পোস্টগুলি

জুন, ২০২০ থেকে পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে

(পর্ব ৪৮): ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র বিদ্রোহের পন্থাজুলাই ২৫, ২০১৯ ১৮:০৩ Asia/Dhakaগত আসরে আমরা বনি উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে বনি আব্বাসের বিদ্রোহ ও ক্ষমতা গ্রহণের ঘটনা উল্লেখ করে বলেছিলাম, ইমাম জাফর সাদেক (আ.) না পারছিলেন বনি আব্বাসদের সমর্থন জানাতে এবং না পারছিলেন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে।রাসূলুল্লাহ (সা.)’র চাচা আব্বাসের বংশধর দাবিদার একদল মানুষ আহলে বাইতের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্লোগান তুলে বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিন্তু ইমাম জাফর সাদেক (আ.) রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে বুঝতে পারেন ক্ষমতার মোহ ছাড়া এদের আর কোনো লক্ষ্য নেই। তাই তিনি এই গোষ্ঠীর সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন এবং বিদ্রোহে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। তবে কেউ কেউ ইমামের এই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, তিনি কেন এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেননি।এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, ইমাম জাফর সাদেক (আ.) যেসব কারণে বিদ্রোহে যোগ দেননি তার প্রথম কারণ হতে পারে মহানবী (সা.)’র রেহলাতের পর হযরত আলী (আ.)’র ক্ষমতা গ্রহণ করতে না পারা। অবশ্য ২৫ বছর পর জনগণের প্রবল চাপে হযরত আলী (আ.) শাসনক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সুস্থ মস্তিষ্কে মুসলিম ভূখণ্ডে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজ করতে পারেননি। মাত্র পাঁচ বছরের শাসনামলে তাঁর ওপর তিন তিনটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়। জঙ্গে জামাল, জঙ্গে সিফফিন ও জঙ্গে নাহরাওয়ানের পর একজন অভিশপ্ত খারেজির হাতে তাঁকে শহীদ হতে হয়।দ্বিতীয় যে কারণে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বিদ্রোহে যোগ দেননি তা ছিল হযরত হাসান (আ.)’র তিক্ত অভিজ্ঞতা। কুফার জনগণ মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও সময়মতো তারা সটকে পড়েছিল যার কারণে ইমাম হাসান মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন। ওই অভিজ্ঞতার আলোকে ইমাম সাদেক (আ.) তাঁর আশপাশে থাকা লোকজনের ওপর নির্ভর করতে পারেননি বলে বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দেননি। এ সম্পর্কে নিজের এক সঙ্গীর সঙ্গে ইমামের কথোকপথন উল্লেখ করা যাক:‘সারির সেইরাফি’ নামের একজন সঙ্গী বলেন: আমি একবার ইমাম জাফর সাদেক (আ.)কে প্রশ্ন করি, আপনি কেন বিদ্রোহ করছেন না? ইমাম পাল্টা প্রশ্ন করেন: এ ধরনের প্রশ্ন করছো কেন? আমি বললাম: আপনার তো প্রচুর সমর্থক ও অনুসারী রয়েছে। ইমাম বলেন: তাদের সংখ্যা কতো হতে পারে বলে তোমার মনে হয়? আমি বললাম: এক লাখ। হযরত বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন: এক লাখ? আমি বললাম: দুই লাখও হতে পারে। ইমামের কণ্ঠে আবার বিস্ময় ঝড়ে পড়ে: দুই লাখ? এ অবস্থায় ইমাম কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে নিয়ে মদীনার বাইরে যান। সেখানে একটি ভেড়ার পাল দেখিয়ে হযরত বললেন: খোদার কসম যদি আমার মাত্র এই কয়জন প্রকৃত অনুসারী থাকত তাহলে আমি কালবিলম্ব না করে বিদ্রোহ করতাম। সারির বলেন, ওই ভেড়ার পালে মাত্র ১৭টি ভেড়া ছিল।বিদ্রোহ না করলেও শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নীরবতা অবলম্বন করাও ইমাম সাদেক (আ.)’র পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি বনি আব্বাস শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা ও সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য নিজের প্রকৃত অনুসারীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি একদিন ধর্মীয় ক্লাসে ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন: আমি কখনো জালেম শাসকদের সাহায্য করব না এবং তাদের স্বার্থে কথা বলার জন্য কলম ধরব না। কারণ, কিয়ামতের দিন জালেম শাসকের পাশাপাশি তাকে সাহায্যকারী ব্যক্তিরাও জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। আলেম ও ফকিহগণকে বিশ্বনবী (সা.)’র উত্তরাধিকারী হিসেবে উল্লেখ করে ইমাম সাদেক (আ.) বলেন, যদি কখনো কোনো ফকিহকে জালেম শাসকের সমর্থক হয়ে যেতে দেখো তাহলে তার দ্বীনদারী নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এবং মানুষের সামনে তার স্বরূপ উন্মোচন করে দেবে।একদিন এক ব্যক্তি ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র কাছে প্রশ্ন করেন: ইহুদিরা তাদের আলেমদের অনুসরণ করার কারণে আল্লাহ তায়ালার ভর্ৎসনার শিকার হয়ে থাকলে মুসলমানরাও তো তাদের আলেমদের অনুসরণ করছে। তাহলে এই দুই পক্ষের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?ইমাম উত্তরে বলেন: সাধারণ ইহুদিরা তাদের আলেমদের চিনত এবং তারা জানত যে, এসব আলেম তাদেরকে মিথ্যা বলছে, হারাম খাচ্ছে, উৎকোচ গ্রহণ করছে এবং আল্লাহর নির্দেশ পরিবর্তন করে নিজেদের মনের অশুভ বাসনাকে আল্লাহর নির্দেশ বলে চাপিয়ে দিচ্ছে। সাধারণ ইহুদিরা আলেমদের এই অপকর্ম সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও অন্ধভাবে তাদেরকে অনুসরণ করার কারণে আল্লাহর উপহাসের পাত্র হয়েছে। এরপর ইমাম বলেন, মুসলমানরাও যদি ইহুদিদের মতো কোনো ভ্রান্ত আলেম বা ফকিহকে অনুসরণ করে তাহলে তারাও আল্লাহর ক্রোধের পাত্রে পরিণত হবে।এরপর ইমাম সাদেক (আ.) অনুসরণযোগ্য আলেম বা ফকিহ’র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেন: যিনি তাঁর আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে নফসের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন, আল্লাহর দ্বীন রক্ষার জন্য কাজ করছেন এবং আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজের কামনা-বাসনাকে জলাঞ্জলি দিতে পেরেছেন তাকে অনুসরণ করা সাধারণ মুসলমানের কর্তব্য। সবশেষে তিনি এ কথাও বলেন, “কিন্তু সমাজে এ ধরনের আলেমের সংখ্যা অত্যন্ত কম।” ইমামের এই দিকনির্দেশনা শুধু তাঁর আমলের মানুষের জন্যই প্রযোজ্য ছিল না বরং সকল যুগের সকল মানুষের উচিত এভাবেই অনুসরণযোগ্য আলেম খুঁজে বের করা।একবার মানসুর আব্বাসি ইমাম সাদেক (আ.)কে চিঠি লিখে জানতে চান, আপনি কেনো রাজ দরবারে আসেন না? ইমাম উত্তরে চিঠি লিখে জানান: আমি যেমন দুনিয়ার ঐশ্বর্য চাই না বলে তোমার দরবারে আসি না তেমনি আখেরাতের ব্যাপারেও তোমার কাছে এমন কোনো পুঁজি নেই যা গ্রহণ করে সৌভাগ্যবান হওয়ার লক্ষ্যে আমাকে রাজদরবারে আসতে হবে।ইমাম রাজদরবারে যাওয়ার পরিবর্তে মানুসর আব্বাসির জুলুমের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করে তোলেন যা ওই শাসকের ভালো লাগেনি। ইমাম ও তাঁর অনুসারিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে মানসুর গোয়েন্দা বাহিনীকে লেলিয়ে দেন। সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী ইমাম ও তাঁর শিয়াদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। এ অবস্থায় ইমাম জাফর সাদেক (আ.) জালেম শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নয়া পন্থা অবলম্বন করেন। #পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৫

(পর্ব ৪৭): ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র মূল্যবান জীবনী ও কর্মজুলাই ২৩, ২০১৯ ১৫:৪২ Asia/Dhakaনবী পরিবারের ইমামগণের মধ্যে ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র সময়কাল ছিল সব দিক দিয়ে অন্য ইমামদের সময়কাল থেকে আলাদা। কারণ, রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে তিনি কঠিন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন।রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইমাম যে সংকটের মুখে পড়েছিলেন তার অন্যতম ছিল নিজ গোত্র বনি হাশিমের পক্ষ থেকে হুমকি। বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর বনি হাশিম গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকজন শাসকগোষ্ঠীর রোষানল থেকে বাঁচার জন্য মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী আবুয়া নামক স্থানে এসে গোপনে বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র সমসাময়িক যুগে এখানে বসবাস করছিলেন ইমাম হাসান (আ.)’র অন্যতম দৌহিত্র আব্দুল্লাহ বিন হাসান মুসান্না। তার সঙ্গে ছিলেন তার দুই ছেলে মুহাম্মাদ ও ইব্রাহিম। পাশাপাশি সেখানে ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)’র চাচা আব্বাসের বংশধর ইব্রাহিমসহ আরো অনেকে।বনি হাশিম গোত্রের এই মানুষগুলো নিজেদেরকে নবী পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু এই দাবির পেছনে তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতায় যাওয়া। তারা জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য এই দাবি করতে থাকেন যে, নবী পরিবারের সদস্যরাই ক্ষমতার একমাত্র উত্তরাধিকারী। কাজেই তাদের কাউকে নির্বাচিত করে ক্ষমতার অধিকারী করা হোক। কিন্তু তারা যে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন তা হলো তারা ইমাম সাদেক (আ.)’র নাম উচ্চারণ না করে সার্বিকভাবে নবী পরিবারের কথা তুলে ধরেন যাতে বনি হাশিম গোত্র থেকে তাদের পছন্দসই ব্যক্তির হাতে শাসনক্ষমতা তুলে দেয়া হয়।এক গোপন বৈঠকে আব্দুল্লাহ তার ছেলে মোহাম্মাদের হাতে বায়াত গ্রহণ করে তার নেতৃত্বে উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য উপস্থিত সবার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি নিজ সন্তান মোহাম্মাদকে ‘উম্মতের মাহদি’ হিসেবে দাবি করেন। তার এ বক্তব্যের পর উপস্থিত সবাই মোহাম্মাদের হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। মোহাম্মাদ সবার মধ্যে মুত্তাকি ও পরহেজগার হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে এই সিদ্ধান্তে কেউ দ্বিমত করেনি।আব্দুল্লাহ এরপর মোহাম্মাদের পক্ষে ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র সমর্থন লাভের চেষ্টা শুরু করেন। তিনি ইমামের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠান। তার পাঠানো প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ইমাম সাদেক (আ.) বনি হাশিম গোত্র পরিদর্শনে আসেন। আব্দুল্লাহ সবার সামনে ইমামকে উদ্দেশ করে বলেন, মুসলিম উম্মাহর পরিস্থিতি বেশি ভালো নয়। এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে সবাই একথা একবাক্যে মেনে নিয়েছেন যে, আমার ছেলে মোহাম্মাদই হচ্ছে উম্মতের মাহদি এবং তারা তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। আপনিও তার হাতে বায়াত গ্রহণ করুন।একথা শোনার পর ইমাম সাদেক (আ.) সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) যে মাহদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন তোমার ছেলে সে নয়। তুমি যদি সেরকমটি মনে করো তাহলে মারাত্মক ভুলের মধ্যে রয়েছ। এরপর তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন: আপনারা যদি ‘উম্মতের মাহদি’ হিসেবে তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেন তাহলে আমি তা করব না। প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদির আবির্ভাবের সময় এখনো আসেনি এবং এই দাবিটি মিথ্যা। তবে আপনাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য যদি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দেয়া হয়ে থাকে তাহলে আমি তার হাতে বায়াত গ্রহণ করব।ইমাম সাদেক (আ.) এই বক্তব্যের মাধ্যমে তার অবস্থান স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেও আব্দুল্লাহ তার বক্তব্যে অটল থাকেন এবং দাবি করেন, তার সন্তানই উম্মতের মাহদি। এ সময় ইমাম আবার বলেন, তোমার ছেলে উম্মতের মাহদি নয় এবং সে নিহত হবে। এ সত্ত্বেও আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মাদের তাকওয়া ও পরহেজগারির জন্য তাকে ভালোবাসতেন ইমাম জাফর সাদেক (আ.)। এ সময় আব্বাসের বংশধররা বা বনি আব্বাস ছিল ক্ষমতার অন্ধ পাগল। তারা বাইরে বাইরে মোহাম্মাদের হাতে বায়াত নিলেও কুফার অধিবাসী আবু সালামাকে নেতা নির্বাচিত করে। এ ছাড়া, তৎকালীন বৃহত্তর খোরাসান অঞ্চলের জন্য আবু মোসলেম নামের এক ব্যক্তিকে আমীর উপাধিতে ভূষিত করে। আবু মোসলেম ক্ষমতায় যাওয়ার পথে আবু সালামাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ধরে নেয় এবং তাকে হত্যা করে। আবু সালামা নিহত হওয়ার আগে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, তিনি ক্ষমতা পিপাসুদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন। তাই তিনি অনুতপ্ত হন এবং খেলাফতকে বনি আব্বাসের হাত থেকে আবু তালেবের বংশধরদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার সংকল্প করেন। এজন্য তিনি মদীনায় অবস্থানরত ইমাম জাফর সাদেক, আব্দুল্লাহ বিন হাসান এবং ওমর বিন আলী বিন হোসেইনের কাছে একটি চিঠি পাঠান। তিনি তার দূতকে সবার আগে ইমাম সাদেক (আ.)’র কাছে যেতে বলেন।আবু সালামা তাকে বলে দেন, যদি ইমাম সাদেক চিঠির বিষয়বস্তু মেনে নেন তাহলে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ব্যক্তির কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি ইমাম মেনে না নেন তাহলে দূত যেন আব্দুল্লাহ বিন হাসানের কাছে যান। কথা অনুযায়ী আবু সালামার দূত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র কাছে চিঠি হস্তান্তরের সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলেন।এবার আবু সালামা’র দূত দ্বিতীয় চিঠি নিয়ে আব্দুল্লাহর কাছে যান। আব্দুল্লাহ চিঠি পেয়ে ভীষণ খুশি হন। তিনি চিঠিটি নিয়ে ইমাম সাদেক (আ.)’র কাছে যান এবং বলেন: এই চিঠিটি আবু সালামা আমাকে পাঠিয়েছে। এতে লেখা আছে, খোরাসানে আমাদের সব শিয়া আমাদের কাছে খেলাফত ফিরিয়ে দেয়ার জন্য মাঠে নামতে প্রস্তুত। আমাকে এ কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়েছেন আবু সালামা।ইমাম সাদেক (আ.) একথা শোনার পর আব্দুল্লাহকে বলেন: আবু সালামা তোমার আগে ঠিক এই চিঠিটাই আমাকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু আমি সেটা ছিঁড়ে ফেলেছি। একথা শুনে আব্দুল্লাহ ক্ষুব্ধ হয়ে ইমামের কাছ থেকে চলে যান।যাই হোক, আব্দুল্লাহ ও তার সন্তানরা ক্ষমতার মোহে বনি আব্বাসের ওপর ভরসা করেন। কিন্তু ইমাম সাদেক (আ.) ভালোভাবে জানতেন, বনি আব্বাস মুখে আহলে বাইতের কথা বললেও প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার পর আবু মোসলেমের মতো সহচরদের পাশাপাশি সব বিরুদ্ধবাদীর ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল।ইমাম জাফর সাদেক (আ.) না পারছিলেন বনি আব্বাসদের সমর্থন জানাতে এবং না পারছিলেন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে। আগামী আসরে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৩

আল হাসানাইন ‎(আ.)العربيةفارسیاردو中国的ภาษาไทยहिंदीবাংলাIndonesiaAzəriSwahiliHausaTürkçeBosnianPусскийFrançaisEnglishনীড়পাতাইসলামী গ্রন্থাগারপ্রবন্ধঅডিও ভিডিওফটো গ্যালারিঅনুসন্ধানঅনুসন্ধান... ‏হাদীসে সাকালাইনShare0 ‏বিভিন্ন মতামত0.0 / 5প্রবন্ধ ‎›হাদিস বিষয়ক জ্ঞান ‎›হাদীসপ্রকাশিত হয়েছে ‎2017-09-15 17:24:33লেখক: ‏এম এফ বারীনবী ‎(সা.) ‏তাঁর আহলে বাইতের অনেক ফযিলতের কথা বর্ণনা করেছেন। তাঁর ঐ সব বর্ণনা আহলে বাইতকে তাঁর উম্মতদের মধ্যে অতি উচ্চ আসনে আসীন করেছে। এই ফযিলতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কোরআন ও আহলে বাইতের একাত্মতা এবং তাদের মধ্যকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তাদের মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধন রয়েছে তা কেয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। শিয়া সুন্নী সকলেই যে হাদীসের ব্যপারে একমত তা হাদীসে ‎‘সাকালাইন’ ‏নামে পরিচিত। নবী করিম ‎(সা.) ‏এরশাদ করেছেন ‎: إنّى تارِكٌ فِيكُمْ الثَقْلَيْنِ کِتَابَ اللهِ و عِتْرَتِی أَهْلَ بَيْتِی إنْ تَمَسَّکْتُمْ بِهِمَا لَنْ تَضِلُّوا أبَداً‘আমি তোমাদের জন্য অতি মূল্যবান দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, ‏অপরটি হচ্ছে আমার রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়, ‏আমার আহলে বাইত। তোমরা যদি এ দুটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধর তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।’ ‏এ হাদিসটি সামান্য শব্দের তারতম্যভেদে বিভিন্ন বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে- ‏সহিহ মুসলিম, ‏৭ম খণ্ড, ‏পৃ:-১২২, ‏দারুল যিল, ‏বৈরুত; ‏সহিহ তিরমিযি, ‏৫ম খণ্ড, ‏পৃ:-৬৬৩, ‏বৈরুত; ‏মুসনাদে আহমাদ, ‏৩য় খণ্ড, ‏পৃ:-১৪, ‏বৈরুত; ‏কানযুল উম্মাল, ‏১ম খণ্ড, ‏পৃ:-১৮৭; ‏মুসতাদরাকে হাকেম, ‏৩য় খণ্ড, ‏পৃ:-১৪৮, ‏বৈরুত।এই হাদীসটি নবী করিম ‎(সা.) ‏এর অনেক বিশিষ্ট সাহাবী বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসটি মুতাওয়াতির ‎(অসংখ্য) ‏সূত্রে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। অনেকেই উল্লিখিত হাদীসটি বিশেরও অধিক সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসের প্রেক্ষাপট ও দলীল সমূহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে নবী ‎(সা.) ‏এই কথাগুলি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাহাবা ও অনুসারীদের সামনে বলেছেন এবং আহলে বাইত ও কোরআনের মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধন রয়েছে, ‏তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।ইবনে হাজার হাইসামি ‎(একজন প্রসিদ্ধ সুন্নী আলেম) ‏এ ব্যাপারে বলেছেন যে, ‏উল্লিখিত হাদীসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেরও অধিক সংখ্যক সাহাবী এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই হাদীসটি বিদায় হজ্জ্বের সময় অথবা আরাফার দিনে স্বয়ং নবীর মুখ থেকে শুনেছেন এবং বর্ণনা করেছেন । কেউ কেউ বলেছেন নবী ‎(সা.) ‏তাঁর অসুস্থতার সময় বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীর সমাবেশে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। অন্য দল বর্ণনা করেছেন যে, ‏নবী ‎(সা.) ‏তায়েফ থেকে ফেরার পর একটা বক্তৃতা দেন এবং সেখানেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।কোরআন এবং আহলে বাইতের মধ্যে বিদ্যমান চিরস্থায়ী ও দৃঢ় বন্ধনের পেছনে একটা সূক্ষ্ণ ঐশী পরিকল্পনা রয়েছে। কোরআনের কিছু কিছু আয়াত সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছে যে, ‏সকল যুগের ঐশী বাণীসমূহ দুটো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবসময় আল্লাহর ঐশী বাণী সে যুগের নবীর মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ওহীর পাশাপাশি একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ ছিলেন, ‏যিনি আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং যিনি আল্লাহর দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন, ‏সেই সাথে অদৃশ্যেরও জ্ঞান রাখেন। অন্যদিকে ঐ ব্যক্তি পূর্ণ পবিত্রতার অধিকারী এবং কু প্রবৃত্তি ও শয়তানের প্ররোচনায় কখনও প্রভাবিত হন না। আল্লাহর ওহী প্রচার এবং প্রসারের দায়িত্ব ছাড়াও তা বর্ণনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে প্রতিষ্ঠা করা, ‏বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তারা পালন করে থাকেন। সর্বোপরি তারা হচ্ছেন ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির দিশারী।আলোচ্য হাদীসটি থেকে যে বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে তা নিম্নরূপঃ১. ‏পবিত্র কুরআন যেভাবে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে টিকে থাকবে, ‏মহানবী ‎(সা.) ‏এর পবিত্র আহলে বাইতও তেমনি কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবেন। অর্থাৎ এ বিশ্বের কোন যুগই ইমাম বা প্রকৃত নেতাবিহীন অবস্থায় থাকবে না।২. ‏বিশ্বনবী ‎(সা.) ‏মানব জাতির কাছে এই দু’টো অমূল্য আমানত গচ্ছিত রাখার মাধ্যমে তাদের সর্বপ্রকার ধর্মীয় ও জ্ঞানের চাহিদা মিটিয়েছেন এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে গেছেন। মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণকে ‎(আ.) ‏সকল প্রকার জ্ঞানের ভান্ডার হিসেবে মুসলমানদের মাঝে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। মহানবী ‎(সা.) ‏তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণের ‎(আ.) ‏যে কোন কথা ও কাজকেই নির্ভরযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন।৩. ‏পবিত্র কুরআন ও মহানবী ‎(সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতকে অবশ্যই পরস্পর থেকে পৃথক করা যাবে না। মহানবী ‎(সা.)-এর আহলে বাইতের পবিত্র জ্ঞানধারা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাদের উপদেশ ও হেদায়েতের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবার অধিকার কোন মুসলমানেরই নেই।৪. ‏মানুষ যদি পবিত্র আহলে বাইতগণের ‎(আ.) ‏আনুগত্য করে এবং তাঁদের কথা মেনে চলে, ‏তাহলে কখনোই তারা পথভ্রষ্ট হবে না। কেননা, ‏তারা সর্বদাই সত্যের সাথে অবস্থান করছেন।৫. ‏মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার ধর্মীয় ও অন্য সকল জ্ঞানই পবিত্র আহলে বাইতগণের ‎(আ.) ‏কাছে রয়েছে। তাই যারা তাঁদের অনুসরণ করবে, ‏তারা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না, ‏এবং তারা অবশ্যই জীবনের প্রকৃত সফলতা লাভ করবে অর্থাৎ পবিত্র আহলে বাইতগণ ‎(আ.) ‏সর্ব প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।এ থেকেই বোঝা যায় যে, ‏পবিত্র আহলে বাইত বলতে মহানবী ‎(সা.) ‏এর পরিবারের সকল আত্মীয়বর্গ ও বংশধরকেই বোঝায় না। বরং পবিত্র আহলে বাইত বলতে নবী বংশের বিশেষ ব্যক্তিবর্গকেই বোঝানো হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞানের অধিকারী হওয়া এবং সর্বপ্রকার পাপ ও ভুল থেকে তাঁদের অস্তিত্ব মুক্ত ও পবিত্র হওয়াই ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বৈশিষ্ট্য। যাতে করে তাঁরা প্রকৃত নেতৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী হতে পারেন। ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেনঃ হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব ‎(আ.) ‏এবং তাঁর বংশের অন্য এগারোজন সন্তান। তাঁরা প্রত্যেকেই একের পর এক ইমাম হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। একই ব্যাখ্যা মহানবী ‎(আ.) ‏এর অন্য একটি হাদীসে পাওয়া যায়।হযরত ইবনে আব্বাস ‎(রা.) ‏বলেনঃ ‎“আমি মহানবী ‎(সা.) ‏কে জিজ্ঞাস করলাম যে, ‏আপনার যেসব আত্মীয়কে ভালবাসা আমাদের জন্যে ওয়াজিব, ‏তাঁরা কারা? ‏মহানবী ‎(সা.) ‏বললেনঃ ‎‘তাঁরা হলেন আলী, ‏ফাতিমা, ‏হাসান এবং হোসাইন।” (ইয়ানাবী-উল-মুয়াদ্দাহ্‌, ‏৩১১ নং পৃষ্ঠা।)হযরত যাবির ‎(রা.) ‏থেকে বর্ণিত বিশ্বনবী ‎(সা.) ‏বলেছেনঃ ‎“মহান আল্লাহ্‌ ‏প্রত্যেক নবীর বংশকেই স্বীয় পবিত্র সত্তার মাঝে নিহিত রেখেছেন। কিন্তু আমার বংশকে আলীর মাঝেই সুপ্ত রেখেছেন।” (ইয়ানাবী-উল-মুয়াদ্দাহ্‌, ‏৩১৮ নং পৃষ্ঠা।)#আল-হাসানাইন

হাদীসে সাকালাইন ও এর সাথে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হাদীসসমূহের পর্যালোচনাহাদীসে সাকালাইনের অর্থঅনেক হাদীস থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে,গাদীরে খুমে একটি ভাষণের মধ্যেই মহানবী (সা.) হাদীসে সাকালাইন ও হাদীসে গাদীরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব হাদীসের কয়েকটি মুত্তাকী আল-হিন্দী তাঁর ‘কানজুল উম্মাল’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ১৬৭),ইবনে কাসির তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে (৫ম খণ্ড,পৃ. ২০৯),আস সাখাভী তাঁর ‘আল-ইসতিজলাব’ গ্রন্থে,আল সামহুদী তাঁর ‘জাওয়াহির আল ইকদাইন’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তাঁর ‘সাওয়ায়েক’ গ্রন্থে তাবারানী ও অন্যদের থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন।কতিপয় হাদীসে ‘খালিফাতাইন’ (উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি) শব্দটি সাকালাইন শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ করা হয়েছে,যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁর মুসনাদে (৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮১) উল্লেখ করেছেন। আবার তাবারানী,ইবনে আবি আসিম,আবু বকর ইবনে আবি শায়বাহ,আল-যারকানী এবং অন্যরাও উল্লেখ করেছেন। এই শব্দ ইমাম আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের নেতৃত্ব ও খেলাফতের বিষয়টিকে সন্দেহাতীতভাবে প্রকাশ করে।এ হাদীসের কতিপয় বর্ণনা,যেমন কুন্দুজী তাঁর ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহতে হাসান ইবনে আলী (আ.) থেকে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাতে নবী (সা.)-এর বাণী রয়েছে যা ইমামতের চিরস্থায়িত্বের বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে :‘হে আল্লাহ! তুমি দুনিয়াকে সৃষ্টির ওপর তোমার হুজ্জাত থেকে খালি রেখ না যাতে তোমার হুজ্জাত বাতিল হয়ে যায় অথবা তুমি তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার পর তোমার বন্ধুরা বিপথে যেতে না পারে। তারা (আল্লাহর হুজ্জাত) সংখ্যায় অল্প,কিন্তু সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহর নৈকট্যশীল। নিশ্চয়ই আমি প্রশংসিত ও মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমার বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বংশধরদের বংশধরদের মধ্যে এবং আমার বীজের মধ্যে এবং আমার বীজের বীজের মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দেওয়ার। আর আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে।’এটি নাহজুল বালাগায় বর্ণিত (হিকাম : ১৪৭) আলী (আ.) কর্তৃক তাঁর শিষ্য কুমাইল ইবনে যিয়াদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ :...হ্যাঁ,পৃথিবী কখনও এমন লোকশূন্য হয়ে যায় না যারা গোপনে বা প্রকাশ্যে আল্লাহর ওপর রক্ষা করে এবং তারা সব সময় শংকিত থাকে যে,আল্লাহর গুপ্ত ওজর ও প্রমাণ যেন অপ্রমাণিত না হয়। তাদের সংখ্যা কত,আর তারা কোথায়? আল্লাহর কসম,তাদের সংখ্যা কম,কিন্তু আল্লাহর নিকট তাদের সম্মান অনেক বেশি। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর ওজর ও প্রমাণ রক্ষা করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের মতো অপর কাউকে বিশ্বাস না করে এবং তাদের মতো অন্য কারও হৃদয়ে আস্থার বীজ বপন না করে।জ্ঞান তাদেরকে সত্যিকার বোধগম্যতার দিকে চালিত করে এবং এ কারণে তারা দৃঢ় প্রত্যয়সম্পন্ন আত্মার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। অন্যেরা যেটাকে কঠিন বলে মনে করে তা তারা সহজ বলে মনে করে। অজ্ঞরা যা বিস্ময়কর মনে করে,তারা তা সাদরে গ্রহণ করে। তারা এ পৃথিবীতে দেহ নিয়ে বসবাস করে,কিন্তু তাদের আত্মা অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। আল্লাহর জমিনে তারা আল্লাহর প্রতিনিধি এবং তাঁর দীনের প্রতি আহ্বানকারী। আহা! তাদেরকে দেখার জন্য আমার আকুল আগ্রহ!হযরত আলীর এ বক্তব্য অনেক হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিক তাঁদের গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ করেছেন। যেমন ইবনে আব্দ রাব্বিহ তাঁর ‘আল ইকদুল ফারীদ’ গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃ. ২৬৫,২৯৩);ইয়াকুবী তাঁর ‘তারিখ’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ৪০০);আল হাররানী তাঁর ‘তুহাফুল উকূল’ গ্রন্থে (পৃ. ১৬৯);আল খাতীব আল বাগদাদী তাঁর ‘তারীখে বাগদাদ’ গ্রন্থে (৬ষ্ঠ খণ্ড,পৃ. ৩৮৯);আল রাযী তাঁর ‘তাফসীরে কাবীর’ গ্রন্থে (২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২);ইবনে আবদুল বার তাঁর ‘আল মুখতাসার’ গ্রন্থে (পৃ. ২৯) এ রেওয়ায়াতটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে হওয়া কতিপয় হাদীস ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ আবদুল আযীয দেহলভী একটি গ্রন্থে (তোহফায়ে ইসনা আশারা) হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক কয়েকটি হাদীস উপস্থাপন করে হাদীসে সাকালাইনের ঘোষিত আহলে বাইতের নেতৃত্বের বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। আমরা এখানে সেই হাদীসগুলো উল্লেখ করে এগুলোর অসারতা প্রমাণ করব।প্রথম হাদীসশাহ আবদুল আযীয তাঁর তুহ্ফা গ্রন্থে বলেন,যদি হাদীসে সাকালাইন গ্রহণ করা হয়েও থাকে,তবু তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অপর কয়েকটি হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব হাদীসের মধ্য থেকে তিনি নিম্নোল্লিখিত হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেন :‘আমার সুন্নাহ অনুসরণ কর এবং আমার পর সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারীদের (খোলাফায়ে রাশেদীনের) অনুসরণ কর,তা আঁকড়ে ধর এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন (আবাকাত আল আনওয়ার গ্রন্থের প্রণেতা) বলেন যে,এমন হাদীস সহীহ নয়।প্রথমত,তিনি বলেন,এ হাদীসটি কেবল সুন্নীদের দ্বারা বর্ণনাকৃত। অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন সুন্নীদের পাশাপাশি আহলে বাইতের মাযহাবের আলেমগণও বর্ণনা করেছেন।দ্বিতীয়ত শাহ আবদুল আযীয এখানে তাঁর স্বঘোষিত নীতি ওপর বহাল থাকেননি যে,আহলে বাইতের মতবাদের বিপক্ষে তাঁর যুক্তি তাদের দ্বারা গ্রহণীয় লেখনীর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হবে।তৃতীয়ত হাদীসটি মুসলিম ও বুখারী লিপিবদ্ধ করেননি-হাদীসের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত যাঁদেরকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করে থাকে।চতুর্থত,উপরিউক্ত হাদীসের সহীহ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। কারণ,সুন্নী আলেমগণের দ্বারাই এ হাদীসের সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।এ হাদীসের ওপর পর্যালোচনাএ হাদীসটি আবু দাউদ,তিরমিযী এবং ইবনে মাজাহ কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে। আবু দাউদের রাবীদের সম্পর্কিত আলোচনা :আল-আরবাদ ইবনে সারিআহ-তিনি এ হাদীসের অন্যতম রাবী (বর্ণনাকারী)। তিনি নির্ভরযোগ্য নন। কারণ,তিনি নিজের সম্বন্ধেই এমন উক্তি করেছেন যে,‘আমি ইসলামের এক-চতুর্থাংশ।’হাজার ইবনে হাজার আল কিলাই-সিরিয়ার একটি শহরে বসবাস করত যে শহরের অধিবাসীরা আলী (আ.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। ইবনে হাজার তাঁর তাহযীব আত তাহযীবে তাঁর অবস্থা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। (৩য় খণ্ড,পৃ. ১১৮)খালিদ ইবনে মাদান ইবনে আবি কারিব আল কিতাবী-সে ছিল ইসলামের ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়ার পুলিশ বাহিনীর প্রধান।সাওর ইবনে ইয়াযীদ-ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে,সে আলী (আ.)-কে ঘৃণা করত। কারণ,তিনি এক যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন এবং তাঁকে একজন গোঁড়া মনে করতেন।পরবর্তী রাবী হলো আল ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম। আবু মুসহার কর্তৃক জালকরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে,যা মিযানুল ইতিদালে যাহাবী উল্লেখ করেছেন (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৪৭) ।অন্যদিকে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ যেসব রাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন,যেমন আবু আসিম,হাসান ইবনে আলী আল-খাল্লাল,বুহাইর ইবনে সা’দ,বাকীয়াহ ইবনে আল-ওয়ালীদ,ইয়াহইয়া ইবনে আবি আল-মুতী,আবদুল্লাহ ইবনে আলা’,মু‘আবিয়া ইবনে সালিহ,ইসমাঈল ইবনে বিশর ইবনে মানসূর এবং আবুল মালিক ইবনে আল-সাব্বাহ-তাঁরা সকলেই দুর্বল রাবী। আহলে সুন্নাতের রেজালশাস্ত্রবিদগণ তাঁদের সকলকেই দুর্বল রাবী হিসাবে অভিহিত করেছেন।উপরন্তু যদি এ হাদীসটি সহীহ বলে ধরেও নিই,তবু তা হাদীসে সাকালাইনের বিপক্ষে কোন গুরুত্ব রাখে না। কারণ,হাদীসে সাকালাইন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিপুল সংখ্যক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে,অন্যদিকে সুন্নী পণ্ডিতদের বিপুল সংখ্যক তাঁদের হাদীস গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করেননি। যদি এ হাদীসটি সত্যিই নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে,তবে ‘সঠিক পথপ্রাপ্ত উত্তরাধিকারী’ শব্দগুলো আহলে বাইতের বারো ইমামের ওপর আরোপ করা যায়-যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা সমর্থিত হতে পারে। আর সেই হাদীসটি হল ‘আমার পরে বারো জন খলীফা বা ইমাম আসবে।’শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত আরেকটি প্রশ্নের জবাব দানআবদুল আযীয বলেছেন,যদি হাদীসে সাকালাইন পূর্বোক্ত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নাও হয়,তবুও ‘ইতরাত’ শব্দ সাধারণভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গোত্র বনি হাশিমের সকল আত্মীয় অথবা হযরত ফাতিমার সকল বংশধরের ওপর আরোপ করা যায়। তাহলে এটি বলা অবান্তর যে,তাঁদের সকলেই হলেন ইমাম।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এ সন্দেহ সম্পর্কে নানা অভিধান রচয়িতার অর্থ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন,যেমন জাওহারী,ইবনে আসির,ইবনে মানযুর,আল ফিরূযাবাদী এবং অন্যরা। তাঁদের মতে ‘ইতরাত’ বলতে বুঝায় কারও নিকটতম আত্মীয় (আখাস আকরাবীন),সন্তানাদি (ওয়ালাদ) এবং বংশধর (যুররিয়াহ)।উপরন্তু তিনি উল্লেখ করেন,হাদীসে সাকালাইন তাঁদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাধান্যের পাশাপাশি তাঁদের পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিও নির্দেশ করে। এমন বর্ণনা নিঃসন্দেহে কেবল বারো ইমামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,আলী (আ.) যাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ‘ইতরাত’ বলে পরিচিত করিয়েছেন এবং কুরআনের ব্যাপারে তাঁদেরকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন।দ্বিতীয় হাদীসশাহ আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত দ্বিতীয় হাদীসটি হলো :‘ধর্মের বিষয়াদি তোমরা এই হুমায়রার (আয়েশা) নিকট থেকে গ্রহণ কর।’তিনি এ হাদীসটিকে সহীহ বলে দাবি করেছেন।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,সুন্নী পণ্ডিতগণই এ হাদীসকে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন :১. আল-মিযযী এবং যাহাবী (আল-তাকরীর ওয়াল তাহবীর ফি শাহর আল-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।২. ইবনুল কাইয়্যেম জাওযীয়াহ,যেসব হাদীস ‘হে হুমায়রা’ এবং ‘আল-হুমায়রা’ শব্দযোগে এসেছে সেসব হাদীসকে তিনি জাল বলে গণ্য করেছেন।৩. ইবনে কাসির,(আল-দুরুর আল-মুনতাশিরাহ ফি আল-আহাদীস আল-মুশতাহিরাহ,পৃ. ৭৯)।৪. ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(আল-তাকরীর ওয়া আল-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯)।৫. তাঁদের পাশাপাশি ইবনুল মুলাক্কিন,আস সুবকি,ইবনে আমির আল-হাজ,আল-সাখাভী,আল-সুয়ূতী,আল-শায়বানী,আল-শেখ আলী আল-কারী,আল-যারকানী,আবদুল আলী আল-শাওকানী এবং অন্যরাও এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তৃতীয় হাদীসশাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে এনেছেন। আর তা হলো :‘আম্মারের নিকট থেকে পথনির্দেশনা চাও।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন হাদীস কখনই হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উত্থাপন করা যায় না। কারণ,হযরত আম্মার নিজেই হযরত আলী (আ.)-এর একনিষ্ঠ শিয়া (অনুসারী) ছিলেন এবং মহানবী (সা.) তাঁকে হযরত আলীকে মেনে চলা ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে :‘হে আম্মার! আলী তোমাকে সত্যপথ হতে বিচ্যুত করবে না। হে আম্মার! আলীর আনুগত্য আমার আনুগত্য,আর আমার আনুগত্যই হল সর্বশক্তিমান ও প্রশংসিত আল্লাহর আনুগত্য।’এ হাদীসটি বেশ কয়েকটি সুন্নী হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ফারায়েদুস সিমতাইন,১ম খণ্ড,পৃ. ১৭৮;আল মাওয়াদ্দাহ ফিল কুরবা;আল খারাযমীর মানাকিব,পৃ. ৫৭ ও ১২৪;ইয়া নাবি আল-মাওয়াদ্দাহ,পৃ. ১২৮ ও ২৫০;মিফতাহ আন-নাযা এবং কানজুল উম্মাল,১২তম খণ্ড,পৃ. ২১২।উপরন্তু এ বিষয়টি অদ্ভুত যে,শাহ আবদুল আযীয এ হাদীসকে হাদীসে সাকালাইনের বিপরীতে উপস্থাপন করেছেন,যেখানে ঐতিহাসিক ইয়াকুবী তাঁর তারিখে (২য় খণ্ড,পৃ. ১১৪) এবং মাসউদী তাঁর মুরুযুয যাহাব (২য় খণ্ড,পৃ. ৩৪২) গ্রন্থে আম্মারকে তাঁদের মধ্যে গণ্য করেছেন যাঁরা প্রথম খলীফার আনুগত্য করা থেকে দূরে ছিলেন। হযরত উমর তাঁর খেলাফতকালে আম্মারের দিকনির্দেশনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং কর্কশ কণ্ঠে তাঁর সাথে কথা বলেছিলেন যখন তিনি ওযূর জন্য পানি না পেলে নামায ছেড়ে না দিয়ে তায়াম্মুম করার মাধ্যমে পবিত্র হবার বিষয়টি তাঁর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। এ ঘটনাটি নিম্নের হাদীস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : মুসনাদে আহমাদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৫;সহীহ মুসলিম,১ম খণ্ড,পৃ. ১১০;আবু দাউদ,নাসাঈ,তাবারী,আল-আঈনী,ইবনে আসির এবং আল-শায়বানীও এ ঘটনা উল্লেখ করেছেন।হযরত উসমান তাঁর খেলাফতকালে আম্মারকে ততক্ষণ প্রহার করেন যতক্ষণ না আম্মার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং মারা যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ঘটনাটি তখন ঘটে যখন তিনি হযরত উসমানের শাসনামলের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে মুসলমানদের প্রতিবাদলিপি তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। এ ঘটনাটি নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে : ইবনে কুতাইবার আল-ইমামাহ্ ওয়াল সিয়াসাহ,১ম খণ্ড,পৃ. ৩২;ইবনে আবদ রাব্বিহের আল-ইকদুল ফারীদ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৯২;মাসউদীর মুরুযুয যাহাব,২য় খণ্ড,পৃ. ৩৩৮;ইবনে আবদুল বারের আল-ইসতিয়াব,৩য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬;ইয়াকুবীর তারিখ,২য় খণ্ড,পৃ. ১৬০।যদিও রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আম্মার সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছিলেন,যেমন ‘আম্মারের শত্রু আল্লাহর শত্রু’,তারপরও রাসূলের কতিপয় সাহাবী কর্তৃক তিনি প্রতিরোধের মুখে পড়েন,তাঁরা তাঁকে ঘৃণা করতেন এবং তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করতেন,যেমন আবদুর রহমান ইবনে আওফ,সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,মুগীরাহ ইবনে শোবা,আবু মূসা আশআরী,আবু মাসউদ আল-আনসারী এবং অন্যরা। আম্মার দৃঢ়ভাবে আলীর পক্ষে এবং আলীর বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে দাঁড়ান। যেমন তিনি তালহা,যুবায়েরের বিপক্ষে জামাল যুদ্ধে এবং মু‘আবিয়ার বিপক্ষে সিফ্ফীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরিশেষে তিনি মু‘আবিয়ার সৈন্যদের দ্বারা নিহত হন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হয় যে,‘আম্মার একদল বিদ্রোহী (আল-ফিআত আল-বাগিয়াহ) কর্তৃক নিহত হবে।’ চতুর্থ হাদীসসাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন আরও কয়েকটি হাদীসের ওপর আলোচনা করেন যা আবদুল আযীয কর্তৃক উত্থাপিত হয়েছে। যেমন :‘ইবনে উম্মে আবদ (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ) এর সিদ্ধান্তের ওপর কর্ম সম্পাদন কর।’ অথবা ‘ইবনে উম্মে আবদ এর অভিমতই তোমাদের জন্য আমার অভিমত।’এ দু’টি হাদীসই দুর্বল (যাইফ) এবং খবরে আহাদ,যেখানে হাদীসে সাকালাইন হলো মুতাওয়াতির। মুসলিম ও বুখারী উভয়েই যেহেতু এটি তাঁদের গ্রন্থে উল্লেখ করেননি,তাই বলা যায় তাঁরা এগুলোর সনদকে দুর্বল মনে করেছেন।উপরন্তু যদি এগুলো সত্য বলে ধরে নেয়া হয় তুবও সেগুলো হাদীসে সাকালাইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ,এগুলো কেবল ইবনে মাসউদের প্রতিভাকে বর্ণনা করে,অন্যদিকে হাদীসে সাকালাইন আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁদের নেতৃত্বের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে।উপরন্তু শাহ আবদুল আযীযের ক্ষেত্রে এখানে দ্বিমুখিতা লক্ষ্যণীয় যে,তিনি এ হাদীসগুলোকে উপস্থাপন করেছেন,অথচ ইবনে মাসউদের কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিবর্তে হযরত উমর তাঁকে ফতোয়া দিতে নিষেধ করেছিলেন,রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছিলেন এবং তাঁর মদীনা ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। এ অবস্থা হযরত উমরের ইন্তেকাল পর্যন্ত বহাল ছিল। হযরত উসমান আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ইবনে মাসউদকে এতটা নির্দয়ভাবে প্রহার করেছিলেন যে,তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। পঞ্চম হাদীসশাহ আবদুল আযীয আরেকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন :‘মু‘আয ইবনে জাবাল হারাম ও হালাল সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।’সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এটি কেবল সুন্নীদের দ্বারাই বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারী এ হাদীসকে পরিহার করেছেন। সুন্নী পণ্ডিতদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়াহ,ইবনে আবদুল হাদী,যাহাবী,মানাভী প্রমুখ এ হাদীসকে দুর্বল মনে করেছেন বা ভিত্তিহীন বলেছেন।এ হাদীসের রাবীদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহমান আল-বাইলামানী,তাঁর পিতা,যায়েদ আল-আম্মি,সালিম ইবনে সালিম হাদীস ও রিযালশাস্ত্রের আলেমগণ কর্তৃক অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছেন। যেমন : বুখারী,নাসাঈ,আল-মাকদিসী,দারে কুতনী,ইবনে হাজার,আল-যাহাবী,ইবনুল জাওযী এবং অন্যরা অবিশ্বস্ত বলেছেন।উপরন্তু তাবাকাতে ইবনে সা’দ (৩য় খণ্ড,পৃ. ৫৮৫) এবং ইবনে আবদুল বারের আল-ইস্তিআবে (৩য় খণ্ড,পৃ. ১৪০৪) এমন কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যাতে বোঝা যায় যে,উপরিউক্ত হাদীসে তাঁর জন্য যে যোগ্যতা দাবি করা হয় তিনি সে রকম যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন না। ষষ্ঠ হাদীসশাহ আবদুল আযীয রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস এনেছেন যেটার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকারের দাবি করেছেন যা তাওয়াতুরের কাছাকাছি :‘আমার পরে যারা আসবে তাদের অনুসরণ কর,আবু বকর ও উমর।’হামিদ হুসাইন বলেন,শুরার দাবি সমর্থনযোগ্য নয় এবং অনেক সুন্নী আলেম এ হাদীসের ত্রুটি পেয়েছেন এবং একে ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। যেমন : আবু হাতিম আল-রাযী,আল-বাযযায এবং ইবনে হায্ম (ফাত্হ আল-কাদির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৫২);তিরমিযী,(সহীহ,৫ম খণ্ড,পৃ. ৬৭২);উকাইলী,(আদ-দুআফা);নাক্কাস,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১৪২);দারে কুতনী,(লিসান আল মিযানে,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);ইবরী আল-ফারগানী,(শারহ আল মিনহাজ);যাহাবী,(মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ১০৫);ইবনে হাজার আল-আসকালানী,(লিসানুল মিযান,১ম খণ্ড,পৃ. ১৮৮ ও ২৭২,৫ম খণ্ড,পৃ. ২৩৭);এবং শায়খুল ইসলাম আল-হারাভী,(আল-দুররুন নাদিদ,পৃ. ৯৭)ইবরাহীম ইবনে ইসমাঈল,ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া,ইয়াহইয়া ইবনে সালামাহ ইবনে কুহাইল এবং আবু আল-জারা-যাঁরা এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাঁদেরকে আবু যুরাহ,আবু হাতিম,ইবনে নুমাইর,দারে কুতনী,বুখারী,নাসাঈ,ইবনে মুঈন,ইবনে হিব্বান,তিরমিযী এবং অন্য অনেকেই অবিশ্বস্ত বলে গণ্য করেছেন।উপরিউক্ত হাদীসগুলো শাহ আবদুল আযীয উত্থাপন করেছেন এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে,যদি হাদীসে সাকালাইনকে আহলে বাইতের ইমামদের ইমামতের নির্দেশক হিসাবে গণ্য করা হয় তবে এসব হাদীসও হুমায়রা,আম্মার,ইবনে মাসউদ,মুয়াজ ইবনে জাবাল,হযরত আবু বকর এবং হযরত উমরের ইমামতের বিষয়টি নির্দেশ করছে। সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন বলেন যে,এমন উপসংহারে আমরা তখনই পৌঁছব যখন উপস্থাপিত হাদীসগুলো নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আবাকাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে,এ হাদীসগুলো দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য যেগুলো কোনভাবেই হাদীসে সাকালাইনের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে না-যা মুতাওয়াতির হাদীস এবং শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক রাবী ও পণ্ডিত কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। সপ্তম হাদীসশাহ আবদুল আযীয তাঁর যুক্তির সপক্ষে মহানবী (সা.)-এর আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা ‘হাদীসে নুজুম’ নামে পরিচিত। হাদীসটি হলো :‘নিশ্চয়ই আমার সাহাবীরা আকাশের নক্ষত্রতুল্য (নুজুম);তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে,তুমি সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আমার সাহাবীদের মধ্যে মতপার্থক্য তোমাদের জন্য রহমত।’সুন্নী আলেমদের মধ্যে যাঁরা এ হাদীসকে অনির্ভরযোগ্য গণ্য করেছেন তাঁরা হলেন :১.আহমাদ ইবনে হাম্বাল (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহবীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯):২.আল-মিযযী (আল-জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৮৯-৯০);৩. আল-বাযযায (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০);৪. ইবনে আল কাততান,(আল-কামিল);৫. দারে কুতনী (লিসান আল-মিযান,২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৭);৬. ইবনে হায্ম,(বাহার আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৮);৭. আল-বায়হাকী,আল-হাফিয আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);৮. ইবনে আবদুল বার (জামী বায়ান আল-ইলম,২য় খণ্ড,পৃ. ৯০-৯১);৯. ইবনে আসাকির (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);১০. ইবনুল জাওযী,(আল-ইলাল আল-মুতানাহিয়াহ ফি আল-আহাদীস আল-ওয়াহিয়াহ);১১. ইবনে দাহিয়াহ (তালিক তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);১২. আবু হাইয়ান আল-আন্দালুসী (আল-দুর আল-লাকিত মিন আল-বাহর আল-মুহিত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৭-৫২৮);১৩. আল-যাহাবী (মিযানুল ইতিদাল,১ম খণ্ড,পৃ. ৪১৩,২য় খণ্ড,পৃ. ১০২ ও ৬০৫);১৪. ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযীয়াহ (ইলাম আল-মুকিন,২য় খণ্ড,পৃ. ২২৩)১৫. যাইন আল-দীন আল-ইরাকী (তাখরীয আহাদীস আল-মিনহাজ);১৬. ইবনে হাজার আল-আসকালানী (তালখীস আল-খাবীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৯০-১৯১)১৭. ইবনে আল-হুমাম (আল-তাহরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);১৮. ইবনে আমীর আল-হাজ (আল-তাকরীর ওয়া আত-তাহরীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ৯৯);১৯. আল-সাখাভী (আল-মাকাসিদ আল-হাসানাহ্,পৃ. ২৬-২৭);২০. ইবনে আবি শারীফ (ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২১. আল-সুয়ূতী (ইতমাম আল-দিরায়াহ্ এবং আল-জামি আস-সাগীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২২. আল-মুত্তাকী আল-হিন্দী (কানজুল উম্মাল,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ১৩৩);২৩. আল-কারী (আল-মিরকাত,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫২৩);২৪. আল-মানাভী (আল-তাইসির ফি শারহ আল-জামি আস-সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ৪৮ এবং ফায়যুল কাদীর,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৭৬);২৫. আল-কাফাযী [নাসীম আর রিয়াদ (আশ শিফার ব্যাখ্যাগ্রন্থ),৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩২৩-৩২৪];২৬. আল-সিন্দী (দিরাসাত আল-লাবিব ফি আল-উসওয়াত আল-হাসানাহ্ আল-হাবীব,পৃ. ২৪০);২৭. আল-কাযী মুহিব্বুল্লাহ আল-বিহারী (মুসাল্লিম আল-সুবুত বি শারহ আবদুল আলী,২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০);২৮. নিযাম আল-দীন সাহালাভী [আল-সুবহ আল-সাদিক (মানার এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ)];২৯. আল-মাওলাভী আবদুল আলী [ফাওয়াতিহ আর-রাহমাত (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত),২য় খণ্ড,পৃ. ৫১০];৩০. আল-শাওকানী (ইরশাদ আল-ফুহুল,পৃ. ৮৩);৩১. ওয়ালিউল্লাহ ইবনে হাবীবুল্লাহ্ আল-লাখনাভী (শারহ মুসাল্লিম আস-সুবুত);৩২. সিদ্দীক হাসান খান আল-কনৌজী (হুসুল আল-মামুল,পৃ. ৫৬৮)।৩৩. নাসির উদ্দিন আলবানী (যঈফ ও মওযু হাদীস)নিম্নলিখিত কারণেও এ হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য :১. হাদীসটি কেবল এটিই ইঙ্গিত করে না যে,প্রত্যেক সাহাবীই ন্যায়নিষ্ঠ;বরং প্রত্যেকেই উম্মতের যোগ্য নেতা ও পথপ্রদর্শক। এটি সর্বসম্মতভাবে মিথ্যা। কারণ,তাঁরা নিজেরাই পথনির্দেশনার মুখাপেক্ষী ছিলেন।২. ইতিহাসের বর্ণনা মতে তাঁদের একটি দল বিভিন্ন গুরুতর পাপের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। যেমন হত্যাকাণ্ডএবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান ইত্যাদি। আর তাই এটি যুক্তিসংগত নয় যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মাহর পথনির্দেশক ও নেতা মনোনীত করবেন।৩. পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে,বিশেষ করে সূরা বাকারা,সূরা আহযাব,সূরা জুমুআহ এবং সূরা মুনাফিকুন,যেগুলো সাহাবীদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের মন্দ চরিত্রের ওপর আলোকপাত করেছে এবং এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) এমন ব্যক্তিদের উম্মতের পথনির্দেশক ও নেতা বলে ঘোষণা করবেন।৪. মাযহাব নির্বিশেষে বিভিন্ন সূত্রে মহানবী (সা.)-এর অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যেগুলো সাহাবীদেরকে একটি দল হিসাবে গণ্য করেছে। উপরিউক্ত হাদীস সেসব নির্ভরযোগ্য হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।১৫. সুন্নী সূত্রে অনেক হাদীস রয়েছে যা উম্মাহকে সাহাবীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে। যাইন আল-ফাতা ফি তাফসীরে সূরা হাল আতা’য় আসিমী কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়েছে যে,মহানবী (সা.) বলেছেন :‘আমার পরে আমার সাহাবীদের দ্বারা বেদআত তৈরি করা হবে (যেমন তাদের মধ্যে যে ফিতনা হবে)। আল্লাহ তাদের পূর্বেকার (উত্তম) আমলের কারণে তাদের ক্ষমা করে দেবেন,কিন্তু যদি লোকজন আমার পরে তাদের অনুসরণ করে,তবে আল্লাহ তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।’৬. মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ এমন সব কথা বলেছেন যাতে বোঝা যায় যে,উম্মতের নেতা ও পথপ্রদর্শক হওয়ার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না। হযরত আবু বকর ও হযরত উমর তাঁদের নিজেদের সম্পর্কে এমন অনেক বিবৃতি দিয়েছেন যা প্রকাশ করে যে,পথপ্রদর্শক হিসাবে কুরআনের মতো নির্দ্বিধায় অনুসরণ করার মতো যোগ্যতা তাঁদের ছিল না।২হাদীসে নুজুম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকার ফলে শাহ আবদুল আযীয স্বীকার করেছেন যে,কিছু সংখ্যক সাহাবী ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। কারণ,তা কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশের (নাস) বিপরীত। তারপরও তিনি স্বীকার করেছেন যে,যেসব ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায় না সেসব ক্ষেত্রে সাহাবীদের ইজতিহাদের অনুসরণ করা যাবে।সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন এর জবাব দিয়েছেন এভাবে :প্রথমত যে ব্যক্তির ফতোয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল করার ব্যাপারটি নিশ্চিত সে আইনসঙ্গতভাবে পথপ্রদর্শক হতে পারে না।দ্বিতীয়ত যেখানে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও সাহাবীদের ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে,তাহলে যেখানে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে ভুল করার সম্ভাবনা আরও অনেক বেশি।তৃতীয়ত যেখানে সঠিক পথপ্রদর্শক রয়েছেন-যাঁর পথনির্দেশনা এবং যাঁর পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছে,সেখানে যার ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে তার অনুসরণ করার কোন অনুমতি নেই। আয়াতে তাতহীর (সূরা আহযাব : ৩৩) এবং হাদীসে সাকালাইনসহ অনেক আয়াত ও হাদীস আহলে বাইতের ইমামদের নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছে।চতুর্থত সাহাবীরা শরীয়তের অনেক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করেছেন-যেগুলোর ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের সকলকে পথনির্দেশনার জন্য নক্ষত্রতুল্য বিবেচনা করা সম্পূর্ণরূপে ভুল।পঞ্চমত সাহাবীরা নিজেরাই একে অপরের ভুল ধরেছেন। কখনও কখনও পরিমিতিবোধ লুপ্ত হয়েছে;একে অপরকে মিথ্যাবাদী,অজ্ঞ,এমনকি কাফের পর্যন্ত বলেছেন-যেগুলো আহলে সুন্নাতের গ্রন্থাদিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয়ই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন কোন ব্যক্তি তাঁদের প্রত্যেককে মুসলিম উম্মাহর সঠিক পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করবে না।ষষ্ঠত সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁরা কিয়াসের অনুশীলন করতেন যে বিষয়ে উম্মতের বিপুল সংখ্যক আইনজ্ঞ দোষারোপ করেছেন।সপ্তমত তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন,এমনকি প্রথম তিন খলীফাও,যাঁরা শরীয়তের নানা বিধান জানার জন্য অন্যদের শরণাপন্ন হতেন। এটি মনে করা অযৌক্তিক যে,মহানবী (সা.) মতবাদগত ও আইনগত বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তিদের উম্মতের কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করবেন। তাঁদের মধ্যে এমনও ছিলেন যাঁরা কুরআনের কিছু শব্দের অর্থও বুঝতেন না। যেমন হযরত উমর ‘কালালাহ’ শব্দের অর্থ বুঝতেন না যেটা তাবারী তাঁর তাফসীরে (৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৮৩-২৮৪) উল্লেখ করেছেন। হযরত উমরের নিজের কথাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।অষ্টমত তাঁদের কেউ কেউ সুদের লেনদেনের সাথে জড়িত ছিলেন৩,কেউ মদ বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন৪ অথবা জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও ফতোয়া দিতেন,এমনকি মহানবী (সা.)-এর স্পষ্ট হাদীসের বিপরীতে। কেউ কেউ মহানবী (সা.)-এর সুন্নাতের বিপরীতে বেদআত সৃষ্টির দোষে দুষ্ট। ‘কিতাবুল্লাহ ও আমার সুন্নাহ’ সংক্রান্ত হাদীসের ওপর আলোচনাপথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে সমাজে বহুল প্রচলিত যে হাদীস বিদ্যমান তা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদীস :‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। তোমরা যতক্ষণ তা ধরে থাকবে পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’‘মহান আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ আঁকড়ে ধর’-এ হাদীসটি অনির্ভরযোগ্য এবং এর কোন সহীহ সনদ নেই। কারণ,এ রেওয়ায়াতটি আহলে সুন্নাতের মাত্র আটজন আলেম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর সবকটির সনদ দুর্বল এবং ত্রুটিযুক্ত। নিচে এ হাদীসটি নিয়ে আলোচনা করা হলো :১. মালেক ইবনে আনাস বলেছেন : আমার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে যে,দু’টি জিনিস আমি তোমাদের মধ্যে রেখে যাচ্ছি যেগুলো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও গোমরাহ হবে না : মহান আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক,সুয়ূতীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ,২য় খণ্ড,পৃ. ২০৮;ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র.),২য়খণ্ড,তাকদীর অধ্যায়,রেওয়ায়াত ৩,পৃ. ৬১৭)তিনি এ হাদীসটি সনদ ছাড়াই মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন।২. ইবনে হিশাম এ রেওয়ায়াতটি মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনিও সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৬০৩)৩. হাকিম নিশাবুরী এ হাদীসটি দু’টি সনদসহ বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অপরটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (মুসতাদরাকে হাকিম,১ম খণ্ড,পৃ. ৯৩)হাকিম কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটির প্রথম সনদে ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস বিদ্যমান যাঁকে এক বিরাট সংখ্যক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ (দুর্বল) বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি এবং তাঁর পিতা যাঈফ। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : তিনি তাঁর মামার কাছ থেকে বেশ কিছু গারীব (অদ্ভুত) হাদীস বর্ণনা করেছে যেগুলো কেউই গ্রহণ করেননি। ইবনে হায্ম তাঁর নিজের সনদ সহকারে সাইফ ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেছেন : ইসমাঈল ইবনে আবি উওয়াইস হাদীস জা’ল করতেন...। (তাহযীবুত তাহযীব,১ম খণ্ড,পৃ. ২৭১)আর দ্বিতীয় সনদে সালেহ ইবনে মূসা তালহী কুফী বিদ্যমান যাঁকে বহু সুন্নী রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ বলেছেন। ইবনে মুঈন বলেন : তিনি কিছুই নন (অর্থাৎ তাঁর কোন মূল্যই নেই)। বুখারী বলেছেন : তিনি হাদীস প্রত্যাখ্যানকারী। নাসাঈ বলেছেন : তিনি যাঈফ। ইবনে আদী বলেছেন : জুমহুর আলেমগণ তাঁকে গ্রহণ করেন না। আকীলী বলেছেন : তাঁর কোন হাদীসই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৫৪)৪. আবু বকর বাইহাকী এ হাদীসটি দু’টি সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যার একটি ইবনে আব্বাস এবং অন্যটি আবু হুরাইরা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। (আস-সুনানুল কুবরা,১০ম খণ্ড,পৃ. ১১৪)। এ সনদটিও হাকিম নিশাবুরীর সনদসমূহের মতো প্রথম সনদে ইবনে আবি উওয়াইস এবং দ্বিতীয়টিতে সালেহ ইবনে মূসা আছে যাঁদের উভয়কেই যঈফ বলে গণ্য করা হয়েছে।৫. ইবনে আবদুল বার আল কুরতুবীও এ হাদীসটি দু’টি সূত্রে রেওয়ায়াত করেছেন। (ইবনে আবদুল বার প্রণীত আত তামহীদ)। এর প্রথম সনদ হচ্ছে ঐ সূত্র যা হাকিম আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন এবং এর মধ্যে সালেহ বিন মূসা বিদ্যমান যাঁকে অনেক রিজালশাস্ত্রবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন।আর এর দ্বিতীয় সনদে কাসীর বিন আবদুল্লাহ বিদ্যমান যাঁকে একদল রিজালবিদ যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁকে হাদীস অমান্যকারী ও প্রত্যাখ্যানকারী বলে বিবেচনা করতেন এবং তাঁর কোন মূল্যই দিতেন না। নাসাঈ তাঁকে সিকাহ (বিশ্বস্ত) বলে বিবেচনা করেননি। ইবনে আদী বলেছেন : তাঁর বর্ণনাকৃত রেওয়ায়াতসমূহ অনুসরণযোগ্য নয়। আলী ইবনে মাদানীও তাঁকে যাঈফ প্রতিপন্ন করেছেন। ইবনে আবদুল বার বলেছেন : তাঁর যঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি তাঁর পিতা ও দাদা থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিব্বান বলেছেন : তাঁর দাদার সূত্রে তাঁর পিতা থেকে যেসব রেওয়ায়াত তিনি বর্ণনা করেছেন সেগুলো আসলে একটি জাল পাণ্ডুলিপির সাথে জড়িত যা গ্রন্থ হিসাবে বর্ণনা করা সঠিক নয়। (আল-ইলমা ফী যাবতির রেওয়ায়াহ ওয়া তাকঈদিস সিমা’,পৃ. ৮-৯)৬. কাযী আইয়ায এ হাদীসটি নিজ সূত্রে আবু সাঈদ খুদরীর মাধ্যমে মহানবী (সা.)থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু (এ সনদের) এর বেশ কতিপয় রাবী যঈফ বলে গণ্য হয়েছে যে,তাঁদের মধ্যে শুআইব ইবনে ইবরাহীম ইবনে সাইফ ইবনে উমরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশেষ করে সাইফ ইবনে উমরের যাঈফ হওয়ার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রবিদগণের ইজমা রয়েছে। (তাহযীবুত তাহযীব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৫৯)৭. সুয়ূতীও উপরিউক্ত হাদীসটি হাকিম নিশাবুরীর ঐ একই সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যা ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে। (মানাভী প্রণীত ফাইযুল কাদীর,৩য় খণ্ড,পৃ. ২৪০)৮. মুত্তাকী হিন্দীও ‘কানযুল উম্মাল’ গ্রন্থে কিতাব ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের অবতারণা করেছেন। একই শিরোনামের অধীনে হাকিম ও বাইহাকীর মতো অন্যান্য হাদীসবেত্তার রেওয়ায়াতসমূহ উল্লেখ করেছেন এবং আল-ইবানাহ থেকেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি বলেছেন : এ হাদীসটি অত্যন্ত গরীব।উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,এমন একটি হাদীসকে ‘হাদীসে সাকালাইন’ এর মতো মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীসের বিপরীতে উপস্থাপনের কোন অবকাশই নেই। টীকা১. বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে (কিতাব আল-রুকুক) নিচের এই মুতাওয়াতির হাদীসটি হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণনা করেছেন :বুখারী মুসলিম ইবনে ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেন,যিনি উহাইব থেকে,তিনি আবদুল আযীয থেকে,তিনি আনাস থেকে বর্ণনা করেন যে,মহানবী (সা.) বলেন : ‘আমার কাছে হাউসের (হাউসে কাওসার) নিকট আমার সাহাবীদের একটি দলকে আনা হবে এবং আমি তাদের চিনতে পারব;তাদেরকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বলব,(হে আল্লাহ! তারা কি) আমার সাহাবী (নয়)? (আল্লাহ) বলবেন,‘তুমি জান না,তোমার পরে তারা কী করেছিল!’অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে (১৪৪২ নং) মহানবী (সা.)-কে বলা হবে : ‘তোমার জানা নেই যে,তোমার পর তারা কী করেছিল! তারা পতনশীল আচরণে (শিরকের অবস্থায়) ফিরে গিয়েছিল।’বুখারী একই রকম হাদীস আর-রুকুক অধ্যায়ে হুযায়ফাহ (১৪৩৫ নং),আবদুল্লাহ (১৪৩৫ নং),সাহল ইবনে সা’দ (১৪৪২ নং),আবু সাইদ আল-খুদরী (১৪৪২ নং),ইবনে আব্বাস (১৪৪২ নং),আবু হুরায়রাহ (১৪৪৩ নং) এবং আসমা বিনতে আবি বকর (১৪৪৯ নং) থেকে বর্ণনা করেছেন এবং তাফসীর ও বাদাউল খালক অধ্যায়েও বর্ণনা করেছেন। একই হাদীস কিছু শব্দগত পার্থক্যসহ মুসলিম,আবু দাউদ,তিরমিযী,নাসাঈ,ইবনে মাযাহ,ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল তাঁদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় (কিতাব আল-তাহারাত অধ্যায়ে,হাদীস নং ২৮) কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন।ইমাম মালিক তাঁর মুয়াত্তায় কিতাব আল জিহাদ এ ৩২ নং হাদীস হিসাবে নিম্নের হাদীসটি এনেছেন :মহানবী (সা.) ওহুদের শহীদদের উদ্দেশে বলেন : ‘আমি তাদের ব্যাপারে সাক্ষী।’ তখন আবু বকর বলেন : ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা কি তাদের ভাই নই? আমরা তাদের মতো ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তাদের মতো জিহাদ করেছি।’ মহানবী (সা.) জবাব দেন : ‘হ্যাঁ,কিন্তু আমি জানি না যে,আমার পরে তোমরা কী করবে...।’উদাহরণস্বরূপ দেখুন,আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পণ্ডিত মাহমুদ আবু রিয়াহ প্রণীত আদওয়া আলাল সুন্নাত আল মুহাম্মাদীয়াহ,পৃ. ৩৩৯-৩৬৩,এবং আল্লামা হিল্লী কর্তৃক প্রণীত নাহজ আল হাক্ক ওয়া কাশফ আস সিদক,পৃ. ২৬২-৩৭৫;এ দু’টি গ্রন্থ পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনেক হাদীস আলোচনা করেছেন যেগুলো পথপ্রদর্শক হিসাবে রাসূলের প্রত্যেক সাহাবীর নক্ষত্রতুল্য হওয়ার সম্ভাবনার ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে।২. ইবনে সা’দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থে (লেইডেন,১৩২২) ২য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হযরত আবু বকরের একটি ভাষণ উল্লেখ করেছেন,যেখানে তিনি বলেছেন : ‘আমি একজন মানুষ মাত্র এবং আমি তোমাদের চেয়ে উত্তম নই। সুতরাং আমার আনুগত্য কর যখন আমি সোজা পথে চলি এবং আমাকে সংশোধন কর যখন আমাকে ভুল পথে দেখ। তোমাদের জানা উচিত যে,(কখনও) আমি শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হই। সুতরাং যখন তোমরা আমাকে ক্রোধান্বিত দেখ,তখন আমার থেকে দূরে থেক।’ একই রকম বক্তব্য তাঁর থেকে লিপিবদ্ধ করেছেন :ক. তাবারী তাঁর তারিখে,(কায়রো,১৩৫৭),২য় খণ্ড,পৃ. ৪৪০;খ. ইবনে কুতায়বা তাঁর আল-ইমামাহ্ ওয়াস সিয়াসাহ্ (মাকতাবাতুল ফুতুহ আল-আদাবিয়্যাহ,১৩১),পৃ. ৬;গ. আল হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ (১৩৫২),৫ম খণ্ড,পৃ. ১৮৩;ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল (হায়দারাবাদ,১৩১২) ২য় খণ্ড,পৃ. ১৩৬ এবং অন্যরা।দ্বিতীয় খলীফা উমর প্রায়ই বলতেন,‘প্রত্যেকেরই (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি জ্ঞান রয়েছে (কুল্লু আহাদিন আ’লামু মিন উমার) এবং ‘সকল লোকের (শরীয়ত সম্পর্কে) উমরের চেয়ে বেশি বুঝ আছে’ (কুল্লু আহাদিন আফকাহু মিন উমার)। এর জন্য দেখুন :ক. আল-বায়হাকী,সুনান (হায়দারাবাদ,১৩৪৪),৭ম খণ্ড,পৃ. ২৩৩;খ. আল-সুয়ূতী,আল-দুররুল মানসূর (আল মাতবাআতুল মাইমানিয়্যাহ্,১৩১৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;গ. আল-জামাখশারী,আল-কাশশাফ (মিসর,১৩৫৪),সূরা ৪,আয়াত ২০ এবং সূরা ৩৪,আয়াত ১৩ এর তাফসীর;ঘ. আল-মুত্তাকী,কানজুল উম্মাল,৮ম খণ্ড,পৃ. ২৯৮;ঙ. আল-হায়সামী,মাজমাউল যাওয়ায়েদ,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ২৬৩।৩. হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে যায়েদ ইবনে আরকাম এবং একজন মহিলার লেনদেনের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। এ হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে :ক. আবদুর রাযযাক,আল মুসান্নাফ;খ. ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল,তাঁর মুসনাদে;গ. আল-জাসসাস,আহকামুল কুরআনে;ঘ. আল-সারাখশী,মাবসুত;ঙ. আল-দাবুসী,তাসীস আন-নাযার,এবং অনেক সুন্নী আইনজ্ঞ,হাদীসশাস্ত্রবিদ এবং তাফসীরকারই তাঁদের গ্রন্থাদিতে এটি উল্লেখ করেছেন।৪. বুখারী,মুসলিম,দারিমী,ইবনে আবি শায়বাহ,নাসাঈ,ইবনে আসির,গাযযালী,মুত্তাকী,ইবনে খালদূন এবং আবু হিলাল আল-আসকারী কতিপয় হাদীস উল্লেখ করেছেন যেখানে কতিপয় সাহাবী কর্তৃক মদ বিক্রির বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। (প্রবন্ধটির প্রধান অংশ সংকলিত হয়েছে প্রখ্যাত ভারতীয় আলেম সাইয়্যেদ হামিদ হুসাইন লক্ষ্ণৌভী রচিত ‘আবাকাত আল আনওয়ার’ থেকে।)

(পর্ব ৪৬): হিশামের ক্রোধের শিকারে ইমাম বাকের(আ.) শাহাদাৎবরণ করেনজুন ২৭, ২০১৯ ১৮:১৬ Asia/Dhakaগত আসরে আমরা বলেছি, নবী পরিবারের পঞ্চম ইমাম- ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) যেসব উল্লেখযোগ্য কাজ করেন তার অন্যতম হচ্ছে, প্রকৃত শিয়া মুসলমানের গুণাবলী উপস্থাপন করেন। আজকের আসরে আমরা উমাইয়া শাসক হিশামের ক্রোধের শিকার হয়ে ইমামের শাহাদাৎবরণের ঘটনা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব।ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই ঐশী ধর্মের দিকনির্দেশনা ব্যক্তিজীবনে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। শুধুমাত্র ধর্মের কথা মুখে বললেই হবে কাজেও বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। এ সম্পর্কে ইমাম বাকের (আ.) তার অনুসারী জাবেরকে বলেন: তুমি কি মনে করো আমাদের অনুসারী হওয়া এবং আমাদেরকে ভালোবাসার দাবি করাই যথেষ্ট? যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্য হওয়াকে ভয় পায় না এবং তাঁর নির্দেশ মেনে চলে না আল্লাহর কসম সে আমাদের অনুসারী বা শিয়া নয়। হে জাবের! জেনে রেখো, যেসব বৈশিষ্ট্য দেখে প্রকৃত শিয়াকে চেনা যাবে তার কয়েকটি হচ্ছে বিনয়, আমানতদারি, বেশি বেশি আল্লাহর জিকির, রোজা রাখা, নামাজ কায়েম করা, পিতাপাতার সেবা করা, প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা করা, এতিম ও ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা, সত্যবাদী হওয়া, কুরআন তেলাওয়াত করা, পরোপকার করা এবং মানুষের কাছে আমিন বা উত্তম মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করা।এরপর ইমাম আরো বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার গোলামি বা আনুগত্য করে সে আমাদের বন্ধু এবং যে ব্যক্তি আনুগত্য করে না সে আমাদের শত্রু। যে ব্যক্তি আমাদের অনুসারী বা শিয়া সে ক্ষুব্ধ হলে মানুষের ক্ষতি করে না এবং খুশির সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে না। সব প্রতিবেশী তার দ্বারা উপকৃত হয় এবং শত্রুর সঙ্গে সে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে।ইমাম বাকের (আ.) যখন আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার জন্য এভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামের বিধিবিধান প্রচারে মগ্ন তখন বর্তমান সময়ের আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর মতো উমাইয়া শাসকরা ইমাম ও তাঁর শিয়াদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার কাজে উঠেপড়ে লেগে যায় তারা খাঁটি মোহাম্মাদি ইসলামকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে ইসলামের বিভিন্ন ফেরকা বা দল তৈরি করে সেগুলোকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।বর্ণনায় এসেছে, একবার ইমাম বাকের (আ.) নিজ সন্তান ইমাম জাফর সাদিক (আ.)কে সঙ্গে নিয়ে পবিত্র হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মসজিদুল হারামের দিকে রওনা হন। সে বছর হজ্বে প্রচুর লোকসমাগম হয়। উমাইয়া শাসন হিশাম বিন আব্দুল মালিকও লোকদেখানোর জন্য আল্লাহর ঘর জিয়ারত করতে যায়। এ সময় ইমাম সাদেক (আ.) বুঝতে পারেন, সমবেত হাজিদের সামনে শিয়াদের গুণাবলী উপস্থাপনের মাধ্যমে উমাইয়া শাসকদের বিদ্বেষী ও কুচক্রী নীতির স্বরূপ উন্মোচন করে দেয়ার এটাই প্রকৃত সুযোগ। তিনি পিতার উপস্থিতিতে জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে শুরু করেন। ইমাম সাদেক (আ.) প্রকৃত শিয়া মুসলমানের কিছু গুণাবলী বর্ণনা করার পর বলেন, এরাই প্রকৃত মোমেন এবং আহলে বাইতের প্রকৃত অনুসারী। ইমাম এই বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে উমাইয়াদের শাসনক্ষমতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চান ইসলামি সমাজের শাসক হওয়ার যোগ্যতা এদের নেই। এরা বরং অবৈধভাবে ক্ষমতার মসনদে চেপে বসেছে। আদর্শ ও উত্তম চরিত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে জনগণের মাঝে প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জনকারী ইমাম বাকের (আ.)কে সহ্য করা উমাইয়া শাসকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারা ইমামের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার জন্য নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে। হিশাম বিন আব্দুল মালেক হজ্বের সময় জনগণের সামনে ইমামদের কিছু না বললেও হজ্ব শেষ করে শামে ফিরে গিয়ে ইমাম বাকের (আ.) ও ইমাম সাদেক (আ.)কে মদীনা থেকে দামেস্কে ডেকে পাঠায়। এ সম্পর্কে ইমাম সাদেক (আ.) বলেন: আমরা দামেস্ক যাওয়ার পর তিনদিন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে দেখা করেনি হিশাম। চতুর্থ দিন আমাদেরকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। হিশাম সিংহাসনে বসে ছিলেন এবং তার পারিষদবর্গ তার সামনে তীরধনুক নিয়ে লক্ষ্যভেদের কাজে মশগুল ছিল।হিশাম আমার পিতাকে নাম ধরে ডেকে বলেন: আপনার নিজ গোত্রের লোকজনের সঙ্গে তীরচালনা করুন। আমার পিতা বলেন: আমার এখন বয়স হয়েছে। এসব আমার কাজ নয়। আমাকে মাফ করবেন।কিন্তু হিশামের লক্ষ্য ছিল আমার পিতা ইমাম বাকেরকে অক্ষম ও অকর্মণ্য হিসেবে তুলে ধরা। তাই তিনি ইমামকে এ কাজে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। তিনি উপস্থিত এক ব্যক্তিকে তার ধনুকটি ইমামের হাতে দিতে বলেন। পিতা উপায়ন্তরহীন হয়ে তীর ধনুক হাতে নিয়ে একটি তীর নিক্ষেপ করেন। ইমামের প্রথম তীরটি লক্ষ্যভেদ করে। দ্বিতীয় তীরটি নিক্ষেপ করলে সেটি প্রথম তীরে আঘাত কোরে সেটিকে দুভাগ করে ফেলে। ইমাম বাকের (আ.) এভাবে একে একে আটটি তীর নিক্ষেপ করেন এবং আটবারই একই পরিণতি হয়। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত পারিষদবর্গ ইমামের প্রশংসায় উচ্চস্বরে স্লোগান দিতে থাকে।হিশামের পক্ষে এই দৃশ্য মেনে নেয়া ছিল কঠিন। তিনি উচ্চস্বরে বলে ওঠেন: সাবাশ আবু জাফর! তীরচালনার দিক দিয়ে আপনি তো আরব ও আজমের মধ্যে শীর্ষস্থান অধিকার করে নিয়েছেন। কিন্তু আপনি শুরুতে কেন বলেছিলেন এখন আর তীরধনুক চালাতে পারেন না? কুরাইশ বংশে যতক্ষণ আপনার মতো বীর আছে ততক্ষণ এই বংশের লোকেরা আরব ও আজমদের মধ্যে গর্ব করতে পারে। আপনি এত নিখুঁত তীরচালনা কবে কার কাছ থেকে শিখেছেন? ইমাম বাকের (আ.) জবাব দেন: আপনি একথা জানেন যে, মদীনার লোকজন তীরচালনায় পারদর্শী। আমি যৌবনে বেশ কিছুদিন তীরচালনা করেছি। তার জবাব শুনে হিশাম বলেন, যখন থেকে আমার বুদ্ধি হয়েছে তখন থেকে আমি এতটা দক্ষ হাতে কাউকে তীর চালনা করতে দেখিনি। আপনার তীরচালনা প্রথমে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। আপনার ছেলেও কি আপনার মতো তীর চালাতে ওস্তাদ? আমার পিতা জবাবে বলেন: আমরা ইমামগণ পিতার কাছ থেকে সবকিছু হুবহু আয়ত্ব করি।ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেন: আমার পিতার এই জবাব শুনে হিশাম ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে যায় এবং আমি পরবর্তীতে উপলব্ধি করি এই ক্রোধের বশবর্তী হয়েই সে আমার পিতাকে শহীদ করার সিদ্ধান্ত নেয়।সত্যি সত্যিই হিশামউদ্দিন ইমামকে জনগণের সামনে অপমান ও তাঁর ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ন করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উমাইয়া শাসক ১১৪ হিজরির ৭ জিলহাজ্ব তারিখে নিজের অনুচরকে দিয়ে ইমাম বাকের (আ.)কে বিষপ্রয়োগে শহীদ করে। #পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৭

(পর্ব ৪৫): বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের শাফায়াত হাসিলজুন ২৩, ২০১৯ ২০:২৫ Asia/Dhakaগত দুই আসরে আমরা ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)’র পক্ষ থেকে শুরু করা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা ইমামের আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি কিয়ামতের দিন বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের শাফায়াত হাসিল করার জন্য ইমাম যে শর্ত বেধে দিয়েছেন সে সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করব।সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে নবী বংশের পঞ্চম ইমাম যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে বিশিষ্ট আলেম-ওলামা তৈরি করা। মুসলিম সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও বেদআত প্রতিহত করা ছিল ইমাম বাকের (আ.)’র এই কাজের উদ্দেশ্য। একইসঙ্গে উমাইয়া শাসকদের ধর্মবিদ্বেষী চরিত্র উন্মোচন করাও ছিল এ কাজে ইমামের আরেকটি লক্ষ্য। ইমামের এই উদ্যোগ ব্যাপকভাবে সফল হয়।ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)’র অন্যতম প্রখ্যাত ছাত্র ছিলেন মোহাম্মাদ বিন মোসলেম। ধর্মীয় জ্ঞানে তিনি যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজে বলেন: আমি ইমাম বাকের (আ.)’র কাছ থেকে ৩০ হাজার হাদিস এবং ইমাম সাদেক (আ.)’র কাছ থেকে ১৬ হাজার হাদিস শিখেছি। আমি এই সব হাদিস মুখস্ত করেছি এবং মনে যেকোনো প্রশ্ন আসা মাত্রই ইমাম বাকের (আ.)’র কাছে জিজ্ঞাসা করেছি।ইমামের আরেকজন ছাত্রের নাম জাবের বিন এজিদ জু’ফি। মুসলিম বিশ্বের এই শীর্ষস্থানীয় চিন্তাবিদ বর্তমান ইরাকের কুফা নগরীতে বসবাস করতেন এবং সেখানে তিনি সামাজিক পদমর্যাদারও অধিকারী ছিলেন। ধর্ম, ইতিহাস ও হাদিস বিষয়ক জ্ঞান এমনকি রাজনৈতিক জ্ঞানেও তিনি যথেষ্ট পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ইমাম বাকের (আ.)’র কাছে প্রায় ৫০ হাজার হাদিস শিখেছিলেন জাবের। এসব হাদিসে ধর্মের খুঁটিনাটি বিষয় ও ফিকাহ সংক্রান্ত সব প্রশ্নের উত্তর ছিল।ইমামের এসব ছাত্র ধর্মীয় জ্ঞানে বুৎপত্তি অর্জনের পর এই জ্ঞান জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ইমাম বাকের (আ.) তাঁর অন্যতম ছাত্র আবান বিন তাগলিব সম্পর্কে বলেন: হে আবান! তুমি জনগণের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর এবং ফতোয়া দেয়ার জন্য মদীনার মসজিদে যাও। আমি চাই তোমার মতো জ্ঞানী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি আমার অনুসারী বা শিয়া হিসেবে জনগণের মাঝে পরিচিতি লাভ করুক। ইমাম বাকের (আ.)’র সন্তান ও ষষ্ঠ ইমাম- ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ইসলামি জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে তাঁর পিতা যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তা কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেন। তিনি এ সম্পর্ক বলেন: আমার পিতার এসব জ্ঞানী ছাত্র না থাকলে তাঁর হাদিস ও শিক্ষাগুলো হারিয়ে যেত।এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে,উমাইয়া শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নবীবংশের পঞ্চম ইমামকে এসব দ্বীনী দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। ইমাম বাকের (আ.) ইসলামি জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যে কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন তার গুণগত মান ও ব্যাপ্তি এত বেশি ছিল যে, মুসলিম বিশ্বের যেকোনো চিন্তাবিদ তাঁর সামনে আসলে নিজেকে নিঃস্ব মনে করতেন। ইমামের যুগের একজন বড় মুসলিম চিন্তাবিদের নাম ছিল হাকাম বিন উতাইবা। তিনি যখনই ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা করার জন্য ইমাম বাকের (আ.)’র কাছে আসতেন তখনই গুটিসুটি মেরে যেতেন। এ সম্পর্কে তৎকালীন অন্যতম মুসলিম পণ্ডিত আব্দুল্লাহ বিন আতা মাক্কি বলেন: নিজ এলাকায় হাকাম অনেক উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ইমাম বাকেরের সামনে এলে তিনি সেভাবেই গুটিয়ে যেতেন যেভাবে একজন ছাত্র তার শিক্ষকের সামনে গেলে জড়োসড়ো হয়ে যায়।শুধু শিয়া আলেমগণ নন সেইসঙ্গে সুন্নি আলেমগণও ইমামের উচ্চতর ধর্মীয় জ্ঞানের কথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন। শাফিয়ী মাজহাবের বিখ্যাত চিন্তাবিদ শাহাবুদ্দিন আহমাদ বিন হাজার হাইতামি বলেন: আবু জাফর মোহাম্মাদ বাকের এই কারণে বাকের উপাধি পেয়েছিলেন যে, তিনি ইসলামি জ্ঞানভাণ্ডার বিদীর্ণ করে এর শিক্ষা বের করে এনেছিলেন। তিনি ইসলামি শিক্ষার অনেক গোপন ও সুপ্ত বিষয় প্রকাশ করতে সক্ষম হন।ইমাম বাকের (আ.)’র আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল আহলে বাইতের অনুসারী শিয়া মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা। উমাইয়া শাসকরা ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়ে জনমনে শিয়াদের সম্পর্কে যে নেতিবাচক ধারনার জন্ম দিয়েছিল তার মূলোৎপাটন করা ছিল তাঁর এ কাজের লক্ষ্য। উমাইয়া শাসকরা সে সময় মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র মোসাহেবি ও চাটুকারিতার সংস্কৃতি চালু করেছিল। এ কারণে সাধারণ মানুষ প্রশংসা শুনলে খুশি এবং সমালোচনা শুনলে ক্ষুব্ধ হতো। এই অপসংস্কৃতি দূর করার লক্ষ্যে ইমাম তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ করে বলেন: যদি সমাজের সকল লোক তোমাকে ভর্ৎসনা করে তাহলেও দুঃখ পেও না এবং সবাই মিলে যদি অনর্থক তোমার প্রশংসা করে তাহলেও খুশি হওয়ার কিছু নেই। ইমাম এরপর তাঁর অনুসারীদের আরো বলেন, তোমরা পবিত্র কুরআনের বিধান মেনে চলবে। এই মহাগ্রন্থ যা কিছু করতে বলেছে তা করবে এবং যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছে তা থেকে বিরত থাকবে। যদি আল্লাহর বিধানের উল্টো চলা অবস্থায় কেউ তোমার প্রশংসা করে তাহলে সেই ধোঁকায় পা দিও না। সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী প্রতিটি মানুষ প্রশংসা শুনলে খুশি হয় এবং সমালোচনা শুনলে কষ্ট পায়। সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিরা মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তির অপব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেয়। তারা একজন মানুষের যে ভালো গুণগুলো নেই তাকে সেসব গুণে ভূষিত করে তার অন্তরে স্থান করে নেয় এবং এরপর নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে। দুষ্টু লোকের এই ধোঁকাবাজি থেকে রক্ষা পাওয়া মানুষের জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ।ইমাম বাকের (আ.) এই ধোঁকাবাজির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আশ্রয় নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী যারা জীবন গড়বে তারাই কিয়ামতের দিন বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের শাফায়াত লাভ করবে। অন্যথায় মুখে আহলে বাইত প্রেমিকের দাবি করে কেউ যদি খোদায়ী বিধানের উল্টো চলে তবে সে আহলে বাইতের শাফায়াত পাবে না।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৩