পোস্টগুলি

আগস্ট, ২০২০ থেকে পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে

পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে হযরত ইমাম হোসাইন ‎(আ.) -এর ব্যক্তিত্বড.মাওলানা এ.কে. ‏এম মাহবুবুর রহমান*ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏শুধু একটি নাম নয় ‎,একটি ইতিহাস ‎,একটি চেতনা ‎,হক ও বাতিলের নির্ণয়কারী। দুনিয়ার ইতিহাসে ন্যায়-ইসাফকে প্রতিষ্ঠিত করা ‎,অন্যায় ‎,জুলুম ‎,নির্যাতন ‎,স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দড়ানোর জন্য যারাই নিজের জান ও মাল দিয়ে সত্যের সাক্ষ্য হিসাবে কালোত্তীর্ণ অমর ব্যক্তিত্ব হিসাবে সত্যাণ্বেষীদের মন-মগজে স্থান জুড়ে আছেন ‎,যদের আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে যুগে যুগে কুফর ‎,শিরক তথা তাগুতের মসনদ জ্বলে পুড়ে ভস্মীভূত হচ্ছে এবং হবে ইমাম হোসাইন ‎(আ.) -এর স্থান তাদের শীর্ষে রয়েছে এবং থাকবে। ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏কিয়ামত পর্যন্ত বাতিলের বিরুদ্ধে সত্যের সকল যুদ্ধের সেরা ইমাম বা অপ্রতিদ্বন্দী নেতা ।হোসাইন ‎(ﺣﺴﻴﻦ ) ‏নামটির মাঝেই রয়েছে গভীর তাৎপর্য ।ﺣﺴﻴﻦ ‏শব্দেরح ‏হরফ দিয়েﺣﺴﻦ (হুসন) ‏বা সুন্দেই ‎,আকর্ষণীয় ‎,দৃষ্টিনন্দন ‎,শ্রুতিমধুর ‎,বাহ্যিক ও আত্মিক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বুঝায়।س (সীন) ‏দ্বারা সাআদাতﺳﻌﺎدت ‏বা দৃঢ় প্রত্যয় ‎,ي (ইয়া) ‏দ্বারাﻳﻘﻴﻦ (ইয়াকীন) ‏বা প্রত্যয় ‎,ن (নূন) ‏হরফ ‎;দ্বারাﻧﻮر ‏বা আলো ও জ্যোতি বুঝায়। অর্থাৎﺣﺴﻴﻦ (হোসাইন ‎) ‏এমন সত্তা ‎,এমন ব্যক্তিত্ব যিনি জাগতিক ‎,মানসিক ‎,আত্মিক সকল প্রকারের সৌন্দর্যের প্রতীক ‎,সৌভাগ্য-সমৃদ্ধিরি পথ নির্দেশক ‎,দৃঢ় প্রত্যয়ীর সর্বশ্রেষ্ঠ নমুনা ‎,আপসহীনতার মূর্ত প্রতীক ‎,আর সকল যুগের সকল মানুষের জন্য নূর বা আলোকবর্তিকা। হাদীসের ভাষায়-ان ا ﻟﺤﺴﻴﻦ ﻣﺼﺒﺎ ح ا ﻟﻬﺪ ى و ﺳﻔﻴﻨﺔ ا ﻟﻨﺠﺎ ة‘ ‏হোসাইন হেদায়েতের আলোকবর্তিকা ও নাজাতের তরী’’‘ ‏হোসাইন’ ‏নামটিও অতি পবিত্র। এ নাম মানুষের দেয়া নয়। এ নামও মহান আল্লাহ তা’ ‏আলা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা নাসাফী ‎(রহ.) ‏বলেন ‎:وﻟﻤﺎ وﻟﺪ اﻟﺤﺴﻴﻦ ﻗﺎل ﻳﺎ ﻣﺤﻤﺪ ان ﷲ ﻳﻬﻨﻴﻚ ﺑﻬﺬا اﻟﻤﻮﻟﻮد و ﻳﻘﻮل ﻟﻚ اﺳﻤﻪ ﺑﺎﺳﻢ اﺑﻦ هارون ﺷﺒﻴﺮ و ﻣﻌﻨﺎﻩ ﺣﺴﻴﻦ -( ﻧﺰهة اﻟﻤﺠﺎﻟﺲ،ص229)‘ ‏হোসাইন জন্ম গ্রহণ করার পর হযরত জিবরাইল ‎(আ.) ‏এসে বললেন ‎:‘‘ ‏হে মুহাম্মদ ‎(সা.) ‏আল্লাহ তা’ ‏আলা এ নবজাত শিশুর জন্মে আপনাকে অভিবাদন ও মুবারকবাদ জানিয়েছেন এবং বলেছেন ‎,হযরত হারুন ‎(আ.)– ‏এর ছলের নামে তার নাম রাখতে। তার ছলের নাম শাব্বির ‎,যার আর বি অর্থ হয় হোসাইন’’ ‏।’ (নুযহাতুল মাজালেস ‎:. 229)ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏ছিলেন রাসূলে আকরাম নূরে মোজাসসাম ‎(সা.)– ‏এর আহলে বাইতের অন্যতম স্তম্ভ । আহলে বাইত সম্পর্কে আল কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে রাসূলে পাক ‎(সা.) ‏তাদের পূত-পবিত্রতার কথা ঘোষণা করে ছেন। বিশ্ব বিখ্যাত হাদীস মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে ‎:ﻋﻦ ﻋﺎﺋﺸﺔ ﺧﺮج اﻟﻨﺒﻰصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم ﻏﺪاة و ﻋﻠﻴﻪ ﻣﺮط ﻣﺮﺣﻞ ﻣﻦ ﺷﻌﺮ اﺳﻮد ﻓﺠﺎء اﻟﺤﺴﻦ ﺑﻦ ﻋﻠﻰ ﻓﺎدﺧﻠﻪ ﺛﻢ ﺟﺎء اﻟﺤﺴﻴﻦ ﻓﺪﺧﻞ ﻣﻌﻪ ﺛﻢ ﺟﺎﺋﺖ ﻓﺎﻃﻤﺔ ﻓﺎدﺧﻠﻬﺎ ﺛﻢ ﺟﺎء ﻋﻠﻰ ﻓﺎدﺧﻠﻪ ﺛﻢ ﻗﺎل :( إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرً ا)‘ ‏উম্মুল মু’ ‏মিনীন হযরত আয়েশা বলেন ‎: ‏মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভোরবেলায় ঘর থেকে বের হন। তার গায়ে ছিল পশমের মোটা ইয়েমেনী চাদেই । তখন হাসান ইবনে আলী আসলেন। মহানবী তাকে এই বড় চাদরের ভেতর ঢুকিয়ে নিলেন ‎,এরপর হোসাইন আসলেন তিনি তাকেও চাদরের ভেতর ঢুকিয়ে নিলেন ‎,এরপর ফাতেমা আসলেন ‎,পয়গম্বর ‎(সা.) ‏তাকেও চাদরের ভেতর ঢুকালেন। সবশেষে আলী আসলে মহানবী আলীকেও চাদরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর মহাগ্রন্থ আল কুরআনের এ আয়াত পাঠ করলেন ‎:( إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا)‘ ‏আল্লাহর ইচ্ছায় হলো তিনি আহলে বাইত থেকে সকল প্রকার অপবিত্রতা দূর করবেন এবং তোমাদের সম্পূর্ণ রূপে পবিত্র করবেন’ ‏।’’ (সূরা আহযাব ‎: 33)(মুসলিম শরীফ ‎,5ম খণ্ড ‎,. ‏পৃ. 1883 ;ফতহুল কাদীর শওকানী ‎,4র্থ খণ্ড ‎,. ‏পৃ. 279)এ হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ী উক্ত পাঁচজনকে চাদরের ভেতর ঢুকিয়ে কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে আল্লাহর নবী আহলে বাইতের মর্যাদা যেভাবে তুলে ধরেছেন একজন ঈমানদারের জন্য এটাই যথেষ্ট । মহান আল্লাহ তা’ ‏আলা অন্যত্র এরশাদ করে ন ‎:( قُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَىٰ ۗ وَمَن يَقْتَرِفْ حَسَنَةً نَّزِدْ لَهُ فِيهَا حُسْنًا ۚ إِنَّ اللَّـهَ غَفُورٌ شَكُورٌ)‘ ‏হে রাসূল আপনি বলুন ‎: ‏আমি আমার দাওয়াতের জন্য তোমাদের কাছে আমার আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছু চাইনা । যে কেউ উত্তম কাজ করে আমি তার জন্য তাতে পূণ্য বাড়িয়ে দেই । নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাকারী ‎,গুণগ্রাহী।’ (সূরা আশ শুরা ‎: 23)আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা এবং তাদের পদাংক অনুসরণই সত্য পথে টিকে থাকা এবং গোমরাহী থেকে নিজেকে রক্ষা করার অন্যতম উপায় হিসাবে আল্লাহর নবী বিদায় হজ্জের ভাষণে ঘোষণা দিয়েছেন।ﻋﻦ ﺟﺎﺑﺮرضي‌الله‌عنه ﻗﺎل رأﻳﺖ رﺳﻮل ﷲصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم ﻓـﻰ ﺣﺠﺘﻪ ﻳﻮم ﻋﺮﻓﺔ و هو ﻋﻠﻰ ﻧﺎﻗﺘﻪ اﻟﻘﺼﻮاى ﻳﺨﻄﺐ ﻓﺴﻤﻌﺘﻪ ﻳﻘﻮل ﻳﺎ اﻳﻬﺎ اﻟﻨﺎس اﻧـﻰ ﺗﺮکت ﻓﻴﻜﻢ ﻣﺎ ان اﺧﺬﺗﻢ ﺑﻪ ﻟﻦ ﺗﻀﻠﻮا کتاب ﷲ و ﻋﺘﺮﺗﻰ اهل ﺑﻴﺘﻲ‘ ‏হযরত জাবের ‎(রা.) ‏বলেন ‎,‘ ‏আমি আরাফার দিনে হজ্ব অনুষ্ঠানে রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) -কে তার কাসওয়া নামক উটনীর পিঠে বসা অবস্থায় সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলতে শুনেছি-হে মানবমণ্ডলী! ‏আমি তোমাদের কাছে এমন বস্তু রেখে যাচ্ছি তোমরা তা ধারণ করলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইত ।’ (জামে তিরমিজি)হযরত ইমাম হাসান ‎(আ.) ‏ও ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏কত বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন ‎,রাসূলে আকরাম ‎(সা.)– ‏এর ঘোষণা থেকে তা সহজেই অনুমেয়।ﻋﻦ اﺑﻲ ﺳﻌﻴﺪ ﻗﺎل ﻗﺎل رﺳﻮل اﷲ ﺻﻠﻲ اﷲ ﻋﻠﻴﻪ و ﺳﻠﻢ اﻟﺤﺴﻦ و اﻟﺤﺴﻴﻦ ﺳﻴﺪا ﺷﺒﺎب اهل اﻟﺠﻨﺔ (رواﻩ اﻟﺘﺮﻣﺬى ، ج 2، ص 218)হযরত আবু সাঈদ খুদরী ‎(রা.) ‏হতে বর্ণিত ‎,রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏এরশাদ করে ছেন ‎:‘ ‏হাসান ও হোসাইন দু’ ‏জন বেহেশতবাসী যুবকদের নেতা।’ (জামে তিরমিযি ‎,2য় খণ্ড ‎,. 217)পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর ঘোষণার প্রেক্ষিতিই মুফতী শফী ‎(রহ.) ‏লিখেছেন ‎:‘ ‏পবিত্র আহলে বাইতের মুহাববাত ঈমানের অংশ বিশেষ। আর তাদের প্রতি কৃত পাশবিক অত্যাচারের কাহিনী ভুলে যাওয়ার মতো নয়। হযরত হোসাইন ‎(রা.) ‏এবং তার সাথী দের ওপর নিপীড়নমূলক ঘটনা এবং হৃদয়বিদারক শাহাদাত যার অন্তরে শোক এবং বেদনা সৃষ্টি করে না ‎,সে মুসলমান তো নয়ই ‎,মানুষ নামের অযোগ্য।’ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏ছিলেন মহানবী ‎(সা.) ,শেরে খোদা হযরত আলী ‎(আ.) ‏এবং খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা যাহরা ‎(আ.)– ‏এর হাতে গড়া এক মহান ব্যক্তিত্ব । আল্লাহর দীনের জন্য নিবেদিত প্রাণ। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় না করে আপসহীনভাবে সত্যের সাক্ষি হিসাবে নিজেকে অটল ‎,অবিচল রেখে প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দীনকে ঠিক রাখার বাস্তব উদাহরণ ছিলেন হযরত ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏। সত্যের প্রতি অবিচল থাকার অনন্য দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছিল হোর ইবনে ইয়াযীদ তামিমীর সেনাবাহিনীর সামনে ইমাম হোসাইনের প্রদত্ত ভাষণে। তিনি বলেন ‎:اﻳﻬﺎ اﻟﻨﺎس ان رﺳﻮل الله علیه صلی الله و سلم قال من رای سلطانا جائزا مستحلا لحرام الله ناکثا لعهد الله مخالفا لسنة رسول الله یعمل فی عباد الله بالاثم و العدوان فلم یغیر علیه بفعل و لا قول کان حقا علی الله ان یدخله مدخلة، الا و ان هولاء قد لزموا طاعة الشیطان و ترکو طاعة الرحمن اظهر الفساد و عطلوا الحدود و استأثروا بالفئ و احلو حرام الله و حرموا حلاله و انا احق من غیر‘ ‏হে লোকসকল! ‏রাসূলুল্লাহা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‎,যে ব্যক্তি এমন অত্যাচারী শাসককে দখবে যে আল্লাহর হারামকে হালাল করছে ‎,আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে ‎,রাসূলের সুন্নাতের খেলাফ করছে ‎,আল্লাহর বান্দাদের সাথে গুনাহ ও শত্রুতাপূর্ণ কাজ করছে ‎,কাজ ও কথার দ্বারা কেউ যদি তা প্রতিহত করার না থাকে তখনই আল্লাহ তা’ ‏আলা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে ন।’ ‏তিনি বলেন ‎:‘ ‏সাবধান! ‏ওরা ‎(ইয়াযীদ গোষ্ঠি) ‏রহমানের ‎(আল্লাহর) ‏আনুগত্য ছেড়ে দিয়েছে ‎,বিপর্যয় সৃষ্টি করে ছে ‎,আল্লাহর হদ বা সীমা বন্ধ করে দিয়েছে ‎,বিনা পরিশ্রমে সম্পদ ভোগে মতে উঠেছে ‎,আল্লাহ যা হারাম করে ছেন তা হালাল করছে ‎,আর যা হালাল করে ছেন তা হারাম করছে ‎,এ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ উল্টিয়ে দিতে আমিই সবচেয়ে বেশি অধিকার রাখি।’ (তারিখে তাবারী ‎,2য় খণ্ড ‎,. 307)কারবালায় যাওয়ার পথে অনেকেই ইমাম হোসাইন ‎(আ.) -কে বলেছেন এ পথ বিপজ্জনক। আপনি বরং ফিরে যান। ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏তাদের জবাবে বলেছিলেন ‎:ﺳﺎﻣﻀﻰ و ﻣﺎ ﺑﺎﻟﻤﻮ ت ﻋﺎ ر ﻋﻠﻰ ا ﻟﻔﺘﻰاذا ﻣﺎ ﻧﻮ ى ﺣﻘﺎ و ﺟﺎ هد ﻣﺴﻠﻤﺎ‘ ‏আমাকে যেতে নিষেধ করছো ‎? ‏কিন্তু আমি অবশ্যই যাবো ‎,আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখাও ‎? ‏একজন বীরের কাছে কি মৃত্যু অপমানজনক ‎?’পবিত্র হজ্ব অনুষ্ঠানের মাত্র দু’ ‏দিন বাকি ‎,এ সময় হজ্ব আদায় না করে কিয়ামের ‎(আন্দোলনের ‎) ‏পথ বছে নিয়ে মক্কা থেকে কুফার পথে পাড়ি জমানো কত বলিষ্ঠ ঈমান ও খেলাফতে ইলাহিয়া রক্ষার বাস্তব প্রমাণ তা ইতিহাস ‎,দর্শন ও শিক্ষা গ্রহণ কারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏ছিলেন রাসূলে খোদা ‎(সা.) -কে ভালোবাসার মাধ্যম ।ﻋﻦ اﺑﻰ هریرة ﻗﺎل ﻗﺎل رﺳﻮل اﷲ ﺻﻠﻲ اﷲ ﻋﻠﻴﻪ وﺳﻠﻢ ﻣﻦ اﺣﺐ اﻟﺤﺴﻦ و اﻟﺤﺴﻴﻦ ﻓﻘﺪ اﺣﺒﻨﻰ و ﻣﻦ اﺑﻐﻀﻬﻤﺎ ﻓﻘﺪ اﺑﻐﻀﻨﻰহযরত আবু হুরায়রা বর্ণনা করে ন ‎:‘ ‏রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏বলেছেন ‎,যে ব্যক্তি হাসান ও হোসাইন কে ভালোবাসবে সে অবশ্যই আমাকে ভালোবাসবে ‎,আর যে তাদের প্রতি দুশমনী রাখবে ‎,সে অবশ্যই আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে।’ (ইবনে মাজা)আল কুরআনের আয়াত ও রাসূলে খোদা ‎(সা.)– ‏এর ঘোষণা মোতাবেক উম্মতের নাজাতের তরী হযরত হোসাইন ‎(আ.) ‏। তার শাহাদাতের ঘটনা শুনে শুধু ক্রন্দন বা আফসোস করাই তার প্রতি ভালোবাসার প্রকৃত প্রমাণ নয় বরং ইয়াযীদ ও তার উত্তরসূরি নব্য ইয়াযীদ যারা আল্লাহর এ যমিনে হারামকে হালাল করছে ‎,আবার হালাল কে হারাম করছে ‎,যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধানকে বাদ দিয়ে তাগুতী শাসন চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে জান ‎,মাল তথা সব কিছু দিয়ে‘ ‏বাঁচলে গাজী আর মরলে শহীদ’ ‏এ প্রত্যয় নিয়ে প্রত্যক্ষ জিহাদে অবতীর্ণ হওয়াই হযরত হোসাইন ‎(আ.)– ‏এর প্রতি ভালোবাসার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। ইয়াযিদী শাসন চলবে ‎,সব বাতিলকে মেনে নেবো আর ইমাম হোসাইন ‎(আ.) -এর জন্য কাদবো এটা হবে মুনাফিকের ঘৃণ্যপথ। তাই আজকে আসুন ইমাম হোসাইন ‎(আ.)– ‏এর মতো দীপ্ত শপথ গ্রহণ করি। হয় আমরা হকপন্থীরা হকের ঝাণ্ডা উচু করে ই ছাড়বো ‎,না হয় শাহাদাতের পেয়ালা পান করে শহীদানে কারবালার সাথী হবো। আর কবি নজরুলের কন্ঠে বলে উঠবো ‎:উষ্ণীষ কোরানের ‎,হাতে তেগ আরবির ‎,দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির ‎,তবে শোন ঐ বাজে কোথা ফের দামামাশমশের হাতে নাও ‎,বাধো শিরে আমামাবেজেছে নাকাড়া ‎,হাঁকে নকীবের তূর্যহুশিয়ার ইসলাম ‎,ডুবে তব সূর্য।জাগো ‎,ওঠো মুসলিম ‎,হাঁকো হায়দারি হাঁকশহীদের খুনে সব লালে-লাল হয়ে যাক। ‎(অগ্নিবীণা)পরিশেষে সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নওয়াজ মঈনুদ্দীন চিশতী আজমেরী ‎(রহ.)– ‏এর কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই ‎:ﺟﺎ ن ﻣﻦ ﻧﺜﺎ رم ﺑﻨﺎ م ﺣﺴﻴﻦﻣﻦ ﻏﻼ م ﻏﻼﻣﺎ ن ﺣﺴﻴﻦ‘ ‏হোসাইনের নামে আমার জীবন উৎসর্গকৃতআমি কেবল তারই গোলাম যিনি হোসাইনের গোলাম’গ্রন্থপঞ্জি ‎:1. ‏কুরআন মজীদ ‎;2. ‏সহীহ মুসলিম শরীফ ‎;3. ‏তিরমিযি শরীফ ‎;4. ‏ইবনে মাজা ‎;5. ‏নুযহাতুল মাজালেস ‎;6. ‏ফতহুল কাদীর শওকানী ‎;7. ‏মিরকাত ফি শারহিল মিশকাত ‎;8. ‏শহীদে কারবালা-মুফতী শফী ‎(রহ.) ;9.তারিখে তাবারী ‎;10. ‏অগ্নিবীণা-কাজী নজরুল ইসলাম ‎;12. ‏দিওয়ানে খাজায়ে হিন্দ ‎;13. ‏মাকতালুল হোসাইন ‎;14. ‏নেহায়াতুল আরব ‎;15. ‏আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া।*অধ্যক্ষ ‎,ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসা ওচেয়াম্যান ‎,ফার্সী ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশপবিত্র কুরআনের আয়াতের আলোকে সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন ‎(আ.)আল্লাহ তা’ ‏আলা এরশাদ করেন ‎:( فَتَلَقَّىٰ آدَمُ مِن رَّبِّهِ كَلِمَاتٍ فَتَابَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ)‘ ‏অতঃপর আদমের নিকট রবের পক্ষ থেকে কয়েকটি শব্দ ওহী করা হলো ‎,অতঃপর তিনি ‎(আল্লাহ) ‏তার প্রতি প্রত্যাবর্তন করলেন ‎(তাকে ক্ষমা করলেন) ‏। নিঃসন্দেহে তিনি পুনঃপুনঃপ্রত্যাবর্তনকারী ‎(তওবা কবুলকারী) ‏পরম দয়ালু।’ (সূরা বাকারা: 37)উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে যে ‎,হযরত আদম ‎(আ.) ‏আল্লাহ তা’ ‏আলা র মহান আরশের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন এবং সেখানে রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ও মা’ ‏সুম ইমামগণের নাম দেখতে পলেন। হযরত জিবরাইল ‎(আ.) ‏তাকে নামগুলো কাদের তা বুঝিয়ে দিলেন। অতঃপর আদম ‎(আ.) ‏বললেন ‎:‘ ‏হে পরম সাত্তা! ‏আলীর উসিলায় ‎,হে স্রষ্টা! ‏ফাতেমার উসিলায় আমাদের ক্ষমা কর।’এর পর হযরত ইমাম হোসাইন ‎(আ.) -এর নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে তার চোখে অশ্রু এসে গেল । তখন তিনি বললেন ‎:‘ ‏হে আমার ভাই জিবরাইল! ‏এর কী কারণ যে ‎,হোসাইনের নাম উচ্চারণে আমার চোখে অশ্রু এসে যাচ্ছে ‎?’ ‏জিবরাইল বললেন ‎:‘ ‏আপনার বংশধরদের মধ্য থেকে আপনার এ সন্তান এমন মুসিবতের মুখোমুখি হবে যে ‎,দুনিয়ার বুকে আসন্ন অন্য সমস্ত মুসিবত এর সামনো স্লান হয়ে যাবে।’ ‏আদম ‎(আ.) ‏জিজ্ঞাসা করলেন ‎:‘ ‏তার ওপরে কী ধরনের মুসিবত আপতিত হবে ‎?’জিবরাইল বললেন ‎:‘ ‏তিনি পিপাসার্ত অবস্থায় তার পূর্বে নিহত সঙ্গীদের লাশ সামনে নিয়ে নিহত হবেন। শত্রুরা তার মৃত্যু দেখার জন্য অপেক্ষা করবে।’ ‏তখন আদম ‎(আ.) ‏ও জিবরাইল খুব ক্রন্দন করলেন।’ (আল আওয়ালিম ‎:.পৃ.104-117)‘ ‏হায়! ‏আমি যদি তাদের সাথে থাকতাম’ !আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন ‎,যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সাথে জিহাদে শরীক হতে পারেনি এক পর্যাযে তারা বলবে ‎:( يَا لَيْتَنِي كُنتُ مَعَهُمْ فَأَفُوزَ فَوْزًا عَظِيمًا)‘ ‏হায়! ‏আমিও যদি তাদের সাথে থাকতাম তাহলে বিরাট সাফল্যের অধিকারী হতাম!’ (সূরা নিসা ‎: 73)হযরত ইমাম রেযা ‎(আ.) ‏উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করার পর বলেন ‎:‘ ‏হে শহীদের! ‏পুত্র তুমি যদি হযরত রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏ও তার আহলে বাইতের সাথে বেহেশতে স্থান লাভ করতে চাও ‎,তাহলে তোমাকে হযরত ইমাম হোসাইন ‎(আ.) -এর হত্যাকারীদের প্রতি অভিসম্পাত করতে হবে । যারা তার সাথে শহীদ হয়েছিলেন তুমি যদি তাদের মতো পুরস্কৃত হতে চাও ‎,তাহলে যখনই তুমি তার কথা স্মরণ করবে তখনই বলবে ‎: ‏হায়! ‏আমি যদি তাদের সাথে থাকতাম ‎,তাহলে এক মহাবিজয় লাভ করতে পারতাম!’ (বিহারুল আনওয়ার ‎: 44তম খণ্ডণ্ড ‎,299 )‘ ‏অঙ্গীকার পূরণ কর’আল্লাহ তা’ ‏আলা কুরআন মজীদে এরশাদ করেন ‎:( وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّـهَ وَرَسُولَهُ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا)‘ ‏ঈমানদারদের মধ্যে এমন অনেক লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছে ও কেউ কেউ ‎(শাহাদাতের জন্য) ‏প্রতীক্ষা করছে এবং তারা তাদের অঙ্গীকারে পরিবর্তন সাধন করে নি।’ (সূরা আহযাব ‎: 23)আশুরার দিনে ইমাম হোসাইন ‎(আ.)-এর সঙ্গী-সাথিগণ একজন একজন করে তার নিকট আসেন এবং তাকে অভিনন্দন জানান। তারা তাকে সম্বোধন করে বলেন ‎:‘ ‏হে আল্লাহর রাসূল ‎(সা.)-এর বংশধর!’ ‏তখন তিনি তাদের অভিনন্দনের জবাবে বলেন ‎:‘ ‏তোমাদের পরে শাহাদাতের জন্য আমরা অপেক্ষা করব।’ ‏এর পর তিনি উপরিউক্ত আয়াত পাঠ করলেন। এর পর ইমাম হোসাইন ‎(আ.) -এর সঙ্গী-সাথিগণ ‎(আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হন) ‏সকলেই শহীদ হলেন এবং তার সাথে কেবল তার পরিবারের সদস্যরা রইলেন। ‎(আল-আওয়ালিম ‎: 17তম খণ্ডণ্ড ‎,পৃ. 275) ‏এর পর তারা ‎(শত্রুরা) ‏তার ওপর ভয়ঙ্কর ভাবে ঝপিয়ে পড়ল।ওপরে উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম রেযা ‎(আ.) ‏বলেন ‎:‘ ‏আল্লাহ তা’ ‏আলা যখন হযরত ইবরাহীম ‎(আ.) -এর নিকট হযরত ইসমাইল ‎(আ.) -এর পরিবর্তে একটি দুম্বা পাঠালেন ও তা-ই কুরবানি করার নির্দেশ দিলেন ‎,তখন ইবরাহীম ‎(আ.) ‏আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন যাতে তার মধ্যে সেই পিতার বিয়োগ-ব্যথা অনুভূত হয় যিনি তার সন্তানকে কুরবানি করছেন এবং এভাবে যাতে তিনি সর্বোত্তম পুরস্কারের উপযুক্ত হতে পারেন। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নিকট ওহী হয় ‎:‘ ‏হে ইবরাহীম! ‏আমার সৃষ্ট সকল মানুষের মধ্যে তোমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় কে ‎?’ ‏ইবরাহীম ‎(আ.) ‏জবাব দিলেন ‎:‘ ‏আমি মুহাম্মাদকে সকলের চেয়ে বেশি ভালোবাসি।’ ‏আল্লাহ পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন ‎:‘ ‏তুমি কাকে বেশি ভালোবাস ‎,মুহাম্মাদকে ‎,নাকি তোমার আত্মাকে ‎?’ ‏তিনি বললেন ‎:‘ ‏মুহাম্মাদকে।’ ‏আল্লাহ পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন ‎:‘ ‏তার সন্তান কি তোমার নিকট তোমার নিজের সন্তানের চেয়ে প্রিয়তর ‎?’ ‏তিনি জবাব দিলেন ‎:‘ ‏অবশ্যই ।’ ‏আল্লাহ বললেন ‎:‘ ‏কঠিন মুসিবতে নিপতি হয়ে মুহাম্মাদের সন্তানের মৃত্যুকেই কি তুমি বেশি কষ্ট পাবে ‎,নাকি আমার প্রতি তোমার আনুগত্য প্রকাশের জন্য নিজের হাতে তোমার পুত্রের কুরবানিতে বেশি কষ্ট পাবে ‎?’ ‏তিনি বললেন ‎:‘ ‏মুহাম্মাদের সন্তানের মৃত্যুতে।’ ‏তখন আল্লাহ বললেন ‎:‘ ‏ইবরাহীম! ‏একদল লোক যারা নিজেদেরকে মুহাম্মাদের অনুসারী বলে মনে করবে-তার সন্তানের রক্তে নিজেদের হাত রঞ্জিত করবে এবং এভাবে তারা আমার ক্রোধের শিকার হবে ।’ ‏একথা শুনে ইবরাহীম ‎(আ.) ‏ক্রন্দন করতে লাগলেন। তখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’ ‏আলা তার নিকট ওহী প্রেরণ করলেন ‎:‘ ‏হে ইবরাহীম! ‏হোসাইনের মৃত্যু তোমার জন্য এক বিরাট মুসিবত স্বরূপ হতো। এ কারণে মহামুসিবতে নিপতিত হওয়ায় আমি যাদেরকে পুরস্কৃত করব তোমাকেও তদ্রূপ পুরস্কৃত করব।’ (বিহারুল আনওয়ার ‎: 44তম খণ্ডণ্ড ‎,.পৃ. 225-266) ‏আল্লাহ তা’ ‏আলা সূরা আল-ফাজরে এরশাদ করেন ‎:( يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً)‘ ‏হে নিশ্চিন্ত নাফস! ‏তুমি তোমার রবের দিকে প্রত্যাবর্তন কর এমন অবস্থায় যে ‎,তুমি ‎(তার প্রতি) ‏সন্তুষ্ট ও ‎(তার পক্ষ থেকে) ‏সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত।’ (সূরা আল-ফাজরে-27-28)হযরত ইমাম জাফর সাদেক ‎(আ.) ‏বলেন ‎:‘ ‏তোমরা তোমাদের নামাযে সূরা আল-ফাজর পড়বে। হোসাইন বিন আলী ‎(আ.) ‏প্রসঙ্গে এটি নাযিল হয়েছে।’ ‏তখন সেখানে উপস্থিত আবু আসসামা তাকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। জবাবে ইমাম বললেন ‎:‘ ‏এখানে‘ ‏হে নিশ্চিন্ত নাফস’ ‏বলতে ইমাম হোসাইন ‎(আ.) -এর নামকে বোঝানো হয়েছে। তিনি আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট ‎,এ কারনে আল্লাহও তার ওপর সন্তুষ্ট। আর হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.) -এর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত তার সঙ্গী-সাথিগণ শেষ বিচাই দিনের ব্যাপারে আল্লাহর ওপর সনন্তুষ্ট। যারা সব সময় এ আয়াত পড়বে তারা বেহেশতে ইমাম হোসাইন ‎(আ.) -এর সাথে থাকবে।’ (বিহারুল আনওয়ার ‎: 44তম খণ্ড ‎,পৃ.218-219)মাহবুবা ‎,জুন-1996অনুবাদ ‎:মুহাম্মাদ আবু যীনাত‘ ‏আমি কোনো ধন-সম্পদ বা ক্ষমতার লোভে কিংবা গালযোগ সৃষ্টির জন্য বিদ্রোহ করছিনা ‎,আমি আমার নানাজানের উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই ‎,আমি‘ ‏সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ’ ‏করতে চাই এবং আমার নানাজান যে পথে চলেছেন আমি ও সে পথে চলতে চাই।’ইমাম হোসাইন ‎(আ.) [মাকতালু খারাযমী ‎: 1/188]

🌹🌹আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারজাউম🍒🍒🍒🍒🍒🍒মুবাহালা=====🌹🌹=পর্ব ১=🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷 চিরভাস্বর মহানবী-(সা)’, ‏দ্বিতীয় খণ্ড থেকে সংগৃহীত🌷🌷🌹🌹🌹সত্তরটি গ্রাম সমেত নাজরান অঞ্চল হিজায ও ইয়েমেন সীমান্তে অবস্থিত। ইসলামের চূড়ান্ত পর্যায়ে আবির্ভাবকালে এ এলাকাটি হিযাজের একমাত্র খ্রিষ্টান অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। এ এলাকার অধিবাসীরা বিভিন্ন কারণে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল।১🌹🌹বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও ধর্মীয় কেন্দ্রসমূহের প্রধানদের কাছে চিঠি-পত্র প্রেরণের পাশাপাশি মহানবী ‎(সা.) ‏নাজরানের আর্চবিশপ আবু হারিসা-এর কাছে ইসলাম ধর্মের দাওয়াত দিয়েছিলেন২ ‎:🌹🌹“ইবরাহীম, ‏ইসহাক ও ইয়াকূবের প্রভুর নামে, (এ পত্রটি) ‏মহান আল্লাহর নবী মুহাম্মদের পক্ষ থেকে নাজরানের মহামান্য আর্চবিশপের প্রতি। ইসহাক ও ইয়াকূবের প্রভুর প্রশংসা করছি এবং আপনাদের বান্দাদের ‎(গায়রুল্লাহর) ‏উপাসনা থেকে মহান আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। আপনাদেরকে গায়রুল্লাহর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য থেকে বের হয়ে মহান আল্লাহর আধিপত্যে ‎(বেলায়েত) ‏প্রবেশ করার আহবান জানাচ্ছি। আর যদি আপনারা আমার দাওয়াত গ্রহণ না করেন, ‏তা হলে অন্ততঃপক্ষে ইসলামী সরকারকে কর ‎(জিযিয়া) ‏প্রদান করুন ‎(যে, ‏এ কর প্রদান করার দরুন আপনাদের জীবন ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হবে)। এর অন্যথা হলে আপনাদের প্রতি সমূহ বিপদ অর্থাৎ যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে।”৩🌹🌹কিছু কিছু শিয়া ঐতিহাসিক সূত্রে আরো বেশি বর্ণিত হয়েছে যে, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏আহলে কিতাব-এর সাথে সংশ্লিষ্ট ঐ আয়াতও৪ পত্রে লিখেছিলেন, ‏যার মধ্যে এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের প্রতি সবাইকে আহবান জানানো হয়েছে।🌹🌹মহানবী ‎(সা.)-এর প্রেরিত প্রতিনিধি দল নাজরানে প্রবেশ করে তাঁর পত্র নাজরানের প্রধান খ্রিষ্ট ধর্মযাজকের কাছে অর্পণ করেন। আর্চবিশপ ভালোভাবে পত্রটি পাঠ করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য তিনি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরামর্শসভার আয়োজন করেন। ঐ পরামর্শসভার একজন সদস্য ছিলেন শুরাহবিল, ‏যিনি বুদ্ধিমত্তা, ‏বিচারক্ষমতা ও দক্ষতার জন্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি আর্চবিশপের উত্তরে বলেছিলেন ‎: “আমার ধর্ম বিষয়ক জ্ঞান খুবই কম। সুতরাং অভিমত ব্যক্ত করার অধিকার আমার নেই। আর যদি আপনারা অন্য কোন বিষয়ে আমার সাথে পরামর্শ করতেন, ‏তা হলে আমি আপনাদের সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন পথের সন্ধান দিতাম।🌹🌹কিন্তু অনন্যোপায় হয়ে একটি বিষয় সম্পর্কে আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছি যে, ‏আমরা আমাদের ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে বহু বার শুনেছি যে, ‏একদিন হযরত ইসহাকের বংশধারা থেকে নবুওয়াতের পদ ইসমাঈলের বংশধারায় স্থানান্তরিত হবে। আর ‎‘মুহাম্মদ’, ‏যিনি ইসমাঈলের বংশধর, ‏তিনিই যে সেই প্রতিশ্রুত নবী হবেন, ‏তা মোটেই অসম্ভব নয়।”🌹🌹এ পরামর্শসভা এ মর্মে অভিমত ব্যক্ত করে যে, ‏নাজরানের প্রতিনিধি দল হিসেবে একদল লোক মুহাম্মদ ‎(সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে যেসব বিষয় তাঁর নবুওয়াতের সত্যতার দলিলস্বরূপ সেসব কাছে থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করার জন্য মদীনায় যাবে।🌹🌹তাই নাজরানবাসীর মধ্য থেকে ষাটজন সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে এ প্রতিনিধি দলের সদস্য নির্বাচিত করা হয়। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন তিনজন ধর্মীয় নেতা যাঁদের পরিচয় নিচে দেয়া হলো ‎:🌹🌹১. ‏আবু হারিসাহ ইবনে আলকামাহ্ ‎: ‏নাজরানের প্রধান ধর্মযাজক বা আর্চবিশপ যিনি হিজাযে রোমের গীর্জাসমূহের স্বীকৃত প্রতিনিধি ছিলেন।🌹🌹২. ‏আবদুল মসীহ্ ‎: ‏নাজরানের প্রতিনিধি দলের নেতা, ‏যিনি বিচার-বুদ্ধি, ‏দক্ষতা, ‏কর্মকৌশল ও ব্যবস্থাপনার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।🌹🌹৩. ‏আইহাম ‎: ‏যিনি ছিলেন একজন প্রবীণ ব্যক্তি এবং নাজরানবাসীর সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত।৫🌹🌹প্রতিনিধি দল রেশমী বস্ত্র নির্মিত অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিধান করে, ‏হাতে স্বর্ণনির্মিত আংটি পরে এবং গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে অপরাহ্নে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে মহানবী ‎(সা.)-কে সালাম জানায়। কিন্তু তিনি তাদের ঘৃণ্য ও অসংযত অবস্থা- ‏তাও আবার মসজিদের অভ্যন্তরে,- ‏দেখে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হন। তারা বুঝতে পারে, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏তাদের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু তারা এর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই তারা তৎক্ষণাৎ হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের এ ঘটনা সম্পর্কে জানালে তাঁরা বলেন, ‏এ ব্যাপারে সমাধান আলী ইবনে আবী তালিবের হাতে রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‏হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান এবং আবদুর রহমান ইবনে আউফ তাদের পূর্ব পরিচিত ছিলেন। প্রতিনিধি দল যখন হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী ‎(আ.)-এর কাছে গমন করে তাঁকে ঘটনা সম্পর্কে জানায়, ‏তখন আলী ‎(আ.) ‏তাদেরকে বলেছিলেন ‎: “আপনাদের উচিত আপনাদের এসব জমকালো পোশাক ও স্বর্ণালংকার পাল্টিয়ে সাদা-সিধাভাবে মহানবী ‎(সা.)-এর নিকট উপস্থিত হওয়া। তা হলে আপনাদেরকে যথাযথ সম্মান করা হবে।”🌹🌹নাজরানের প্রতিনিধি দল সাদামাটা পোশাক পরে এবং সোনার আংটি খুলে রেখে মহানবী ‎(সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে সালাম জানালে তিনিও সম্মানের সাথে তাদের সালামের জবাব দেন এবং তারা যে সব উপঢৌকন এনেছিল, ‏সেগুলোর কিছু কিছু গ্রহণ করেন। আলোচনা শুরু করার আগে প্রতিনিধিরা বলেছিল, ‏তাদের প্রার্থনার সময় হয়েছে। মহানবী ‎(সা.) ‏তাদেরকে মদীনার মসজিদে নববীতে নামায ও প্রার্থনা করার অনুমতি দেন এবং তারা পূর্ব দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করে।৬🌹🌹🌹🌹🌹নাজরানের প্রতিনিধিদের আলোচনা🌹🌹🌹কতিপয় সীরাত রচয়িতা, ‏মুহাদ্দিস ‎(হাদীসবিদ) ‏এবং ঐতিহাসিক মহানবী ‎(সা.)-এর সাথে নাজরানের প্রতিনিধিদের আলোচনার মূল বিষয় উদ্ধৃত করেছেন। তবে সাইয়্যেদ ইবনে তাউস এ আলোচনা এবং মুবাহালার ঘটনার সমুদয় বৈশিষ্ট্য অন্যদের চেয়ে সূক্ষ্ম ও ব্যাপকভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল মুত্তালিব শাইবানীর৭ ‎‘মুবাহালা’ ‏গ্রন্থ এবং হাসান ইবনে ইসমাঈলের৮ ‎‘যিলহজ্ব মাসের আমল’ ‏গ্রন্থ থেকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুবাহালার ঘটনার সমুদয় বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন।🌹🌹তবে এ ক্ষুদ্র পরিসরে এ মহা ঐতিহাসিক ঘটনার সমুদয় দিক, ‏যেসবের প্রতি দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ‏কতিপয় ঐতিহাসিক, ‏এমনকি সামান্য ইঙ্গিত পর্যন্ত করেন নি, ‏সেসব উদ্ধৃত করা সম্ভব হবে না। আর তাই হালাবী তাঁর সীরাত গ্রন্থে মহানবী ‎(সা.)-এর সাথে নাজরানের প্রতিনিধি দলের আলাপ-আলোচনা যা উদ্ধৃত করেছেন, ‏তার অংশ বিশেষের প্রতি আমরা ইঙ্গিত করব।৯🌹🌹মহানবী ‎(সা.) : “আমি আপনাদেরকে তাওহীদী ‎(একত্ববাদী) ‏ধর্ম, ‏এক-অদ্বিতীয় মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী এবং তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলার আহবান জানাচ্ছি।” ‏এরপর তিনি পবিত্র কুরআনের কতিপয় আয়াত তাদেরকে তেলাওয়াত করে শুনালেন।🌹🌹নাজরানের প্রতিনিধিগণ ‎: “আপনি যদি ইসলাম বলতে বিশ্বজাহানের এক-অদ্বিতীয় স্রষ্টা মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকেই বুঝিয়ে থাকেন, ‏তা হলে আমরা আগেই তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলছি।”🌹🌹মহানবী ‎(সা.) : “ইসলামের ‎(মহান আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ) ‏কতিপয় নিদর্শন আছে। আর আপনাদের কতিপয় কর্মকাণ্ড বলে দেয় যে, ‏আপনারা ইসলামে যথাযথ বাইয়াত হন নি। আপনারা কিভাবে বলেন যে, ‏আপনারা এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতকারী, ‏অথচ আপনারা একই সময় ক্রুশের উপাসনা করেন এবং শূকরের মাংস ভক্ষণ থেকে বিরত থাকেন না, ‏আর মহান আল্লাহর পুত্রসন্তানেও বিশ্বাস করেন?”🌹🌹নাজরানের প্রতিনিধিরা ‎: “আমরা তাঁকে ‎(হযরত ঈসা মসীহ্) ‘আল্লাহ্’ ‏বলে বিশ্বাস করি; ‏কারণ তিনি মৃতদের জীবিত এবং অসুস্থ রোগীদের আরোগ্য দান করতেন এবং কাদা থেকে পাখি তৈরি করে আকাশে উড়িয়ে দিতেন। আর এ সব কাজ থেকে প্রতীয়মান হয়, ‏তিনি আল্লাহ্।”🌹🌹মহানবী ‎(সা.) : “না, ‏তিনি মহান আল্লাহর বান্দা ও তাঁরই সৃষ্টি, ‏যাকে তিনি হযরত মারিয়াম ‎(আ.)-এর গর্ভে রেখেছিলেন। আর মহান আল্লাহ্ই তাঁকে এ ধরনের ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন।”🌹🌹একজন প্রতিনিধি ‎: “হ্যাঁ, ‏তিনিই মহান আল্লাহর পুত্র। কারণ তাঁর মা মারিয়াম ‎(আ.) ‏কোন পুরুষের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েই তাঁকে জন্ম দিয়েছিলেন। তাই অনন্যোপায় হয়ে বলতেই হয় যে, ‏তাঁর পিতা হচ্ছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ্, ‏যিনি বিশ্বজাহানের স্রষ্টা।”🌹🌹এ সময় ওহীর ফেরেশতা হযরত জিবরীল ‎(আ.) ‏অবতরণ করে মহানবী ‎(সা.)-কে বললেন ‎: “আপনি তাদেরকে বলে দিন ‎: ‏হযরত ঈসা মসীহর অবস্থা এ দিক থেকে হযরত আদম ‎(আ.)-এর অবস্থার সাথে সদৃশ যে, ‏তাঁকে তিনি তাঁর অসীম ক্ষমতা দিয়ে বিনা পিতা-মাতায় মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন।১০ তাই পিতা না থাকা যদি তিনি ‎(ঈসা) ‏যে খোদার পুত্র- ‏এ কথার প্রমাণ বলে বিবেচিত হয়, ‏তা হলে হযরত আদম ‎(আ.)-কে এ আসনের জন্য অধিকতর উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা উচিত। কারণ হযরত আদম ‎(আ.)-এর পিতা ছিল না, ‏আর তাঁর মাও ছিলেন না।”🌹🌹নাজরানের প্রতিনিধিরা ‎: “আপনার বক্তব্য আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না। আর পথ হচ্ছে এটাই যে, ‏একটি নির্দিষ্ট সময় আমরা পরস্পর মুবাহালা করব এবং যে মিথ্যাবাদী, ‏তার ওপর লানত ‎(অভিশাপ) ‏দেব এবং মহান আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদীকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য প্রার্থনা করব।”১১🌹🌹তখন ওহীর ফেরেশতা মুবাহালার আয়াত নিয়ে অবতরণ করে মহানবী ‎(সা.)-কে জানান, ‏যারা তাঁর সাথে অযথা বিতর্কে লিপ্ত হবে এবং সত্য মেনে নেবে না, ‏তাদেরকে মুবাহালা করতে আহবান জানাবেন এবং উভয় পক্ষ যেন মহান আল্লাহর কাছে এই বলে প্রার্থনা করেন যে, ‏তিনি মিথ্যাবাদীকে স্বীয় দয়া থেকে দূরে সরিয়ে দেন।🌹🌹🌹🌹فمن حاجّك فيه من بعد ما جائك من العلم فقل تعالوا ندع أبنائنا و أبنائكم و نسائنا و نسائكم و أنفسنا و أنفسكم ثمّ نبتهل فنجعل لعنة الله علي الكاذبين🌹🌹“আপনার কাছে সঠিক জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে আপনার সাথে বিতর্ক করে ‎(এবং সত্য মেনে নিতে চায় না) ‏তাকে বলে দিন ‎: ‏এসো, ‏আমরা আহবান করি আমাদের পুত্রসন্তানদের এবং তোমাদের পুত্রসন্তানদের, ‏আমাদের নারীগণকে এবং তোমাদের নারীগণকে, ‏আমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের নিজেদেরকে, ‏অতঃপর আমরা ‎(মহান আল্লাহর কাছে) ‏বিনীতভাবে প্রার্থনা করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর মহান আল্লাহর অভিশম্পাৎ করি।” (আলে ইমরান ‎: ‏৬৩)🌹🌹🌹🌹প্রচারে মোঃ শামসীর হায়দার

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ হাদীসে ঈদে গাদীর এবং আমিরুল মোমেনীন আলী ইবনে আবী তালিব ‎(আ.)-এর খেলাফতঈদ মোবারকহিজরী সনের দশম বর্ষ এবং হজের মৌসুম। হেজাযের মরুভূমি বিশাল জনসমষ্টির সাক্ষী যাদের সকলেই একই ধ্বনি দিতে দিতে একই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন।ঐ বৎসর হজের দৃশ্যে এক অন্যরকম উদ্দীপনা এবং উত্তেজনা বিরাজ করছিল। মুসলমানেরা অধীর আগ্রহে এবং দ্রুতবেগে পথের দু’ধারে বাড়ী ঘর পেরিয়ে মক্কায় উপস্থিত হচ্ছিলেন।মক্কা মরু প্রান্তরের লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি কানে আসছিল। কাফেলা সমূহ পালাক্রমে শহরের নিকটবর্তী হচ্ছিল। হাজীগণ ইহরামের লেবাস পরে একই বেশে ধূলামেখে অশ্রু ঝরিয়ে আল্লাহর নিরাপদ হারামে উপস্থিত হচ্ছিলেন। আর যে গৃহ ‎(কাবা) ‏তৌহীদের মহান দৃষ্টান্ত হযরত ইবরাহীম ‎(আ.) ‏কতৃক নির্মিত তার চার পাশে তাওয়াফ করছিলেন।ফরিদ ওয়াজদী দশম হিজরীতে অংশগ্রহণকারী হাজীদের সংখ্যা ৯০ হাজার বর্ণনা করেছেন(দায়েরাতুল মায়ারেফ, ‏ফরিদ ওয়াজদী, ‏৩য় খণ্ড, ‏পৃ. ‏৫৪২।) ‏কিন্তু কোন কোন বর্ণনায় ১২৪০০০ বলা হয়েছে।(আল গাদীর, ‏১ম খণ্ড, ‏পৃ. ‏৯।)রাসূল ‎(সা.) ‏দেখতে পেলেন ‎: ‏মসজিদুল হারাম পূর্ণ এবং সবাই ইবাদতে মশগুল।রাসূল ‎(সা.) ‏খুশী হলেন যে তিনি এ বৃহৎ কার্য সম্পাদন করতে পেরেছেন এবং তাঁর রেসালতের দায়িত্বকে উত্তম ভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছেন।কিন্তু মাঝে মধ্যেই দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা তাঁর চেহারায় দৃশ্যমান হতো এবং আনন্দকে তাঁর জন্য অপ্রীতিকর করে তুলত।তিনি ভয় পেতেন যে, ‏তার মৃত্যুর পর হয়ত জনতার এ সমষ্টি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ঐক্য লোপ পাবে ও পুনরায় অধঃপতিত হবে।রাসূল ‎(সা.) ‏খুব ভাল করেই জানতেন যে, ‏মুসলিম উম্মাহর জন্য এক ন্যায়পরায়ণ ও জ্ঞানী ইমামের পথ নির্দেশনা অতি জরুরী। আর এমনটি না হলে তাঁর দীর্ঘ দিনের মূল্যবান শ্রম বৃথা যাবে।এ কারণেই মহানবী ‎(সা.) ‏যখনই সফর অথবা যুদ্ধের জন্যে মদীনার বাইরে যেতেন, ‏এমনকি সে সফর সংক্ষিপ্ত হলেও তিনি বিশ্বস্ত এবং যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব অর্পণ করতেন এবং মদীনার জনগণকে অভিভাবকহীন রেখে যেতেন না।(কামেল, ‏ইবনে আসির, ‏পৃ. ‏২৪২, ‏২৭৮, ‏২১৬।)সুতরাং কিরূপে বিশ্বাস করা সম্ভব যে, ‏আমাদের প্রিয় ও সদয় নবী ‎(সা.) ‏বিশাল মুসলিম উম্মাহকে নিজের মৃত্যুর পর অভিভাবকহীন রেখে যাবেন। আর তিনি সবার চেয়ে ভাল জানেন যে এই পদমর্যাদার যোগ্য ব্যক্তি কে এবং খেলাফতের পোশাক কোন যোগ্য ব্যক্তির মাপে কাটা ও সেলাই করা হয়েছে।তিনি সেই ব্যক্তি যাকে বহু সংখ্যক কুরাইশ সর্দার ও রাসূল ‎(সা.)-এর আত্মীয়দের মাঝে ইসলামের দাওয়াতের জন্য যাদেরকে একত্রিত করা হয়েছিল, ‏তাদের মাঝে নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন।(তারিখে তারাবী, ‏৩য় খণ্ড, ‏পৃ. ‏১১৭১-১১৭৩।)তিনি পবিত্র ও একত্ববাদী ছিলেন। তিনি বিন্দুমাত্র শিরক ও মূর্তি পূজা করেন নি।তিনি দীনে মুবিনে ইসলামের অগ্রগতির ক্ষেত্রে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তাঁর জ্ঞানের ভিত্তি রাসূল ‎(সা.)-এর জ্ঞানের উৎস থেকেই। মজলুমের ডাকে সাড়া দান তাঁর উত্তম বিচার কার্যেরই অন্তর্ভূক্ত।(ফাযায়েলে খামসা, ‏১ম খণ্ড, ‏পৃ. ‏১৭৮- ‏১৮৬।) ‏তিনি সবার নিকট পরিচিত। তিনি হলেন হযরত আলী ইবনে আবু তালিব ‎(আ.)।পবিত্র হজ পালন করে সকলে আপন শহর অভিমুখে যাত্রা করেন। হঠাৎ রাসূল ‎(সা.) (গাদীরে খুম নামক স্থানে) ‏সকল হাজীদেরকে যাত্রা বিরতির নির্দেশ দেন। কেননা জিবরাইল ‎(আ.) ‏অবতীর্ণ হলেন এবং এই আয়াতটি তাঁকে জানালেন ‎:)يا ايهّا الرّسول بلّغ ما انزل اليك من ربّك وان لّم تفعل فما بلّغت رسالته والله يعصمك من النّاس(“হে রাসূল! ‏তোমার প্রভুর নিকট হইতে তোমার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তা ‎(লোকদের নিকট) ‏পৌঁছিয়ে দাও এবং যদি তুমি এরূপ না কর তাহলে তুমি তাঁর বাণী আদৌ পৌঁছালে না। নিশ্চয় আল্লাহ্ আপনাকে মানুষের কবল হতে রক্ষা করবেন” (মায়েদা ‎: ‏৬৭)।যে বিষয়টি আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে কড়া ভাষায় খেতাব করেছিলেন, ‏তা ছিল আলী ‎(আ.)-এর খেলাফতকে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রচার করা। রাসূল ‎(সা.) ‏বিষয়টি প্রচারে বিরত থাকছিলেন, ‏কেননা ভয় পেতেন বিষয়টি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও ফাটলের কারণ হতে পারে। তিনি তা প্রচারের জন্য অনুকূল পরিবেশের প্রতীক্ষায় ছিলেন। আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর তিনি অনুধাবন করলেন এখনই উপযুক্ত সময়। আর এই লক্ষ্যেই জনগণকে গাদীরে খুম নামক ধুধু মরুভূমিতে একত্রিত করলেন, ‏যার মাধ্যমে ইসলামের প্রাণ অর্থাৎ খেলাফত ও উত্তরাধিকারের ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে যায়।জনগণ বুঝতে পারছিলেন না যে কেন থামতে বললেন এবং কী এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছে। কিন্তু কিছু সময় না যেতেই যোহরের নামাজের জন্য আহবান করা হলো এবং নামাজ আদায় করার পর জনগণ রাসূল ‎(সা.)-এর আকর্ষণীয় এবং আসমানী চেহারাকে মিম্বরের উপর ‎(যা উটের হাউদায দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছিল) ‏দেখতে পেলেন।সর্বত্র নিস্তব্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল ‎... ‏এমন সময় রাসূল ‎(সা.)-এর মনোরম ও অর্থবহ বাণী মরুভূমির নিস্তব্ধতার অবসান ঘটাল। আল্লাহর প্রশংসার পর নিজের আসন্ন মৃত্যুর মর্মান্তিক খবর ঘোষণা করে বললেন ‎:হে লোক সকল! ‏আমি তোমাদের জন্য কেমন নবী ছিলাম? ‏সকলে সমস্বরে বলল ‎: ‏ইয়া রাসূলাল্লাহ! ‏আপনি আমাদেরকে সদুপদেশের ক্ষেত্রে কিঞ্চিত অবহেলা করেন নি। উপদেশ ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করেন নি। আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন ‎(আপনি উত্তম রাসূল)। রাসূল ‎(সা.) ‏বললেন ‎: ‏আমার পর আল্লাহর কিতাব ‎(কোরআান) ‏ও পবিত্র মাসুমগণ ‎(আমার আহলে বাইত) ‏একত্রে তোমাদের পথ প্রদর্শক। তোমরা যদি এই দু’টিকে দৃঢ় ও পরিপূর্ণ ভাবে আকড়ে ধর তাহলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না।অতঃপর আলী ‎(আ.)-এর হস্ত মোবারককে এমন ভাবে উচ্চে তুলে ধরলেন যে উপস্থিত সকলেই তাকে দেখতে পেলেন এবং বললেন ‎:লোকসকল! ‏কোন সে ব্যক্তি যে মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের থেকে ও বেশি শ্রেয় এবং তাদের উপর বেলায়েত ও আধিপত্য রাখেন?জনগণ বললেন ‎: ‏আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।রাসূল ‎(সা.) ‏বললেন ‎: ‏আল্লাহ্ হলেন আমার মাওলা ‎(অভিভাবক) ‏আর আমি মুমিনদের মাওলা এবং তাদের উপর তাদের নিজেদের চেয়েও বেশি অধিকার রাখি। অতঃপর বললেন ‎: ‏আমি যার মাওলা এবং যার প্রতি বেলায়েত ও আধিপত্ব রাখি। এই আলীও আমার পর তাদের মাওলা।من كنت مو لاه فهذا علي مولاه.এই বাক্যটিকে তিনবার আবৃতি করলেন। সবশেষে বললেন ‎: ‏এখানে উপস্থিত সকলে এ সত্য অন্যদের কাছে পৌঁছে দিবে।জনগণ তখনো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েনি এমতাবস্থায় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলো ‎:)اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الا سلام دنيا(“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে ‎(অনুগ্রহকে) ‏সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীনরূপে মনোনীত করলাম”(মায়েদা ‎: ‏৩)।আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরাধিকারী মনোনীত হওয়ার পর উপস্থিত জনতা মরিয়া হয়ে রাসূল ‎(সা.)-এর উত্তরাধিকারী হযরত আলী ‎(আ.)-কে মোবারক বাদ জানালেন।প্রথম যে ব্যক্তি আলী ‎(আ.)-কে মোবারকবাদ জানায় সে হলো আবু বকর, ‏অতঃপর ওমর। তারা এই বাক্যগুলি বলছিল এবং আমিরুল মুমিনিন আলী ‎(আ.)-এর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল ‎:بخ بخ يا علي ابن ابي طالب اصبحت موليئ و مولي كل مومنين و المومنات“শুভ হোক, ‏হে আলী ইবনে আবি তালিব, ‏আজ থেকে আপনি আমার এবং সকল মুসলিম নর-নারীর মাওলা বা নেতা হয়ে গেলেন।(আল গাদীর, ‏১ম খণ্ড, ‏পৃ. ‏৯-১১।)হাদীসে গাদীরের বর্ণনাকারীগণপ্রকৃত পক্ষে হাদীসে গাদীরের রাবীর সংখ্যা ১২০,০০০। কেননা রাসূল ‎(সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী সকলেই এই সফরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে এ হাদীসটি অন্যদের কাছে বর্ণনা করেন। ‎(আল গাদীর, ‏১ম খণ্ড, ‏পৃ. ‏৬০-১১।) ‏আর এ কারণেই মুসলমানদের সর্বস্তরে গাদীরের ঘটনাটি প্রতিবারই নতুন করে জীবিত হয়েছিল।গাদীরে খুমের ঘটনার প্রায় ২৫ বৎসর পর অর্থাৎ যখন রাসূল ‎(সা.)-এর অধিকাংশ সাহাবীরা ইহধাম ত্যাগ করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক জীবিত ছিলেন; ‏আলী ‎(আ.) ‏জনগণকে বললেন ‎: ‏আপনাদের মধ্যে যারা গাদীরে খুমে উপস্থিত ছিলেন এবং রাসূল ‎(সা.)-এর মুখ থেকে হাদীসে গাদীর শ্রবণ করেছিলেন, ‏সাক্ষ্য দান করুন।ঐ বৈঠকেই ৩০ জন রাবী উঠে দাঁড়িয়ে হাদীসে গাদীর সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন। ‎(আল গাদীর, ‏১ম খণ্ড,, ‏পৃ. ‏১৬৬-১৭৪।)মুয়াবিয়ার মৃত্যুর ১ বৎসর পূর্বে ‎(অর্থাৎ ৫৯ হিজরীতে) ‏ইমাম হুসাইন ‎(আ.) ‏বনি হাশেম, ‏আনসার এবং সকল হাজীদেরকে ‎“মিনায়” ‏একত্রিত করে বক্তৃতার এক পর্যায়ে বললেন ‎: ‏আপনাদেরকে আল্লাহর শপথ করে বলছি, ‏জানেন কি রাসূল ‎(সা.) ‏গাদীরে খুমে আলীকে মুসলিম উম্মাহর নেতা ঘোষণা করেছিলেন এবং উপস্থিত সকলকে তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন?সকলে বলল ‎: ‏জী হ্যাঁ। ‎(আল গাদীর, ‏১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৯৮-১৯৯।)আহলে সুন্নাতের পণ্ডিতরা তাদের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে রাসূল ‎(সা.)-এর ১১০ জন সাহাবী যারা স্বয়ং মহানবীর থেকে হাদীসে গাদীর শুনেছেন এবং অন্যদের কাছে বর্ণনা করেছেন তাদের নাম উল্লেখ করেছেন।(আল গাদীর, ‏১ম খণ্ড,পৃ. ‏১৪-৬১।) ‏আরও কিছু পণ্ডিতগণ হাদীসে গাদীর এবং গাদীরের ঘটনা সম্পর্কে বিশেষ কিতাবও রচনা করেছেন।(আল গাদীর, ‏১ম খণ্ড, ‏পৃ. ‏১৫২-১৫৭ এ ২৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।)হাদীসে গাদীরের তাৎর্পযস্পষ্ট দলিল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ‎‘মাওলা’ ‏এবং ‎‘ওয়ালী’ ‏শব্দের অর্থ হলো মুসলিম উম্মাহর উত্তরাধিকারী ও অভিভাবক এবং অন্য অর্থের সাথে সংগতি রাখে না। এখন নিম্নের বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য করুন ‎:১.ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি যে, ‏রাসূল ‎(সা.) ‏হাদীসে গাদীর উপস্থাপন করতে ভয় পাচ্ছিলেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তিনি তা ঘোষণা করেন নি।তাহলে একথা বলা সম্ভব নয় যে হাদীসে গাদীরের উদ্দেশ্য হলো রাসূল ‎(সা.)-এর সাথে আলী ‎(আ.)-এর বন্ধুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া? ‏যদি উদ্দেশ্য তাই হতো, ‏তাহলে তা প্রচার করাতে ভয়ের কোন কারণ ছিল না এবং তাতে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট হতো না। সুতরাং উদ্দেশ্য খেলাফত ও উত্তরাধিকারীর ব্যাপারই ছিল। আর এ ভীতি বিদ্যমান ছিল যে, ‏এই বিষয়টি প্রচার করলে কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী ঔদ্ধ্যত্য প্রকাশ করতে পারে।২.রাসূল ‎(সা.) “মান কুনতু মাওলা ফাহাযা আলীয়ুন মাওলা” ‏বলার পূর্বে জনগণের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিয়েছিলেন যে, ‏তিনি মুমিনদের নিজেদের অপেক্ষা তাদের উপর অধিক অধিকার রাখেন এবং উম্মতের কর্ণধার। অতঃপর ঐ স্থানকে আলীর জন্যেও নির্ধারণ করলেন এবং বললেন ‎: “আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা।”৩.হাসসান ইবনে ছাবেত গাদীরের ঘটনাটিকে রাসূল ‎(সা.)-এর অনুমতিক্রমে কবিতার ভাষায় বর্ণনা করেন এবং রাসূল ‎(সা.) ‏তাতে অনুমোদন দেন। হাসসানের কবিতায় আলী ‎(আ.)-এর খেলাফত ও ইমামতের মর্যদাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিন্তু ব্যাপক জনসমষ্টির কেউই প্রতিবাদ করেন নি যে কেন ‎“মাওলা” ‏শব্দের ভুল অর্থ করছ। বরং সকলেই তার প্রশংসা করেছিলেন এবং স্বীকৃতিদান করেছিলেন।কবিতাটির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি ‎:“রাসূল ‎(সা.) ‏আলীকে বললেন ‎: ‏ওঠ হে আলী আমার পর তুমিই হলে উম্মতের নেতা ও ইমাম। সুতরাং আমি যার মাওলা এবং যার দীনি ও ঐশী কর্ণধার এই আলীও তার মাওলা এবং অভিভাবক। অতএব, ‏তোমরা সকলেই আলীর প্রকৃত অনুসারী হও।”৪.অনুষ্ঠান শেষে রাসূল ‎(সা.) ‏হযরত আলী ‎(আ.)-কে নিয়ে একটি তাঁবুর মধ্যে বসলেন এবং সকলকে এমনকি তাঁর স্ত্রীদেরকেও হযরত আলীকে অভিনন্দন জানাতে বললেন এবং তাঁর হাতে বাইয়াত করতে বললেন। আর আমিরুল মুমিনীন হিসাবে হযরত আলীকে সালাম জানাতে বললেন।(আল গাদীর, ‏১ম খণ্ড, ‏পৃ. ‏২৭০- ‏২৭১।) ‏এটা স্পষ্ট যে, ‏এ অনুষ্ঠান শুধুমাত্র তাঁর খেলাফত ও ইমামতের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।৫.রাসূল ‎(সা.) ‏দু’বার বলেছিলেন ‎: هنئوني ‏অর্থাৎ আমাকে অভিনন্দন জানাও। কেননা আল্লাহ তায়ালা আমাকে শ্রেষ্ঠ নবী ও আমার আহলে বাইতকে উম্মতের জন্য ইমাম নির্বাচন করেছেন।(আল গাদীর, ‏১ম খণ্ড, ‏পৃ. ‏২৭৪।)এসকল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করার পর হাদীসে গাদীর সম্পর্কে আর কোন রূপ সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। প্রচারে মোঃ শামসীর হায়দার

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদইমামতদ্বিতীয় পর্ব ২ইয়া আমিরুল মোমেনীন আলী ইবনে আবী তালিব আঃএভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ‎: ‏প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে। দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে। তৃতীয়ত ‎: ‏ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে ।তবে মা’সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও ‎(সালামুল্লাহ আলাইহা) ‏মা’সুম ছিলেন,যদিও তিনি ইমামতের আধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম ‎(আ.) ‏ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহর ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন,যদিও আমরা তাদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা’সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাদেরকে চিনা সম্ভব নয়।ইমামের প্রয়োজনীয়তাবিশ্বাসগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন না এমন অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে,শিয়া ও সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে ইমামত প্রসঙ্গে বিরোধ এ ছাড়া আর কিছইু নয় যে শিয়াদের বিশ্বাস ‎: ‏মহানবী ‎(সা.) ‘আলী ইবনে আবি তালিবকে’ (আ.) ‏ইসলামী সমাজের পরিচালনার জন্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস যে,এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং জনগণ নিজেদের পছন্দ মত নেতা নির্বাচন করেছিল। তিনি ‎(জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত নেতা) ‏তার উত্তরাধিকারীকে ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন করেছিলেন। তৃতীয় পর্যায়ে নেতা নির্বাচনের দ্বায়িত্ব ছয় সদস্য বিশিষ্ট গোষ্ঠীর নিকট অর্পণ করা হয়েছিল। অপরদিকে চতুর্থ খলিফাও আবার প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষ কর্তৃক নির্বাচিত হয়োছিলেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন পন্থা ছিল না। ফলে চতুর্থ খলিফার পর যার সামরিক শক্তি অধিক ছিল,সে-ই এ স্থান দখল করেছিল,যেমন ‎: ‏অনৈসলামিক দেশসমূহেও মোটামুটি এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।অন্যকথায় ‎: ‏তারা এ রকম মনে করেন যে,প্রথম ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শীয়াদের বিশ্বাস সেরূপ ‎,যেরূপ আহলে সুন্নাত প্রথম খলিফা কর্তৃক দ্বিতীয় খলিফার নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেন,পার্থক্য শুধু এটুকুই যে,মহানবী ‎(সা.) ‏এর বক্তব্য মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি,কিন্তু প্রথম খলিফার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল ‎!কিন্তু প্রশ্ন হল,প্রথম খলিফা এ অধিকার কোথা থেকে পেয়েছিলেন ‎? ‏আল্লাহর রাসূল ‎(সা.) (আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস মতে) ‏ইসলামের জন্যে কেন তার ‎(প্রথম খলিফা) ‏মত আন্তরিকতা প্রদর্শন করেননি এবং নব গঠিত ইসলামী সমাজকে অভিভাবকহীন অবস্থায় রেখে গেলেন অথচ যুদ্ধের জন্যে মদীনা থেকে অন্যত্র যাওয়ার সময়ও একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এবং যেখানে স্বয়ং তিনিই ‎(এ বিষয়ের উপর) ‏তার উম্মতদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তির সংবাদ দিয়েছিলেন ‎? ‏এছাড়া ও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল,শিয়া ও সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে মূলতঃ মতবিরোধ সর্বাগ্রে এখানেই যে,ইমামত কি এক ধর্মীয় মর্যাদা,যা ঐশী বিধানের অনুগামী ও আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়? ‏নাকি পার্থিব রাজকীয় মর্যাদা,যা সামাজিক নির্বাহকের অনুগামী ‎? ‏শিয়াদের বিশ্বাস যে,স্বয়ং মহানবীও ‎(সা.) ‏নিজ থেকে তার উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেননি। বরং মহান আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েই এ কর্ম সম্পাদর্ন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন পবিত্র ইমামগণের নিয়োগদানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আর এ ধরনের ইমামের উপস্থিতিতেই রাসূল ‎(সা.)-এর ইন্তিকালের পর ইসলামী সমাজের অপরিহার্য বিষয়াদির নিশ্চয়তা প্রদান করা যেতে পারে।এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে,কেন শিয়া সম্প্রদায়ের মতে ইমামত ‎‘মূল বিশ্বাসগত’ ‏বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয় ‎-শুধুমাত্র একটি ফিকাহগত গৌণ বিষয় নয়। আর সেই সাথে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,কেন তারা তিনটি শর্ত ‎(ঐশী জ্ঞান,ইসমাত ও আল্লাহ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) ‏বিবেচ্য বলে মনে করেন এবং কেন শিয়া সাধারণের মধ্যে এ ভাবার্থগুলো ঐশী আহকাম,প্রশাসন ও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃত্বের ধারনার সাথে এমনভাবে মিশে আছে,যেন ইমামত শব্দটি এ ভাবার্থগুলোর সবগুলোকেই সমন্বিত করে।এখন শিয়াদের সামগ্রিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে,ইমামতের তাৎপর্য ও মর্যাদার আলোকে এর বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা করব।মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সফলতা,ওহীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ কর্তৃক পথপ্রদর্শনের সাথে সম্পকির্ত। আর প্রভুর প্রজ্ঞার দাবি হল এই যে,কোন নবী প্রেরণ করবেন যাতে ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণের পথ সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞান দান করতে পারেন এবং মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন,আর সেই সাথে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে ‎(আধ্যাত্মিক) ‏পরিচর্যা করতে পারেন এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে পূর্ণতার সর্বোচ্চ শিখরে তাদেরকে পৌছাতে সচেষ্ট হতে পারেন। অনুরূপ তারা উপযুক্ত সামাজিক পরিবেশে ইসলামের সামাজিক বিধানের প্রয়োগের দায়িত্বও নিবেন।ইসলাম হল পবিত্র,চিরন্তন,সার্বজনীন ও অবিস্মৃত ধর্ম এবং ইসলামের নবী ‎(সা.)-এর পর আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না। নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন,তখনই কেবলমাত্র নবীগণের আবির্ভারের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে,যখন সর্বশেষ ঐশী শরীয়ত মানব সম্প্রদায়ের সকল প্রশ্নের জবাব প্রদানে সক্ষম হবে এবং বিশ্বের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এ শরীয়তের অটুট থাকার নিশ্চয়তা থাকবে।উল্লেখিত নিশ্চয়তা পবিত্র কোরানের রয়েছে এবং মহান আল্লাহ স্বয়ং সকল প্রকার বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে প্রিয় গ্রন্থের সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের সকল বিধি-বিধান কোরানের আয়াতের বাহ্যিক যুক্তি থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন ‎: ‏নামাযের রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি এবং আবশ্যকীয় ও অনাবশ্যকীয় এমন অসংখ্য বিধান রয়েছে,যেগুলোকে পবিত্র কোরান থেকে উদঘাটন করা অসম্ভব। সাধারণত ‎: ‏পবিত্র কোরানে আহকাম ও কানুন বিশদভাবে বর্ণিত হয়নি। ফলে এগুলোর প্রশিক্ষণ ও সুস্পষ্ট বর্ণনার দায়িত্ব মহানবী ‎(সা.)-এর উপর অর্পণ করা হয়েছে,যাতে তিনি মহান আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের ‎(কোরানের ওহী ব্যতীত) ‏মাধ্যমে ঐগুলোকে মানুষের জন্যে বর্ণনা করেন।৫ আর এভাবে ইসলাম পরিচিতির প্রকৃত উৎস হিসেবে তার সুন্নাহ বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।কিন্তু হযরত ‎(সা.)-এর শিবেহ আবি তালিবের কয়েক বছরের বন্দীদশা,শত্রুদের সাথে একদশকাব্দী যুদ্ধ ইত্যাদির মত জীবনের সংকটময় মুহূর্তগুলো সাধারান মানুষের জন্যে ইসলামের বিভিন্ন আহকাম,বর্ণনার পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। অপর দিকে সাহাবাগণ যা শিখতেন তা সংরিক্ষত থাকারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এমন কি অজু করার প্রক্রিয়া যা বর্ষপরম্পরায় মানুষের দৃষ্টি সীমায় সম্পাদিত হত তাও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতএব যেখানে এ সুস্পষ্ট বিষয়টি ‎(যা মুসলমানদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বা আছে এবং এর পরিবর্তন ও বিকৃতির মধ্যে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য জড়িত ছিল না) ‏বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে,সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ও গোত্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জটিল ও সূক্ষ্ম নিয়মসমূহের বর্ণনার ক্ষেত্রে বিকৃতি ও ভ্রান্তির সম্ভাবনা অবশ্যই অধিকতর ।৬এ বিষয়টির আলোকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে,ইসলাম ধর্ম কেবলমাত্র তখনই এক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে পৃথিবীর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত মানুষের সকল প্রয়োজন ও প্রশ্নের জবাবদানে সক্ষম হবে যখন দ্বীনের মূলভাষ্যে,সমাজের এ সকল কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধিত হবে,যেগুলো মহানবী ‎(সা.)-এর পরলোক গমণের পর সংকট ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আর এ নিশ্চয়তা বিধানের পথ মহানবী ‎(সা.)-এর যোগ্য উত্তরসুরি নির্বাচন ব্যতীত কিছুই নয়। এ উত্তরসুরিকে একদিকে যেমন ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে,যাতে দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন। অপরদিকে তেমনি দৃঢ়রূপে পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে,যাতে কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানী প্ররোচনায় প্রভাবিত না হন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীনের বিকৃতিতে লিপ্ত না হন। অনুরূপ মানব সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে মহানবী ‎(সা.)-এর দায়িত্ব স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিয়ে,উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে পৌছে দিতেও তারা বদ্ধপরিকর। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে সমাজের শাসন,পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা,বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তারা গ্রহণ করে থাকেন ।উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি যে,নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি কেবলমাত্র তখনই প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে,যখন এমন পবিত্র ইমামগণকে নিয়োগ করা হবে,যারা একমাত্র নবুয়্যত ব্যতীত মহানবী ‎(সা.)-এর সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন।আর এভাবেই একদিকে যেমন সমাজে ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হয়,অপরদিকে তেমনি তাদের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্র মর্যাদাও। অনুরূপ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন এ ধরনের জ্ঞান ও মর্যাদা কাকে দিয়েছেন এবং তিনিই বস্তুতঃ তার বান্দাগণের উপর বিলায়াত ও কর্তৃত্বের অধিকার রাখেন। আর তিনিই এর অধিকার অপেক্ষাকৃত হ্রাসকৃত মাত্রায় উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে প্রদান করতে সক্ষম।এখানে স্মরণযোগ্য যে,আহলে সুন্নাত কোন খলিফার ক্ষেত্রেই উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিকেই স্বীকার করেন না। মহান আল্লাহ ও রাসূলের ‎(সা.) ‏পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়ার দাবি যেমন তারা তুলেন না,তেমনি খলিফাগণের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রসঙ্গও তুলেন না। বরং মানুষের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দানের ক্ষেত্রে তাদের অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি ও অযোগ্যতার দৃষ্টান্ত তারা তাদের বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহে তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ প্রথম খলিফা প্রসঙ্গে উদ্ধৃত হয়েছে যে,তিনি বলেছিলেন ‎:انّ لی سیطانا یعترنیআমার পশ্চাতে এমন এক শয়তান বিদ্যমান যে আমাকে বিভ্রান্ত করে ।৭অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে,তিনি প্রথম খলিফার আনুগত্য স্বীকারকে ‎‘فلته’ (অর্থাৎ অবিলম্বকর্ম ও অবিবেচনাপূর্ণ কর্ম) ‏নামকরণ করেছেন।৮ অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা অসংখ্যবার এ বাক্যটি স্বীয় কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন ‎:لولا علیّ لهلک عمرযদি আলী না থাকতেন,তবে আমি ওমর ধ্বংস হয়ে যেতাম।অর্থাৎ যদি আলী ‎(আ.) ‏না থাকতেন তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেতন।৯ এছাড়া তৃতীয় খলিফা১০ এবং বনি উমাইয়্যা ও বনি আব্বাসের ভুল-ভ্রান্তির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখেনা। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে কেউ ন্যূনতম ধারণা নিলেই এ সম্পর্কে উত্তমরূপে পরিজ্ঞাত হতে পারবেন।একমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ই দ্বাদশ ইমামের ক্ষেত্রে এ শর্তত্রয়ে বিশ্বাসী। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইমামত প্রসঙ্গে তাদের বিশ্বাসের বৈধতা প্রমাণিত হয় এবং এ ব্যাপারে বিস্তারিত কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।প্রচারে মোঃ শামসীর হায়দার

হাদীসে সাকালাইন ও এর সাথে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হাদীসসমূহের পর্যালোচনাহাদীসে সাকালাইনের অর্থঅনেক হাদীস থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে,গাদীরে খুমে একটি ভাষণের মধ্যেই মহানবী (সা.) হাদীসে সাকালাইন ও হাদীসে গাদীরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব হাদীসের কয়েকটি মুত্তাকী আল-হিন্দী তাঁর ‘কানজুল উম্মাল’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ১৬৭),ইবনে কাসির তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে (৫ম খণ্ড,পৃ. ২০৯),আস সাখাভী তাঁর ‘আল-ইসতিজলাব’ গ্রন্থে,আল সামহুদী তাঁর ‘জাওয়াহির আল ইকদাইন’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তাঁর ‘সাওয়ায়েক’ গ্রন্থে তাবারানী ও অন্যদের থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন।কতিপয় হাদীসে ‘খালিফাতাইন’ (উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি) শব্দটি সাকালাইন শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ করা হয়েছে,যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁর মুসনাদে (৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮১) উল্লেখ করেছেন। আবার তাবারানী,ইবনে আবি আসিম,আবু বকর ইবনে আবি শায়বাহ,আল-যারকানী এবং অন্যরাও উল্লেখ করেছেন। এই শব্দ ইমাম আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের নেতৃত্ব ও খেলাফতের বিষয়টিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ করে।এ হাদীসের কতিপয় বর্ণনা,যেমন কুন্দুজী তাঁর ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহতে হাসান ইবনে আলী (আ.) থেকে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাতে নবী (সা.)-এর বাণী রয়েছে যা ইমামতের চিরস্থায়িত্বের বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে :‘হে আল্লাহ! তুমি দুনিয়াকে সৃষ্টির ওপর তোমার হুজ্জাত থেকে খালি রেখ না যাতে তোমার হুজ্জাত বাতিল হয়ে যায় অথবা তুমি তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার পর তোমার বন্ধুরা বিপথে যেতে না পারে। তারা (আল্লাহর হুজ্জাত) সংখ্যায় অল্প,কিন্তু সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহর নৈকট্যশীল। নিশ্চয়ই আমি প্রশংসিত ও মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমার বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বংশধরদের বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বীজের মধ্যে এবং আমার বীজের বীজের মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দেওয়ার। আর আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে।’এটি নাহজুল বালাগায় বর্ণিত (হিকাম : ১৪৭) আলী (আ.) কর্তৃক তাঁর শিষ্য কুমাইল ইবনে যিয়াদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ :...হ্যাঁ,পৃথিবী কখনও এমন লোকশূন্য হয়ে যায় না যারা গোপনে বা প্রকাশ্যে আল্লাহর ওপর রক্ষা করে এবং তারা সব সময় শংকিত থাকে যে,আল্লাহর গুপ্ত ওজর ও প্রমাণ যেন অপ্রমাণিত না হয়। তাদের সংখ্যা কত,আর তারা কোথায়? আল্লাহর কসম,তাদের সংখ্যা কম,কিন্তু আল্লাহর নিকট তাদের সম্মান অনেক বেশি। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর ওজর ও প্রমাণ রক্ষা করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের মতো অপর কাউকে বিশ্বাস না করে এবং তাদের মতো অন্য কারও হৃদয়ে আস্থার বীজ বপন না করে।জ্ঞান তাদেরকে সত্যিকার বোধগম্যতার দিকে চালিত করে এবং এ কারণে তারা দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন আত্মার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। অন্যেরা যেটাকে কঠিন বলে মনে করে তা তারা সহজ বলে মনে করে। অজ্ঞরা যা বিস্ময়কর মনে করে,তারা তা সাদরে গ্রহণ করে। তারা এ পৃথিবীতে দেহ নিয়ে বসবাস করে,কিন্তু তাদের আত্মা অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। আল্লাহর জমিনে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তাঁর দীনের প্রতি আহ্বানকারী। আহা! তাদেরকে দেখার জন্য আমার আকুল আগ্রহ!হযরত আলীর এ বক্তব্য অনেক হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিক তাঁদের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইবনে আব্দ রাব্বিহ তাঁর ‘আল ইকদুল ফারীদ’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ২৬৫,২৯৩);ইয়াকুবী তাঁর ‘তারিখ’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ৪০০);আল হাররানী তাঁর ‘তুহাফুল উকূল’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬৯);আল খাতীব আল বাগদাদী তাঁর ‘তারীখে বাগদাদ’ গ্রন্থে (৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ৩৮৯);আল রাযী তাঁর ‘তাফসীরে কাবীর’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২);ইবনে আবদুল বার তাঁর ‘আল মুখতাসার’ গ্রন্থে (পৃ. ২৯) এ রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হওয়া কতিপয় হাদীস ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী একটি গ্রন্থে (তোহফায়ে ইসনা আশারা) হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করে হাদীসে সাকালাইনের ঘোষিত আহলে বাইতের নেতৃত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। আমরা এখানে সেই হাদীসগুলো উল্লেখ করে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করব।প্রথম হাদীসশাহ আবদুল আযীয তাঁর তুহ্ফা গ্রন্থে বলেন,যদি হাদীসে সাকালাইন গ্রহণ করা হয়েও থাকে,তবু তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অপর কয়েকটি হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব হাদীসের মধ্য থেকে তিনি নিম্নোল্লিখিত হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেন :‘আমার সুন্নাহ অনুসরণ কর এবং আমার পর সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারীদের (খোলাফায়ে রাশেদীনের) অনুসরণ কর,তা আঁকড়ে ধর এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন (আবাকাত আল আনওয়ার গ্রন্থের প্রণেতা) বলেন যে,এমন হাদীস সহীহ নয়।প্রথমত,তিনি বলেন,এ হাদীসটি কেবল সুন্নীদের দ্বারা বর্ণনাকৃত। অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন সুন্নীদের পাশাপাশি আহলে বাইতের মাযহাবের আলেমগণও বর্ণনা করেছেন।দ্বিতীয়ত শাহ আবদুল আযীয এখানে তাঁর স্বঘোষিত নীতি ওপর বহাল থাকেননি যে,আহলে বাইতের মতবাদের বিপক্ষে তাঁর যুক্তি তাদের দ্বারা গ্রহণীয় লেখনীর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হবে।তৃতীয়ত হাদীসটি মুসলিম ও বুখারী লিপিবদ্ধ করেননি-হাদীসের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত যাঁদেরকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করে থাকে।চতুর্থত,উপরিউক্ত হাদীসের সহীহ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। কারণ,সুন্নী আলেমগণের দ্বারাই এ হাদীসের সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।এ হাদীসের ওপর পর্যালোচনাএ হাদীসটি আবু দাউদ,তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে। আবু দাউদের রাবীদের সম্পর্কিত আলোচনা :আল-আরবাদ ইবনে সারিআহ-তিনি এ হাদীসের অন্যতম রাবী (বর্ণনাকারী)। তিনি নির্ভরযোগ্য নন। কারণ,তিনি নিজের সম্বন্ধেই এমন উক্তি করেছেন যে,‘আমি ইসলামের এক-চতুর্থাংশ।’হাজার ইবনে হাজার আল কিলাই-সিরিয়ার একটি শহরে বসবাস করত যে শহরের অধিবাসীরা আলী (আ.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। ইবনে হাজার তাঁর তাহযীব আত তাহযীবে তাঁর অবস্থা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। (৩য় খণ্ড,পৃ. ১১৮)খালিদ ইবনে মাদান ইবনে আবি কারিব আল কিতাবী-সে ছিল ইসলামের ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়ার পুলিশ বাহিনীর প্রধান।সাওর ইবনে ইয়াযীদ-ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে,সে আলী (আ.)-কে ঘৃণা করত। কারণ,তিনি এক যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন এবং তাঁকে একজন গোঁড়া মনে করতেন।পরবর্তী রাবী হলো আল ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম। আবু মুসহার কর্তৃক জালকরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে,যা মিযানুল ইতিদালে যাহাবী উল্লেখ করেছেন (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৪৭) ।অন্যদিকে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ যেসব রাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন,যেমন আবু আসিম,হাসান ইবনে আলী আল-খাল্লাল,বুহাইর ইবনে সা’দ,বাকীয়াহ ইবনে আল-ওয়ালীদ,ইয়াহইয়া ইবনে আবি আল-মুতী,আবদুল্লাহ ইবনে আলা’,মু‘আবিয়া ইবনে সালিহ,ইসমাঈল ইবনে বিশর ইবনে মানসূর এবং আবুল মালিক ইবনে আল-সাব্বাহ-তাঁরা সকলেই দুর্বল রাবী। আহলে সুন্নাতের রেজালশাস্ত্রবিদগণ তাঁদের সকলকেই দুর্বল রাবী হিসাবে অভিহিত করেছেন।উপরন্তু যদি এ হাদীসটি সহীহ বলে ধরেও নিই,তবু তা হাদীসে সাকালাইনের বিপক্ষে কোন গুরুত্ব রাখে না। কারণ,হাদীসে সাকালাইন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিপুল সংখ্যক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে,অন্যদিকে সুন্নী পণ্ডিতদের বিপুল সংখ্যক তাঁদের হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করেননি। যদি এ হাদীসটি সত্যিই নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে,তবে ‘সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারী’ শব্দগুলো আহলে বাইতের বারো ইমামের ওপর আরোপ করা যায়-যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সমর্থিত হতে পারে। আর সেই হাদীসটি হল ‘আমার পরে বারো জন খলীফা বা ইমাম আসবে।’শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত আরেকটি প্রশ্নের জবাব দানআবদুল আযীয বলেছেন,যদি হাদীসে সাকালাইন পূর্বোক্ত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নাও হয়,তবুও ‘ইতরাত’ শব্দ সাধারণভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গোত্র বনি হাশিমের সকল আত্মীয় অথবা হযরত ফাতিমার সকল বংশধরের ওপর আরোপ করা যায়। তাহলে এটি বলা অবান্তর যে,তাঁদের সকলেই হলেন ইমাম।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এ সন্দেহ সম্পর্কে নানা অভিধান রচয়িতার অর্থ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন,যেমন জাওহারী,ইবনে আসির,ইবনে মানযুর,আল ফিরূযাবাদী এবং অন্যরা। তাঁদের মতে ‘ইতরাত’ বলতে বুঝায় কারও নিকটতম আত্মীয় (আখাস আকরাবীন),সন্তানাদি (ওয়ালাদ) এবং বংশধর (যুররিয়াহ)।উপরন্তু তিনি উল্লেখ করেন,হাদীসে সাকালাইন তাঁদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাধান্যের পাশাপাশি তাঁদের পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিও নির্দেশ করে। এমন বর্ণনা নিঃসন্দেহে কেবল বারো ইমামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,আলী (আ.) যাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ‘ইতরাত’ বলে পরিচিত করিয়েছেন এবং কুরআনের ব্যাপারে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন।দ্বিতীয় হাদীসশাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত দ্বিতীয় হাদীসটি হলো :‘ধর্মের বিষয়াদি তোমরা এই হুমায়রার (আয়েশা) নিকট থেকে গ্রহণ কর।’তিনি এ হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেছেন।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,সুন্নী পণ্ডিতগণই এ হাদীসকে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন :১. আল-মিযযী এবং যাহাবী (আল-তাকরীর ওয়াল তাহবীর ফি শাহর আল-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।২. ইবনুল কাইয়্যেম জাওযীয়াহ,যেসব হাদীস ‘হে হুমায়রা’ এবং ‘আল-হুমায়রা’ শব্দযোগে এসেছে সেসব হাদীসকে তিনি জাল বলে গণ্য করেছেন।৩. ইবনে কাসির,(আল-দুরুর আল-মুনতাশিরাহ ফি আল-আহাদীস আল-মুশতাহিরাহ,পৃ. ৭৯)।৪. ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(আল-তাকরীর ওয়া আল-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।৫. তাঁদের পাশাপাশি ইবনুল মুলাক্কিন,আস সুবকি,ইবনে আমির আল-হাজ,আল-সাখাভী,আল-সুয়ূতী,আল-শায়বানী,আল-শেখ আলী আল-কারী,আল-যারকানী,আবদুল আলী আল-শাওকানী এবং অন্যরাও এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তৃতীয় হাদীসশাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে এনেছেন। আর তা হলো :‘আম্মারের নিকট থেকে পথনির্দেশনা চাও।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন হাদীস কখনই হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উত্থাপন করা যায় না। কারণ,হযরত আম্মার নিজেই হযরত আলী (আ.)-এর একনিষ্ঠ শিয়া (অনুসারী) ছিলেন এবং মহানবী (সা.) তাঁকে হযরত আলীকে মেনে চলা ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে :‘হে আম্মার! আলী তোমাকে সত্যপথ হতে বিচ্যুত করবে না। হে আম্মার! আলীর আনুগত্য আমার আনুগত্য,আর আমার আনুগত্যই হল সর্বশক্তিমান ও প্রশংসিত আল্লাহর আনুগত্য।’এ হাদীসটি বেশ কয়েকটি সুন্নী হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ফারায়েদুস সিমতাইন,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭৮;আল মাওয়াদ্দাহ ফিল কুরবা;আল খারাযমীর মানাকিব,পৃ. ৫৭ ও ১২৪;ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ১২৮ ও ২৫০;মিফতাহ আন-নাযা এবং কানজুল উম্মাল,১২তম খণ্ড,পৃ. ২১২।উপরন্তু এ বিষয়টি অদ্ভুত যে,শাহ আবদুল আযীয এ হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উপস্থাপন করেছেন,যেখানে ঐতিহাসিক ইয়াকুবী তাঁর তারিখে (২য় খণ্ড,পৃ. ১১৪) এবং মাসউদী তাঁর মুরুযুয যাহাব (২য় খণ্ড,পৃ. ৩৪২) গ্রন্থে আম্মারকে তাঁদের মধ্যে গণ্য করেছেন যাঁরা প্রথম খলীফার আনুগত্য করা থেকে দূরে ছিলেন। হযরত উমর তাঁর খেলাফতকালে আম্মারের দিকনির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং কর্কশ কণ্ঠে তাঁর সাথে কথা বলেছিলেন যখন তিনি ওযূর জন্য পানি না পেলে নামায ছেড়ে না দিয়ে তায়াম্মুম করার মাধ্যমে পবিত্র হবার বিষয়টি তাঁর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। এ ঘটনাটি নিম্নের হাদীস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : মুসনাদে আহমাদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৫;সহীহ মুসলিম,১ম খণ্ড,পৃ. ১১০;আবু দাউদ,নাসাঈ,তাবারী,আল-আঈনী,ইবনে আসির এবং আল-শায়বানীও এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন।হযরত উসমান তাঁর খেলাফতকালে আম্মারকে ততক্ষণ প্রহার করেন যতক্ষণ না আম্মার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ঘটনাটি তখন ঘটে যখন তিনি হযরত উসমানের শাসনামলের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে মুসলমানদের প্রতিবাদলিপি তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। এ ঘটনাটি নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : ইবনে কুতাইবার আল-ইমামাহ্ ওয়াল সিয়াসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ৩২;ইবনে আবদ রাব্বিহের আল-ইকদুল ফারীদ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২;মাসউদীর মুরুযুয যাহাব,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৩৮;ইবনে আবদুল বারের আল-ইসতিয়াব,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬;ইয়াকুবীর তারিখ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৬০।যদিও রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আম্মার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছিলেন,যেমন ‘আম্মারের শত্রু আল্লাহর শত্রু’,তারপরও রাসূলের কতিপয় সাহাবী কর্তৃক তিনি প্রতিরোধের মুখে পড়েন,তাঁরা তাঁকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করতেন,যেমন আবদুর রহমান ইবনে আওফ,সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,মুগীরাহ ইবনে শোবা,আবু মূসা আশআরী,আবু মাসউদ আল-আনসারী এবং অন্যরা। আম্মার দৃঢ়ভাবে আলীর পক্ষে এবং আলীর বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে দাঁড়ান। যেমন তিনি তালহা,যুবায়েরের বিপক্ষে জামাল যুদ্ধে এবং মু‘আবিয়ার বিপক্ষে সিফ্ফীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরিশেষে তিনি মু‘আবিয়ার সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হয় যে,‘আম্মার একদল বিদ্রোহী (আল-ফিআত আল-বাগিয়াহ) কর্তৃক নিহত হবে।’ চতুর্থ হাদীসসাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন আরও কয়েকটি হাদীসের ওপর আলোচনা করেন যা আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছে। যেমন :‘ইবনে উম্মে আবদ (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ) এর সিদ্ধান্তের ওপর কর্ম সম্পাদন কর।’ অথবা ‘ইবনে উম্মে আবদ এর অভিমতই তোমাদের জন্য আমার অভিমত।’এ দু’টি হাদীসই দুর্বল (যাইফ) এবং খবরে আহাদ,যেখানে হাদীসে সাকালাইন হলো মুতাওয়াতির। মুসলিম ও বুখারী উভয়েই যেহেতু এটি তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেননি,তাই বলা যায় তাঁরা এগুলোর সনদকে দুর্বল মনে করেছেন।উপরন্তু যদি এগুলো সত্য বলে ধরে নেয়া হয় তুবও সেগুলো হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ,এগুলো কেবল ইবনে মাসউদের প্রতিভাকে বর্ণনা করে,অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁদের নেতৃত্বের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।উপরন্তু শাহ আবদুল আযীযের ক্ষেত্রে এখানে দ্বিমুখিতা লক্ষ্যণীয় যে,তিনি এ হাদীসগুলোকে উপস্থাপন করেছেন,অথচ ইবনে মাসউদের কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে হযরত উমর তাঁকে ফতোয়া দিতে নিষেধ করেছিলেন,রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর মদীনা ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এ অবস্থা হযরত উমরের ইন্তেকাল পর্যন্ত বহাল ছিল। হযরত উসমান আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ইবনে মাসউদকে এতটা নির্দয়ভাবে প্রহার করেছিলেন যে,তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। পঞ্চম হাদীসশাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন :‘মু‘আয ইবনে জাবাল হারাম ও হালাল সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এটি কেবল সুন্নীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারী এ হাদীসকে পরিহার করেছেন। সুন্নী পণ্ডিতদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়াহ,ইবনে আবদুল হাদী,যাহাবী,মানাভী প্রমুখ এ হাদীসকে দুর্বল মনে করেছেন বা ভিত্তিহীন বলেছেন।এ হাদীসের রাবীদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহমান আল-বাইলামানী,তাঁর পিতা,যায়েদ আল-আম্মি,সালিম ইবনে সালিম হাদীস ও রিযালশাস্ত্রের আলেমগণ কর্তৃক অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছেন। যেমন : বুখারী,নাসাঈ,আল-মাকদিসী,দারে কুতনী,ইবনে হাজার,আল-যাহাবী,ইবনুল জাওযী এবং অন্যরা অবিশ্বস্ত বলেছেন।উপরন্তু তাবাকাতে ইবনে সা’দ (৩য় খণ্ড,পৃ. ৫৮৫) এবং ইবনে আবদুল বারের আল-ইস্তিআবে (৩য় খণ্ড,পৃ. ১৪০৪) এমন কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যাতে বোঝা যায় যে,উপরিউক্ত হাদীসে তাঁর জন্য যে যোগ্যতা দাবি করা হয় তিনি সে রকম যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন না। ষষ্ঠ হাদীসশাহ আবদুল আযীয রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস এনেছেন যেটার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকারের দাবি করেছেন যা তাওয়াতুরের কাছাকাছি :‘আমার পরে যারা আসবে তাদের অনুসরণ কর,আবু বকর ও উমর।’হামিদ হুসাইন বলেন,শুরার দাবি সমর্থনযোগ্য নয় এবং অনেক সুন্নী আলেম এ হাদীসের ত্রুটি পেয়েছেন এবং একে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। যেমন : আবু হাতিম আল-রাযী,আল-বাযযায এবং ইবনে হায্ম (ফাত্হ আল-কাদির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৫২);তিরমিযী,(সহীহ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৬৭২);উকাইলী,(আদ-দুআফা);নাক্কাস,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪২);দারে কুতনী,(লিসান আল মিযানে,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);ইবরী আল-ফারগানী,(শারহ আল মিনহাজ);যাহাবী,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১০৫);ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(লিসানুল মিযান,১ম খণ্ড,পৃ. ১৮৮ ও ২৭২,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);এবং শায়খুল ইসলাম আল-হারাভী,(আল-দুররুন নাদিদ,পৃ. ৯৭)ইবরাহীম ইবনে ইসমাঈল,ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া,ইয়াহইয়া ইবনে সালামাহ ইবনে কুহাইল এবং আবু আল-জারা-যাঁরা এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাঁদেরকে আবু যুরাহ,আবু হাতিম,ইবনে নুমাইর,দারে কুতনী,বুখারী,নাসাঈ,ইবনে মুঈন,ইবনে হিব্বান,তিরমিযী এবং অন্য অনেকেই অবিশ্বস্ত বলে গণ্য করেছেন।উপরিউক্ত হাদীসগুলো শাহ আবদুল আযীয উত্থাপন করেছেন এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে,যদি হাদীসে সাকালাইনকে আহলে বাইতের ইমামদের ইমামতের নির্দেশক হিসাবে গণ্য করা হয় তবে এসব হাদীসও হুমায়রা,আম্মার,ইবনে মাসউদ,মুয়াজ ইবনে জাবাল,হযরত আবু বকর এবং হযরত উমরের ইমামতের বিষয়টি নির্দেশ করছে। সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন উপসংহারে আমরা তখনই পৌঁছব যখন উপস্থাপিত হাদীসগুলো নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আবাকাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে,এ হাদীসগুলো দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য যেগুলো কোনভাবেই হাদীসে সাকালাইনের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে না-যা মুতাওয়াতির হাদীস এবং শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক রাবী ও পণ্ডিত কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সপ্তম হাদীসশাহ আবদুল আযীয তাঁর যুক্তির সপক্ষে মহানবী (সা.)-এর আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা ‘হাদীসে নুজুম’ নামে পরিচিত। হাদীসটি হলো :‘নিশ্চয়ই আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রতুল্য (নুজুম);তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে,তুমি সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আমার সাহাবীদের মধ্যে মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমত।’সুন্নী আলেমদের মধ্যে যাঁরা এ হাদীসকে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করেছেন তাঁরা হলেন :১.আহমাদ ইবনে হাম্বাল (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯):২.আল-মিযযী (আল-জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৮৯-৯০);৩. আল-বাযযায (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০);৪. ইবনে আল কাততান,(আল-কামিল);৫. দারে কুতনী (লিসান আল-মিযান,২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৭);৬. ইবনে হায্ম,(বাহার আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৮);৭. আল-বায়হাকী,আল-হাফিয আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);৮. ইবনে আবদুল বার (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০-৯১);৯. ইবনে আসাকির (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);১০. ইবনুল জাওযী,(আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়াহ ফি আল-আহাদীস আল-ওয়াহিয়াহ);১১. ইবনে দাহিয়াহ (তালিক তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);১২. আবু হাইয়ান আল-আন্দালুসী (আল-দুর আল-লাকিত মিন আল-বাহর আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৭-৫২৮);১৩. আল-যাহাবী (মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ৪১৩,২য় খণ্ড,পৃ. ১০২ ও ৬০৫);১৪. ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযীয়াহ (ইলাম আল-মুকিন,২য় খণ্ড,পৃ. ২২৩)১৫. যাইন আল-দীন আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);১৬. ইবনে হাজার আল-আসকালানী (তালখীস আল-খাবীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৯০-১৯১)১৭. ইবনে আল-হুমাম (আল-তাহরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);১৮. ইবনে আমীর আল-হাজ (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);১৯. আল-সাখাভী (আল-মাকাসিদ আল-হাসানাহ্,পৃ. ২৬-২৭);২০. ইবনে আবি শারীফ (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২১. আল-সুয়ূতী (ইতমাম আল-দিরায়াহ্ এবং আল-জামি আস-সাগীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২২. আল-মুত্তাকী আল-হিন্দী (কানজুল উম্মাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৩৩);২৩. আল-কারী (আল-মিরকাত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৩);২৪. আল-মানাভী (আল-তাইসির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৪৮ এবং ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২৫. আল-কাফাযী [নাসীম আর রিয়াদ (আশ শিফার ব্যাখ্যাগ্রন্থ),৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩২৩-৩২৪];২৬. আল-সিন্দী (দিরাসাত আল-লাবিব ফি আল-উসওয়াত আল-হাসানাহ্ আল-হাবীব,পৃ. ২৪০);২৭. আল-কাযী মুহিব্বুল্লাহ আল-বিহারী (মুসাল্লিম আল-সুবুত বি শারহ আবদুল আলী,২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০);২৮. নিযাম আল-দীন সাহালাভী [আল-সুবহ আল-সাদিক (মানার এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ)];২৯. আল-মাওলাভী আবদুল আলী [ফাওয়াতিহ আর-রাহমাত (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত),২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০];৩০. আল-শাওকানী (ইরশাদ আল-ফুহুল,পৃ. ৮৩);৩১. ওয়ালিউল্লাহ ইবনে হাবীবুল্লাহ্ আল-লাখনাভী (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত);৩২. সিদ্দীক হাসান খান আল-কনৌজী (হুসুল আল-মামুল,পৃ. ৫৬৮)।৩৩. নাসির উদ্দিন আলবানী (যঈফ ও মওযু হাদীস)নিম্নলিখিত কারণেও এ হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য :১. হাদীসটি কেবল এটিই ইঙ্গিত করে না যে,প্রত্যেক সাহাবীই ন্যায়নিষ্ঠ;বরং প্রত্যেকেই উম্মতের যোগ্য নেতা ও পথপ্রদর্শক। এটি সর্বসম্মতভাবে মিথ্যা। কারণ,তাঁরা নিজেরাই পথনির্দেশনার মুখাপেক্ষী ছিলেন।২. ইতিহাসের বর্ণনা মতে তাঁদের একটি দল বিভিন্ন গুরুতর পাপের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। যেমন হত্যাকাণ্ডএবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান ইত্যাদি। আর তাই এটি যুক্তিসংগত নয় যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মাহর পথনির্দেশক ও নেতা মনোনীত করবেন।৩. পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে,বিশেষ করে সূরা বাকারা,সূরা আহযাব,সূরা জুমুআহ এবং সূরা মুনাফিকুন,যেগুলো সাহাবীদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের মন্দ চরিত্রের ওপর আলোকপাত করেছে এবং এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মতের পথনির্দেশক ও নেতা বলে ঘোষণা করবেন।৪. মাযহাব নির্বিশেষে বিভিন্ন সূত্রে মহানবী (সা.)-এর অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যেগুলো সাহাবীদেরকে একটি দল হিসাবে গণ্য করেছে। উপরিউক্ত হাদীস সেসব নির্ভরযোগ্য হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।১৫. সুন্নী সূত্রে অনেক হাদীস রয়েছে যা উম্মাহকে সাহাবীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে। যাইন আল-ফাতা ফি তাফসীরে সূরা হাল আতা’য় আসিমী কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে যে,মহানবী (সা.) বলেছেন :‘আমার পরে আমার সাহাবীদের দ্বারা বেদআত তৈরি করা হবে (যেমন তাদের মধ্যে যে ফিতনা হবে)। আল্লাহ তাদের পূর্বেকার (উত্তম) আমলের কারণে তাদের ক্ষমা করে দেবেন,কিন্তু যদি লোকজন আমার পরে তাদের অনুসরণ করে,তবে আল্লাহ তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।’৬. মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ এমন সব কথা বলেছেন যাতে বোঝা যায় যে,উম্মতের নেতা ও পথপ্রদর্শক হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না। হযরত আবু বকর ও হযরত উমর তাঁদের নিজেদের সম্পর্কে এমন অনেক বিবৃতি দিয়েছেন যা প্রকাশ করে যে,পথপ্রদর্শক হিসাবে কুরআনের মতো নির্দ্বিধায় অনুসরণ করার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না।২হাদীসে নুজুম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকার ফলে শাহ আবদুল আযীয স্বীকার করেছেন যে,কিছু সংখ্যক সাহাবী ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। কারণ,তা কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশের (নাস) বিপরীত। তারপরও তিনি স্বীকার করেছেন যে,যেসব ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায় না সেসব ক্ষেত্রে সাহাবীদের ইজতিহাদের অনুসরণ করা যাবে।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এর জবাব দিয়েছেন এভাবে :প্রথমত যে ব্যক্তির ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল করার ব্যাপারটি নিশ্চিত সে আইনসঙ্গতভাবে পথপ্রদর্শক হতে পারে না।দ্বিতীয়ত যেখানে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সাহাবীদের ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে,তাহলে যেখানে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে ভুল করার সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি।তৃতীয়ত যেখানে সঠিক পথপ্রদর্শক রয়েছেন-যাঁর পথনির্দেশনা এবং যাঁর পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে,সেখানে যার ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে তার অনুসরণ করার কোন অনুমতি নেই। আয়াতে তাতহীর (সূরা আহযাব : ৩৩) এবং হাদীসে সাকালাইনসহ অনেক আয়াত ও হাদীস আহলে বাইতের ইমামদের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে।চতুর্থত সাহাবীরা শরীয়তের অনেক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করেছেন-যেগুলোর ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের সকলকে পথনির্দেশনার জন্য নক্ষত্রতুল্য বিবেচনা করা সম্পূর্ণরূপে ভুল।পঞ্চমত সাহাবীরা নিজেরাই একে অপরের ভুল ধরেছেন। কখনও কখনও পরিমিতিবোধ লুপ্ত হয়েছে;একে অপরকে মিথ্যাবাদী,অজ্ঞ,এমনকি কাফের পর্যন্ত বলেছেন-যেগুলো আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয়ই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি তাঁদের প্রত্যেককে মুসলিম উম্মাহর সঠিক পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করবে না।ষষ্ঠত সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁরা কিয়াসের অনুশীলন করতেন যে বিষয়ে উম্মতের বিপুল সংখ্যক আইনজ্ঞ দোষারোপ করেছেন।সপ্তমত তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন,এমনকি প্রথম তিন খলীফাও,যাঁরা শরীয়তের নানা বিধান জানার জন্য অন্যদের শরণাপন্ন হতেন। এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) মতবাদগত ও আইনগত বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তিদের উম্মতের কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করবেন। তাঁদের মধ্যে এমনও ছিলেন যাঁরা কুরআনের কিছু শব্দের অর্থও বুঝতেন না। যেমন হযরত উমর ‘কালালাহ’ শব্দের অর্থ বুঝতেন না যেটা তাবারী তাঁর তাফসীরে (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৮৩-২৮৪) উল্লেখ করেছেন। হযরত উমরের নিজের কথাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।অষ্টমত তাঁদের কেউ কেউ সুদের লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন৩,কেউ মদ বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন৪ অথবা জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফতোয়া দিতেন,এমনকি মহানবী (সা.)-এর স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে। কেউ কেউ মহানবী (সা.)-এর সুন্নাতের বিপরীতে বেদআত সৃষ্টির দোষে দুষ্ট। ‘কিতাবুল্লাহ ও আমার সুন্নাহ’ সংক্রান্ত হাদীসের ওপর আলোচনাপথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে সমাজে বহুল প্রচলিত যে হাদীস বিদ্যমান তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদীস :‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা যতক্ষণ তা ধরে থাকবে পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’‘মহান আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ আঁকড়ে ধর’-এ হাদীসটি অনির্ভরযোগ্য এবং এর কোন সহীহ সনদ নেই। কারণ,এ রেওয়ায়াতটি আহলে সুন্নাতের মাত্র আটজন আলেম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর সবকটির সনদ দুর্বল এবং ত্রুটিযুক্ত। নিচে এ হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করা হলো :১. মালেক ইবনে আনাস বলেছেন : আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে,দু’টি জিনিস আমি তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি যেগুলো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও গোমরাহ হবে না : মহান আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক,সুয়ূতীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৮;ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র.),২য়খণ্ড,তাকদীর অধ্যায়,রেওয়ায়াত ৩,পৃ. ৬১৭)তিনি এ হাদীসটি সনদ ছাড়াই মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন।২. ইবনে হিশাম এ রেওয়ায়াতটি মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনিও সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৬০৩)৩. হাকিম নিশাবুরী এ হাদীসটি দু’টি সনদসহ বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অপরটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (মুসতাদরাকে হাকিম,১ম খণ্ড,পৃ. ৯৩)হাকিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির প্রথম সনদে ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস বিদ্যমান যাঁকে এক বিরাট সংখ্যক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ (দুর্বল) বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি এবং তাঁর পিতা যাঈফ। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : তিনি তাঁর মামার কাছ থেকে বেশ কিছু গারীব (অদ্ভুত) হাদীস বর্ণনা করেছে যেগুলো কেউই গ্রহণ করেননি। ইবনে হায্ম তাঁর নিজের সনদ সহকারে সাইফ ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেছেন : ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস হাদীস জা’ল করতেন...। (তাহযীবুত তাহযীব,১ম খণ্ড,পৃ. ২৭১)আর দ্বিতীয় সনদে সালেহ ইবনে মূসা তালহী কুফী বিদ্যমান যাঁকে বহু সুন্নী রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি কিছুই নন (অর্থাৎ তাঁর কোন মূল্যই নেই)। বুখারী বলেছেন : তিনি হাদীস প্রত্যাখ্যানকারী। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : জুমহুর আলেমগণ তাঁকে গ্রহণ করেন না। আকীলী বলেছেন : তাঁর কোন হাদীসই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৫৪)৪. আবু বকর বাইহাকী এ হাদীসটি দু’টি সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অন্যটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (আস-সুনানুল কুবরা,১০ম খণ্ড,পৃ. ১১৪)। এ সনদটিও হাকিম নিশাবুরীর সনদসমূহের মতো প্রথম সনদে ইবনে আবি উওয়াইস এবং দ্বিতীয়টিতে সালেহ ইবনে মূসা আছে যাঁদের উভয়কেই যঈফ বলে গণ্য করা হয়েছে।৫. ইবনে আবদুল বার আল কুরতুবীও এ হাদীসটি দু’টি সূত্রে রেওয়ায়াত করেছেন। (ইবনে আবদুল বার প্রণীত আত তামহীদ)। এর প্রথম সনদ হচ্ছে ঐ সূত্র যা হাকিম আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন এবং এর মধ্যে সালেহ বিন মূসা বিদ্যমান যাঁকে অনেক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন।আর এর দ্বিতীয় সনদে কাসীর বিন আবদুল্লাহ বিদ্যমান যাঁকে একদল রিজালবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁকে হাদীস অমান্যকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী বলে বিবেচনা করতেন এবং তাঁর কোন মূল্যই দিতেন না। নাসাঈ তাঁকে সিকাহ (বিশ্বস্ত) বলে বিবেচনা করেননি। ইবনে আদী বলেছেন : তাঁর বর্ণনাকৃত রেওয়ায়াতসমূহ অনুসরণযোগ্য নয়। আলী ইবনে মাদানীও তাঁকে যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। ইবনে আবদুল বার বলেছেন : তাঁর যঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি তাঁর পিতা ও দাদা থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বান বলেছেন : তাঁর দাদার সূত্রে তাঁর পিতা থেকে যেসব রেওয়ায়াত তিনি বর্ণনা করেছেন সেগুলো আসলে একটি জাল পাণ্ডুলিপির সাথে জড়িত যা গ্রন্থ হিসাবে বর্ণনা করা সঠিক নয়। (আল-ইলমা ফী যাবতির রেওয়ায়াহ ওয়া তাকঈদিস সিমা’,পৃ. ৮-৯)৬. কাযী আইয়ায এ হাদীসটি নিজ সূত্রে আবু সাঈদ খুদরীর মাধ্যমে মহানবী (সা.)থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু (এ সনদের) এর বেশ কতিপয় রাবী যঈফ বলে গণ্য হয়েছে যে,তাঁদের মধ্যে শুআইব ইবনে ইবরাহীম ইবনে সাইফ ইবনে উমরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশেষ করে সাইফ ইবনে উমরের যাঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা রয়েছে। (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৫৯)৭. সুয়ূতীও উপরিউক্ত হাদীসটি হাকিম নিশাবুরীর ঐ একই সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যা ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। (মানাভী প্রণীত ফাইযুল কাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ২৪০)৮. মুত্তাকী হিন্দীও ‘কানযুল উম্মাল’ গ্রন্থে কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। একই শিরোনামের অধীনে হাকিম ও বাইহাকীর মতো অন্যান্য হাদীসবেত্তার রেওয়ায়াতসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং আল-ইবানাহ থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন : এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব।উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,এমন একটি হাদীসকে ‘হাদীসে সাকালাইন’ এর মতো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীসের বিপরীতে উপস্থাপনের কোন অবকাশই নেই। টীকা১. বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে (কিতাব আল-রুকুক) নিচের এই মুতাওয়াতির হাদীসটি হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন :বুখারী মুসলিম ইবনে ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেন,যিনি উহাইব থেকে,তিনি আবদুল আযীয থেকে,তিনি আনাস থেকে বর্ণনা করেন যে,মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমার কাছে হাউসের (হাউসে কাওসার) নিকট আমার সাহাবীদের একটি দলকে আনা হবে এবং আমি তাদের চিনতে পারব;তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব,(হে আল্লাহ! তারা কি) আমার সাহাবী (নয়)? (আল্লাহ) বলবেন,‘তুমি জান না,তোমার পরে তারা কী করেছিল!’অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে (১৪৪২ নং) মহানবী (সা.)-কে বলা হবে : ‘তোমার জানা নেই যে,তোমার পর তারা কী করেছিল! তারা পতনশীল আচরণে (শিরকের অবস্থায়) ফিরে গিয়েছিল।’বুখারী একই রকম হাদীস আর-রুকুক অধ্যায়ে হুযায়ফাহ (১৪৩৫ নং),আবদুল্লাহ (১৪৩৫ নং),সাহল ইবনে সা’দ (১৪৪২ নং),আবু সাইদ আল-খুদরী (১৪৪২ নং),ইবনে আব্বাস (১৪৪২ নং),আবু হুরায়রাহ (১৪৪৩ নং) এবং আসমা বিনতে আবি বকর (১৪৪৯ নং) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাফসীর ও বাদাউল খালক অধ্যায়েও বর্ণনা করেছেন। একই হাদীস কিছু শব্দগত পার্থক্যসহ মুসলিম,আবু দাউদ,তিরমিযী,নাসাঈ,ইবনে মাযাহ,ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় (কিতাব আল-তাহারাত অধ্যায়ে,হাদীস নং ২৮) কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন।ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় কিতাব আল জিহাদ এ ৩২ নং হাদীস হিসাবে নিম্নের হাদীসটি এনেছেন :মহানবী (সা.) ওহুদের শহীদদের উদ্দেশে বলেন : ‘আমি তাদের ব্যাপারে সাক্ষী।’ তখন আবু বকর বলেন : ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা কি তাদের ভাই নই? আমরা তাদের মতো ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তাদের মতো জিহাদ করেছি।’ মহানবী (সা.) জবাব দেন : ‘হ্যাঁ,কিন্তু আমি জানি না যে,আমার পরে তোমরা কী করবে...।’উদাহরণস্বরূপ দেখুন,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পণ্ডিত মাহমুদ আবু রিয়াহ প্রণীত আদওয়া আলাল সুন্নাত আল মুহাম্মাদীয়াহ,পৃ. ৩৩৯-৩৬৩,এবং আল্লামা হিল্লী কর্তৃক প্রণীত নাহজ আল হাক্ক ওয়া কাশফ আস সিদক,পৃ. ২৬২-৩৭৫;এ দু’টি গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনেক হাদীস আলোচনা করেছেন যেগুলো পথপ্রদর্শক হিসাবে রাসূলের প্রত্যেক সাহাবীর নক্ষত্রতুল্য হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে।২. ইবনে সা’দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে (লেইডেন,১৩২২) ২য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হযরত আবু বকরের একটি ভাষণ উল্লেখ করেছেন,যেখানে তিনি বলেছেন : ‘আমি একজন মানুষ মাত্র এবং আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। সুতরাং আমার আনুগত্য কর যখন আমি সোজা পথে চলি এবং আমাকে সংশোধন কর যখন আমাকে ভুল পথে দেখ। তোমাদের জানা উচিত যে,(কখনও) আমি শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হই। সুতরাং যখন তোমরা আমাকে ক্রোধান্বিত দেখ,তখন আমার থেকে দূরে থেক।’ একই রকম বক্তব্য তাঁর থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন :ক. তাবারী তাঁর তারিখে,(কায়রো,১৩৫৭),২য় খণ্ড,পৃ. ৪৪০;খ. ইবনে কুতায়বা তাঁর আল-ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ্ (মাকতাবাতুল ফুতুহ আল-আদাবিয়্যাহ,১৩১),পৃ. ৬;গ. আল হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ (১৩৫২),৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮৩;ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল (হায়দারাবাদ,১৩১২) ২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬ এবং অন্যরা।দ্বিতীয় খলীফা উমর প্রায়ই বলতেন,‘প্রত্যেকেরই (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি জ্ঞান রয়েছে (কুল্লু আহাদিন আ’লামু মিন উমার) এবং ‘সকল লোকের (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি বুঝ আছে’ (কুল্লু আহাদিন আফকাহু মিন উমার)। এর জন্য দেখুন :ক. আল-বায়হাকী,সুনান (হায়দারাবাদ,১৩৪৪),৭ম খণ্ড,পৃ. ২৩৩;খ. আল-সুয়ূতী,আল-দুররুল মানসূর (আল মাতবাআতুল মাইমানিয়্যাহ্,১৩১৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;গ. আল-জামাখশারী,আল-কাশশাফ (মিসর,১৩৫৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল,৮ম খণ্ড,পৃ. ২৯৮;ঙ. আল-হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৩।৩. হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে যায়েদ ইবনে আরকাম এবং একজন মহিলার লেনদেনের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে :ক. আবদুর রাযযাক,আল মুসান্নাফ;খ. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল,তাঁর মুসনাদে;গ. আল-জাসসাস,আহকামুল কুরআনে;ঘ. আল-সারাখশী,মাবসুত;ঙ. আল-দাবুসী,তাসীস আন-নাযার,এবং অনেক সুন্নী আইনজ্ঞ,হাদীসশাস্ত্রবিদ এবং তাফসীরকারই তাঁদের গ্রন্থাদিতে এটি উল্লেখ করেছেন।৪. বুখারী,মুসলিম,দারিমী,ইবনে আবি শায়বাহ,নাসাঈ,ইবনে আসির,গাযযালী,মুত্তাকী,ইবনে খালদূন এবং আবু হিলাল আল-আসকারী কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছেন যেখানে কতিপয় সাহাবী কর্তৃক মদ বিক্রির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। (প্রবন্ধটির প্রধান অংশ সংকলিত হয়েছে প্রখ্যাত ভারতীয় আলেম সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন লক্ষ্ণৌভী রচিত ‘আবাকাত আল আনওয়ার’ থেকে।)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদআশুরার প্রেক্ষাপট: ‏কিভাবে মহানবীর ‎(সা) ‏কথিত ‎'উম্মতের' ‏হাতেই শহীদ হন ইমাম হোসাইন ‎(আ) ?কীভাবে নবীর ‎(সা.) ‏উম্মতই নবীর ‎(সা.) ‏সন্তানকে হত্যা করলো ‎(!)? -এ জিজ্ঞাসা সব যুগের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। আর এ ধরনের প্রশ্ন জাগাটাও খুব স্বাভাবিক।কারণ, ‏ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏মর্মান্তিক শাহাদাত এক বিষাদময় ঘটনা কিংবা আল্লাহর পথে চরম আত্মত্যাগের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্তই শুধু নয়, ‏এ ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে বড়ই অদ্ভুত মনে হবে। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর তিরোধানের মাত্র ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।আর এ হত্যাকাণ্ডের নায়ক ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏কথিত উম্মত যারা রাসূল এবং তাঁর বংশকে ভালবাসে বলে ইতোমধ্যেই খ্যাতিলাভ করেছিল। তাও আবার রাসূলের ‎(সা.) ‏সেইসব শত্রুর পতাকাতলে দাঁড়িয়ে মুসলমানরা রাসূলের ‎(সা.) ‏সন্তানের উপর এ হত্যাকাণ্ড চালায় যাদের সাথে কি-না রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে যুদ্ধ করে গেছেন! ‏মক্কা বিজয়ের পর যখন চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার তখন ইসলামের ঐ চির শত্রুরাও বাধ্য হয়েই নিজেদের গায়ে ইসলামের একটা লেবেল লাগিয়ে নেয়। তাই বলে ইসলামের সাথে তাদের শত্রুতার কোনো কমতি ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের উক্তিটি সুপ্রযোজ্য । তিনি বলেছিলেন-استسلموا و لم یسلموا“ ‏তারা মুসলমান হয়নি, ‏ইসলাম গ্রহণের ভান করেছিল মাত্র।”আবু সুফিয়ান প্রায় ২০ বছর ধরে রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏সাথে যুদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, ‏শেষের দিকে ৫/৬ বছর সে ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং ফেতনা সৃষ্টিতে সরদারের ভূমিকা পালন করে। মোয়াবিয়া তার পিতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতায় নামে। এভাবে আবু সুফিয়ানের দল অর্থাৎ উমাইয়ারা ইসলামের চরম শত্রুতে পরিণত হয়। অথচ আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে প্রত্যক্ষ করি যে, ‏রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏ওফাতের মাত্র দশ বছর পরে সেই মোয়াবিয়া এসে ইসলামী শাসনযন্ত্রের শীর্ষে আরোহণ করে শাম বা সিরিয়ার গভর্নর হয়ে বসে। আরও বিশ বছর পরে ইসলামের এই শত্রু হয়ে বসলো স্বয়ং মুসলমানদের খলীফা! ‏এখানেই শেষ নয়, ‏রাসূলের ‎(সা.) ‏মৃত্যুর পর পঞ্চাশ বছর পর এবার মুসলমানদের খলীফা হল মোয়াবিয়া-পুত্র ইয়াজিদ। আর এই ইয়াজিদ নামায, ‏রোযা, ‏হজ্ব যাকাত তথা ইসলামের বিধি-বিধান পালনকারী মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে অর্ধ-শতাব্দী গড়াতে না গড়াতেই রাসূলের ‎(সা.) ‏সন্তানকে হত্যা করলো। এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মাথা বিগড়ে গেলেও ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। ঐ সব মুসলমানরা যে ইসলামকে পরিত্যাগ করেছিল তা নয়, ‏বরং ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏প্রতি তাদের ভক্তির অভাব ছিল তারও কোনো প্রমাণ মেলে না। কারণ, ‏ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏প্রতি বীতশ্রদ্ধ হলে তারা হয়তো বলতে পারতো যে,(নাউযুবিল্লাহ) ‏ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছেন। সুতরাং তাঁকে হত্যা করতে কোনো বাধা নেই। বরং তারা নিশ্চিতভাবে ইয়াজিদের ওপর ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏সহস্র গুণে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় বিশ্বাস করতো। তাহলে এখন প্রশ্ন হল যে, ‏প্রথমতঃ কিভাবে মুসলিম শাসন ক্ষমতা ইসলামের ঘোর শত্রু আবু সুফিয়ানের দলের হাতে পড়লো? ‏দ্বিতীয়তঃ যে মুসলমানরা ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏রক্তের মূল্য যথার্থভাবে অবগত ছিল তারা কিভাবে ইমাম হোসাইনকে ‎(আ.) ‏হত্যা করলো? (কারবালায় ইমামের পক্ষে প্রায় ১০০ জন ও বিপক্ষে ইয়াজিদ বাহিনীর প্রায় ২০-৩০ হাজার সেনা সমাবেশের আর্ট ছবি) ‏প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে, ‏উমাইয়াদের মধ্যে প্রথমভাগে মুসলমান হবার গৌরব অর্জন করেছিল এবং ইসলামের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করতো না,বরং ইসলামের জন্যে অনেক অবদানই রেখেছিল এমন ব্যক্তির ‎(অর্থাৎ ওসমানের) ‏খলীফা পদ লাভই ছিল এর মূল কারণ। এর ফলেই উমাইয়ারা সর্ব প্রথম মুসলিম খেলাফত লাভ করার সুযোগ পায়। আর,এ সুযোগের অপব্যবহার করে তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে নিজেদের মুলুকে বা ব্যক্তিগত রাজত্বে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বয়ং মারওয়ানই এর জ্বলন্ত উদাহরণ। অবশ্য দ্বিতীয় খলিফার শাসনামলেই মোয়াবিয়াকে শাম বা সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে নিযুক্তির মাধ্যমে ইসলামী শাসনযন্ত্রে উমাইয়াদের উত্থান ঘটে। পরবর্তীতে অন্য সব গভর্নরের পদে রদবদল করা হলেও মোয়াবিয়াকে তার পদে বহাল রাখা হয়। এটাই ছিল মুসলিম শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে উমাইয়াদের হীন বাসনা চরিতার্থকরণের পথে প্রথম অনুকূল ইঙ্গিত।উমাইয়ারা তৃতীয় খলিফা ওসমানের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়ায় ও গোলযোগ সৃষ্টি করে। এতে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শেষ পর্যন্ত মোয়াবিয়া তার সে লালসা পূরণের জন্য মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল। সে নিজের পক্ষ থেকে ওসমানকে ‎‘মজলুম খলীফা’,‘ ‏শহীদ খলীফা’ ‏প্রভৃতি সুবিধামত স্লোগান দিয়ে প্রচারকার্য শুরু করলো এবংনিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে আদাজল খেয়ে লেগে গেল। সে ওসমানের রক্তভেজা জামা সবার সামনে মেলে ধরে তারঅসহায়ত্বকে গতিশীল রূপ দেয় এবং বলে বেড়ায়,‘যেহেতু ওসমানের হত্যার পর আলী ‎(আ.) ‏খলীফা হয়েছেন, ‏তাছাড়া ওসমানের হত্যাকারীদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন-তাই ওসমান হত্যার জন্য মূলতঃ আলীই ‎(আ.) ‏দায়ী।’ ‏এই বলে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে যাতে মানুষের অনুভূতিকে আকৃষ্ট করতে পারে। তার এ প্রচেষ্টা সফলও হয়। কারণ, ‏তার কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে অনেকেই চোখের পানি ঝরায় ও শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে মজলুম খলীফার রক্তের প্রতিশোধ নিতে যেই কথা-সেই কাজ- ‏এইরুপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তারা মোয়াবিয়াকে আশ্বাস দেয়ঃ আমরা প্রস্তুত আছি, ‏তুমি যা বলবে তাই আমরা পালন করতে রাজী আছি। এভাবে পদলোভী স্বার্থপর মোয়াবিয়া মুসলমানদেরকে নিয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। ইসলামের ঊষালগ্নের প্রহেলিকাময় ঘটনাবলী এবং নবীর ‎(সা.) ‏উম্মতের হাতে নবীর ‎(সা.) ‏সন্তানের হত্যার কারণইতিহাসে বেশকিছু বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন ঘটনা রয়েছে যেগুলোর কারণ এবং সূত্র খুঁজতে গিয়ে অনেকেই হয়তো বিপাকে পড়তে পারেন। এগুলোর মধ্যে একটি হল ইসলামের ঊষালগ্নেই সমসাময়িক নানা মতভেদ ও দ্বন্দ্ব।[কারবালা ময়দানের এখানেই ছিল ইমাম হুসাইনেরর ‎(আ) ‏একমাত্র জীবিত পুত্র ও নতুন ইমাম হযরত জাইনুল আবেদীন ‎(আ)'র তাবু। অসুস্থতার কারণে তিনি কারবালার যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তাঁর বেঁচে যাওয়াটাও ছিল বিস্ময়কর এবং অলৌকিক] ‏আরেকটি ঘটনা হল ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏আন্দোলন এবং বিদ্রোহ। আত্মীয়-অনাত্মীয়,চেনা-অচেনা নির্বিশেষে সবাই কুফার লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার ইস্যু টেনে ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏কে বিরত রাখতে চেষ্টা করছিল। তারা যে ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এ চেষ্টা চালিয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রহস্যের বিষয় হল যে, ‏ইমাম হোসাইনও ‎(আ.) ‏তাদের চিন্তাধারাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেননি। অথচ মক্কা,কারবালা এবং কুফার পথে তার বিভিন্ন ভাষ্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, ‏ইমাম হোসাইনের ‎(আ.)ও একটা স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ছিল যা অনেক ব্যাপক ও দূরদর্শী। তাঁর হিতাকাঙ্খীদের ভাবনা কেবল নিজের এবং পরিবার-পরিজনদের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। অথচ, ‏ইমাম হোসাইনের ‎(সা.) ‏চিন্তা ছিল দীন,ঈমান ও আকীদার নিরাপত্তাকে নিয়ে। তাই, ‏মারওয়ানের এক নসিহতের জবাবে ইমাম হোসাইন ‎(সা.) ‏বলেনঃو علی الاسلام السلام اذ قد بلیت الامة براع مثل یزید‘‘ ‏ইয়াজিদের মতো কেউ যদি উম্মতের শাসক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের বিদায় ।’’মোয়াবিয়া ও ইয়াজিদের ইসলামী শাসন ক্ষমতা লাভ এবং ইসলামে অবিচল মুসলমানদের নিয়ে যথাক্রমে হযরত আলী ‎(আ.) ‏এবং ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন ছিল ইসলামের ঊষালগ্নের প্রহেলিকাময় ঘটনাবলীর অন্যতম। এখানে দুটি বিষয়কে খতিয়ে দেখা দরকার। তাহলেই ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা,এর কারণ,লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উদঘাটন করা আমাদের পক্ষে সহজতর হবে। প্রথমতঃ আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ইসলাম ও কোরআনের সাথে উমাইয়া বংশের তীব্র সংঘাত এবং দ্বিতীয়তঃ ইসলামী শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে তাদের সফলতা। ইসলামের সাথে উমাইয়াদের এহেন শত্রুতাসুলভ আচরণের কারণ হল যে,একাদিক্রমে তিন বংশ ধরে বনি হাশিম ও বনি উমাইয়ার মধ্যে গোষ্ঠীগত কোন্দল চলে আসছিল। অতঃপর যখন বনি হাশিম ইসলাম ও কোরআনের ধারক ও বাহক হবার গৌরব লাভ করে তখন বনি উমাইয়ারা ঈর্ষায় পুড়ে মরতে থাকে। ফলতঃ তারা বনি হাশিমকে সহ্য করতে পারলো না,সাথে সাথে ইসলাম ও কোরআনকেও না। দ্বিতীয় কারণ হলঃ তৎকালীন কোরাইশ গোত্রের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে উমাইয়াদের পার্থিব জীবনধারার সাথে ইসলামী বিধানের অসামঞ্জস্য ও বৈপরীত্য। ‎‌ইসলামী নীতিমালায় তাদের প্রভুত্বমূলক প্রভাব ক্ষুণ্ণ হয়। তাদের ভাব ও মন-মানস ছিল সুবিধাবাদী ও বস্তুবাদী। উমাইয়াদের যথেষ্ট বুদ্ধি থাকলেও তাদের ঐ বস্তুবাদী মানসিকতার কারণে খোদায়ী বিধান থেকে তারা উপকৃত হতে পারেনি। কারণ ঐশী শিক্ষাকে সে-ই অবনত মস্তকে গ্রহণ করতে পারে যার মধ্যে মর্যাদাবোধ, ‏উন্নত আত্মা এবং মহত্বের আনাগোনা রয়েছে এবং যার মধ্যে সচেতনতা ও সত্যান্বেষী মনোবৃত্তি নিহিত আছে। অথচ উমাইয়ারা অতিশয় দুনিয়া চর্চা করতে করতে এসব গুণগুলোর সব ক’ ‏টি হারিয়ে বসেছিল। অগত্যা তারা ইসলামের সাথে শত্রুতায় নেমে পড়ে। পবিত্র কুরআনেও এ দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সত্যকে মেনে নেবার সক্ষমতা যাদের আছে তাদেরকে ইশারা করে কুরআনে বলা হয়েছেঃ ‎لِیُنْذِرَ مَنْ کَانَ حَیًّا‘ ‏যাতে তিনি ‎(রাসূল) ‏সচেতনদের সতর্ক করতে পারেন।’’ (ইয়াসীনঃ ৭০) إِنَّمَا تُنْذِرُ مَنِ اتَّبَعَ الذِّکْرَকেবল তাদেরকেই সতর্ক করো যারা উপদেশ মেনে চলে’ ‏। ‎(ইয়াসীনঃ ১১) وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِینَ‘ ‏আমরা কোরআন অবতীর্ণ করি ‎,যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত। আর তা জালেমদের ক্ষতিই বাড়ায়। ‎’ ( ‏বনী ইসরাঈলঃ ৮২) لِیَمِیزَ اللَّهُ الْخَبِیثَ مِنَ الطَّیِّبِ‘ ‏এটি এজন্য যে,আল্লাহ কুজনদেরকে সুজন হতে পৃথক করবেন।’ (আনফাল ‎: ‏৪৮)মোদ্দাকথা,আল্লাহর রহমত থেকে তারাই উপকৃত হতে পারবে যাদের প্রস্তুতি ও যোগ্যতা রয়েছে। এটি একটি খোদায়ী নীতি। আর উমাইয়াদের মধ্যে সে প্রস্তুতি না থাকায় তারা ইসলাম এবং কোরআনের অমিয় সুধা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।রাসূলের ‎(সা.) ‏চাচা হযরত আব্বাস এবং আবু সুফিয়ানের মধ্যে এক সাক্ষাতে তাদের মধ্যকার কথোপকথন থেকে আবু সুফিয়ানের নিরেট ও অন্ধ আত্মার প্রকাশ ঘটে।কিন্তু উমাইয়া দল কিভাবে চিরকাল শত্রুতা করেও হঠাৎ করে একটা তৎপর ইসলামী দল হিসাবে আত্ম প্রকাশ করলো-উপরন্তু তারা ইসলামের শাসন ক্ষমতাকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে সক্ষম হলো? ‏এ প্রশ্নের জবাবের শুরুতে একটা বিষয় উল্লেখ্য । তাহলো-নবনির্মিত ও নব প্রতিষ্ঠিত কোনো জাতি হঠাৎ করেই শক্তিশালী ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, ‏চাই সে ঐক্য যত শক্তিশালীই হোক না কেন। একটু চিন্তা করলে আমাদের সামনে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হবে যে, ‏আরবে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত মজবুত হতে না হতেই দ্বিতীয় খলীফার আমলে ব্যাপক দেশজয়ের ফলে ইসলামের অতি দ্রুত প্রচার ও প্রসার ঘটে। তাই ইসলাম তার স্বাভাবিক গতিতে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েনি। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে দেখা দেয় নানা দ্বন্দ্ব-বিভেদ এবং গড়ে ওঠে অসংহত মুসলিম সাম্রাজ্য। এর পাশাপাশি আরবের ইসলামী সংস্কৃতিতে অনারব ও অনৈসলামী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ করে। ফলে অতি শীঘ্রই আরব তার স্বাতন্ত্র্য ও ইসলামী সাংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলে।কয়েক যুগ আগের কারবালা সেযুগের নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ‎‘ ‏লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ -এর পতাকাতলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল বটে এবং জাতি-বর্ণের ব্যবধানকে দ্রুত মোজেজার ন্যায় মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল বটে কিন্তু বিভিন্ন গোত্র, ‏ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ,রীতি-নীতি,আদব-কায়দা এবং ভিন্ন আকীদা-বিশ্বাসে গড়ে ওঠা মানুষগুলোর দীন ও দীনের আইন-কানুন মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সমান যোগ্যতা ও প্রস্তুতি ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে একজন গাঢ় ঈমানদার হলে আরেকজন যে দুর্বল ঈমানের অধিকারী ছিল একথা অস্বীকার করার জো নেই। আরেকজন হয়তো সন্দেহ ও বিভ্রান্তিতে নিপতিত ছিল এবং কেউ কেউ অন্তরে কুফরি মনোভাবও হয়তো পোষণ করতো। এ ধরনের একটা জনসমষ্টিকে বছরের পর বছর তথা শতাব্দীর পর শতাব্দীঅবধি একটা নির্দিষ্ট সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ধরে রাখা সহজ কথা নয়।পবিত্র কোরআনে বহুবার মোনাফিকদের কথা উল্লেখ করেছে। মোনাফিকদের ব্যাপারে সতর্ক করার ধরন দেখে বোঝা যায় যে, ‏এরা মারাত্মক। কোরআন মুসলমানদেরকে এই গুরুতর বিপদ থেকে রক্ষা করতে চায়। আব্দুল্লাহ ইবনে সালুল মদীনার মোনাফিকদের শীর্ষে ছিল। কোরআন‘ ‏মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ ‏এর কথা উল্লেখ করেছে যারা দায়ে পড়ে কিংবা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মুসলমানের তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়েছে। যাহোক, ‏তারা যাতে আস্তে আস্তে খাঁটি মুসলমান হতে পারে সেদিকে তাদেরকে উৎসাহিত করা উচিত। বায়তুলমাল থেকে তাদেরকে সাহায্য করতে হবে যাতে অন্ততপক্ষে তাদের অনাগত বংশধররা খাটি মুসলমান হয়ে গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে নিয়োগ করা মারাত্মক ভুল। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏তাঁর দয়া ও সদাচরণ থেকে কাউকে বঞ্চিত করতেন না। এমন কি মোনাফিক এবং‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ ‏দেরকেও না। কিন্তু তাদের প্রতি সতর্কাবস্থা তিনি কখনো বর্জন করেননি। আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏জীবদ্দশায় কোনো দুর্বল ঈমানদার,মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম কিংবা মোনাফিক উমাইয়াদের কেউই ইসলামী শাসনযন্ত্রের ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল,রাসূলের ‎(সা.) ‏মৃত্যুর পর থেকে বিশেষ করে তৃতীয় খলিফারআমলে তারাই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো কুক্ষিগত করে। রাসূলের ‎(সা.) ‏জীবদ্দশায় মারওয়ান ও তার বাবা হাকাম মক্কা ও মদীনা থেকে নির্বাসন প্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এ সময় তারা ফিরে আসার সুযোগ পায়। প্রথম দুই খলীফার আমলেও তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা সংক্রান্ত তৃতীয় খলিফার অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ঐ মারওয়ানই ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি এবংওসমান হত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।তৃতীয় খলিফার সময় উমাইয়ারা বড় বড় পদে আসীন এবং বায়তুল মালে হস্তক্ষেপ করে। যেটুকু তাদের ঘাটতি ছিল তা হল ধার্মিকতা। কিন্তু তৃতীয় খলিফার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে অদ্ভুত এক প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির মাধ্যমে‘ ‏ধার্মিক’ ‏হবার গৌরবটাও তারা হাতে পায় এবং সেটাকেও তাদের লক্ষ্য চরিতার্থ করার কাজে নিয়োগ করে। আর এর বদৌলতেই মোয়াবিয়া দীন ও দীনের শক্তির নামে হযরত আলীর ‎(আ.) ‏মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ও বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে মোয়াবিয়া আলেমদেরকে ভাড়া করে আরও একটা কৃতিত্ব বাড়ায়। অর্থাৎ এখন থেকে সে চারটি দিককে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে মুসলমানদের শাসন-মঞ্চে আবির্ভূত হয়। এগুলো ছিলঃ ‎(১) ‏বড় বড় রাজনৈতিক পদ ‎(২) ‏ধন-দৌলতের প্রাচুর্য ‎(৩) ‏অতিমাত্রায় ধার্মিকতা এবং ‎(৪) ‏দরবারী আলেম সমাজ। দামেস্কের জাইনাবিয়া মসজিদ ও হযরত জাইনাব ‎(সা)'র পবিত্র মাজার ‎(পুরোণো ফাইল ছবি) ‏তৃতীয় খলিফার যুগে উমাইয়াদের রাজনৈতিক উত্থান এবং বায়তুলমালের ছড়াছড়ি দেখে দীনদার এবং দুনিয়াদার উভয়পক্ষই ক্ষেপে ওঠে। দুনিয়াদাররা তাদের চোখের সামনে উমাইয়াদের ভোগ-বিলাস সহ্য করতে পারেনি কারণ তারা তাদের নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে সচেতন ছিল। আর দীনদাররা দেখছিল যে, ‏ইসলামী সমাজের আশু ধ্বংস অনিবার্য। এ কারণেই দেখা যায় যে,আমর ইবনে আস যেমন এর বিরোধিতায় নামে তেমনি আবুজর বা আম্মারও এর বিরোধিতা করেন। আমর ইবনে আস বলেঃ‘ ‏আমি এমন কোনো রাখালের পার্শ্ব অতিক্রম করিনি যাকে উসমানের হত্যার জন্যে উস্কানি দেই নি’। হযরত আলী ‎(আ.) ‏জামালের যুদ্ধে বলেন ‎:لعن الله اولانا بقتل عثمان‘ ‏ওসমান হত্যা করতে আমাদের মধ্যে যারা অগ্রণী ছিল আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দিক।’যখন হযরত ওসমান অবরোধের মধ্যে ছিলেন তখন হযরত আলী তাকে বিভিন্ন উপদেশও দিক-নির্দেশনার পাশাপাশি তাকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করেছেন। কিন্তু মোয়াবিয়া এই ফেতনা-ফ্যাসাদের সূচনা ও পরিণতি সম্বন্ধে ভালভাবেই অবগত ছিল। তাই খলিফা ওসমান তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেও মোয়াবিয়া তার বিশাল বাহিনী নিয়ে সিরিয়াতেই বসে থাকলো। কারণ সে বুঝেছিল যে, ‏জীবিত ওসমানের চেয়ে মৃত ওসমানই তার জন্যে বেশি সুবিধাজনক। তারপর যখন ওসমানের হত্যার সংবাদ শুনলো অমনি হায় ওসমান! ‏হায় ওসমান! ‏বলে চীৎকার করে উঠলো। খলিফা ওসমানের রক্ত ভেজা জামা লাঠির মাথায় করে ঘুরালো,মিম্বারে বসে শোক গাঁথা গেয়ে নিজেও যেমন কাঁদলো তেমনি অজস্র মানুষের চোখের পানি ঝরালো, ‏আর কোরআনের এই আয়াত নিজের স্লোগানে পরিণত করল: وَمَن قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِیِّهِ سُلْطَانًا ‘ ‏যে মজলুম অবস্থায় নিহত হয় তার উত্তরসূরিকে আমরা কর্তৃত্ব দান করেছি’ ( ‏বনী ইসরাইল ‎: ‏৪৪ ‎) ‏ফলে ওসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্যে মোয়াবিয়া ধন-দৌলত ও সরকারী পদগুলোর সাথে ধার্মিকতাকেও যুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের একটা বড় অংশের অধিকর্তা হয়ে বসে। অন্যকথায়, ‏ধার্মিকতার শক্তিকে রাজনীতি ও ধন-দৌলতের সাথে যোগ করে জনগণ তথা হযরত আলীর ‎(আ.) ‏অনুসারীদেরকে সংকটাবস্থায় নিক্ষেপ করে। তাদেরকে বস্তুগত দিক থেকেও যেমন সংকটে ফেলে তেমনি আত্মিক ও মানসিকভাবেও। অবশ্য কেবল ধার্মিকতা মজলুমের পক্ষ হয়েই অগ্রসর হয়। কিন্তু যদি জনগণের অজ্ঞতা এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতারণার বলে ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয় তাহলে আর দুর্দশার শেষ নেই। আল্লাহ আমাদেরকে সেদিনের হাত থেকে বাঁচান যেদিন ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হবে।এই ছিল ইসলামী খেলাফত লাভ ও আলেম সমাজের ওপর মোয়াবিয়ার কর্তৃত্ব লাভ করার সংক্ষিপ্ত কাহিনী,যা তিনটি জিনিসের সমন্বয়ে সম্ভব হয়েছিল। যথাঃ উমাইয়াদের, ‏বিশেষ করে মোয়াবিয়ার কূটবুদ্ধি, ‏পূর্ববর্তী খলীফাদের সরলতা যারা এদেরকে ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় স্থান দিয়েছিল আর জনগণের অজ্ঞতা ও মূর্খতা।মোয়াবিয়া তথা উমাইয়ারা দুটো বিষয়কে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়;(১) ‏জাতিগত ব্যবধান সৃষ্টি যার ভিত্তিতে আরব,অনারবের চেয়ে অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হতো।(২) ‏গোত্রীয় ব্যবধান সৃষ্টি যার ভিত্তিতে আব্দুর রহমান ইবনে আউফের মতো লোকেরা লাখপতি হয় অথচ ফকীররা ফকীরই থেকে যায়।আলী ‎(আ.) ‏দুনিয়া ত্যাগ করলে মোয়াবিয়া খলীফা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের সাথে সে দেখতে পেল যে,তার ধারণাকে বদলে দিয়ে মৃত্যুর পরেও হযরত আলী ‎(আ.) ‏একটা শক্তি হয়েই বহাল রয়ে গেছেন। মোয়াবিয়ার ভাব-লক্ষণ দেখে বোঝা যেত যে,এ কারণে সে বড়ই উদ্বিগ্ন ছিল। তাই মোয়াবিয়া হযরত আলীর ‎(আ.) ‏বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার যুদ্ধে নামে। আদেশ জারী করা হলো যে, ‏মিম্বারে এবং খোতবায় হযরত আলী ‎(আ.) ‏কে অভিশাপ দিতে হবে। হযরত আলীর ‎(আ.) ‏অন্যতম সমর্থকদেরকে বেপরোয়াভাবে হত্যা করা হলো এবং বলা হলো যে, ‏প্রয়োজনে মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে হলেও তাদেরকে বন্দী করবে যাতে হযরত আলীর ‎(আ.) ‏গুণ-মর্যাদা প্রচার না হয়। পয়সা খরচ করে হযরত আলীর ‎(আ.) ‏শানে বর্ণিত হাদীসগুলো জাল করে উমাইয়াদের পক্ষে বর্ণনা করা হয়। তবুও বরাবরই উমাইয়া শাসনের জন্যে হযরত আলীর সমর্থকরা একটা হুমকি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।উমাইয়া শাসনামলের বিশ্লেষণ আমাদেরকে কেবল বিস্ময়াভিভূতই করে না বরং আমাদের জন্যে দিক নির্দেশনা বের হয়ে আসে। এটা যেনতেন কোনো ব্যাপার নয় যে, ‏চৌদ্দশ’ ‏বছর আগের ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি লাভ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাব। কারণ,চৌদ্দশ বছর আগের ইতিহাসের ঐ খণ্ড অধ্যায়ে ইসলামের মধ্যে যে বিষক্রিয়া সংক্রমিত হয়েছিল তা থেকে মুক্তির আশা সুদূর পরাহত। তাই এ নিয়ে গবেষণা করলে বরং আমাদের লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি নেই। উমাইয়াদের ঐ বিষাক্ত চিন্তার উপকরণকে ইসলামী চিন্তাধারার সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। ইসলামের খাঁটি রূপ দেখতে হলে এসব ভেজাল উপকরণের অপসারণ দরকার। খোদা না করুন,আজ আমরা যারা দিবারাত্রি উমাইয়াদের গালি দেই তাদের মধ্যেও হয়তো উমাইয়া চিন্তাধারা বিদ্যমান। অথচ আমরা তাকে একবারে বিশুদ্ধ ইসলাম বলে মনে করি।মোয়াবিয়া যখন দুনিয়া ত্যাগ করে তখন ইতোমধ্যে সংযোজিত কিছু বিদআত প্রথার সাথে আরও কয়েকটি প্রথার চলন করে যায়। যেমন ‎:এক ‎. ‏হযরত আলীকে ‎(আ.) ‏অহরহ অভিসম্পাত করাদুই ‎. ‏টাকার বিনিময়ে হযরত আলীর ‎(আ.) ‏বিরুদ্ধে হাদীস জাল করা।তিন ‎. ‏প্রথমবারের মতো ইসলামী সমাজে বিনাদোষে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করার অবাধ নীতি চালু করা। এছাড়া সম্মানীয়দের সম্মান খর্ব করা এবং হাত-পা কেটে বিকল করে দেয়া।চার ‎. ‏বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা। যে প্রথা পরবর্তী খলীফারাও অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করে। এসব অমানবিক প্রথার চলন মোয়াবিয়াই চালু করে যায়। সে ইমাম হাসান ‎(আ.),মালেক আশতার, ‏সা’ ‏দ ইবনে ওয়াক্কাছ প্রমুখকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে।পাঁচ ‎. ‏খিলাফতকে নিজের খান্দানে আবদ্ধ রেখে রাজতন্ত্র প্রথা চালু করা এবং ইয়াজিদের মতো অযোগ্য ব্যক্তিকেও খলীফা পদে মনোনীত করা।ছয় ‎. ‏গোত্র বৈষম্যের স্তিমিতপ্রায় আগুনকে পুনরায় অগ্নিবৎ করা।এগুলোর মধ্যে হযরত আলীকে ‎(আ.) ‏অভিসম্পাত করা,হাদীস জাল করা এবং ইয়াজিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ ছিল মোয়াবিয়ার কার্যকলাপের অন্যতম। রূপান্তরিতইয়াজিদ ছিল মূর্খ ও নির্বোধ। সাধারণতঃ খলীফার পুত্রদের মধ্যে যাকে ভাবী খলীফা হিসাবে মনোনীত করা হতো তাকে বিশেষ শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হত;যেমন আব্বাসীয়দের মধ্যে প্রচলন ছিল। কিন্তু ইয়াজিদ বড় হয় মরুভূমিতে রাজকীয় বিলাসিতায়। দুনিয়ার খবরও সে রাখতো না;পরকালেরও না। মোটকথা খলীফা হবার বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও তার ছিল না। ওসমানের সরলতার সুযোগে বায়তুলমাল লুণ্ঠিত হয়েছিল,বড় বড় পদগুলো অযোগ্যদের হাতে চলে গিয়েছিল। কিংবা মোয়াবিয়া হযরত আলীর ‎(আ.) ‏বিরুদ্ধে অভিসম্পাত দেয়া,হাদীস জাল করা, ‏বিনা দোষে হত্যা, ‏বিষ প্রয়োগ,খেলাফতকে রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করা প্রভৃতি প্রথা চালু করেছিল। কিন্তু ইয়াজিদের যুগে এসে ইসলাম আরো বিপর্যস্ত হতে থাকে। দেশ-বিদেশের দূত এসে সরাসরি ইয়াজিদের কাছে যেত। কিন্তু,অবাক হয়ে দেখতো যে,রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏আসনে এমন একজন বসে আছে যার হাতে মদের বোতল,আর পাশে বসিয়ে রেখেছে রেশমী কাপড় পরা বানর। এরপরে ইসলামের ইজ্জত বলতে আর কি-বা থাকতে পারে? ‏ইয়াজিদ ছিল অহংকারী,যৌবনের পাগল,ক্ষমতালোভী এবং মদ্যপ। এ কারণেই ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏বলেছিলেনঃ‘ ‏যদি ইয়াজিদের মতো দুর্ভাগা উম্মতের শাসক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের ইতি টানতে হবে। ইয়াজিদ প্রকাশ্যে খোদাদ্রোহিতায় নামে। অন্য কথায়,এতোদিনের গোপনতার পর্দা ছিন্ন করে ইয়াজিদ উমাইয়াদের আসল চেহারাটা প্রকাশ করে দেয়। ইসলাম যদি জিহাদ করার আদেশ দিয়ে থাকে-যদি অন্যায়ের গলা চেপে ধরার আদেশ দিয়ে থাকে তাহলে এটাই ছিল তা পালনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তা নাহলে,এরপর আর কি নিয়ে ইসলামের দাবী উত্থাপন করার থাকে?কাজেই,যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, ‏ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏কেন বিদ্রোহ করতে গেলেন তাহলে একই সাথে তার এ প্রশ্নও করা উচিত যে,রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏কেন আপোষহীন বিদ্রোহ করেছিলেন কুফরের বিরুদ্ধে ‎? ‏কিংবা,হযরত ইবরাহীম ‎(আ.) ‏কেন একা হয়েও নমরুদের বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন? ‏আর কেনই বা হযরত মূসা ‎(আ.) ‏একমাত্র সহযোগী ভ্রাতা হারুনকে নিয়ে ফেরাউনের রাজ প্রাসাদে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন? ‏এসবের জবাব খুবই স্পষ্ট যা ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। নাস্তিকতা এবং খোদাদ্রোহিতাকে সমূলে উৎপাটন করাই ছিল এসব কালজয়ী মহা পুরুষদের মূল উদ্দেশ্য । আর নাস্তিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে বস্তুগত সাজ-সরঞ্জাম না হলেও চলে। কারণ,স্বয়ং আল্লাহই তাদের সহায়। তাই ইমাম হোসাইন ‎(আ.)ও উমাইয়া খোদাদ্রোহিতা এবং ইয়াজিদী বিচ্যুতিকে ধূলিসাৎ করে দেবার জন্যেই একবারে অসহায় অবস্থায় পড়েও বিদ্রোহে নামেন। প্রকৃতপক্ষে তার এ পদক্ষেপ ছিল পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলদেরই ‎(আ.) ‏অনুকরণ। বুদ্ধিজীবীদের মতে,বিদ্রোহ তখনই মানায় যখন বিদ্রোহীদের অন্ততপক্ষে সমান সাজ-সরঞ্জাম এবং শক্তি থাকে। কিন্তু,ঐশী-পুরুষদের বেলায় আমরা এই যুক্তির কোনো প্রতিফলন দেখি না। বরং তারা সবাই একবারে খালি হাতে তৎকালীন সর্ববৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ইমাম হোসাইন ‎(আ.)ও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নন। তাছাড়া ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏যদি সেদিন ইয়াজিদ বাহিনীর সমান এক বাহিনী নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতেন তাহলে তার এ অসামান্য বিপ্লব ঐশী দ্যুতি হারিয়ে অতি নিষ্প্রভ হয়ে পড়তো। এই দর্শন প্রতিটি ঐশী বিপ্লবের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল।মানব সমাজে সংঘটিত অজস্র বিপ্লবের মধ্যে ঐশী বিপ্লবকে পৃথক মনে করার দুটি মাপকাঠি রয়েছে:এক ‎. ‏ঐ বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিচার। অর্থাৎ এসব বিপ্লব মনুষ্যত্বকে উন্নত ও উত্তম করতে,মানবতাকে মুক্তি দিতে,একত্ববাদ ও ন্যায়পরায়ণতাকে রক্ষা করতে এবং জুলুম ও স্বৈরাচারের মূলোৎপাটন করে মজলুমের অধিকার ফিরিয়ে দেবার জন্যেই পরিচালিত হয়। জমি-জায়গা বা পদের লোভে কিংবা গোষ্ঠীগত বা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে নয়। দুই ‎. ‏এসব বিপ্লবের উদ্ভব হয় স্ফুলিঙ্গের মতো। চারদিকে যখন মজলুম-নিপীড়ন এবং অত্যাচার ও স্বৈরাচারের ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকারের বুক চিরে বারুদের মতো জ্বলে ওঠে এসব বিপ্লব। চরম দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়ে মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মানুষের ভাগ্যাকাশে আশার দীপ জ্বালিয়ে দেয় এসমস্ত ঐশী বিপ্লব। এই চরম দুর্দিনে মানবতাকে মুক্তি দেয়ার মতো দূরদর্শিতা একমাত্র ঐশী-পুরুষদেরই থাকে। কিন্তু,সাধারণ মানুষ একবারে হাল ছেড়ে দেয়-এমনকি কেউ প্রতিকারে উদ্যোগী হলেও তারা তাকে সমর্থন করতে চায় না। এ ঘটনা আমরা ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏বিপ্লবের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করি। তিনি যখন ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন তখন সমসাময়িক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এটাকে অবাস্তব ব্যাপার বলে মনে করল। এ কারণে তাদের অনেকেই ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏সাথে একাত্মতা প্রকাশে বিরত থাকে।কিন্তু ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏ভালভাবে জানতেন যে,এ মুহূর্তে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তাই অন্য কারও সহযোগিতা থাকবে কি-না সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নবী-রাসূলদের মতো নিজেই আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠলেন। হযরত আলী ‎(আ.) ‏বনী উমাইয়াদের ধূর্তামি সম্পর্কে বলেন ‎:انّها فتنة عمیاء مظلمة‘‘ ‏তাদের এ ধোঁকাবাজি নিরেট ও অন্ধকারময় প্রতারণা।’’তাই ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏এই অন্ধকার থেকে উম্মতকে মুক্ত করার জন্যে ইতিহাসে বিরল এক অসামান্য ও অবিস্মরণীয় বিপ্লবের পথ বেছে নেন।প্রচারে মোঃ শামসীর হায়দার