পোস্টগুলি

অক্টোবর, ২০২২ থেকে পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে

শিয়া মাযহাবের সূচনা সাধারণত এই প্রশ্ন হয়ে থাকে যে শিয়া মাযহাব কোন সময় থেকে শুরু হয়েছে। ইমামত সম্পর্কে অনেক হাদীস বিভিন্ন সূত্রে শিয়া এবং অন্যান্য মাযহাব থেকে বর্ণিত হয়েছে যা পরবর্তিতে "শিয়া মাযহাবের আক্বাইদ" নামক অধ্যায়ে উল্লেখ ও পর্যালোচনা করা হবে। এখানে আমরা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর থেকে বর্ণিত হাদীসগুলি যেখানে কোন গোষ্ঠীকে আলী (আ.)-এর শিয়া বা অনুসারী বলে স্মরণ করেছেন সেগুলি, অতঃপর এই বিষয়ের উপর উল্লেখিত দলিলগুলি যা বিভিন্ন হাদীসসমূহে ও ইসলামী ইতিহাসে এসেছে এবং আমাদের আলোচ্য বিষয়কে বুঝতে সহায়তা করবে, সেগুলি উল্লেখ করব। যে সমস্ত হাদীসগুলি এখানে উল্লেখ করা হবে তা আহলে সুন্নাতের গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। উল্লেখিত হাদীসগুলি (যা এই বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে) শুধুমাত্র উদাহরণ স্বরূপ আনা হল কিন্তু এ বিষয়ক অন্যান্য হাদীসগুলি এই সূত্রে অথবা অন্যান্য সূত্রে পাওয়া যাবে। ১- ইবনে আসাকির (মৃত্যু ৫৭১ হিজরি) জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারি থেকে বলেন: একদিন আমরা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর নিকট ছিলাম যখন আলী (আ.) প্রবেশ করলেন। এমন সময় হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বললেন: 'তারই কসম, যার হাতে আমার জীবন, এই ব্যক্তির (আলী) ও তার শিয়ারা (অনুসারী) কিয়ামত দিবসে মুক্তিপ্রাপ্ত হবে' অতঃপর সূরা বাইয়েনার সাত নং আয়াতটি নাযিল হয় 'অবশ্যই যারা ঈমান এনেছে এবং নেককাজ করবে সমস্ত মানব জাতির থেকে তারা উত্তম'। এর পর থেকে যখন হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সাহাবাগণ আলী (আ.)-কে দেখতেন, বলতেন মানুষের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি এসেছে (ইবনে আছাকির, তারিখে ইবনে আছাকির, খণ্ড- ২, পৃঃ- ৪৪২, সুয়ুতি, আদ্দুররুল মানছুর, খণ্ড-৮, পৃঃ-৫৮৯০)। ২- ইবনে হাজার (মৃত্যু-৯৭৪ হিজরি) ইবনে আববাস থেকে বর্ণনা করে যে : হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সূরা বাইয়েনার সাত নং আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর আলী (আ.)-কে বলেন: 'ঐ (উত্তম) ব্যক্তি তুমি এবং তোমার শিয়ারা। তুমি এবং তোমার শিয়ারা কিয়ামতের দিনে উপস্থিত হবে যখন আল্লাহ তা'য়ালা তোমাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তোমরাও তাঁর উপর সন্তুষ্ট। আর তোমার শত্রুরা উপস্থিত হবে রাগান্বিত অবস্থায় এবং তাদের গর্দান ধরে নিয়ে যাওয়া হবে' (ইবনে হাজার, আছছাওয়াইকুল মোহরিকাহ, অধ্যায়-১১)। এই গ্রন্থেই ইবনে হাজার উম্মে সালামা থেকে বর্ণনা করে : এক রাতে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যখন তার বাড়ীতে ছিল, তাঁর কন্যা ফাতিমা (সা. আ.) ও তাঁর সাথে আলী (আ.) প্রবেশ করেন। অতঃপর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন: "হে আলী, তুমি ও তোমার সাহাবাগণ বেহেশত্বাসী। তুমি ও তোমার শিয়ারা বেহেশতবাসী"। ৩- ইবনে আছির (মৃত্যু-৬০৬ হিজরি) বলেন: হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন : "হে আলী, তুমি আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হবে এমন অবস্থায় যে, তুমি ও তোমার শিয়ারা আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ তা'য়ালা তোমাদের উপর সন্তুষ্ট আর তোমার শত্রুরা উপস্থিত হবে রাগান্বিত এবং তাদের গর্দান ধরা হবে' এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর নিজ হাতে গর্দান ধরে দেখিয়ে দেন (ইবনে আছির, আননিহায়াহ, কামাহ ধাতুমূল)। অন্যান্য আরো হাদীস আছে যেখানে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-কে "আমাদের শিয়া' বলে সম্বোধন করেছেন। এবং এই ব্যাখ্যাটি পুর্বে উল্লেখিত সংজ্ঞাগুলির সাথে একমত, যেমন আমরা পূর্বে বলেছি শিয়া হচ্ছে তারাই যারা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর শিক্ষাদানের ফলে ইমাম আলী (আ.)-কে অনুসরণ করে, না আলী (আ.)-এর নিজ সিদ্ধান্তে। প্রকৃত অর্থে আলী (আ.)-এর শিয়া, অর্থাত্ত হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর শিয়া। উদাহরণ স্বরূপ, ইবনে আসাকির হযরত মুহাম্মাদ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছে যে : 'অবশ্যই বেহেশ্তে একটি ঝর্না আছে যা ফুলের মধুর থেকেও মিষ্টি, মাখনের থেকেও নরম, বরফের থেকেও ঠাণ্ডা এবং তার সুগন্ধ মেশকের থেকেও বেশি। ঐ ঝর্নার তলদেশে যে মাটি আছে তা থেকে আমি এবং আমার আহলে বাইত তৈরি হয়েছে আর আমাদের শিয়ারাও ঐ মাটির অংশ বিশেষ থেকে তৈরি হয়েছে' (তারিখে ইবনে আছাকির, খণ্ড-১, পৃ.-১৩১)। অন্যান্য অনেক হাদীস আছে যেখানে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আলী (আ.)-কে 'তোমার বংশধরের শিয়া' বলে সম্বোধন করেছেন। এই উক্তিটিও পূর্বের আলোচ্য বিষয়ের সমর্থক। কেননা পূর্বে আমরা বলেছি, শিয়া হচ্ছে ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারী এবং তার ইমামতের উপর বিশ্বাসীগণ। ঠিক যেরূপ আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে এই বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করব যে, শিয়া মাযহাবিগণ এই বিষয়ের উপর বিশ্বাসী যে, ইমাম আলী (আ.) হচ্ছেন প্রথম ইমাম এবং তারপর 'ইমামত বিষয়টি' হযরত ফাতিমা (সা. আ.) ও তাঁর বংশের থেকে আল্লাহ তা'য়ালা যাদেরকে মনোনীত এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) উপস্থাপন করেছেন, তাদের মধ্যে অব্যাহত থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ, যামাখশারি (মৃত্যু-৫২৮হিজরি ) তার নিজ গ্রন্থে 'রাবিউল আবরার' বলেন: হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন: 'হে আলী, যখন কিয়ামত দিবস আসবে, আমি আল্লাহ তা'য়ালার রহমত ও অনুগ্রহে আশ্রয় নেব এবং তুমি আমার প্রতি আশ্রয় নিবে, তোমার সন্তানরা তোমার প্রতি আর তাঁদের শিয়ারা (অনুসারীরা) তাদের কাছে আশ্রয় নিবে। ঐ সময় দেখবে যে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়' (সুবহানি, আল মিলালু ওয়াননিহাল, খণ্ড-৬, পৃ.-১০৪) আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মাদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মাদ ওয়া আজ্জিল‌ ফারাজাহুম নিবেদক মোঃ জাহিদ হোসেন

শিয়া অর্থ অনুসারী প্রথম পর্বে আরবি ভাষায় শিয়া শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, এক, দুই অথবা একদল অনুসারী। শিয়া শব্দটি কোরআন শরীফে কয়েকবার এই অর্থে ব্যবহার হয়েছে। উদাহরণস্বরুপ: আল্লাহ তা'য়ালা হযরত মুসা (আ.)-এর একজন অনুসারীকে তাঁর শিয়া বলেছেন (সূরা কিছাছ, আয়াত-১৫)। অন্যক্ষেত্রে হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে হযরত নুহ (আ.) এর শিয়া বলে পরিচয় দেয়া হয়েছে (সূরা ছাফ্ফাত, আয়াত-৩৭,৮৩)। ইসলামের প্রারম্ভে শিয়া শব্দটি প্রকৃত বা অভিধানিক অর্থে, বিভিন্ন ব্যক্তির অনুসারীগণকে বলা হত। যেমন, কিছু রেওয়ায়েতে আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর শিয়া এবং কিছু রেওয়ায়াতে মোয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের শিয়া বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু এই শব্দটি ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয় বা পারিভাষিক অর্থে পরিবর্তন হয় যার অর্থে শুধুমাত্র ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারীগণকে এবং যারা তার ইমামতের উপর বিশ্বাসী তাদেরকে শিয়া বলা হয়। শাহরেস্তানি (মৃত্যু-৫৪৮ হিজরি) আল মিলালু ওয়াননিহাল নামক গ্রন্থে যা বিভিন্ন দ্বীন ও মাযহাব সম্পর্কে লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র, এইরূপ বলেছেন: 'শিয়া হচ্ছে তারাই যারা ইমাম আলী (আ.)-কে বিশেষভাবে অনুসরণ করে এবং তার ইমামত ও খেলাফতকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ইচ্ছা এবং তারই শিক্ষাদানের ফল স্বরূপ বলে মনে করে (শাহরেস্তানি, আল মিলালু ওয়াননিহাল, খণ্ড-১,পৃ.-১৪৬)। এই সংজ্ঞাটি যথার্থ, কেননা শিয়ারা এই বিশ্বাসের উপর বিশ্বাসী যে হযরত আলী (আ.)-কে অনুসরণ করার কারণ হচ্ছে হযরত মোহম্মাদ (সা.)-এর আদেশ ও তারই ইচ্ছাস্বরূপ, না হযরত আলী (আ.)-এর নিজ ইচ্ছা, যেরূপ শিয়া ব্যতীত অনেকেই মনে করে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের দায়িত্ব জনগণের উপর অর্পণ করে গিয়েছেন এবং তার মৃত্যুর পর এমন ব্যক্তির অনুসরণ করেছে যাকে তারা নিজেরাই সকিফাতে নির্ধারণ করেছিল। অবশ্যই উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে আবু বকর ইবনে আবি কোহাফা যে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিল সে নিজে এই বিশ্বাসের উপর বিশ্বাসী ছিল যে অবশ্যই স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করতে হবে এবং উমর ইবনে খাত্তাবও ছয়জনের একটি পরামর্শ পরিষদ গঠন ও তার সমস্ত কর্মসূচী নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন, যাতে করে এই কমিটির মধ্যে থেকে একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসাবে নির্ধারণ করতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে আলী (আ.) চতুর্থ খলীফা ছিলেন এবং সমস্ত মুসালমানরা তাকে নির্বাচন করেছিল কিন্তু তিনি তৃতীয় খলীফা উছমান বিন আফ্ফানের মৃত্যুর পর, খেলাফত দায়িত্বকে বাধ্য হয়ে মেনে নেন। হাসান ইবনে মুসা নো'বাখতি (মৃত্যু-৩১৩ হিযরি) শিয়া মাযহাবের একজন বিখ্যাত গবেষক তার ফিরাকুশ শিয়া নামক গ্রন্থে এরুপ বলেন: শিয়া, ইমাম আলী (আ.)-এর দল ও গোষ্ঠী। তারা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জামানায় এবং তার পরেও শিয়া নামে পরিচিত ছিল এবং আলী (আ.)-এর অনুসারী ও তার ইমামতের উপর বিশ্বাসী । শেইখ মুফিদ (মৃত্যু-৪১৩ হিযরি) একজন বিখ্যাত আলেম, শিয়া শব্দের ব্যাখ্যাতে এরূপ বলেন: শিয়া হচ্ছে তারাই যারা ইমাম আলী (আ.)-কে অনুসরণ করে এবং তাঁকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অব্যবহিত পরে তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মেনে থাকে (মুফিদ, আওয়ায়েলুল মাকালাত, পৃ.-৩৬)। (শিয়া মাযহাবের অনুসারীদেরকে পরবর্তীতে ইমামিয়া বলা হত) শেইখ মুফিদ শিয়া মাযহাবের নামের পরিবর্তন ও ইমামিয়া বলার কারণে বলেন: এই সংজ্ঞাটি তাদের ক্ষেত্রে বলা হয় যারা ইমামতের প্রয়োজনীয়তা ও তা সব জামানাই (যুগেই) অব্যাহত থাকার এবং সুস্পষ্টভাবে ইমাম (আ.)-কে নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা, এছাড়াও তার নিষপাপত্ব ও পরিপূর্ণতার উপর ঈমান রাখে (মাছদার, পৃ.-৩৭)। এমতাবস্থায় বলতে পারি শিয়া মুসলমান বলতে তাদেরকে বোঝায় যারা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অসিয়ত ও তার স্থলাভিষিক্তের উপর এরূপ বিশ্বাস রাখে: ক)- হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্তির পদ একটি ঐশী পদ। খ)- যেরূপ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ তা"য়ালার পক্ষ থেকে মনোনীত হয়েছেন, সেইরূপ তার স্থলাভিষিক্তও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দ্বারা মানুষের মাঝে উপস্থাপিত হবে। গ)- ইমাম আলী (আ.), হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ঠিক পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত। আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা‌ মোহাম্মাদ দিন ওয়া আলে মোহাম্মাদ ওয়া আজ্জিল ফারাজাহুম নিবেদক মোঃ জাহিদ হোসেন