সবার কাছে মিনতি আপনারা মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ পড়বেনহযরত আলী (আ.)এর ফযিলত ও মর্যাদাহযরত আলী ইবন আবী তালিব (আ.) কোরায়েশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন আবু তালিব (আ.) আর মাতার ফাতিমা বিনতে আসাদ । শিশু বয়স থেকেই তিনি হযরত মুহাম্মদের কাছে লালিত-পালিত হন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি নবুয়তের ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন।তার ফযিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সা.)থেকে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে নিম্নে তার কিছু আলোচনা করা হল।১। রাসূল (সা.) আলী (আ.)-এর কাঁধে হাত রেখে বলেছেন :هذا إمام البررة قاتل الفجرة منصور من نصره,مخذول من خذله“এই আলী সৎ কর্মশীলদের ইমাম,অন্যায়কারীদের হন্তা,যে তাকে সাহায্য করবে সে সাফল্য লাভ করবে (সাহায্য প্রাপ্ত হবে) এবং যে তাকে হীন করার চেষ্টা করবে সে নিজেই হীন হবে।”হাদীসটি হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় জাবের বিন আবদুল্লাহ্ আনসারী হতে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন,“এই হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।”২। নবী (সা.) বলেছেন,“আলী সম্পর্কে আমার প্রতি তিনটি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে :إِنَّهٌ سيّد الْمسلمين و إمام الْمتّقين و قائد الغرّ الْمُحجّلينনিশ্চয়ই সে মুসলমানদের নেতা,মুত্তাকীদের ইমাম এবং নূরানী ও শুভ্র মুখমণ্ডলের অধিকারীদের সর্দার।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩৮ পৃষ্ঠায় হাদীসটি এনেছেন ও বলেছেন,“হাদীসটি সনদের দিক হতে বিশুদ্ধ কিন্তু বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।”৩। নবী (সা.) বলেছেন,“আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে যে,আলী মুসলমানদের নেতা,মুত্তাকীদের অভিভাবক এবং শুভ্র ও উজ্জ্বল কপালের অধিকারীদের (সৌভাগ্যবানদের) সর্দার।” ইবনে নাজ্জার ও অন্যান্য সুনান লেখকগণ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।৪। নবী হযরত আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,مرحبا بسيّد المسلمين و إمام المتقين“হে মুসলমানদের নেতা ও মুত্তাকীদের ইমাম! তোমাকে সাধুবাদ।” আবু নাঈম তাঁর ‘হুলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে এটি বর্ণনা করেছেন।৫। একদিন রাসূল (সা.) ঘোষণা করলেন,“প্রথম যে ব্যক্তি এ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে সে মুত্তাকীদের ইমাম,মুসলমানদের নেতা,দীনের মধুমক্ষিকা (সংরক্ষণকারী),সর্বশেষ নবীর প্রতিনিধি ও উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের অধিকারীদের সর্দার।” তখন আলী ঐ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে নবী (সা.) তাঁকে এ সুসংবাদ দানের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করলেন ও তাঁর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,“তুমি আমার ঋণ পরিশোধ করবে,আমার বাণী মানুষের নিকট পৌঁছে দেবে,যে বিষয়ে তারা মতদ্বৈততা করবে তুমি তা ব্যাখ্যা করে বোঝাবে।৬। নবী (সা.) বলেছেন,“আল্লাহ্ আমার নিকট আলীকে এভাবে বর্ণনা করেছেন-আলী হেদায়েতের ধ্বজাধারী,আমার আউলিয়া অর্থাৎ বন্ধুদের ইমাম,আমার আনুগত্যকারীদের আলোকবর্তিকা এবং সে এমন এক আদর্শ মুত্তাকীদের উচিত অপরিহার্যরূপে যার পদাঙ্কনুবর্তী হওয়া।”লক্ষ্য করুন এই ছয়টি সহীহ হাদীস তাঁর ইমামত ও আনুগত্যের অপরিহার্যতাকে কিরূপে সুস্পষ্ট করছে! তাঁর ওপর সালাম বর্ষিত হোক।৭। নবী (সা.) আলীর প্রতি ইশারা করে বলেন,“এই প্রথম ব্যক্তি যে আমার প্রতি ঈমান এনেছে ও প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সে কিয়ামতে আমার সঙ্গে হাত মিলাবে,সে সিদ্দীকে আকবর ও ফারুক (এই উম্মতের সত্যপন্থী ও অসত্যপন্থীদের মধ্যে পার্থক্যকারী),সে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সীমারেখা টানবে এবং সে মুমিনদের সংরক্ষণকারী।”৮। নবী বলেছেন,“হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা কি চাও তোমাদের আমি এমন বিষয়ের প্রতি নির্দেশনা দেব যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনো গোমরাহ ও বিপথগামী হবে না? সেটি হলো আলী। আমাকে তোমরা যেরূপ ভালবাস তাকেও সেরূপ ভালবাস। আমাকে যেরূপ শ্রদ্ধা কর তাকেও সেরূপ শ্রদ্ধা ও সম্মান কর এবং আমি তোমাদের যা বলছি তা আল্লাহ্ জিবরাঈলের মাধ্যমে আমাকে বলতে নির্দেশ দিয়েছেন।”৯। নবী (সা.) বলেছেন,أنا مدينة العلم و عليّ بابُها فمن أراد المدينة فليأت الباب“আমি জ্ঞানের শহর ও আলী তার দ্বার এবং যে কেউ শহরে প্রবেশ করতে চাইলে দ্বার দিয়েই প্রবেশ করবে।”১০। নবী (সা.) বলেছেন,أنا دار الحكمة و عليّ بابُها “আমি প্রজ্ঞার ঘর আলী তার দরজা।”১১। নবী (সা.) বলেছেন,“আলী আমার জ্ঞানের প্রবেশ দ্বার ও আমি যে বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি আমার পরে আমার উম্মতের জন্য সে তার ব্যাখ্যাকারী। তার ভালবাসা ও বন্ধুত্বই ঈমান এবং তার শত্রুতাই নিফাক।”১২। নবী (সা.) আলীকে বলেন,“তুমি আমার পর উম্মত যে বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২২ পৃষ্ঠায় আনাস ইবনে মালিক হতে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যে,বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি বিশুদ্ধ তদুপরি তাঁরা তা বর্ণনা করেন নি।আমার মতে যে কেউ এই হাদীস এবং এর অনুরূপ অন্যান্য হাদীস নিয়ে চিন্তা করলে দেখবেন (বুঝবেন),আলী (আ.)-এর সঙ্গে রাসূলের সম্পর্ক রাসূলের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্কের ন্যায়। কারণ নবীকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,“আমি আপনার প্রতি এ জন্যই গ্রন্থ নাযিল করেছি যাতে আপনি সরল পথ প্রদর্শনের জন্য যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে সে বিষয় পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেন এবং এই কোরআন মুমিনদের জন্য রহমত ও হেদায়েতের উপকরণ।” নবীও আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,“তুমি আমার পর যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী (তাদের জন্য পরিষ্কারভাবে তা বর্ণনাকারী)।”১৩। নবী (সা.) হতে আরেকটি হাদীস যা মারফু (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে ইবনে সাম্মাক আবু বকর হতে বর্ণনা করেছেন,عليّ منّي بِمنْزلتي من ربّي অর্থাৎ আলীর স্থান আমার নিকট আমার প্রতিপালকের নিকট আমার স্থান ও মর্যাদার ন্যায়।১৪। দারে কুতনী তাঁর ‘কিতাবুল আফরাদ’ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস সূত্রে রাসূল হতে বর্ণনা করেছেন,“আলী ইবনে আবি তালিব ক্ষমার দ্বার। যে কেউ এ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে সে মুমিন,আর কেউ তা হতে বের হয়ে গেলে সে কাফের।”১৫। নবী (সা.) বিদায় হজ্বের সময় আরাফাতের ময়দানে বলেন,“আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। আমার পক্ষ হতে ঐশী বাণী পৌঁছানোর অধিকার কারো নেই একমাত্র আলী ব্যতীত।”এই হলো সম্মানিত রাসূলের কথা যিনি শক্তিমান ও আরশের অধিপতির নিকট বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ্ তাঁর সম্পর্কে যেমনটি বলেছেন,তিনি বিশ্বস্ত,তোমাদের নবী উন্মাদ নন,তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কিছু বলেন না,বরং তিনি তাই বলেন যা তাঁর প্রতি ওহী হিসেবে অবতীর্ণ হয়। যেহেতু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই সেহেতু এই সহীহ হাদীস সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? এ বিষয়ে আর কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ আছে কি? যদি আল্লাহর মহান বাণী প্রচারের এই গুরু দায়িত্বের বিষয়ে আপনি চিন্তা করেন এবং বড় হজ্বের সময়ে তা বর্ণনার পেছনে যে হেকমত লুকিয়ে রয়েছে সে বিষয়ে যথাযথ দৃষ্টি দেন তাহলে সত্য আপনার নিকট তার প্রকৃতরূপে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।যদি এই বাণীর শব্দগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেন,দেখবেন বাণীটি কতটা অর্থবহ এবং উন্নত ও গভীর। কারণ রাসূল (সা.) সবদিক বিবেচনা করে দেখেছেন বিষয়টির গুরুত্বের কারণে আলী ব্যতীত অন্য কেউ সঠিকভাবে এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয় এবং নবীর পক্ষ হতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি,খলীফা ও প্রশাসনিক দায়িত্বসম্পন্ন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নন।সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর যিনি আমাদের হেদায়েত করেছেন এবং তিনি হেদায়েত না করলে আমরা কখনো হেদায়েত পেতাম না।১৬। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,“যে আমার আনুগত্য করলো সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো,আর যে আমার বিরোধিতা করলো সে আল্লাহরই বিরোধিতা করলো। আর যে আলীর আনুগত্য করেছে সে যেন আমারই আনুগত্য করেছে,আর যে তার বিরোধিতা করেছে সে আমারই বিরোধিতা করেছে।” হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২১ পৃষ্ঠায় এবং যাহাবী তাঁর ‘তালখিসে মুসতাদরাক’-এ হাদীসটি এনে বলেছেন যে,বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ।১৭। নবী (সা.) বলেছেন,“হে আলী! যে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হলো সে আল্লাহ্ হতেই বিচ্ছিন্ন হলো আর যে আলী হতে বিচ্ছিন্ন হলো সে আমা হতেই বিচ্ছিন্ন হলো।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাকুস্ সহীহাইন’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৪ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যদিও হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেননি।১৮। উম্মে সালামাহ্ রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“যে কেউ আলীকে মন্দ নামে সম্বোধন করলো সে যেন আমাকেই মন্দ নামে সম্বোধন করলো।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২১ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি বিশুদ্ধ বলেছেন। যাহাবীও তাঁর ‘তালখিস’ গ্রন্থে হাদীসটি বিশুদ্ধ বলে স্বীকার করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৩২৩ পৃষ্ঠায় এবং নাসায়ী তাঁর ‘খাসায়েসুল আলাভীয়া’ গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় উম্মে সালামাহ্ হতে এবং অন্যান্য হাদীসবিদগণও এটি বর্ণনা করেছেন। এরূপ অপর একটি হাদীস যা আমর ইবনে শাশ নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন তা হলো : যে কেউ আলীকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল।১৯। নবী (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আলীকে ভালবাসে সে যেন আমাকেই ভালবেসেছে,আর যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে সে আমার সঙ্গেই শত্রুতা পোষণ করেছে।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩০ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ বলেছেন। যাহাবীও তাঁর ‘তালখিস’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে বিশুদ্ধ বলেছেন।আলী নিজেও বলেছেন,“সেই সত্তার শপথ,যিনি বীজ অঙ্কুরিত এবং মানুষের আত্মাকে সৃষ্টি করেন,উম্মী নবী (সা.) এই কথা বলেছেন যে,মুমিন ব্যতীত আমাকে (আলীকে) কেউ ভালবাসবে না এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ আমার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে না।”২০। নবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বলেন,يا عليّ أنت سيّد في الدّنيا و سيّد في الآخرة,حبيبك حبِيبِي و حبيبِي حبيب الله و عدوّك عدوّي و عدوّي عدوّ الله و الويل لمن أبغضك بعدي“হে আলী! তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে নেতা,তোমার বন্ধু আমার বন্ধু এবং আমার বন্ধু আল্লাহর বন্ধু। তোমার শত্রু আমার শত্রু এবং আমার শত্রু আল্লাহর শত্রু। ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য যে আমার পর তোমার সঙ্গে শত্রুতা করবে।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৮ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।২১। নবী (সা.) বলেছেন,“হে আলী! সৌভাগ্য সেই ব্যক্তির যে তোমাকে ভালবাসে ও তোমার বিষয়ে সত্য বলে এবং দুর্ভাগ্য সেই ব্যক্তির যে তোমার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে ও তোমার নামে মিথ্যা ছড়ায়।”হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩৫ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যদিও হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত তবুও বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।২২। নবী (সা.) বলেছেন,من أراد أن يحيى حياتي و يموت ميتتي و يسكن جنّة الخلد الّتي وعدني ربّى فليتول عليّ بن أبي طالب فإنّه لن يخرجكم من هدى و لن يدخلكم في ضلالة“যে চায় তার জীবন আমার জীবনের মত ও মুত্যু আমার মৃত্যুর মত হোক এবং চায় যে চিরস্থায়ী বেহেশতের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন সেখানে থাকতে,তার উচিত আলী ইবনে আবি তালিবের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয়া। সে তাকে কখনোই হেদায়েতের পথ হতে বিচ্যুত করবে না এবং গোমরাহীর পথেও নিয়ে যাবে না।”২৩। নবী (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আমার প্রতি ঈমান এনেছে ও আমাকে সত্যায়ন করেছে তার প্রতি আমার উপদেশ হলো সে যেন আলীর অভিভাবকত্বকে গ্রহণ করে। যে কেউ তার বেলায়েতকে গ্রহণ করবে সে প্রকৃতপক্ষে আমার অভিভাবকত্বকেই মেনে নিল। আর যে আমার অভিভাবকত্ব মেনে নিল সে আল্লাহরই অভিভাবকত্বকে গ্রহণ করে নিল। যে ব্যক্তি তাকে ভালবাসল সে যেন আমাকেই ভালবাসল আর যে আমাকে ভালবাসল সে আল্লাহকেই ভালবাসল। যে ব্যক্তি তার প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে সে মূলত আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে আর যে আমার প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে সে আল্লাহর প্রতিই শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে।”২৪। নবী (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আশা করে আমার ন্যায় জীবন যাপন ও আমার ন্যায় মৃত্যুবরণ করার এবং সেই চিরস্থায়ী বেহেশতে বসবাসের আকাঙ্ক্ষী হয় যার বৃক্ষসমূহকে আমার প্রতিপালক বপন করেছেন,সে যেন আমার পর আলীর অভিভাবকত্বকে গ্রহণ করে ও তার উত্তরাধিকারীর বেলায়েতকেও মেনে নেয়। সে যেন আমার পর আমার আহলে বাইতের অনুসরণ করে কারণ তারা আমার ইতরাত (রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়) ও আমা হতেই তাদের সৃষ্টি। আমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আল্লাহ্ তাদের রিযিক হিসেবে দিয়েছেন। দুর্ভাগ্য আমার উম্মতের সেই লোকদের যারা তাদের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করে এবং আমার ও তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের সৃষ্টি করে। আল্লাহর শাফায়াত হতে তারা বঞ্চিত।”২৫। নবী (সা.) বলেছেন,“যে কেউ পছন্দ করে আমার মত জীবন যাপন করতে ও আমার ন্যায় মৃত্যুবরণ করতে এবং সেই চিরস্থায়ী বেহেশত যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন তার অধিবাসী হতে সে যেন আমার পর আলী ও তার বংশধরদের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয়। তারা তোমাদেরকে হেদায়েতের দ্বার হতে বহিষ্কার করবে না এবং গোমরাহীর পথেও পরিচালিত করবে না।”২৬। নবী (সা.) হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে বলেন,“হে আম্মার! যখন দেখবে আলী এক পথে চলছে আর লোকেরা অন্য পথে। আলীর সঙ্গে যাও ও অন্যদের ত্যাগ কর। কারণ সে তোমাকে পতনের পথে পরিচালিত করবে না এবং হেদায়েতের পথ হতেও বের করে দেবে না।”২৭। রাসূল (সা.) হতে হযরত আবু বকর বর্ণনা করেছেন,“রাসূল (সা.) বলেছেন : আমার ও আলীর হাত ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সমান।”২৮। নবী (সা.) ফাতিমা (আ.)-কে বলেন,“হে ফাতিমা! তুমি এই বিয়েতে (আলীর সাথে) সন্তুষ্ট কি? (জেনে রাখ) আল্লাহ্ পৃথিবীবাসীদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবং দু’ব্যক্তিকে তাদের হতে মনোনীত করলেন,যার একজন তোমার পিতা,অন্যজন তোমার স্বামী।”২৯। নবী (সা.) বলেছেন,أنا المنذر و عليّ الهاد وبك يا عليّ يهتدي المهتدون من بعدي“আমি ভয়প্রদর্শনকারী এবং আলী হেদায়েতকারী। হে আলী! আমার পর তোমার মাধ্যমেই হেদায়েতপ্রাপ্তগণ হেদায়েত পাবে।”৩০। নবী (সা.) বলেছেন,يا عليّ لا يحل لأحد أن يجنب في المسجد غيري و غيرك“হে আলী! আমি ও তুমি ব্যতীত মসজিদে কারো অপবিত্র হওয়া জায়েয হবে না।”অনুরূপ একটি হাদীস যা তাবরানী হযরত উম্মে সালামাহ্ এবং সা’দের সূত্রে নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“আমি ও আলী ব্যতীত এ মসজিদে কারো অপবিত্র হওয়া বৈধ হবে না।” ৩১। নবী (সা.) বলেছেন,أنا و هذا يعني عليّا حجة على أمّتي يوم القيامة“আমি ও এই ব্যক্তি (আলী) কিয়ামত দিবসে আমার উম্মতের জন্য দলিল।”খাতীব বাগদাদী হযরত আনাস হতে হাদীসটি বর্ণনা করছেন। কিরূপে সম্ভব যে,আবুল হাসান আলী ইবনে আবি তালিব রাসূলের মত উম্মতের জন্য দলিল হবেন অথচ তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও অভিভাবক হিসেবে উম্মতের পরিচালক ও নির্দেশক হবেন না?৩২। নবী (সা.) বলেছেন,“বেহেশতের দ্বারে লেখা রয়েছে :لا إله إلّا الله محمّد رّسول الله عليّ أخو رسول اللهআল্লাহ্ ব্যতীত উপাস্য নেই,মুহাম্মদ তাঁর রাসূল এবং আলী রাসূলের ভ্রাতা।”৩৩। নবী (সা.) বলেছেন,“আরশের পাদদেশে লেখা রয়েছে আল্লাহ্ ছাড়া উপাস্য নেই,মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁকে আমি আলীর মাধ্যমে সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছি।”৩৪। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি নূহের লক্ষ্যের দৃঢ়তা,আদমের জ্ঞানের গভীরতা,ইবরাহীমের সহিষ্ণুতা,মূসার বুদ্ধিমত্তা ও ঈসার আত্মসংযম (দুনিয়া বিমুখতা) দেখতে চায় সে যেন আলীর প্রতি লক্ষ্য করে।” ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে এবং বায়হাকী তাঁর ‘সহীহ’তে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।৩৫। রাসূল (সা.) আলীকে বলেছেন,“হে আলী! তোমার মধ্যে ঈসার নিদর্শনসমূহ রয়েছে,যে নিদর্শনের কারণে ইহুদীরা তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করতঃ তাঁর মাতাকে অপবাদ দিয়েছে ও নাসারারা তাঁর প্রতি ভালবাসার বশবর্তী হয়ে তাঁকে আল্লাহর স্থানে বসিয়েছে।”৩৬। নবী (সা.) বলেছেন, السّبق ثلاثة السّابق إلى موسى يوشع بن نون و السّابق إلى عيسى صاحب ياسين و السّابق إلى محمّد عليّ بن أبى طالب“অগ্রগামীরা তিন ব্যক্তি : মূসার অনুগামীদের মধ্যে অগ্রগামী হলেন ইউশা ইবনে নূন,ঈসার অনুগামীদের মধ্যে অগ্রগামী হলেন ইয়াসীনের অধিকারী এবং মুহাম্মদের অগ্রগামীদের প্রধান হলো আলী ইবনে আবি তালিব।” ৩৭। নবী বলেছেন,“তিন ব্যক্তি সিদ্দীক : হাবীব নাজ্জার (আলে ইয়াসীনের মুমিন ব্যক্তি) যিনি বলেছিলেন : হে আমার জাতি! আল্লাহর রাসূলদের আনুগত্য কর;হিযকীল (ফিরআউন বংশের মুমিন ব্যক্তি) যিনি বলেছিলেন : ঐ ব্যক্তিকে এ কারণেই কি তোমরা হত্যা করতে চাও যে,সে বলে : আমার প্রভু একমাত্র আল্লাহ্ এবং আলী ইবনে আবি তালিব যে তাঁদের সকল হতে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ।”৩৮। নবী (সা.) আলীকে বলেন,“আমার উম্মত অচিরেই তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে যদিও তখন তুমি আমার বিধানের ওপর জীবন যাপন করবে ও আমার সুন্নাহর ওপর মুত্যুবরণ করবে। যে কেউ তোমাকে ভালবাসবে সে যেন আমাকেই ভালবাসল আর যে তোমার সঙ্গে শত্রুতা করবে সে যেন আমার সঙ্গেই শত্রুতা করল। আমি দেখতে পাচ্ছি খুব নিকটেই তোমার শ্মশ্রু তোমার মস্তকের রক্তে রঞ্জিত হবে।” হযরত আলী (আ.) বলেন,“নবী (সা.) আমাকে যেসব বিষয়ে অবহিত করেন তার অন্যতম হলো এ উম্মত তাঁর পর আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।”ইবনে আব্বাস বলেন,“নবী (সা.) আলীকে বলেছেন : আমার পর খুব নিকটেই তুমি দুঃখ-কষ্টে পতিত হবে। আলী প্রশ্ন করলেন : তখন কি আমি দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকব? রাসূল (সা.) বললেন : হ্যাঁ,তখন তুমি সঠিক দীনের ওপরই থাকবে।”৩৯। নবী (সা.) একদিন সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন,“তোমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি রয়েছে যে কোরআনের ব্যাখ্যার জন্য যুদ্ধ করবে যেমনটি আমি এর অবতীর্ণ হবার জন্য যুদ্ধ ও প্রচেষ্টা চালিয়েছি।” আবু বকর ও উমরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সকলেই ঘাড় সজাগ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। হযরত আবু বকর বললেন,“আমি কি সেই ব্যক্তি?” রাসূল (সা.) বললেন,“না।” হযরত উমর বললেন,“আমি কি?” তিনি বললেন,“না,বরং সেই ব্যক্তি যে এখন তার জুতায় তালি দিচ্ছে (তখন আলী [আঃ] তাঁর জুতা সেলাই করছিলেন)।”আবু সাঈদ খুদরী বলেন,“আলীর নিকট গিয়ে এ সুসংবাদ দিলাম। তিনি তাঁর মাথা নীচু করেই রইলেন যেন তিনি রাসূল (সা.) হতে অসংখ্যবার একথা শুনেছেন।”অনুরূপ হাদীস আবু আইউব আনসারী খলীফা হযরত উমরের সময় বলেছেন,“রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আলীকে ‘নাকেসীন’ (প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী),‘মারেকীন’ (ধর্মচ্যুত) এবং ‘কাসেতীন’দের (সীমালঙ্ঘনকারী ও বিদ্রোহী) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ও তাদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।”(*২১) তদ্রুপ হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের হাদীসটিও। তিনি বলেন,“রাসূল (সা.) বলেছেন :يا عليّ ستقاتلك الفئة الباغية و أنت على الحق فمن لم ينصرك يومئذ ليس منّيহে আলী! শীঘ্রই একদল সীমালঙ্ঘনকারী (বিদ্রোহী) তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে যদিও তখন তুমি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যে ব্যক্তি তখন তোমাকে সাহায্য করবে না সে আমার অনুসারী নয়।”অনুরূপ একটি হাদীস হযরত আবু যর রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ নিবদ্ধ,তোমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি রয়েছে যে আমার পরে কোরআনের ব্যাখ্যার জন্য যুদ্ধ করবে যেমন আমি মুশরিকদের বিরুদ্ধে তা অবতীর্ণ হবার জন্য যুদ্ধ করেছি।”মুহাম্মদ ইবনে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে আবি রাফে তাঁর পিতার সূত্রে তাঁর দাদা আবু রাফে হতে বর্ণনা করেন,রাসূল (সা.) বলেছেন,“আমার পর একদল আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে,তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে সবার ওপর বাধ্যতামূলক। যে ব্যক্তি অস্ত্র হাতে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে অক্ষম সে যেন জিহ্বার দ্বারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে,তাতেও অক্ষম হলে সে যেন অন্তর দ্বারা (ঘৃণার মাধ্যমে) যুদ্ধ করে।”আখদ্বার আনসারী বলেন,“নবী করিম (সা.) বলেছেন : আমি কোরআন অবতীর্ণ হবার জন্য যুদ্ধ করেছি এবং আলী এর ব্যাখ্যার জন্য যুদ্ধ করবে।” ৪০। নবী (সা.) বলেছেন, يا عليّ أخصمك بالنّبوّة فلا نبوّة بعدي و تخصم النّاس بسبع أنت أوّلهم إيْمانا بالله و أوفاهم بعهد الله و أقسمهم بالسّويّة و أعدلهم في الرّعيّة و أعظمهم عند الله مزية“হে আলী,তোমার ওপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব হলো নবুওয়াতের কারণে এবং আমার পরে কোন নবী ও রাসূল নেই। আর সকল মানুষের ওপর তোমর সাতটি শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে,তুমি সর্বপ্রথম ব্যক্তি যে ঈমান এনেছ,তুমি আল্লাহর প্রতিশ্রুতি রক্ষার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে অগ্রগামী,তুমি সকল মানুষ হতে প্রত্যয়ী এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে সবার হতে অগ্রগামী,বায়তুল মাল বণ্টনে সর্বাধিক সমতা রক্ষাকারী,বিচার ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সকল হতে ন্যায় বিচারক,আল্লাহর নিকট সম্মানের ক্ষেত্রে সকলের চেয়ে নৈকট্যের অধিকারী।”আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেছেন,“রাসূল (সা.) বলেছেন : হে আলী! সাতটি বৈশিষ্ট্যের কারণে তুমি অন্যদের হতে শ্রেষ্ঠ,তুমি সর্বপ্রথম ঈমান আনয়নকারী,তাঁর প্রতি প্রতিশ্রুতি পালনকারী,তাঁর নির্দেশের ক্ষেত্রে সর্বাধিক দৃঢ়,জনগণের প্রতি সবচেয়ে দয়ালু,বিচারের ক্ষেত্রে পারদর্শী এবং জ্ঞান,বিদ্যা,দয়া,উদারতা ও সাহসিকতা ইত্যাদি যাবতীয় সৎ গুণের ক্ষেত্রে অন্য সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম।”আপনার নিকট এ সম্পর্কিত চল্লিশটি হাদীস বর্ণনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেগুলো এখানে লিপিবদ্ধ করেছি। এ হাদীসগুলো ছাড়াও সমার্থক ও সমমর্যাদার প্রচুর হাদীস রয়েছে (যেগুলো বর্ণনার সুযোগ এখানে নেই) যেগুলো থেকে বোঝা যায় এই উম্মতের মধ্যে রাসূলের পর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হলেন আলী ইবনে আবি তালিব এবং এ উম্মতের নেতৃত্বের দায়িত্ব রাসূলের পর একইভাবে আলীর ওপর অর্পিত হয়েছে।তাই শব্দগতভাবে সব হাদীস একই রকম না হলেও অর্থের দিক থেকে তা সমার্থক ও মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত। সুতরাং বিষয়টি আপনার নিকট অকাট্যরূপে প্রতিভাত হয়েছে বলে মনে করছি। আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসালনিবেদক______ কবির উদ্দিন

সবার কাছে মিনতি আপনারা মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ পড়বেন
হযরত আলী (আ.)এর ফযিলত ও মর্যাদা

হযরত আলী ইবন আবী তালিব (আ.)  কোরায়েশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন আবু তালিব (আ.) আর মাতার ফাতিমা বিনতে আসাদ । শিশু বয়স থেকেই তিনি হযরত মুহাম্মদের কাছে লালিত-পালিত হন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি নবুয়তের ডাকে সাড়া দিয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন।

তার ফযিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সা.)থেকে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে নিম্নে তার কিছু আলোচনা করা হল।

১। রাসূল (সা.) আলী (আ.)-এর কাঁধে হাত রেখে বলেছেন :

هذا إمام البررة قاتل الفجرة منصور من نصره,مخذول من خذله

“এই আলী সৎ কর্মশীলদের ইমাম,অন্যায়কারীদের হন্তা,যে তাকে সাহায্য করবে সে সাফল্য লাভ করবে (সাহায্য প্রাপ্ত হবে) এবং যে তাকে হীন করার চেষ্টা করবে সে নিজেই হীন হবে।”

হাদীসটি হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় জাবের বিন আবদুল্লাহ্ আনসারী হতে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন,“এই হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।”

২। নবী (সা.) বলেছেন,“আলী সম্পর্কে আমার প্রতি তিনটি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে :

إِنَّهٌ سيّد الْمسلمين و إمام الْمتّقين و قائد الغرّ الْمُحجّلين

নিশ্চয়ই সে মুসলমানদের নেতা,মুত্তাকীদের ইমাম এবং নূরানী ও শুভ্র মুখমণ্ডলের অধিকারীদের সর্দার।”

হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩৮ পৃষ্ঠায় হাদীসটি এনেছেন ও বলেছেন,“হাদীসটি সনদের দিক হতে বিশুদ্ধ কিন্তু বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।”

৩। নবী (সা.) বলেছেন,“আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে যে,আলী মুসলমানদের নেতা,মুত্তাকীদের অভিভাবক এবং শুভ্র ও উজ্জ্বল কপালের অধিকারীদের (সৌভাগ্যবানদের) সর্দার।” ইবনে নাজ্জার ও অন্যান্য সুনান লেখকগণ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৪। নবী হযরত আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

مرحبا بسيّد المسلمين و إمام المتقين

“হে মুসলমানদের নেতা ও মুত্তাকীদের ইমাম! তোমাকে সাধুবাদ।” আবু নাঈম তাঁর ‘হুলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে এটি বর্ণনা করেছেন।

৫। একদিন রাসূল (সা.) ঘোষণা করলেন,“প্রথম যে ব্যক্তি এ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে সে মুত্তাকীদের ইমাম,মুসলমানদের নেতা,দীনের মধুমক্ষিকা (সংরক্ষণকারী),সর্বশেষ নবীর প্রতিনিধি ও উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের অধিকারীদের সর্দার।” তখন আলী ঐ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে নবী (সা.) তাঁকে এ সুসংবাদ দানের উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করলেন ও তাঁর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,“তুমি আমার ঋণ পরিশোধ করবে,আমার বাণী মানুষের নিকট পৌঁছে দেবে,যে বিষয়ে তারা মতদ্বৈততা করবে তুমি তা ব্যাখ্যা করে বোঝাবে।

৬। নবী (সা.) বলেছেন,“আল্লাহ্ আমার নিকট আলীকে এভাবে বর্ণনা করেছেন-আলী হেদায়েতের ধ্বজাধারী,আমার আউলিয়া অর্থাৎ বন্ধুদের ইমাম,আমার আনুগত্যকারীদের আলোকবর্তিকা এবং সে এমন এক আদর্শ মুত্তাকীদের উচিত অপরিহার্যরূপে যার পদাঙ্কনুবর্তী হওয়া।”

লক্ষ্য করুন এই ছয়টি সহীহ হাদীস তাঁর ইমামত ও আনুগত্যের অপরিহার্যতাকে কিরূপে সুস্পষ্ট করছে! তাঁর ওপর সালাম বর্ষিত হোক।

৭। নবী (সা.) আলীর প্রতি ইশারা করে বলেন,“এই প্রথম ব্যক্তি যে আমার প্রতি ঈমান এনেছে ও প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সে কিয়ামতে আমার সঙ্গে হাত মিলাবে,সে সিদ্দীকে আকবর ও ফারুক (এই উম্মতের সত্যপন্থী ও অসত্যপন্থীদের মধ্যে পার্থক্যকারী),সে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সীমারেখা টানবে এবং সে মুমিনদের সংরক্ষণকারী।”

৮। নবী বলেছেন,“হে আনসার সম্প্রদায়! তোমরা কি চাও তোমাদের আমি এমন বিষয়ের প্রতি নির্দেশনা দেব যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনো গোমরাহ ও বিপথগামী হবে না? সেটি হলো আলী। আমাকে তোমরা যেরূপ ভালবাস তাকেও সেরূপ ভালবাস। আমাকে যেরূপ শ্রদ্ধা কর তাকেও সেরূপ শ্রদ্ধা ও সম্মান কর এবং আমি তোমাদের যা বলছি তা আল্লাহ্ জিবরাঈলের মাধ্যমে আমাকে বলতে নির্দেশ দিয়েছেন।”

৯। নবী (সা.) বলেছেন,

أنا مدينة العلم و عليّ بابُها فمن أراد المدينة فليأت الباب

“আমি জ্ঞানের শহর ও আলী তার দ্বার এবং যে কেউ শহরে প্রবেশ করতে চাইলে দ্বার দিয়েই প্রবেশ করবে।”

১০। নবী (সা.) বলেছেন,أنا دار الحكمة و عليّ بابُها “আমি প্রজ্ঞার ঘর আলী তার দরজা।”

১১। নবী (সা.) বলেছেন,“আলী আমার জ্ঞানের প্রবেশ দ্বার ও আমি যে বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি আমার পরে আমার উম্মতের জন্য সে তার ব্যাখ্যাকারী। তার ভালবাসা ও বন্ধুত্বই ঈমান এবং তার শত্রুতাই নিফাক।”

১২। নবী (সা.) আলীকে বলেন,“তুমি আমার পর উম্মত যে বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী।”

হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২২ পৃষ্ঠায় আনাস ইবনে মালিক হতে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যে,বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি বিশুদ্ধ তদুপরি তাঁরা তা বর্ণনা করেন নি।

আমার মতে যে কেউ এই হাদীস এবং এর অনুরূপ অন্যান্য হাদীস নিয়ে চিন্তা করলে দেখবেন (বুঝবেন),আলী (আ.)-এর সঙ্গে রাসূলের সম্পর্ক রাসূলের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্কের ন্যায়। কারণ নবীকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ্ বলেছেন,“আমি আপনার প্রতি এ জন্যই গ্রন্থ নাযিল করেছি যাতে আপনি সরল পথ প্রদর্শনের জন্য যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে সে বিষয় পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেন এবং এই কোরআন মুমিনদের জন্য রহমত ও হেদায়েতের উপকরণ।” নবীও আলীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,“তুমি আমার পর যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যাদানকারী (তাদের জন্য পরিষ্কারভাবে তা বর্ণনাকারী)।”

১৩। নবী (সা.) হতে আরেকটি হাদীস যা মারফু (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে ইবনে সাম্মাক আবু বকর হতে বর্ণনা করেছেন,عليّ منّي بِمنْزلتي من ربّي অর্থাৎ আলীর স্থান আমার নিকট আমার প্রতিপালকের নিকট আমার স্থান ও মর্যাদার ন্যায়।

১৪। দারে কুতনী তাঁর ‘কিতাবুল আফরাদ’ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস সূত্রে রাসূল হতে বর্ণনা করেছেন,“আলী ইবনে আবি তালিব ক্ষমার দ্বার। যে কেউ এ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে সে মুমিন,আর কেউ তা হতে বের হয়ে গেলে সে কাফের।”

১৫। নবী (সা.) বিদায় হজ্বের সময় আরাফাতের ময়দানে বলেন,“আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। আমার পক্ষ হতে ঐশী বাণী পৌঁছানোর অধিকার কারো নেই একমাত্র আলী ব্যতীত।”

এই হলো সম্মানিত রাসূলের কথা যিনি শক্তিমান ও আরশের অধিপতির নিকট বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ্ তাঁর সম্পর্কে যেমনটি বলেছেন,তিনি বিশ্বস্ত,তোমাদের নবী উন্মাদ নন,তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কিছু বলেন না,বরং তিনি তাই বলেন যা তাঁর প্রতি ওহী হিসেবে অবতীর্ণ হয়। যেহেতু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই সেহেতু এই সহীহ হাদীস সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? এ বিষয়ে আর কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ আছে কি? যদি আল্লাহর মহান বাণী প্রচারের এই গুরু দায়িত্বের বিষয়ে আপনি চিন্তা করেন এবং বড় হজ্বের সময়ে তা বর্ণনার পেছনে যে হেকমত লুকিয়ে রয়েছে সে বিষয়ে যথাযথ দৃষ্টি দেন তাহলে সত্য আপনার নিকট তার প্রকৃতরূপে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

যদি এই বাণীর শব্দগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেন,দেখবেন বাণীটি কতটা অর্থবহ এবং উন্নত ও গভীর। কারণ রাসূল (সা.) সবদিক বিবেচনা করে দেখেছেন বিষয়টির গুরুত্বের কারণে আলী ব্যতীত অন্য কেউ সঠিকভাবে এ দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয় এবং নবীর পক্ষ হতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি,খলীফা ও প্রশাসনিক দায়িত্বসম্পন্ন একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নন।

সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর যিনি আমাদের হেদায়েত করেছেন এবং তিনি হেদায়েত না করলে আমরা কখনো হেদায়েত পেতাম না।

১৬। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,“যে আমার আনুগত্য করলো সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো,আর যে আমার বিরোধিতা করলো সে আল্লাহরই বিরোধিতা করলো। আর যে আলীর আনুগত্য করেছে সে যেন আমারই আনুগত্য করেছে,আর যে তার বিরোধিতা করেছে সে আমারই বিরোধিতা করেছে।” হাকিম নিশাবুরী তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২১ পৃষ্ঠায় এবং যাহাবী তাঁর ‘তালখিসে মুসতাদরাক’-এ হাদীসটি এনে বলেছেন যে,বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ।

১৭। নবী (সা.) বলেছেন,“হে আলী! যে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হলো সে আল্লাহ্ হতেই বিচ্ছিন্ন হলো আর যে আলী হতে বিচ্ছিন্ন হলো সে আমা হতেই বিচ্ছিন্ন হলো।”

হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাকুস্ সহীহাইন’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৪ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যদিও হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে তদুপরি বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেননি।

১৮। উম্মে সালামাহ্ রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“যে কেউ আলীকে মন্দ নামে সম্বোধন করলো সে যেন আমাকেই মন্দ নামে সম্বোধন করলো।”

হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২১ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি বিশুদ্ধ বলেছেন। যাহাবীও তাঁর ‘তালখিস’ গ্রন্থে হাদীসটি বিশুদ্ধ বলে স্বীকার করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৩২৩ পৃষ্ঠায় এবং নাসায়ী তাঁর ‘খাসায়েসুল আলাভীয়া’ গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় উম্মে সালামাহ্ হতে এবং অন্যান্য হাদীসবিদগণও এটি বর্ণনা করেছেন। এরূপ অপর একটি হাদীস যা আমর ইবনে শাশ নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন তা হলো : যে কেউ আলীকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল।

১৯। নবী (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আলীকে ভালবাসে সে যেন আমাকেই ভালবেসেছে,আর যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে সে আমার সঙ্গেই শত্রুতা পোষণ করেছে।”

হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩০ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ বলেছেন। যাহাবীও তাঁর ‘তালখিস’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করে বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে বিশুদ্ধ বলেছেন।

আলী নিজেও বলেছেন,“সেই সত্তার শপথ,যিনি বীজ অঙ্কুরিত এবং মানুষের আত্মাকে সৃষ্টি করেন,উম্মী নবী (সা.) এই কথা বলেছেন যে,মুমিন ব্যতীত আমাকে (আলীকে) কেউ ভালবাসবে না এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ আমার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে না।”

২০। নবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বলেন,

يا عليّ أنت سيّد في الدّنيا و سيّد في الآخرة,حبيبك حبِيبِي و حبيبِي حبيب الله و عدوّك عدوّي و عدوّي عدوّ الله و الويل لمن أبغضك بعدي

“হে আলী! তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে নেতা,তোমার বন্ধু আমার বন্ধু এবং আমার বন্ধু আল্লাহর বন্ধু। তোমার শত্রু আমার শত্রু এবং আমার শত্রু আল্লাহর শত্রু। ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য যে আমার পর তোমার সঙ্গে শত্রুতা করবে।”

হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৮ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।

২১। নবী (সা.) বলেছেন,“হে আলী! সৌভাগ্য সেই ব্যক্তির যে তোমাকে ভালবাসে ও তোমার বিষয়ে সত্য বলে এবং দুর্ভাগ্য সেই ব্যক্তির যে তোমার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে ও তোমার নামে মিথ্যা ছড়ায়।”

হাকিম তাঁর ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১৩৫ পৃষ্ঠায় হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন যদিও হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত তবুও বুখারী ও মুসলিম তা বর্ণনা করেন নি।

২২। নবী (সা.) বলেছেন,

من أراد أن يحيى حياتي و يموت ميتتي و يسكن جنّة الخلد الّتي وعدني ربّى فليتول عليّ بن أبي طالب فإنّه لن يخرجكم من هدى و لن يدخلكم في ضلالة

“যে চায় তার জীবন আমার জীবনের মত ও মুত্যু আমার মৃত্যুর মত হোক এবং চায় যে চিরস্থায়ী বেহেশতের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন সেখানে থাকতে,তার উচিত আলী ইবনে আবি তালিবের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয়া। সে তাকে কখনোই হেদায়েতের পথ হতে বিচ্যুত করবে না এবং গোমরাহীর পথেও নিয়ে যাবে না।”

২৩। নবী (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আমার প্রতি ঈমান এনেছে ও আমাকে সত্যায়ন করেছে তার প্রতি আমার উপদেশ হলো সে যেন আলীর অভিভাবকত্বকে গ্রহণ করে। যে কেউ তার বেলায়েতকে গ্রহণ করবে সে প্রকৃতপক্ষে আমার অভিভাবকত্বকেই মেনে নিল। আর যে আমার অভিভাবকত্ব মেনে নিল সে আল্লাহরই অভিভাবকত্বকে গ্রহণ করে নিল। যে ব্যক্তি তাকে ভালবাসল সে যেন আমাকেই ভালবাসল আর যে আমাকে ভালবাসল সে আল্লাহকেই ভালবাসল। যে ব্যক্তি তার প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে সে মূলত আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে আর যে আমার প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে সে আল্লাহর প্রতিই শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে।”

২৪। নবী (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি আশা করে আমার ন্যায় জীবন যাপন ও আমার ন্যায় মৃত্যুবরণ করার এবং সেই চিরস্থায়ী বেহেশতে বসবাসের আকাঙ্ক্ষী হয় যার বৃক্ষসমূহকে আমার প্রতিপালক বপন করেছেন,সে যেন আমার পর আলীর অভিভাবকত্বকে গ্রহণ করে ও তার উত্তরাধিকারীর বেলায়েতকেও মেনে নেয়। সে যেন আমার পর আমার আহলে বাইতের অনুসরণ করে কারণ তারা আমার ইতরাত (রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়) ও আমা হতেই তাদের সৃষ্টি। আমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আল্লাহ্ তাদের রিযিক হিসেবে দিয়েছেন। দুর্ভাগ্য আমার উম্মতের সেই লোকদের যারা তাদের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করে এবং আমার ও তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের সৃষ্টি করে। আল্লাহর শাফায়াত হতে তারা বঞ্চিত।”

২৫। নবী (সা.) বলেছেন,“যে কেউ পছন্দ করে আমার মত জীবন যাপন করতে ও আমার ন্যায় মৃত্যুবরণ করতে এবং সেই চিরস্থায়ী বেহেশত যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন তার অধিবাসী হতে সে যেন আমার পর আলী ও তার বংশধরদের অভিভাবকত্বকে মেনে নেয়। তারা তোমাদেরকে হেদায়েতের দ্বার হতে বহিষ্কার করবে না এবং গোমরাহীর পথেও পরিচালিত করবে না।”

২৬। নবী (সা.) হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে বলেন,“হে আম্মার! যখন দেখবে আলী এক পথে চলছে আর লোকেরা অন্য পথে। আলীর সঙ্গে যাও ও অন্যদের ত্যাগ কর। কারণ সে তোমাকে পতনের পথে পরিচালিত করবে না এবং হেদায়েতের পথ হতেও বের করে দেবে না।”

২৭। রাসূল (সা.) হতে হযরত আবু বকর বর্ণনা করেছেন,“রাসূল (সা.) বলেছেন : আমার ও আলীর হাত ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সমান।”

২৮। নবী (সা.) ফাতিমা (আ.)-কে বলেন,“হে ফাতিমা! তুমি এই বিয়েতে (আলীর সাথে) সন্তুষ্ট কি? (জেনে রাখ) আল্লাহ্ পৃথিবীবাসীদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবং দু’ব্যক্তিকে তাদের হতে মনোনীত করলেন,যার একজন তোমার পিতা,অন্যজন তোমার স্বামী।”

২৯। নবী (সা.) বলেছেন,

أنا المنذر و عليّ الهاد وبك يا عليّ يهتدي المهتدون من بعدي

“আমি ভয়প্রদর্শনকারী এবং আলী হেদায়েতকারী। হে আলী! আমার পর তোমার মাধ্যমেই হেদায়েতপ্রাপ্তগণ হেদায়েত পাবে।”

৩০। নবী (সা.) বলেছেন,

يا عليّ لا يحل لأحد أن يجنب في المسجد غيري و غيرك

“হে আলী! আমি ও তুমি ব্যতীত মসজিদে কারো অপবিত্র হওয়া জায়েয হবে না।”

অনুরূপ একটি হাদীস যা তাবরানী হযরত উম্মে সালামাহ্ এবং সা’দের সূত্রে নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“আমি ও আলী ব্যতীত এ মসজিদে কারো অপবিত্র হওয়া বৈধ হবে না।” 

৩১। নবী (সা.) বলেছেন,

أنا و هذا يعني عليّا حجة على أمّتي يوم القيامة

“আমি ও এই ব্যক্তি (আলী) কিয়ামত দিবসে আমার উম্মতের জন্য দলিল।”

খাতীব বাগদাদী হযরত আনাস হতে হাদীসটি বর্ণনা করছেন। কিরূপে সম্ভব যে,আবুল হাসান আলী ইবনে আবি তালিব রাসূলের মত উম্মতের জন্য দলিল হবেন অথচ তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও অভিভাবক হিসেবে উম্মতের পরিচালক ও নির্দেশক হবেন না?

৩২। নবী (সা.) বলেছেন,“বেহেশতের দ্বারে লেখা রয়েছে :

لا إله إلّا الله محمّد رّسول الله عليّ أخو رسول الله

আল্লাহ্ ব্যতীত উপাস্য নেই,মুহাম্মদ তাঁর রাসূল এবং আলী রাসূলের ভ্রাতা।”

৩৩। নবী (সা.) বলেছেন,“আরশের পাদদেশে লেখা রয়েছে আল্লাহ্ ছাড়া উপাস্য নেই,মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁকে আমি আলীর মাধ্যমে সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছি।”

৩৪। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,“যে ব্যক্তি নূহের লক্ষ্যের দৃঢ়তা,আদমের জ্ঞানের গভীরতা,ইবরাহীমের সহিষ্ণুতা,মূসার বুদ্ধিমত্তা ও ঈসার আত্মসংযম (দুনিয়া বিমুখতা) দেখতে চায় সে যেন আলীর প্রতি লক্ষ্য করে।” ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে এবং বায়হাকী তাঁর ‘সহীহ’তে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

৩৫। রাসূল (সা.) আলীকে বলেছেন,“হে আলী! তোমার মধ্যে ঈসার নিদর্শনসমূহ রয়েছে,যে নিদর্শনের কারণে ইহুদীরা তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ করতঃ তাঁর মাতাকে অপবাদ দিয়েছে ও নাসারারা তাঁর প্রতি ভালবাসার বশবর্তী হয়ে তাঁকে আল্লাহর স্থানে বসিয়েছে।”

৩৬। নবী (সা.) বলেছেন,

 السّبق ثلاثة السّابق إلى موسى يوشع بن نون و السّابق إلى عيسى صاحب ياسين و السّابق إلى محمّد عليّ بن أبى طالب

“অগ্রগামীরা তিন ব্যক্তি : মূসার অনুগামীদের মধ্যে অগ্রগামী হলেন ইউশা ইবনে নূন,ঈসার অনুগামীদের মধ্যে অগ্রগামী হলেন ইয়াসীনের অধিকারী এবং মুহাম্মদের অগ্রগামীদের প্রধান হলো আলী ইবনে আবি তালিব।” 

৩৭। নবী বলেছেন,“তিন ব্যক্তি সিদ্দীক : হাবীব নাজ্জার (আলে ইয়াসীনের মুমিন ব্যক্তি) যিনি বলেছিলেন : হে আমার জাতি! আল্লাহর রাসূলদের আনুগত্য কর;হিযকীল (ফিরআউন বংশের মুমিন ব্যক্তি) যিনি বলেছিলেন : ঐ ব্যক্তিকে এ কারণেই কি তোমরা হত্যা করতে চাও যে,সে বলে : আমার প্রভু একমাত্র আল্লাহ্ এবং আলী ইবনে আবি তালিব যে তাঁদের সকল হতে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ।”

৩৮। নবী (সা.) আলীকে বলেন,“আমার উম্মত অচিরেই তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে যদিও তখন তুমি আমার বিধানের ওপর জীবন যাপন করবে ও আমার সুন্নাহর ওপর মুত্যুবরণ করবে। যে কেউ তোমাকে ভালবাসবে সে যেন আমাকেই ভালবাসল আর যে তোমার সঙ্গে শত্রুতা করবে সে যেন আমার সঙ্গেই শত্রুতা করল। আমি দেখতে পাচ্ছি খুব নিকটেই তোমার শ্মশ্রু তোমার মস্তকের রক্তে রঞ্জিত হবে।” হযরত আলী (আ.) বলেন,“নবী (সা.) আমাকে যেসব বিষয়ে অবহিত করেন তার অন্যতম হলো এ উম্মত তাঁর পর আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।”

ইবনে আব্বাস বলেন,“নবী (সা.) আলীকে বলেছেন : আমার পর খুব নিকটেই তুমি দুঃখ-কষ্টে পতিত হবে। আলী প্রশ্ন করলেন : তখন কি আমি দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকব? রাসূল (সা.) বললেন : হ্যাঁ,তখন তুমি সঠিক দীনের ওপরই থাকবে।”

৩৯। নবী (সা.) একদিন সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন,“তোমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি রয়েছে যে কোরআনের ব্যাখ্যার জন্য যুদ্ধ করবে যেমনটি আমি এর অবতীর্ণ হবার জন্য যুদ্ধ ও প্রচেষ্টা চালিয়েছি।” আবু বকর ও উমরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সকলেই ঘাড় সজাগ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। হযরত আবু বকর বললেন,“আমি কি সেই ব্যক্তি?” রাসূল (সা.) বললেন,“না।” হযরত উমর বললেন,“আমি কি?” তিনি বললেন,“না,বরং সেই ব্যক্তি যে এখন তার জুতায় তালি দিচ্ছে (তখন আলী [আঃ] তাঁর জুতা সেলাই করছিলেন)।”

আবু সাঈদ খুদরী বলেন,“আলীর নিকট গিয়ে এ সুসংবাদ দিলাম। তিনি তাঁর মাথা নীচু করেই রইলেন যেন তিনি রাসূল (সা.) হতে অসংখ্যবার একথা শুনেছেন।”

অনুরূপ হাদীস আবু আইউব আনসারী খলীফা হযরত উমরের সময় বলেছেন,“রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আলীকে ‘নাকেসীন’ (প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী),‘মারেকীন’ (ধর্মচ্যুত) এবং ‘কাসেতীন’দের (সীমালঙ্ঘনকারী ও বিদ্রোহী) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ও তাদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।”(*২১)

 

 

তদ্রুপ হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের হাদীসটিও। তিনি বলেন,“রাসূল (সা.) বলেছেন :

يا عليّ ستقاتلك الفئة الباغية و أنت على الحق فمن لم ينصرك يومئذ ليس منّي

হে আলী! শীঘ্রই একদল সীমালঙ্ঘনকারী (বিদ্রোহী) তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে যদিও  তখন তুমি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যে ব্যক্তি তখন তোমাকে সাহায্য করবে না সে আমার অনুসারী নয়।”

অনুরূপ একটি হাদীস হযরত আবু যর রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ নিবদ্ধ,তোমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি রয়েছে যে আমার পরে কোরআনের ব্যাখ্যার জন্য যুদ্ধ করবে যেমন আমি মুশরিকদের বিরুদ্ধে তা অবতীর্ণ হবার জন্য যুদ্ধ করেছি।”

মুহাম্মদ ইবনে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে আবি রাফে তাঁর পিতার সূত্রে তাঁর দাদা আবু রাফে হতে বর্ণনা করেন,রাসূল (সা.) বলেছেন,“আমার পর একদল আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে,তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে সবার ওপর বাধ্যতামূলক। যে ব্যক্তি অস্ত্র হাতে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে অক্ষম সে যেন জিহ্বার দ্বারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে,তাতেও অক্ষম হলে সে যেন অন্তর দ্বারা (ঘৃণার মাধ্যমে) যুদ্ধ করে।”

আখদ্বার আনসারী বলেন,“নবী করিম (সা.) বলেছেন : আমি কোরআন অবতীর্ণ হবার জন্য যুদ্ধ করেছি এবং আলী এর ব্যাখ্যার জন্য যুদ্ধ করবে।” 

৪০। নবী (সা.) বলেছেন,

 يا عليّ أخصمك بالنّبوّة فلا نبوّة بعدي و تخصم النّاس بسبع أنت أوّلهم إيْمانا بالله و أوفاهم بعهد الله و أقسمهم بالسّويّة و أعدلهم في الرّعيّة و أعظمهم عند الله مزية

“হে আলী,তোমার ওপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব হলো নবুওয়াতের কারণে এবং আমার পরে কোন নবী ও রাসূল নেই। আর সকল মানুষের ওপর তোমর সাতটি শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে,তুমি সর্বপ্রথম ব্যক্তি যে ঈমান এনেছ,তুমি আল্লাহর প্রতিশ্রুতি রক্ষার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে অগ্রগামী,তুমি সকল মানুষ হতে প্রত্যয়ী এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে সবার হতে অগ্রগামী,বায়তুল মাল বণ্টনে সর্বাধিক সমতা রক্ষাকারী,বিচার ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সকল হতে ন্যায় বিচারক,আল্লাহর নিকট সম্মানের ক্ষেত্রে সকলের চেয়ে নৈকট্যের অধিকারী।”

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেছেন,“রাসূল (সা.) বলেছেন : হে আলী! সাতটি বৈশিষ্ট্যের কারণে তুমি অন্যদের হতে শ্রেষ্ঠ,তুমি সর্বপ্রথম ঈমান আনয়নকারী,তাঁর প্রতি প্রতিশ্রুতি পালনকারী,তাঁর নির্দেশের ক্ষেত্রে সর্বাধিক দৃঢ়,জনগণের প্রতি সবচেয়ে দয়ালু,বিচারের ক্ষেত্রে পারদর্শী এবং জ্ঞান,বিদ্যা,দয়া,উদারতা ও সাহসিকতা ইত্যাদি যাবতীয় সৎ গুণের ক্ষেত্রে অন্য সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম।”

আপনার নিকট এ সম্পর্কিত চল্লিশটি হাদীস বর্ণনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেগুলো এখানে লিপিবদ্ধ করেছি। এ হাদীসগুলো ছাড়াও সমার্থক ও সমমর্যাদার প্রচুর হাদীস রয়েছে (যেগুলো বর্ণনার সুযোগ এখানে নেই) যেগুলো থেকে বোঝা যায় এই উম্মতের মধ্যে রাসূলের পর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হলেন আলী ইবনে আবি তালিব এবং এ উম্মতের নেতৃত্বের দায়িত্ব রাসূলের পর একইভাবে আলীর ওপর অর্পিত হয়েছে।

তাই শব্দগতভাবে সব হাদীস একই রকম না হলেও অর্থের দিক থেকে তা সমার্থক ও মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত। সুতরাং বিষয়টি আপনার নিকট অকাট্যরূপে প্রতিভাত হয়েছে বলে মনে করছি।

 আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাল

নিবেদক______ কবির উদ্দিন

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202