পোস্টগুলি

মে, ২০২০ থেকে পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদনবী পরিবারের(আঃ) শানে পবিত্র কোরানের আয়াতসুরা আহযাব,আয়াত#৩৩“হে নবী পরিবার,আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদিগকে সম্পুর্ন্রুপে পবিত্র করতে যেমন পবিত্র করার অধিকার আছে।“হযরত উম্মে সালামা (রাঃ) বর্ননা করিয়াছেন যে,আকদিন আল্লাহর রাসুল(সাঃ) আমার ঘরে ছিলেন,হযরত ফাতিমা(আঃ) একদিন হাড়িতে খাবার নিয়ে আসিলেন।আল্লাহর রাসুল(সাঃ) ফরমাইলেনঃহে ফাতিমা!তোমার স্বামী, এবং পুত্রদেরকেও ডাকিয়া আন,তারপর হযরত আলী(আঃ),হযরত হাসান ও হসাইন(আঃ) আসিয়া বসিয়া পড়িলেন।ঐ খাবার খাইলেন এবং ঐ স্থানে শিয়া পড়িলেন।হযরত রাসুলাল্লাহ(সাঃ)এর পায়ের নীচে খয়বরের একটি আবা (চাদর) ছিল।উম্মে সালামা(রাঃ) বলিয়াছেন যে, আমি ঐ কামরার মধ্যে সালাত আদায় করিতেছিলাম,তখন আল্লাহতায়ালা উক্ত আয়াত নাযিল করিলেন।তারপর নবী পাক(সাঃ) ঐ চাদর দ্বারা তাহাদেরকে ঢাকিয়া দিলেন এনং নিজের হাত মোবারক আকাশের দিকে উত্তোলন করিয়া বলিলেনঃহে আল্লাহ! তাহারা হইলো আমার পরিবারের বিশেষ সদস্য এবং আমার অতি প্রিয়।তুমি তাদের মধ্য হইতে নাপাকী এবং অপবিত্রতা দূর করিয়া দাও।তাহাদেরকে পাক ও পবিত্র করিয়া দাও।হযরত উম্মে সালামা(রাঃ) বলিয়াছিলেন যে,আমি নিজের মাথা ঐ চাদরের মধ্যে প্রবেশ করাইলাম এবং বলিলাম যে, হে আল্লাহর রাসুল(সাঃ)! আমিও কি আপনাদের মধ্যে শামিল হইতে পারি,তিনি ফরমাইলেনঃনা ,বরং তুমিও উত্তম অবস্থায় থাকিবে।এই হাদিসটি একটি সহী হাদিস,নির্ভরযোগ্য সাহাবী হইতে ইহা বর্নিত হইয়াছে।বর্ননার আসল ভিত্তি হইলো এই যে,নবী পরিবার (আহলে বায়েত) দ্বারা শুধু হযরত আলী,ফাতিমা,হাসান ও হোসাইন(আঃ)কে বুঝানো হইয়াছে।আমর বিন আবি সালামা,আবু সাইদ খুদরী এবং আনাস ইবনে মালিকও ইহা বর্ননা করিয়াছেন।সুরা আম্বিয়া,আয়াত# ৭“তোমরা যদি না জান তবে আহলে জিকরকে জিজ্ঞাসা কর”।রাসুল(সাঃ)পবিত্র ইমামগন বলিয়াছেন যে, আহলে জিকর অর্থাৎ জ্ঞানবান ব্যক্তি তাহাদের পাকজ্জাত ও মানবকুলকে আদেশ করা হইয়াছে যে, নিজেদের সমস্যার ব্যাপারে তাহাদের কাছে গিয়া তাহার সমাধান চাও।এই অর্থের সঠিক বর্ননা কোরানে বর্নিত হইয়াছে-যাহা রাসুল(সাঃ) ব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং কোরানকেও জিকর অর্থে বলা হইয়াছে।ইহা ষ্পষ্ট যে,হযরত নবীকরিম(সা;)এর বংশধররাই করান ও নবুওতের আসল ব্যাখ্যাকারী এবং তাঁহাদেরকেই আহলে কোরান বলা হয়।(সুত্রঃতাফসীরে কুমী,৩য় খন্ড,পৃঃ৬৮;আল-মুরাজায়াত,পৃঃ৫৪;মাজমাউল বায়ান,৭ম খন্ড,পৃঃ৪০;রাওয়ানে জাভেদ,৩য় খন্ড,পৃঃ৫৪১)।সুরা আম্বিয়া,আয়াত# ১০৫“ আমি ‘যাবুর’ কিতাবেও এ উপদেশ উল্লেখের পর (দুনিয়ার কতৃ্ত্বের ব্যাপারে পরিস্কার করে আমার ) একথা লিখিয়া দিয়াছি যে,একমাত্র সৎ/যোগ্য বান্দারাই এ জমীনে নেতৃত্বের অধিকারী হইবে”।রাসুল(সাঃ) ফরমাইয়াছেনঃপৃথিবী ততক্ষন পর্যন্ত শেষ হইবে না যতক্ষন পর্যন্ত না আমার বংশ হইতে আল্লাহতায়ালা একজনকে পাঠাইবেন আর পৃথিবীর আয়ু যদি একদিনও থাকে তবে ঐ একদিনকে আল্লাহতায়ালা এত দীর্ঘ করিয়া দিবেন যে, একজন মহাপুরুষ আমার আহলে বায়েত হইতে আবির্ভুত হইবেন।আর পৃথিবীর জুলুম ও অত্যাচারে পুর্ন হইয়ান যাইবে,তখন সে এই পৃথিবীকে ন্যায়বিচার এবং ন্যায়পরায়নতায় পরিপুর্ন কর‍্যা দিবে।অন্যান্য বর্ননা ও ব্যাখ্যায় রহিয়াছে যে,তাহার নাম আমার নামে হইবে এবং সে ফাতিমার সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত হইবে।আর এই আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, ইহা লাওহে মাহফুজে এবং সমস্ত আসমানী কিতাবে যেমন তাওরাত,ইঞ্জিল,যাবুর এবং কোরানে উল্লেখ করা হইয়াছে,হযরত ইমাম মেহেদীর(আঃ) আগমন আর তাঁহার ভক্তদের সুসংবাদ দেওয়া হইয়াছে।(সুত্রঃ মুসনাদে আহমাদ,১ম খন্ড,পৃঃ৩৭৬;তারিখে বাগদাদ,৪র্থ খন্ড, পৃঃ৩৮৮;কানজুল উম্মাল,৭ম খন্ড,পৃঃ১৮৮;তাফসীরে কুমী,২য় খন্ড,পৃঃ৭৭;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃঃ৪২৫;)।সুরা নুর,আয়াত# ৩৬“সেই সকল ঘর যাহাকে সমুন্নত করিতে এবং যাহাতে তাঁহার নাম স্মরন করিতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়াছেন,সকাল ও সন্দ্ব্যায় তাঁহার পবিরতা ও মহিমা ঘোষনা করে”।হযরত আনাস বিন মালিক এবং হযরত বুরাইদা বর্ননা করিয়াছেন যে, আল্লাহর রাসুল(সাঃ) এই আয়াত পাক পাঠ করিলে হযরত আবুবকর দাড়াইয়া আবেদন করিলেনঃহে আল্লাহর রাসুল(সাঃ)! এই ঘরগুলি কোথায়?হযরত নবী পাক (সাঃ) বলিলেনঃ ইহা আল্লাহর নবীগনের ঘরসমুহ।তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেনঃহযরত আলী ও হযরত ফাতিমার ঘরও কি ইহাতে অন্তর্ভুক্ত?আল্লাহর রাসুল(সাঃ) ফরমাইলেনঃঅবশ্যই ইহার মধ্যে তাহাদের ঘরও অন্তর্ভুক্ত এবং ইহা ঐ সব ঘরের চেয়ে উত্তম এবং সমুন্নত।(সুত্রঃ মাজমাউল বায়ান,৭ম খন্ড,পৃঃ১৪৪; শাওয়াহেদুত তাঞ্জিল,১ম খন্ড,পৃঃ৪০৯; আল-মুরাজায়াত,পৃঃ৬১; জাযবায়ে বেলায়েত,পৃঃ১৪২; কেফাইয়াতুল মোওয়াহহেদীন, ২য় খন্ড,পৃঃ২৫৮;গায়াতুল মোরাম,পৃঃ৩০৮)প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদঈদ মোবারকঈদ মোবারকঈদ মোবারকআজ ইসলামের ইতিহাসের এক অতি আনন্দের দিন। এ দিনে প্রথমবারের মত নানা হন বিশ্বনবী ‎(সা)। অর্থাৎ আজ হতে ১৪৩৪ চন্দ্র-বছর আগে তৃতীয় হিজরির এই দিনে ‎(১৫ রমজান) ‏বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.)'র সবচেয়ে বড় নাতি এবং তাঁর দ্বিতীয় নিষ্পাপ উত্তরসূরি হযরত ইমাম হাসান মুজতবা পবিত্র মদিনায় জন্ম গ্রহণ করেন। আজ ইরানসহ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে এই মহা-খুশির দিবস।হযরত হারুন ‎(আ.)'র প্রথম পুত্র ‎'শাবার' ‏নামের অনুকরণে মহান আল্লাহর নির্দেশে তাঁর নাম রাখা হয় হাসান যার অর্থ অসাধারণ সুন্দর বা উৎকৃষ্ট। তিনি ছিলেন বিশ্বনবীর ‎(সা) ‏রহমতের অব্যাহত ফল্গু ধারার অংশ।বিশ্বনবী ‎(সা)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যদের বলা হয় জীবন্ত কুরআন বা সরব কুরআন ‎(যে কুরআন কথা বলে)। কারণ, ‏তাঁদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে প্রতিফলিত হত কুরআনের মহান শিক্ষা।বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ ‎(সা.) ‏ইমাম হাসান ও হুসাইনকে বেহেশতি যুবকদের সর্দার বলে উল্লেখ করেছেন এবং এও বলেছেন যে, ‏তাঁরা দু'জনই মুসলমানদের ইমাম তা ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক কিংবা বিপ্লব করুক বা না করুক।মুসলিম বিশ্বের যোগ্য ইমাম হিসেবে তাঁকে গড়ে তুলেছিলেন স্বয়ং বিশ্বনবী ‎(সা.), ‏আমিরুল মু'মিনিন আলী ‎(আ.) ‏ও হযরত ফাতিমা জাহরা ‎(সা.)। এই মহান ইমাম মুয়াবিয়ার ষড়যন্ত্রে শহীদ হন হিজরি ৫০ সনে। তিনি সমাহিত হন মদীনার জান্নাতুল বাকিতে। ‎(বলা হয় বিশ্বনবী-সা.'র কবরের পাশেই সমাহিত হতে চেয়েছিলেন এই মহান ইমাম, ‏কিন্তু বিশেষ মহলের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি)মহান আল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ(সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতকে পবিত্র তথা নিষ্পাপ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন ‎(কুরআন, ‏আহজাব ৩৩:৩৩) ‏যে ঘটনার পর সেই ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন হাসান ‎(আ.)। ঘটনাটি হল, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏একদিন আলী ‎(আ.), ‏ফাতিমা ‎(সা.আ.), ‏হাসান ‎(আ.)ও হুসাইন ‎(আ.)-কে নিজের ঢিলেঢালা আলখাল্লা বা চাদরের নিচে স্থান দিয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ মুনাজাত করেছিলেন। এ সময় রাসূল ‎(সা.)'র স্ত্রীদের কেউ কেউ আসতে চাইলে রাসূল তাঁদেরকে নিজ আলখাল্লা বা চাদরের নিচে আসার অনুমতি দেননি।এ ছাড়াও নাজরানের খ্রিস্টানদের সঙ্গে বিতর্ক ও মুবাহিলার ঘটনার ‎(যারা মিথ্যাবাদী হবে তাদের এবং তাদের পরিবারের ওপর আল্লাহর অভিশাপ দেয়ার চ্যালেঞ্জ) ‏সময়ও আল্লাহর নির্দেশে নবী-পরিবার বা আহলে বাইতের সদস্য হিসেবে সেই পবিত্র পাঁচজনের একজন হিসেবে আবারও উপস্থিত ছিলেন হাসান ‎(আ.)। এ বিষয়ে নাজিল হয়েছিল সুরা নিসার ৬১ নম্বর আয়াত।ইমাম হাসান ‎(আ.) ‏পিতা আলী ‎(আ.)'র শাহাদতের পর মুসলিম বিশ্বের খলিফা হন। কিন্তু মাত্র ছয় মাস পর মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে ব্যাপক বিদ্রোহ ও নিজের সমর্থকদের মধ্যে মুনাফিকদের দৌরাত্ম্য প্রবল হয়ে ওঠার কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতা মুয়াবিয়ার হাতে হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এ সময় স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী খলিফা পদবী ব্যবহারের অধিকার মুয়াবিয়ার ছিল না।অন্য কথায় সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়তা ও আদর্শিক বিচ্যুতিসহ নানা দিক থেকে পরিস্থিতি অত্যন্ত প্রতিকূল থাকায় ইমাম হাসান মুজতবা ‎(আ.) ‏মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ-বিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ, ‏ইমামের প্রধান সেনাপতিসহ অনেকেই ভেতরে ভেতরে মুয়াবিয়ার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এ সময় তিনি মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ অব্যাহত রাখলে ইসলাম পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত এবং ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু সুযোগ-সন্ধানী রোমানরা সিরিয়া ও বায়তুল মোকাদ্দাস দখল করে নিত। এ ছাড়াও এ চুক্তির ফলে মুয়াবিয়ার প্রকৃত চেহারা জনগণের কাছে তুলে ধরা সহজ হয়েছিল।ইমাম হাসান ‎(আ.)'র অনেক মু'জিজা বা অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। এইসব মু'জিজার মধ্যে আমরা কেবল দু'টি মু'জিজার ঘটনা এখানে তুলে ধরব।একআবু জাফর ‎(আ.) ‏থেকে বর্ণিত হয়েছে: ‏একদল লোক ইমাম হাসান ‎(আ.)'র কাছে এসে বলে: ‏আমরা আপনার বাবার মু'জিজাগুলো দেখেছি, ‏এইসব মু'জিজা আপনার কাছেও দেখতে চাই। ইমাম হাসান ‎(আ.) ‏বললেন, ‏যদি দেখাই তাহলে তাঁর প্রতি তথা আলী ‎(আ.)'র প্রতি কি ঈমান আনবেন? ‏তারা বলল: ‏জি, ‏আল্লাহর কসম তাঁর প্রতি ঈমান আনব। ইমাম বললেন: ‏আপনারা কি আমার বাবাকে চেনেন? ‏সবাই বলল: ‏হ্যাঁ, ‏চিনি। ইমাম তাদের চোখের বা দৃষ্টি থেকে পর্দা তুলে নিলেন এবং সবাই দেখল যে স্বয়ং হযরত আলী ‎(আ.) ‏দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর ইমাম হাসান ‎(আ.) ‏বললেন: ‏আপনারা কি তাঁকে চেনেন? ‏সবাই বলল: ‏ইনি আমিরুল মু'মিনিন আলী ‎(আ.) ‏এবং আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি আল্লাহর ওলি বা বন্ধু এবং আলীর পর আপনিই প্রকৃত ইমাম ও নেতা। আপনি আমাদেরকে আপনার পিতা আলী ‎(আ.)'র মৃত্যুর পরও তাঁকে দেখিয়েছেন যেমনটি আপনার বাবা রাসূল ‎(সা.)'র মৃত্যুর পরও মসজিদে কুবায় আবুবকরের কাছে রাসূল ‎(সা.)-কে দেখিয়েছিলেন।এরপর ইমাম বললেন: ‏তোমাদের ওপর আক্ষেপ! ‏তোমরা কি শোনোনি মহান আল্লাহ বলেছেন: و لا تقولوا لمن یقتل فی سبیل الله امواتا بل أحیاء و لکن لا تشعرونযারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, ‏বরং তারা জীবিত, ‏কিন্তু তোমরা তা অনুধাবন কর না।যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদের সম্পর্কে যদি এই আয়াত নাজিল হয়ে থাকে তাহলে আমাদের সম্পর্কে তোমরা কি মনে কর? ‏লোকেরা বলল: ‏হে আল্লাহর রাসূলের সন্তান! ‏আমরা আপনার কথা ও আচরণের প্রতি ঈমান আনছি এবং আপনার কথা ও আচরণকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিচ্ছি। ‎(সূত্র: ‏বিহারুল আনোয়ার)দুইকোনো এক ওমরাহ হজের সফরের সময় ইমাম হাসান ‎(আ.)'র সঙ্গে ছিলো যুবাইর বিন আলআওয়ামের কোনো এক পুত্র। সফরের এক পর্যায়ে তারা একটি স্থানে থামেন। সেখানে কয়েকটি শুকিয়ে যাওয়া খেজুর গাছ ছিল। ওই ব্যক্তি বলল: ‏এই খেজুর গাছে যদি খেজুর থাকতো তাহলে তা পেড়ে খেতাম।ইমাম হাসান ‎(আ.) ‏বললেন: ‏তোমার কি খুরমা খেজুর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে?লোকটি বলল: ‏হ্যাঁ। ইমাম আকাশের দিকে হাত তুলে দোয়া করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই খেজুর গাছটি সবুজ হয়ে যায় এবং তাতে খেজুরও দেখা যায়। লোকটি গাছে উঠে খেজুর পেড়ে খায়। এ সময় তাদের সফরসঙ্গী এক উট-চালক বলে ওঠে: ‏এ তো দেখছি জাদু।ইমাম হাসান ‎(আ.) ‏বললেন: ‏তোমার প্রতি আক্ষেপ! ‏এটা জাদু নয় বরং নবীর ‎(সা.) ‏সন্তানের দোয়া যা কবুল হয়।সমস্ত মহৎ গুণের অধিকারী ইমাম হাসান ‎(আ.) ‏জীবনে অন্তত: ‏দুবার তাঁর ব্যক্তিগত সব সম্পদ দান করে দিয়েছেন এবং বেশ কয়েকবার অর্ধেক বা তারও বেশি সম্পদ দান করে দিয়েছিলেন। তিনি পায়ে হেটে এবং কখনও নগ্ন পায়ে ২৫ বার মদিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজ্ব বা ওমরাহ করেছেন। ইমাম হাসান ‎(আ.) ‏বলেছেন, ‏সব জিনিসের প্রতি লোভই হচ্ছে দারিদ্র আর অল্পে তুষ্টি হচ্ছে প্রাচুর্য বা সম্পদের অধিকারী হওয়া।হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা ‎(আ.)'র পবিত্র জন্ম-বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা অভিনন্দন ও মুবারকবাদ এবং এই মহান ইমামের শানে পেশ করছি অসংখ্য সালাম ও দরুদ। প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

মা খাতুনে জান্নাত ফাতেমা তুজ জোহরা (সাঃ আঃ)প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইনমহানবী ( সা:) এর প্রিয়তমা কন্যা ছিলেন হযরত ফাতেমা যাহরা ( সাঃ আঃ ) ।তাঁর শুভ জন্ম সম্পর্কে হযরত খাদিজা (সা: আ: ) বলেন, ফাতেমার জন্মের সময় সাহায্য করার জন্য আমি প্রতিবেশি কুরাইশ রমণীদের ডেকে পাঠিয়েছিলাম । কিন্তু তারা এই বলে প্রত্যাখ্যান করল যে, আমি মুহাম্মদ (সা:) কে বিয়ে করেছি। আমি কিছুক্ষণের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম । হঠাৎ দেখলাম চারজন উজ্জ্বল জ্যোতির্ময়ী দীর্ঘকায়া মহিলা আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমাকে আতঙ্কিত দেখে তারা বললেন, হে খাদিজা ভয় পাবেন না ।আমি হলাম ইসহাকের মাতা সারা, আর অপর তিনজন হলেন ঈসার মাতা মরিয়ম, ফিরাউনের স্ত্রী আসিয়া এবং মূসার বোন উম্মে কুলসুম ।আল্লাহ আমাদেরকে পাঠিয়েছেন আপনাকে সাহায্য করতে। এই বলে সেই জ্যোতির্ময় নারীরা আমার চারপাশে ঘিরে বসলেন । আমার মেয়ে ফাতেমা জন্মগ্রহণ করা পর্যন্ত তাঁরা আমার সেবা করলেন। হযরত ফাতেমা যাহরা ( সাঃ আঃ ) মাত্র ৫ বছর তাঁর স্নেহময়ী মায়ের আদর-সোহাগ পেয়েছিলেন । তাঁর জম্মের পাঁচ বছর পরেই হযরত খাদিজা ( সা: আ: ) ইন্তেকাল করেন।মা খাদিজা ( সা: আ:)র ইন্তেকালের পর সংগ্রামী পিতার সাথে হযরত ফাতেমাও জীবনের কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হন। ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে যেসকল দুঃখ-কষ্ট নবীজী ভোগ করেছেন সে সময়ে তাঁর সাথী ছিলেন হযরত ফাতেমা। তিনি যখন খুব ছোট তখনই কুরাইশরা বনি হাশিমকে শেবে আবু তালিবে নির্বাসন দিয়েছিল। মহানবী (সা:) তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে দীর্ঘ তিন বছর সেখানে অনাহারে-অর্ধাহারে অবরোদ্ধ জীবন যাপন করেছিলেন। মা বাবার সাথে ছোট্ট ফাতেমাও এ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেন। ইন্তেকালের সময় মা খাদিজা ( সা: আ: ) প্রচুর ধন সম্পদ রেখে যান। সে সম্পদের কোন প্রভাব বালিকা ফাতেমার উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে নি। মহীয়সী মায়ের মতো তিনিও সকল ধন সম্পদ ইসলাম প্রচারের জন্যে পিতার হাতে তুলে দেন।মায়ের ইন্তেকালের পর থেকে হযরত ফাতেমা যাহরা ( সাঃ আঃ ) এর দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায় । নবী পিতার সেবা-শুশ্রুষা থেকে শুরু করে সংসারের নানান কাজের দায়িত্ব তিনি নিজ কাঁধে তুলে নেন। মক্কার কাফেররা প্রায়ই মহানবী ( সা:)কে উত্যক্ত করত, তাঁর ওপর অত্যাচার চালাত। সেই সময় স্নেহময়ী মায়ের মতো বালিকা ফাতেমা পিতার পাশে এসে দাঁড়াতেন, পিতার ক্ষতের পরিচর্যা করতেন, কাফেরদের হাত থেকে তাঁকে আগলে রাখার চেষ্টা করতেন । তিনি একাই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হতেন। এজন্য হযরত ফাতেমা যাহরা ( সাঃ আঃ )কে সকলে উম্মে আবিহা বলে ডাকতো। উম্মে আবিহা অর্থ তাঁর পিতার মা। ফাতেমা মহানবী (সা:) এর কন্যা হয়েও স্নেহময়ী মায়ের মতো মহানবীকে ভালোবাসতেন বলেই তাঁর উপাধি হয়েছিল উম্মে আবিহা। ইসলাম প্রচারের কঠিন মিশন নিয়ে মহানবী ( সা: ) দেশান্তরী হয়েছিলেন । সে সময়ও হযরত ফাতেমা যাহরা ( সাঃ আঃ ) পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। মদিনায় পৌছে মহানবী (সা: ) তাঁর আদরের উম্মে আবিহার সাথে তাঁর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হযরত আলী ( আ:) এর বিয়ে দেন।হযরত ফাতেমা যাহরা ( সাঃ আঃ )র যখন বিয়ের বয়স হলো তখন তাঁর জন্য অনেকেই বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। মহানবী এ ব্যাপারে কাউকেই কথা দিলেন না ।তিনি আল্লাহর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছিলেন । অবশেষে হযরত আলী ( আ: ) তাঁর কাছে হযরত ফাতেমা যাহরা ( সাঃ আঃ র বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন । মহানবী (সা: ) এতে খুব খুশী হলেন । কারণ আল্লাহর ইচ্ছা ছিল আলীর সাথে ফাতেমার বিয়ে দেবার । হযরত আলী (আ:) এর প্রস্তাব নিয়ে মহানবী (সা:) কন্যা হযরত ফাতেমার কাছে এলেন । জিজ্ঞেস করলেন, মা তুমি কি আলীকে বিয়ে করতে রাজী আছো ? আল্লাহ আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত ফাতেমা এ কথা শুনে খুবই আনন্দিত হলেন। তিনি লজ্জায় মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলেন না। মাথা নিচু করে সম্মতি জানালেন। মহানবী ( সা:) মেয়ের সম্মতি জানতে পেরে খুশীতে আল্লাহুআকবর বলে উঠলেন। দ্বিতীয় হিজরীর ১ লা জিলহাজ্জ রোজ শুক্রবার হযরত আলী (আ:) এর সাথে হযরত ফাতেমার শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। এ বিবাহ অনুষ্ঠানে সকল আনসার ও মুহাজির উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে মহানবী ( সা: ) সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন,আল্লাহর আদেশেআমি ফাতেমার সাথে আলীর বিয়ে দিচ্ছি এবং তাদের বিয়ের মোহরানা বাবত ধার্য করেছি চারশ মিসকাল রৌপ্য। অতঃপর মহানবী (সা:) হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আলী তুমি কি এতে রাজী আছো ?হযরত আলী (আ:) সম্মতি জানিয়ে বললেন, হ্যাঁ , আমি রাজী। তখন নবীজী দুহাত তুলে তাঁদের জন্য এবং তাঁদের অনাগত বংশধরদের সার্বিক কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। হযরত ফাতেমা যাহরা ( সাঃ আঃ ) এর সন্তান ইমাম হাসান ( আ:), ইমাম হোসাইন ( আ: ), হযরত জয়নাব (সা: আ: ) ও হযরত উম্মে কুলসুম (সা: আ: ) ছিলেন মুসলিম উম্মার সর্বোত্তম সন্তান। ধার্মিকতায়, সৎ কাজে এবং উদারতায় তাঁরা ছিলেন অতুলনীয় । তাঁদের চরিত্র মাধুর্য এবং কর্মশক্তি ইতিহাসের গতিধারাকেই পাল্টে দিয়েছে এবং ইসলামের আদর্শকে মানবজাতির উদ্দেশ্যে চিরকালের জন্য সমুন্নত রেখেছে।নিবেদক মোঃ জাহিদ হুসাইন

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-ই সর্বপ্রথম ইমাম। তিনি মহানবী (সা.) এর চাচা এবং বনি হাশেম গোত্রের নেতা জনাব আবু তালিবের সন্তান ছিলেন।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইনআল্লাহর রাসুল (সা.)-এর এই চাচাই শৈশবেও তাঁর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজের ঘরে মহানবী (সা.)-কে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং লালন পালনের মাধ্যমে তাঁকে বড় করেছিলেন। মহানবী (সা.)এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার পর থেকে নিয়ে যত দিন তিনি (আবু তালিব) জীবিত ছিলেন, মহানবী (সা.)-কে সার্বিক সহযোগিতা ও সমর্থন করেছিলেন। তিনি সবসময়ই মহানবী (সা.)-কে কাফেরদের, বিশেষ করে কুরাইশদের সার্বিক অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন। হযরত ইমাম আলী (আ.) (প্রশিদ্ধ মতানুযায়ী) মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির ঘোষণার প্রায় দশ বছর পূর্বে জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর জন্মের প্রায় ছ’বছর পর মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর আবেদনক্রমে ঐসময় হযরত আলী (আ.) বাবার বাড়ী থেকে মহানবী (সা.)-এর বাড়ীতে স্থানান্তরিত হন। তারপর থেকে হযরত ইমাম আলী (আ.) সরাসরি মহানবী (সা.)-এর অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধানে তাঁর কাছে লালিত পালিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। মহানবী (সা.) হেরা গুহায় অবস্থানকালে তাঁর কাছে সর্বপ্রথম আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘ওহী’ বা ঐশীবাণী অবর্তীণ হয়। যার ফলে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। এরপর হেরা গুহা থেকে বের হয়ে মহানবী (সা.) নিজ গৃহে যাওয়ার পথে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে এবং তিনি তাঁর কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন। হযরত ইমাম আলী (আ.) সাথে সাথেই মহানবী (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন। অতঃপর নিকট আত্মীয়দেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্‌বান জানানোর উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) তাদের সবাইকে নিজ বাড়ীতে খাওয়ার আমন্ত্রন জানিয়ে সমবেত করেন। ঐ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সবার প্রতি লক্ষ্য করে মহানবী (সা.) বলেছিলেন যে, ‘আপনাদের মধ্যে যে সর্বপ্রথম আমার আহ্‌বানে (ইসলাম গ্রহণে) সাড়া দেবে, সেই হবে আমার খলিফা, উত্তরাধিকারী এবং প্রতিনিধি। কিন্তু উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে একমাত্র যে ব্যক্তিটি সর্বপ্রথম উঠে দাঁড়িয়ে সেদিন বিশ্বনবী (সা.)-এর আহ্‌বানে সাড়া দিয়েছিল এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল তিনিই হচ্ছেন হযরত ইমাম আলী (আ.)। আর বিশ্বনবী (সা.) সেদিন (তাঁর প্রতি) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ঈমানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং স্বঘোষিত প্রতিশ্রুতিও তিনি তার ব্যাপারে পালন করেছিলেন। এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলিম। আর তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি কখনই মূর্তিপুজা করেননি। মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গমনের পূর্ব পর্যন্ত হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী। মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা গমনের রাতে হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই মহানবী (সা.) এর বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ঐ রাতেই কাফেররা মহানবী (সা.) এর বাড়ী ঘেরাও করে শেষরাতের অন্ধকারে মহানবী (সা.)-কে বিছানায় শায়িত অবস্থায় হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। মহানবী (সা.) কাফেরদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হবার পূর্বেই গৃহত্যাগ করে মদীনার পথে পাড়ি দিয়েছিলেন। এরপর হযরত ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর কাছে গচ্ছিত জনগণের আমানতের মালা-মাল তাদের মালিকদের কাছে পৌঁছে দেন। তারপর তিনিও নিজের মা, নবী কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.) ও অন্য দু’জন স্ত্রীলোক সহ মদীনার পথে পাড়ি দেন। এমনকি মদীনাতেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-ই ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নিত্যসঙ্গী। নির্জনে অথবা জনসমক্ষে তথা কোন অবস্থাতেই মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখেননি। তিনি স্বীয় কন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-কেও হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছেই বিয়ে দেন। সাহাবীদের উপস্থিতিতে মহানবী (সা.), হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপনের ঘোষণা দেন। একমাত্র ‘তাবুকের’ যুদ্ধ ছাড়া বিশ্ব নবী (সা.) (স্বীয় জীবদ্দশায়) যত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, হযরত ইমাম আলী (আ.)-ও সেসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন। এ ছাড়াও হযরত ইমাম আলী (আ.) কোন যুদ্ধেই আদৌ পিছপা হননি। জীবনে কোন শত্রুর মোকাবিলায় তিনি পৃষ্ঠ প্রর্দশন করেননি। তিনি জীবনে কখনোই মহানবী (সা.)-এর আদেশের অবাধ্যতা করেননি। তাই তাঁর সম্পর্কে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন যে, “আলী কখনই সত্য থেকে অথবা সত্য আলী থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।” বিশ্ব নবী (সা.)-এর মৃত্যুর সময় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বয়স ছিল প্রায় তেত্রিশ বছর। বিশ্বনবী (সা.)-এর সকল সাহাবীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ইসলামের সকল মহত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন তিনিই। সাহাবীদের মধ্যে হযরত ইমাম আলী (আ.) বয়সের দিক থেকে ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ। আর ইতিপূর্বে বিশ্বনবী (আ.)-এর পাশাপাশি অংশগ্রহণকৃত যুদ্ধসমূহে যে রক্তপাত ঘটেছিল, সে কারণে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর প্রতি অনেকেই শত্রুতা পোষণ করত। এসব কারণেই বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরলোক গমনের পর হযরত আলী (আ.)-কে খেলাফতের পদাধিকার লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। আর এর মাধ্যমে সকল রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাই বাধ্য হয়ে তখন তিনি নিরালায় জীবন যাপন করতে শুরু করেন এবং ব্যক্তি প্রশিক্ষণের কাজে নিজেকে ব্যপৃত করেন। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর তিনজন খলিফার শাসনামল শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই জীবন যাপন করতে থাকেন। তারপর তৃতীয় খলিফা নিহত হবার পর জনগণ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে ‘বাইয়াত’ (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন এবং তাঁকে খেলাফতের পদে অধিষ্ঠিত করেন।হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকাল ছিল প্রায় ৪ বছর ৯ মাস। তিনি তাঁর এই খেলাফতের শাসন আমলে সম্পূর্ণরূপে মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করেন। তিনি তাঁর খেলাফতকে আন্দোলনমুখী এক বিপ্লবীরূপ প্রদান করে ছিলেন। তিনি তাঁর শাসন আমলে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। অবশ্য ইমাম আলী (আ.)-এর ঐসব সংস্কারমূলক কর্মসূচী বেশকিছু সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির ক্ষতির কারণ ঘটিয়ে ছিল। এ কারণে উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা, তালহা, যুবাইর ও মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে বেশকিছু সংখ্যক সাহাবী হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের দাবীর শ্লোগানকে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। আর তারা ইসলামী রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলিত করার মাধ্যমে এক ব্যাপক রাজনৈতিক অরাজকতার সৃষ্টি করে। যার ফলে উদ্ভুত ফিৎনা ও অরাজকতা দমনের জন্যে বস্‌রার সন্নিকটে ইমাম আলী (আ.) নবীপত্নি আয়েশা, তালহা, ও যুবায়েরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবর্তীণ হতে বাধ্য হন। ইসলামী ইতিহাসের ঐ যুদ্ধিটিই ‘জঙ্গে জামাল’ নামে পরিচিত। এ ছাড়াও ইরাক ও সিরিয়া সীমানে- অনুরূপ কারণে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে হযরত ইমাম আলী (আ.) ‘সিফফিন’ নামক আরও একটি যুদ্ধে অবর্তীণ হতে বাধ্য হন। ‘সিফফিন’ নামক ঐ যুদ্ধ দীর্ঘ দেড় বছর যাবৎ অব্যাহত ছিল। ঐ যুদ্ধ শেষ না হতেই ‘নাহ্‌রাওয়ান’ নামক স্থানে ‘খাওয়ারেজ’ (ইসলাম থেকে বহিস্কৃত) নামক বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। ঐ যুদ্ধিটি ইতিহাসে ‘নাহ্‌রাওয়ানের’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এভাবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালই আভ্যন্তরীণ মতভেদ জনিত সমস্যা সমাধানের মধ্যেই অতিক্রান্ত হয়। এর কিছুদিন পরই ৪০ হিজরীর রমযান মাসের ১৯ তারীখে কুফার মসজিদে ফজরের নামাযের ইমামতি করার সময় জনৈক ‘খারেজির’ তলোয়ারের আঘাতে তিনি আহত হন। অতঃপর ২০শে রমযান দিবাগত রাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। ইতিহাসের সাক্ষ্য এবং শত্রু ও মিত্র, উভয়পক্ষের স্বীকারোক্তি অনুসারে মানবীয় গুণাবলীর দিক থেকে আমিরুল মু’মিনীন হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এ ব্যাপারে সামান্যতম ক্রটির অস্তিত্বও তাঁর চরিত্রে ছিল না। আর ইসলামে মহত গুণাবলীর দিক থেকে তিনি ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)-এর আদর্শের এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিভু।ইমাম আলী (আ.)-এর মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এ যাবৎ যত আলোচনা হয়েছে এবং শীয়া, সুন্নী, জ্ঞানী গুণী ও গবেষকগণ যে পরিমাণ গ্রন্থাবলী তাঁর সম্পর্কে আজ পর্যন্ত রচনা করেছেন, ইতিহাসে এমনটি আর অন্য কারও ক্ষেত্রেই ঘটেনি। হযরত ইমাম আলী (আ.) ছিলেন সকল মুসলমান এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানীব্যক্তি। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি তাঁর অগাধ জ্ঞানগর্ভ বর্ণনার মাধ্যমে ইসলামে যুক্তিভিত্তিক প্রমাণ পদ্ধতির গোড়াপত্তন করেন। এভাবে তিনিই সর্ব প্রথম ইসলামী জ্ঞান ভান্ডারে দর্শন চর্চার মাত্রা যোগ করেন। তিনিই কুরআনের জটিল ও রহস্যপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা করেন। কুরআনের বাহ্যিক শব্দাবলীকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্যে তিনি আরবী ভাষার ব্যাকরণ শাস্ত্র রচনা করেন। বীরত্বের ক্ষেত্রেও হযরত আলী (আ.) ছিলেন মানবজাতির জন্য প্রতীক স্বরূপ। বিশ্ব নবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর পরেও জীবনে যত যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেছেন, কখনোই তাঁকে ভীত-সন্ত্রস্ত হতে বা মানসিক অস্থিরতায় ভূগতে দেখা যায়নি। এমনকি ওহুদ, হুনাইন, খান্দাক এবং খাইবারের মত কঠিন যুদ্ধগুলো যখন মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং সাহাবীরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছত্রভঙ্গ হয়ে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেই কঠিন মূহুর্তগুলোতেও হযরত ইমাম আলী (আ.) কখনোই শত্রুদের সম্মুখে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেননি। ইতিহাসে এমন একটি ঘটনাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোন খ্যাতিমান বীর যোদ্ধা ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিরাপদে নিজের প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছে। তিনি এমন মহাবীর হওয়া সত্ত্বেও কখনও কোন দূর্বল লোককে হত্যা করেননি এবং তাঁর নিকট থেকে পালিয়ে যাওয়া (প্রাণ ভয়ে) ব্যক্তির পিছু ধাওয়া করেননি। তিনি কখনোই রাতের আঁধারে শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমন চালাননি। শত্রুপক্ষের জন্য পানি সরবরাহ কখনোই তিনি বন্ধ করেননি। এটা ইতিহাসের একটি সর্বজন স্বীকৃত ঘটনা যে, ইমাম আলী (আ.) খাইবারের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের দূর্গম দূর্গের বিশাল লৌহ ত্বোরণটি তাঁর হাতের সামান্য ধাক্কার মাধ্যমে সম্পূর্ণ রূপে উপড়ে ফেলেছিলেন। একইভাবে মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে ইমাম আলী (আ.) কা’বা ঘরের মূর্তিগুলো ধ্বংস করেন। ‘আকিক’ পাথরের তৈরী ‘হাবল’ নামক মক্কার সর্ববৃহৎ মূর্তিটি কা’বা ঘরের ছাদে স্থাপিত ছিল। ইমাম আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর কাঁধে পা রেখে কা’বা ঘরের ছাদে উঠে একাই বৃহাদাকার মূর্তিটির মূলোৎপাটন করে নীচে নিক্ষেপ করেন। খোদাভীতি ও আল্লাহ্‌র ইবাদতের ক্ষেত্রে ইমাম আলী (আ.) ছিলেন অনন্য। জনৈক ব্যক্তির প্রতি ইমাম আলী (আ.)-এর রূঢ় ব্যবহারের অভিযোগের উত্তরে মহানবী (সা.) তাকে বলেছিলেন যে, “আলীকে তিরস্কার করো না। কেননা সে তো আল্লাহ‌ প্রেমিক”। একবার রাসুল (সা.)-এর সাহাবী হযরত আবু দার্‌দা (রা.) কোন এক খেজুর বাগানে ইমাম আলী (আ.)-এর দেহকে শুষ্ক ও নিষপ্রাণ কাঠের মত পড়ে থাকতে দেখেন। তাই সাথে সাথে নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর কাছে তাঁর স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছালেন এবং নিজের পক্ষ থেকে শোকও জ্ঞাপন করেন। কিন্তু ঐ সংবাদ শুনে হযরত ফাতিমা (আ.) বললেন ঃ “না, আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেননি। বরং ইবাদত করার সময় আল্লাহ্‌র ভয়ে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন। আর এ অবস্থা তাঁর ক্ষেত্রে বহু বারই ঘটেছে।” অধীনস্থদের প্রতি দয়াশীলতা, অসহায় ও নিঃস্বদের প্রতি ব্যথিত হওয়া এবং দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি পরম উদারতার ব্যাপার ইমাম আলী (আ.)-এর জীবনে অসংখ্য ঘটনার অস্তিত্ব বিদ্যমান। ইমাম আলী (আ.) যা-ই উপার্জন করতেন, তাই অসহায় ও দরিদ্রদেরকে সাহায্যের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র পথে দান করতেন। আর তিনি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সহজ সরল ও কষ্টপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। ইমাম আলী (আ.) কৃষি কাজকে পছন্দ করতেন। তিনি সাধারণতঃ পানির নালা কেটে সেচের ব্যবস্থা করতেন। বৃক্ষ রোপণ করতেন। চাষের মাধ্যমে মৃত জমি আবাদ করতেন। কিন্তু পানি সেচের নালা ও আবাদকৃত সব জমিই তিনি দরিদ্রদের জন্যে ‘ওয়াকফ’ (দান) করতেন। হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পক্ষ থেকে দরিদ্রদের জন্যে ‘ওয়াকফ’কৃত ঐসব সম্পত্তির বার্ষিক গড় আয়ের পরিমাণ ২৪ হাজার সোনার দিনারের সমতুল্য ছিল। তাঁর ঐসব ‘ওয়াকফ্‌’কৃত সম্পত্তি ‘আলী (আ.)-এর সাদ্‌কা’ নামে খ্যাত ছিল।নিবেদক মোঃ জাহিদ হুসাইন

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদবিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমমহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পর ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত নাম হলো আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালেব (আ.)। তৎকালীন আরবে (সপ্তম শতাব্দী) যিনি একাধারে তাত্ত্বিক, সুবক্তা, লেখক, চিন্তক ও কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি জ্ঞান ও পবিত্রতার সাগর, ধর্মের কুতুব, ধর্মপথের প্রদর্শক, আল্লাহ্র রাসূলের চাচাত ভাই ও শেরে খোদা। তাঁর উপাধি মুরতাজা ও মুজতাবা। তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর স্বামী, আল্লাহ্র রাসূলের জামাতা। রাসূলের সাহাবিগণের মাঝে যিনি মর্যাদা ও সত্যের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকলেই একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও অতুলনীয় বীর যোদ্ধা।আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (আ.) ২৩ হিজরি পূর্বাব্দের ১৩ রজব শুক্রবার আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম ফাতিমাহ্ বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম। তিনি প্রথম ঈমানদারদের একজন। রাসূল (সা.) হযরত আলীকে তাঁর শিশুকালেই নিজ গৃহে নিয়ে আসেন এবং তাঁর পবিত্র বিছানার পাশেই তাঁর দোলনাটি রাখা হয়েছিল। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে দোল দিতেন, গোসল করাতেন এবং দুধ খাওয়াতেন। এ সম্পর্কে হজরত আলী তাঁর বিখ্যাত ‘খুত্বাতুল ক্বাসেয়াহ্তে বলেছেন : ‘রাসূলের সাথে আমার বিশেষ জ্ঞাতিত্ব ও আত্মীয়তার কারণে আমার মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা জান। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনই তিনি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর পবিত্র বুকে চেপে ধরতেন, বিছানায় তাঁর পাশে শোয়াতেন, আমার শরীরে হাত বুলাতেন। তখন আমি তাঁর পবিত্র দেহের সুঘ্রাণ নিয়েছি। তিনি খাবার চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন…. সে সময় থেকেই আমি তাঁকে এমনভাবে অনুসরণ করতাম যেভাবে উটের বাচ্চা তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। প্রতিদিন তিনি আমাকে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখাতেন এবং তা অনুসরণ করতে আদেশ দিতেন। প্রতিবছর তিনি হেরা পাহাড়ে নির্জনবাসে যেতেন। সেখানে আমি ব্যতীত আর কেউ তাঁকে দেখেনি। সে সময় খাদিজার ঘর ব্যতীত আর কোথাও ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না আর সেসময় দু’জনের পর আমি ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ ও ঐশী বাণীর তাজাল্লি আমি দেখতাম এবং নবুওয়াতের সুঘ্রাণ প্রাণভরে গ্রহণ করতাম।’একান্ত অনুগত বুদ্ধিদীপ্ত আলীকে রাসূল (সা.) ভীষণ ভালবাসতেন। জন্মের পর থেকে আলীও রাসূলকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, একই গৃহের ভেতরে একই ছাদের নিচে একান্ত নিবিড়ভাবে। ছোটবেলা থেকে হযরত আলীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। মাত্র তের বছর বয়সে তিনি নিজেকে সত্যের পয়গাম গ্রহণকারী, রাসূল (সা.)-এর রিসালাতের স্বীকৃতি দানকারী ও দ্বীনের পথে প্রথম সাহায্যকারী হিসেবে বনু হাশিমের সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি দানের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে নিজের ভাই, ওয়ালী ও খলিফা বলে উপস্থিত সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর অনুসারিগণ হাবশা ও মদিনায় হিজরত করতে শুরু করেন। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ এলে মহানবী হযরত আলী (আ.)-কে নিজের বিছানায় রেখে রাতের আঁধারে মক্কা ত্যাগ করলেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর আলী (আ.) মক্কায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। তৃতীয় বা চতুর্থ দিন মদিনার উদ্দেশে প্রকাশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাঁর সাথে ছিল তাঁর মা, নবীকন্যা হযরত ফাতেমা, হযরত উম্মে আইমানসহ আরও কয়েকজন মহিলা। তিনি মদিনায় পৌঁছলে মহানবী (সা.) নিজে এগিয়ে এসে তাঁদের কাফেলাকে গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রিয় ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় মহানবীর চোখ মমতা ও আনন্দে ভরে গিয়েছিল।মদিনায় হযরত আলীর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। হযরত আলী তখন ২২-২৩ বছরের প্রাণবন্ত যুবক। মদিনা সনদ সম্পাদনের মাধ্যমে একটি জাতি গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২য় হিজরিতে বদরের যুদ্ধে হযরত আলী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বদরের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নিতে মক্কার কাফেররা পরের বছর পুনরায় যুদ্ধের আয়োজন করে। এই যুদ্ধে মদিনার মুসলমানদের অবহেলার জন্য ইসলামের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় সংযোজিত হয়। রাসূলুল্লাহ্র আদেশ অমান্য করার ফলে মুসলমানরা নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হয়ে এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ্র মৃত্যুর গুজবে মুসলিম বাহিনী হতাশ হয়ে পালাতে থাকে। সেসময়ে হযরত আলী বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে একত্রিত করে কাফিরদের ওপর আক্রমণ করেন। কুরাইশদের পতাকাবাহী নয়জন শ্রেষ্ঠ বীরকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ্কে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ওহুদের যুদ্ধে হযরত আলীর দেহে সত্তরটির মতো আঘাত লেগেছিল।৫ম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধে মদিনা যখন মক্কার কাফেরদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয় তখন আরবের বিখ্যাত যোদ্ধা ‘আমর ইবনে আবদে উদ্দ’ মল্লযুদ্ধের জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান করে। সে ছিল এক অপরাজেয় বীর। তাই তাকে বলা হতো ‘এক হাজার ঘোড় সওয়ারের সমতুল্য’১০। রাসূল (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে হযরত আলী আমর ইবনে আবদে উদ্দকে মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং মল্লযুদ্ধের এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করেন।৬২৮ সালে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক ছিলেন হযরত আলী (আ.)। সপ্তম হিজরিতে মহানবী (সা.) খায়বর অভিযানে বের হন। খায়বরের সুরক্ষিত দুর্গ কামুস জয় করা মুসলমানদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। কামুস দুর্গের প্রধান ছিল ‘হাজার বীরের শ্রেষ্ঠ বীর’ খ্যাত মারহাব। দ্বন্দ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী (আ.) মারহাবের মাথায় এমন জোরে আঘাত করলেন যে তরবারি মারহাবের শিরস্ত্রাণ পরিহিত মাথা দ্বিখণ্ডিত করে দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত নেমে এল। হযরত আলীর নেতৃত্বে দুর্ভেদ্য কামুস দুর্গের পতন ঘটে এবং মুসলমানরা খায়বর জয় করে। খায়বরবাসী খারাজ প্রদানের শর্তে সন্ধি করে।মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন মক্কায় প্রবেশ করেন। হযরত আলী ‘কাদ’-র দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। এক বিন্দু রক্তপাত ছাড়াই হযরত আলী তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেন।মক্কা বিজয়ের পর ঐ একই বছর হোনায়েনের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দিন ‘হাওয়াযিন গোত্রের’ আক্রমণে মুসলিম সৈন্যবাহিনী যখন দিশেহারা তখন হযরত আলী ও আব্বাস (রা.) সমগ্র আনসার বাহিনীকে একত্রিত করে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে মুসলমানগণ জয় লাভ করে।অষ্টম হিজরিতে হেজাজ অঞ্চলের চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলো। এরই প্রেক্ষিতে হযরত খালিদ ইবনে ওলীদকে ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয়। খালিদ দীর্ঘ ছয় মাস এখানে ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম গ্রহণ করল না। মহানবী (সা.) তাঁর স্থলে হযরত আলীকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন। তাঁর পাণ্ডিত্য, আভিজাত্যপূর্ণ মার্জিত ব্যবহার, রাসূলের প্রতিনিধিসুলভ ব্যক্তিত্ব, জীবন যাপনের সারল্য ইয়েমেনীদের মুগ্ধ করল। ইয়েমেনের হামদান গোত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে গেল। পরের বছর পুনরায় ইয়েমেনের মাযহাজী গোত্রের কাছে হযরত আলীকে প্রেরণ করা হয়। গোত্রপতিগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ ইয়েমেন ক্রমান্বয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসে।দশম হিজরিতে রাসূল (সা.) শেষ হজ করার জন্য মক্কায় গমন করলে হযরত আলী (আ.) তাঁর সহগামী হন। সেই বিখ্যাত বিদায় হজের ভাষণ শেষ করে মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো। মহানবী (সা.) সমবেত সাহাবিগণকে নিয়ে যোহরের নামায আদায় করে উটের হাওদার তৈরি মঞ্চে আরোহণ করে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন যা ‘খুত্বায়ে গাদীর’ নামে প্রসিদ্ধ। এই খুত্বাতে মহানবী (সা.) বলেছিলেন : ‘আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা ও তাদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অধিকার রাখি এবং তাদের ওপর অধিকার রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ততর। হে লোকসকল! আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা ও নেতা।’গাদীরে খুমের ভাষণের সত্যতা লিপিবদ্ধ করেছেন আত তাবারী, আবু নাঈম ইসফাহানী, ইবনে আসাকের, আবু ইসহাক হামুইনী, আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতীর মতো বিখ্যাত আলেমগণ।হযরত আলী তাঁর পূর্ববর্তী তিন খলিফার পঁচিশ বছরের শাসনামলে অধিকাংশ সময় নিজ গৃহে এবং মসজিদে নববীতেই কাটাতেন। এই সময় তিনি যেসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সেগুলো হলো :প্রথমত, তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল থাকা।দ্বিতীয়ত, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের তাফসীর, মুতাশাবেহ আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা, দুর্বোধ্য বিষয়াবলির সমাধান অন্বেষণ করা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে শিক্ষা দান করে তাঁকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রস্তুত করে তা উম্মাহ্র মাঝে প্রচার করার ব্যবস্থা করতেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর পরে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাস্সির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।তৃতীয়ত, খলিফাদের দরবারে অনাহূত সমস্যাগুলোর সমাধান বাতলে দেওয়া। জটিল বিষয়ে হযরত আলী তাঁর বিজ্ঞ মত ব্যক্ত করতেন যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল।চতুর্থত, একদল নিঃস্বার্থ, পবিত্র অন্তর ও আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও পরকালীন যাত্রার পথে আগ্রহী অনুসারী তৈরি করা যাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারেন।পঞ্চমত, বিধবা, অনাথ ও অসহায়দের প্রতিপালন ও পুনর্বাসনের জন্য অনুসারীদের মাঝে কর্ম তৎপরতা তৈরি করা এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে বাগান তৈরি করে, কূপ খনন করে সেগুলো ওয়াক্ফ করা।অর্থাৎ হযরত আলী (আ.) দ্বীন ইসলাম ও উম্মতের খিদমতের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।এছাড়াও এই পঁচিশ বছর সময়ে তিনি মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি নুস্খা বা অনুলিপি তৈরি করেন এবং মহানবী (সা.)- এর পবিত্র জীবনের অমিয় বাণী ও সুন্নাহ্র উপর একটি সংকলন তৈরি করেন যা মুসনাদে ইমাম আলী ইবনে আবি তালেব নামে প্রসিদ্ধ।রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর খলিফাদের শাসনকালে হযরত আলী ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেই অধিক গুরুত্ব দেন এবং খলিফাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।হযরত আলীর পরামর্শক্রমেই হযরত ওমর বায়তুল মুকাদ্দাসে যাত্রা করেছিলেন। নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ, ইয়ারমুকের যুেদ্ধ হযরত আলীর পরামর্শেই মুসলিম বাহিনী ও রাজধানী মদিনা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। খলিফাদের সময় হযরত আলী কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ঐতিহাসিক রায়সমূহ মুসলিম আইনের বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। এমনি আরও বহু ঘটনা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই।হযরত আলী তাঁর খিলাফতকালে চেয়েছিলেন মুসলমানদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র শাসনকালীন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মহানবীর পদ্ধতিকে পুনর্জীবিত করে মুসলিম উম্মাহকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। খিলাফতের প্রথমদিকে বাইতুল মালের বণ্টনের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কর তাদের জেনে রাখা উচিত শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড অন্য কিছুতে। শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্য যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় অধিকারের দিক থেকে সকলে পরস্পর সমান হবে। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা আর ধনসম্পদ হলো আল্লাহ্র যা তোমাদের মাঝে সমভাবে বণ্টিত হবে। এ ক্ষেত্রে কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আগামীকাল বাইতুল মাল তোমাদের মধ্যে বণ্টিত হবে আর এতে আরব-অনারব এক সমান।’তিনি পূর্ববর্তী খলিফার সময়ে দুর্নীতিপরায়ণ আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে অপসারণ করে তদস্থলে নতুন গভর্নরদের নিয়োগ দেন। একমাত্র সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ব্যতীত অন্য সকলেই খলিফার আদেশ মেনে নিয়ে নতুন গভর্নরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন।পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানবিক ও অতি সংবেদনশীল যুদ্ধনীতি ঘোষণা করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে জেনেভা কনভেনশন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতিসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে।আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর তেষট্টি বছরের ঘটনাবহুল জীবনের বাস্তব চিত্র পাঠকদের কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুট না হলে এবং ইসলামের চরম সংকটে তাঁর অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলে ইতিহাসের সত্য দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকার সম্ভাবনাই প্রবল।‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জ্ঞাননগরীর দরজা’ খ্যাত হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের জন্য স্বীকৃতি লাভ করেন। ইয়াকীনপূর্ণ জ্ঞান আর বোধে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেনÑ ‘আলী আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং বিচার কার্যে সকলের চেয়ে উত্তম।’ ইয়েমেনের সিংহের গর্তে নিহত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর মতামতকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের নিগূঢ় জ্ঞানরাশি মুহাম্মাদ (সা.) হযরত আলীকে শিখিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন তিনি ফিরে আসলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘কী আলোচনা হলো?’ তিনি বললেন : ‘মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন, প্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্রটি দ্বার উন্মুক্ত হয়।’ মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে হযরত আলী মসজিদে নববীতে জ্ঞানচর্চার মুক্তাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় খুতবার মাধ্যমে ও সাহাবিগণের আলাপচারিতায় তিনি যে সমস্ত বিদগ্ধ আলোচনা ও বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তা পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি সত্যিকার অর্থে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ কর্তৃক ‘শারহে নাহজুল বালাগাহ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হযরত আলী (আ.)-এর খুতবা ও পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে তাঁর জ্ঞানজগতের বিশালতা ও পরিব্যাপ্তি বোঝা যায়। এই সমস্ত খুতবার বিষয়বস্তু ছিল মহাজগৎ সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র অস্তিত্ব, ফেরেশ্তা সৃষ্টি, আদম সৃষ্টি ঈমান, রুহ্, রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা, অন্যান্য আসমানি কিতাবের আলোচনাসহ বিভিন্ন দার্শনিক ও তাত্ত্বিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞান-নগরীর দরজা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। এই সমস্ত জ্ঞানপূর্ণ সমাবেশে রাসূল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিগণ উপস্থিত থাকতেন। তাঁরা তাঁর কাছে বিভিন্ন জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন আর হযরত আলী (আ.) অত্যন্ত সুবিজ্ঞ উত্তরসহ মতামত দান করতেন।প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

আজ হতে ১৪৪৪ চন্দ্র-বছর আগে এই দিনে (১০ই রমজান, হিজরতের তিন বছর আগে) ইন্তিকাল করেছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র প্রথম স্ত্রী উম্মুল মু'মিনিন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)। জীবন পরিচিতিনাম: খাদিজা।উপাধি: মুবারাকাহ, তাহেরাহ, কুবরা।উপনাম: উম্মে হিন্দ, উম্মুল মু'মিনীন, উম্মে জাহরা।পিতা: খুয়াইলিদ বিন আসাদ।মাতা: ফাতিমা বিনতে যাসেম।জন্ম তারিখ ও স্থান: নবুয়্যত ঘোষণার ৫৫ বছর পূর্বে মক্কায়।রাসূলের (সা.) সাথে বিবাহের তারিখ: ১০ই রবিউল আউয়াল, নবুয়্যত ঘোষণার ১১ বছর পূর্বে।মৃত্যু তারিখ ও স্থান: নবুয়্যত ঘোষণার দশম বছরে ১০ই রমজান মক্কাতে মৃত্যুবরণ করেন। প্রকৃতার্থে তিনি শেবে আবু তালিবে (আবু তালিব উপত্যকাতে) ৩ বছর বন্দী অবস্থায় তার উপর যে অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়েছিল সে কারণে বলা যেতে পারে তিনি শাহাদতবরণ করেছেন।মৃত্যুকালীন বয়স: ৬৫ বছর।পবিত্র মাজার শরীফ: মোয়াল্লা নামক কবরস্থানে যার অপর নাম আবু তালিবের কবরস্থান।রাসূলের (সা.) সাথে জীবন যাপন কাল: প্রায় ২৫ বছর।_____________________________________________________________রাসূলুল্লাহ্‌র (সা:) জীবনে হযরত খাদীজাতুল কুবরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)ছিলেন আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ নেয়ামত স্বরূপ। দীর্ঘ পঁচিশ বছর যাবত আল্লাহ্‌র নবীকে (সা:) সাহচর্য দিয়ে, সেবা-যত্ন দিয়ে, বিপদাপদে সাহস ও শক্তি যুগিয়ে, অভাব-অনটনে সম্পদ দিয়ে, প্রয়োজন মত প্রেরণা ও পরামর্শ দিয়ে শিশু ইসলামের লালন-পালনের ক্ষেত্রে তিনি যে অসামান্য অবদান রেখেছেন ইসলামের ইতিহাসে তা তুলনাহীন। হযরত খাদীজাতুল কুবরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)'র পবিত্র স্মৃতি যখনই স্মরণে আসত বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র দু চোখ বেয়ে ঝরে পড়ত অশ্রুধারা। অন্য কোনো স্ত্রীই হযরত খাদিজা (সা. আ.)'র সমকক্ষ নন বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। বিশ্বনবী (সা.) খাদিজা (সা. আ.)বান্ধবীদেরকেও শ্রদ্ধা করতেন।একবার বিশ্বনবী (সা.)’র কোনো এক স্ত্রী নিজেকে হযরত খাদিজা (সা. আ.)’র চেয়ে উত্তম বলে দাবি করলে আল্লাহর রাসূল (সা:) তাকে তিরস্কার করে বলেন:- “আল্লাহর কসম, মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর চেয়ে কোনো উত্তম স্ত্রী দান করেননি।যে সময় লোকেরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছিল তখন তিনিই আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন, যখন অপরেরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তখন তিনিই আমার উপর আস্থা স্থাপন করেছিলেন, যখন অন্যেরা আমাকে বঞ্চিত করেছিল, তখন তিনি আমাকে তাঁর সম্পদে অংশীদার করেছিলেন এবং আল্লাহ আমার অন্য সব স্ত্রীর মাধ্যমে আমাকে কোন সন্তান দেননি। কিন্তু তাঁরই মাধ্যমে আমাকে সন্তান দ্বারা অনুগৃহীত করেছিলেন”। প্রাগুক্ত পৃঃ ২২৬; মুসনাদে আহমদ ৬ষ্ঠ খণ্ড পৃঃ ১১৮, বুখারি শরিফ।উম্মুল মু'মিনিন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (সালামুল্লাহি আলাইহা) ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলমান। ইসলামের শুরুতে যখন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর কোন সাথী ছিল না এবং সকলে তাঁকে শত্রুর চোখে দেখত, ঠিক তখনই তিনি তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং তার জীবনে অর্জিত অঢেল অর্থ ও সম্পদ ইসলামের জন্য বিলিয়ে দেন।দরিদ্র আর নির্যাতিত নও-মুসলিমদের খাবার দেয়া, কাপড় ও পোশাক দেয়া ও তাদের আশ্রয় দেয়ার কাছে নিজের সব সম্পদ বিলিয়ে দেন হযরত খাদিজা।বলা হ‌য়ে থা‌কে বিশ্বনবী (সা.)'র চারিত্রিক সুষমা ও মহানুভবতা, আলী (আ.)'র তরবারি এবং খাদিজা (সা. আ.)'র অঢেল সম্পদ ছাড়া ইসলাম কখনও এতটা বিকশিত হতে পারত না।বরোধের বছরগুলোতে হজরত খাদিজা (রা.) ঈমানদারদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে সব সম্পদ ব্যয় করেছিলেন। ফলে মৃত্যুর সময় তার কাছে ছিল না কোনো বস্তুগত সম্পদ। একমাত্র সন্তান ফাতিমার জন্যও তাই রেখে যাননি একটি মুদ্রাও।এমনকি তার মৃত্যুর পর কাফনের কাপড় কেনার অর্থও তার ঘরে ছিল না।প্রিয় স্বামীর চাদর তার দাফন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।তার একটি উদাহরণ এখানে আমার প্রিয় শ্রদ্ধেয় জনাব জাহিদ আহমেদ ভাইয়ের টাইমলাইন থেকে তুলে ধরলাম:-জনাবে তাহেরা (সা. আ.) ছিলেন সেই স্বত্তা যার সম্পদের বিনিময়ে শুরু হয়েছে ইসলামের সুত্রপাত! ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্নে মাওলা মুহাম্মদ যখন দ্বীনের দাওয়াত দিতেন তখন সবাই মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, কেউ মাওলার কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বা কেউই তার বাপ দাদার ধর্ম থেকে সরে আসতে আগ্রহ পাচ্ছিলেন না। সেই সময়ে এগিয়ে আসেন জনাবে তাহেরা মা খাদিজা, বাসার সামনে চাদর বিছিয়ে তাতে মুদ্রা আর স্বর্নালংকারের স্তুপ করে সবাইকে ডাকতে থাকেন “এসো মুহাম্মদের কলেমা পড়ো, আর যার যা লাগে নিয়ে যাও, দুনিয়াতেও খুশি থাকো আর আখেরাতেও খুশী থাকো।“ অনেকেই দান গ্রহন করে কলেমা পড়ে মুসলিম হয়, আবার কেউ কেউ ভাব দেখায় আমার সম্পত্তি লাগবেনা বলে! তাদেরকে বিবি বলেন “তাহলে আমার কর্জ ফেরত দাও, আর না হয় মুহাম্মদের কলেমা পড়, কর্জ মাফ!” এত লোভনীয় সুযোগ হাতছাড়া করেনি তারা, তাদেরই কেউ কেউ আজ গনী নামে পরিচিত। দিন শেষে যখন মা খাদিজা খালি চাদর থেকে ধুলি ঝাড়তেন তখন আমার মাওলা হেসে বলতেন “বিবি তোমার সব সম্পদ তো শেষ হয়ে যাচ্ছে!” আমার মা ও হেসে বলতেন “ইয়া মাওলা! এগুলি আপনার হাসির সদকা! এ তো কিছুই নয়, আপনার হাসির জন্য এই কানিজের জানও কোরবান!”ইমাম বাকির (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে: "হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মিরাজ থেকে ফিরে আসার পথে হযরত জিবরাইলকে (আ.) বললেন, আপনার কোন ইচ্ছা আছে? হযরত জিবরাইল (আ.) উত্তরে বললেন: আমার ইচ্ছা আপনি আমার এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত খাদিজা (সা. আ.)কে সালাম পৌঁছে দেবেন।"হযরত খাদিজা (সা. আ.) জন্মের পূর্বে, ঐশী গ্রন্থ ইঞ্জিল যা হযরত ঈসার (সা.) উপর অবতীর্ণ হয়েছিল তাতে "বরকতময় নারী ও বেহেশতে হযরত মরিয়মের (আ.) সাথী" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: যেখানে হযরত ঈসাকে (আ.) উদ্দেশ্য করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বলা হয়েছে: তার বংশধর বরকতময় থেকে যিনি বেহেশতে তোমার মাতা হযরত মরিয়মের (আ.) সাথী।যার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন "আল্লাহ মুমিনদের জন্য যেমন ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া ও ইমরান তনয়া মারিয়ামকে উদাহরণ স্বরূপ করেছে, যেভাবে তাঁরা তাদের পবিত্রতাকে বজায় রেখেছিলেন।"যেভাবে আসিয়া ও মারিয়াম তাঁরা তাঁদের পবিত্রতাকে বজায় রেখেছিলেন এবং মহত্বতা অর্জন করেছিলেন। ঠিক সেভাবে হযরত খাদিজা তাঁর পবিত্রতাকে বজায় রেখেছিলেন। তাই হযরত খাদিজা (সা. আ.) কে হযরত আসিয়া ও মারিয়ামের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেহেতু তিনিও আসিয়া ও মারিয়ামের মত নমুনা স্বরূপ ছিলেন।হযরত খাদিজার পদমর্যাদা এত বেশি মূল্যবান ছিল যে, আল্লাহ তাঁর আসমানী কিতাব তাওরাত যা হযরত মুসা (আ.) এর উপর নাজিল হয়েছিল, তাতে উল্লেখ করেছেন যে,"হযরত খাদিজার (সা. আ.) উপমা ঐ নদীর পানির সাথে যে পানি আবে হায়াত নামে প্রসিদ্ধ এবং যে নদীর দুই ধারে জীবন বৃক্ষ আছে, যে বৃক্ষের বারোটি ফল আছে আর ঐ বৃক্ষের পাতাগুলো হচ্ছে উম্মতের জন্য নিরাময় স্বরূপ।"যদিও অন্ধকার যুগে সচ্চরিত্র নারী খুবই কম ছিল ও অনেক নারীই সে যুগে অসৎ কর্মে লিপ্ত ছিল কিন্তু হযরত খাদিজা (সা. আ.) সে যুগেও তার সর্বদিক থেকে পবিত্রতার জন্য "তাহেরাহ" অর্থাৎ পবিত্রা উপাধি অর্জন করেছিলেন।তার ব্যক্তিত্ব সে যুগেও এত বেশী উচ্চ পর্যায়ে ও সম্মানের পাত্র ছিল যে, তাকে সবাই "সায়্যেদাতুন নেসাওয়ান" বা নারীদের সর্দারিনী বলে ডাকতেন।সংক্ষিপ্তাকারে বলতে হয় যে, অন্ধকার যুগের নরীদেও মধ্যে হযরত খাদিজার (সা. আ.) অবস্থান এতটাই প্রিয়ভাজন ও সম্মানিত ছিল যে, পূর্ণতা ও উচ্চ মর্যাদার ক্ষেত্রে ছিলেন অনুপম। সে কারণেই বিবাহের পর রাসূল (সা.) তাকে "কুবরা" বা পরিপূর্ণ ও উচ্চাসন উপাধি দিয়েছিলেন।ইমাম হাসান (আ.) যার সৌন্দর্য্য বনী হাসিমের সবার নিকট উপমা হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি স্বয়ং এক বক্তব্যে বলেছেন:"যখন আল্লাহ তায়ালা সবার চিত্রাঙ্কন করছিলেন আমিই সবচেয়ে বেশী তার সাথে অর্থাৎ হযরত খাদিজার (সা. আ.) সাথে সদৃশ্য ছিলাম"।খাদিজা (সা. আ.) কে দাফন করার পর শিশু কন্যা ফাতিমা (সা. আ.)’কে (বড় জোর সাত বছর বয়স) সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন মহানবী (সা) যখন ফাতিমা (সা. আ.) প্রশ্ন করেন: বাবা! আমার মা কোথায় গেছেন? এ সময় ওহির ফেরেশতা জিব্রাইল (আ) নেমে এসে মহানবীকে বলেন, আপনার প্রভু আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন ফাতিমাকে এটা বলতে যে তিনি (মহান আল্লাহ) ফাতিমার কাছে সালাম বা দরুদ পাঠিয়েছেন এবং বলেছেন, তোমার মা রয়েছেন (খাদিজা) রয়েছে কিংখাব বা বুটিদার রেশমি কাপড়ের এমন একটি ঘরে যার প্রান্ত বা দেয়ালগুলো সোনার নির্মিত ও খুঁটিগুলো চুনি বা রুবি পাথরের তৈরি। ঘরটি রয়েছে আসিয়া বিনতে মুজাহিম (জালিম ফেরাউনের মুমিন স্ত্রী) এবং মারিয়াম বিনতে ইমরানের তথা হযরত ইসার মায়ের ঘরের মাঝখানে।যে বছর হযরত খাদিজা (সা. আ.) ইন্তিকাল করেন সেই বছর ইন্তিকাল করেন রাসূল (সা.)'র প্রিয় চাচা ও অভিভাবক হযরত আবু তালিব(রা.)। তাই এ বছরটিকে ইসলামের ইতিহাসে 'আমুল হোজন' বা 'দুঃখের বছর' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।আজ ১০ রমজান উম্মুল মু‌মি‌নীন হযরত খাদিজা সালামুল্লা‌হি অালাইহ‌ার ই‌ন্তেকাল দিবস।আজকের এই দিনে মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তার উদ্দেশে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা। উম্মুল মু‌মি‌নীন হযরত খাদিজা সালামুল্লা‌হি অালাইহ‌ার ই‌ন্তেকাল দিবস সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।—সৈয়দ হোসাইন উল হক

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদ চেপে রাখা ইতিহাস ঃ ১ম ৩ খলিফা রাসুলের(সাঃ) যে সুন্নতগুলো পরিবর্তন করে ফেলেছিলেনপ্রথম ৩ খলিফার ২৫ বছর সময়ের শাসনকালে,গনঅভ্যুথ্যানের ফলে উসমানের ক্ষমতাচ্যুতি ও হত্যাকান্ডের পুর্ব পর্যন্ত,মহানবী(সাঃ)এর সাহাবীগন ও ইসলামের অন্যান্য প্রজন্ম চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনপাত করছিল।অতঃপর জনগন ইমাম আলী(আঃ)এর প্রতি ফিরে আসে এবং তাঁকে তাদের পরবর্তি খলিফা নিযুক্ত করে(“আল-হাদিছ-ই-উম্মুল মু’মেনিন আয়শা” অধ্যায়-আলা আহদ আল সাহরাইন/১১৫)ইমাম আলী(আঃ) এমন সময়ে খেলাফতে অধিষ্টিত হলেন যখন মুসলমানেরা পুর্ববর্তি খলিফাদের আমলের ২৫ বছরে তাদের নিজেদের স্টাইলে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।ঐ সময়ে বিরাজিত পরিবেশ সম্পর্কে ইমাম আলী(আঃ)নিজে যে বর্ননা দিয়েছেন তা হলো নিম্নরুপ(মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব কুলাইনীর গ্রন্থ “রাওজাতুল কাফী”৮/৬১-৬৩তে বিস্তারিত দেখা যেতে পারে)ঃ“আমার পুর্ববর্তি খলিফাগন এমন কাজ করেছিলেন যাতে তারা সচেতনভাবেই রাসুলুল্লাহর(সাঃ) নির্দেশের বিপরীতে চলে গিয়েছিলেন।তাঁর প্রতি করা আনুগত্যের শপথ তারা ভঙ্গ করেছিল এবং তাঁর সুন্নতের পরিবর্তন করেছিল।এখন আমি যদি ঐ সকল বিষয়গুলোকে পরিত্যাগ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করি এবং রাসুল(সাঃ)এর সময় যা ছিল সেইভাবে ঐ বিষয়গুলোকে পুর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনি,তাহলে আমার বাহিনীর লোকেরা আমাকে নিঃসঙ্গ অসহায় অবস্থায় ফেলে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।খুব বেশী হলে এক ক্ষুদ্র সংখ্যক অনুসারী আমার পক্ষে থাকবে;যারা আল-কুরান ও সুন্নাহর ভিত্তিতে আমার ইমামতকে স্বীকার করে”।“আমি যদি নিম্ন বর্নিত ব্যাবস্থাগুলো গ্রহন করি তার ফলাফল কি হবে তা কি তোমরা ভাবতে পারো?ঃ১/রাসুল(সাঃ) যেখানে মাকামে ইব্রাহিমকে স্থাপন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন যদি আমি তা সেখানে পুনঃস্থাপন করি।২/নবী কন্যা ফাতেমা(আঃ)এর সন্তানদেরকে আমি আমি যদি ফিদাকের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেই।৩/মহানবী(সাঃ)এর সময় ওজন ও পরিমাপ যেমন প্রতিস্টিত ছিল,যদি সেই অবস্থায় তা প্রতিস্টিত করি।৪/যেসব ভুমি মহানবী(সাঃ)যাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলেন যদি সেগুলো তাদের কাছে ফিরিয়ে দেই।৫/যদি খলিফাদের জারীকৃ্ত নিষ্টুর আইন বাতিল করি।৬/যদি যাকাত ব্যাবস্থাকে তার প্রকৃ্ত ভিত্তির উপর পুনর্বিন্যাস্ত করি।৭/যদি অজু গোসল ও নামাযের নিয়ম-নীতি সংশোধন করি।৮/যে সকল মহিলাদের অন্যায়ভাবে তাদের স্বামীদের থেকে পৃ্থক করে অন্যদের নিকট দেওয়া হয়েছে,যদি তাদেরকে তাদের আসল স্বামীদের নিকট ফিরিয়ে দেই।৯/বায়তুলমালের অর্থ যেভাবে ধনিকদের প্রদান করতঃশুধুমাত্র তাদের হাতে উহা পুঞ্জিভুত না করে মহানবী(সাঃ)এর সময়কালে যেমন ছিল তেমনিভাবে উহা পাওয়ার উপযুক্ত ব্যাক্তিদের মাঝে সমভাবে বন্টন করি(হযরত উমর রাষ্টিয় কোষাগার হতে অর্থ বন্টনের ক্ষেত্রে সমাজে শ্রেনী বিভাজন চালু করেছিল।সেই সময়ে একটি তালিকা করা হয়েছিল এবং এই অনুযায়ি একদল পাচ্ছিল প্রতি বছর ৫০০০ দিরহাম,অন্য একদল ৪০০০ দিরহাম এবং অন্যান্যরা ৩০০০,২০০০,১০০০ এবং ৫০০ শত থেকে ২০০শত দিরহাম।এইভাবে সমাজে ধনী ও দরিদ্র শ্রেনী সৃষ্টি করা হয়)।১০/যদি ভুমি কর বাতিল করি(হযরত উমর ইরাকের ভুমি কর আরোপ করেছিল ইরানের সাসানিদ রাজন্যদের ভুমি রাজস্ব আইন অনুসারে এবং মিশরে রোমান রাজন্যদের ভুমি রাজস্ব আইন অনুসারে)।১১/যদি দাম্পত্য সম্পর্ক সংক্রান্ত ব্যাপারে সকল মুসলমানকে সমান ঘোষনা করি(হযরত উমর আরবীয় কন্যাদের সাথে অনারবদের বিবাহ নিষিদ্ব করেছিলেন)।১২/যদি আল্লাহর আইন অনুসারে খুমস(সম্পদের এক পঞ্চমাংশ) আদায় করি(সুরা আনফাল-৪১)(৩ খলিফা মহানবী(সাঃ) ওফাতের পর খুমস হতে আহলে বায়াতের প্রাপ্য অংশ বাদ দিয়ে দিয়েছিল)।১৩/যদি মসজিদে নববীকে এর সুচনালগ্নের কাঠামোতে,যে কাঠামোতে রাসুল(সা)এর সময়কালে প্রতিষ্টিত ছিল,পুনঃপ্রতিষ্টিত করি।মহানবী(সাঃ)ওফাতের পর মসজিদের যে প্রবেশ পথ গুলো বন্দ্ব করে দেয়া হয়েছিল তা আবার খুলে দেই,এবং তাঁর ওফাতের পর যে প্রবেশ পথগুলো খোলা হয়েছিল তা আবার বন্দ্ব করে দেই।১৪/যদি ওজুতে চামড়ার মোজার উপর মাসেহ করা নিষিধ্ব করি(‘খুফ’ হচ্ছে পশুর চামড়ার তৈরী মোজা।সুন্নী মুসলমানগন,তাদের পুর্ববর্তীদের মত,ওজুর জন্য নগ্ন পা ধোয়া বাধ্যতামুলক মনে করে,কিন্তু ‘খুফ’ দ্বারা পা আবৃত থাকলে উহা মাসেহ করা যথেষ্ট মনে করে(এব্যাপারে বুখারি শরিফে মিথ্যা হাদিস রয়েছে)।১৫/ “নাবিয” এবং খেজুরের মদপানের উপর দন্ড এবং বিশেষ শাস্তির বিধান চালু করি(নাবিয হচ্ছে একধরনের হাল্কা মদ,যা সাধারনত বিয়ার জাতীয় যব/বার্লি হতে তৈ্রি করা হয়)।১৬/যদি নারী এবং হজ্বের ক্ষেত্রে মহানবী(সাঃ)এর সময়কালে যেমন ছিল,সেই মোতাবেক মু’তার বিধান আইনসিদ্ব করি(খলিফা উমর ২ ধরনের মুতাকে অবৈ্ধ ঘোষনা করেন।হজ্বের মুতা(হজ্বে তামাত্তু) ও নারীর মুতা।একইভাবে নিদিষ্ট কন্যাদের বিবাহ,কুরানের ঘোষনা ও সুন্নী পন্ডিতগনের বননা অনুযায়ী যা সুস্পষ্টভাবেই ইসলামি বিধানের অন্তর্ভুক্ত)।১৭/যদি মৃত ব্যাক্তির জানাযার নামাযে ৫বার তাকবির বলি(আবু হোরায়রার সুত্রে সুন্নীগন মৃতের জানাজা নামাযে ৪বার তাকবির পড়ে থাকে,সুত্রঃইবনে রুশদ আন্দালুসীর “বিদায়া ওয়াল মুজতাহিদ”১//২৪০)।১৮/যদি নামাযের শুরুর সময় শব্দ করে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ তেলাওয়াত করা বাধ্যতামুলক করি(সুন্নিদের একটি গ্রুপ তেলাওয়াতের সময় সুরা ফাতিহা ও অন্য সুরা হতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বাদ দেয়।স্পষ্টতই তারা এই ব্যাপারে মুয়াবিয়াকে অনুসরন করে থাকে,সুত্রঃআল-ফাতিহার তাফসীর, ‘তাফদীরে আল-কাশশাফ’১/২৪-২৫)।১৯/যদি মহানবী(সাঃ)এর সময়কালে তালাকের যে রীতি প্রচলিত ছিল,সেই রীতি কঠোরভাবে অনুসরনের নির্দেশ দেই(তালাক ২ বার……..সুরা বাকারাহঃ২২৯,সুন্নিদের মতে তালাক দেওয়ার জন্য এক বৈঠকে ৩ তালাক উচ্চারন করলে তা বৈ্ধ,এবং এর যথাযথ সাক্ষী না থাকলে তা দ্রুত অনুসমর্থন করাতে হবে,সুত্রঃ’বিদায়াহ ওয়াল মুজতাহিদ ১/৮০-৮৪)।২০/যদি বিভিন্ন জাতির যুধ্ববন্দীদের প্রতি আচরনের ব্যাপারে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল(সাঃ)এর নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরনের নির্দেশ দেই।“ এক কথায় আমি যদি লোকদেরকে আল্লাহতায়ালা এবং রাসুল(সাঃ)এর নির্দেশ অনুসরন করানোর জন্য প্রচেষ্টা গ্রহন করি,তাহলে তারা আমায় ত্যাগ করবে এবং এদিক-সেদিক চলে যাবে”।“আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি,যখন রমযানের মাসে ওয়াযিব(ফরয) নামায ছাড়া অন্য কোন নামায জামাতের সাথে না আদায় করার জন্য আমি লোকদেরকে নির্দেশ দিলাম এবং বুঝিয়ে বললাম যে মুস্তাহাব নামায জামাতের সাথে আদায় করা বিদায়াত,আমার সেনাবাহিনীর একটি দল,যারা আমার পক্ষে একদা যুধ্ব করেছিল,হৈচৈ শুরু করে দিল,বলেঃ’আহ!উমরের সুন্নাত’।‘হে মুসলমানেরা।আলী উমরের সুন্নাত পালটে দিতে চায় ও রমযান মাসে মুস্তাহাব নামায বন্ধ করে দেওয়ার বাসনা করে।তারা এমন গোলমাল শুরু করে দিল যে আমি ভীত হলাম-তারা কিনা বিদ্রোহ করে বসে”।“হায়!”,ইমাম আলী(আঃ) বলতে থাকেন, “আহ এমন যন্ত্রনা আমি এই লোকদের হাতে ভোগ করলাম,যারা অত্যন্ত প্রবল ভাবে আমার বিরোধিতা করে;যারা তাদেরকে কেবলমাত্র জাহান্নামের দিকেই চালিত করেছিল তারা তাদের সেই ভ্রান্ত নেতাদের আনুগত্য করে”।রাসুল(সাঃ) ঘোষিত ১ম ইমাম আলী(আঃ) ১ম ৩ খলিফাদের রীতি-পদ্বতির বিপরীতে বিশেষ করে হাদিস সংক্রান্ত বিষয়ে মহানবী(সাঃ)এর পথ অনুসরন করে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য একটি কার্যক্রম গ্রহন করেছিলেন।তিনি ১ম ৩ খলিফা কত্বৃক চালুকৃ্ত বিদয়াত ( নতুন রীতি পদ্বতি)ধ্বংশ করার জন্যএক বিরামহীন যুদ্ব শুরু করেছিলেন(তিনি সকল কাহিনী কথকদের উপর,যারা উমর ও উসমানের নির্দেশ মোতাবেক জুময়ার দিনে মসজিদসমুহে খোতবা দিত,নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন।তিনি নবীজীর হাদিস মুক্তভাবে কোন লুকানো ছাড়াই বর্ননার রীতি চালু করলেন।তাঁর পক্ষে যতটুকু সম্ভব তিনি খলিফাদের আবিস্কারসমুহের মুলোতপাটন করলেন।বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুনঃ “ মিন তারিখ আল-হাদিস”)প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদনবী পরিবারের(আঃ) শানে পবিত্র কোরানের আয়াতসুরা নুর,আয়াত# ৫৫“আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন তাহাদেরকে যাহারা তোমাদের মধ্যে ঈমান আনিয়াছে এবং সৎ কর্ম করিয়াছে।অবশ্যই তাহাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফাত প্রদান করিবেন”।এই আয়াতের উদ্দেশ্য আল্লাহর রাসুলের(সাঃ) বংশধর।আর এক রেওয়ায়েতে যুগের ইমামকে বুঝান হয়াছে।অন্য রেওয়ায়েতে বলা হইয়াছে যে,হযরত ইমাম মাহদী(আঃ) এবং তাঁহার সঙ্গীদের শানে এই আয়াত নাজিল হইয়াছে।(সুত্রঃ কেফাইয়াতুল মোওয়াহহেদীন, ২য় খন্ড,পৃঃ২৪০; মাজমাউল বায়ান,৭ম খন্ড,পৃঃ১৫২;মেহদী মাউদ,পৃঃ২৫৯;বয়ানুস সায়াদাহ,৩য় খন্ড,পৃঃ১২৯; ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃঃ৪২৫;) দালায়েলুল ইমামাত,পৃঃ৪৫; শাওয়াহেদুত তাঞ্জিল,১ম খন্ড,পৃঃ৪১২;তাফসীরে ফরাত,পৃঃ১০৩)।সুরা ফুরকান,আয়াত# ৫৪“ এবং তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছেন পানি হইতে;অতঃপর তিনি তাহার বংশগত ও বৈবাহিক সম্বন্ধ্ব স্থাপন করিয়াছেন।“ইবনে শিরিন বর্ননা করিয়াছেন যে, এই আয়াতে আল্লাহর রাসুল(সাঃ) হযরত আলী বিন আবি তালিবের শানে নাজিল হইয়াছে,যখন তিনি হযরত ফাতিমাকে(আঃ) হযরত আলীর(আঃ) সাথে বিবাহ দিলেন।আবু আহমদ বিন সুলাইমান হযরত আলী বিন মুসা রেজা(আঃ) হইতে বর্ননা করিয়াছেন এবং তিনি নিজের পবিত্র পুর্ব পুরুষগন হইতে এইভাবে বর্ননা করিয়াছেনঃআমি তাহাদের নিকট হইতে শুনিয়াছি হযরত আলী ফরমাইয়াছেন যে, একদিন আল্লাহর রাসুল(সাঃ) আমাকে ফরমাইলেনঃ হে আলী! আল্লাহ পাক তোমাকে ৩ ধরনের এমন মরযাদা প্রদান করিয়াছেন যাহা আমাকেও প্রদান করেন নাই।১/আমার মত একজন শ্বশুর তুমি পাইয়াছ,২/তোমার স্ত্রী ফাতিমা জান্নাতবাসী সমস্ত রমনীর নেত্রী এবং ৩/তোমার ২পুত্র হাসান এবং হোসাইন শহীদগনের নেতা এবং জান্নাতবাসীদের সর্দার।(সুত্রঃ মাজমাউল বায়ান,৭ম খন্ড,পৃঃ১৫৭; শাওয়াহেদুত তাঞ্জিল,১ম খন্ড,পৃঃ৪১৪;গায়াতুল মোরাম,পৃঃ৩৭৫;জাজবায়ে বেলায়েত,পৃঃ১৫৬;বয়ানুস সায়াদাহ,৩য় খন্ড,পৃঃ১৪৫;জাখায়েরুল উকবা,পৃঃ৩০;ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ,পৃঃ৪৬;শাওয়াহেদুত তানজিল,১ম খন্ড,পৃঃ৪১৪;নুরুল আবসার,পৃঃ১০২।)সুরা ফুরকান,আয়াত# ৭৪“ এবং যাহারা প্রার্থনা করে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক!আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান কর যাহারা আমাদিগের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদিগকে মুত্তাকীদিগের জন্য নেতা ও ইমাম কর”।যাহারা আরজ করে হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দান কর আমাদের স্ত্রীগন হইতে[অর্থাত খাদিজা এবং আমাদের সন্তান-সন্ততি অর্থাৎ হযরত ফাতিমা থেকে],চক্ষু সমূহের শান্তি অর্থাত হাসান-হোসাইন এবং আমাদেরকে পরহেযগারদের আদর্শ করুন।অর্থাৎ নবী পাক(সাঃ) ও হযরত আলী(আঃ) এবং নবী পাকের(সাঃ) বংশধর সম্বন্ধ্বে অবতীর্ন হইয়াছে।তাঁহাদের ছাড়া আর কাউকেও উদ্দেশ্য করা হয় নাই।(সুত্রঃ কেফাইয়াতুল মোওয়াহহেদীন, ২য় খন্ড,পৃঃ৬৬২; মেহদী মাউদ,পৃঃ২৫৯;বয়ানুস সায়াদাহ,৩য় খন্ড,পৃঃ১৫০;দালায়েলে ইমামাত,পৃঃ৪৭; শাওয়াহেদুত তাঞ্জিল,১ম খন্ড,পৃঃ৪১৬;তাফসীরে ফুরাত,পৃঃ১০৬;তাফসীরে কুমী,২য় খন্ড,পৃঃ১১৭প্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন

নবীজী (সাঃ) এর রেসালতের দুইজন সাক্ষ্যদাতা ,প্রথম জন – মহান আল্লাহ।দ্বিতীয় জন – হযরত আলী (আঃ) ।“—- যারা কুফরী করেছে তারা বলে , আপনি রাসুল নন । আপনি বলে দিন , আমার ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহ এবং ঐ ব্যক্তি যার কাছে কিতাবের ( ইলমুল কিতাব ) জ্ঞান আছে , সাক্ষী হিসাবে যথেষ্ট —- ” সুরা রাদ/৪৩ ।আবদুল্লাহ বিন সালাম বলেছেন যে , আমি নবীজীকে (সাঃ) প্রশ্ন করলাম যে , এই আয়াতে ঐ ব্যক্তি যার নিকট কিতাবের সমূদয় জ্ঞান রয়েছে , তিনি কে ?নবীজী (সাঃ) উত্তরে বললেন—” ঐ ব্যক্তিটি হচ্ছে হযরত আলী ইবনে আবু তালিব “।সূত্র – আল কাশফু ওয়াল বায়ান , খন্ড-৪, পৃ-৬০ , আল নাঈম আল মুকিম ,পৃ-৪৮৯ , তাফসীরে কুরতুবি ,খন্ড-৯ পৃ- ৩৩৬ সহ ১৩ টি কিতাবের খন্ড ও পৃষ্ঠার রেফারেন্স দেয়া যাবে ।মহান আল্লাহ স্বয়ং যেখানে হযরত আলীকে (আঃ) সাক্ষী হিসাবে ঘোষনা দিচ্ছেন , সেখানে আমরা হযরত আলীকে (আঃ) কোন পর্যায় মানছি , সেটা আরেকবার ভেবে দেখার অবকাশ আছে ।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদঈদ মোবারকস্বয়ং নবীজির নিজ মুখের কথা ইমাম হাসান মুজতবা উনি হলেন সকল ফাশাদ বিনাস কারি১৫ রমজান ইমাম হাসান ইবনে আলী আল-মুজতাবা (আ.)-এর জন্মদিন। তৃতীয় হিজরির এই দিনে তিনি মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের দিনটি ছিল মঙ্গলবার।হযরত হাসান (আ.)-এর মূল নাম ছিল আল-হাসান এবং আল-মুজতবা ছিল তাঁর উপাধি। তাঁর একটি ডাক নাম ছিল আবু মুহাম্মাদ। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) ছিলেন তাঁর পিতা এবং মহানবী (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতেমা (আ.) ছিলেন তাঁর মাতা। ইমাম হাসান ছিলেন তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র। হযরত হাসান ছিলেন মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যেদিন তাঁর এই দৌহিত্রের জন্মের আনন্দ সংবাদ শোনেন সেদিন তিনি তাঁর স্নেহাস্পদ কন্যার বাড়িতে যান এবং নবজাতককে কোলে তুলে নেন। তিনি শিশু হাসানের ডান ও বাম কানে যথাক্রমে আযান ও ইকামত দেন এবং আল্লাহ তাআলার নির্দেশ মোতাবেক তাঁর নাম রাখেন আল-হাসান।ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.)-এর শৈশব জীবনের প্রথম সাত বছর অতিবাহিত হয় মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দয়ার্দ্র পৃষ্ঠপোষকতায়। তিনি তাঁর সকল মহান গুণের শিক্ষা দান করে এবং খোদায়ী জ্ঞান, ধৈর্য, সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা, দানশীলতা ও সাহসিকতার প্রশিক্ষণ দিয়ে ইমাম হাসান (আ.)-কে সমৃদ্ধ করে তোলেন। জন্মগতভাবে মাসুম এবং আল্লাহ কর্তৃক স্বর্গীয় জ্ঞানে সজ্জিত হওয়ায় তাঁর অন্তরাত্মা লওহে মাহফুজে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।আল্লাহতাআলার পক্ষ থেকে যখনই কোনো অহী নাজিল হতো এবং মহানবী (সা.) তাঁর সঙ্গী-সাথিদের কাছে তা পকাশ করতেন ইমাম হাসান তৎক্ষণাত তা অবগত হতেন। মহানবী (সা.) প্রায়শঃই বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করতেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে হযরত ফাতেমা (আ.)-কে বলার আগেই তিনি নতুন নাযিলকৃত অহীর আয়াতসমূহ হুবহু তেলাওয়াত করছেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে হযরত ফাতেমা মহানবী (সা.)-কে জানান যে, ঐ আয়াতগুলো তিনি ইমাম হাসানের কাছ থেকে শিখেছেন।ইমাম হাসান আল-মুজতাবা এত অধিক নিষ্ঠার সাথে নামায আদায় করতেন যে, সেজদাকালে তাঁর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই যেন আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যেত। তাঁর জীবনের অধিকাংশ রাত অতিবাহিত হয়েছে জায়নামাযের ওপর। নামাযের মধ্যে এত বেশি বিনীত ও আত্মনিবেদিত ভাব সৃষ্টি হতো যে, খোদার ভয়ে তাঁর চোখে অঝোর ধারায় পানি এসে যেত। ওজুর সময় থেকেই খোদার ভয়ে ইমাম হাসানের শরীরে কম্পন সৃষ্টি হতো এবং নামাযের সময় তাঁর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যেত। নামাযের মধ্যে তিনি এত ধ্যানমগ্ন ও খোদার সাথে একাত্ম হয়ে যেতেন যে, আশপাশের অবস্থা সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি যেন অবচেতন হয়ে যেতেন।বিলাসী জীবনযাপনের মতো পর্যাপ্ত বিষয়-সম্পত্তি ইমাম হাসান (আ.)-এর ছিল, কিন্তু তিনি তার সবটাই দরিদ্রদের কল্যাণে ব্যয় করেছেন।তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৌজন্যবোধ সম্পন্ন ও নিরহংকার মানুষ। রাস্তার ভিক্ষুকদের পাশে বসতে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না। ধর্মীয় বিষয়াদিতে জিজ্ঞাসার জবাব দিতে তিনি মদীনার পথেও বসে যেতেন। তিনি অত্যন্ত সম্প্রীতিবোধসম্পন্ন ও অতিথিপরায়ণ ছিলেন এবং কোনো দরিদ্র ও নিঃস্ব লোক তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি তাদেরকে কখনই খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি।মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর এক ঘটনাবহুল যুগের সূচনা হয়। এমনি ধরনের এক পরিবের্তনের পর্যায়ে ইমাম আল-হাসান আল-মুজতাবা (আ.) তাঁর মহান পিতা ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে মিলিত হয়ে ইসলামের শান্তির বাণী ও মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা প্রচারের পবিত্র মিশন অব্যাহত রাখেন।২১ রমজান ইমাম আলী (আ.) শাহাদাত লাভ করলে সেদিন থেকেই হযরত হাসান ইমামতি লাভ করেন। মুসলমানদের অধিকাংশই তাঁর কাছে আনুগত্যের অঙ্গীকার ঘোষণা করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাইয়াত গ্রহণ করে। নেতৃত্ব গ্রহণের সাথে সাথে ইমাম আল-হাসান আল-মুজতাবা (আ.)-কে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী সিরিয়ার গভর্নর আমীরে মুআবিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। অবশ্য, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা মোতাবেক মুসলমানদের একটি ব্যাপক হত্যাকাণ্ড এড়ানোর জন্য তিনি মুআবিয়ার সাথে একটি শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হন (যদিও মুআবিয়া পুরোপুরি ঐ চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাননি এবং মেনে চলেননি)। তবে এভাবে তিনি ইসলামকে রক্ষা করেন ও গৃহযুদ্ধ বন্ধ করেন। তাই বলে এই শান্তি চুক্তির অর্থ কখনই মুআবিয়ার স্থায়ী নেতৃত্ব মেনে নেয়া বুঝায় না। এটি ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসন হস্তান্তরের একটি অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা এবং তাও এই শর্তে যে, মুআবিয়ার ইন্তেকালের পর প্রশাসন ইমাম হাসান (আ.)-এর কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং পরবর্তীকালে ইমাম হোসাইন (আ.) তার উত্তরাধিকারী হবেন। এই ঘটনার পর ইমাম আল-হাসান আল-মুজতাবা (আ.) প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকেন, তবে ধর্মীয় নেতৃত্ব নিজের কাছেই সংরক্ষণ করেন এবং মদীনায় ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।ইমাম হাসান মুজতাবার বিরুদ্ধে চক্রান্ত এতদূর পর্যন্ত পৌঁছায় যে, তাঁর স্ত্রী যাদাকে পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের সাথি করে নেয়া হয়। যাদা ইমামকে বিষপান করায়, যা তাঁর যকৃতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এভাবে ইমাম হাসান (আ.) এক মারাত্মক অনিষ্টকর অপকর্মের শিকার হন এবং ৫০ হিজরির ২৮ সফর শাহাদাত বরণ করেন। মদীনার জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে দাফন করা হয়।ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (আ.) ইমামতি লাভ করেন খোদায়ী নির্দেশ মোতাবেক এবং তাঁর পিতার অসিয়ত অনুসারে। তিনি ইমাম ছিলেন এবং একই সাথে ছয় মাসের জন্য খলিফা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ইমাম হাসান আমীর মুআবিয়ার কাছে খেলাফত ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। দশ বছরের ইমামতকালে ইমাম হাসান (আ.)-কে অত্যন্ত কঠিন অবস্থা ও অত্যাচার-নির্যাতন ভোগের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। এমনকি নিজ গৃহেও তাঁর নিরাপত্তার অভাব দেখা দেয়।মানবীয় পরিশুদ্ধতার দিক থেকে ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন তাঁর মহান মাতামহের এক খাঁটি দৃষ্টান্ত ও পিতার এক স্মারকচিহ্ন।মহানবী (সা.) অনেক সময়ই বলতেন : ‘হাসান ও হোসাইন আমার সন্তান।’ এ কারণে হযরত আলী তাঁর অন্য সন্তানদের কাছে বলতেন : ‘তোমরা আমার সন্তান আর হাসান ও হোসাইন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তান।’ মহানবী (সা.) হযরত হাসান (আ.) ও হযরত হোসাইন (আ.) সম্পর্কে আরো বলেছেন, দণ্ডায়মান থাক আর উপবিষ্ট থাক আমার এই দুই সন্তান হচ্ছে ইমাম।’ইমাম হাসান (আ.)-এর কয়েকটি উক্তি১. যদি তুমি কোনো পার্থিব কল্যাণ লাভে ব্যর্থ হও, তাহলে বিষয়টিকে এভাবে গ্রহণ কর যে, ঐ চিন্তা একেবারেই তোমার মনে আসেনি।২. পরিপক্বতা বা পরিপূর্ণতা দ্বারা পরিচালিত হওয়ার যোগ্যতা ব্যতিরেকে কোনো জাতি পারস্পরিক পরামর্শের পন্থা অবলম্বন কখনই করতে পারে না।৩. বংশগতভাবে যারা দূরবর্তী, ভালোবাসার দ্বারা তাদেরকে নিকটতর করা যায়। আবার ভালোবাসার অভাব হলে বংশগত আত্মীয়দের মধ্যেও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়।৪. সুযোগ-সুবিধা এমন জিনিস যা খুব দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায় এবং ফিরে আসে দেরিতেপ্রচারে মোঃ জাহিদ হুসাইন