পোস্টগুলি

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ কেন ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি ?ইমাম হোসাইন (আ.) ৫০ হিজরি থেকে ৬১ হিজরি পর্যন্ত ১১ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১০ বছর মুয়াবিয়ার শাসনামলে অতিবাহিত হয়। ঐ সময় ধরে তার সঙ্গে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল। এ দ্বন্দ্বের কতগুলো নমুনা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিভিন্ন চিঠিতে লক্ষ্য করা যায়। ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর চিঠিতে মুয়াবিয়ার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডগুলো (যেমন আল্লাহর রাসূলের সাহাবী আমর ইবনে হামেক ও হুজর ইবনে আদীকে হত্যা) তুলে ধরে মুসলমানদের ওপর মুয়াবিয়ার শাসনকে ‘বড় ফিতনা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।(আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০; ইবনে আব্দুল বার বলেন, ইসলামের ইতিহাসে একজন মানুষের মাথা কেটে অন্য স্থানে প্রেরণের ঘটনা মুয়াবিয়ার দ্বারা সংঘটিত হয় যখন সে সাহাবী আমর ইবনে হামেকের মাথা কেটে তার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। আল ইসতিয়াব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭৪) আর এভাবে ইমাম হোসাইন (আ.),মুয়াবিয়ার খেলাফতের বৈধতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে জিহাদ করাকে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল মনে করতেন। এছাড়া তিনি মনে করতেন,যদি কেউ তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই ইস্তিগফার করতে (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে) হবে।(ইবনে কুতাইবা দিনওয়ারী, আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০) কিন্তু এরপরও ইমাম হোসাইন (আ.) কেন মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি তার কতগুলো কারণ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বক্তব্যে পাওয়া যায়। যদি আমরা ঐ কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই,তাহলে আমাদেরকে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করতে হবে।এক : মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তিইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার যে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল,ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার কাছে দেয়া চিঠিতে সেই সন্ধিচুক্তির প্রতি তাঁর নিবেদিত থাকার কথা বলে তাঁর বিরুদ্ধে তা লঙ্ঘন করার যে অভিযোগ মুয়াবিয়া তুলেছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।(মাওসুআতু কালিমাতি ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ২৩৯) কিন্তু প্রশ্ন হলো,মুয়াবিয়া যেখানে কুফায় প্রবেশ করার পর সন্ধিচুক্তির কালি শুকানোর আগেই তা লঙ্ঘন করেছিল এবং তার প্রতি নিবেদিত থাকা তার জন্য আবশ্যক নয় বলে ঘোষণা দিয়েছিল(আল-ইরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩৫৫)সেখানে কেন ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি মেনে চললেন?এ প্রশ্নের উত্তর কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া যেতে পারে :ক. যদি আমরা মুয়াবিয়ার বক্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে,সে সুস্পষ্টভাবে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘনের কথা বলেনি। কারণ,সে বলেছিল : ‘আমি হাসানকে কতগুলো বিষয়ের ওয়াদা দিয়েছি।’ আর হতে পারে সে যে ওয়াদার কথা বলেছে তা সন্ধিচুক্তির বহির্ভূত কোন বিষয় ছিল যার প্রতি নিবেদিত থাকা মুয়াবিয়ার মতে আবশ্যক ছিল না। আর অন্তত এর ভিত্তিতে সে অজুহাত দেখাত যে,তার পক্ষ থেকে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘিত হয়নি।খ. রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও ইমাম হোসাইন (আ.) এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ ছিল,ঠিক যে রকম তফাৎ ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার ছিল।আসলে মুয়াবিয়া এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিল,যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে কোন অন্যায়-অবিচার,(মুয়াবিয়ার মনোনীত শাসক ও সেনাপতিরা কোনপ্রকার অন্যায় ও হত্যা করতে দ্বিধা করত না। তার গভর্নর বুশর ইবনে আরতাত ইয়েমেনে প্রবেশ করে অসংখ্য মুসলমান নারীকে বন্দি করে বাজারে বিক্রি করে (আল ইসতিয়াব, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪০, সংখ্যা ১৭৫) এবং একযুদ্ধে শিশু-বৃদ্ধসহ ত্রিশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে (আলগারাত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৩৯)। মুয়াবিয়ার মনোনীত গভর্নরদের দ্বারা সংঘটিত হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের বীভৎস ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। দ্রষ্টব্য: তারিখে তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৭৭-৮১, কামিল ফিত তারিখ, ইবনে আছির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬২-১৬৭ ও ৪৫০, তারিখে ইবনে আসাকির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২২২ ও ৪৫৯; আলইসতিয়াব, পৃ. ৬৫-৬৬; তারিখে ইবনে কাসির, ৭ম খণ্ড, ৩১৯-৩২২; ওয়াফাউল ওয়াফা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৯৬) প্রতারণা ও ছল-চাতুরির আশ্রয় নিত। এসব প্রতারণার কতক নমুনা ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়েও দেখা যায়। যেমন উসমানের রক্তকে বাহানা হিসেবে তুলে ধরা,তালহা এবং যুবায়েরকে ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা,সিফফিনের যুদ্ধে বর্শার মাথায় কুরআন শরীফ তুলে ধরা এবং ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন শহরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা।অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক পবিত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন,যিনি স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সত্যের পরিপন্থী কোন পথে অগ্রসর হতেন না। যেভাবে ইমাম আলী (আ.) বলেছিলেন : ‘আমি জোর-জবরদস্তি করে বিজয়ী হতে চাই না।’(নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১২৬)অতএব,এটা স্বাভাবিক যে,ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে যে চুক্তি করেছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) কোনক্রমেই তা লঙ্ঘন করতে পারেন না। এমনকি মুয়াবিয়া তা লঙ্ঘন করলেও ইমামের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।গ. অবশ্যই আমাদেরকে ঐ সময়ের অবস্থা বিবেচনা করে দেখতে হবে। আর এটাও দেখতে হবে যে,ইমাম যদি সন্ধির খেলাফ কাজ করতেন তাহলে কী ঘটত? কারণ,ঐ সময় মুয়াবিয়া মুসলমানদের একচ্ছত্র খলীফা ছিল। আর তার শাসনব্যবস্থা সিরিয়া থেকে শুরু করে মিশর,ইরাক,আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেন তথা গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রতিটি এলাকাতে তার অনুচর ও দালালরা তার খেলাফতের বৈধতার পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতো। এহেন পরিস্থিতিতে ইমামের পক্ষে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না।মুয়াবিয়া,হযরত আলী (আ.)-এর সাথে দ্বন্দ্বের সময় সিরিয়াবাসীদের কাছে নিজেকে উসমান দরদী এবং তাঁর খুনের একমাত্র দাবিদার (প্রতিশোধ গ্রহণকারী) হিসেবে তুলে ধরেছিল। যদিও উসমান হত্যার ঘটনায় সে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে কোন সাহায্যই করেনি।(তারীখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০২) অতএব,এটা সুস্পষ্ট যে,ঐ সময় কেউ তার সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস করত না। এ পরিস্থিতিতে যদি ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করতেন,তাহলে মুয়াবিয়া তাঁকে মুসলিম সমাজে চুক্তি লঙ্ঘনকারী ও বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত করাতো এবং উম্মাহর চিন্তাধারাকে তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করাতো। আর ঐ পরিস্থিতিতে ইমামের আহ্বান মুসলিম জাতির কাছে পৌঁছত না। ইমাম এবং তাঁর সাথিরা এ সময় মুয়াবিয়াকে প্রথম সন্ধি লঙ্ঘনকারী হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু তাঁরা এতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।দুই. মুয়াবিয়ার শক্তিশালী অবস্থানঐ সময় মুয়াবিয়ার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিশেষ করে সিরিয়াবাসীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটাকে কঠিন করে তুলেছিল। কারণ,সিরিয়াবাসী তাকে নবীর সাহাবা,ওহী লেখক এবং ‘মুসলমানদের মামা’ মনে করত। তাদের দৃষ্টিতে,সিরিয়া ও দামেশকে ইসলাম প্রচারে মুয়াবিয়ার ভূমিকাই ছিল মূখ্য।এছাড়া মুয়াবিয়া একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ ছিল। আর তার বয়সও ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.) থেকে বেশি ছিল। এজন্য সে সবসময় ইমামদের কাছে দেয়া চিঠিতে এ দুটি বিষয় উল্লেখ করত এবং নিজেকে খেলাফতের জন্য বেশি উপযুক্ত মনে করত।(আবুল ফারাজ ইসফাহানী, মাকাতিলুত তালিবীয়ীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০। যেমন সে ইমাম হাসানকে একটি পত্রে লিখে : ...তুমি অবশ্যই জান যে, আমি দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব করছি। এ ক্ষেত্রে তোমার থেকে আমি অভিজ্ঞ এবং বয়সেও তোমার চেয়ে বড়।... তাই আমার আনুগত্যের ছায়ায় প্রবেশ কর) অতএব,এটা স্বাভাবিক যে,ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধি লঙ্ঘন করলে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগত।তিন. মুয়বিয়ার রাজনৈতিক কূটচাল ও ধূর্ততাসন্ধির পর যদিও মুয়াবিয়া বনি হাশেম,বিশেষ করে ইমাম আলী (আ.)-এর পরিবারকে কোণঠাসা করার জন্য সকল প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল,এমনকি বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান (আ.)-কে শহীদ করেছিল,(মাকাতিলুত তালিবীয়ীন, পৃ. ১ম খণ্ড, পৃ. ৮০; আল-ইরশাদ, পৃ. ৩৫৭) কিন্তু সে বাহ্যত মানুষদের দেখাত যে,নবী-বংশের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে,মুয়াবিয়া প্রতি বছর এবং প্রতি মাসে ইমাম হাসান (আ.),ইমাম হোসাইন (আ.) এবং আবদুল্লাহ বিন জাফরের জন্য প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন পাঠাত। আর তারাও যেহেতু নিজেদেরকে বায়তুল মালের হকদার মনে করতেন তাই ঐসব উপঢৌকন গ্রহণ করতেন এবং উপযুক্ত জায়গায় সেগুলো খরচ করতেন।(মাওসুআতু কালিমাতিল ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ২০৯ ও ২১০)মুয়াবিয়া নিজেকে নবীর পরিবারের ভক্ত হিসেবে দেখানোর জন্য মৃত্যুর সময়ে স্বীয় পুত্র ইয়াযীদকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে অসিয়ত করেছিল যে,যদি ইমাম আন্দোলন করেন তাহলে যেন তাঁকে হত্যা করা না হয়।(আল-আখবারুত তোয়াল, পৃ. ২২৭; তাজারিবুল উমাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯)মুয়াবিয়ার এ রকম রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট। কারণ,সে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সন্ধি করে নিজের খেলাফতকে বৈধতা না থাকার সংকট থেকে মুক্তি দান করে এবং মানুষের মাঝে নিজেকে বৈধ খলীফা হিসেবে পরিচিত করায়। আর সে চাইত না যে,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করার মাধ্যমে সে মুসলিম সমাজে ঘৃণিত হোক। এর বিপরীতে সে চেষ্টা করত যে,নবীপরিবারের প্রতি লোকদেখানো ভালোবাসা প্রদর্শন করার মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে নিজের সুনাম বজায় রাখা।আর সে ভাবত যে,এভাবে সে নবীর বংশধরদের নিজের প্রতি ঋণী করছে। ফলে তারা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে তার অনুগত হয়ে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকবে। একবার সে ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে বিপুল পরিমাণে উপঢৌকন পাঠিয়ে খোঁটা দিয়ে বলেছিল,‘এ উপহারগুলো গ্রহণ কর,আর জেনে রাখ যে,আমি হিন্দার ছেলে। খোদার শপথ,এর আগে কেউ তোমাদেরকে এ রকমভাবে দান করেনি। আর আমার পরেও কেউ তোমাদেরকে এভাবে দান করবে না।’ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়াকে দেয়া চিঠিতে তার উপঢৌকনগুলো যে করুণা প্রদর্শনের যোগ্যতা রাখে না তা উল্লেখ করে বলেছেন : ‘খোদার শপথ,তোমার আগের এবং পরের কোন লোকের পক্ষে আমাদের থেকেশ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত কোন ব্যক্তির কাছে উপহার পাঠানো সম্ভব নয় (কেননা,নবুওয়াতের গৃহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন গৃহ নেই)।’(তারীখে ইবনে আসাকির, তারজুমাতুল ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ৭, পাদটীকা ৫)মুয়াবিয়া জানত যে,সে যদি কঠোর নীতি গ্রহণ করে,তাহলে পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যাবে। পরিশেষে মানুষ মুয়াবিয়ার শাসনের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠবে। আর স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম সমাজ আহলে বাইতের পাশে একত্র হবে।ঐ সময়ে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ থেকে বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করত না। কিন্তু ভবিষ্যতে যেহেতু নবী-পরিবারের পক্ষ থেকে কোন বিপদ না আসতে পারে এজন্য এ রকম কলা-কৌশল অবলম্বন করে চলত যাতে অঙ্কুরেই বিপদের বীজ বিনাশ হয়ে যায়।অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার খেলাফতকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলার জন্য প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাতেন। এর সুস্পষ্ট নমুনা হলো মুয়াবিয়াকে লেখা চিঠিতে মুয়াবিয়ার সৃষ্ট বেদআত ও তার কৃত অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা(বিহারুল আনওয়ার, ৪৪ তম খণ্ড, পৃ. ২১২) এবং যুবরাজ হিসেবে ইয়াযীদের মনোনয়নের বিরোধিতা করা।(তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮; আল-ইমামাত ওয়াস সিয়াসাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৬) অবশ্য ইমাম হোসাইন (আ.) ভালো করেই জানতেন যে,যদি তিনি মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন,তাহলে সাধারণ মানুষ মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক কলা- কৌশলের কারণে তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিবে না। উপরন্তু সরকারি অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে মুয়াবিয়াকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করবে।চার. তৎকালীন সময়ের মুসলমানদের চিন্তাগত ও সামাজিক অবস্থাযদিও একদল কুফাবাসী ইমাম হাসান (আ.) শহীদ হওয়ার পর সমবেদনা জ্ঞাপন করে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে চিঠি লিখেছিল এবং নিজেদেরকে ইমামের নির্দেশের অপেক্ষাকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল(তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮),কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ভালোভাবেই জানতেন যে,সিরিয়ায় মুয়াবিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কুফা শহরও উমাইয়া গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছে। এছাড়া কুফাবাসী ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে অনেকবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। যখন সমগ্র ইসলামী ভূখণ্ডের ওপর মুয়াবিয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি বহাল হয়েছে তখন যদি তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তাহলে পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু ঘটবে না। আর যে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য তাঁর সাথে রয়েছে তারাও অযথা নিহত হবে এবং তিনি বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত হবেন। পরিশেষে তিনি কোন ফলাফল ছাড়াই শহীদ হবেন এবং তাঁর রক্ত বৃথা যাবে। কিন্তু ইয়াযীদের শাসনামলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ এর বিপরীত ছিল।(এ প্রবন্ধটি ‘আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)প্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কি

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ কেন ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি ?ইমাম হোসাইন (আ.) ৫০ হিজরি থেকে ৬১ হিজরি পর্যন্ত ১১ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১০ বছর মুয়াবিয়ার শাসনামলে অতিবাহিত হয়। ঐ সময় ধরে তার সঙ্গে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল। এ দ্বন্দ্বের কতগুলো নমুনা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিভিন্ন চিঠিতে লক্ষ্য করা যায়। ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর চিঠিতে মুয়াবিয়ার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডগুলো (যেমন আল্লাহর রাসূলের সাহাবী আমর ইবনে হামেক ও হুজর ইবনে আদীকে হত্যা) তুলে ধরে মুসলমানদের ওপর মুয়াবিয়ার শাসনকে ‘বড় ফিতনা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।(আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০; ইবনে আব্দুল বার বলেন, ইসলামের ইতিহাসে একজন মানুষের মাথা কেটে অন্য স্থানে প্রেরণের ঘটনা মুয়াবিয়ার দ্বারা সংঘটিত হয় যখন সে সাহাবী আমর ইবনে হামেকের মাথা কেটে তার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। আল ইসতিয়াব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭৪) আর এভাবে ইমাম হোসাইন (আ.),মুয়াবিয়ার খেলাফতের বৈধতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে জিহাদ করাকে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল মনে করতেন। এছাড়া তিনি মনে করতেন,যদি কেউ তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই ইস্তিগফার করতে (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে) হবে।(ইবনে কুতাইবা দিনওয়ারী, আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০) কিন্তু এরপরও ইমাম হোসাইন (আ.) কেন মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি তার কতগুলো কারণ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বক্তব্যে পাওয়া যায়। যদি আমরা ঐ কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই,তাহলে আমাদেরকে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করতে হবে।এক : মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তিইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার যে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল,ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার কাছে দেয়া চিঠিতে সেই সন্ধিচুক্তির প্রতি তাঁর নিবেদিত থাকার কথা বলে তাঁর বিরুদ্ধে তা লঙ্ঘন করার যে অভিযোগ মুয়াবিয়া তুলেছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।(মাওসুআতু কালিমাতি ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ২৩৯) কিন্তু প্রশ্ন হলো,মুয়াবিয়া যেখানে কুফায় প্রবেশ করার পর সন্ধিচুক্তির কালি শুকানোর আগেই তা লঙ্ঘন করেছিল এবং তার প্রতি নিবেদিত থাকা তার জন্য আবশ্যক নয় বলে ঘোষণা দিয়েছিল(আল-ইরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩৫৫)সেখানে কেন ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি মেনে চললেন?এ প্রশ্নের উত্তর কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া যেতে পারে :ক. যদি আমরা মুয়াবিয়ার বক্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে,সে সুস্পষ্টভাবে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘনের কথা বলেনি। কারণ,সে বলেছিল : ‘আমি হাসানকে কতগুলো বিষয়ের ওয়াদা দিয়েছি।’ আর হতে পারে সে যে ওয়াদার কথা বলেছে তা সন্ধিচুক্তির বহির্ভূত কোন বিষয় ছিল যার প্রতি নিবেদিত থাকা মুয়াবিয়ার মতে আবশ্যক ছিল না। আর অন্তত এর ভিত্তিতে সে অজুহাত দেখাত যে,তার পক্ষ থেকে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘিত হয়নি।খ. রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও ইমাম হোসাইন (আ.) এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ ছিল,ঠিক যে রকম তফাৎ ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার ছিল।আসলে মুয়াবিয়া এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিল,যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে কোন অন্যায়-অবিচার,(মুয়াবিয়ার মনোনীত শাসক ও সেনাপতিরা কোনপ্রকার অন্যায় ও হত্যা করতে দ্বিধা করত না। তার গভর্নর বুশর ইবনে আরতাত ইয়েমেনে প্রবেশ করে অসংখ্য মুসলমান নারীকে বন্দি করে বাজারে বিক্রি করে (আল ইসতিয়াব, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪০, সংখ্যা ১৭৫) এবং একযুদ্ধে শিশু-বৃদ্ধসহ ত্রিশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে (আলগারাত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৩৯)। মুয়াবিয়ার মনোনীত গভর্নরদের দ্বারা সংঘটিত হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের বীভৎস ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। দ্রষ্টব্য: তারিখে তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৭৭-৮১, কামিল ফিত তারিখ, ইবনে আছির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬২-১৬৭ ও ৪৫০, তারিখে ইবনে আসাকির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২২২ ও ৪৫৯; আলইসতিয়াব, পৃ. ৬৫-৬৬; তারিখে ইবনে কাসির, ৭ম খণ্ড, ৩১৯-৩২২; ওয়াফাউল ওয়াফা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৯৬) প্রতারণা ও ছল-চাতুরির আশ্রয় নিত। এসব প্রতারণার কতক নমুনা ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়েও দেখা যায়। যেমন উসমানের রক্তকে বাহানা হিসেবে তুলে ধরা,তালহা এবং যুবায়েরকে ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা,সিফফিনের যুদ্ধে বর্শার মাথায় কুরআন শরীফ তুলে ধরা এবং ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন শহরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা।অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক পবিত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন,যিনি স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সত্যের পরিপন্থী কোন পথে অগ্রসর হতেন না। যেভাবে ইমাম আলী (আ.) বলেছিলেন : ‘আমি জোর-জবরদস্তি করে বিজয়ী হতে চাই না।’(নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১২৬)অতএব,এটা স্বাভাবিক যে,ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে যে চুক্তি করেছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) কোনক্রমেই তা লঙ্ঘন করতে পারেন না। এমনকি মুয়াবিয়া তা লঙ্ঘন করলেও ইমামের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।গ. অবশ্যই আমাদেরকে ঐ সময়ের অবস্থা বিবেচনা করে দেখতে হবে। আর এটাও দেখতে হবে যে,ইমাম যদি সন্ধির খেলাফ কাজ করতেন তাহলে কী ঘটত? কারণ,ঐ সময় মুয়াবিয়া মুসলমানদের একচ্ছত্র খলীফা ছিল। আর তার শাসনব্যবস্থা সিরিয়া থেকে শুরু করে মিশর,ইরাক,আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেন তথা গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রতিটি এলাকাতে তার অনুচর ও দালালরা তার খেলাফতের বৈধতার পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতো। এহেন পরিস্থিতিতে ইমামের পক্ষে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না।মুয়াবিয়া,হযরত আলী (আ.)-এর সাথে দ্বন্দ্বের সময় সিরিয়াবাসীদের কাছে নিজেকে উসমান দরদী এবং তাঁর খুনের একমাত্র দাবিদার (প্রতিশোধ গ্রহণকারী) হিসেবে তুলে ধরেছিল। যদিও উসমান হত্যার ঘটনায় সে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে কোন সাহায্যই করেনি।(তারীখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০২) অতএব,এটা সুস্পষ্ট যে,ঐ সময় কেউ তার সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস করত না। এ পরিস্থিতিতে যদি ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করতেন,তাহলে মুয়াবিয়া তাঁকে মুসলিম সমাজে চুক্তি লঙ্ঘনকারী ও বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত করাতো এবং উম্মাহর চিন্তাধারাকে তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করাতো। আর ঐ পরিস্থিতিতে ইমামের আহ্বান মুসলিম জাতির কাছে পৌঁছত না। ইমাম এবং তাঁর সাথিরা এ সময় মুয়াবিয়াকে প্রথম সন্ধি লঙ্ঘনকারী হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু তাঁরা এতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।দুই. মুয়াবিয়ার শক্তিশালী অবস্থানঐ সময় মুয়াবিয়ার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিশেষ করে সিরিয়াবাসীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটাকে কঠিন করে তুলেছিল। কারণ,সিরিয়াবাসী তাকে নবীর সাহাবা,ওহী লেখক এবং ‘মুসলমানদের মামা’ মনে করত। তাদের দৃষ্টিতে,সিরিয়া ও দামেশকে ইসলাম প্রচারে মুয়াবিয়ার ভূমিকাই ছিল মূখ্য।এছাড়া মুয়াবিয়া একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ ছিল। আর তার বয়সও ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.) থেকে বেশি ছিল। এজন্য সে সবসময় ইমামদের কাছে দেয়া চিঠিতে এ দুটি বিষয় উল্লেখ করত এবং নিজেকে খেলাফতের জন্য বেশি উপযুক্ত মনে করত।(আবুল ফারাজ ইসফাহানী, মাকাতিলুত তালিবীয়ীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০। যেমন সে ইমাম হাসানকে একটি পত্রে লিখে : ...তুমি অবশ্যই জান যে, আমি দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব করছি। এ ক্ষেত্রে তোমার থেকে আমি অভিজ্ঞ এবং বয়সেও তোমার চেয়ে বড়।... তাই আমার আনুগত্যের ছায়ায় প্রবেশ কর) অতএব,এটা স্বাভাবিক যে,ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধি লঙ্ঘন করলে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগত।তিন. মুয়বিয়ার রাজনৈতিক কূটচাল ও ধূর্ততাসন্ধির পর যদিও মুয়াবিয়া বনি হাশেম,বিশেষ করে ইমাম আলী (আ.)-এর পরিবারকে কোণঠাসা করার জন্য সকল প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল,এমনকি বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান (আ.)-কে শহীদ করেছিল,(মাকাতিলুত তালিবীয়ীন, পৃ. ১ম খণ্ড, পৃ. ৮০; আল-ইরশাদ, পৃ. ৩৫৭) কিন্তু সে বাহ্যত মানুষদের দেখাত যে,নবী-বংশের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে,মুয়াবিয়া প্রতি বছর এবং প্রতি মাসে ইমাম হাসান (আ.),ইমাম হোসাইন (আ.) এবং আবদুল্লাহ বিন জাফরের জন্য প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন পাঠাত। আর তারাও যেহেতু নিজেদেরকে বায়তুল মালের হকদার মনে করতেন তাই ঐসব উপঢৌকন গ্রহণ করতেন এবং উপযুক্ত জায়গায় সেগুলো খরচ করতেন।(মাওসুআতু কালিমাতিল ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ২০৯ ও ২১০)মুয়াবিয়া নিজেকে নবীর পরিবারের ভক্ত হিসেবে দেখানোর জন্য মৃত্যুর সময়ে স্বীয় পুত্র ইয়াযীদকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে অসিয়ত করেছিল যে,যদি ইমাম আন্দোলন করেন তাহলে যেন তাঁকে হত্যা করা না হয়।(আল-আখবারুত তোয়াল, পৃ. ২২৭; তাজারিবুল উমাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯)মুয়াবিয়ার এ রকম রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট। কারণ,সে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সন্ধি করে নিজের খেলাফতকে বৈধতা না থাকার সংকট থেকে মুক্তি দান করে এবং মানুষের মাঝে নিজেকে বৈধ খলীফা হিসেবে পরিচিত করায়। আর সে চাইত না যে,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করার মাধ্যমে সে মুসলিম সমাজে ঘৃণিত হোক। এর বিপরীতে সে চেষ্টা করত যে,নবীপরিবারের প্রতি লোকদেখানো ভালোবাসা প্রদর্শন করার মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে নিজের সুনাম বজায় রাখা।আর সে ভাবত যে,এভাবে সে নবীর বংশধরদের নিজের প্রতি ঋণী করছে। ফলে তারা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে তার অনুগত হয়ে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকবে। একবার সে ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে বিপুল পরিমাণে উপঢৌকন পাঠিয়ে খোঁটা দিয়ে বলেছিল,‘এ উপহারগুলো গ্রহণ কর,আর জেনে রাখ যে,আমি হিন্দার ছেলে। খোদার শপথ,এর আগে কেউ তোমাদেরকে এ রকমভাবে দান করেনি। আর আমার পরেও কেউ তোমাদেরকে এভাবে দান করবে না।’ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়াকে দেয়া চিঠিতে তার উপঢৌকনগুলো যে করুণা প্রদর্শনের যোগ্যতা রাখে না তা উল্লেখ করে বলেছেন : ‘খোদার শপথ,তোমার আগের এবং পরের কোন লোকের পক্ষে আমাদের থেকেশ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত কোন ব্যক্তির কাছে উপহার পাঠানো সম্ভব নয় (কেননা,নবুওয়াতের গৃহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন গৃহ নেই)।’(তারীখে ইবনে আসাকির, তারজুমাতুল ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ৭, পাদটীকা ৫)মুয়াবিয়া জানত যে,সে যদি কঠোর নীতি গ্রহণ করে,তাহলে পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যাবে। পরিশেষে মানুষ মুয়াবিয়ার শাসনের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠবে। আর স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম সমাজ আহলে বাইতের পাশে একত্র হবে।ঐ সময়ে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ থেকে বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করত না। কিন্তু ভবিষ্যতে যেহেতু নবী-পরিবারের পক্ষ থেকে কোন বিপদ না আসতে পারে এজন্য এ রকম কলা-কৌশল অবলম্বন করে চলত যাতে অঙ্কুরেই বিপদের বীজ বিনাশ হয়ে যায়।অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার খেলাফতকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলার জন্য প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাতেন। এর সুস্পষ্ট নমুনা হলো মুয়াবিয়াকে লেখা চিঠিতে মুয়াবিয়ার সৃষ্ট বেদআত ও তার কৃত অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা(বিহারুল আনওয়ার, ৪৪ তম খণ্ড, পৃ. ২১২) এবং যুবরাজ হিসেবে ইয়াযীদের মনোনয়নের বিরোধিতা করা।(তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮; আল-ইমামাত ওয়াস সিয়াসাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৬) অবশ্য ইমাম হোসাইন (আ.) ভালো করেই জানতেন যে,যদি তিনি মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন,তাহলে সাধারণ মানুষ মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক কলা- কৌশলের কারণে তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিবে না। উপরন্তু সরকারি অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে মুয়াবিয়াকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করবে।চার. তৎকালীন সময়ের মুসলমানদের চিন্তাগত ও সামাজিক অবস্থাযদিও একদল কুফাবাসী ইমাম হাসান (আ.) শহীদ হওয়ার পর সমবেদনা জ্ঞাপন করে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে চিঠি লিখেছিল এবং নিজেদেরকে ইমামের নির্দেশের অপেক্ষাকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল(তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮),কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ভালোভাবেই জানতেন যে,সিরিয়ায় মুয়াবিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কুফা শহরও উমাইয়া গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছে। এছাড়া কুফাবাসী ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে অনেকবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। যখন সমগ্র ইসলামী ভূখণ্ডের ওপর মুয়াবিয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি বহাল হয়েছে তখন যদি তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তাহলে পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু ঘটবে না। আর যে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য তাঁর সাথে রয়েছে তারাও অযথা নিহত হবে এবং তিনি বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত হবেন। পরিশেষে তিনি কোন ফলাফল ছাড়াই শহীদ হবেন এবং তাঁর রক্ত বৃথা যাবে। কিন্তু ইয়াযীদের শাসনামলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ এর বিপরীত ছিল।(এ প্রবন্ধটি ‘আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)প্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কি

আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ হজরত মুসলিম ইবনে আকিল (আ.)এর সন্তানদ্বয়ের হত্যাকারির শেষ পরিণাম হজরত মুসলিম (আ.)এর ‍দুই সন্তান মোহাম্মাদ ও ইব্রাহিমের কবর কারবালা থেকে প্রায় ২৫ কি:মি: দূরে মুসাইয়েব নামক শহরে অবস্থিত। মরহুম সাদুক (রহ.) তিনি বর্ণনা করেছেন একটি মত অনুযায়ি আশুরার ঘটনার পরে হজরত মুসলিম (আ.)এর দুই সন্তানকে কুফায় সৈন্যরা তাদেরকে বন্দি করে ইবনে যিয়াদের কাছে নিয়ে আসে। তখন ইবনে যিয়াদ তাদেরকে কারাগারে কষ্টের মধ্যে রাখার নির্দেশ দেয়। কারাগারে সারা দিন রাতে তাদেরকে শুধুমাত্র দুই টুকরা যবের রুটি দেয়া হতো। একদিন তারা পরামর্শ করে যে কারা রক্ষিকে তাদের পরিচয় দিবে যেন তাদের খাবারের মাত্রাটা কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দেয়। যখন কারারক্ষি তাদের কাছে খাবার দেয়ার জন্য আসে তখন তারা বলে: হে কারারক্ষি তুমি কি মোহাম্মাদ (সা.) কে চিন? জাফর বিন আবি তালিবকে চিন? তখন কারারক্ষিরা তাঁদের প্রসংশা করে এবং যখন বাচ্চারা বলে যে আমরা হচ্ছি হজরত মুসলিমের সন্তান। তখন সে তাদেরকে আদর করে এবং তাদেরকে বলে আমি তোমাদের জন্য কারাগারের দরজা খুলে রাখছি তোমরা রাত হলে উক্ত পথ দিয়ে বাহির হয়ে যাবে রাতে পথ চলবে এবং দিনে নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখবে। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে এক রাতে তারা এক ‍বৃদ্ধার ঘরে আশ্রয় নেয় এবং তাকে নিজেদের পরিচয় দেয়। তখন উক্ত বৃদ্ধা তাদেরকে বলে: তোমরা এখান থেকে চলে যাও কেননা আমার জামাই হচ্ছে একজন অসৎ লোক সে কারবালাতে এজিদের পক্ষ নিয়ে ইমাম হুসাইন (আ.) এর বিরূদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা উক্ত বৃদ্ধাকে বলে: আমরা ঘরে এক কোণায় নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখব। অপর দিকে যখন ইবনে যিয়াদ হজরত মুসলিমের দুই সন্তানের পলায়ণের খবর শুনতে পায় তখন সে উক্ত কারারক্ষিকে হত্যা করে এবং হজরত মুসলিমের দুই সন্তানকে আটক করার জন্য দুই হাজার দিরহাম ঘোষণা দেয়। উক্ত ঘোষণাটি শোনার পরে বৃদ্ধার জামাই হারেস বিন উরওয়া বাচ্চা দুটিকে আটক করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। যখন সে ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। তখন বৃদ্ধা তাদেরকে অন্ধকারে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু যখন বাচ্চা দুটি ঘুমিয়ে পড়ে তাদের ঘুমের শব্দের কারণে হারেস বুঝতে পারে যে তাদের বাড়িতে আরো কেউ আছে যা সে জানে না। অবশেষে সে তাদেরকে খুঁজে বাহির করে এবং তাদের হাত পাকে বেধে রাখে। সকাল হলে সে তার দাশকে নির্দেশ দেয় সে যেন উক্ত সন্তান দুটিকে ফুরাতের কিনারায় নিয়ে যায় এবং তাদেরকে হত্যা করে। হারেসের দাশ তাদেরকে চিনতে পারে সে ফুরাত নদিতে ঝাপ দেয় এবং পালিয়ে যায়। তখন হারেস নিজেই তরবারি দ্বারা মুসলিমের বড় সন্তানকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। তখন তাঁরা হারেসকে মিনতি করে বলে আমাদেরকে হত্যা করো না। বরং আমাদেরকে দাশরূপে বিক্রয় করে দাও অথবা ইবনে যিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দাও হয়তো সে আমাদের প্রতি দয়ার দৃষ্টিতে দেখবে। যখন হারেস তাদের কথাকে মেনে নেয় তখন তারা হারেসকে বলে আমাদেরকে অনুমতি দাও যেন আমরা দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে পারি। নামাজান্তে হারেস মুসলিমের বড় সন্তান মোহাম্মাদকে তরবারির এক কোপে শহিদ করে তখন ইব্রাহিম ভাইয়ের রক্তে নিজেকে লুটিয়ে দেয় এবং বলে আমি চাই রক্ত মাখা অবস্থায় রাসুল (সা.) এর কাছে উপস্থিত হতে। হারেস তাকে বলে তুমি চিন্তা করো না আমি তোমাকে সেখানেই পাঠাবো যেখানে তুমি যেতে চাও। অতঃপর তরবারির আরেক কোপে সে ইব্রাহিমকেও শহিদ করে দেয় এবং তাদের কাটা মাথাকে ঘোড়ার পিঠে রাখা বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় এবং তাদের দেহকে ফুরাতের নদিতে ফেলে দেয়। সে পুরষ্কার পাওয়ার লোভে উক্ত মাথা দুটিকে নিয়ে ইবনে যিয়াদের দরবারে উপস্থিত হয়। ইবনে যিয়াদ হারেসের কাছে ঘটনাটি শোনার পরে বুঝতে পারে যে সে চাইলে ঐ বাচ্চাদেরকে ইবনে যিয়াদের কাছে উপস্থিত করতে পারতো। তখন ইবনে যিয়াদ তার সেনাদেরকে নির্দেশ দেয় তারা যেন হারেসকে উক্ত স্থানে নিয়ে যেয়ে যেখানে সে মুসলিমের দুই সন্তানকে হত্যা করেছিল এবং তাকে হত্যা করে। হারেসকে হত্যা করার পরে তার কাটা মাথাকে ইবনে যিয়াদের সামনে উপস্থিত করে। ইবনে যিয়াদ হারেসের মাথাকে কিছুক্ষণ অবলোকন করে অতঃপর কুফার বাচ্চাদের কাছে দিয়ে দেয় তারা হারেসের মাথাকে উদ্দেশ্যে করে পাথর নিক্ষেপ করে এবং বলতে থাকে হারেস রাসুল (সা.) এর বংশধরকে হত্যা করেছে।অন্য এক মত অনুযায়ি হজরত মুসলিম (আ.)এর বাচ্চারা কারবালাতে বন্দি হয় অথবা তার পিতার সাথে কুফাতে আসে। উক্ত বিষয়টি নিয়ে এতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।তবে যদি তারা কুফাতে বন্দিরূপে থাকতো তাহলে অবশ্যই ইবনে যিয়াদ তাদেরকে কারবালার বন্দিদের সাথে শামে প্রেরণ করতো। যেহেতু তারা তাদের পিতার সাথে কুফায় এসেছিল সেহেতু ইতিহাসের কোথাও এজিদের দরবারে অথবা শামের কারাগারে হজরত মুসলিম (আ.)এর দুই সন্তানের কথা উল্লেখিত হয়নি। সুতরাং এটাই প্রমাণিত হয় যে হজরত মুসলিম (আ.) এর দুই সন্তান তার সাথেই ছিল এবং কুফাতেই তাদেরকে শহিদ করা হয়।সূত্র: আমালি শেইখ সাদুক (রহপ্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কি

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ ইমামত নবুওয়াতের নির্বাহী ক্ষমতার ধারাবাহিকতা মহানবী ‎(সা.) ‏নবুয়্যত, ‏রিসালাত এবং ইসলামের আহকাম প্রচার ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছাড়াও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দয়িত্বে ও নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকার্য ও সামরিক নেতৃত্ব ইত্যাদি এ থেকেই উৎকলিত হত। যেমনিকরে ইসলামে ইবাদত ও আচরণগত দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক, ‏অর্থনৈতিক ও অধিকারগত ইত্যাদি কর্তব্যও বিদ্যমান, ‏তেমনি করে ইসলামের নবী ‎(সা.) ‏প্রচার, ‏প্রশিক্ষণ ও ‎(আধ্যাত্মিক) ‏পরিচর্যার দায়িত্ব ছাড়াও মহান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে ঐশী বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সকল প্রকার প্রশাসনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।এটা অনস্বীকার্য যে, ‏যদি কোন দ্বীন বিশ্বের শেষাবধি সকল প্রকার সামাজিক কর্তব্য পালনের দাবি করে তবে এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। অনুরূপ যে সমাজ এ দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, ‏সে সমাজ এ ধরনের কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তব্য থেকে নিরুদ্দিষ্ট থাকবে, ‏যা ইমামত নামে অভিষিক্ত, ‏তাও হতে পারে না।কিন্তু কথা হল মহানবী ‎(সা.) ‏এর তিরোধানের পর, ‏কে এ দায়িত্ব লাভ করবেন? ‏এবং তা কার কাছ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবেন? ‏মহান আল্লাহ্‌ ‏এ মর্যাদা যেরূপে মহানবীকে ‎(সা.) ‏দিয়েছিলেন সেরূপে অন্য কাউকেও কি দিয়েছেন? ‏এ দায়িত্বভার অন্য কারও গ্রহণের কোন বৈধতা রয়েছে কি? ‏নাকি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এ মর্যাদা মহানবী ‎(সা.)-এর জন্যেই নির্ধারিত ছিল এবং অতঃপর মুসলিম জনতাই তাদের ইমাম নির্বাচন করবে ও তাকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্থান দিবে, ‏তা-ও বিধিসম্মত? ‏মানুষের কি এ ধরনের কোন অধিকার আছে? ‏না নেই?আর এটিই হল শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয়। অর্থাৎ একদিকে শিয়াদের বিশ্বাস যে ইমামত হল একটি ঐশী মর্যাদা, ‏যা মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃকই যথোপযুক্ত ও যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা আবশ্যক। আর মহান আল্লাহ্‌, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏এর মাধ্যমে এ কর্মটি সম্পাদন করেছেন এবং আমীরুল মু’মীনিন আলীকে ‎(আ.) ‏তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষনা করেছেন। অতঃপর তাঁরই সন্তানদের মধ্য থেকে পরস্পরায় বারজনকে ইমামতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করছেন। অপরদিকে সুন্নি মাযহাবের বিশ্বাস নবী ‎(সা.)-এর তিরোধানের মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগতের সাথে মানুষের সম্পর্ক কর্তিত হয়ে গেছে এবং মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় পৌঁছেছে। এখন তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে কোরআনকে বুঝতে ও তাদের পথকে চিনে নিতে পারে। তাই তাদের পথপ্রদর্শনের জন্য ঐশী কোন ব্যক্তির আর প্রয়োজন নাই। আর নবী ‎(সা.) ‏এর পর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্বও তাদের উপরই অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি আহলে সুন্নাতের কোন কোন বিজ্ঞজন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ‏যদি কেউ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, ‏তবে তার আনুগত্য করাও অন্যান্যদের জন্যে অপরিহার্য!১ স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, ‏এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী, ‏অত্যাচারী ও প্রতারকদের অপরাধের জন্যে কতটা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের অবক্ষয় ও বিভেদের পথে কতটা সহায়ক হয়েছে!প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ঐশী সস্পর্কহীন ইমামতের বৈধতা দিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর শিয়া মাযহাবের বিশ্বাস, ‏এটিই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সত্য সুন্দর পথ থেকে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুতির মূল কারণ। অনুরূপ শতসহস্র ধরনের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার সূতিকাগারও এখানেই, ‏যেগুলো মহানবী ‎(সা.) ‏এর পরলোক গমনের পর থেকে মুসলমানদের মাঝে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং করবে।অতএব প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই কোন প্রকার অন্ধ অনুকরণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যতিরেকে এ বিষয়টির উপর পরিপূর্ণ গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য।২ আর সেই সাথে সত্য ও সঠিক মাযহাবের শনাক্তকরণের মাধ্যমে এর প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।উল্লেখ্য এ ব্যাপোরে ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রুদের জন্যে সুযোগ করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না যা ইসলামী সমাজে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হবে। আর এ ক্ষতির অংশীদার মুসলমানরাই হবে, ‏যার ফলশ্রুতি মুসলিম সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা বৃদ্ধি ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য সংরক্ষণ যেন, ‏সঠিক ও সত্য মাযহাবের অনুসন্ধান ও শনাক্তকরণের জন্যে, ‏অনুসন্ধান ও গবেষণার সুষ্ঠ পথকে রুদ্ধ না করে ফেলে। আর ইমামতের বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুষ্ঠ পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‏এ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধানের উপর মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে।ইমামতের তাৎপর্যইমামতের আভিধানিক অর্থ হল নেতা, ‏পথপ্রদর্শক এবং যে কেউ কোন জনসমষ্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহন করবে তাকেই ইমাম ‎(امام) ‏বলা হয়ে থাকে ‎-হোক সে সত্য পথের অনুসারী কিংবা মিথ্যা পথের অনুসারী। যেমন: ‏পবিত্র কোরানে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে ‎(ائمة الكفر) ‏অর্থাৎ কাফেরদের নেতারা ‎(সূরা তওবাহ-১২) ‏কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তদনুরূপ মুসুল্লীরা নামাজের জন্যে যার পিছনে সমবেত হয়ে থাকেন, ‏তাকে ‎‘ইমামুল জামা’ত’ ‏নামকরণ করা হয়।কিন্তু কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ইমামত হল ইহ ও পরলৌকিক সকল বিষয়ে ইসলামী সমাজের সর্বময় ও বিস্তৃত নেতৃত্ব প্রদান। ইহলৌকিক শব্দটি ইমামতের পরিসীমার ব্যাপকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা ইসলামী সমাজে ইহলৌকিক বিষয়াদিও দ্বীন ইসলামেরই অন্তর্ভুক্ত।শিয়া মাযহাবের মতে এ ধরনের নেতৃত্ব কেবলমাত্র তখনই বৈধ হবে, ‏যখন তা মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অনুমোদিত হবে। আর প্রকৃতপক্ষে যিনি এ মর্যাদার অধিকারী হবেন, ‏তিনি আহকাম ও ইসলাম পরিচিতির বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত থাকবেন। অনুরূপ তিনি সকল প্রকার গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবেন। বস্তুতঃ পবিত্র ইমাম, ‏একমাত্র নবুয়্যত ও রিসালাত ব্যতীত মহানবীকে ‎(সা.), ‏মহান আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত সকল মর্যাদার অধিকারী হবেন। ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য যেমন নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য, ‏তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়েও তাঁর আদেশ পালন করাও অপরিহার্য।এভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে।দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।তৃতীয়তঃ ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে।তবে মা’সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও ‎(সালামুল্লাহ আলাইহা) ‏মা’সুম ছিলেন, ‏যদিও তিনি ইমামতের অধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম ‎(আ.) ‏ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহ্‌র ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, ‏যদিও আমরা তাঁদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা’সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাঁদেরকে চিনা সম্ভব নয়।একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনাবিশ্বাসগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন না এমন অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে, ‏শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামত প্রসঙ্গে বিরোধ এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে শিয়াদের বিশ্বাস হলঃ মহানবী ‎(সা.) ‘আলী ইবনে আবি তালিবকে’ (আ.) ‏ইসলামী সমাজের পরিচালনার জন্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস যে, ‏এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং রাসূল ‎(সা.) ‏উম্মতকে কোন নেতা মনোনীত করা ছাড়াই ত্যাগ করেছিলেন। আর তাই তাঁর মৃত্যুর পর জনগণ নিজেদের পছন্দ মত প্রথম খলিফাকে নেতা নির্বাচন করেছিল। প্রথম খলিফা যদিও নিজে জনগণ কর্তৃক নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীকে নিজেই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব ছয় সদস্য বিশিষ্ট গোষ্ঠীর নিকট অর্পণ করা হয়েছিল। অপরদিকে চতুর্থ খলিফাও আবার প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন পন্থা ছিল না। ফলে চতুর্থ খলিফার পর যার সামরিক শক্তি অধিক ছিল, ‏সে-ই এ স্থান দখল করেছিল, ‏যেমন: ‏অনৈসলামিক দেশসমূহেও মোটামুটি এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।অন্যকথায়ঃ তারা এ রকম মনে করেন যে, ‏প্রথম ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শীয়াদের বিশ্বাস সেরূপ, ‏যেরূপ আহলে সুন্নাত প্রথম খলিফা কর্তৃক দ্বিতীয় খলিফার নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেন, ‏পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏এর বক্তব্য মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, ‏কিন্তু প্রথম খলিফার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল!কিন্তু প্রশ্ন হল, ‏প্রথম খলিফা এ অধিকার কোথা থেকে পেয়েছিলেন? ‏আল্লাহ্‌র রাসূল ‎(সা.) (আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস মতে) ‏ইসলামের জন্যে কেন তার ‎(প্রথম খলিফা) ‏মত আন্তরিকতা প্রদর্শন করেননি এবং নব গঠিত ইসলামী সমাজকে অভিভাবকহীন অবস্থায় রেখে গেলেন অথচ যুদ্ধের জন্যে মদীনা থেকে অন্যত্র যাওয়ার সময়ও একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এবং যেখানে স্বয়ং তিনিই ‎(এ বিষয়ের উপর) ‏তাঁর উম্মতদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তির সংবাদ দিয়েছিলেন? ‏এছাড়া ও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ‏শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূলতঃ মতবিরোধ সর্বাগ্রে এখানেই যে, ‏ইমামত কি এক ধর্মীয় মর্যাদা, ‏যা ঐশী বিধানের অনুগামী ও আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়? ‏নাকি পার্থিব রাজকীয় বা অন্য কোন পদ মর্যাদা, ‏যা সামাজিক নীতিমালার অনুগামী? ‏শিয়াদের বিশ্বাস যে, ‏স্বয়ং মহানবীও ‎(সা.) ‏নিজ থেকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেননি। বরং মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক আদিষ্ট হয়েই এ কর্ম সম্পাদন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন পবিত্র ইমামগণের নিয়োগদানের সাথে সস্পর্কযুক্ত। আর এ ধরনের ইমামের উপস্থিতিতেই রাসূল ‎(সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী সমাজের অপরিহার্য বিষয়াদির নিশ্চয়তা প্রদান করা যেতে পারে।এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ‏কেন শিয়া মাযহাবের মতে ইমামত ‎‘মূল বিশ্বাসগত’ ‏বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয় ‎-শুধুমাত্র একটি ফিকাহ্‌গত গৌণ বিষয় নয়। আর সেই সাথে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ‏কেন তারা তিনটি শর্ত ‎(ঐশী জ্ঞান, ‏ইসমাত ও আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) ‏বিবেচ্য বলে মনে করেন এবং কেন শিয়া সাধারণের মধ্যে এ ভাবার্থগুলো ঐশী আহকাম, ‏প্রশাসন ও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃত্বের ধারনার সাথে এমনভাবে মিশে আছে, ‏যেন ইমামত শব্দটি এ ভাবার্থগুলোর সবগুলোকেই সমন্বিত করে।এখন শিয়াদের সামগ্রিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, ‏ইমামতের তাৎপর্য ও মর্যাদার আলোকে এর বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা করব।ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তাআমরা জানি খতমে নবুওয়াতের দর্শন হল এই যে, ‏ইসলাম হল পবিত্র, ‏চিরন্তন, ‏সার্বজনীন ও অবিস্মৃত ধর্ম এবং ইসলামের নবী ‎(সা.)-এর পর আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না। নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন, ‏তখনই কেবলমাত্র নবীগণের আবির্ভাবের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে, ‏যখন সর্বশেষ ঐশী শরীয়ত মানব মাযহাবের সকল প্রশ্নের জবাব প্রদানে সক্ষম হবে এবং বিশ্বের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এ শরীয়তের অটুট থাকার নিশ্চয়তা থাকবে।উল্লেখিত নিশ্চয়তা পবিত্র কোরআনে রয়েছে এবং মহান আল্লাহ্‌ ‏স্বয়ং সকল প্রকার বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে প্রিয় গ্রন্থের সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের সকল বিধি-বিধান কোরানের আয়াতের বাহ্যিক যুক্তি থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন: ‏নামাযের রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি এবং আবশ্যকীয় ও অনাবশ্যকীয় এমন অসংখ্য বিধান রয়েছে, ‏যেগুলোকে পবিত্র কোরান থেকে উদঘাটন করা অসম্ভব। সাধারণতঃ পবিত্র কোরানে আহকাম ও কানুন বিশদভাবে বর্ণিত হয়নি। ফলে এগুলোর প্রশিক্ষণ ও সুস্পষ্ট বর্ণনার দায়িত্ব মহানবী ‎(সা.)-এর উপর অর্পণ করা হয়েছে, ‏যাতে তিনি মহান আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত জ্ঞানের ‎(কোরআনের ওহী ব্যতীত) ‏মাধ্যমে ঐগুলোকে মানুষের জন্যে বর্ণনা করেন।৩ আর এভাবে ইসলাম পরিচিতির প্রকৃত উৎস হিসেবে তাঁর সুন্নাহ বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।কিন্তু হযরত ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের প্রচার কর্ম শুরুর পর দশ বছর ধরে নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে ছিলেন, ‏অতঃপর আবি তালিবের উপত্যকায় কয়েক বছরের বন্দীদশা কাটিয়েছেন, ‏মদীনায় হিজরতের পর শত্রুদের সাথে দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ ইত্যাদির মত জীবনের সংকটময় মুহূর্তগুলো সাধারণ মানুষের জন্যে ইসলামের বিভিন্ন আহ‌কাম, ‏বর্ণনার পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। অপর দিকে সাহাবাগণ যা শিখতেন তা সংরক্ষিত থাকারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এমন কি অজু করার প্রক্রিয়া যা তেইশ বছর ধরে সাহাবাদের চোখের সামনে সম্পাদিত হয়েছে তাও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতএব যেখানে এ সুস্পষ্ট বিষয়টি ‎(যা মুসলমানদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বা আছে এবং এর পরিবর্তন ও বিকৃতির মধ্যে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য জড়িত ছিল না) ‏বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, ‏সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ও গোত্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জটিল ও সূক্ষ্ম নিয়মসমূহের বর্ণনার ক্ষেত্রে বিকৃতি ও ভ্রান্তির সম্ভাবনা অবশ্যই অধিকতর।৪এ বিষয়টির আলোকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ‏ইসলাম ধর্ম কেবলমাত্র তখনই এক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে পৃথিবীর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত মানুষের সকল প্রয়োজন ও প্রশ্নের জবাবদানে সক্ষম হবে যখন দ্বীনের মূলভাষ্যে, ‏সমাজের এ সকল কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধিত হবে, ‏যেগুলো মহানবী ‎(সা.)-এর ইন্তেকালের পর সংকট ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আর এ নিশ্চয়তা বিধানের পথ মহানবী ‎(সা.)-এর যোগ্য উত্তরসুরি নির্বাচন ব্যতীত কিছুই নয়। এ উত্তরসুরিকে একদিকে যেমন ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে, ‏যাতে দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন। অপরদিকে তেমনি দৃঢ়রূপে পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে,যাতে কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানী প্ররোচনায় প্রভাবিত না হন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীনের বিকৃতিতে লিপ্ত না হন। অনুরূপ মানব জাতির আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে মহানবী ‎(সা.)-এর দায়িত্ব স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিয়ে, ‏উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে পৌঁছে দিতেও তাঁরা বদ্ধপরিকর। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে সমাজের শাসন, ‏পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা, ‏বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তাঁরা গ্রহণ করে থাকেন।উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ‏নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি কেবলমাত্র তখনই প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে, ‏যখন এমন পবিত্র ইমামগণকে নিয়োগ করা হবে, ‏যাঁরা একমাত্র নবুয়্যত ব্যতীত মহানবী ‎(সা.)-এর সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন।আর এভাবেই একদিকে যেমন সমাজে ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হয়, ‏অপরদিকে তেমনি তাঁদের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্র মর্যাদাও। অনুরূপ মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন এ ধরনের জ্ঞান ও মর্যাদা কাকে দিয়েছেন এবং তিনিই বস্তুতঃ তাঁর বান্দাগণের উপর বিলায়াত ও কর্তৃত্বের অধিকার রাখেন। আর তিনিই এর অধিকার অপেক্ষাকৃত হ্রাসকৃত মাত্রায় উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে প্রদান করতে সক্ষম।এখানে স্মরণযোগ্য যে, ‏আহলে সুন্নাত কোন খলিফার ক্ষেত্রেই উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিকেই স্বীকার করেন না। মহান আল্লাহ্‌ ‏ও রাসূলের ‎(সা.) ‏পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়ার দাবি যেমন তারা তুলেন না, ‏তেমনি খলিফাগণের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রসঙ্গও তুলেন না। বরং মানুষের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দানের ক্ষেত্রে তাদের অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি ও অযোগ্যতার দৃষ্টান্ত তারা তাদের বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহে তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ প্রথম খলিফা প্রসঙ্গে ইবনে কুতাইবা রচিত ‎‘আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ’ ‏গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, ‏তিনি বলেছিলেন:«انّ لي شيطانا يعتريني»‘আমার পশ্চাতে এমন এক শয়তান বিদ্যমান যে আমাকে বিভ্রান্ত করে।’অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‏তিনি প্রথম খলিফার আনুগত্য স্বীকারকে ‎‘فلته’ ‏অর্থাৎ অবিলম্বকর্ম ও অবিবেচনাপূর্ণ কর্ম নামকরণ করেছেন।৫ অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা অসংখ্যবার এ বাক্যটি স্বীয় কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন:«لولاعليّ لهلك عمر»‘যদি আলী না থাকতেন, ‏তবে আমি ওমর ধ্বংস হয়ে যেতাম।’অর্থাৎ যদি আলী ‎(আ.) ‏না থাকতেন তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেতেন।৬ এছাড়া তৃতীয় খলিফা৭ এবং বনি উমাইয়্যা ও বনি আব্বাসের ভুল-ভ্রান্তির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখেনা। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে কেউ ন্যূনতম ধারণা নিলেই এ সম্পর্কে উত্তমরূপে পরিজ্ঞাত হতে পারবেন।একমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ই দ্বাদশ ইমামের ক্ষেত্রে এ শর্তত্রয়ে বিশ্বাসী। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইমামত প্রসঙ্গে তাদের বিশ্বাসের বৈধতা প্রমাণিত হয়। ‎#আল-বাসাইরমূল: ‏আয়াতুল্লাহ্‌ ‏মিসবাহ্‌ ‏ইয়াজদির অমুজেশে আকায়েদ গ্রন্থঅনুবাদ: ‏মোহাম্মাদ মাঈনুদ্দীনসঙ্কলন ও সম্পাদন: ‏আবুল কাসেমতথ্যসূত্র১. ‏আল আহ্‌কামুল সোলতানিয়াহ্‌, ‏লিখেছেন আবু ইয়ালা এবং ‎‘আস সাওয়াদুল আ’যাম’ ‏লিখেছেন আবুল কাশিম সামারক্বান্দি, ‏পৃঃ ৪০-৪২।২. ‏সৌভাগ্যবশতঃ বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ের উপর একাধিক ভাষায় ও একাধিক পদ্ধতিতে শতসহস্র গ্রন্থ রচনা করে সত্যানুসন্ধিৎসুগণের জন্যে গবেষণার পথকে বিস্তৃত করেছেন। উদাহরণতঃ আবাক্বাতুল আনওয়ার, ‏আল গাদির, ‏দালায়িলুস সিদক্ব, ‏গায়াতুল মারাম এবং ইসবাতুল হুদাহ ইত্যাদি গ্রন্থের নাম উল্লেখ যোগ্য।যারা পড়াশুনার যথেষ্ট সুযোগ পান না তারা ‎‘আল মুরাজিয়াত’ ‏নামক একটি বই, ‏যা শিয়া ও সুন্নী দু’জন মনীষীর মধ্যে বিনিময়কৃত পত্রসমূহের সমাহার, ‏তা পড়তে পারেন। সৌভাগ্যবশতঃ বইটি বাংলায় অনুদিত করা হয়েছে।৩. ‏বাকারাঃ ১৫১, ‏আলে-ইমরান-১৬৪, ‏জুমুআ’-২, ‏নাহল ‎-৬৪, ‏৬৪, ‏আহযাব- ‏২১, ‏হাশর ‎-৭।৪. ‏আল্লামা আমিনি ‎(র.) ‏সাতশতজন মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীর নাম তার ‎"আল গাদীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক লক্ষেরও অধিক হাদীসের বর্ণনাকারী রয়েছে ‎(আল গাদীর, ‏খণ্ড-৫ পৃঃ-২০৮)।৫. ‏শারহে নাহজুল বালাগাহ ‎: ‏ইবনে আবিল হাদিদ, ‏খণ্ড- ‏১, ‏পৃষ্ঠা-৮৫ খণ্ড-৪, ‏পৃঃ-২৩১-২৬২, ‏এবং আল গাদীর ‎: ‏খণ্ড ‎-৭, ‏পৃঃ-১০২-১৮০।৬. ‏ইবনে আবদুল বার, ‏আলইসতিয়াব, ‏৩য় খণ্ড, ‏পৃ.১১০৩; ‏শারহে নাহজুল বালাগাহ ‎: ‏খণ্ড ‎-১, ‏পৃঃ-১৪২-১৫৮ ‎, ‏খণ্ড-৩, ‏পৃঃ-৫৭।৭. ‏আল গাদীর ‎: ‏খণ্ড ‎- ‏৬, ‏পৃঃ ‎-৯৩ ও পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো।প্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কি

আখলাক ‎( ‏সদাচরণ এবং চরিত্র ‎)সদাচরণ এবং নৈতিক চরিত্র ও আদর্শ ‎( ‏আখলাক ‎) ‏সংক্রান্ত ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) - ‏এর কিছু অমিয় বাণীঃ ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলনঃ নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর রাহে যুদ্ধে গমনকারী মুজাহিদকে যে সওয়াব ও পূ্ণ্য দেন ঠিক সেটার ন্যায় তিনি বান্দাকে সদাচরণ অবলম্বন করার জন্য সওয়াব ও পূণ্য দেবেন । ‎( ‏দ্রঃ আল-কাফী ‎, ‏খঃ ২ ‎, ‏পৃঃ ১০১ ‎, ‏হাদীস নং ১২ ‎)قال الصّادق ( ع ) : إِنَّ اللهَ تَبَارَکَ وَ تَعَالَی لَيُعطِيَ العَبدَ مِنَ الثَّوَابِ عَلَی حُسنِ الخُلقِ کَمَا يُعطِي المُجَاهِدَ فِي سَبِيلِ اللهِ يَغدُو وَ يَرُوحُ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে ফরযসমুহ আঞ্জাম দেয়ার পর বান্দার যে আমলটি মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় তা হচ্ছে মানুষের সাথে তার ‎( ‏ঐ বান্দার ‎) ‏সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার । ‎( ‏দ্রঃ প্রাগুক্ত ‎, ‏পৃঃ ১০০ ‎, ‏হাদীস নং ৬ ‎)قال الصّادق ( ع ) : مَا يَقدِمُ المُؤمِنُ عَلَی الله بِعَمَلٍ بَعدَ الفَرَائِضِ أَحَبَّ إِلَی اللهِ تَعَالَی مِن أَن يَسَعَ النَّاسَ بِخُلقِهِ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ মহান আল্লাহ যে সব বিষয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ‎( ‏সাঃ ‎)কে সম্বোধন করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে ছিল তাঁর এ বাণী বা আয়াতঃ হে মুহাম্মাদ ‎, ‏নিশ্চয়ই আপনি এক অতিমহান ‎( ‏উত্তম ‎) ‏চারিত্রিক নীতি ও আদর্শের উপর আছেন । তিনি ‎( ‏ইমাম সাদিক আঃ ‎) ‏বলেনঃ এই অতিমহান ‎( ‏উত্তম ‎) ‏চারিত্রিক নীতি ও আদর্শ হচ্ছে দানশীলতা ‎( ‏বদান্যতা ‎/ ‏মহত্ত্বالسَّخَاءُ ) ‏এবং সদাচারণ ও সদ্ব্যবহার ‎( حُسنُ الخُلقِ)) ( ‏দ্রঃ তাফসীর নূরুস সাকালাইন ‎, ‏খঃ ৫ ‎, ‏পৃঃ ৩৯১ ‎, ‏হাদীস নং ২৩ ‎) قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : کَانَ فِيمَا خَاطَبَ اللهُ تَعَالَی نَبِيَّهُ ( ص ) أَن قَالَ لَهُ : يَا مُحَمَّدُ (( إِنّکَ لَعَلَی خُلقٍ عَطِيمٍ )) قَالَ : السَّخَاءُ وَ حُسنُ الخُلقِ . ‏সদাচরণ ও সদ্ব্যবহারের ‎( ‏ভালো স্বভাব ও চরিত্র ‎) ‏সীমা পরিসীমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ ‎(সদাচরণ ও সদ্ব্যবহারের সীমা পরিসীমা হচ্ছে এই যে ‎) ‏স্বীয় পার্শ্বদেশ অর্থাৎ হস্তদ্বয় বিনয়াবনত ও নমনীয় করবে ‎( ‏তুমি নম্র ও ভদ্র হবে ‎) , ‏মুখের ভাষাকে মিষ্টি মধুর ও মার্জিত ‎( ‏পবিত্র ‎) ‏করবে ‎( ‏ভালো ও সুন্দর কথা বলবে ‎) ‏এবং স্বীয় দ্বীনী ভাইয়ের সাথে সহাস্য বদনে ও প্রফুল্ল চিত্তে সাক্ষাৎ করবে । ‎( ‏দ্রঃ মাআনিল আখবার ‎, ‏পৃঃ ২৫৩ ‎, ‏হাদীস নং ১ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : - لَمَّا سُئِلَ عَن حَدِّ حُسنِ الخُلقِ - : تُلِينُ جَانِبَکَ ، وَ تُطَيِّبُ کَلَامَکَ ، وَ تَلقَی أَخَاکَ بِبِشرٍ حَسَنٍ .উত্তম নৈতিক চরিত্রের ‎( مَکَارِمُ الأَخلَاقِ ) ‏ব্যখ্যা প্রসঙ্গেঃ ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ মহান আল্লাহ মহানবী ‎( ‏সাঃ ‎)কে উত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী করেছিলেন । অতঃপর তোমরা নিজেদেরকে পরীক্ষা কর ‎, ‏যদি তোমাদের মাঝে উত্তম নৈতিক চরিত্র ‎( ‏মাকারিমুল আখলাক ‎) ‏বিদ্যমান থাকে তাহলে এরজন্য মহান আল্লাহর প্রশংসা কর এবং তাঁর কাছে তা আরও বৃদ্ধি করে দেয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত কর । অতঃপর তিনি ‎( ‏ইমাম সাদিক ‎) ‏১০ টি উত্তম ‎( ‏সুন্দর ‎) ‏নৈতিক চরিত্র উল্লেখ করেনঃ ১. ‏দৃঢ় বিশ্বাস ‎( ‏ইয়াকীন ‎) , ‏২. ‏পরিতোষ ও সন্তুষ্টি ‎( ‏কানাআত ‎) , ‏৩. ‏ধৈর্য্য ‎( ‏সবর ‎) , ‏৪. ‏কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ‎( ‏শুকুর ‎) , ‏৫. ‏সহিষ্ণুতা ‎( ‏হিলম ‎) , ‏৬. ‏সদাচরণ ‎( ‏সদ্ব্যবহারঃ হুসনুল খুলক ‎) , ‏৭. ‏দানশীলতা ‎( ‏বদান্যতাঃ সাখা ‎) , ‏৮. ‏আত্মসম্মানবোধ ‎( ‏গাইরাত ‎) , ‏৯. ‏সাহস ‎( ‏শাজাআত ‎) ‏এবং ১০. ‏পৌরুষ ও মনুষ্যত্ব ‎( ‏মুরূআত ‎) ‏। ‎( ‏দ্রঃ আমালীস সাদূক ‎, ‏হাদীস নং ৮ ‎, ‏পৃঃ ১৮৪ ‎) قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : إِنّ اللهَ تَبَارَکَ وَ تَعَالَی خَصَّ رَسُولَ اللهِ ( ص ) بِمَکَارِمِ الأَخلَاقِ ، فَامتَحِنُوا أَنفُسَکُم ، فَإِن کَانَت فِيکُم فَاحمَدُوا اللهَ عَزَّ وَ جَلَّ وَ ارغَبُوا إِلَيهِ فِي الزِّيَادَةِ مِنهَا ، فَذَکَرَهَا عَشَرَةً : اليَقِينُ ، وَ القَنَاعَةُ ، وَ الصَّبرُ ، وَ الشُّکرُ ، وَ الحِلمٌ ، وَ حُسنُ الخُلقِ ، وَ السَّخَاءُ ، وَ الغَيرَةُ ، وَ الشَّجَاعَةُ ، وَ المُرُوءَةُ. ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ ‎(- ‏আর তাঁকে উত্তম নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ‎-) ‏যে তোমার সাথে অন্যায় ‎( ‏জুলুম ‎) ‏করেছে তাকে তোমার ক্ষমা করা ‎, ‏যে তোমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তার সাথে তোমার সম্পর্ক স্থাপন ‎, ‏যে তোমাকে বঞ্চিত করেছে তাকে দেয়া ‎( ‏দান করা ‎) ‏এবং তোমার নিজের বিরুদ্ধে হলেও সত্য বলা ।(দ্রঃ মাআনিল আখবার ‎, ‏পৃঃ ১৯১ ‎, ‏হাদীস নং ১ ‎) قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : - وَ قَد سُئِلَ عَن مَکَارِمِ الأَخلَاقِ : العَفوُ عَمَّن ظَلَمَکَ ، وَ صِلَةُ مَن قَطَعَکَ ، وَ إِعطَاءُ مَن حَرَمَکَ ، وَ قَولُ الحَقِّ وَ لَو عَلَی نَفسِکَ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏জার্রাহ আল-মাদায়েনীকে বলেনঃ ‎" ‏আমি তোমাকে উত্তম নৈতিক চরিত্র ‎( ‏মাকারিমুল আখলাক ‎مَکَارِمُ الأَخلَاقِ ) ‏সম্পর্কে বলব কি ‎?" ‏তা ‎( ‏উত্তম নৈতিক চরিত্র ‎) ‏হচ্ছে মানুষকে ক্ষমা করা ‎, ‏অর্থ সম্পদ দিয়ে ‎(অভাবগ্রস্ত দ্বীনী) ‏ভাইকে সাহায্য করা এবং মহান আল্লাহকে অনেক স্মরণ করা ।( ‏দ্রঃ প্রাগুক্তঃ হাদীস নং ২ ‎)عَنهُ ( ع ) - لِجَرَّاح المَدَائِنِيِّ - أَلَا أُحَدِّثُکَ بِمَکَارِمِ الأَخلَاقِ ؟ الصَّفحُ عَنِ النَّاسِ ، وَ مُؤَامسَاةُ الرَّجُلِ أَخَاهُ فِي مَالِهِ ، وَ ذِکرُ اللهِ کَثِيرَاً . ‏ইমাম সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার ‎( ‏হুসনুল খুলক ‎) ‏রিযক ও রুজি বৃদ্ধি করে ।( ‏দ্রঃ বিহারুল আনওয়ার ‎, ‏খঃ ৭১ ‎, ‏পৃঃ ৩৯৬ ‎, ‏হাদীস নং ৭৭ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : حُسنُ الخُلقِ يَزِيدُ فِي الرِّزقِ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ নিশ্চয়ই দয়া ও অনুগ্রহ ‎( البِرّ ) , ‏শিষ্ঠাচার ও সদাচরণ ‎( ‏সদ্ব্যবহার ও উত্তম নৈতিক চরিত্র ‎) ‏দেশকে আবাদ ও উন্নত এবং মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করে ।( ‏দ্রঃ বিহারুল আনওয়ার ‎, ‏খঃ ৭১ ‎, ‏পৃঃ ৩৯৫ ‎, ‏হাদীস নং ৭৩ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : إِنَّ البِرَّ وَ حُسنَ الخُلقَ يَعمُرانِ الدِّيَارَ وَ يَزِيدَانِ فِي الأَعمَارِ. ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ রোদ যেমন শক্তিশালী ‎( ‏পরাক্রমশালী ‎) ‏ব্যক্তিকে ধরাশায়ী ‎( ‏ক্লান্ত শ্রান্ত ‎) ‏করে ঠিক তেমনি সদাচরণ ও উত্তম চরিত্র পাপকে গলিয়ে দ্রবীভুত ‎( ‏অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন ‎) ‏করে দেয় । ‎( ‏আল-কাফী ‎, ‏খঃ ২ ‎, ‏পৃঃ ১০০ ‎, ‏হাদীস নং ৭ ও ৯ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : الخُلقُ الحَسَنُ يَمِيثُ الخَطِيئَةَ کَمَا تَمِيثُ الشَّمسُ الجَلِيدُ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ সদাচরণ ও উত্তম চরিত্রের ‎( ‏হুসনুল খুলক ‎) ‏চেয়ে আর অধিক উপভোগ্য ও মিষ্টি মধুরকোন জীবন নেই । ‎( ‏দ্রঃ ইলালুশ শারায়ে ‎, ‏পৃঃ ৫৬০ ‎, ‏হাদীস নং ১ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : لَا عَيشَ أَهنَأُ مِن حُسنِ الخُلقِ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ যেমন সিরকা মধুকে নষ্ট করে ঠিক তেমনি অসদাচরণ ও অসদ্ব্যবহারও( ‏সূউল খুলক ‎سُوءُ الخُلقِ ) ‏কর্মকে বিনষ্ট করে দেয় । ‎( ‏দ্রঃ আল-কাফী ‎, ‏খঃ ২ ‎, ‏পৃঃ ৩২১ ‎, ‏হাদীস নং ১ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : إِنّ سُوءَ الخُلقِ لَيُفسِدُ العَمَلَ کَمَا يُفسِدُ الخَلُّ العَسَلَ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ হযরত লুকমান ‎( ‏আঃ) ‏নিজ পুত্রকে বলেনঃ হে বৎস্য ‎, ‏তোমাকে অস্থিরতা ও ব্যাকুলতা ‎, ‏অসদাচরণ ‎( ‏অসংযত আচরণ ও ব্যবহার ‎) ‏এবং অধৈর্য হওয়া থেকে সাবধান করছি । কারণ এ ধরণের স্বভাব ও চরিত্রের অধিকারী কখনও দৃঢ়পদ ও অবিচল থাকতে পারে না । তুমি তোমার নিজ কর্ম ও বিষয়াদির ক্ষেত্রে অবশ্যই নিজেকে ধীরস্থির রাখবে ‎( ‏অর্থাৎ অযথা ত্বরা করবে না ‎) ‏।স্বীয় ‎( ‏দ্বীনী ‎) ‏ভাইদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে নিজেকে ধৈর্য্যশীল ও অভ্যস্ত করবে ‎( ‏ধৈর্য্যের সাথে তাদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে তাদের খরচ যোগাবে আর এ ক্ষেত্র ধৈর্য্যাবলম্বন করা প্রয়োজন ‎) ‏। আর সকল মানুষের সাথে স্বীয় ব্যবহার ও আচরণকে সুন্দর করবে । ‎( ‏দ্রঃ কাসাসুল আম্বিয়া ‎, ‏পৃঃ ২৯০ ‎, ‏হাদীস নং ৭৮৮ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : قَالَ لُقمَانُ ( ع ) لِابنِهِ : يَا بُنَيَّ ، إِيَّاکَ وَ الضَّجَرَ وَ سُوءَ الخُلقِ وَ قِلَّةِ الصَّبرِ ، فَلَا يَستقِيمُ عَلَی هذِهِ الخِصَالِ صَاحِبٌ، وَ أَلزِم نَفسَکَ التُّؤَدَةَ فِي أُمُورِکَ ، وَ صّبِّر عَلَی مَؤُونَةِ الإِخوَانِ نَفسَکَ ، وَ حَسِّن مَعَ جَمِيعِ النَّاسِ خُلقَکَ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ যে ব্যক্তির স্বভাব ও মেজাজ রুক্ষ ও অসংযত ‎( ‏যে বদমেজাজী ‎) ‏সে নিজের আত্মাকেই শাস্তি ‎(যন্ত্রণা ও কষ্ট) ‏দেয় । ‎( ‏দ্রঃ বিহারুল আনওয়ার ‎, ‏খঃ ৭১ ‎, ‏পৃঃ ৩৯৪ ‎, ‏হাদীস নং ৬৩ ‎)قَالَ الإِمامُ الصَّادِقُ ( ع ) : مَن سَاءَ خُلقُهُ عَذَّبَ نَفسَهُ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ মাংস মাংসবৃদ্ধি করে ‎( ‏অর্থাৎ মাংস খেলে দেহের মাংস ও পেশী বৃদ্ধি লাভ করে ‎) ‏। তাই যে ব্যক্তি ‎( ‏লাগাতার ‎) ‏৪০ দিন মাংস ‎( ‏red meat বা লাল মাংস ‎) ‏খাওয়া ত্যাগ করবে তার স্বভাব ‎( ‏মেজাজ ‎) ‏ও আচরণ রুক্ষ ও অসংযত হবে ‎( ‏অর্থাৎ সে বদমেজাজী হয়ে যাবে ‎)। ‎( ‏দ্রঃ আল-কাফী ‎, ‏খঃ ৬ ‎, ‏পৃঃ ৩০৯ ‎, ‏হাদীস নং ১ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : اَللَّحمُ يُنبِتُ اللَّحمَ ، وَ مَن تَرَکَ اللَّحمَ أَربَعِينَ يَومَاً سَاءَ خُلقُهُ . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ) ‏বলেনঃ তোমাকে দুটো স্বভাব বা খাসলত সম্পর্কে সাবধান করে দিচ্ছি । আর ঐ দুটো খাসলত বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছেঃ ১. ‏অস্থিরতা ‎( ‏ব্যাকুলতা ‎) ‏এবং আলস্য । তাই যদি তুমি অস্থির ও ব্যাকুলচিত্ত ‎( ‏অধৈর্য্যশীল ‎) ‏হও তাহলে তুমি কোনো সত্য বিষয় বা হকের ‎( ‏অধিকার ‎) ‏ক্ষেত্রে ধৈর্য্যধারণ করতে পারবে না । আর যদি তুমি অলস হও তাহলে কোনো অধিকার ‎( ‏হক ‎)ই আদায় করতে পারবে না । ‎( ‏দ্রঃ বিহারুল আনওয়ার ‎, ‏খঃ ৭২ ‎, ‏পৃঃ ১৯২ ‎, ‏হাদীস নং ৮ ‎)قَالَ الإمَامُ الصَّادقُ ( ع ) : إِيَّاکَ وَ خَصلَتَينِ : الضَّجَرَ وَ الکَسَلَ ، فَإِنَّکَ إِن ضَجَرتَ لَم تَصبِر عَلَی حَقٍّ ، وَ إِن کَسَلتَ لَم تُؤَدِّ حَقَّاً . ‏যখন ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎)কে ইয়াহইয়া ইবনে ইমরান আল-হালাবী জিজ্ঞেস করলেনঃ ‎" ‏সবচেয়ে সুন্দর স্বভাব ও চারিত্রক বৈশিষ্ট্য কোনটি ‎? " ‏তখন তিনি ‎( ‏আঃ ‎) ‏বললেনঃ ভীতিপ্রদান ও ভয়ের উদ্রেক করে না এমন গাম্ভীর্য্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্ব ‎, ‏শাস্তি ও প্রতিশোধগ্রহণের স্পৃহা ও মনোবৃত্তি পরিহার করে ক্ষমা করা এবং দুনিয়াবী ‎( ‏পার্থিব ‎) ‏পণ্য ‎- ‏সামগ্রী এবং বিষয় থেেক মুখ ফিরিয়ে পারলৌকিক বিষয়ে লিপ্ত ও মগ্ন হওয়া ‎( ‏হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর ও উত্তম চারিত্রিক স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য ‎) ‏। ‎( ‏দ্রঃ আল-কাফী ‎, ‏খঃ ২ ‎, ‏পৃঃ ২৪০ ‎, ‏হাদীস নং ৩৩ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) - لَمَّا سَأَلَهُ يَحيَی بنُ عِزرَانَ الحَلَبِيُّ عَن أَجمَلِ الخِصَالِ : وَقَارٌ بِلَا مَهَابَةٍ ، وَ سَمَاحٌ بِلَا طَلَبِ مّکَافَاةٍ و تَشَاغُلٍ بِغَيرِ مَتَاعِ الدُّنيَا . ‏ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ ধর্ম ‎( ‏দ্বীন ‎) ‏ও ধর্মীয় ‎( ‏দ্বীনী ‎) ‏ভাইদেরকে রক্ষা করার জন্যই হচ্ছে তাকীয়াহ নীতি অবলম্বন । আর তাকীয়াহ নীতি মেনে চলার কারণে ভীত ‎( ‏সন্ত্রস্ত ‎) ‏ব্যক্তি যদি রক্ষা পায় এবং বেঁচে যায় তাহলে তা ‎( ‏তাকীয়াহ ‎) ‏হবে সবচেয়ে মহৎ ও ভদ্রজনোচিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণ । ‎( ‏বিহারুল আনওয়ার ‎, ‏খঃ ৭৫ ‎, ‏পৃঃ ৪১৫ ‎, ‏হাদীস নং ৬৮ ‎) ‏তাকীয়াহ ‎( التَّقِيَّةُ ) ‏শত্রু বা শত্রুমনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের কাছে সত্য ধর্ম ও সঠিক আকীদা-বিশ্বাস প্রকাশ করলে যদি তাদের পক্ষ থেকে জান-মালের ক্ষতি এবং মান-সম্ভ্রম হানির আশঙ্কা থাকে তাহলে এমতাবস্থায় তা প্রকাশ না করে বরং শত্রুর ধর্মমত ও আকীদা-বিশ্বাস বাহ্যতঃ ব্যক্ত ‎(প্রকাশ) ‏এবং তাদের মত শরয়ী বিধি-বিধান পালন করে এবং অন্তরে সত্য ধর্মের প্রতি প্রকৃত বিশ্বাস ও আস্থা গোপণ রেখে ক্ষতির হাত থেকে মুমিনদের জান-মাল ও মান-সম্ভ্রম রক্ষা করাই হচ্ছে তাকীয়াহ । আর তাকীয়াহ শব্দের আভিধানিক অর্থও হচ্ছে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা বা সংরক্ষণ ‎( التَّحَفُّظُ عَنِ الضَّرَرِ) ‏এবং এ অর্থে ই হচ্ছে তাকওয়া ‎( تَقوَی ) , ‏তুকাত ‎( تُقَاة ) ‏এবং ইত্তিকা ‎( اِتِّقَاء ) ‏। ইমাম জাফার সাদিক ‎( ‏আঃ ‎) ‏বলেনঃ নিঃসন্দেহে উত্তম নৈতিক গুণাবলী পরষ্পর শর্তাধীন । ‎( ‏অর্থাৎ প্রতিটি উন্নত নৈতিক চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের শর্ত হচ্ছে অপর কোনো উন্নত নৈতিক চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য ‎; ‏তাই সকল নৈতিক চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে এগুলোর যাবতীয় শর্ত ‎, ‏অবস্থা এবং প্রয়োগ ক্ষেত্র বিবেচনা করতে হবে । ‎) ( ‏দ্রঃ শেখ তূসী প্রণীত আল- ‏আমালী ‎, ‏পৃঃ ৩০১ ‎, ‏হাদীস নং ৫৯৭ ‎)قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ ( ع ) : إِنَّ خِصَالَ المَکَارِمِ بَعضُهَا مُقَيَّدٌ بِبَعضٍ . ‏প্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কি

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করণ বা শাক্কুল ক্বামারমানব জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হযরত মাওলা মুহাম্মাদ ‎(সা.)'র জীবন সেই শৈশব থেকে ওফাত পর্যন্ত মোজেজা বা মহাবিস্ময়কর অনেক ঘটনায় ভরপূর ছিল। আমরা জানি মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনা সাধারণ মানুষ বা সাধারণ কার্য-কারণ বা চালিকা শক্তির মাধ্যমে ঘটানো সম্ভব নয়। হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.)'র জীবনের অলৌকিক অথচ সন্দেহাতীত ঘটনাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে তিনি মহান আল্লাহর পরম প্রিয়পাত্র এবং তাঁরই মনোনীত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ।মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনা সব নবী-রাসূলের জীবনেই ঘটেছে। কারণ প্রত্যেক নবী ও রাসূলের সাথে আল্লাহর যোগাযোগ ছিল। অন্য কথায় নবী-রাসূলগণ আল্লাহর কাছ থেকে বাণী ও দিকনির্দেশনা লাভ করতেন। তাঁরা নবুওত বা রেসালাতের বিষয়টি প্রমাণের জন্যে প্রয়োজনে যুক্তির পাশাপাশি মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনাও ঘটাতেন। মোজেজা আল্লাহর নির্দেশেই ঘটতো এবং এ ধরনের ক্ষমতা আল্লাহ-প্রদত্ত ক্ষমতারই নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে হযরত মূসা ও হযরত ঈসা ‎(আ.)'র মো'জেজাসহ অতীতের অনেক নবীর মো'জেজার কথা বলা হয়েছে। হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.)ও তাঁর পূর্ববর্তী নবীগণের মো'জেজার বা অলৌকিক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। বিশ্বমানবতার মুক্তির মহাকাণ্ডারী ও একত্ববাদের বিজয়-গাঁথার সর্বশ্রেষ্ঠ নিশানবরদার রাসূলে পাক ‎(সা.) ‏ও অনেক মো'জজা দেখিয়েছেন। পবিত্র কোরআন তাঁর সর্বত্তোম মো'জেজা এবং তাঁর রেসালাত ইসলাম ধর্মের সত্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।পবিত্র কোরআনে ‎(সা.)'র অন্য যেসব মো'জেজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেসবের মধ্যে চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করার ঘটনা অন্যতম।আবুজেহেল ও ওয়ালিদ বিন মুগিরাহসহ মক্কার কোরাইশ ও মুশরিকদের একদল নেতা একবার হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.)'র কাছে আসেন। সে সময় রাতের বেলায় পূর্ণ চাঁদ দেখা যাচিছল। ওরা রাসূলে পাক ‎(সা.)কে বললো,তোমার নবুওতের দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে এই চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত হতে বল। রাসূলে খোদা ‎(সা.) ‏বললেন,এ কাজ করলে কি তোমরা ঈমান আনবে? ‏তারা বললো হ্যা। রাসূল ‎(সা.) ‏আল্লাহর কাছে এ মো'জেজা ঘটানোর প্রার্থনা করেন। হঠাৎ সবাই দেখলো,চাঁদ এত স্পষ্টভাবে দুই খন্ড হয়ে গেছে যে দ্বিখণ্ডিত চাঁদের মাঝখানে হেরা পর্বত দেখা যাচেছ। এরপর দ্বিখণ্ডিত চাঁদ আবার জোড়া লেগে যায় এবং তা পূর্ণ চাঁদে পরিণত হয়। এ সময় রাসূলে পাক ‎(সা.) ‏বলছিলেন,সাক্ষী থাক ও দেখ। মুশরিকরা তো এই অসাধারণ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক! ‏কিন্তু তাদের কেউ কেউ ঈমান না এনে বললো,মুহাম্মাদ আমাদেরকে যাদু করেছে। আবু জেহেল বলল,এটা জাদু হলে জাদুর প্রভাব কেবল তোমাদের উপরই পড়ার কথা,এটাতো হতে পারে না যে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের উপর পড়বে। আবু জেহেল আরো বলল,।অন্যান্য শহরের লোকেরা যারা তোমাদের নিকট আসবে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে । তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা সবাই বলল যে,আমরা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার দৃশ্য অবলোকন করেছি।গ্রীক দার্শনিকদের একটি দল তারা কাফের-মুশরিকদেরও ছাড়িয়ে যায় এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার মোজেযাকে কেবল অস্বীকারই করে না,তারা তাদের ভ্রান্ত নীতি দর্শন অনুযায়ী বলতে থাকে,আকাশ ও গ্রহ-উপগ্রহের পক্ষে বিদীর্ণ হওয়াও সংযুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তারা আরও প্রশ্ন উত্থাপন করে যে,চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার মতো মোজেযা সংঘটিত হয়ে থাকলে তা বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পেত অথচ ইতিহাসে এই ঘটনার কথা উল্লেখ নেই। সুতরাং এই ঘটনার কোন বাস্তবতা নেই। তাছাড়া গণক,জ্যোতিষীরা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেনি,ভবিষ্যৎ বক্তারাও এ ব্যাপারে নীরব রয়েছে। এ ধরনের নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে দার্শনিক-বিজ্ঞানীরা চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সত্য ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা কম করেনি। এ ব্যাপারে তারা গোলক ধাঁধাঁর সৃষ্টি করে একশ্রেণীর মুসলিম সীরাত লেখককেও বিভ্রান্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যার জন্য আরেক সীরাত গ্রন্থে শক্কে কমরের মোজেযা সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে স্থান পায়নি বলে দার্শনিক-বিজ্ঞানীদের অভিযোগ যে কত ভিত্তিহীন তা নিম্নের আলোচনা হতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।১ ‎‘শক্কল কামারে’র মোজেযা মক্কার কাফেরদের একটি বিশেষ দাবির প্রেক্ষিতে সংঘটিত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏সেই দাবী পূরণ করার জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করেন এবং আল্লাহ তাঁর সেই দোয়া কবুল করেন।২. ‏মক্কাবাসীরা ছাড়াও আশপাশের এলাকা হতে আগত মোসাফিরগণও চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার সাক্ষ্য দান করে।৩. ‏যদি ধরেও নেয়া যায় যে,ঘটনাটি সকল স্থানে দেখা যায়নি এর কারণ কি? ‏জবাবে বলা যায় চাঁদের উদয়স্থলের পার্থক্যের কারণে কোন কোন স্থানে চাঁদ উদিতই হয়নি। এ জন্য চন্দ্র গ্রহণ সব স্থানে পরিলক্ষিত হয় না এবং কোন কোন সময় অন্যান্য স্থানে মেঘাচ্ছন্ন বা পর্বত ইত্যাদি চাঁদের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে।৪. ‘খিরকে ইলতিয়াম’- ‏একটি বিশেষ পরিভাষা। খিরক অর্থ হচ্ছে ফেটে যাওয়া,চিরাচরিত নিয়মনীতি ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে কিছু ঘটে যাওয়া,ব্যতিক্রম,অভিনব,নবী-রাসূলগণের মোজেযা বা অলৌকিক ঘটনা। এর বহু বচন খাওয়ারেকা। আর ইলতিয়াম শব্দের অর্থ,পরস্পর দুই বস্তুর মিলিত হওয়া। সুতরাং ঘিরকে ইলতিয়াম বলা হয়,সৌরম-লে অর্থাৎ আকাশ,তারকারাজি তথা গ্রহ-উপগ্রহ ইত্যাদি ফাটল-মিলন বা ব্যতিক্রমী ঘটনাবলী। মুসলমানদের কাছে আকাশ নক্ষত্ররাজির মধ্যে এসব অবস্থার সৃষ্টি হওয়া খুবই সম্ভব। এর বহু দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে,কেয়ামতের সময় আসমান ও তারকারাজি ফেটে তুলাতুলা হয়ে যাবে যার বর্ণনা কোরআনের বহুস্থানে রয়েছে। এতদসংক্রান্ত বহু হাদীসেও এ বর্ণনা এসেছে। ‎‘হেকমত’বা যুক্তিশাস্ত্র অনুযায়ী ও দার্শনিকদের যুক্তি বাতিল-অচল এ সম্পর্কে গ্রীসের বিখ্যাত প্রাচীন দার্শনিক ফিসাব্যারাম ‎‘হাইয়াত’বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন যে,তারকারাজি মৃত্তিকার ন্যায় খুব ঘন,পুরু এবং সমস্তই লীন,ধ্বংসযোগ্য এবং তাদেও ফাটল-মিলন ঘটবে। অতএব বিনাদ্বিধায় প্রমাণিত যে,চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনা একটি অকাট্য সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত,এতে সংশয়ের কোন অবকাশ নেই।৫. ‏প্রাচীন ঐশী গ্রন্থ ‎‘তওরাতে’বর্ণিত হয়েছে যে,হযরত ইউশা ‎(আ.)-এর জন্য চলমান সূর্য থেমে গিয়েছিল,অথচ এ ঘটনা কোন ইতিহাস গ্রন্থে লিখিত হয়নি,যদিও এটি ছিল দিনের ঘটনা। সুতরাং ঘটনাটি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ না থাকলে তার বাস্তবতা মিথ্যা হতে পারে না। কাজেই রাতের ঘটনা ‎‘শক্কে কমরকেও অস্বীকার করা যায় না। মুসলমান ঐতিহাসিকদের আরবী,ফার্সী,উর্দু,বাংলাসহ বিশ্বের নানা ভাষায় রচিত প্রাচীন ও আধুনিক বহু গ্রন্থে এবং রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর মোজেযা সংক্রান্ত হাদীসও অন্যান্য অসংখ্য গ্রন্থে,পদ্যে-গদ্যে শক্কে কমরের ঘটনার বিবরণ,আভাস,ইঙ্গিত ছাড়াও কোরআনে সূরা ‎‘কামার’অপেক্ষা বড় দলিল আর কি হতে পারে!৭. ‏শক্কে কমরের মোজেযা অস্বীকারকারী আধুনিক শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজের মধ্যে প্রত্যেকেই চাঁদে মানব অবতরণের বিস্ময়ক ঘটনা অবগত। বিশ্ব ইতিহাসের এই চমকপ্রদ ঘটনাটি সর্বপ্রথম ঘটেছিল ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই রাত ২টা ১৬ মিনিটে। চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানব চাঁদের তথাকথিত ‎‘কলঙ্ক’অর্থাৎ ক্ষত চিহ্নের যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তা কেউ এখনও ভুলে যায়নি। আমেরিকার চন্দ্র বিজয়ী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গিয়ে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার প্রমাণ পেয়ে পৃথিবীতে ফিরে এসে মুসলমান হয়ে গেছেন। এর পরেও কি অস্বীকারকারীদের বোধোদয় হবে না?৮. ‏ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত মালাবার রাজ্যের ততকালীন রাজা চক্রবর্তী ফারমাস ‎(চেরামান পিরুমেল) ‏আকাশে চাঁদ দুই টুকরো হয়ে যাওয়ার ওই অলৌকিক ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। যখন তিনি জানতে পারেন যে আরব দেশে শেষ নবী(সা.)’র আবির্ভাব ঘটেছে তখন তিনি মক্কায় আসেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ভারতের ইতিহাস গ্রন্থ ‎‘তারিখে ফেরেশতা’য় ওই ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে।মার্কিন মহাশূন্য সংস্থা নাসার নভোচারীদের মাধ্যমে তোলা ছবিতেও চাঁদের মধ্যে গভীর ফাটলের চিহ্ন বা দাগ দেখা গেছে এবং এ থেকে স্পষ্ট হয় যে কোনো এক সময় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল।ভারতীয় রাজা যে ওই ঘটনা দেখেছিলেন তার লিখিত বিবরণের একটি প্রাচীন দলিল বর্তমানে লন্ডনে ভারতীয় দপ্তরের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে। ওই দলিলে ভারতীয় সেই রাজার ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ওই রাজা ভারতের দিকে ফেরার পথে ইয়েমেনে মারা যান।পবিত্র কোরআনে এ ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়েছে,اقْتَرَ‌بَتِ السَّاعَةُ وَانشَقَّ الْقَمَرُ‌ وَإِن يَرَ‌وْا آيَةً يُعْرِ‌ضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ‌ مُّسْتَمِرٌّ‌ وَكَذَّبُوا وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْকিয়ামত আসন্ন এবং চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছে,তারা কোন নিদর্শন প্রত্যক্ষ করলেও বিমুখ হয়ে থাকে এবং বলে,‘এতো চিরাচরিত জাদু।’তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে।(সূরা আল ক্বামর-১-৩)ফাখরে রাজী তাফসীরে মাফাতিহুল গাইবে সূরা ক্বামারের তাফসীরে লিখেছেন,সমস্ত তাফসীরকার এ ব্যাপারে একমত যে চাঁদে ফাটল বা ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল এবং গোটা চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। এ ঘটনা সম্পর্কে হাদীসের প্রায় বিশটি বর্ণনা রয়েছে এবং এ ঘটনার সত্যতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেইপ্রচারে মোঃ শামসীর হায়দার

ইমামত নবুওয়াতের নির্বাহী ক্ষমতার ধারাবাহিকতাShare0 ‏বিভিন্ন মতামত0.0 / 5প্রবন্ধ ‎›ইসলামী বিশ্বাস ‎›দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহ ‎›ইমামতপ্রকাশিত হয়েছে ‎2019-08-19 11:11:21ভূমিকামহানবী ‎(সা.) ‏নবুয়্যত, ‏রিসালাত এবং ইসলামের আহকাম প্রচার ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছাড়াও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দয়িত্বে ও নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকার্য ও সামরিক নেতৃত্ব ইত্যাদি এ থেকেই উৎকলিত হত। যেমনিকরে ইসলামে ইবাদত ও আচরণগত দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক, ‏অর্থনৈতিক ও অধিকারগত ইত্যাদি কর্তব্যও বিদ্যমান, ‏তেমনি করে ইসলামের নবী ‎(সা.) ‏প্রচার, ‏প্রশিক্ষণ ও ‎(আধ্যাত্মিক) ‏পরিচর্যার দায়িত্ব ছাড়াও মহান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে ঐশী বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সকল প্রকার প্রশাসনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।এটা অনস্বীকার্য যে, ‏যদি কোন দ্বীন বিশ্বের শেষাবধি সকল প্রকার সামাজিক কর্তব্য পালনের দাবি করে তবে এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। অনুরূপ যে সমাজ এ দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, ‏সে সমাজ এ ধরনের কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তব্য থেকে নিরুদ্দিষ্ট থাকবে, ‏যা ইমামত নামে অভিষিক্ত, ‏তাও হতে পারে না।কিন্তু কথা হল মহানবী ‎(সা.) ‏এর তিরোধানের পর, ‏কে এ দায়িত্ব লাভ করবেন? ‏এবং তা কার কাছ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবেন? ‏মহান আল্লাহ্‌ ‏এ মর্যাদা যেরূপে মহানবীকে ‎(সা.) ‏দিয়েছিলেন সেরূপে অন্য কাউকেও কি দিয়েছেন? ‏এ দায়িত্বভার অন্য কারও গ্রহণের কোন বৈধতা রয়েছে কি? ‏নাকি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এ মর্যাদা মহানবী ‎(সা.)-এর জন্যেই নির্ধারিত ছিল এবং অতঃপর মুসলিম জনতাই তাদের ইমাম নির্বাচন করবে ও তাকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্থান দিবে, ‏তা-ও বিধিসম্মত? ‏মানুষের কি এ ধরনের কোন অধিকার আছে? ‏না নেই?আর এটিই হল শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয়। অর্থাৎ একদিকে শিয়াদের বিশ্বাস যে ইমামত হল একটি ঐশী মর্যাদা, ‏যা মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃকই যথোপযুক্ত ও যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা আবশ্যক। আর মহান আল্লাহ্‌, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏এর মাধ্যমে এ কর্মটি সম্পাদন করেছেন এবং আমীরুল মু’মীনিন আলীকে ‎(আ.) ‏তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষনা করেছেন। অতঃপর তাঁরই সন্তানদের মধ্য থেকে পরস্পরায় বারজনকে ইমামতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করছেন। অপরদিকে সুন্নি মাযহাবের বিশ্বাস নবী ‎(সা.)-এর তিরোধানের মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগতের সাথে মানুষের সম্পর্ক কর্তিত হয়ে গেছে এবং মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় পৌঁছেছে। এখন তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে কোরআনকে বুঝতে ও তাদের পথকে চিনে নিতে পারে। তাই তাদের পথপ্রদর্শনের জন্য ঐশী কোন ব্যক্তির আর প্রয়োজন নাই। আর নবী ‎(সা.) ‏এর পর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্বও তাদের উপরই অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি আহলে সুন্নাতের কোন কোন বিজ্ঞজন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ‏যদি কেউ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, ‏তবে তার আনুগত্য করাও অন্যান্যদের জন্যে অপরিহার্য!১ স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, ‏এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী, ‏অত্যাচারী ও প্রতারকদের অপরাধের জন্যে কতটা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের অবক্ষয় ও বিভেদের পথে কতটা সহায়ক হয়েছে!প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ঐশী সস্পর্কহীন ইমামতের বৈধতা দিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর শিয়া মাযহাবের বিশ্বাস, ‏এটিই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সত্য সুন্দর পথ থেকে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুতির মূল কারণ। অনুরূপ শতসহস্র ধরনের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার সূতিকাগারও এখানেই, ‏যেগুলো মহানবী ‎(সা.) ‏এর পরলোক গমনের পর থেকে মুসলমানদের মাঝে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং করবে।অতএব প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই কোন প্রকার অন্ধ অনুকরণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যতিরেকে এ বিষয়টির উপর পরিপূর্ণ গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য।২ আর সেই সাথে সত্য ও সঠিক মাযহাবের শনাক্তকরণের মাধ্যমে এর প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।উল্লেখ্য এ ব্যাপোরে ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রুদের জন্যে সুযোগ করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না যা ইসলামী সমাজে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হবে। আর এ ক্ষতির অংশীদার মুসলমানরাই হবে, ‏যার ফলশ্রুতি মুসলিম সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা বৃদ্ধি ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য সংরক্ষণ যেন, ‏সঠিক ও সত্য মাযহাবের অনুসন্ধান ও শনাক্তকরণের জন্যে, ‏অনুসন্ধান ও গবেষণার সুষ্ঠ পথকে রুদ্ধ না করে ফেলে। আর ইমামতের বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুষ্ঠ পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‏এ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধানের উপর মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে।ইমামতের তাৎপর্যইমামতের আভিধানিক অর্থ হল নেতা, ‏পথপ্রদর্শক এবং যে কেউ কোন জনসমষ্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহন করবে তাকেই ইমাম ‎(امام) ‏বলা হয়ে থাকে ‎-হোক সে সত্য পথের অনুসারী কিংবা মিথ্যা পথের অনুসারী। যেমন: ‏পবিত্র কোরানে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে ‎(ائمة الكفر) ‏অর্থাৎ কাফেরদের নেতারা ‎(সূরা তওবাহ-১২) ‏কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তদনুরূপ মুসুল্লীরা নামাজের জন্যে যার পিছনে সমবেত হয়ে থাকেন, ‏তাকে ‎‘ইমামুল জামা’ত’ ‏নামকরণ করা হয়।কিন্তু কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ইমামত হল ইহ ও পরলৌকিক সকল বিষয়ে ইসলামী সমাজের সর্বময় ও বিস্তৃত নেতৃত্ব প্রদান। ইহলৌকিক শব্দটি ইমামতের পরিসীমার ব্যাপকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা ইসলামী সমাজে ইহলৌকিক বিষয়াদিও দ্বীন ইসলামেরই অন্তর্ভুক্ত।শিয়া মাযহাবের মতে এ ধরনের নেতৃত্ব কেবলমাত্র তখনই বৈধ হবে, ‏যখন তা মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অনুমোদিত হবে। আর প্রকৃতপক্ষে যিনি এ মর্যাদার অধিকারী হবেন, ‏তিনি আহকাম ও ইসলাম পরিচিতির বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত থাকবেন। অনুরূপ তিনি সকল প্রকার গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবেন। বস্তুতঃ পবিত্র ইমাম, ‏একমাত্র নবুয়্যত ও রিসালাত ব্যতীত মহানবীকে ‎(সা.), ‏মহান আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত সকল মর্যাদার অধিকারী হবেন। ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য যেমন নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য, ‏তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়েও তাঁর আদেশ পালন করাও অপরিহার্য।এভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে।দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।তৃতীয়তঃ ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে।তবে মা’সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও ‎(সালামুল্লাহ আলাইহা) ‏মা’সুম ছিলেন, ‏যদিও তিনি ইমামতের অধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম ‎(আ.) ‏ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহ্‌র ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, ‏যদিও আমরা তাঁদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা’সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাঁদেরকে চিনা সম্ভব নয়।একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনাবিশ্বাসগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন না এমন অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে, ‏শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামত প্রসঙ্গে বিরোধ এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে শিয়াদের বিশ্বাস হলঃ মহানবী ‎(সা.) ‘আলী ইবনে আবি তালিবকে’ (আ.) ‏ইসলামী সমাজের পরিচালনার জন্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস যে, ‏এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং রাসূল ‎(সা.) ‏উম্মতকে কোন নেতা মনোনীত করা ছাড়াই ত্যাগ করেছিলেন। আর তাই তাঁর মৃত্যুর পর জনগণ নিজেদের পছন্দ মত প্রথম খলিফাকে নেতা নির্বাচন করেছিল। প্রথম খলিফা যদিও নিজে জনগণ কর্তৃক নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীকে নিজেই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব ছয় সদস্য বিশিষ্ট গোষ্ঠীর নিকট অর্পণ করা হয়েছিল। অপরদিকে চতুর্থ খলিফাও আবার প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন পন্থা ছিল না। ফলে চতুর্থ খলিফার পর যার সামরিক শক্তি অধিক ছিল, ‏সে-ই এ স্থান দখল করেছিল, ‏যেমন: ‏অনৈসলামিক দেশসমূহেও মোটামুটি এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।অন্যকথায়ঃ তারা এ রকম মনে করেন যে, ‏প্রথম ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শীয়াদের বিশ্বাস সেরূপ, ‏যেরূপ আহলে সুন্নাত প্রথম খলিফা কর্তৃক দ্বিতীয় খলিফার নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেন, ‏পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏এর বক্তব্য মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, ‏কিন্তু প্রথম খলিফার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল!কিন্তু প্রশ্ন হল, ‏প্রথম খলিফা এ অধিকার কোথা থেকে পেয়েছিলেন? ‏আল্লাহ্‌র রাসূল ‎(সা.) (আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস মতে) ‏ইসলামের জন্যে কেন তার ‎(প্রথম খলিফা) ‏মত আন্তরিকতা প্রদর্শন করেননি এবং নব গঠিত ইসলামী সমাজকে অভিভাবকহীন অবস্থায় রেখে গেলেন অথচ যুদ্ধের জন্যে মদীনা থেকে অন্যত্র যাওয়ার সময়ও একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এবং যেখানে স্বয়ং তিনিই ‎(এ বিষয়ের উপর) ‏তাঁর উম্মতদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তির সংবাদ দিয়েছিলেন? ‏এছাড়া ও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ‏শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূলতঃ মতবিরোধ সর্বাগ্রে এখানেই যে, ‏ইমামত কি এক ধর্মীয় মর্যাদা, ‏যা ঐশী বিধানের অনুগামী ও আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়? ‏নাকি পার্থিব রাজকীয় বা অন্য কোন পদ মর্যাদা, ‏যা সামাজিক নীতিমালার অনুগামী? ‏শিয়াদের বিশ্বাস যে, ‏স্বয়ং মহানবীও ‎(সা.) ‏নিজ থেকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেননি। বরং মহান আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক আদিষ্ট হয়েই এ কর্ম সম্পাদন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন পবিত্র ইমামগণের নিয়োগদানের সাথে সস্পর্কযুক্ত। আর এ ধরনের ইমামের উপস্থিতিতেই রাসূল ‎(সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী সমাজের অপরিহার্য বিষয়াদির নিশ্চয়তা প্রদান করা যেতে পারে।এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ‏কেন শিয়া মাযহাবের মতে ইমামত ‎‘মূল বিশ্বাসগত’ ‏বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয় ‎-শুধুমাত্র একটি ফিকাহ্‌গত গৌণ বিষয় নয়। আর সেই সাথে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ‏কেন তারা তিনটি শর্ত ‎(ঐশী জ্ঞান, ‏ইসমাত ও আল্লাহ্‌ ‏কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) ‏বিবেচ্য বলে মনে করেন এবং কেন শিয়া সাধারণের মধ্যে এ ভাবার্থগুলো ঐশী আহকাম, ‏প্রশাসন ও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃত্বের ধারনার সাথে এমনভাবে মিশে আছে, ‏যেন ইমামত শব্দটি এ ভাবার্থগুলোর সবগুলোকেই সমন্বিত করে।এখন শিয়াদের সামগ্রিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, ‏ইমামতের তাৎপর্য ও মর্যাদার আলোকে এর বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা করব।ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তাআমরা জানি খতমে নবুওয়াতের দর্শন হল এই যে, ‏ইসলাম হল পবিত্র, ‏চিরন্তন, ‏সার্বজনীন ও অবিস্মৃত ধর্ম এবং ইসলামের নবী ‎(সা.)-এর পর আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না। নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন, ‏তখনই কেবলমাত্র নবীগণের আবির্ভাবের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে, ‏যখন সর্বশেষ ঐশী শরীয়ত মানব মাযহাবের সকল প্রশ্নের জবাব প্রদানে সক্ষম হবে এবং বিশ্বের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এ শরীয়তের অটুট থাকার নিশ্চয়তা থাকবে।উল্লেখিত নিশ্চয়তা পবিত্র কোরআনে রয়েছে এবং মহান আল্লাহ্‌ ‏স্বয়ং সকল প্রকার বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে প্রিয় গ্রন্থের সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের সকল বিধি-বিধান কোরানের আয়াতের বাহ্যিক যুক্তি থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন: ‏নামাযের রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি এবং আবশ্যকীয় ও অনাবশ্যকীয় এমন অসংখ্য বিধান রয়েছে, ‏যেগুলোকে পবিত্র কোরান থেকে উদঘাটন করা অসম্ভব। সাধারণতঃ পবিত্র কোরানে আহকাম ও কানুন বিশদভাবে বর্ণিত হয়নি। ফলে এগুলোর প্রশিক্ষণ ও সুস্পষ্ট বর্ণনার দায়িত্ব মহানবী ‎(সা.)-এর উপর অর্পণ করা হয়েছে, ‏যাতে তিনি মহান আল্লাহ্‌ ‏প্রদত্ত জ্ঞানের ‎(কোরআনের ওহী ব্যতীত) ‏মাধ্যমে ঐগুলোকে মানুষের জন্যে বর্ণনা করেন।৩ আর এভাবে ইসলাম পরিচিতির প্রকৃত উৎস হিসেবে তাঁর সুন্নাহ বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।কিন্তু হযরত ‎(সা.)-এর নবুওয়াতের প্রচার কর্ম শুরুর পর দশ বছর ধরে নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে ছিলেন, ‏অতঃপর আবি তালিবের উপত্যকায় কয়েক বছরের বন্দীদশা কাটিয়েছেন, ‏মদীনায় হিজরতের পর শত্রুদের সাথে দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ ইত্যাদির মত জীবনের সংকটময় মুহূর্তগুলো সাধারণ মানুষের জন্যে ইসলামের বিভিন্ন আহ‌কাম, ‏বর্ণনার পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। অপর দিকে সাহাবাগণ যা শিখতেন তা সংরক্ষিত থাকারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এমন কি অজু করার প্রক্রিয়া যা তেইশ বছর ধরে সাহাবাদের চোখের সামনে সম্পাদিত হয়েছে তাও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতএব যেখানে এ সুস্পষ্ট বিষয়টি ‎(যা মুসলমানদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বা আছে এবং এর পরিবর্তন ও বিকৃতির মধ্যে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য জড়িত ছিল না) ‏বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, ‏সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ও গোত্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জটিল ও সূক্ষ্ম নিয়মসমূহের বর্ণনার ক্ষেত্রে বিকৃতি ও ভ্রান্তির সম্ভাবনা অবশ্যই অধিকতর।৪এ বিষয়টির আলোকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ‏ইসলাম ধর্ম কেবলমাত্র তখনই এক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে পৃথিবীর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত মানুষের সকল প্রয়োজন ও প্রশ্নের জবাবদানে সক্ষম হবে যখন দ্বীনের মূলভাষ্যে, ‏সমাজের এ সকল কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধিত হবে, ‏যেগুলো মহানবী ‎(সা.)-এর ইন্তেকালের পর সংকট ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আর এ নিশ্চয়তা বিধানের পথ মহানবী ‎(সা.)-এর যোগ্য উত্তরসুরি নির্বাচন ব্যতীত কিছুই নয়। এ উত্তরসুরিকে একদিকে যেমন ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে, ‏যাতে দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন। অপরদিকে তেমনি দৃঢ়রূপে পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে,যাতে কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানী প্ররোচনায় প্রভাবিত না হন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীনের বিকৃতিতে লিপ্ত না হন। অনুরূপ মানব জাতির আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে মহানবী ‎(সা.)-এর দায়িত্ব স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিয়ে, ‏উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে পৌঁছে দিতেও তাঁরা বদ্ধপরিকর। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে সমাজের শাসন, ‏পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা, ‏বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তাঁরা গ্রহণ করে থাকেন।উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ‏নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি কেবলমাত্র তখনই প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে, ‏যখন এমন পবিত্র ইমামগণকে নিয়োগ করা হবে, ‏যাঁরা একমাত্র নবুয়্যত ব্যতীত মহানবী ‎(সা.)-এর সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন।আর এভাবেই একদিকে যেমন সমাজে ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হয়, ‏অপরদিকে তেমনি তাঁদের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্র মর্যাদাও। অনুরূপ মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন এ ধরনের জ্ঞান ও মর্যাদা কাকে দিয়েছেন এবং তিনিই বস্তুতঃ তাঁর বান্দাগণের উপর বিলায়াত ও কর্তৃত্বের অধিকার রাখেন। আর তিনিই এর অধিকার অপেক্ষাকৃত হ্রাসকৃত মাত্রায় উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে প্রদান করতে সক্ষম।এখানে স্মরণযোগ্য যে, ‏আহলে সুন্নাত কোন খলিফার ক্ষেত্রেই উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিকেই স্বীকার করেন না। মহান আল্লাহ্‌ ‏ও রাসূলের ‎(সা.) ‏পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়ার দাবি যেমন তারা তুলেন না, ‏তেমনি খলিফাগণের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রসঙ্গও তুলেন না। বরং মানুষের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দানের ক্ষেত্রে তাদের অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি ও অযোগ্যতার দৃষ্টান্ত তারা তাদের বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহে তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ প্রথম খলিফা প্রসঙ্গে ইবনে কুতাইবা রচিত ‎‘আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ’ ‏গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, ‏তিনি বলেছিলেন:«انّ لي شيطانا يعتريني»‘আমার পশ্চাতে এমন এক শয়তান বিদ্যমান যে আমাকে বিভ্রান্ত করে।’অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ‏তিনি প্রথম খলিফার আনুগত্য স্বীকারকে ‎‘فلته’ ‏অর্থাৎ অবিলম্বকর্ম ও অবিবেচনাপূর্ণ কর্ম নামকরণ করেছেন।৫ অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা অসংখ্যবার এ বাক্যটি স্বীয় কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন:«لولاعليّ لهلك عمر»‘যদি আলী না থাকতেন, ‏তবে আমি ওমর ধ্বংস হয়ে যেতাম।’অর্থাৎ যদি আলী ‎(আ.) ‏না থাকতেন তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেতেন।৬ এছাড়া তৃতীয় খলিফা৭ এবং বনি উমাইয়্যা ও বনি আব্বাসের ভুল-ভ্রান্তির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখেনা। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে কেউ ন্যূনতম ধারণা নিলেই এ সম্পর্কে উত্তমরূপে পরিজ্ঞাত হতে পারবেন।একমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ই দ্বাদশ ইমামের ক্ষেত্রে এ শর্তত্রয়ে বিশ্বাসী। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইমামত প্রসঙ্গে তাদের বিশ্বাসের বৈধতা প্রমাণিত হয়। ‎#আল-বাসাইরমূল: ‏আয়াতুল্লাহ্‌ ‏মিসবাহ্‌ ‏ইয়াজদির অমুজেশে আকায়েদ গ্রন্থঅনুবাদ: ‏মোহাম্মাদ মাঈনুদ্দীনসঙ্কলন ও সম্পাদন: ‏আবুল কাসেমতথ্যসূত্র১. ‏আল আহ্‌কামুল সোলতানিয়াহ্‌, ‏লিখেছেন আবু ইয়ালা এবং ‎‘আস সাওয়াদুল আ’যাম’ ‏লিখেছেন আবুল কাশিম সামারক্বান্দি, ‏পৃঃ ৪০-৪২।২. ‏সৌভাগ্যবশতঃ বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ের উপর একাধিক ভাষায় ও একাধিক পদ্ধতিতে শতসহস্র গ্রন্থ রচনা করে সত্যানুসন্ধিৎসুগণের জন্যে গবেষণার পথকে বিস্তৃত করেছেন। উদাহরণতঃ আবাক্বাতুল আনওয়ার, ‏আল গাদির, ‏দালায়িলুস সিদক্ব, ‏গায়াতুল মারাম এবং ইসবাতুল হুদাহ ইত্যাদি গ্রন্থের নাম উল্লেখ যোগ্য।যারা পড়াশুনার যথেষ্ট সুযোগ পান না তারা ‎‘আল মুরাজিয়াত’ ‏নামক একটি বই, ‏যা শিয়া ও সুন্নী দু’জন মনীষীর মধ্যে বিনিময়কৃত পত্রসমূহের সমাহার, ‏তা পড়তে পারেন। সৌভাগ্যবশতঃ বইটি বাংলায় অনুদিত করা হয়েছে।৩. ‏বাকারাঃ ১৫১, ‏আলে-ইমরান-১৬৪, ‏জুমুআ’-২, ‏নাহল ‎-৬৪, ‏৬৪, ‏আহযাব- ‏২১, ‏হাশর ‎-৭।৪. ‏আল্লামা আমিনি ‎(র.) ‏সাতশতজন মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীর নাম তার ‎"আল গাদীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক লক্ষেরও অধিক হাদীসের বর্ণনাকারী রয়েছে ‎(আল গাদীর, ‏খণ্ড-৫ পৃঃ-২০৮)।৫. ‏শারহে নাহজুল বালাগাহ ‎: ‏ইবনে আবিল হাদিদ, ‏খণ্ড- ‏১, ‏পৃষ্ঠা-৮৫ খণ্ড-৪, ‏পৃঃ-২৩১-২৬২, ‏এবং আল গাদীর ‎: ‏খণ্ড ‎-৭, ‏পৃঃ-১০২-১৮০।৬. ‏ইবনে আবদুল বার, ‏আলইসতিয়াব, ‏৩য় খণ্ড, ‏পৃ.১১০৩; ‏শারহে নাহজুল বালাগাহ ‎: ‏খণ্ড ‎-১, ‏পৃঃ-১৪২-১৫৮ ‎, ‏খণ্ড-৩, ‏পৃঃ-৫৭।৭. ‏আল গাদীর ‎: ‏খণ্ড ‎- ‏৬, ‏পৃঃ ‎-৯৩ ও পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো।

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ কেন ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি ?ইমাম হোসাইন (আ.) ৫০ হিজরি থেকে ৬১ হিজরি পর্যন্ত ১১ বছর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ১০ বছর মুয়াবিয়ার শাসনামলে অতিবাহিত হয়। ঐ সময় ধরে তার সঙ্গে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল। এ দ্বন্দ্বের কতগুলো নমুনা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিভিন্ন চিঠিতে লক্ষ্য করা যায়। ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর চিঠিতে মুয়াবিয়ার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডগুলো (যেমন আল্লাহর রাসূলের সাহাবী আমর ইবনে হামেক ও হুজর ইবনে আদীকে হত্যা) তুলে ধরে মুসলমানদের ওপর মুয়াবিয়ার শাসনকে ‘বড় ফিতনা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।(আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০; ইবনে আব্দুল বার বলেন, ইসলামের ইতিহাসে একজন মানুষের মাথা কেটে অন্য স্থানে প্রেরণের ঘটনা মুয়াবিয়ার দ্বারা সংঘটিত হয় যখন সে সাহাবী আমর ইবনে হামেকের মাথা কেটে তার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। আল ইসতিয়াব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭৪) আর এভাবে ইমাম হোসাইন (আ.),মুয়াবিয়ার খেলাফতের বৈধতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে জিহাদ করাকে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল মনে করতেন। এছাড়া তিনি মনে করতেন,যদি কেউ তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই ইস্তিগফার করতে (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে) হবে।(ইবনে কুতাইবা দিনওয়ারী, আল-ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০) কিন্তু এরপরও ইমাম হোসাইন (আ.) কেন মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি তার কতগুলো কারণ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বক্তব্যে পাওয়া যায়। যদি আমরা ঐ কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই,তাহলে আমাদেরকে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করতে হবে।এক : মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তিইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার যে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল,ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার কাছে দেয়া চিঠিতে সেই সন্ধিচুক্তির প্রতি তাঁর নিবেদিত থাকার কথা বলে তাঁর বিরুদ্ধে তা লঙ্ঘন করার যে অভিযোগ মুয়াবিয়া তুলেছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।(মাওসুআতু কালিমাতি ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ২৩৯) কিন্তু প্রশ্ন হলো,মুয়াবিয়া যেখানে কুফায় প্রবেশ করার পর সন্ধিচুক্তির কালি শুকানোর আগেই তা লঙ্ঘন করেছিল এবং তার প্রতি নিবেদিত থাকা তার জন্য আবশ্যক নয় বলে ঘোষণা দিয়েছিল(আল-ইরশাদ, শেখ মুফিদ, পৃ. ৩৫৫)সেখানে কেন ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি মেনে চললেন?এ প্রশ্নের উত্তর কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া যেতে পারে :ক. যদি আমরা মুয়াবিয়ার বক্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে,সে সুস্পষ্টভাবে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘনের কথা বলেনি। কারণ,সে বলেছিল : ‘আমি হাসানকে কতগুলো বিষয়ের ওয়াদা দিয়েছি।’ আর হতে পারে সে যে ওয়াদার কথা বলেছে তা সন্ধিচুক্তির বহির্ভূত কোন বিষয় ছিল যার প্রতি নিবেদিত থাকা মুয়াবিয়ার মতে আবশ্যক ছিল না। আর অন্তত এর ভিত্তিতে সে অজুহাত দেখাত যে,তার পক্ষ থেকে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘিত হয়নি।খ. রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও ইমাম হোসাইন (আ.) এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ ছিল,ঠিক যে রকম তফাৎ ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার ছিল।আসলে মুয়াবিয়া এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিল,যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে কোন অন্যায়-অবিচার,(মুয়াবিয়ার মনোনীত শাসক ও সেনাপতিরা কোনপ্রকার অন্যায় ও হত্যা করতে দ্বিধা করত না। তার গভর্নর বুশর ইবনে আরতাত ইয়েমেনে প্রবেশ করে অসংখ্য মুসলমান নারীকে বন্দি করে বাজারে বিক্রি করে (আল ইসতিয়াব, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪০, সংখ্যা ১৭৫) এবং একযুদ্ধে শিশু-বৃদ্ধসহ ত্রিশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে (আলগারাত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৩৯)। মুয়াবিয়ার মনোনীত গভর্নরদের দ্বারা সংঘটিত হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের বীভৎস ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। দ্রষ্টব্য: তারিখে তাবারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৭৭-৮১, কামিল ফিত তারিখ, ইবনে আছির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬২-১৬৭ ও ৪৫০, তারিখে ইবনে আসাকির, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২২২ ও ৪৫৯; আলইসতিয়াব, পৃ. ৬৫-৬৬; তারিখে ইবনে কাসির, ৭ম খণ্ড, ৩১৯-৩২২; ওয়াফাউল ওয়াফা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪৯৬) প্রতারণা ও ছল-চাতুরির আশ্রয় নিত। এসব প্রতারণার কতক নমুনা ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়েও দেখা যায়। যেমন উসমানের রক্তকে বাহানা হিসেবে তুলে ধরা,তালহা এবং যুবায়েরকে ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা,সিফফিনের যুদ্ধে বর্শার মাথায় কুরআন শরীফ তুলে ধরা এবং ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন শহরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা।অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক পবিত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন,যিনি স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সত্যের পরিপন্থী কোন পথে অগ্রসর হতেন না। যেভাবে ইমাম আলী (আ.) বলেছিলেন : ‘আমি জোর-জবরদস্তি করে বিজয়ী হতে চাই না।’(নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ১২৬)অতএব,এটা স্বাভাবিক যে,ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে যে চুক্তি করেছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) কোনক্রমেই তা লঙ্ঘন করতে পারেন না। এমনকি মুয়াবিয়া তা লঙ্ঘন করলেও ইমামের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।গ. অবশ্যই আমাদেরকে ঐ সময়ের অবস্থা বিবেচনা করে দেখতে হবে। আর এটাও দেখতে হবে যে,ইমাম যদি সন্ধির খেলাফ কাজ করতেন তাহলে কী ঘটত? কারণ,ঐ সময় মুয়াবিয়া মুসলমানদের একচ্ছত্র খলীফা ছিল। আর তার শাসনব্যবস্থা সিরিয়া থেকে শুরু করে মিশর,ইরাক,আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেন তথা গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রতিটি এলাকাতে তার অনুচর ও দালালরা তার খেলাফতের বৈধতার পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতো। এহেন পরিস্থিতিতে ইমামের পক্ষে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না।মুয়াবিয়া,হযরত আলী (আ.)-এর সাথে দ্বন্দ্বের সময় সিরিয়াবাসীদের কাছে নিজেকে উসমান দরদী এবং তাঁর খুনের একমাত্র দাবিদার (প্রতিশোধ গ্রহণকারী) হিসেবে তুলে ধরেছিল। যদিও উসমান হত্যার ঘটনায় সে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে কোন সাহায্যই করেনি।(তারীখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০২) অতএব,এটা সুস্পষ্ট যে,ঐ সময় কেউ তার সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস করত না। এ পরিস্থিতিতে যদি ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করতেন,তাহলে মুয়াবিয়া তাঁকে মুসলিম সমাজে চুক্তি লঙ্ঘনকারী ও বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত করাতো এবং উম্মাহর চিন্তাধারাকে তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করাতো। আর ঐ পরিস্থিতিতে ইমামের আহ্বান মুসলিম জাতির কাছে পৌঁছত না। ইমাম এবং তাঁর সাথিরা এ সময় মুয়াবিয়াকে প্রথম সন্ধি লঙ্ঘনকারী হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু তাঁরা এতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।দুই. মুয়াবিয়ার শক্তিশালী অবস্থানঐ সময় মুয়াবিয়ার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিশেষ করে সিরিয়াবাসীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটাকে কঠিন করে তুলেছিল। কারণ,সিরিয়াবাসী তাকে নবীর সাহাবা,ওহী লেখক এবং ‘মুসলমানদের মামা’ মনে করত। তাদের দৃষ্টিতে,সিরিয়া ও দামেশকে ইসলাম প্রচারে মুয়াবিয়ার ভূমিকাই ছিল মূখ্য।এছাড়া মুয়াবিয়া একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ ছিল। আর তার বয়সও ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.) থেকে বেশি ছিল। এজন্য সে সবসময় ইমামদের কাছে দেয়া চিঠিতে এ দুটি বিষয় উল্লেখ করত এবং নিজেকে খেলাফতের জন্য বেশি উপযুক্ত মনে করত।(আবুল ফারাজ ইসফাহানী, মাকাতিলুত তালিবীয়ীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০। যেমন সে ইমাম হাসানকে একটি পত্রে লিখে : ...তুমি অবশ্যই জান যে, আমি দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব করছি। এ ক্ষেত্রে তোমার থেকে আমি অভিজ্ঞ এবং বয়সেও তোমার চেয়ে বড়।... তাই আমার আনুগত্যের ছায়ায় প্রবেশ কর) অতএব,এটা স্বাভাবিক যে,ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধি লঙ্ঘন করলে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগত।তিন. মুয়বিয়ার রাজনৈতিক কূটচাল ও ধূর্ততাসন্ধির পর যদিও মুয়াবিয়া বনি হাশেম,বিশেষ করে ইমাম আলী (আ.)-এর পরিবারকে কোণঠাসা করার জন্য সকল প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল,এমনকি বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান (আ.)-কে শহীদ করেছিল,(মাকাতিলুত তালিবীয়ীন, পৃ. ১ম খণ্ড, পৃ. ৮০; আল-ইরশাদ, পৃ. ৩৫৭) কিন্তু সে বাহ্যত মানুষদের দেখাত যে,নবী-বংশের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে,মুয়াবিয়া প্রতি বছর এবং প্রতি মাসে ইমাম হাসান (আ.),ইমাম হোসাইন (আ.) এবং আবদুল্লাহ বিন জাফরের জন্য প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন পাঠাত। আর তারাও যেহেতু নিজেদেরকে বায়তুল মালের হকদার মনে করতেন তাই ঐসব উপঢৌকন গ্রহণ করতেন এবং উপযুক্ত জায়গায় সেগুলো খরচ করতেন।(মাওসুআতু কালিমাতিল ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ২০৯ ও ২১০)মুয়াবিয়া নিজেকে নবীর পরিবারের ভক্ত হিসেবে দেখানোর জন্য মৃত্যুর সময়ে স্বীয় পুত্র ইয়াযীদকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে অসিয়ত করেছিল যে,যদি ইমাম আন্দোলন করেন তাহলে যেন তাঁকে হত্যা করা না হয়।(আল-আখবারুত তোয়াল, পৃ. ২২৭; তাজারিবুল উমাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৯)মুয়াবিয়ার এ রকম রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট। কারণ,সে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সন্ধি করে নিজের খেলাফতকে বৈধতা না থাকার সংকট থেকে মুক্তি দান করে এবং মানুষের মাঝে নিজেকে বৈধ খলীফা হিসেবে পরিচিত করায়। আর সে চাইত না যে,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করার মাধ্যমে সে মুসলিম সমাজে ঘৃণিত হোক। এর বিপরীতে সে চেষ্টা করত যে,নবীপরিবারের প্রতি লোকদেখানো ভালোবাসা প্রদর্শন করার মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে নিজের সুনাম বজায় রাখা।আর সে ভাবত যে,এভাবে সে নবীর বংশধরদের নিজের প্রতি ঋণী করছে। ফলে তারা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে তার অনুগত হয়ে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকবে। একবার সে ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে বিপুল পরিমাণে উপঢৌকন পাঠিয়ে খোঁটা দিয়ে বলেছিল,‘এ উপহারগুলো গ্রহণ কর,আর জেনে রাখ যে,আমি হিন্দার ছেলে। খোদার শপথ,এর আগে কেউ তোমাদেরকে এ রকমভাবে দান করেনি। আর আমার পরেও কেউ তোমাদেরকে এভাবে দান করবে না।’ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়াকে দেয়া চিঠিতে তার উপঢৌকনগুলো যে করুণা প্রদর্শনের যোগ্যতা রাখে না তা উল্লেখ করে বলেছেন : ‘খোদার শপথ,তোমার আগের এবং পরের কোন লোকের পক্ষে আমাদের থেকেশ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত কোন ব্যক্তির কাছে উপহার পাঠানো সম্ভব নয় (কেননা,নবুওয়াতের গৃহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন গৃহ নেই)।’(তারীখে ইবনে আসাকির, তারজুমাতুল ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ৭, পাদটীকা ৫)মুয়াবিয়া জানত যে,সে যদি কঠোর নীতি গ্রহণ করে,তাহলে পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যাবে। পরিশেষে মানুষ মুয়াবিয়ার শাসনের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠবে। আর স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম সমাজ আহলে বাইতের পাশে একত্র হবে।ঐ সময়ে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ থেকে বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করত না। কিন্তু ভবিষ্যতে যেহেতু নবী-পরিবারের পক্ষ থেকে কোন বিপদ না আসতে পারে এজন্য এ রকম কলা-কৌশল অবলম্বন করে চলত যাতে অঙ্কুরেই বিপদের বীজ বিনাশ হয়ে যায়।অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার খেলাফতকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলার জন্য প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাতেন। এর সুস্পষ্ট নমুনা হলো মুয়াবিয়াকে লেখা চিঠিতে মুয়াবিয়ার সৃষ্ট বেদআত ও তার কৃত অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা(বিহারুল আনওয়ার, ৪৪ তম খণ্ড, পৃ. ২১২) এবং যুবরাজ হিসেবে ইয়াযীদের মনোনয়নের বিরোধিতা করা।(তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮; আল-ইমামাত ওয়াস সিয়াসাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৬) অবশ্য ইমাম হোসাইন (আ.) ভালো করেই জানতেন যে,যদি তিনি মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন,তাহলে সাধারণ মানুষ মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক কলা- কৌশলের কারণে তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিবে না। উপরন্তু সরকারি অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে মুয়াবিয়াকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করবে।চার. তৎকালীন সময়ের মুসলমানদের চিন্তাগত ও সামাজিক অবস্থাযদিও একদল কুফাবাসী ইমাম হাসান (আ.) শহীদ হওয়ার পর সমবেদনা জ্ঞাপন করে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে চিঠি লিখেছিল এবং নিজেদেরকে ইমামের নির্দেশের অপেক্ষাকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল(তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৮),কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ভালোভাবেই জানতেন যে,সিরিয়ায় মুয়াবিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কুফা শহরও উমাইয়া গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছে। এছাড়া কুফাবাসী ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে অনেকবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। যখন সমগ্র ইসলামী ভূখণ্ডের ওপর মুয়াবিয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি বহাল হয়েছে তখন যদি তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তাহলে পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু ঘটবে না। আর যে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য তাঁর সাথে রয়েছে তারাও অযথা নিহত হবে এবং তিনি বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত হবেন। পরিশেষে তিনি কোন ফলাফল ছাড়াই শহীদ হবেন এবং তাঁর রক্ত বৃথা যাবে। কিন্তু ইয়াযীদের শাসনামলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ এর বিপরীত ছিল।(এ প্রবন্ধটি ‘আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)প্রচারে বিধি তুমার ধর্ম কি

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদআশুরার প্রেক্ষাপট: ‏কিভাবে মহানবীর ‎(সা) ‏কথিত ‎'উম্মতের' ‏হাতেই শহীদ হন ইমাম হোসাইন ‎(আ) ?কীভাবে নবীর ‎(সা.) ‏উম্মতই নবীর ‎(সা.) ‏সন্তানকে হত্যা করলো ‎(!)? -এ জিজ্ঞাসা সব যুগের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। আর এ ধরনের প্রশ্ন জাগাটাও খুব স্বাভাবিক।কারণ, ‏ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏মর্মান্তিক শাহাদাত এক বিষাদময় ঘটনা কিংবা আল্লাহর পথে চরম আত্মত্যাগের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্তই শুধু নয়, ‏এ ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে বড়ই অদ্ভুত মনে হবে। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)-এর তিরোধানের মাত্র ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।আর এ হত্যাকাণ্ডের নায়ক ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏কথিত উম্মত যারা রাসূল এবং তাঁর বংশকে ভালবাসে বলে ইতোমধ্যেই খ্যাতিলাভ করেছিল। তাও আবার রাসূলের ‎(সা.) ‏সেইসব শত্রুর পতাকাতলে দাঁড়িয়ে মুসলমানরা রাসূলের ‎(সা.) ‏সন্তানের উপর এ হত্যাকাণ্ড চালায় যাদের সাথে কি-না রাসূলুল্লাহ ‎(সা.)মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে যুদ্ধ করে গেছেন! ‏মক্কা বিজয়ের পর যখন চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার তখন ইসলামের ঐ চির শত্রুরাও বাধ্য হয়েই নিজেদের গায়ে ইসলামের একটা লেবেল লাগিয়ে নেয়। তাই বলে ইসলামের সাথে তাদের শত্রুতার কোনো কমতি ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের উক্তিটি সুপ্রযোজ্য । তিনি বলেছিলেন-استسلموا و لم یسلموا“ ‏তারা মুসলমান হয়নি, ‏ইসলাম গ্রহণের ভান করেছিল মাত্র।”আবু সুফিয়ান প্রায় ২০ বছর ধরে রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏সাথে যুদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, ‏শেষের দিকে ৫/৬ বছর সে ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং ফেতনা সৃষ্টিতে সরদারের ভূমিকা পালন করে। মোয়াবিয়া তার পিতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতায় নামে। এভাবে আবু সুফিয়ানের দল অর্থাৎ উমাইয়ারা ইসলামের চরম শত্রুতে পরিণত হয়। অথচ আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে প্রত্যক্ষ করি যে, ‏রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏ওফাতের মাত্র দশ বছর পরে সেই মোয়াবিয়া এসে ইসলামী শাসনযন্ত্রের শীর্ষে আরোহণ করে শাম বা সিরিয়ার গভর্নর হয়ে বসে। আরও বিশ বছর পরে ইসলামের এই শত্রু হয়ে বসলো স্বয়ং মুসলমানদের খলীফা! ‏এখানেই শেষ নয়, ‏রাসূলের ‎(সা.) ‏মৃত্যুর পর পঞ্চাশ বছর পর এবার মুসলমানদের খলীফা হল মোয়াবিয়া-পুত্র ইয়াজিদ। আর এই ইয়াজিদ নামায, ‏রোযা, ‏হজ্ব যাকাত তথা ইসলামের বিধি-বিধান পালনকারী মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে অর্ধ-শতাব্দী গড়াতে না গড়াতেই রাসূলের ‎(সা.) ‏সন্তানকে হত্যা করলো। এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মাথা বিগড়ে গেলেও ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। ঐ সব মুসলমানরা যে ইসলামকে পরিত্যাগ করেছিল তা নয়, ‏বরং ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏প্রতি তাদের ভক্তির অভাব ছিল তারও কোনো প্রমাণ মেলে না। কারণ, ‏ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏প্রতি বীতশ্রদ্ধ হলে তারা হয়তো বলতে পারতো যে,(নাউযুবিল্লাহ) ‏ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছেন। সুতরাং তাঁকে হত্যা করতে কোনো বাধা নেই। বরং তারা নিশ্চিতভাবে ইয়াজিদের ওপর ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏সহস্র গুণে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় বিশ্বাস করতো। তাহলে এখন প্রশ্ন হল যে, ‏প্রথমতঃ কিভাবে মুসলিম শাসন ক্ষমতা ইসলামের ঘোর শত্রু আবু সুফিয়ানের দলের হাতে পড়লো? ‏দ্বিতীয়তঃ যে মুসলমানরা ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏রক্তের মূল্য যথার্থভাবে অবগত ছিল তারা কিভাবে ইমাম হোসাইনকে ‎(আ.) ‏হত্যা করলো? (কারবালায় ইমামের পক্ষে প্রায় ১০০ জন ও বিপক্ষে ইয়াজিদ বাহিনীর প্রায় ২০-৩০ হাজার সেনা সমাবেশের আর্ট ছবি) ‏প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে, ‏উমাইয়াদের মধ্যে প্রথমভাগে মুসলমান হবার গৌরব অর্জন করেছিল এবং ইসলামের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করতো না,বরং ইসলামের জন্যে অনেক অবদানই রেখেছিল এমন ব্যক্তির ‎(অর্থাৎ ওসমানের) ‏খলীফা পদ লাভই ছিল এর মূল কারণ। এর ফলেই উমাইয়ারা সর্ব প্রথম মুসলিম খেলাফত লাভ করার সুযোগ পায়। আর,এ সুযোগের অপব্যবহার করে তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে নিজেদের মুলুকে বা ব্যক্তিগত রাজত্বে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বয়ং মারওয়ানই এর জ্বলন্ত উদাহরণ। অবশ্য দ্বিতীয় খলিফার শাসনামলেই মোয়াবিয়াকে শাম বা সিরিয়ার গভর্নর হিসেবে নিযুক্তির মাধ্যমে ইসলামী শাসনযন্ত্রে উমাইয়াদের উত্থান ঘটে। পরবর্তীতে অন্য সব গভর্নরের পদে রদবদল করা হলেও মোয়াবিয়াকে তার পদে বহাল রাখা হয়। এটাই ছিল মুসলিম শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে উমাইয়াদের হীন বাসনা চরিতার্থকরণের পথে প্রথম অনুকূল ইঙ্গিত।উমাইয়ারা তৃতীয় খলিফা ওসমানের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়ায় ও গোলযোগ সৃষ্টি করে। এতে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শেষ পর্যন্ত মোয়াবিয়া তার সে লালসা পূরণের জন্য মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল। সে নিজের পক্ষ থেকে ওসমানকে ‎‘মজলুম খলীফা’,‘ ‏শহীদ খলীফা’ ‏প্রভৃতি সুবিধামত স্লোগান দিয়ে প্রচারকার্য শুরু করলো এবংনিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে আদাজল খেয়ে লেগে গেল। সে ওসমানের রক্তভেজা জামা সবার সামনে মেলে ধরে তারঅসহায়ত্বকে গতিশীল রূপ দেয় এবং বলে বেড়ায়,‘যেহেতু ওসমানের হত্যার পর আলী ‎(আ.) ‏খলীফা হয়েছেন, ‏তাছাড়া ওসমানের হত্যাকারীদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন-তাই ওসমান হত্যার জন্য মূলতঃ আলীই ‎(আ.) ‏দায়ী।’ ‏এই বলে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে যাতে মানুষের অনুভূতিকে আকৃষ্ট করতে পারে। তার এ প্রচেষ্টা সফলও হয়। কারণ, ‏তার কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে অনেকেই চোখের পানি ঝরায় ও শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে মজলুম খলীফার রক্তের প্রতিশোধ নিতে যেই কথা-সেই কাজ- ‏এইরুপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তারা মোয়াবিয়াকে আশ্বাস দেয়ঃ আমরা প্রস্তুত আছি, ‏তুমি যা বলবে তাই আমরা পালন করতে রাজী আছি। এভাবে পদলোভী স্বার্থপর মোয়াবিয়া মুসলমানদেরকে নিয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। ইসলামের ঊষালগ্নের প্রহেলিকাময় ঘটনাবলী এবং নবীর ‎(সা.) ‏উম্মতের হাতে নবীর ‎(সা.) ‏সন্তানের হত্যার কারণইতিহাসে বেশকিছু বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন ঘটনা রয়েছে যেগুলোর কারণ এবং সূত্র খুঁজতে গিয়ে অনেকেই হয়তো বিপাকে পড়তে পারেন। এগুলোর মধ্যে একটি হল ইসলামের ঊষালগ্নেই সমসাময়িক নানা মতভেদ ও দ্বন্দ্ব।[কারবালা ময়দানের এখানেই ছিল ইমাম হুসাইনেরর ‎(আ) ‏একমাত্র জীবিত পুত্র ও নতুন ইমাম হযরত জাইনুল আবেদীন ‎(আ)'র তাবু। অসুস্থতার কারণে তিনি কারবালার যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তাঁর বেঁচে যাওয়াটাও ছিল বিস্ময়কর এবং অলৌকিক] ‏আরেকটি ঘটনা হল ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏আন্দোলন এবং বিদ্রোহ। আত্মীয়-অনাত্মীয়,চেনা-অচেনা নির্বিশেষে সবাই কুফার লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার ইস্যু টেনে ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏কে বিরত রাখতে চেষ্টা করছিল। তারা যে ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই এ চেষ্টা চালিয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রহস্যের বিষয় হল যে, ‏ইমাম হোসাইনও ‎(আ.) ‏তাদের চিন্তাধারাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেননি। অথচ মক্কা,কারবালা এবং কুফার পথে তার বিভিন্ন ভাষ্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, ‏ইমাম হোসাইনের ‎(আ.)ও একটা স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ছিল যা অনেক ব্যাপক ও দূরদর্শী। তাঁর হিতাকাঙ্খীদের ভাবনা কেবল নিজের এবং পরিবার-পরিজনদের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। অথচ, ‏ইমাম হোসাইনের ‎(সা.) ‏চিন্তা ছিল দীন,ঈমান ও আকীদার নিরাপত্তাকে নিয়ে। তাই, ‏মারওয়ানের এক নসিহতের জবাবে ইমাম হোসাইন ‎(সা.) ‏বলেনঃو علی الاسلام السلام اذ قد بلیت الامة براع مثل یزید‘‘ ‏ইয়াজিদের মতো কেউ যদি উম্মতের শাসক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের বিদায় ।’’মোয়াবিয়া ও ইয়াজিদের ইসলামী শাসন ক্ষমতা লাভ এবং ইসলামে অবিচল মুসলমানদের নিয়ে যথাক্রমে হযরত আলী ‎(আ.) ‏এবং ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী গঠন ছিল ইসলামের ঊষালগ্নের প্রহেলিকাময় ঘটনাবলীর অন্যতম। এখানে দুটি বিষয়কে খতিয়ে দেখা দরকার। তাহলেই ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা,এর কারণ,লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উদঘাটন করা আমাদের পক্ষে সহজতর হবে। প্রথমতঃ আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ইসলাম ও কোরআনের সাথে উমাইয়া বংশের তীব্র সংঘাত এবং দ্বিতীয়তঃ ইসলামী শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে তাদের সফলতা। ইসলামের সাথে উমাইয়াদের এহেন শত্রুতাসুলভ আচরণের কারণ হল যে,একাদিক্রমে তিন বংশ ধরে বনি হাশিম ও বনি উমাইয়ার মধ্যে গোষ্ঠীগত কোন্দল চলে আসছিল। অতঃপর যখন বনি হাশিম ইসলাম ও কোরআনের ধারক ও বাহক হবার গৌরব লাভ করে তখন বনি উমাইয়ারা ঈর্ষায় পুড়ে মরতে থাকে। ফলতঃ তারা বনি হাশিমকে সহ্য করতে পারলো না,সাথে সাথে ইসলাম ও কোরআনকেও না। দ্বিতীয় কারণ হলঃ তৎকালীন কোরাইশ গোত্রের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে উমাইয়াদের পার্থিব জীবনধারার সাথে ইসলামী বিধানের অসামঞ্জস্য ও বৈপরীত্য। ‎‌ইসলামী নীতিমালায় তাদের প্রভুত্বমূলক প্রভাব ক্ষুণ্ণ হয়। তাদের ভাব ও মন-মানস ছিল সুবিধাবাদী ও বস্তুবাদী। উমাইয়াদের যথেষ্ট বুদ্ধি থাকলেও তাদের ঐ বস্তুবাদী মানসিকতার কারণে খোদায়ী বিধান থেকে তারা উপকৃত হতে পারেনি। কারণ ঐশী শিক্ষাকে সে-ই অবনত মস্তকে গ্রহণ করতে পারে যার মধ্যে মর্যাদাবোধ, ‏উন্নত আত্মা এবং মহত্বের আনাগোনা রয়েছে এবং যার মধ্যে সচেতনতা ও সত্যান্বেষী মনোবৃত্তি নিহিত আছে। অথচ উমাইয়ারা অতিশয় দুনিয়া চর্চা করতে করতে এসব গুণগুলোর সব ক’ ‏টি হারিয়ে বসেছিল। অগত্যা তারা ইসলামের সাথে শত্রুতায় নেমে পড়ে। পবিত্র কুরআনেও এ দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সত্যকে মেনে নেবার সক্ষমতা যাদের আছে তাদেরকে ইশারা করে কুরআনে বলা হয়েছেঃ ‎لِیُنْذِرَ مَنْ کَانَ حَیًّا‘ ‏যাতে তিনি ‎(রাসূল) ‏সচেতনদের সতর্ক করতে পারেন।’’ (ইয়াসীনঃ ৭০) إِنَّمَا تُنْذِرُ مَنِ اتَّبَعَ الذِّکْرَকেবল তাদেরকেই সতর্ক করো যারা উপদেশ মেনে চলে’ ‏। ‎(ইয়াসীনঃ ১১) وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِینَ‘ ‏আমরা কোরআন অবতীর্ণ করি ‎,যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত। আর তা জালেমদের ক্ষতিই বাড়ায়। ‎’ ( ‏বনী ইসরাঈলঃ ৮২) لِیَمِیزَ اللَّهُ الْخَبِیثَ مِنَ الطَّیِّبِ‘ ‏এটি এজন্য যে,আল্লাহ কুজনদেরকে সুজন হতে পৃথক করবেন।’ (আনফাল ‎: ‏৪৮)মোদ্দাকথা,আল্লাহর রহমত থেকে তারাই উপকৃত হতে পারবে যাদের প্রস্তুতি ও যোগ্যতা রয়েছে। এটি একটি খোদায়ী নীতি। আর উমাইয়াদের মধ্যে সে প্রস্তুতি না থাকায় তারা ইসলাম এবং কোরআনের অমিয় সুধা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।রাসূলের ‎(সা.) ‏চাচা হযরত আব্বাস এবং আবু সুফিয়ানের মধ্যে এক সাক্ষাতে তাদের মধ্যকার কথোপকথন থেকে আবু সুফিয়ানের নিরেট ও অন্ধ আত্মার প্রকাশ ঘটে।কিন্তু উমাইয়া দল কিভাবে চিরকাল শত্রুতা করেও হঠাৎ করে একটা তৎপর ইসলামী দল হিসাবে আত্ম প্রকাশ করলো-উপরন্তু তারা ইসলামের শাসন ক্ষমতাকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে সক্ষম হলো? ‏এ প্রশ্নের জবাবের শুরুতে একটা বিষয় উল্লেখ্য । তাহলো-নবনির্মিত ও নব প্রতিষ্ঠিত কোনো জাতি হঠাৎ করেই শক্তিশালী ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, ‏চাই সে ঐক্য যত শক্তিশালীই হোক না কেন। একটু চিন্তা করলে আমাদের সামনে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হবে যে, ‏আরবে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত মজবুত হতে না হতেই দ্বিতীয় খলীফার আমলে ব্যাপক দেশজয়ের ফলে ইসলামের অতি দ্রুত প্রচার ও প্রসার ঘটে। তাই ইসলাম তার স্বাভাবিক গতিতে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েনি। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে দেখা দেয় নানা দ্বন্দ্ব-বিভেদ এবং গড়ে ওঠে অসংহত মুসলিম সাম্রাজ্য। এর পাশাপাশি আরবের ইসলামী সংস্কৃতিতে অনারব ও অনৈসলামী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ করে। ফলে অতি শীঘ্রই আরব তার স্বাতন্ত্র্য ও ইসলামী সাংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলে।কয়েক যুগ আগের কারবালা সেযুগের নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ‎‘ ‏লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ -এর পতাকাতলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল বটে এবং জাতি-বর্ণের ব্যবধানকে দ্রুত মোজেজার ন্যায় মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল বটে কিন্তু বিভিন্ন গোত্র, ‏ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ,রীতি-নীতি,আদব-কায়দা এবং ভিন্ন আকীদা-বিশ্বাসে গড়ে ওঠা মানুষগুলোর দীন ও দীনের আইন-কানুন মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সমান যোগ্যতা ও প্রস্তুতি ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে একজন গাঢ় ঈমানদার হলে আরেকজন যে দুর্বল ঈমানের অধিকারী ছিল একথা অস্বীকার করার জো নেই। আরেকজন হয়তো সন্দেহ ও বিভ্রান্তিতে নিপতিত ছিল এবং কেউ কেউ অন্তরে কুফরি মনোভাবও হয়তো পোষণ করতো। এ ধরনের একটা জনসমষ্টিকে বছরের পর বছর তথা শতাব্দীর পর শতাব্দীঅবধি একটা নির্দিষ্ট সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ধরে রাখা সহজ কথা নয়।পবিত্র কোরআনে বহুবার মোনাফিকদের কথা উল্লেখ করেছে। মোনাফিকদের ব্যাপারে সতর্ক করার ধরন দেখে বোঝা যায় যে, ‏এরা মারাত্মক। কোরআন মুসলমানদেরকে এই গুরুতর বিপদ থেকে রক্ষা করতে চায়। আব্দুল্লাহ ইবনে সালুল মদীনার মোনাফিকদের শীর্ষে ছিল। কোরআন‘ ‏মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ ‏এর কথা উল্লেখ করেছে যারা দায়ে পড়ে কিংবা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় মুসলমানের তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়েছে। যাহোক, ‏তারা যাতে আস্তে আস্তে খাঁটি মুসলমান হতে পারে সেদিকে তাদেরকে উৎসাহিত করা উচিত। বায়তুলমাল থেকে তাদেরকে সাহায্য করতে হবে যাতে অন্ততপক্ষে তাদের অনাগত বংশধররা খাটি মুসলমান হয়ে গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে নিয়োগ করা মারাত্মক ভুল। রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏তাঁর দয়া ও সদাচরণ থেকে কাউকে বঞ্চিত করতেন না। এমন কি মোনাফিক এবং‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ ‏দেরকেও না। কিন্তু তাদের প্রতি সতর্কাবস্থা তিনি কখনো বর্জন করেননি। আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏জীবদ্দশায় কোনো দুর্বল ঈমানদার,মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম কিংবা মোনাফিক উমাইয়াদের কেউই ইসলামী শাসনযন্ত্রের ধারে কাছেও ঘেষতে পারেনি। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল,রাসূলের ‎(সা.) ‏মৃত্যুর পর থেকে বিশেষ করে তৃতীয় খলিফারআমলে তারাই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো কুক্ষিগত করে। রাসূলের ‎(সা.) ‏জীবদ্দশায় মারওয়ান ও তার বাবা হাকাম মক্কা ও মদীনা থেকে নির্বাসন প্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এ সময় তারা ফিরে আসার সুযোগ পায়। প্রথম দুই খলীফার আমলেও তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা সংক্রান্ত তৃতীয় খলিফার অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ঐ মারওয়ানই ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি এবংওসমান হত্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।তৃতীয় খলিফার সময় উমাইয়ারা বড় বড় পদে আসীন এবং বায়তুল মালে হস্তক্ষেপ করে। যেটুকু তাদের ঘাটতি ছিল তা হল ধার্মিকতা। কিন্তু তৃতীয় খলিফার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে অদ্ভুত এক প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির মাধ্যমে‘ ‏ধার্মিক’ ‏হবার গৌরবটাও তারা হাতে পায় এবং সেটাকেও তাদের লক্ষ্য চরিতার্থ করার কাজে নিয়োগ করে। আর এর বদৌলতেই মোয়াবিয়া দীন ও দীনের শক্তির নামে হযরত আলীর ‎(আ.) ‏মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ও বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে মোয়াবিয়া আলেমদেরকে ভাড়া করে আরও একটা কৃতিত্ব বাড়ায়। অর্থাৎ এখন থেকে সে চারটি দিককে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে মুসলমানদের শাসন-মঞ্চে আবির্ভূত হয়। এগুলো ছিলঃ ‎(১) ‏বড় বড় রাজনৈতিক পদ ‎(২) ‏ধন-দৌলতের প্রাচুর্য ‎(৩) ‏অতিমাত্রায় ধার্মিকতা এবং ‎(৪) ‏দরবারী আলেম সমাজ। দামেস্কের জাইনাবিয়া মসজিদ ও হযরত জাইনাব ‎(সা)'র পবিত্র মাজার ‎(পুরোণো ফাইল ছবি) ‏তৃতীয় খলিফার যুগে উমাইয়াদের রাজনৈতিক উত্থান এবং বায়তুলমালের ছড়াছড়ি দেখে দীনদার এবং দুনিয়াদার উভয়পক্ষই ক্ষেপে ওঠে। দুনিয়াদাররা তাদের চোখের সামনে উমাইয়াদের ভোগ-বিলাস সহ্য করতে পারেনি কারণ তারা তাদের নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে সচেতন ছিল। আর দীনদাররা দেখছিল যে, ‏ইসলামী সমাজের আশু ধ্বংস অনিবার্য। এ কারণেই দেখা যায় যে,আমর ইবনে আস যেমন এর বিরোধিতায় নামে তেমনি আবুজর বা আম্মারও এর বিরোধিতা করেন। আমর ইবনে আস বলেঃ‘ ‏আমি এমন কোনো রাখালের পার্শ্ব অতিক্রম করিনি যাকে উসমানের হত্যার জন্যে উস্কানি দেই নি’। হযরত আলী ‎(আ.) ‏জামালের যুদ্ধে বলেন ‎:لعن الله اولانا بقتل عثمان‘ ‏ওসমান হত্যা করতে আমাদের মধ্যে যারা অগ্রণী ছিল আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দিক।’যখন হযরত ওসমান অবরোধের মধ্যে ছিলেন তখন হযরত আলী তাকে বিভিন্ন উপদেশও দিক-নির্দেশনার পাশাপাশি তাকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করেছেন। কিন্তু মোয়াবিয়া এই ফেতনা-ফ্যাসাদের সূচনা ও পরিণতি সম্বন্ধে ভালভাবেই অবগত ছিল। তাই খলিফা ওসমান তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেও মোয়াবিয়া তার বিশাল বাহিনী নিয়ে সিরিয়াতেই বসে থাকলো। কারণ সে বুঝেছিল যে, ‏জীবিত ওসমানের চেয়ে মৃত ওসমানই তার জন্যে বেশি সুবিধাজনক। তারপর যখন ওসমানের হত্যার সংবাদ শুনলো অমনি হায় ওসমান! ‏হায় ওসমান! ‏বলে চীৎকার করে উঠলো। খলিফা ওসমানের রক্ত ভেজা জামা লাঠির মাথায় করে ঘুরালো,মিম্বারে বসে শোক গাঁথা গেয়ে নিজেও যেমন কাঁদলো তেমনি অজস্র মানুষের চোখের পানি ঝরালো, ‏আর কোরআনের এই আয়াত নিজের স্লোগানে পরিণত করল: وَمَن قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِیِّهِ سُلْطَانًا ‘ ‏যে মজলুম অবস্থায় নিহত হয় তার উত্তরসূরিকে আমরা কর্তৃত্ব দান করেছি’ ( ‏বনী ইসরাইল ‎: ‏৪৪ ‎) ‏ফলে ওসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্যে মোয়াবিয়া ধন-দৌলত ও সরকারী পদগুলোর সাথে ধার্মিকতাকেও যুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের একটা বড় অংশের অধিকর্তা হয়ে বসে। অন্যকথায়, ‏ধার্মিকতার শক্তিকে রাজনীতি ও ধন-দৌলতের সাথে যোগ করে জনগণ তথা হযরত আলীর ‎(আ.) ‏অনুসারীদেরকে সংকটাবস্থায় নিক্ষেপ করে। তাদেরকে বস্তুগত দিক থেকেও যেমন সংকটে ফেলে তেমনি আত্মিক ও মানসিকভাবেও। অবশ্য কেবল ধার্মিকতা মজলুমের পক্ষ হয়েই অগ্রসর হয়। কিন্তু যদি জনগণের অজ্ঞতা এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতারণার বলে ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয় তাহলে আর দুর্দশার শেষ নেই। আল্লাহ আমাদেরকে সেদিনের হাত থেকে বাঁচান যেদিন ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হবে।এই ছিল ইসলামী খেলাফত লাভ ও আলেম সমাজের ওপর মোয়াবিয়ার কর্তৃত্ব লাভ করার সংক্ষিপ্ত কাহিনী,যা তিনটি জিনিসের সমন্বয়ে সম্ভব হয়েছিল। যথাঃ উমাইয়াদের, ‏বিশেষ করে মোয়াবিয়ার কূটবুদ্ধি, ‏পূর্ববর্তী খলীফাদের সরলতা যারা এদেরকে ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় স্থান দিয়েছিল আর জনগণের অজ্ঞতা ও মূর্খতা।মোয়াবিয়া তথা উমাইয়ারা দুটো বিষয়কে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়;(১) ‏জাতিগত ব্যবধান সৃষ্টি যার ভিত্তিতে আরব,অনারবের চেয়ে অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হতো।(২) ‏গোত্রীয় ব্যবধান সৃষ্টি যার ভিত্তিতে আব্দুর রহমান ইবনে আউফের মতো লোকেরা লাখপতি হয় অথচ ফকীররা ফকীরই থেকে যায়।আলী ‎(আ.) ‏দুনিয়া ত্যাগ করলে মোয়াবিয়া খলীফা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের সাথে সে দেখতে পেল যে,তার ধারণাকে বদলে দিয়ে মৃত্যুর পরেও হযরত আলী ‎(আ.) ‏একটা শক্তি হয়েই বহাল রয়ে গেছেন। মোয়াবিয়ার ভাব-লক্ষণ দেখে বোঝা যেত যে,এ কারণে সে বড়ই উদ্বিগ্ন ছিল। তাই মোয়াবিয়া হযরত আলীর ‎(আ.) ‏বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার যুদ্ধে নামে। আদেশ জারী করা হলো যে, ‏মিম্বারে এবং খোতবায় হযরত আলী ‎(আ.) ‏কে অভিশাপ দিতে হবে। হযরত আলীর ‎(আ.) ‏অন্যতম সমর্থকদেরকে বেপরোয়াভাবে হত্যা করা হলো এবং বলা হলো যে, ‏প্রয়োজনে মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে হলেও তাদেরকে বন্দী করবে যাতে হযরত আলীর ‎(আ.) ‏গুণ-মর্যাদা প্রচার না হয়। পয়সা খরচ করে হযরত আলীর ‎(আ.) ‏শানে বর্ণিত হাদীসগুলো জাল করে উমাইয়াদের পক্ষে বর্ণনা করা হয়। তবুও বরাবরই উমাইয়া শাসনের জন্যে হযরত আলীর সমর্থকরা একটা হুমকি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।উমাইয়া শাসনামলের বিশ্লেষণ আমাদেরকে কেবল বিস্ময়াভিভূতই করে না বরং আমাদের জন্যে দিক নির্দেশনা বের হয়ে আসে। এটা যেনতেন কোনো ব্যাপার নয় যে, ‏চৌদ্দশ’ ‏বছর আগের ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি লাভ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাব। কারণ,চৌদ্দশ বছর আগের ইতিহাসের ঐ খণ্ড অধ্যায়ে ইসলামের মধ্যে যে বিষক্রিয়া সংক্রমিত হয়েছিল তা থেকে মুক্তির আশা সুদূর পরাহত। তাই এ নিয়ে গবেষণা করলে বরং আমাদের লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি নেই। উমাইয়াদের ঐ বিষাক্ত চিন্তার উপকরণকে ইসলামী চিন্তাধারার সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। ইসলামের খাঁটি রূপ দেখতে হলে এসব ভেজাল উপকরণের অপসারণ দরকার। খোদা না করুন,আজ আমরা যারা দিবারাত্রি উমাইয়াদের গালি দেই তাদের মধ্যেও হয়তো উমাইয়া চিন্তাধারা বিদ্যমান। অথচ আমরা তাকে একবারে বিশুদ্ধ ইসলাম বলে মনে করি।মোয়াবিয়া যখন দুনিয়া ত্যাগ করে তখন ইতোমধ্যে সংযোজিত কিছু বিদআত প্রথার সাথে আরও কয়েকটি প্রথার চলন করে যায়। যেমন ‎:এক ‎. ‏হযরত আলীকে ‎(আ.) ‏অহরহ অভিসম্পাত করাদুই ‎. ‏টাকার বিনিময়ে হযরত আলীর ‎(আ.) ‏বিরুদ্ধে হাদীস জাল করা।তিন ‎. ‏প্রথমবারের মতো ইসলামী সমাজে বিনাদোষে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করার অবাধ নীতি চালু করা। এছাড়া সম্মানীয়দের সম্মান খর্ব করা এবং হাত-পা কেটে বিকল করে দেয়া।চার ‎. ‏বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা। যে প্রথা পরবর্তী খলীফারাও অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করে। এসব অমানবিক প্রথার চলন মোয়াবিয়াই চালু করে যায়। সে ইমাম হাসান ‎(আ.),মালেক আশতার, ‏সা’ ‏দ ইবনে ওয়াক্কাছ প্রমুখকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে।পাঁচ ‎. ‏খিলাফতকে নিজের খান্দানে আবদ্ধ রেখে রাজতন্ত্র প্রথা চালু করা এবং ইয়াজিদের মতো অযোগ্য ব্যক্তিকেও খলীফা পদে মনোনীত করা।ছয় ‎. ‏গোত্র বৈষম্যের স্তিমিতপ্রায় আগুনকে পুনরায় অগ্নিবৎ করা।এগুলোর মধ্যে হযরত আলীকে ‎(আ.) ‏অভিসম্পাত করা,হাদীস জাল করা এবং ইয়াজিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ ছিল মোয়াবিয়ার কার্যকলাপের অন্যতম। রূপান্তরিতইয়াজিদ ছিল মূর্খ ও নির্বোধ। সাধারণতঃ খলীফার পুত্রদের মধ্যে যাকে ভাবী খলীফা হিসাবে মনোনীত করা হতো তাকে বিশেষ শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হত;যেমন আব্বাসীয়দের মধ্যে প্রচলন ছিল। কিন্তু ইয়াজিদ বড় হয় মরুভূমিতে রাজকীয় বিলাসিতায়। দুনিয়ার খবরও সে রাখতো না;পরকালেরও না। মোটকথা খলীফা হবার বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও তার ছিল না। ওসমানের সরলতার সুযোগে বায়তুলমাল লুণ্ঠিত হয়েছিল,বড় বড় পদগুলো অযোগ্যদের হাতে চলে গিয়েছিল। কিংবা মোয়াবিয়া হযরত আলীর ‎(আ.) ‏বিরুদ্ধে অভিসম্পাত দেয়া,হাদীস জাল করা, ‏বিনা দোষে হত্যা, ‏বিষ প্রয়োগ,খেলাফতকে রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করা প্রভৃতি প্রথা চালু করেছিল। কিন্তু ইয়াজিদের যুগে এসে ইসলাম আরো বিপর্যস্ত হতে থাকে। দেশ-বিদেশের দূত এসে সরাসরি ইয়াজিদের কাছে যেত। কিন্তু,অবাক হয়ে দেখতো যে,রাসূলুল্লাহর ‎(সা.) ‏আসনে এমন একজন বসে আছে যার হাতে মদের বোতল,আর পাশে বসিয়ে রেখেছে রেশমী কাপড় পরা বানর। এরপরে ইসলামের ইজ্জত বলতে আর কি-বা থাকতে পারে? ‏ইয়াজিদ ছিল অহংকারী,যৌবনের পাগল,ক্ষমতালোভী এবং মদ্যপ। এ কারণেই ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏বলেছিলেনঃ‘ ‏যদি ইয়াজিদের মতো দুর্ভাগা উম্মতের শাসক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের ইতি টানতে হবে। ইয়াজিদ প্রকাশ্যে খোদাদ্রোহিতায় নামে। অন্য কথায়,এতোদিনের গোপনতার পর্দা ছিন্ন করে ইয়াজিদ উমাইয়াদের আসল চেহারাটা প্রকাশ করে দেয়। ইসলাম যদি জিহাদ করার আদেশ দিয়ে থাকে-যদি অন্যায়ের গলা চেপে ধরার আদেশ দিয়ে থাকে তাহলে এটাই ছিল তা পালনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তা নাহলে,এরপর আর কি নিয়ে ইসলামের দাবী উত্থাপন করার থাকে?কাজেই,যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, ‏ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏কেন বিদ্রোহ করতে গেলেন তাহলে একই সাথে তার এ প্রশ্নও করা উচিত যে,রাসূলুল্লাহ ‎(সা.) ‏কেন আপোষহীন বিদ্রোহ করেছিলেন কুফরের বিরুদ্ধে ‎? ‏কিংবা,হযরত ইবরাহীম ‎(আ.) ‏কেন একা হয়েও নমরুদের বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন? ‏আর কেনই বা হযরত মূসা ‎(আ.) ‏একমাত্র সহযোগী ভ্রাতা হারুনকে নিয়ে ফেরাউনের রাজ প্রাসাদে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন? ‏এসবের জবাব খুবই স্পষ্ট যা ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। নাস্তিকতা এবং খোদাদ্রোহিতাকে সমূলে উৎপাটন করাই ছিল এসব কালজয়ী মহা পুরুষদের মূল উদ্দেশ্য । আর নাস্তিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে বস্তুগত সাজ-সরঞ্জাম না হলেও চলে। কারণ,স্বয়ং আল্লাহই তাদের সহায়। তাই ইমাম হোসাইন ‎(আ.)ও উমাইয়া খোদাদ্রোহিতা এবং ইয়াজিদী বিচ্যুতিকে ধূলিসাৎ করে দেবার জন্যেই একবারে অসহায় অবস্থায় পড়েও বিদ্রোহে নামেন। প্রকৃতপক্ষে তার এ পদক্ষেপ ছিল পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলদেরই ‎(আ.) ‏অনুকরণ। বুদ্ধিজীবীদের মতে,বিদ্রোহ তখনই মানায় যখন বিদ্রোহীদের অন্ততপক্ষে সমান সাজ-সরঞ্জাম এবং শক্তি থাকে। কিন্তু,ঐশী-পুরুষদের বেলায় আমরা এই যুক্তির কোনো প্রতিফলন দেখি না। বরং তারা সবাই একবারে খালি হাতে তৎকালীন সর্ববৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ইমাম হোসাইন ‎(আ.)ও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নন। তাছাড়া ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏যদি সেদিন ইয়াজিদ বাহিনীর সমান এক বাহিনী নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতেন তাহলে তার এ অসামান্য বিপ্লব ঐশী দ্যুতি হারিয়ে অতি নিষ্প্রভ হয়ে পড়তো। এই দর্শন প্রতিটি ঐশী বিপ্লবের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল।মানব সমাজে সংঘটিত অজস্র বিপ্লবের মধ্যে ঐশী বিপ্লবকে পৃথক মনে করার দুটি মাপকাঠি রয়েছে:এক ‎. ‏ঐ বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিচার। অর্থাৎ এসব বিপ্লব মনুষ্যত্বকে উন্নত ও উত্তম করতে,মানবতাকে মুক্তি দিতে,একত্ববাদ ও ন্যায়পরায়ণতাকে রক্ষা করতে এবং জুলুম ও স্বৈরাচারের মূলোৎপাটন করে মজলুমের অধিকার ফিরিয়ে দেবার জন্যেই পরিচালিত হয়। জমি-জায়গা বা পদের লোভে কিংবা গোষ্ঠীগত বা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে নয়। দুই ‎. ‏এসব বিপ্লবের উদ্ভব হয় স্ফুলিঙ্গের মতো। চারদিকে যখন মজলুম-নিপীড়ন এবং অত্যাচার ও স্বৈরাচারের ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকারের বুক চিরে বারুদের মতো জ্বলে ওঠে এসব বিপ্লব। চরম দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়ে মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মানুষের ভাগ্যাকাশে আশার দীপ জ্বালিয়ে দেয় এসমস্ত ঐশী বিপ্লব। এই চরম দুর্দিনে মানবতাকে মুক্তি দেয়ার মতো দূরদর্শিতা একমাত্র ঐশী-পুরুষদেরই থাকে। কিন্তু,সাধারণ মানুষ একবারে হাল ছেড়ে দেয়-এমনকি কেউ প্রতিকারে উদ্যোগী হলেও তারা তাকে সমর্থন করতে চায় না। এ ঘটনা আমরা ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏বিপ্লবের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করি। তিনি যখন ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন তখন সমসাময়িক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এটাকে অবাস্তব ব্যাপার বলে মনে করল। এ কারণে তাদের অনেকেই ইমাম হোসাইনের ‎(আ.) ‏সাথে একাত্মতা প্রকাশে বিরত থাকে।কিন্তু ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏ভালভাবে জানতেন যে,এ মুহূর্তে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তাই অন্য কারও সহযোগিতা থাকবে কি-না সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নবী-রাসূলদের মতো নিজেই আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠলেন। হযরত আলী ‎(আ.) ‏বনী উমাইয়াদের ধূর্তামি সম্পর্কে বলেন ‎:انّها فتنة عمیاء مظلمة‘‘ ‏তাদের এ ধোঁকাবাজি নিরেট ও অন্ধকারময় প্রতারণা।’’তাই ইমাম হোসাইন ‎(আ.) ‏এই অন্ধকার থেকে উম্মতকে মুক্ত করার জন্যে ইতিহাসে বিরল এক অসামান্য ও অবিস্মরণীয় বিপ্লবের পথ বেছে নেন।প্রচারে মোঃ শামসীর হায়দার