ,তার শাস্তির পরিমাণ কতটুতু হবে। সুতরাং ইমাম আলীর নিকট জিজ্ঞাসা করেছিল। তিনি বললেন : আশিটি চবুক। ২২

হযরত ওসমানের সময়
আল্লামা মাজলিসি কাশশাফ ,ছা ’ লাবী ও খতিবের ‘ আরবাইন ’ থেকে বর্ণনা করেছেন যে ,এক নারী ওসমানের সময় ছয় মাসে বাচ্চা জন্ম দিয়েছিল। ওসমান ব্যভিচারের হদ জারি করার হুকুম দিল। কারণ ,হতে পারে এ বাচ্চা তার স্বামী থেকে নয় এবং সে পূর্বেই কারো মাধ্যমে অন্তঃসত্তা হয়েছিল। তাই তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল।

ইমাম এ ঘটনা শুনে ওসমানকে বললেন : আমি মহান আল্লাহর কিতাব নিয়ে এ ব্যাপারে তোমার সাথে বিতর্ক করতে চাই। কারণ মহান আল্লাহ্ এক আয়াতে অন্তঃসত্তা থেকে দুগ্ধ পান করানো পর্যন্ত ত্রিশ মাস সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন :

) وحمله و فصاله ثلاثون شهرا (

গর্ভ ধারণ থেকে স্তন্য পান সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত ,সময় হলো ত্রিশ মাস। (সূরা আহকাফ : ১৫)। অন্যত্র স্তন্য পানের সময়কাল ২৪ মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

যেমন :

) والوالدات يرضعن اولادهنّ حولين كاملين لمن اراد ان يتمّ الرّضاعة (

‘ যে স্তন্য কাল পূর্ণ করতে চায় তার জন্য জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দুই বৎসর স্তন্য পান করাবে (সূরা বাকারা : ২৩৩)। ’

অতএব ,যদি নিশ্চিতরূপে চব্বিশ মাস নির্ধারিত হয়ে থাকে ,তবে প্রথম আয়াতের মতে যে গর্ভধারণ ও স্তন্য প্রদানের মোট সময় কাল ত্রিশ মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে ,এতদুভয়ের অন্তর ছয় মাস হয়ে থাকে ,যা গর্ভধারণের সর্বনিম্নকাল। অতএব ,এ নারী কোরআনের মতে কোন প্রকার পাপাচারে লিপ্ত  হয়নি...।

অতঃপর ওসমানের আদেশে তাকে মুক্তি দেয়া হলো। জ্ঞানীগণ ও আমাদের ফকীহগণ এ দু ’ আয়াত ব্যবহার করেই গর্ভধারণের সর্বনিম্ন সময় কাল ছয় মাস বলে জানেন। অর্থাৎ স্বীয় বৈধ পিতার বীর্য থেকে ছয় মাসে বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তা অপেক্ষা কম সময়ে বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করতে পারে না। হযরত আলীর মতও এরকমই ছিল।

হযরত আলীর (আ.)-এর শাহাদাত
চল্লিশ হিজরীতে খারেজীদের একদল মক্কায় মিলিত হলো এবং চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা করেছিল যে ,হযরত আলীকে ,মুয়াবিয়াকে ও আমর ইবনে আসকে যথাক্রমে কুফা ,শাম ও মিশরে নির্দিষ্ট সময়ে হত্যা করবে। পবিত্র রমযান মাসের ১৯ তারিখের রাত্রে হত্যার তারিখ নির্ধারণ করা হলো। এ পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য নির্বাহীও যথাক্রমে এরূপে নির্দিষ্ট করা হলো : আবদুর রহমান (মুলজামের পুত্র) হযরত আলীকে হত্যা করবে ,মুয়াবিয়াকে হত্যা করবে হাজ্জাজ (আবদুল্লাহ্ সূরাইমীর পুত্র) এবং আমর আসকে হত্যা করবে আমর (বাকর তামীমীর পুত্র)।

এ উদ্দেশ্যে ইবনে মুলজাম কুফায় আসল। কিন্তু কাউকেই সে তার স্বীয় নোংরা উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেনি। একদা একজন খারেজীর গৃহে আশ্রয় নিল। কোতামাহর (সুদর্শনা ও মনোহারীণী রমনী) সাথে সাক্ষাৎ লাভের পর ,তার প্রতি আকৃষ্ট হলো। অতঃপর তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করল। যখন তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিল ,সে বলল : ‘ আমার মোহরানা হবে তিন হাজার দেরহাম ,এক  গোলাম এবং আলী ইবনে আবি তালিবের হত্যা। ’ কোতামাহ পূর্ব থেকেই নাহরাওয়ানের যুদ্ধে তার পিতা ও ভাই ,হযরত আলীর হাতে নিহত হওয়ার ফলে তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করত এবং চরম প্রতিহিংসায় জ্বলছিল। ইবনে মুলজাম ,কোতামাহর কাছে ব্যক্ত করেছিল যে ,ঘটনাক্রমে আমি এ কর্ম সম্পাদনের জন্যেই কুফায় এসেছি ?আর এভাবেই ইবনে মুলজামের পূর্ব পরিকল্পনা কোতামাহর কামাতুর প্রেমের ছোঁয়ায় দৃঢ়তর হলো।

অবশেষে সে বিষাদ রজনী উপস্থিত হলো ইবনে মুলজাম তার দু ’ একজন একান্ত সহযোগীর সাথে ,এ কলুষ চিন্তা মাথায় নিয়ে মসজিদে রাত্রিযাপন করল...। ২৩

এ বিষাদময় রজনীর ত্রিশ বছরের ও অধিক পূর্বে হযরত আলী (আ.) মহানবীর নিকটে জানতে পেরেছিলেন যে ,তিনি রমযান মাসে শহীদ হবেন। এ ব্যাপারটি হযরত আলীর নিকট শুনবো :...যখন মহানবী (সা.) রমযান মাসের ঐ বিখ্যাত খোতবাটি পাঠ করলেন ,আমি উঠে দাঁড়ালাম ও জানতে চাইলাম : হে আল্লাহর রসূল (সা.)! এ মাসের উৎকৃষ্ট কর্মসমূহ কি কি ?তিনি বললেন : পাপাচার থেকে দূরে থাকা। অতঃপর মহানবী (সা.) বেদনাগ্রস্থ হয়ে কাঁদলেন এবং এ মাসে আমার শাহাদাত সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করলেন...। ২৪

ইমামের কথাবার্তা ও আচার-আচরণেও সুস্পষ্ট ছিল যে ,এ মাসে তিনি শাহাদাত বরণ করবেন ,একথা তিনি জানতেন। ঐ বছরেই তিনি বলেছিলেন : ‘ এ বছর হজের সময় আমি তোমাদের মাঝে থাকব না।

অনুরূপ তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো : কেন ইফতারের সময় সল্প খাবার গ্রহণ করেন ?তখন তিনি বলতেন : খালি পেটে মহান আল্লাহর সাক্ষাতে যেতে চাই। ২৫

কিন্তু ঊনিশের রাত্রিতে বিন্দুমাত্র নিদ্রা গ্রহণ করেন নি। অধিকাংশ সময় বলতেন : আল্লাহর শপথ ,মিথ্যা বলব না ও আমাকেও মিথ্যা বলা হয়নি ,‘ অদ্যরজনী সে প্রতিশ্রুত রজনী। ২৬

অবশেষে ঐ প্রাতে যখন হযরত আলী (আ.) মসজিদে এলেন। ফজরের নামায পড়া অবস্থায় নিকৃষ্টতম ব্যক্তি ইবনে মুলজামের বিষাক্ত রক্তলোলুপ তরাবারি হযরত আলীর উপর হানা হলো। আর সেই সাথে সত্যের মেহরাবে রঞ্জিত হলো বিভাকর। এর দু ’ দিন পর একুশে রমযানের রাত্রিতে চল্লিশ হিজরী সনে অস্তমিত হলো রঞ্জিত রবি। ২৭

তাঁর পবিত্র দেহ নাজাফের পবিত্র মাটিতে সমাহিত করা হলো ,যা আজ মুসলমানদের বিশেষ করে শিয়াদের হৃদয় মণিতে পরিণত হয়েছে।

ইমাম যেরূপ আজীবন মহান আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে বেঁচে ছিলেন ,ঐ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার সময়ও আল্লাহর স্মরণেই ছিলেন। ...যখন ইবনে মুলজামের তরবারি তাঁর দীপ্তিময় মাথায় আঘাত হানল ,তখন প্রথম যে কথাটি তিনি উচ্চারণ করেছিলেন তা হলো :

فزت وربّ الكعبة

“ কাবার প্রভুর শপথ ,আমি সফলকাম হলাম। ”

অতঃপর তাঁকে রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় গৃহে নিয়ে আসা হলো...। শাহাদাতের শয্যায় দু ’ দিন পর চির নিদ্রায় চক্ষু মুদন করলেন। ...তিনি  প্রতিটি মুহূর্তে তারপরও মানুষের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের চিন্তায় ছিলেন। ...যদি ও ইমাম হাসান (আ.) এবং তদনুরূপ ইমাম হোসাইন (আ.) ও দ্বাদশ ইমাম পর্যন্ত তাঁর সন্তানগণের ইমামত সম্পর্কে নবী (সা.) ও আলী (আ.) থেকে পূর্বেও একাধিক বার বর্ণিত হয়েছিল ,তথাপি কর্তব্য সমাপনার্থে জীবনের অন্তিম লগ্নগুলোতে পুনরায় তা মানুষের জন্য বর্ণনা করলেন...। ২৮

অন্তিম বাণী
জীবনের শেষ লগ্নগুলোতে সন্তানসন্ততি ও পরিবার-পরিজন এবং মুসলমানদের জন্য এরূপ অসিয়ত করলেন :

“ তোমাদেরকে সংযমের দিকে আহবান জানাব এবং তোমরা তোমাদের কর্মগুলোকে বিন্যস্ত কর। সর্বদা মুসলমানদের সংশোধন ও সংস্কারের চিন্তায় থেকো...। অনাথদেরকে বিস্মৃত হয়ো না ;প্রতিবেশীদের অধিকার সংরক্ষণ করো। কোরআনকে জীবনের কর্মসূচী হিসাবে গ্রহণ কর।

الله الله في الصّلاة فانّها عمود دينكم

“ নামাযকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করো ,যা তোমাদের দ্বীনের স্তম্ভ। ”

মহান আল্লাহর পথে তোমাদের ধন-সম্পদ ,বক্তব্য ও জীবন দিয়ে জিহাদ ও ত্যাগ তিতীক্ষা করো।

পরস্পর মিলেমিশে থেকো সৎ কর্মের আদেশ ও অসৎ কর্মে নিষেধ করা থেকে বিরত থেক না। কেননা ,যদি প্রভুর প্রদত্ত এ কর্তব্য পালনে অসচেতন থাক ,তবে সমাজে নিকৃষ্টজন তোমাদের উপর শাসন করবে ,আর তখন যতই তাদেরকে অভিশম্পাত কর না কেন ,তা গৃহিত হবে না। ২৯

আল্লাহর সন্তুষ্টি বর্ষিত হোক এ মহান পবিত্র ইমামের উপর। আর অব্যাহত থাকুক তাঁর জন্য পবিত্রগণের ও সৎকর্মশীলদের দরূদ ,যিনি ছিলেন অসাধারণ। আর তিনি তো বিশ্বের বিস্ময় ,বিস্ময়কর তার জীবন ব্যবস্থা ,বিস্ময়কর তার বিদায়।

তথ্যসূত্র
১ . বিহারুল আনওয়ার ,৩৫তম খণ্ড ,পৃ. ৮।

২ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ৩।

৩ . নাহজুল বালাগা ,খোতবা নং ২৩৪- এর কিছু অংশ ,পৃ. ৮০২।

৪ . সীরাতে ইবনে হিশাম ,১ম খণ্ড ,পৃ. ২৪৫। অনুরূপ আল গাদীর ,৩য় খণ্ড ,পৃ.২২০-২৪০ তে আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহ থেকে অনেক রেওয়ায়েত উল্লিখিত আছে।

৫ . তারিখে তাবারি ,৩য় খণ্ড ,পৃ. ১১৭১-১১৭৪ ,এছাড়া মাজমায়ুল বায়ান ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ২০৬ দ্রষ্টব্য।

৬ . তাবিখে তাবারি ,৩য় খণ্ড ,পৃ. ১২৩২-১২৩৪।

৭ . প্রাগুক্ত ,পৃ. ১২৩২-১২৩৪।

৮ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ২২-২৩।

৯ .প্রাগুক্ত ,পৃ. ৪৩-৪৫।

১০ .বিহারুল আনওয়ার ,২০তম খণ্ড ,পৃ. ২০৫।

১১ .এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ৫৭- ৫৮

১২ .প্রাগুক্ত ,পৃ. ১৫-১৬।

১৩ . ( النبیُّ اولی بالمؤمنين من انفسهم ) সূরা আহযাব : ৬।

১৪ . আল গাদীর ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৯-১১।

১৫ . ওসায়েল ,১১তম খণ্ড ,পৃ. ৭৯।

১৬ . প্রাগুক্ত ,পৃ. ৮০।

১৭ .মুরুজুয যাহাব ,২য় খণ্ড ,পৃ. ২৯৮।

১৮ .প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩০৪।

১৯ .প্রাগুক্ত ,পৃ. ৩৩১।

২০ . ইহতিজাযে তাবরিসি ,নতুন সংস্করণ ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৩১২।

২১ . সূরা মায়িদাহ : ৯৩।

২২ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ৯৭ ।

২৩ . প্রাগুক্ত ,পৃ. ৯।

২৪ . উয়ুনু আখবারির রিজা ,১ম খণ্ড ,পৃ. ২৯৭।

২৫ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ১৫১।

২৬ . প্রাগুক্ত ,পৃ. ৮।

২৭ . এরশাদ ,শেখ মুফিদ ,পৃ. ৫ ;বিহারুল আনওয়ার ,৪২তম খণ্ড ,পৃ. ২৮১।

২৮ . প্রাগুক্ত ।

২৯ . নাহজুল বালাগাহ ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৪৭ ,দামেস্ক থেকে প্রকাশিত (লক্ষণীয় যে ,এ অসিয়তের মূলবক্তব্য সংক্ষিপ্তাকারে প্রাসঙ্গিকরূপে অনুবাদ করা হয়েছে)।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202