Imported post: Facebook Post: 2023-07-28T20:26:02

আশুরা-বিপ্লবের রয়েছে বহুমাত্রিকতা। আসলে ইমাম হুসাইনের নেতৃত্বে সংঘটিত এ মহাবিপ্লব ইসলামেরই পরিপূর্ণ চিত্রের প্রতিচ্ছবি। কালের মহাপাখায় এ মহাবিপ্লব ইসলামেরই সব দিককে জানার এবং সবগুলো মহৎ গুণ চর্চার কেন্দ্র-বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কারবালা ও আশুরা একত্ববাদ বা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, ইসলামী নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ, খোদাপ্রেম ও ইসলামী আদর্শের জন্য চরম ত্যাগ-তিতিক্ষা, চরম ধৈর্য, চরম দৃঢ়তা, মানবতা, মহত্ত্ব, বীরত্ব, বিশ্বস্ততা, মহানুভবতা, মুক্তিকামিতা , সততা, আধ্যাত্মিকতা ও আত্ম-সংশোধনের নানা দিক শেখার এক মহান বিশ্ববিদ্যালয়। কারবালা এটা প্রমাণ করে যে রক্ত তরবারির ওপর বিজয়ী হতে পারে। সত্যের পক্ষে মুষ্টিমেয় সেনানীও ভেঙ্গে দিতে পারে প্রবল পরাক্রান্ত তাগুতি শক্তির সিংহাসন। ইমাম হুসাইনের (আ.) বিপ্লব ইসলামের ইতিহাসে অনন্য। এ বিপ্লব বদলে দিয়েছে বিশ্বের ইতিহাসকে। আশুরা বিপ্লবে মহানবীর (সা) নাতি শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর সঙ্গীদের অনন্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগ ইসলামকে এবং মানবতাকে দিয়েছে এক অনন্য মহিমা, গৌরব ও সৌন্দর্য। মানবতা ও ইসলামকে অমর্যাদা ও অপবিত্রতার হাত থেকে রক্ষার যে আন্দোলন ও বিপ্লব তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা যে কোনো মুক্তিকামী ও স্বাধীনতাকামী মানুষকে দেয় অশেষ মহত্ত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ সেই আদর্শকে অনুসরণের অনুপ্রেরণা এবং তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের দুর্বার সংকল্প। ইমাম হুসাইনের (আ) মহাবিপ্লব ছিল এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পবিত্র ও মহান আন্দোলন। ইতিহাসে এর কোনো জুড়ি নেই। আর এ কারণেই তা চিরকালের আদর্শে পরিণত হয়েছে। এর লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট গোত্র, জাতি, দেশ ও মহাদেশে সীমিত নয়। সমস্ত মানবতার কল্যাণই ছিল ওই মহাবিপ্লবের টার্গেট। একত্ববাদ, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, সমতা, সহমর্মিতা এবং এ ধরনের মনুষ্যত্বের জন্য অপরিহার্য হাজারো উপাদানকে সুপ্রতিষ্ঠার করাই ছিল এ মহাবিপ্লবের কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য। এ কারণে ইমাম হুসাইন (আ) সমস্ত মানুষের। সবাই তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমনটি বলেছেন, ‘হুসাইন আমা হতে এবং আমি হুসাইন হতে।’ তেমনি আমরাও যেন সমস্বরে বলি, ‘হুসাইন আমা হতে এবং আমি হুসাইন হতে।’ কারণ প্রায় ১৪০০ বছর আগে তিনি আমাদের জন্য এবং মানবতার জন্য বিপ্লব করে গেছেন। তার বিপ্লব ছিল গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে এবং পবিত্র ও মহান। ইমাম হুসাইন (আ.) দূরদর্শী ছিলেন। তিনি যা দেখতেন সমসাময়িক কালের কোনো বুদ্ধিজীবী কিংবা চিন্তাবিদের মাথায়ও তা আসত না। তিনি জনগণের পরিত্রাণের উপায় জনগণের চেয়ে ভালো বুঝতেন। দশ, কুড়ি, পঞ্চাশ, শত বছর যখন পার হয় তখন মানুষ একটু একটু বুঝতে পারে যে, সত্যিই তো! তিনি তো এক মহাবিপ্লব করে গেছেন! আজ আমরা পরিস্কার বুঝতে পারি যে, ইয়াজিদ কেমন মানুষ ছিল আর মুয়াবিয়া কেমন ব্যক্তি ছিল বা উমাইয়াদের ষড়যন্ত্র কি ছিল! কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) সেদিনই সবার চেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছিলেন। সেকালে বিশেষ করে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মদিনার লোকজন ইমাম হুসাইন (আ.) কি চান তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদাতের সংবাদ যেদিন তাদের কানে গেলো, অমনি যেন সবার টনক নড়ে উঠল। সবার একই প্রশ্ন: হুসাইন ইবনে আলীকে (আ.) কেন শহীদ করা হল? এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য মদিনার চিন্তাশীল লোকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। এর প্রধান ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা। তদন্ত কমিটি সিরিয়ায় গিয়ে ইয়াজিদের দরবারে এসে উপস্থিত হল। মাত্র ক’ দিন অতিক্রান্ত হতে না হতেই তারা অবস্থাটি ধরে ফেলল। অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে তারা শীঘ্রই মদিনায় ফিরে এলো। লোকজন জিজ্ঞেস করলো: কি দেখে এলেন? জবাবে তারা বলল, শুধু এইটুকুই তোমাদের বলি যে,আমরা যে ক’ দিন সিরিয়ায় ছিলাম সে ক’ দিন শুধু এ চিন্তায় ছিলাম যে, খোদা এক্ষুণি হয়তো এ জাতিকে পাথর নিক্ষেপ করে ধ্বংস করবেন! লোকজন বলল, কেন, কি হয়েছে!? তারা বলল, আমরা এমন এক খলিফার সামনে গিয়েছিলাম যে প্রকাশ্যে মদ খাচ্ছিলো, জুয়া খেলছিল, কুকুর-বানর নিয়ে খেলা করছিল, এমন কি নারীর সাথে যেনাও করছিল! যে ব্যক্তির নাম সর্বযুগের স্বৈরাচার ও অত্যাচারী শাসকের রাজ প্রাসাদ নড়বড়ে করে দিয়েছে তিনি কি বৃথা নিহত হলেন! আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালার আটজন ছেলে ছিল। তিনি মদিনার জনগণকে বললেন, তোমরা বিদ্রোহ কর আর না করো আমি শুধু আমার আটজন ছেলেকে নিয়ে হলেও বিদ্রোহ করতে যাচ্ছি। কথামতো তিনি তার আটজন ছেলেকে নিয়ে বিদ্রোহ করলেন এবং ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ‘হাররা বিদ্রোহে’ প্রথম তার আটজন ছেলের সবাই এবং পরে তিনি নিজেও শহীদ হন। (মুরুজুয যেহাব ৩/৬৯) আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা নিঃসন্দেহে একজন চিন্তাশীল লোক ছিলেন। কিন্তু তিন বছর আগে ইমাম হুসাইন (আ.) যখন মদিনা থেকে বেরিয়ে আসনে তখন তিনিও ইমামের (আ.) কাজকর্ম থেকে কিছুই বুঝতে পারেননি। ইমাম হুসাইন (আ.) বিদ্রোহ করলেন, আন্দোলন করলেন, জানমাল উৎসর্গ করলেন। তিনটি বছর কেটে গেল। তারপর আজ এসে আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালার মতো ব্যক্তিরও টনক নড়ল। এ হল ইমাম হুসাইনের (আ.) দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতার স্বরূপ মাত্র। আশুরা বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি এমন লোকদের কেউ কেউ বলেন, ইমাম শহীদ হলেন যাতে উম্মতের সমস্ত পাপ মাফ হয়ে যায়। এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও বিভ্রান্ত খ্রিস্টানদের অনুকরণ মাত্র। খ্রিষ্টানদের আকীদার একটি মূল অংশ এই যে, তারা বিশ্বাস করে হযরত ঈসা (আ.) ক্রুশবিদ্ধ হন খ্রিষ্টানদের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নেবার জন্য। অর্থাৎ এখন থেকে খ্রিষ্টানরা যতই পাপ করুক,কোনো ভয় নেই। কেননা হযরত ঈসা (আ.) আছেন। উম্মতের সব পাপ তার কাঁধেই পড়বে। এ কারণে আজ খ্রিষ্ট সমাজে যত অনাচার, নৈরাজ্য, ব্যভিচার, হত্যা, লুণ্ঠন অবাধে চলছে। দ্বিতীয় যে ভ্রষ্ট ব্যাখ্যা হুসাইনি আদর্শকে অসার ও প্রভাবহীন করে দেয় তা হলোঃ আরেক দল মুসলমান বলে থাকে ইমাম হুসাইন (আ.) বিদ্রোহ করে নিহত হলেন এটি তাঁর ভাগ্যে লেখা ছিল বলেই। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যাস, এ নিয়ে আপনার আমার মাথা ঘামানোর কিছু নেই এবং এটি ইসলামের মূল করণীয় বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ ইমাম হুসাইন (আ.) চিৎকার করে বললেন যে, আমার বিদ্রোহের কারণ ইসলামের মৌলিক ও সার্বিক বিষয়াদির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। ইসলাম কোনো মুমিনকে জুলুম, অত্যাচার, সামাজিক অধঃপতন প্রভৃতির প্রেক্ষিতে নাকে তেল ঢেলে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর অনুমতি দেয় না। ইমাম হুসাইনের (আ.) আদর্শ ছিল ইসলামী আদর্শেরই এক বাস্তব প্রতিফলন। অনেকে আবার এই বলে চোখের পানি ঝরাতে থাকে যে, নবীর (সা.) সন্তান ইমাম হুসাইনকে (আ.) বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইমাম হুসাইন (আ.) নির্দোষ ছিলেন তবে দুঃখ হল যে তাকে মজলুম অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। শুধু এটিই তাদের আফসোস। অনর্থক তার রক্ত ধুলায় মেখেছে। তারা চোখের পানি দিয়ে যেন হযরত ফাতিমাকে (আ.) সান্ত্বনা দিতে চায়। এর চেয়ে বোকামি আর কী আছে? পৃথিবীতে যদি কোনো একজন লোক তার রক্তের প্রতিটি ফোটাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্য দান করে থাকেন তাহলে তা একমাত্র ইমাম হুসাইনই তা (আ.) পেরেছেন। সেই ৬১ হিজরি থেকে আজ ১৪৪৫ হিজরি পর্যন্ত ইমাম হুসাইনের (আ.) নামে যত টাকা-পয়সা খরচ করা হয়েছে তা যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে তাঁর প্রতি ফোটা রক্তের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যে ব্যক্তির নাম সর্বযুগের স্বৈরাচার ও অত্যাচারী শাসকের রাজ প্রাসাদ নড়বড়ে করে দিয়েছে তিনি কি বৃথা নিহত হলেন! তাই আমরা যারা আফসোস করে বলি যে, মজলুম ইমাম হুসাইন (আ.) অকারণে নিহত হয়েছেন তাদের জানা উচিত মহানবীর (সা) এই বাক্য, ‘হুসাইন আমা থেকে ও আমি হুসাইন থেকে!’ শহীদ সম্রাট ইমাম হুসাইনের (আ.) মর্যাদায় একমাত্র শাহাদাতের মাধ্যমেই পৌঁছানো সম্ভব। তিনি শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। তাই তাঁর নজিরবিহীন মজলুম অবস্থা ও বীরত্বপূর্ণ শাহাদাতের প্রেক্ষাপটে আমাদের মূলত এ উদ্দেশ্যেই চোখের পানি ঝরানো উচিত যাতে ইমাম হুসাইনের (আ.) ঈমান, দৃঢ়তা, সত্যকামিতা ও ন্যায়পরায়ণতা, মুক্তিকামিতা, সৎসাহস, বীরত্ব, খোদাভীতি প্রভৃতির সাগর থেকে এক বিন্দু হলেও যেন আমাদের ভাগ্যে জোটে!। হুসাইনী আদর্শকে হুবহু টিকিয়ে রাখা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা হুসাইনি আত্মার সাথে একাত্ম হতে পারব। ইমাম হুসাইনের (আ.) ঈমান, একত্ববাদ, মুক্তিকামিতা, তাকওয়া, সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা থেকে আমরা যদি সামান্যটুকুও লাভের আশায় চোখের পানি ঝরাতে পারি তাহলে এ চোখের পানির মূল্য হবে অপরিসীম। এ অশ্রু একটি মাছির পাখনার সমান সূক্ষ্ণ হলেও তার মূল্য কেউ দিতে পারবে না। ইমাম হুসাইন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এই আদর্শের খাঁটি অনুসারী হবার আশায় কাঁদলে সে কান্নাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। ইমাম হুসাইনের (আ.) সুউন্নত আত্মা অপরাজেয়। এ আত্মার কোনো ধ্বংস নেই! হুসাইনী আদর্শকে টিকিয়ে রাখার ওপর বেশি জোর দেয়া হয় এ জন্যই যাতে মানুষ ইসলামের এই বাস্তব চেহারাকে সরাসরি দেখতে পারে। মানুষ নবী (সা.) বংশের এই ঈমান দেখে নবীর (সা.) নবুয়্যতকে সত্য বলে বুঝতে পারবে। কেউ যদি অসীম বীরত্ব ও ঈমানের পরিচয় দিয়ে কেবল কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হয় তবুও এটি রাসূলুল্লাহর (সা.) রিসালাতের সত্যতার জন্য তেমন কোনো দলিল হতে পারে না। কিন্তু নবীর (সা.) সন্তান হযরত ইমাম হুসাইনকে (আ.) যখন ঐ অসীম ঈমান, সাহস, বীরত্ব, তৌহিদী অবস্থায় শহীদ হতে দেখে তখন যে কেউই রাসূলুল্লাহর (সা.) রিসালাতের সত্যতা বুঝতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর কোনো লোকই হযরত আলীর (আ.) চেয়ে বেশী সময় রাসূলুল্লাহর (সা.) সান্নিধ্য পায়নি। রাসূলের (আ.) ঘরেই তিনি বড় হন। তাঁকে দেখে মানুষ যেমন রাসূলুল্লাহর (সা.) রেসালাতের সত্যতাকে বুঝতে পারে ঠিক তেমনিভাবে রাসূলুল্লাহর (সা.) আদর্শে অনুপ্রাণিত রাসূলের (সা.) সন্তানকেও যখন অসীম ঈমান ও বিশ্বস্ততার সাথে দেখে তখনও মানুষ রাসূলুল্লাহর (সা.) রিসালাতের সত্যতা বুঝতে পারে। কারণ রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতিচ্ছবি ইমাম হুসাইনের (আ.) মধ্যে দেখা যায়। মুসলমানরা ঈমান শব্দটি কতই শুনেছে কিন্তু বাস্তবে কমই দেখেছ। ইমাম হুসাইনের (আ.) দিকে তাকালেই এই ঈমানের প্রতিফলন দেখতে পায়। মানুষ অবাক হয়ে বলতে বাধ্য হয় যে,মানুষ কোথায় পৌঁছতে পারে!! মানুষের আত্মা এত অপরাজেয় হতে পারে!! তাঁর দেহকে খণ্ড -বিখণ্ড করা হয়, যুবক পুত্রকে তাঁর চোখের সামনে ছিন্ন-ভিন্ন করা হয়, তৃষ্ণার চোটে আকাশের দিকে চেয়ে যার চোখ অন্ধকার হয়ে আসে, পরিবার-পরিজনদেরকে একই শিকলে বেঁধে বন্দী করা হয়, সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হন। কিন্তু যে জিনিস অক্ষয় হয়ে রয়ে গেছে তা হল ইমাম হুসাইনের (আ.) সুউন্নত অপরাজেয় আত্মা। এ আত্মার কোনো ধ্বংস নেই। পৃথিবীতে আর মাত্র একটি ঘটনা খুঁজে বের করুন যাতে সমস্ত মানবিক গুণাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হয়েছে রক্ষিত ও প্রতিফলিত। কারবালা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ঘটনায় যদি তা পাওয়া যেত তাহলে আমরা এখন থেকে কারবালার ঘটনাকে রেখে সেটাকেই স্মরণ করবো। না, কোথাও পাবেন না। তাই কারবালার মতো ঘটনাকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে ঘটনায় আত্মিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে মাত্র ৭২ জনের এক বাহিনী ত্রিশ হাজার লোকের বাহিনীকে পরাজিত করেছে। তারা সংখ্যায় মাত্র ৭২ জন ছিলেন এবং মৃত্যু যে নির্ঘাত এটিও তারা নিশ্চিতভাবে জানতেন। তবুও কিভাবে তারা ত্রিশ হাজারের বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হলেন? প্রথমত তারা এমন শক্তিতে শক্তিমান ছিলেন যে,শত্রুদের থেকে হুর ইবনে ইয়াজিদ রিয়াহীর মতো ত্রিশ জনেরও বেশি লোককে বেঁচে থাকার ঘাঁটি থেকে নির্ঘাত মৃত্যুর ঘাঁটিতে আকর্ষণ করতে সক্ষম হন! কিন্তু মৃত্যুর ঘাঁটি থেকে একজন লোকও ইয়াজিদের দুনিয়াবি ঘাঁটিতে যায়নি! তাহলে বুঝতে হবে যে, এ ঘাঁটিতে সংখ্যা কম এবং মৃত্যু নিশ্চিত হলেও এখানে শক্তি-সামর্থ্য অনেক বেশী যা দিয়ে শত্রুদেরকেও আকর্ষণ করা যায়। দ্বিতীয়ত আরবের চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী একজনের মোকাবিলায় অন্য আরেকজন যুদ্ধ করতো। কারবালায় ইয়াজিদই সেনাপতি ইবনে সা’ দ প্রথমে এভাবেই যুদ্ধ করত রাজি হয়। কিন্তু যখন দেখল যে, এভাবে যুদ্ধ করলে ইমাম হুসাইনের (আ.) একজন সৈন্যই তাঁর সব সৈন্যকে সাবাড় করে দিতে যথেষ্ট তখন সে এ যুদ্ধ বর্জন করে দল বেঁধে আক্রমণ করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হল। আশুরার দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত একে একে ৭১ জন শহীদের লাশকে ইমাম হুসাইন কাঁধে বয়ে তাঁবুতে নিয়ে এসেছেন। তাদের কাছে গিয়ে অভয় বাণী দিয়েছেন, তাঁবুতে এসে সবাইকে শান্ত করেছেন, এছাড়া তিনি নিজেও কত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন। ৫৭ বছরের একজন বৃদ্ধলোক এত ক্লান্ত, শ্রান্ত অবস্থায় যখন ময়দানে এলেন তখন শত্রুরা ভেবেছিল হয়তো সহজেই তাঁকে পরাস্ত করা যাবে। কিন্তু একটু পরেই তাদের সব আশা-ভরসা উড়ে গেল। ইমাম হুসাইনের (আ.) সামনে যে-ই এলো এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারলো না। ওমর ইবনে সাদ এ অবস্থা দেখে চিৎকার করে বলে উঠে: ‘তোমরা কি জানো ইনি কার সন্তান? এ তাঁরই সন্তান যে সমস্ত আরবকে নিশ্চিহ্ন করতে পারতো। এ তো আল্লাহর সিংহ শেরে খোদা আলীর (আ.) সন্তান!’ ( মাকতালু মোকাররম: ৩৪৬ বিহারুল আনওয়ারঃ ৪৫/৫৯ মানাকিবে ইবনে শাহের অশুবঃ ৪/১১০) ওমর ইবনে সাদ তারপর বলে : ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, তার দু’ বাহুতে তার বাবার মতোই শক্তি। আজ যে তাঁর মোকাবিলায় যাবে তার মৃত্যু অনিবার্য।’ এটি কি ওমর ইবনে সা’ দের পরাজয়ের প্রমাণ নয়? ত্রিশ হাজার সেনা নিয়ে যে একজন ক্লান্ত-শ্রান্ত, বয়োবৃদ্ধ, অপরিমেয় দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পিছু হটে ছুটে পালায় এটি কি তাদের পরাজয় নয়? ( ইরশাদে মুফিদঃ ২৩০ বিহারুল আনওয়ারঃ ৪৪/৩৯০) তারা তলোয়ারের মুখে যেমন পরাজয় বরণ করে তেমনি ইমাম হুসাইনের (আ.) চিন্তাধারার কাছেও তাদের হীন চিন্তাধারা পরাজিত হয়। আশুরার দিন যুদ্ধ আরম্ভ হবার আগে ইমাম হুসাইন (আ.)-তিনবার বক্তৃতা দান করেন। এ বক্তৃতাগুলোর প্রত্যেকটিই ছিল বীরত্বপূর্ণ। যাদের বক্তৃতা করার অভ্যাস আছে তারা হয়তো জানেন যে বক্তৃতার ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত মানসিকতার দরকার হয়। সাধারণ অবস্থায় মানুষ একটি অসাধারণ বক্তব্য রাখতে পারে না। যে হৃদয় আঘাত পেয়েছে সে ভালো শোক-গাঁথা পড়তে পারে। তেমনি কেউ যদি বীরত্বপূর্ণ বক্তব্য দিতে চায় তাহলে তার অস্তিত্ব বীরের ভাবানুভবে ভরা থাকতে হবে। ইমাম হুসাইন (আ.) আশুরার দিনে যখন বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন তখন ইবনে সা’ দ চিন্তায় পড়ে গেল। সবার কানে যাতে ইমামের কথা পৌঁছায় সে জন্য ইমাম হুসাইন (আ.) একটি উঁচু জায়গা হিসাবে উটের পিঠে উঠে দাঁড়ালেন এবং চিৎকার করে বললেন, ‘হে জনগোষ্ঠী! তোমাদের জন্য ধ্বংস এ জন্য যে, তোমরা জটিল পরিস্থিতিতে আমার সাহায্য চেয়েছো। আমি তোমাদের সাহায্যের জন্য ছুটে এসেছি। কিন্তু যে তরবারি আমার সাহায্যে পরিচালনার শপথ তোমরা নিয়েছিলে আজ আমাকেই হত্যার জন্য সে তরবারি হাতে নিয়েছ।’ ( আল-লুহুফঃ ৪১ তুহফাল উকুলঃ ১৭৩ মানাকিবে ইবনে শাহরে অশুবঃ ৪/১১০ মাকতালু মোকাররামঃ ২৮৬/৬) সত্যিকার অর্থে হযরত আলীর (আ.) জ্ঞানগর্ভমূলক বাগ্মিতার পর এ ধরনের বক্তৃতা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ইমাম হুসাইনের (আ.) বক্তৃতায় যেন হযরত আলীরই (আ.) বিচক্ষণতা! যেন সেই একই জ্ঞান, সেই একই সাহস! সেই একই বীরত্ব! ইমাম হুসাইন (আ.) এ কথা তিনবার চিৎকার করে বললেন। তাতেই ইবনে সাদের মনে ভয় ঢুকে গেলো যে, এভাবে কথা বলতে দিলে এক্ষুণি তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে। তাই ইমাম হুসাইন (আ.) যখন চতুর্থ বারের মত কথা বলতে যাবেন এ সময় পরাজিত মনোবৃত্তি নিয়ে কাপুরুষ ওমর ইবনে সাদ নির্দেশ দিল যে, সবাই হৈ-হুল্লোড় করে উঠবে যাতে ইমাম হুসাইনের (আ.) কথা কেউ শুনতে না পারে। এটি কি পরাজয় নয়? এটি কি ইমাম হুসাইনের (আ.) বিজয় নয়? মানুষ যদি ইমানদার হয়, একত্ববাদী হয়, যদি আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে এবং পরকালে বিশ্বাসী হয় তাহলে একাই বিশ-ত্রিশ হাজার সুসজ্জিত সৈন্যকে মানসিকভাবে পরাস্ত করতে পারে। এটি কি আমাদের জন্য একটা শিক্ষণীয় বিষয় নয়? এরূপ উদাহরণ আপনি দ্বিতীয়টি পাবেন কোথায়? পৃথিবীতে একজন লোক খুঁজে বের করুন, যে ইমাম হুসাইনের (আ.) মত দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে পড়েও মাত্র দুটো শব্দ ইমাম হুসাইনের (আ.) মতো বলতে পারে!। হুসাইনী আন্দোলনকে জিইয়ে রাখার জন্য এত জোর দেয়ার কারণ হল যে আমরা এটিকে সঠিক ভাবে বুঝবো, এর অনাবিষ্কৃত রহস্যগুলো উদ্ধার করবো এবং তা থেকে শিক্ষা নেব। আমরা যাতে ইমাম হুসাইনের (আ.) মহত্বকে অনুধাবন করতে পারি এবং যদি দু’ ফোটা চোখের পানি ঝরাই তা যেন সম্পূর্ণ মারেফাত সহকারে এবং জেনেশুনে ঝরাতে পারি। ইমাম হুসাইনের (আ.) পরিচিতি আমাদেরকে উন্নত করে, আমাদের মানুষ করে গড়ে তোলে, আমাদের মুক্তি দান করে। আমাদেরকে সত্য, হাকিকত এবং ন্যায়ের শিবিরে নিয়ে যায় এবং একজন খাঁটি মুসলমান তৈরি করে দেয়। হুসাইনী আদর্শ মানুষ গড়ার আদর্শ, পাপী তৈরি করার আদর্শ নয়। হুসাইনের (আ.) ঘাঁটি সৎ কর্মীর ঘাঁটি, পাপীদের এখানে কোন আশ্রয় নেই। ইতিহাসে আছে, আশুরার দিন ভোর বেলায় ইমাম হুসাইন নামাজ সেরে তার সঙ্গী-সাথীদেরকে বললেন, তৈরি হয়ে যাও। মৃত্যু এ দুনিয়া থেকে ঐ দুনিয়ার পার হবার জন্য একটা সাকো বৈ কিছুই নয়। একটা কঠিন দুনিয়া থেকে তোমাদেরকে একটা মর্যাদাশালী মহান জগতে পার করে দেব। এ ছিল ইমাম হুসাইনের (আ.) বক্তব্য । এ ঘটনাটি ইমাম হুসাইন (আ.) বর্ণনা করেননি। কারবালায় যারা উপস্থিত ছিল তারাই বর্ণনা করেছে। এমন কি ইবনে সা’দের নিযুক্ত গুপ্তচর বা সংবাদ সংগ্রহকারী হেলাল ইবনে নাফেও এ ঘটনা বর্ণনা করেছে যে, আমি হুসাইন ইবনে আলীকে (আ.) দেখে অবাক হয়ে যাই। তাঁর শেষ মুহূর্ত যতই ঘনিয়ে আসছিল এবং যতই তার কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠছিল ততই তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। যেন দীর্ঘ বিরহের পর কারো তাঁর আপনজনের সাথে মিলনের সময় হয়েছে!এমনকি যখন অভিশপ্ত শিমার ইমাম হুসাইনের শিরচ্ছেদ করছিল তখন অন্য এক ঘাতক বলছিল আমি তার চেহারায় এমন প্রসন্নতা এবং উজ্জ্বলতা দেখেছিলাম যে তাকে হত্যা করার কথা একবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। (আল লুহুফঃ ৫৩, বিহারুল আনওয়ারঃ ৪৫/৫৭) ইমাম হুসাইন (আ) যখন পরিবারের কাছ থেকে শেষবারের মত বিদায় নিয়ে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিলেন তখন বোন যাইনাবকেও কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নেয়ার সময় যাইনাব আবারও ফিরে আসতে লাগল ভাইয়ের দিকে এবং বললেন: থামো থামো বা ধীরে চলুন ভাই! ইমাম বললেন, কি ব্যাপার! তাবুতে যেতে বললাম না! যাইনাব কাছে এসে বললেন: মায়ের একটা ওসিয়ত মনে পড়ল! তা পালন করতে এলাম! এ কথা বলে ভাইয়ের গলায় একটি চুমো খেলেন! মা ফাতিমা যাইনাবকে সেই বহু বছর আগে বলে রেখেছিলেন যে, আমার হুসাইন যখন নিশ্চিত শাহাদাতকামী যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে তখন তুমি আমার পক্ষ থেকে তাঁর গলায় একটি চুমো দিও। এ যেন মা ফাতেমারই চুম্বন সেই গলায় যা কিছুক্ষণ পরই জীবন্ত অবস্থায় কাটা হবে শিমারের মত জালিমদের হাতে! জালিমদের ওপর আল্লাহর চির-অভিশাপ ও কঠোর শাস্তি কামনা করছি লানাতুল্লাহি আলাল কাজেবিন আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মাদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মাদ ওয়া আজ্জিল ফারাজাহুম নিবেদক মোঃ জাহিদ হোসেন

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

ইসলামে হযরত আবু তালিব আঃ এর অবদান:::::::::::::_________পর্ব (((((৩)))))_____________:::::::::::::::মহানবী (সা.) জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারিয়েছেন। মায়ের কাছে তিনি পিতা আব্দুল্লার ইন্তেকালের কথা জানতে পেরেছেন। ছয় বছর বয়সে তিনি মাতা আমেনার স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হন।ফলে তাঁর লালন-পালনের ভার পিতামহ জনাব আব্দুল মোতালিব গ্রহণ করেন। মাত্র দুই ছর পর তিনিও এ পৃথীবি ছেড়ে চলে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (সাঃ) অসহায় হয়ে পড়লেন। মহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর হাবিবের জন্য নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন। আট বছর বয়সে শুরু হলো নবী (সা.)-এর জীবনের এক নতুন অধ্যায় , তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পিতৃব্য হযরত আবু তালিব। মোহাম্মদ (সা.)-কে চাচা আবু তালিব ও চাচি ফাতেমা বিনতে আসাদ প্রাণাধিক ভালবাসতেন। মোহাম্মদ (সা.)-কে তিনি কখনো মায়ের শূন্যতা বুঝতে দেননি। নিজেদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও মোহাম্মদ (সা.)-কে তা অনুধাবন করতে দেননি। এই মহিমান্বিত পরিবারের অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর-যন্ন আর লালন-পালন ও ছত্রছায়ায় প্রিয় নবী (সা.)-এর শিশু , কিশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয়েছিল। জীবনের সেই সময়গুলো কত সুখময় ছিল নবী (সা.) তা বুঝতে পেরেছিলেন , যখন মাতৃসুলভ চাচি ইন্তেকাল করলেন।নবী (সা.) সেই মহিয়সী চাচিকে‘ মা’ বলেই ডাকতেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী (সা.) দীর্ঘদিন অশ্রুসজল ছিলেন। হযরত আবু তালিব যেমনি পিতার ন্যায় স্নেহ ভালবাসা দিয়ে নবীকে আগলে রেখেছেন , তেমনি তাঁর ভরণ-পোষণ , পোশাক-পরিচ্ছেদ ও অন্যন্য প্রয়োজন মিটিয়েছেন অকৃপণ ভাবে। এমনকি নিজের সন্তানের চেয়েও নবীকে দিয়েছেন অগ্রাধিকার। নিজেরা কষ্টে থাকলেও নবী (সা.)-এর কষ্টে থাকা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।এখানে আমি একটি হাদীস উপস্থাপন করছি: রাসূল (সা.) বলেছেন ,“ যে ব্যক্তি তার জান-মাল , ইজ্জত-সম্মান ও সন্তানসন্ততি এবং সকল মানুষের চাইতে আমাকে অধিক ভালবাসে না তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়” । উল্লিখিত হাদীসের আলোকে প্রমাণ হয় হযরত আবু তালিব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ ঈমানদার। একজন স্নেহবৎসল পিতা , দয়ালু চাচা ও একজন দরদি অভিভাবক। তাঁরা উভয়ই চাচা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র একে অন্যের প্রতি এতটাই অনুরোক্ত ছিলেন যেন মনে হতো তাঁদের জীবন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিদেশে হযরত আবু তালিব আঃ যেখানেই সফর করতেন নবীকে সাথে রাখতেন। যে কারণে আরবের লোকেরা মোহাম্মদ (সা.)-কে‘ আবু তালিবের ইয়াতিম’ নামেও ডাকত। ভাতিজাকে কখনও তিনি একা ছাড়তেন না , এমনকি ঘুমানো কালেও পাশে নিয়ে ঘুমাতেন এরূপে নবী (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে 25 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 17 টি বছর তিনি হযরত আবু তালিবের গৃহে অবস্থান করেন।আর যেখানে এত বছর নবী (সা.) অবস্থান করলেন , সেখানে যে খাওয়া দাওয়া করেছেন তা নিশ্চই হালাল ছিল। কারণ নবী-রাসূলগণ হারাম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাহলে যারা বলেন ,“ আবু তালিব ঈমান আনেননি” । তারা নবী (সা.)-কে কোথায় পৌঁছালেন ? কারণ পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার 28 নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন :) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِ‌كُونَ نَجَسٌ(“ হে ইমানদারগন! নিশ্চই মুশরিকরা হচ্ছে অপবিত্র” ।📚📚📚📚তাই ঐ সকল ওলামাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের উক্তি সত্য হলে , নবী (সা.) কি 17 বছর হালাল খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন ? যা আদৌ বিশ্বাস যোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে আমরা জানতে পেরেছি নবী মূসা (আ.)-কে ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া (আ.) যখন লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এই শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য ধাত্রীর আহবান করলেন অতঃপর অসংখ্য ধাত্রীর আগমণ ঘটল কিন্তু কেউ শিশু মূসাকে দুগ্ধ পান করাতে সক্ষম হল না। তখন সেখানে উপস্থিত নবী মূসা (আ.)-এর আপন ভগ্নী বললেন ,“ আমি আপনাদের এমন এক ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি , হয়তো এই শিশু তাঁর দুগ্ধ পান করবে” । আর বাস্তবেও তাই ঘটল , অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিলেন এবং মায়ের দুগ্ধই পান করালেন। উক্ত ঘটনায় ইহাই প্রমানিত হয় যে , আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত যখন যা ইচ্ছা খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণ করেন না।দুঃখজনক হলেও সত্য যে , আমাদের প্রিয় নবী (সা.) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মুসলমান নামধারী উম্মত এমন সব প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন , যা শুনে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও লজ্জাবোধ করেন। যেমন রাসূল (সা.)-কে সদা সর্বদা অভাবী , ক্ষুধার্ত ও অসহায় হিসেবে উপস্থাপন , তালিওয়ালা জামা পরিধারণ , রাসূল (সা.)-এর সিনাছাক করে ময়লা দূরিকরণ , রাসূল (সা.)-কে নিরক্ষর নির্ধারণ ও চল্লিশ বছর পর নবী নির্ধারণ সহ বেশ কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ কিচ্ছা-কাহিনী আমাদের সমজে প্রচলিত আছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বেশকিছু সংখ্যক নবীর নাম ও বর্ণনা রয়েছে , যাঁদের কারো কখনো সিনাছাক করতে হয়নি এবং কেহ নিরক্ষর ছিলেন এমন প্রমাণও নেই। তাই প্রিয় নবী (সা.)-এর উম্মত হিসাবে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত নূন্যতম আকিদা এই হওয়া উচিৎ ছিল যে , আমাদের সমাজে যে সকল বক্তব্য রাসূল (সা.)-এর মান-মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং ভিন্ন ধর্মের লোকেদের কাছে রাসূল (সা.)-এর শাণ ও মানকে প্রশ্নের সন্মূখিন করে তোলে , অন্তত সে সকল প্রচার-প্রচারণা থেকে বিরত থাকা।উদহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে যে , ইসলামের ইতিহাসের প্রথম তিন খলিফার সন্মানিত পিতাগণ , কে কোন অবস্থানে ছিলেন বা তাঁরা প্রকাশ্যে কলেমা পড়ে ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন কি না এবিষয়ে ইতিহাসে তেমন কোন আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। অথচ চতুর্থ খলিফার সম্মানিত পিতা সম্পর্কে যারা মর্যাদাহানীকর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি নিশ্চিত বলতে পারেন যে , দ্বীন ইসলাম এতে কত টুকু উপকৃত হয়েছে ?আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর 8 বছর বয়স থেকে শুরু করে তাঁর 50 বছর বয়স পর্যন্ত সুদীর্ঘ 42 বছরের এক অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন হযরত আবু তালিব। তিনি যে কেবলমাত্র নবী (সা.)-এর অভিভাবক ছিলেন এমন নয় , তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা , কল্যানের অগ্রদূত , মজলুমের বন্ধু ও জালেমের শত্রু। নবী (সা.)-এর বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেও তা প্রকাশ পেয়েছে।হযরত আবু তালিব সম্পর্কে কিছু লিখতে গিয়ে ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে যে বিষয়টি বারবার আমার অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে তা সমীপে প্রকাশ করছি।আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম খালিফা তুল বিলা ফাসাললা'নাতুল্লাহি আল্লাল কাজেবিননিবেদক______ কবির উদ্দিন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদনবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরার মাহাত্ম্য যতই বর্ণনা করা হোক না তা অপূর্ণই থেকে যাবে ঠিক যেমনি জানা যায়নি তাঁর পবিত্র কবর কোথায় রয়েছে এবং তা গোপন বা অজ্ঞাত থাকার রহস্যই বা কী।তিনি কেবল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী ছিলেন না। বলা হয় মহান আল্লাহর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)। আর তাঁর পরই সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলেন হযরত ফাতিমা। তাই এমন ব্যক্তিদের মহিমা ও মহত্ত্ব পুরোপুরি তুলে ধরা মহান আল্লাহর পর কেবল এই তিন শীর্ষ সৃষ্টির পক্ষেই সম্ভব। বলা হয় ইমাম হাসান ও হুসাইনসহ মাওলা মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহর আহলে বাইতের ১১ জন সদস্য মা ফাতিমাকে তাঁদের জন্য আদর্শ বা হুজ্জাত বলে মনে করতেন।এমন কোনো নারীর কথা কি কল্পনা করা যায় যিনি তার দুই শিশু-সন্তানসহ তিন দিন ধরে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বামীকে খাবার সংগ্রহের কথা বলছেন না ইসলামের জন্য তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ বিঘ্নিত হবে বলে? অথবা এমন নারীর কথা কি চিন্তা করা যায় যিনি পর পর তিন দিন শুধু পানি পান করে রোজা রাখা সত্ত্বেও ইফতারের সময় ক্ষুধার্ত সাহায্যপ্রার্থীকে খাদ্য দেয়ার জন্য সেই তিন দিন কেবল পানি দিয়েই ইফতার করেন? আসলে হযরত ফাতিমা যাহরা ছিলেন মানবজাতির চিরন্তন গৌরব ও আদর্শ মানুষের প্রতীক তথা মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূর্ণতারঅন্যতম মডেল। এ ধরনের মানুষ পৃথিবীতে জন্ম না নিলে আদর্শের দিক থেকে মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করতো ব্যাপক অপূর্ণতা এবং আদর্শিক শূন্যতা। মাওলা মোহাম্মদ সাঃ এর পুত্র সন্তানরা শৈশবেই ইন্তিকাল করায় মক্কার কাফিররা যখন মহানবীকে আবতার বা নির্বংশ বলে বিদ্রূপ করতো তখন মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেন হযরত ফাতিমা যাহরা। পবিত্র কুরআনে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কাওসার' হিসেবে যার অর্থ মহত্ত্ব আর নেয়ামতের চির-প্রবহমান ঝর্ণা। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী বলেছেন, হযরত ফাতিমার শানেই সুরা কাওসার নাযিল হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার সত্ত্বেও হযরত ফাতিমার বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে, অন্যদিকে বনু উমাইয়্যা ধ্বংস হয়ে গেছে।অবশ্য পরবর্তী যুগে বনু আব্বাসও রাসূলের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল। অবশেষে তারাও ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলত তাদের বংশধরদের কোন খবর পৃথিবীর মানুষ জানে না, নেয় না। রাসূলের বংশধরদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেও তারা সফল হয়নি। একের পর এক রাসূলের বংশধরদের শহীদ করা সত্ত্বেও যারা পুত্রসন্তান নিয়ে গর্ব বোধ করত তাদের কোন খবর আজ বিশ্ববাসী জানে না, অথচ রাসূলের বংশধারা হযরত ফাতিমার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ বংশেই ইমাম মাহদী (আ.) আবির্ভূত হবেন এবং তিনি সারা বিশ্বে আল্লাহর ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সকল নারীর সন্তানকে যুক্ত করা হয় বাবার সাথে শুধু ফাতিমা ছাড়া। ফাতিমার সন্তানদের আমার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।’আর সেজন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, হযরত ফাতিমার সন্তানদের মানুষ ‘ইয়াবনা রাসূলিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘হে রাসূলের সন্তান’ বলে সম্বোধন করত।মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) তাঁর কন্যা সন্তানের নাম রাখেন ফাতিমা। ‘ফাত্‌ম্‌’ শব্দের অর্থ রক্ষা করা। এ সম্পর্কে মহানবী বলেন : ‘তাঁর নামকরণ করা হয়েছে ফাতিমা। কারণ, আল্লাহ তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত রেখেছেন।’ হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকহযরত ফাতিমা ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোসহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ বহু মহান স্বর্গীয় গুণের আদর্শ। স্নেহময়ী জননীর মত বিশ্বনবীর সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য মহীয়সী নারী ফাতিমা'র অন্য একটি উপাধি উম্মে আবিহা বা পিতার জননী। বিশ্বনবী (সা:) তাঁকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ নারী বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণেই ফাতিমাকে দেখলে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিতেন মহানবী (সা)। রাসুলে খোদা বলেছেন, 'ফাতিমা আমার দেহের অংশ, যা কিছু তাঁকে সন্তুষ্ট করে তা আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যা কিছু আমাকে সন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে, আর যা কিছু ফাতিমা কে কষ্ট দেয়, তা আমাকে কষ্ট দেয়, আর যা আমাকে কষ্ট দেয়, তা আল্লাহকেও কষ্ট দেয়।' হযরত ফাতিমা বেহেশতে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবেন বলে বিশ্বনবী উল্লেখ করেছেন। অনেকেই মনে করেন প্রিয় কন্যা ফাতিমাকে নিজের দেহের অংশ বলে মহানবী (সা) এটাও বুঝিয়েছেন যে পিতার রিসালাতের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ফাতিমা। এই মহীয়সী নারীর অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সেবা না থাকলে ইসলাম বিলুপ্ত হয়ে যেত।হযরত ফাতিমাকে কেউ কেউ কষ্ট দেবেন- এটা জানতেন বলেই বিশ্বনবী (সা) তাঁকে রাগানোর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ফাতিমা আমার অস্তিত্বের অংশ। যে তাঁকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে এবং ফাতিমা কোন ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হলে আল্লাহও ক্রুদ্ধ হন এবং ফাতিমার আনন্দে আল্লাহও আনন্দিত হন।’অনেক মহৎ গুণের আদর্শ হযরত ফাতিমার রয়েছে অনেক উপাধি। যেমন, তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ,আল-মুবারাকাহ বা বরকতপ্রাপ্ত,আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র,আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আজ জাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয যাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি। আর পিতা মহানবীর প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও সেবার কারণে তাঁকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা।হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে যাহরা উপাধি দেয়া হয়।রাসুল (সা)’র ওফাতের পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন ওহির ফেরেশতা। ওহির ফেরেশতা তাঁকে ভবিষ্যৎ বিষয়ে অনেক কিছু জানান। আর তার থেকে সেসব বিষয় লিখে রাখেন হযরত আলী (আ)। আর এ জন্যই ফাতিমাকে বলা হয় মুহাদ্দিসা।হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি তুলতে তুলতে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে সেগুলো মদীনার দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমার কাপড়ের পোশাকে থাকতো তালি। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে নামায পড়তেন, মহান আল্লাহর যিকির করতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি এত বেশি নামায পড়তেন যে, তাঁর পা ফুলে যেত। সংসারের কাজ করার সময়ও তাঁর মুখে আল্লাহর যিকির থাকত।রাসূলের স্ত্রী হযরত উম্মে সালামাহ্ বলেন : রাসূলের ওফাতের পর ফাতিমাকে দেখতে যাই এবং তাঁর অবস্থা জানতে চাই। তিনি জবাব দিলেন : অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত হচ্ছে।এ রকম কষ্টের মধ্য দিয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের অল্প কিছুদিন পরই হযরত ফাতিমা এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাসূলে খোদা ওফাতের আগে হযরত ফাতিমার কানে কানে বলে গিয়েছিলেন যে, তিনিই তাঁর সাথে প্রথম মিলিত হবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূলকে এও জানিয়েছিলেন যে, কীভাবে হযরত ফাতিমা তাঁর সাথে এত তাড়াতাড়ি মিলিত হবেন। আর সেজন্যই রাসূল (সা.) বারবার তাঁর উম্মতকে সতর্ক করছেন যে,তারা যেন হযরত ফাতিমাকে কষ্ট না দেয়,তাঁকে অসন্তুষ্ট না করে। হযরত ফাতিমা যাহরা পিতার শারীরিক বিদায়ের কারণে যতটা না দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার কারণে। রাসুলে খোদার কাছেই তিনি শুনেছিলেন তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর অনেক বিপদ ও মুসিবত তথা ইসলামের ওপরই অনেক দুর্যোগ নেমে আসবে। আর সেইসব বিপদ মুকাবিলার মত কঠিন ধৈর্যের খোদায়ী পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সর্বকালের সেরা মহামানবী হযরত ফাতিমা ঠিক যেভাবে সিফফিন ও কারবালা প্রান্তরসহ যুগে যুগে নানা বিপদ, সংকট ও শত্রুতার মোকাবেলায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্বনবী (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য।কোনো কোনো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে হযরত ফাতিমাকে আহত করা হয়েছিল প্রভাবশালী মহলের পক্ষ হতে এবং পরবর্তীকালে এ আঘাতজনিত কারণেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ: মহানবী (সা)অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমাকে দাফন করা হয়েছিল মধ্যরাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে। হযরত ফাতিমা জানতেন কখন তাঁর মৃত্যু হবে। আর এ জন্য তিনি নিজে গোসল করে নতুন ও পরিষ্কার পোশাক পরে কিবলামুখী হয়েছিলেন।তিনি নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হযরত হাসান ও হুসাইন কিভাবে মারা যাবেন সেইসব তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত হযরত ফাতিমার কাছ থেকে। ফাদাক সম্পর্কিত তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।মাওলা মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ আলী, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদেরকে মানুষের জন্য হুজ্জাত বা দলিল করেছেন এবং তাঁরা হল জ্ঞানের দরজা।মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আলী (আ.) ছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীরুতার প্রতীক। আলী (আ.)'র ঘরে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.)'র মত ইসলামের ইতিহাসের প্রবাদতুল্য গৌরব সৃষ্টিকারী অনন্য সন্তান। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে বলা হয়েছে। ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিন ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে। মাওলা হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা:) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সা:)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সা:)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইত (আঃ)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। হযরত ফাতিমা (সা:)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) হযরত ফাতিমা (সা:)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতিমার ঘ্রাণ নেই।আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সা:)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ বা কারো উদ্দেশ্যে যে কোনো বক্তব্য রাখার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মহান আল্লাহর বিভিন্ন নেয়ামতের কথা খুব সুন্দর ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় তুলে ধরে আল্লাহর প্রশংসা করা ছিল তাঁর অন্য একটি বড় বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা:)'র আহলে বাইতের অন্য সদস্যদের মত তিনিও কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। হযরত ফাতিমা (সা:) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) ঐশী পন্থায় অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। হযরত ফাতিমা ইমাম হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন। মদিনার নারী সমাজ ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত ফাতিমা (সা.আ.)'র কাছ থেকে। ফাদাক ও মানজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।নবী-নন্দিনী (সা:) বলেছেন, পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (সা:)র চেহারার দিকে তাকানো এবং কুরআন তিলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদেরকে মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়। ফাতিমা (সা. আ.) রাসূল (সা.)'র উম্মতের উদ্দেশে বলেছেন: আল্লাহ ঈমানকে তোমাদের জন্য শির্ক হতে পবিত্র হওয়ার ও নামাজকে অহংকার থেকে পবিত্র হওয়ার এবং আমাদের আনুগত্য করাকে ধর্মের ব্যবস্থায় বা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যম করেছেন, আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্যের পথে বাধা ও আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ইসলামের জন্য সম্মানের মাধ্যম করেছেন। ফাতিমা বা তাঁর বংশধরদের কেউই ঐশী সম্মানকে পার্থিব ভোগের কাজে লাগান নি। আত্মত্যাগের বিশালত্বে ফাতিমা এবং তাঁর বংশধররা ইতিহাসে অনন্য। ফাতিমার ত্যাগের শিক্ষাই হল কারবালার শিক্ষা। এ শিক্ষা আজও জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আদর্শ। সত্যকে জানতে হলে, স্রষ্টার পথ চিনতে হলে এবং স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে হলে ধরতে হবে হযরত ফাতিমার পথ। তাই হজরত ফাতিমা(সা) আদর্শ মানবাত্মার প্রতীকবেশুমার লানত বর্ষিত হোক দুশমনে আহলে বায়েত পারআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদদিন ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাহুম31=12=202