পোস্টগুলি

(পর্ব ৪৪): ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)’র নেয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপজুন ১৯, ২০১৯ ১৮:০৬ Asia/Dhakaইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) তার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন।ইসলামের অন্যতম মৌলিক দিক হলো সাধারণ মানুষের সঙ্গে ইমামের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকবে এবং গণমানুষ তাদের জীবন পরিচালনার জন্য ইমামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকরা এ বিষয়টিকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। তারা ইমামের সঙ্গে জনতার এই সম্পর্ক ছিন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। একবার স্বৈরাচারী উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আব্দুলমালেক দেখতে পায়, ইরাকের একদল লোক ইমাম বাকের (আ.)কে ঘিরে ধরে তাঁর বক্তব্য শুনছে এবং নানা ধরনের প্রশ্নের উত্তর জেনে নিচ্ছে। হিশাম ইমামকে ভালোভাবে চেনা সত্ত্বেও নিজের একজন সহচরকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে। এ সময় ইমামকে ঘিরে থাকা এক সাহসী ব্যক্তি জবাব দেয়: উনি হলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)’র বংশধর, বাকেরুল উলুম এবং মুফাসসিরে কুরআন ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)।মানুষের সঙ্গে ইমামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ব্যাপারে হিশামের এই স্পর্শকাতরতা সত্ত্বেও ইমাম বাকের (আ.) মুসলমান ও শিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি বরং উল্টো ইসলাম বিরোধীদের সামনে ইসলামের সুমহান শিক্ষা তুলে ধরার লক্ষ্যে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কে বসেন। একদিন ইমাম রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটি স্থানে একদল লোককে জটলা পাকাতে দেখেন। তিনি একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, ওরা কারা? একজন জবাব দিল, এরা হচ্ছে খ্রিষ্টান পাদ্রী। তারা তাদের প্রধান পাদ্রী বা বিশপের অপেক্ষা করছে। তিনি এসে তাদের বিভিন্ন সমস্যা ও ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দেবেন। একথা শোনার পর ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) একজন অপরিচিত ব্যক্তি হিসেবে পাদ্রীদের মধ্যে বসে যান।গুপ্তচররা এই খবর হিশামের দরবারে পৌঁছে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে উমাইয়া শাসক হিশাম একদল লোক পাঠিয়ে দেয় এটা দেখার জন্য যে, ইমাম খ্রিস্টানদের জমায়েতে বসে কি করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বিশপ এসে সেখানকার প্রধান আসন গ্রহণ করেন। তিনি সামনে তাকিয়ে সবাইকে ভালো করে দেখে নেন। এক পর্যায়ে ইমাম মোহাম্মাদ বাকেরের চেহারা মোবারকের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তার ভালো লেগে যায়। তিনি জিজ্ঞাসা করেন: আপনি কি খ্রিস্টান নাকি মুসলমান? ইমাম জবাব দেন: আমি মুসলমান। বিশপ আবার জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি আলেম নাকি অজ্ঞ ব্যক্তি? ইমাম জবাব দেন: আমি অজ্ঞ নই।বিশপ জিজ্ঞাসা করেন: আমি আগে প্রশ্ন করব নাকি আপনি কিছু জিজ্ঞাসা করবেন? ইমাম বলেন: আপনার ইচ্ছা হলে আগে প্রশ্ন করতে পারেন। এ সময় বিশপ অনেক কঠিন ও জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করা সত্ত্বেও ইমাম সবগুলো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে উপস্থিত লোকজনকে অভিভূত করেন। এ সময় বিশপ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে পাদ্রীদের বলেন: তোমরা আমার চেয়ে অনেক বড় জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিকে এখানে এনেছো কেন? তিনি তো আমার অজ্ঞতা সবার সামনে প্রকাশ করে দিলেন। মুসলমানরা এখন আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করবে এই কথা বলে যে, খ্রিস্টানদের বিশপ কোনো জ্ঞানই রাখে না!বিশপের সঙ্গে ইমাম মোহাম্মাদ বাকেরের এই বিতর্কের কাহিনী অতি দ্রুত দামেস্কে পৌঁছে যায় এবং সেখানকার সাধারণ মানুষ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতে থাকে। কিন্তু উমাইয়া শাসক হিশাম খুশি হওয়ার পরিবর্তে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। জনগণের মধ্যে ইমামের আধ্যাত্মিক প্রভাবে বেড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। উমাইয়া শাসক ইমামকে শাম থেকে মদিনায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপর হিশাম কপটতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মদীনার গভর্নরকে চিঠি লিখে জানায়: “আবু তোরাবের ছেলে মোহাম্মাদ বিন আলী তার ছেলেসহ আমার কাছে এসেছিল। আমার নির্দেশে মদীনায় যাওয়ার আগে সে পাদ্রীদের কাছে যায় এবং খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমার সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় তার এই অপরাধ আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। সে মদীনায় পৌঁছার আগে জনগণের মধ্যে এই ঘোষণা দিয়ে যাও যে, আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট।”ইমাম মোহাম্মাদ বাকের উমাইয়া শাসকের এই প্রতারণা জানতে পেরে শাসনযন্ত্রের সব ধরনের ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে জনগণকে সঠিক কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন: হে জনগণ! উমাইয়া শাসকেরা তোমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? তোমাদের পূর্বপুরুষরা আমার পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে সঠিক পথের দিশা পেয়েছিল এবং এখন তোমরাও যদি দুনিয়া ও আখেরাতে সৌভাগ্যের অধিকারি হতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে যোগ দাও। দুনিয়ার চাকচিক্য ও ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী কিন্তু পরকালীন জীবন চিরস্থায়ী।ইমামের এই সচেতনামূলক বক্তব্যে সাধারণ মানুষের টনক নড়ে এবং তারা আস্তে আস্তে তাঁর কাছে জড়ো হতে থাকে। তারা ধর্মীয় বিষয়াদির পাশাপাশি পার্থিব জীবন সুন্দর করার উপায় শিখে নেয় ইমামের কাছ থেকে। ইমামের অনুসারীরা একটি বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আহলে বাইতের অনুসরণ না করলে পরকালীন জীবনে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। ইমাম বাকের (আ.) দ্বীনের এই জরুরি শিক্ষাগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য হজ্বের সময়কে বেছে নেন। প্রতি বছর হজ্বের সময় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কাবা শরীফে জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ।এ সম্পর্কে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এসেছে: মক্কায় এক ব্যক্তিকে দেখি কাবা ও হাজরে আসওয়াদের মাঝখানে একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন এবং অনেক মানুষ তাঁকে ঘিরে ধরেছে। সমবেত লোকজন অনেক কঠিন ও জটিল প্রশ্নের উত্তর ওই ব্যক্তির কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে। এরপর তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, উনি কে ছিলেন? তখন একজন জবাব দেন: তিনি হলেন ইমাম বাকের (আ.)। এভাবে আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম জনগণের মধ্যে ইমামতের উচ্চ মর্যাদা তুলে ধরতে সক্ষম হন। সেইসঙ্গে উমাইয়া শাসকরা ইমামদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরির যে চেষ্টা করেছিল সে দূরত্বও অনেকাংশে কমিয়ে আনেন। #পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১৯

(পর্ব ৪৩): ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)’র সংক্ষিপ্ত জীবনীজুন ১৭, ২০১৯ ১৯:০৪ Asia/Dhakaনবীবংশের এই পঞ্চম ইমাম ৫৭ হিজরির ১লা রজব মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম ছিল মোহাম্মাদ, আবু জাফর ছিল তাঁর উপাধি এবং অনেকে তাঁকে বাকেরুল উলুম উপাধিও দিয়েছিলেন।ইমাম বাকের (আ.) সম্পর্কে প্রখ্যাত শাফিয়ী আলেম ও ফকিহ ইবনে হাজার হাইতামি লিখেছেন: যা ভূমিকে বিদারিত করে এর ভেতরের সুপ্ত বস্তুগুলো বের করে আনে তাকে আরবি ভাষায় ‘বাকেরুল আরদ’ বলা হয়। এই পরিভাষা থেকে এই ইমামের জন্য বাকের উপাধি গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ, তিনি ইসলামের অনেক সুপ্ত শিক্ষা, আহকাম ও হাকিকাত মানুষের সামনে প্রকাশ করে দিয়েছেন। এই সুপ্ত শিক্ষাগুলো অদূরদর্শী ও পাপী ব্যক্তিদের দৃষ্টিগোচর হতো না।তিনি এমন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যে পরিবার ছিল সবদিক দিকে শ্রেষ্ঠ। কারণ, তাঁর পিতা ছিলেন ইমাম হোসেইন (আ.)’র সন্তান ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এবং তাঁর মা ছিলেন ইমাম হাসানের কন্যা ফাতিমা। পবিত্র ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী নারী ফাতিমা ছিলেন ইসলামি জ্ঞানে অত্যন্ত পারদর্শী। ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন: একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর বিখ্যাত সাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ আনসারিকে বলেন, হে জাবের! আল্লাহ তায়ালা তোমাকে তুলনামূলক লম্বা হায়াত দান করবেন। তুমি বৃদ্ধ বয়সে আমার সন্তান মোহাম্মাদ বিন আলী বিন হোসেইন যার নাম তাওরাতে ‘বাকের’ লেখা রয়েছে তাকে দেখতে পাবে। তখন তুমি তাঁকে আমার সালাম পৌঁছে দিও।রাসূলের ওই বক্তব্যের বহু বছর পরে জাবের একদিন ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র কাছে যান এবং সেখানে শিশু ইমাম বাকের (আ.)কে দেখতে পান। ছোট্ট শিশুর কথা ও আচরণে মুগ্ধ হয়ে যান জাবের। রাসূলের সেই বক্তব্য মনে পড়ে যায় তার। তিনি ইমাম সাজ্জাদের কাছে জানতে চান এই শিশুটি কে? তিনি জবাবে বলেন, এই হচ্ছে আমার পরে আমার স্থলাভিষিক্ত ইমাম মোহাম্মাদ বাকের। জাবের একথা শুনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শিশু মোহাম্মাদ বাকেরের দিকে তাকিয়ে থাকেন, উঠে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেন এবং চুমু খেয়ে বলেন: তুমি তোমার পূর্বপুরুষ রাসূলে খোদার সালাম ও দরুদ গ্রহণ করো। কারণ, তিনি আমার মাধ্যমে তোমাকে সালাম পৌঁছে দিয়েছেন। ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) তখন বলেন, আমি আমার পূর্বপুরুষ রাসূলে খোদার প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠাচ্ছি। সেইসঙ্গে আমার পিতার দরুদ ও সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য হে জাবের আপনাকেও সালাম জানাচ্ছি।ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)’র বয়স যখন তিন বা চার বছর তখন কারবালা ময়দানের নির্মম ইতিহাস সংঘটিত হয়। অর্থাৎ জীবনের শুরুতেই তিনি এরকম একটি বিপর্যয়কর ঘটনার তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কারবালার এই হৃদয়বিদারক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এজিদ বাহিনী মদীনা ও মক্কায় গণহত্যা ও ভয়াবহ অপরাধযজ্ঞ চালায়। এরপর ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র ইমামতের ৩৪ বছরে তিনি স্বৈরাচারী উমাইয়া শাসকদের পক্ষ থেকে যেসব অত্যাচার ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছিলেন তা প্রত্যক্ষ করেন ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)।ইমাম সাজ্জাদ (আ.) কুফা ও শামের দরবারে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে এজিদের পাপাচারী ও দুশ্চরিত্র আত্মার স্বরূপ উন্মোচন করার পাশাপাশি দোয়ার আদলে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলো মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে দেন। পিতার এসব তৎপরতা সার্বিকভাবে ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)’র জন্য অভিজ্ঞতার নতুন দুয়ার খুলে দেয়। বিশেষ করে এই সময়ে উমাইয়া শাসকদের শাসনক্ষমতার ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)’র ১৯ বছরের ইমামতের সময়কালে পাঁচজন শাসক ক্ষমতায় আসেন। ওই পাঁচজন হলেন ওয়ালিদ বিন আব্দুলমালেক, সোলায়মান বিন আব্দুলমালেক, ওমর বিন আব্দুলআজিজ, এজিদ বিন আব্দুলমালেক এবং হিশাম বিন আব্দুলমালেক।শাসনক্ষমতায় এই টালমাটাল অবস্থার সুযোগ ইমাম বাকের (আ.) একটি শিয়া সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান। এ লক্ষ্যে তিনি একজন প্রকৃত শিয়া মুসলমানের বৈশিষ্ট্য জনগণের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি আব্বাসীয় শাসকদের মিথ্যা শিয়া স্লোগানের স্বরূপ উন্মোচন করেন।উমাইয়া শাসকগোষ্ঠী তাদের অর্ধ শতকের শাসনামলে হযরত আলী (আ.) ও তাঁর বংশধরদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করার জন্য সব রকম প্রচেষ্টা চালায়। এ অবস্থায় ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) সবার আগে ইমামতের উচ্চ মর্যাদার বিষয়টি জনগণের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা শুরার ২৩ নম্বর আয়াতের শিক্ষা উপস্থাপন করে বিশ্বনবীর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বনবী (সা.)কে উদ্দেশ করে বলেন: “(হে নবী) আপনি বলুন, আমি আমার (রিসালাতের) দাওয়াতের জন্যে তোমাদের কাছে আমার নিকটজনদের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো পুরস্কার চাই না।” ইমাম বলেন, “আমাদের প্রতি অর্থাৎ আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা হচ্ছে ধর্মের মৌলিক ভিত্তি।” তিনি আরেক ভাষণে বলেন, “তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদেরকে ভালোবাসবে।” এমনকি আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে এই ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেন।তিনি এক ভাষণে বলেন: “কেউ যদি সারাজীবন প্রতিটি রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করে, সারাজীবন রোজা রাখে, নিজের সব সম্পদ গরীবের মাঝে বিলিয়ে দেয় এবং প্রতি বছর হজ্ব পালন করে কিন্তু তার মনে আমাদের প্রতি অর্থাৎ আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা না থাকে ও আমাদের নির্দেশ পালন না করে তাহলে এত ইবাদত ও দান-খয়রাতের কোনো মূল্য নেই এবং কিয়ামতের দিন তাকে আল্লাহ তায়ালা কোনো পুরস্কার দেবেন না।”আহলে বাইতের প্রতি অন্তরে ভালোবাসা পোষণের জন্য ইমাম মোহাম্মাদ বাকেরের এতটা তাগিদ দেয়ার প্রধান কারণ ছিল শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নমূলক আচরণ। উমাইয়া শাসকরা মানুষের মন থেকে আহলে বাইতের প্রতি শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা মুছে ফেলতে সবরকম চেষ্টা করছিল। #পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /১৭

(পর্ব ৪২): ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র সংক্ষিপ্ত জীবনীজুন ০৭, ২০১৯ ২০:৩৪ Asia/Dhakaগত আসরে আমরা কারবালা বিপ্লব পরবর্তী কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, ইমাম হোসেইন (আ.)কে নির্মমভাবে শহীদ করার পর এজিদের বাহিনী মদীনা ও মক্কা নগরীতে হানা দিয়ে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।বনি উমাইয়া গোষ্ঠীর এই দুঃশাসনের সামনে প্রতিরোধ গড়ে না তুলে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) জনগণের মধ্যে ইসলামি শিক্ষা প্রসারের কাজে হাত দেন। আজকের আসরে আমরা এ সম্পর্কে আরো কিছু আলোচনা করার আশা রাখছি। প্রকৃতপক্ষে, মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব যখন থেকে স্বৈরশাসক ও স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিদের হাতে ন্যস্ত হয়েছে তখন থেকে এই সমাজে ইসলাম বিরোধী তৎপরতা শুরু হয়েছে। দুঃখজনকভাবে সে সময় মুসলিম সমাজের যে পদস্খলন ঘটে তার রেশ আজও অব্যাহত রয়েছে। সৌদি আরবে ওহাবি মতাবলম্বী আলে সৌদ রাজবংশের ক্ষমতায় আরোহনকে সেই ঘটনার ধারাবাহিকতা হিসেবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। এই ওহাবি মতবাদের ধ্বজাধারীরা ১২১৬ হিজরিতে ইরাকে আগ্রাসন চালায়। তারা প্রথমে কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)’র মাজারে এবং পরে নাজাফে হযরত আলী (আ.)’র মাজারে হামলা চালিয়ে চার থেকে পাঁচ হাজার জিয়ারতকারীকে হত্যা করে। ওহাবিরা দু’টি মাজারেই ব্যাপক লুটপাট চালায় ও ভাঙচুর করে এবং শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। সবশেষে এই আগ্রাসী বাহিনী মাজার প্রাঙ্গনে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে।সাম্প্রতিক সময়ে এই ওহাবি মতবাদ অনুসরণ করে আলে সৌদ সরকারের ছত্রছায়ায় উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশের জন্ম হয়। এই গোষ্ঠীও মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংসের পাশাপাশি হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। তবে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র সঙ্গে বর্তমান সময়ের মূল পার্থক্য হচ্ছে এই যে, বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের বিশাল অংশ আমেরিকা ও সৌদি আরবের সমর্থিত ওহাবি মতবাদ ও উগ্র জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র সময়ে পরিস্থিতি এরকম ছিল না। ইমাম নিজে এ সম্পর্কে একবার দুঃখ করে বলেছিলেন: “মক্কা ও মদীনা মিলে আমার ২০ জন প্রকৃত সহযোগী বা বন্ধুও নেই।”সে যুগে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র সামনে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল মানুষের সামনে প্রকৃত ইসলামি শিক্ষা তুলে ধরা; যে শিক্ষা রাসূলুল্লাহ (সা.)’র রেহলাতের পর বিশেষ করে উমাইয়াদের শাসনামলে হারিয়ে যেতে বসেছিল। প্রখ্যাত শিয়া আলেম ‘শেখ তুসি’ ইমাম সাজ্জাদের এমন ১৭০ জন ছাত্রের নাম উল্লেখ করেছেন যারা ইসলামি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। আমরা তাদের মধ্য থেকে তিনজনের নাম উল্লেখ করছি।ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র অন্যতম মেধাবী ছাত্র ছিলেন সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব। তার প্রশংসায় ইমাম নিজে বলেছেন: ইসলামের প্রাথমিক যুগের দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে সাঈদ সবার চেয়ে এগিয়ে আছে।ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র আরেক ছাত্রের নাম আবু হামজা সুমালি। ইমাম রেজা (আ.) তাঁর সম্পর্কে বলেন: নিজ যুগে আবু হামজা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)’র যুগের সালমান ফারসির মতো সাহাবী। আবু হামজা ইমাম সাজ্জাদের পর ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) এবং ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’রও সাহচার্য লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন।ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র আরেকজন বিখ্যাত ছাত্রের নাম সাঈদ বিন জুবায়ের। তিনি ইসলামের বিভিন্ন শাখায় গভীর বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তাঁর এই বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের সংস্পর্শে এসে বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছে দেখে উমাইয়া নরঘাতক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাঈদ বিন জুবায়েরকে হত্যা করে।ইমাম সাজ্জাদ (আ.) উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের অংশ হিসেবে দোয়া ও মুনাজাতে মগ্ন হওয়াকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সরাসরি মুমিনের সম্পর্ক স্থাপিত হয় বলে দ্বীন-ইসলামে দোয়াকে ইবাদতের মগজ বা আধার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জীবনের কঠিন সময়ে দোয়া মানুষকে চরম প্রশান্তি দেয় এবং তার মধ্যে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে সহায়তা করে। আল্লাহ তায়ালার দরবারে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) যেসব দোয়া করেছেন তার সংকলিত গ্রন্থ ‘সহিফায়ে সাজ্জাদিয়ে’ মুসলিম উম্মাহর জন্য ইমামের রেখে যাওয়া মূল্যবান অবদান হিসেবে মনে করা হয়। প্রখ্যাত সুন্নি আলেম তানতাভি ‘সহিফায়ে সাজ্জাদিয়ে’ অধ্যয়ন করার পর একে একটি অনন্য গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।সহিফায়ে সাজ্জাদিয়ে গ্রন্থের ২০তম দোয়ায় বলা হয়েছে: “হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ ও তাঁর বংশধরদের প্রতি দুরুদ বর্ষণ করো। আমার ঈমানকে পূর্ণাঙ্গ ঈমানে পৌঁছে দাও, আমার বিশ্বাসকে পরিপূর্ণ বিশ্বাসে পরিণত করো, আমার নিয়্যতকে শ্রেষ্ঠ নিয়্যত এবং আমার আমলকে শ্রেষ্ঠ আমল হিসেবে কবুল করে নাও।” এই দোয়ার উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এখানে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) মহান আল্লাহর কাছে সেরা ঈমান, শ্রেষ্ঠ বিশ্বাস, সেরা নিয়্যত ও শ্রেষ্ঠ আমল করার তৌফিক কামনা করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি আল্লাহর কাছে কি চাইতে হবে এবং কতটুকু চাইতে হবে তা মুসলিম উম্মাহকে শিখিয়ে গেছেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ পর্বতারোহীর মতো মানুষকে পর্বতের শীর্ষ চূড়ায় আরোহণের শিক্ষা দিয়েছেন।সহিফায়ে সাজ্জাদিয়ে দোয়াগ্রন্থের গুরুত্ব কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায় এই গ্রন্থের প্রতি মুসলিম আলেম, পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের আগ্রহ থেকে। প্রখ্যাত আলেমগণ এই গ্রন্থের ওপর ৭০টি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং বিশ্বের বহু ভাষায় এই বই অনুদিত হয়েছে। আরবি থেকে অন্য যেসব ভাষায় এই গ্রন্থ অনুদিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ফারসি, ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, উর্দু, তুর্কি ইত্যাদি।ইমাম সাজ্জাদের রেখে যাওয়া আরেকটি গ্রন্থের নাম ‘রেসালে-ই-হুকুক’। মানুষকে তার সারাজীবনে দু’টি হক্ব বা অধিকার আদায় করতে হয়। এর একটি হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক্ব এবং অপরটি হাক্কুল এবাদ বা বান্দার হক। ইমামের এই গ্রন্থে এই দু’টি হক্ব আদায়ের সর্বোত্তম উপায়েগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার অধিকার বা নানারকম ইবাদতের পাশাপাশি সমাজ, পরিবার, দ্বীনি ভাই, বন্ধু এমনকি শত্রুর প্রতি মানুষকে কি কি কর্তব্য পালন করতে হবে তা এই গ্রন্থে সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।এসব মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি মানুষের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কি কি অধিকার রয়েছে তাও এই গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বাতলে দিয়েছেন ইমাম সাজ্জাদ (আ.)। তিনি মানুষের জিহ্বা, কান, চোখ, হাত ও পায়ের জন্য আলাদা আলাদা অধিকারের কথা বলে দিয়েছেন। ইমাম সাজ্জাদের অন্যতম উপাধি হচ্ছে সাইয়েদুস সাজেদিন বা সিজদাকারীদের নেতা এবং জয়নুল আবেদিন বা ইবাদতকারীদের অলংকার। আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের উদ্দেশ্যে রাত্রিজাগরণ ও একনিষ্ঠ কাকুতি মিনতিতে এই মহান ইমামের কোনো তুলনা ছিল না বলে তিনি এসব উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০৭

(পর্ব ৪১): কারবালা বিপ্লব পরবর্তী ঘটনাবলীজুন ০১, ২০১৯ ১৮:২২ Asia/Dhakaআশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা কুফা ও শামের ভর মজলিসে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র তেজদ্বীপ্ত ভাষণ এবং জনগণের ওপর এসব ভাষণের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছি। আজকের আসরে আমরা কারবালা বিপ্লব পরবর্তী কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা করব।ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র জ্বালাময়ী ভাষণের প্রভাবে জনগণ বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে এমন চিন্তায় ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে পাপিষ্ঠ এজিদ। মদীনার জনগণ এজিদের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে- এমন খবর পাওয়ার পর মোসলেম বিন উকবার নেতৃত্বে মদীনায় সৈন্য পাঠায় সে। বিন উকবা মদীনায় গিয়ে তিনদিন ধরে সেখানকার নিরীহ জনগণের ওপর গণহত্যা ও নারীদের ওপর গণধর্ষণ চালায়। অথচ এই মদীনা সম্পর্কে বিশ্বনবীর এক হাদিসে বলা হয়েছে, “হে আল্লাহ যে কেউ মদীনার জনগণের ওপর হামলা চালাবে এবং তাদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করবে তার ওপর তোমার নিজের ও ফেরেশতাদের ঘৃণা বর্ষণ করো।” সেই মদীনার জনগণ বনি উমাইয়া শাসকদের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজের শিকার হন।মদীনাবাসীর ওপর পাশবিকতা চালিয়ে দৃশ্যত মুসলিম বিন উকবার রক্তপিপাসা মেটেনি। সে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরকে হত্যা করার জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়। এ সময় এজিদের নির্দেশে হুসাইনুবনু নুমায়েরকে এই আগ্রাসী বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের মক্কার বাইরে এজিদের পাঠানো বাহিনীকে প্রতিহত করেন। কিন্তু যুদ্ধে তার অনেক সৈন্য নিহত হওয়ার পর আব্দুল্লাহ মক্কা শরীফে আশ্রয় নেন। এ সময় ইবনে নুমায়ের বাহিনী মক্কার চারপাশ থেকে শহরে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করে যার ফলে কাবা শরীফে আগুন ধরে যায়। এজিদের পাঠানো রক্তপীপাসু বাহিনী মক্কা নগরীতেও ব্যাপক লুটপাট চালায়। কিন্তু হিজরি ৬৪ সালের রবিউস সানি মাসের প্রথমদিকে এজিদের মৃত্যুর খবর মক্কায় পৌঁছালে হুসাইনিবনু নুমায়ের তার বাহিনী নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।এখানে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে তা হচ্ছে, কারবালার হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা, আল্লাহর রাসূলের শহর মদীনায় গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালানো এবং মক্কায় আল্লাহর ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মতো যেসব ধৃষ্টতা বনি উমাইয়া গোষ্ঠী দেখায় তার সূত্রপাত কবে হয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বিদায় হজ্ব শেষে আল্লাহর রাসূল (সা.) গাদিরে খোমে হযরত আলী (আ.)কে নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা উপেক্ষা করার সময়ই এসব অপরাধযজ্ঞের বীজ বপিত হয়।এই বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় এজিদের মৃত্যুর পর তার পুত্র মুয়াবিয়া ইবনে এজিদ ক্ষমতায় আসলে। মুয়াবিয়া ইবনে এজিদ ক্ষমতা গ্রহণ করেই এক বক্তব্যে তার পূর্বপুরুষদের অপতৎপরতার সমালোচনা করেন, কারবালা বিপর্যয় এবং মদীনা ও মক্কায় চালানো পাশবিকতার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, এসব পাশবিকতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করে জানান, রাসূলে খোদার পবিত্র বংশধররাই খেলাফতের যোগ্য উত্তরাধিকার।নিঃসন্দেহে ইসলামের অঙ্কুরেই যদি হযরত আলী (আ.) মুসলিম উম্মাহর ইমামত ও খেলাফতের দায়িত্ব নিতেন তাহলে মুয়াবিয়া ও এজিদের মতো লোকেরা মুসলিম জাহানের অধিপতি হতে পারত না এবং কারবালা ও মক্কা-মদীনার বিপর্যয় ঘটতে পারত না। এখানে অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যে, ইমাম সাজ্জাদ (আ.) কেন এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি এবং মদীনা ও মক্কায় বনি উমাইয়া বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিহত করার চেষ্টা করেননি?এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, ইমাম সাজ্জাদ নিজের চোখে তাঁর পূর্ব পুরুষদের যেসব বেদনাদায়ক ঘটনা দেখতে পেয়েছিলেন তারপর আর বিদ্রোহ করার মতো মানসিকতা তার ছিল না। সেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) উপলব্ধি করেন, তিনি এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে আবার নিরীহ কিছু মুসলমানের রক্তপাত ছাড়া আর কোনো ফল বয়ে আসবে না। তাই তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিবর্তে সচেতনতামূলক ভাষণের মাধ্যমে ঘুমিয়ে পড়া জনগণের বিবেক জাগিয়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর অযোগ্যতা ও দুঃশাসনের বিষয়টি তুলে ধরার পাশাপাশি রাসূলের আহলে বাইতের যোগ্যতা ও উচ্চ মর্যাদার কথা প্রচার করতে থাকেন।এ সময় কিছু অদূরদর্শী লোক ভাবতে থাকে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে ভয় পাচ্ছেন। তাই তারা ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে সূরা তওবার ১১১ নম্বর আয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই আয়াতের একাংশে বলা হয়েছে: “নিশ্চয় আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে, অতঃপর মারে ও মারা যায়।”ইমাম তাদের এ বক্তব্য শোনার পর বলেন: সূরা তওবার যে আয়াতের কথা তোমরা বললে তার পরের আয়াতেই এসব মুমিন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। আমি যদি তোমাদের মধ্যে সেসব বৈশিষ্ট্য দেখতে পেতাম তাহলে তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই বনি উমাইয়াদের শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতাম। ওই আয়াতে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, “তারা তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোযার, রোজা পালনকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহর দেওয়া সীমাসমূহের হেফাযতকারী। বস্তুতঃ সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে।”এজিদের মৃত্যুর পর মক্কা আগ্রাসন থেকে বেঁচে যাওয়া আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের বিদ্রোহ করেন এবং হিজাজ, ইয়েমেন, ইরাক ও খোরাসানের জনগণ তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। অন্যদিকে মুয়াবিয়া ইবনে এজিদ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করার পর মারওয়ান ইবনে হাকাম ক্ষমতা দখল করে। মারওয়ান ছিল আল্লাহর রাসূলের শত্রু এবং এই শত্রুতার কারণে বিশ্বনবী (সা.) মারওয়ান ও তার পিতাকে মদীনা থেকে বহিস্কার করেছিলেন। মাওয়ান শাম ও মিশরে নিজের ক্ষমতা সংহত করে। তার মৃত্যুর পর ৬৫ হিজরিতে তার ছেলে আব্দুলমালেক মারওয়ান শামের ক্ষমতা গ্রহণ করে। ওদিকে মক্কায় তখন চলছিল আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের শাসন। ৭০ হিজরিতে আব্দুলমালেক মক্কা অবরোধ করে আব্দুল্লাহকে প্রথমে বন্দি ও পরে হত্যা করে।আব্দুলমালেক ছিল চরম নির্দয় ও নিষ্ঠুর এক শাসক। নরহত্যায় তার কোনো তুলনা ছিল না। শাসনকাজ পরিচালনায় তার সহযোগীরাও ছিল একই চরিত্রের অধিকারী। উদাহরণ হিসেবে বাগদাদে তার খলিফা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নাম উল্লেখ করা যায়। রক্তপিপাসু এই শাসকের হাতে এক লাখ ২০ হাজার বা মতান্তরে এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ নিহত হয়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নিজে বলে বেড়াত যে, মানুষ হত্যা করার মতো অন্য কিছুতে সে এত বেশি আনন্দ পায় না। আব্দুলমালেকের মৃত্যুর পর পর ওয়ালিদ ক্ষমতায় আসে। সেও ক্ষমতায় এসে তার শাসনের বিরুদ্ধাচরণকারীদের কঠোর হাতে দমন করার ঘোষণা দেয়। তো বন্ধুরা! অবৈধভাবে শাসনক্ষমতা দখলদারদের এই ধরনের ভয়ঙ্কর আচরণের কারণে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র সামনে গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আগামী আসরে আমরা এ সম্পর্কে আরো আলোচনা করব। সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /০১

(পর্ব ৪০): ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.)’র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীমে ২৮, ২০১৯ ১৮:১০ Asia/Dhakaগত আসরে আমরা বিশ্বনবী (সা.)-এর দৌহিত্র এবং জান্নাতে যুবকদের অন্যতম সর্দার ইমাম হোসেইন (আ.)’র মূল্যবান জীবনী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করেছি। কাজেই আজ শুরু হবে চতুর্থ ইমাম- ইমাম সাজ্জাদ বা জয়নুল আবেদিন (আ.)’র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনা।প্রখ্যাত বর্ণনা মতে, হযরত আলী (আ.)’র ইমামতের শেষভাগে ৩৮হিজরির জমাদিউল আউয়াল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আলী (আ.)’র শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (আ.)’র ১০ বছরের ইমামতের যুগ শুরু হয়। তাঁর শাহাদাতের পর ইমাম সাজ্জাদের বয়স যখন প্রায় ১৩ বছর তখন তাঁর পিতা ইমাম হোসেইন (আ.)’র ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় শামের বিদ্রোহী শাসক মুয়াবিয়া ছলে-বলে-কৌশলে নিজের অপকর্মগুলো ঢাকা দিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। সে নিজের পুত্র এজিদকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে। মুয়াবিয়া এমন এক ব্যক্তিকে খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দেয় যে স্বেচ্ছাচারী জীবনে অভ্যস্ত ছিল এবং বেশিরভাগ সময়ই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকত। ইমাম জয়নুল আবেদিন এই ঘটনাবলী দেখে বড় হন এবং কারবালার ময়দানের শোকাবহ ঘটনার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত থাকলেও অসুস্থতার কারণে যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। ইমাম হোসইন (আ)’র শাহাদাতের মাধ্যমে তাঁর ইমামতের যুগ শেষ হয়ে যায়। ফলে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এই গুরুদায়িত্ব পালন শুরু করেন। কারবালা ময়দানের হৃদয়বিদারক ঘটনার রক্তের হোলিখেলা শেষ হতে না হতেই ইমাম ও তাঁর একনিষ্ঠ সহযোগীদের পরিবারগুলোর নারী, শিশু ও অসুস্থ সদস্যদের গ্রেফতার করে কুফায় ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের দরবারে হাজির করা হয়। ইবনে জিয়াদ ভেবেছিল সে কারবালার যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। তাই অহংকার ও স্পর্ধার চরম প্রকাশ ঘটিয়ে সে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)কে জিজ্ঞাসা করে: ‘তোর নাম কি?’ ইমাম ধীরস্থিরভাবে জবাব দেন- ‘আলী’।ক্ষমতার নেশায় মত্ত ইবনে জিয়াদ এ সময় আরো বেশি ধৃষ্ঠতার সুরে বলে ওঠে: “তাহলে কি আল্লাহ কারবালার ময়দানে আলী ইবনুল হোসেইনকে হত্যা করেননি?” তার এ বক্তব্যে ইমাম উপলব্ধি করেন, বনি উমাইয়ার শাসকরা জনগণকে ধোঁকা দেয়ার মাধ্যমে কারবালার পাশবিক গণহত্যাকে আল্লাহর নামে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এ কারণে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বলে ওঠেন: আলী ছিল আমার ভাই এবং সে তোর শয়তানি বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করেছে। তাকে আল্লাহ হত্যা করেনি বরং এজিদের ইসলাম বিদ্বেষী বাহিনীর হাতে তার রক্ত ঝরেছে। ইমাম সাজ্জাদের ধীরস্থীর ও শান্ত কণ্ঠে ইবনে জিয়াদের ক্রোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। সে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে: ‘তুমি আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছো?’ এরপর সে জল্লাদকে তলব করে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)কে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। ইমাম বিন্দুমাত্র শঙ্কিতবোধ না করে বলে ওঠেন: “তুমি আমাকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছো? আমাদের কাছে শাহাদাত কোনো দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনা নয়। শাহাদাত আমাদের মর্যাদা বাড়ায় এবং এটি ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।” ইবনে জিয়াদ যখন বুঝতে পারে, ইমামের সঙ্গে যুক্তিতর্কে পেরে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয় বরং এভাবে কথা বাড়তে থাকলে তাকে আরো বেশি অপমানিত হতে হবে তখন সে বন্দিদেরকে শাম বা সিরিয়ায় এজিদের দরবারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।ইমাম পরিবারের বন্দিরা শামে পৌঁছালে এজিদ ইবনে মুয়াবিয়া দামেস্কের জামে মসজিদে বিশাল জনসমাবেশ ডাকে। ভর সমাবেশে ইমাম পরিবারের সদস্যদের অপমান করা ছিল তার এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য। এজিদ পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মসজিদের মিম্বরে এমন এক খতিবকে পাঠায় যে ব্যক্তি ইমাম পরিবারের কুৎসা গাইতে থাকে। ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র পক্ষে এই অপমান মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর কণ্ঠে উপস্থিত জনতা যেন বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পায়। ইমাম ওই পদলেহী বক্তাকে উদ্দেশ করে বলে ওঠেন: তোমার প্রতি ঘৃণা হে খতিব! তুমি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির পরিবর্তে তার বান্দার সন্তুষ্টি অর্জনকে প্রাধান্য দিয়েছ। তুমি জেনে রাখো তোমার স্থান হবে জাহান্নামে। এরপর উপস্থিত জনতাকে হতবিহ্বল করে দিয়ে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এজিদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন: তুমি আমাকে এই মিম্বরে ওঠতে দাও। আমি এমন কিছু কথা বলব যা শুনলে এখানে উপস্থিত ব্যক্তিরা খুশি হবেন। এজিদ সহজে এই অনুমতি দিতে চাইছিল না কিন্তু উপস্থিত জনতার তীব্র দাবির মুখে সে ইমামকে কথা বলার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। ইমাম সাজ্জাদ মিম্বরে উঠে অত্যন্ত সুরেলা কণ্ঠে আল্লাহ তায়ালার হামদ ও প্রশংসা করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)’র শানে দরুদ পেশ করেন। এরপর বলেন: হে জনগণ! আমি এমন এক মহামানবের সন্তান যাকে আল্লাহ সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে মনোনিত করেছেন এবং তাঁর প্রতি ওহী নাজিল করেছেন। আমার পিতার নানাজী ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। আমি সেই আলী ইবনে আবি তালিবের সন্তান যিনি প্রথম প্রহরে ইসলাম গ্রহণ করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাসূলুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন। নারীকূল শিরমনী বিবি খাদিজা ও বিবি ফাতিমার রক্ত আমার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে। আমি এমন এক পিতার সন্তান যাকে কারবালার ময়দানে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছে।এরপর তিনি কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদেরকে কি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরেন। দামেস্ক জামে মসজিদে উপস্থিত জনতা এতদিন বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর অপপ্রচারই শুনতে পেত। সত্য তাদের সামনে ছিল অস্পষ্ট। ইমামের মুখে সত্য ভাষণ শুনে তারা হতচকিত হয়ে যায়। তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অঝোরে কাঁদতে থাকে। ইমাম পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য যে সমাবেশ ডাকা হয়েছিল সেই সমাবেশের আবেগানুভূতি পুরোপুরি এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চলে যায়। দুরাচার এজিদ পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য মুয়াজ্জিনকে ডেকে বলে: নামাজের সময় হয়েছে আজান দাও। মুয়াজ্জিন আল্লাহু আকবার ধ্বনি দেয়। এ সময় ইমাম সাজ্জাদ (আ.) আজানের জবাব দিতে থাকেন। তিনি বলেন: আল্লাহর চেয়ে বড় আর কেউ নেই। মুয়াজ্জিন যখন বলে ওঠে আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তখন ইমাম বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে যখন ধ্বনিত হয় আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ তখন ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এজিদকে উদ্দেশ করে বলেন: হে এজিদ, মুয়াজ্জিন যে রাসূলুল্লাহর কথা বলছে সে কি তোমার পূর্বপুরুষ নাকি আমার পূর্বপুরুষ? যদি বলো তোমার পূর্বপুরুষ তাহলে উপস্থিত জনতার সামনে প্রমাণ হবে তুমি মিথ্যা বলছ। আর যদি বলো আমার পূর্বপুরুষ তাহলে আমার প্রশ্ন, কেন সেই রাসূলের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র এবং জান্নাতে যুবকদের সর্দার ইমাম হোসেইনকে হত্যা করেছো? তোমার প্রতি অভিশাপ! কিয়ামতের দিন তোমাকে ভয়াবহ জবাবদিহীতার সম্মুখীন হতে হবে।এজিদ পরিকল্পনা করেছিল, দামেস্কের প্রতারিত জনগণকে ইমাম পরিবারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে তাদের সামনেই ইমাম সাজ্জাদকে হত্যা করবে। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টে যায়। সে এবার ইমামকে সমবেদনা দিতে অগ্রসর হয় এবং নিজেকে নিরপরাধ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। সে কারবালার ময়দানের সব ঘটনার দোষ কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বলে: তার জায়গায় আমি থাকলে তোমার পিতা হোসেইনের সব দাবি মেনে নিতাম এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতাম না। #পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২৮

(পর্ব ৩৯): কারবালা বিপ্লবের সুমহান শিক্ষামে ২২, ২০১৯ ১৮:৩১ Asia/Dhakaগত আসরে আমরা বলেছি, কোনো কোনো ইতিহাসবিদ কারবালা বিপ্লবকে দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বলে উল্লেখ করলেও বাস্তবে এটি যেরকম কোনো ঘটনা ছিল না। এই কালজয়ী বিপ্লব যেমন অনেক প্রস্তুতির পর সম্পন্ন হয়েছিল তেমনি এর প্রভাব যুগ যুগ ধরে অব্যাহত ছিল এবং ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। আজকের আসরে আমরা কারবালা বিপ্লবের সুমহান শিক্ষাগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।আল্লাহর রাসূলের আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইমাম হোসেইন (আ.) ও তাঁর নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীরা নিজেদের মধ্যে যেমন সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন তেমনি কাফির ও মুনাফিকদের তারা প্রতি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। শত্রুকে চেনা এবং তার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা আশুরা বিপ্লবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। বেদআত ও কুসংস্কারের ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করা, ইসলামের লেবাসধারী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহ যোগানো, অত্যাচার ও নিপীড়নের সামনে উদাসীনতা ও নীরবতা পরিহার করা, আলেম ও চিন্তাবিদদেরকে বিপ্লবের ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো, অত্যাচারী শাসকের সঙ্গে আপোষ না করা, শিরক ও নিফাকের মূর্ত প্রতীকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান, শয়তানি শক্তিকে ভয় না পাওয়া, সবার মাঝে মুক্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়া, অপমানজনকভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে সম্মানজনক মৃত্যুকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং চূড়ান্তভাবে রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো হচ্ছে আশুরা বিপ্লবের উল্লেখযোগ্য কিছু শিক্ষা।এ ছাড়া,এই বিপ্লবের সাংস্কৃতিক অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে,জনগণের মধ্যে পার্থিব জীবনের চাকচিক্যকে প্রত্যাখ্যান করে ধর্মীয় চেতনার পুনর্জাগরণ,ধর্মীয় দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞাকে শক্তিশালী করা, অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জিহাদ এবং সর্বোপরি ধর্মীয় নেতার আনুগত্যকে জীবনের অঙ্গে পরিণত করা। আশুরার পূর্বরাতে ইমাম হোসেইন (আ.) ও তাঁর ঈমানদার সঙ্গীরা খোদাপ্রেমের এক অপূর্ব নিদর্শন স্থাপন করেন। হযরত হোসেইন (আ.) আশুরার আগের রাতে যখন জানতে পারেন এজিদ বাহিনী তাঁর তাবুর কাছাকাছি চলে এসেছে তখন তিনি নিজের ভাই আবুল ফজলকে কয়েকজন সঙ্গীসহ শত্রুবাহিনীর কাছে একটি বার্তা দিয়ে পাঠান। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু করার আগে তিনি একান্ত মনে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য একটি রাত সময় চান। তিনি আবুল ফজলকে বলেন, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই জানেন যে, আমি নামাজ আদায়, কুরআন তেলাওয়াত, বেশি বেশি দোয়া করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কাজে সময় ব্যয় করতে পছন্দ করি।ইমাম হোসেইন (আ.) এমন এক রাতে এই আবেদন জানিয়েছিলেন যে রাতে তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, আগামীকাল এই কারবালার ময়দানে তাকে সকল পুরুষ সঙ্গীসহ শহীদ হয়ে যেতে হবে। এ অবস্থায় অস্থিরতা ও চিৎকারের পরিবর্তে ইমাম শিবিরের তাবুগুলো থেকে ভেসে আসতে থাকে নফল ইবাদত, কুরআন তেলাওয়াত, দোয়া-মুনাজাত ও তসবিহ তাহলিলের সুমধুর ধ্বনি। ইমাম শিবিরে তৈরি হয় চমৎকার এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ। আশুরার দিন জোহরের নামাজের সময় এই পরিবেশ চূড়ান্ত রূপলাভ করে। পাপিষ্ঠ এজিদের দুর্বৃত্ত সেনাদলের মুহুর্মুহু আক্রমণের মুখেও ইমাম হোসেইন তাঁর একদল সঙ্গীসহ জোহরের নামাজ আদায় করতে দাঁড়িয়ে যান।মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তিনি বিশ্ব মানবতাকে দেখিয়ে দিয়ে যান, চরম দুঃসময়েও আল্লাহর ইবাদত থেকে দূর সরে যাওয়া যাবে না বরং এক সৃষ্টিকর্তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার মধ্যেই শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজতে হবে। নিঃসন্দেহে সেদিন ইমাম হোসেইন (আ.)ও তাঁর নিবেদিতপ্রাণ সঙ্গীরা পবিত্র কুরআনের এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছিলেন যেখানে বলা হচ্ছে: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে (আল্লাহর) সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।”আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে গিয়ে ইমাম হোসেইন (আ.) আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। অনুষ্ঠানের সময়ের স্বল্পতার কারণে তার জীবনের সব ঘটনা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তারপরও আমরা মানুষের সঙ্গে ইমামের ঘনিষ্ঠ ও দয়ার্দ্র আচরণ সম্পর্কিত দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।হোসেইন বিন আলী (আ.) একদিন একটি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে দেখতে পান, একদল দরিদ্র ও নিঃস্ব লোক গোল হয়ে বসে শুকনা রুটি খাচ্ছে। ইমামকে দেখে তারা তাঁকেও তাদের সঙ্গে বসে রুটি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। জান্নাতের যুবকদের অন্যতম সর্দার বিন্দুমাত্র অহংকার প্রদর্শন না করে দরিদ্র লোকগুলোর সঙ্গে রুটি খেতে মাটিতে বসে যান। এরপর তিনি অসহায় মানুষগুলোকে নিজের বাসভবনে দাওয়াত করে নিয়ে যান এবং ভালো খাবার পরিবেশন করে তাদেরকে পরিতৃপ্ত করেন।বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেইন (আ.) শহীদ হওয়ার পর তার পিঠে কালো দাগ দেখা যায়। এর কারণ জানতে চাইলে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেন: আমার পিতা রাতের বেলায় লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের ঘরে ঘরে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিতেন। নিজ হাতে নিজের পিঠে করে সেই বোঝা বহন করতে করতে তার পিঠে এই কালো দাগ সৃষ্টি হয়েছে।ইমাম হোসেইন (আ.) অসহায় মানুষের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: “যে ব্যক্তি তার একজন মুসলমান ভাইয়ের কষ্ট দূর করে দেয় আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে সব ধরনের কষ্ট থেকে নিরাপদে রাখবেন।” তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি অন্যের উপকার করে আল্লাহ তায়ালা তার উপকার করেন এবং তিনি উপকারীকে ভালোবাসেন।”ইমাম হোসেইন (আ.)আরেক বাণীতে আরো বলেন, “যখন তোমাদের কাছে কেউ হাত পাতে তখন বিষয়টিকে আল্লাহ প্রদত্ত একটি নেয়ামত হিসেবে গ্রহণ করবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ হবে না বরং সাধ্যমতো অভাবী লোকটিকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে। তা না হলে আল্লাহ তায়ালা যদি ক্ষুব্ধ হন তাহলে তিনি তোমাকে দেয়া রিজিক কেড়ে নিতে পারেন। তখন অনুশোচনা করে কোনো লাভ হবে না।”প্রখ্যাত মিশরীয় লেখক আল্লামা আব্দুল্লাহ আলায়েলি তার এক বইয়ে লিখেছেন, “ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাই যারা উন্নত কর্মের মাধ্যমে নিজেদের মহত্বের পরিচয় রেখে গেছেন। সাহসিকতা, দয়া-দাক্ষিণ্য, আত্মত্যাগ, দানশীলতা, মহানুভবতা ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত মহান ব্যক্তিত্বদেরকে মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মনে রাখে। তবে ইমাম হোসেইন (আ.)’র ব্যক্তিত্বের বিশালতা এত গভীর যে, নির্দিষ্ট কোনো মহৎ গুণের মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। তাঁর চরিত্রে যেন সকল মহৎ গুণের সমাহার ঘটেছে।”তো বন্ধুরা, দেখতে দেখতে আজকের আসরের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। গত কয়েকটি আসরে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)’র প্রিয় দৌহিত্র, হযরত আলী (আ.)’র সন্তান এবং বেহেশতের যুবকদের সর্দার ইমাম হোসেইন (আ.)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে আলোচনা করলাম। আগামী আসরে আমরা ইমাম হোসেইন (আ.)’র সন্তান ইমাম জয়নুল আবেদিন বা ইমাম সাজ্জাদ (আ.)র জীবনী নিয়ে আলোচনা শুরু করব।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২২

(পর্ব ৩৮): এজিদ ইসলামের আলো নিভিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেমে ১৮, ২০১৯ ১৬:৪৭ Asia/Dhakaগত আসরে আমরা বলেছি, ইমাম হোসেইন (আ.) বনি উমাইয়ার জালিম শাসক এজিদের দুঃশাসনের স্বরূপ জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালান।তিনি বিভিন্ন এলাকা সফর করে জনগণের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার পাশাপাশি নানা স্থানে চিঠি পাঠিয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেন। একইসঙ্গে সম্ভাব্য রক্তপাত এড়ানোর জন্যও সর্বান্তকরণে প্রচেষ্টা চালান ইমাম হোসেইন (আ.)। কিন্তু পাপিষ্ঠ এজিদ ও তার অনুচর বাহিনী ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকেসহ ইসলামের আলো চিরতরে নিভিয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র করে। আজকের আসরে আমরা এরপরের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব।এজিদ ইসলামের আলো নিভিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করলেও সে জানত না এই আলো নিভিয়ে ফেলা যায় না বরং আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় এর জ্যোতি দিন দিন তীব্রতর হয়। এ সম্পর্কে সূরা তওবার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা বিধান করবেন,যদিও কাফেররা তা অপ্রীতিকর মনে করে।”এজিদের অনুচর বাহিনীর পাশাপাশি কিছু ধোকা খাওয়া মুসলমান ৬১ হিজরির ১০ মহররম আশুরার দিন দুপুর বেলা কারবালার ময়দানে এমন এক বিপর্যয় সৃষ্টি করে যা ন্যুনতম মানবতাবোধ সম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়।কারবালার ময়দানের অসম যুদ্ধের একদিকে ছিল এজিদের হাজার হাজার সৈন্য অন্যদিকে শহীদদের সর্দার ইমাম হোসেইন (আ.)’র সঙ্গে ছিলেন ৭২ জন শ্রেষ্ঠ মানুষ। এজিদ বাহিনীর সেনারা ইমাম ও তার সব সঙ্গীকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তারা ইমাম হোসেইন’সহ প্রত্যেকের মস্তক দেহ থেকে আলাদা করে ফেলেছে।এরপর তারা ইমাম শিবিরের তাবুগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তাতে অবস্থানরত নারী ও শিশুদের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এসব সম্মানিত নারী ও শিশু যখন তাদের প্রিয়তম ব্যক্তিদের হারিয়ে শোকে কাতর তখন এজিদ বাহিনী তাদেরকে বন্দি করে চরম অমানবিক কায়দায় প্রথমে কুফায় ওবায়দুল্লাহ ও পরে শামে এজিদের দরবারে নিয়ে যায়।এজিদ ও তার সহচররা ভেবেছিল, মানুষকে শারীরিকভাবে বন্দি করলে তাদের স্বাধীনচেতা মনোবলকেও হয়ত বন্দি করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু ইমাম শিবিরের সম্মানিত নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে তারা এর উল্টোচিত্র দেখতে পায়। ইমাম হোসেইন (আ.)’র বোন হযরত জয়নাব সালামুল্লাহি আলাইহা এবং ইমামের যোগ্য উত্তরসূরি ও সন্তান ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এজিদের দরবারে সাড়া জাগানো ভাষণ দেন। তাঁদের সচেতনতামূলক ভাষণে দরবারে উপস্থিত লোকদের টনক নড়ে। হযরত জয়নাব ও ইমাম সাজ্জাদ নিজেদেরকে কারবালার ময়দানের বিজয়ী হিসেবে তুলে ধরেন এবং এমন সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলেন যাতে এজিদের শাসনক্ষমতার ভিতে কম্পন সৃষ্টি হয়।আসলে এজিদ শুরু থেকেই তার প্রচারযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম বিশ্বে ইমাম হোসেইন (আ.)সম্পর্কে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচার চালায়। এজিদের হাজারো দোষ ও নৈতিক স্খলনের কথা সে যুগের কারো অজানা ছিল না। তারপরও সে ইমামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে জনগণের সামনে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, মুসলিম জাহানের খলিফা ও আমিরুল মুমিনিন হওয়ার ক্ষেত্রে তার যোগ্যতা ইমাম হোসেইন (আ.)’র চেয়ে বেশি। সে জনগণকে আরো বোঝানোর চেষ্টা করে, ইমাম হোসেইন শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে মুসলিম জাহানের খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন; কাজেই তাকে হত্যা করা জায়েয।কিন্তু এই চরম মিথ্যাচারের স্বরূপ জনতার সামনে তুলে ধরার জন্য ইমাম এক ভাষণে বলেন: আমি ব্যক্তিগত স্বার্থে, ক্ষমতার লোভে, ফুর্তি, দুর্নীতি কিংবা জনগণের ওপর নির্যাতন করার লক্ষ্যে বিদ্রোহ করিনি; বরং আমরু বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার বা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার খোদায়ী বিধান পালন করাই আমার উদ্দেশ্য। শাসকগোষ্ঠী ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও চারিত্রিক দিক দিয়ে সমাজে যে চরম অনাচার ছড়িয়ে দিয়েছে তার মূলোৎপাটন করে আমি একটি সংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই। এই কাজে আমি আমার নানাজান রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং আমার পিতা আলী ইবনে আবি তালেবের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করব। কাজেই যে ব্যক্তি আমার এই বার্তা গ্রহণ করবে এবং তা মেনে চলবে সে যেন আল্লাহরই পথ অনুসরণ করল। কেউ যদি তা গ্রহণ না করে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে তাহলেও আমি আমার পথ চলা অব্যাহত রাখব। আল্লাহ তাদের ও আমার মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন এবং তিনিই সর্বোত্তম মীমাংসাকারী।ইমাম হোসেইন (আ.) এই ভাষণের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে একথা ঘোষণা করেন যে, ইসলামের শিক্ষাকে অগ্রাহ্যকারী কোনো ব্যক্তির মুসলিম জাহানের শাসনকর্তা হওয়ার অধিকার নেই।তাকে বরং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ঐতিহাসিকদের একাংশ বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শহীদদের সর্দার ইমাম হোসেইন (আ.)’র যুদ্ধকে নিছক একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করে এবং তাদের ধারণা, এর বাইরে কারবালার ঘটনার আর কোনো বিশেষত্ব নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আশুরা বিপ্লব এমন একটি কালজয়ী ঘটনা যা থেকে যুগে যুগে স্বাধীনচেতা মানুষ ও জাতিগুলো জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছে। ইরানের ইসলামি বিপ্লব নিঃসন্দেহে এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কাজেই দেখা যাচ্ছে, নিছক একটি সাধারণ ঘটনা হলে কারবালা বিপ্লব বহু আগে মানুষের মন থেকে মুছে যেত। কিন্তু বাস্তবে চৌদ্দশ’ বছর পরও কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের ঔজ্জ্বল্য যেন দিন দিন বাড়ছে।ইমাম হোসেইন (আ.) যখন হক ও বাতিলের মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নেয়ার অবস্থায় পৌঁছে যান তখন এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকে না। তার সামনে দু’টি পথ খোলা থাকে। হয় অপমানজনক জীবন বেছে নিয়ে প্রাণে রক্ষা পাবেন অথবা লড়াই করতে করতে সম্মানজনক মৃত্যু বা শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করবেন। এ অবস্থায় তিনি ঘোষণা করেন: “আমি মৃত্যু ও শাহাদাতকে চরম সৌভাগ্য এবং অত্যাচারী শাসকের সঙ্গে আপোশ করাকে দুর্ভাগ্য ও অপমানজনক মনে করি।” তিনি আরো বলেন, একটি অপবিত্র লোক আমাকে তার হাতে বায়াত গ্রহণ করে জিল্লতির জীবন গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে। তা না হলে আমি যেন মৃত্যুর জন্য তৈরি থাকি।কাজেই দেখা যাচ্ছে, ইমাম হোসেইন (আ.) জেনেবুঝে শাহাদাতের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি আশুরার পূর্ব রাতে নিজ সঙ্গীদের উদ্দেশে বলেন, আমি তোমাদেরকে বায়াতের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিলাম। তোমরা চলে যেতে পারো। কিন্তু জেনে রেখো, যদি আমার সঙ্গে থাকো তাহলে তোমাদেরকে নিশ্চিতভাবে শহীদ করা হবে। ইমামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত সঙ্গীরা এ সময় বলে ওঠেন, আপনার জন্য যদি ৭০ বারও শহীদ করা হয় তাহলেও আমরা আপনাকে ছেড়ে যাব না।আগামী আসরে আমরা ইমাম হোসেইনের জীবনী নিয়ে আলোচনার অংশ হিসেবে কালজয়ী আশুরা বিপ্লবের আরো কিছু দিক নিয়ে কলা বলার চেষ্টা।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১৮

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমআল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মোহাম্মদ ওয়া আলে মোহাম্মদইয়া আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব আঃ মাদাদ বেশ কিছু সংখ্যক জাহান্নামী সাহাবাগন —-” — সেদিন কিছু চেহারা শুভ্র হবে এবং কিছু চেহারা কাল হয়ে যাবে । আর যাদের চেহারা কাল হয়ে যাবে [তাদের বলা হবে] ” ঈমান আনার পর তোমরা কি সত্য প্রত্যাখান করেছিলে ?” সুতরাং তোমরা শাস্তি ভোগ কর যেহেতু তোমরা কুফরী করতে — ” ।সুরা – আলে ইমরান / ১০৬ ।প্রিয় পাঠক ,খেয়াল করুন – ” ঈমান আনার পর তোমরা কি সত্য প্রত্যাখান করেছিলে ?” সুতরাং তোমরা শাস্তি ভোগ কর যেহেতু তোমরা কুফরী করতে — ” ।পবিত্র কোরআনের এই আয়াতে পরিস্কার করে বলা হচ্ছে যে , ঐ সকল ব্যক্তিবর্গ প্রথমে মুসলমান হয়েছিল এবং পরে তারা পুনরায় তাদের অতীত জীবন অর্থাৎ কুফরীর জীবনে চলে যায় ।এবারে পবিত্র কোরআনের এই আয়াতের সমর্থিত রাসুল (সাঃ) এর দুটি হাদিসের প্রতি মনযোগ চাচ্ছি , প্লীজ —রাসুল (সাঃ) বলেন যে , আমি দন্ডায়মান অবস্থায় ছিলাম । দেখলাম আমার সামনে একদল লোক যাদের সবাইকে আমি চিনলাম ।তখন মধ্যখানে একজন লোক এসে বলল , ” চল আমরা যাই ” ।আমি জিজ্ঞাসা করলাম , ” এদের কোথায় যেতে হবে ?”সে বলল , ” আল্লাহর কসম , জাহান্নামে ” ।আমি জিজ্ঞেস করলাম , ” এদের অপরাধ কি ? ”সে বলল , ” আপনার ইন্তেকালের পর এরা সবাই মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল এবং আমি আশা করি অতি অল্প সংখ্যক মুক্তি পাবে ” ।আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) থেকে বর্ণিত –মহানবী (সাঃ) বলেন , আমি সবার পূর্বে হাউজে কাউসারে তোমাদের সম্মুখে থাকব । যে আমার নিকট দিয়ে যাবে সে হাউজে কাউসার থেকে তৃপ্তি সহকারে পানি পান করে যাবে । যে একবার পানি পান করবে তার কখনই পিপাসা লাগবে না ।হাউজের নিকটে কিছু লোক আসবে । আমি তাদেরকে চিনি , তারাও আমাকে ভালভাবে চেনে । অতঃপর আমার ও তাদের মাঝে একটি দেওয়াল সৃষ্টি করে দেওয়া হবে ।আমি বলব , ” এরা তো সকলেই আমার সাহাবী ” !জবাবে তখন বলা হবে , ” আপনি জানেন না , আপনার ইন্তেকালের পর তারা কি কি বেদআত করেছে ” ।তখন আমি তাদের বলব , ” আফসোস ! তাদের উপর , যারা আমার ইন্তেকালের পরে দ্বীনের ভিতর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছে ” ।সূত্র – বুখারী শরীফ , (আধুনিক প্রকাশনী) ষষ্ঠ খন্ড , হাদিস নাঃ – ৬১১৯ / সহীহ আল বুখারী , চতুর্থ খন্ড , পৃ- ৯৪ , ২য় খন্ড , পৃ- ৩২ / সহীহ মুসলিম শরীফ , ৭ম খন্ড , পৃ- ৬৬ (হাদিস আল হাউজ) / অবশেষে আমি সত্য পেলাম , পৃ- ১০৩ (নিউ দিল্লী , ভারত) ।পাঠক ,উপরে উল্লেখিত হাদিসগুলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সহীহ সিত্তাহ হাদিসগ্রন্থে বিদ্যমান আছে ।অতএব , সন্দেহের কোন অবকাশ নাই যে , রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর অধিকাংশ সাহাবাগন নবীজী (সাঃ) এর রেখে যাওয়া দ্বীনের মধ্যে প্রচুর পরিবর্তন করেছিলেন । মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক সাহাবী ব্যতীত অধিকাংশ সাহাবা মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল মহানবী (সাঃ) এর ইন্তেকালের পরে ।উপরোক্ত হাদিস অবশ্যই মুনাফেকগনের জন্য প্রযোজ্য হবে না । কেননা হদিসে এসেছে , মহানবী (সাঃ) বলবেন , ” এরা তো সকলেই আমার সাহাবী ” ।পবিত্র কোরআন এবং সহীহ সিত্তাহর হাদিস মোতাবেক অপ্রিয় বাস্তব সত্য এটাই যে , রাসুল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর অধিকাংশ সাহাবী তাদের পূর্বের জীবন অর্থাৎ কুফরী জীবনে পদার্পন করেছিলেন ।নিরপেক্ষ মন নিয়ে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি ভাবুন , প্লীজপ্রচারে মোঃ শামসীর হায়দার

(পর্ব ৩৭): এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনমে ১৪, ২০১৯ ১৮:১১ Asia/Dhakaগত আসরে আমরা এজিদ বিন মুয়াবিয়া ক্ষমতায় আসার পর ইমাম হোসেইন (আ.) তার শাসনের মোকাবিলায় কি কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিলেন সে সম্পর্কে আলোচনা করেছি।আমরা বলেছি, ইমাম সরাসরি জনগণের মধ্যে উপস্থিত হয়ে তাদের সামনে সত্য তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় দূত মারফত বাণী পাঠিয়ে এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজ শুরু করেন। আজকের আসরে আমরা ইমামের এ সংক্রান্ত কিছু ভাষণ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।ইমাম হোসেইন (আ.) তার ভাষণে একদিকে নবীজী (সা.)’র আহলে বাইতের সদস্য হিসেবে নিজের মর্যাদা তুলে ধরেন এবং অন্যদিকে উমাইয়া গোত্র বিশেষ করে মুয়াবিয়া ও এজিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে জনগণকে একথা বোঝানোর চেষ্টা করেন, কেন তিনি এজিদের মতো শাসকের হাতে বায়াত গ্রহণ করছেন না। ইমাম বলেন, তিনি সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান কিন্তু এজিদের লক্ষ্য বাতিল বা মিথ্যাকে শক্তিশালী করা; তিনি ইসলাম রক্ষায় সচেষ্ট কিন্তু এজিদ ইসলাম ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে; তিনি নির্যাতিত মানুষের মুক্তি ও ন্যায়বিচার চান অন্যদিকে এজিদের শাসনব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জুলুম ও অত্যাচারকে ভিত্তি করে। ইমাম হোসেইন মানুষকে দুনিয়ায় মুক্তি দিতে ও আখেরাতে জান্নাতে নিয়ে যেতে চান কিন্তু এজিদ দুনিয়াতে মানুষকে গোলাম করে রাখার পাশাপাশি পরকালে তাদেরকে নিয়ে জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দিতে চায়। কাজেই এ অবস্থায় দু’জনের মধ্যে আপোসরফার কোনো সুযোগ নেই।প্রখ্যাত শিয়া মোহাদ্দেস শেখ সাদুক (রহ.) বর্ণনা করেন: একদিন এক ব্যক্তি ইমাম হোসেইন (আ.)’র কাছে সূরা বনি-ইসরাইলের ৭১ নম্বর আয়াতের তফসির জানতে চায়। ওই আয়াতের একাংশে বলা হয়েছে: “স্মরণ কর,যেদিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমাম বা নেতাসহ আহবান করব...”। ইমাম জবাবে বলেন: এখানে ইমাম বলতে দুই ধরনের নেতার কথা বলা হয়েছে। তাদের একজন নেতা হচ্ছেন এমন যিনি মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিম ও আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের দিকে আহ্বান জানান। এমন নেতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে একদল মানুষ তাকে অনুসরণ করে। আরেক ধরনের নেতা আছে যারা সমাজকে বাতিল, বিভ্রান্তি ও বেলেল্লাপনার দিকে নিয়ে যায়। এমন নেতাদেরও অনেক অনুসারী থাকে। এরপর ইমাম সূরা আশ-শুরার ৭ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, উল্লেখিত প্রথম নেতা তার দল নিয়ে জান্নাতে এবং দ্বিতীয় নেতা তার দলবলসহ জাহান্নামে প্রবেশ করবে।কাজেই আমরা বুঝতে পারি, ইসলামি সংস্কৃতিতে নেতা নির্বাচন করা নিছক কোনো ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় নয় বরং এর সঙ্গে একজন মানুষের পরকালীন জীবনের ভাগ্য নির্ভর করছে। যারা আল্লাহর পথে আহ্বানকারী ঐশী নেতৃত্ব বেছে নেবে তারা চিরকালীন সুখের আবাস জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং যারা খোদাদ্রোহী জালেম নেতৃত্বের অনুসরণ করবে তারা জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। ইমাম হোসেইন (আ.) মানুষকে জালেম শাসকের হাত থেকে রক্ষা করে মূলত তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দিতে চেয়েছেন। জনগণের উদ্দেশে দেয়া এক সচেতনতামূলক ভাষণে ইমাম বলেন: হে জনগণ! জেনে রেখো রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যখন তোমরা এমন শাসকের মুখোমুখি হবে, যে শাসক হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করে, আল্লাহর রাসূলের সুন্নত পরিপন্থি কাজ করে এবং সমাজে গোনাহ বা পাপকাজ ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দেয় তখন তার বিরুদ্ধে জিহাদ করো। এমন শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ না করে নির্বিকার থাকলে আল্লাহ তায়ালা ওই শাসকের সঙ্গে তার অনুগত সব লোককে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।বিশ্বনবী (সা.)’র এই হাদিস স্মরণ করিয়ে দিয়ে ইমাম তার যুগের মানুষকে জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে বাঁচার জন্য এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। কিন্তু দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়া মানুষ তাঁর এ কথায় কান দেয়নি যার পরিণতিতে কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়। ইমাম হোসেইন (আ.) বনি উমাইয়া গোষ্ঠীর পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে আরেক ভাষণে বলেন: হে জনগণ! তোমরা জেনে রেখো, উমাইয়ারা আল্লাহর আনুগত্য বাদ দিয়ে এখন শয়তানের আনুগত্য করছে। তারা হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করছে, সমাজে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দিয়েছে এবং রাসূলের সুন্নতকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছে। তারা আল্লাহর দ্বীনকে পরিবর্তন করতে উদ্যত হয়েছে। এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরজ হয়ে পড়েছে।ইমাম এ বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে উমাইয়াদের শাসন ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করেন। আর ঠিক এ কারণেই মদিনার গভর্নর এজিদের পক্ষে বায়াত নিতে আসলে ইমাম হোসেইন (আ.) তাকে স্পষ্ট বলে দেন, “আমি যদি এজিদের মতো পাপিষ্ঠের হাতে বায়াত গ্রহণ করি তাহলে ইসলামের অপমৃত্যু ঘটবে।” প্রশ্ন হচ্ছে, শুধুমাত্র ইমাম হোসেইন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদেরই কি শুধু দায়িত্ব ছিল এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো? এ প্রশ্নের উত্তরে ইমাম অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে আলেম সমাজের গুরুদায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং তাদের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের আগে আলেম সমাজ ও চিন্তাবিদদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।ইমাম হোসেইন (আ.) তাঁর ভাষণের শুরুতে ‘ইয়া আইয়ু হান্নাস’ বা ‘হে লোকসকল’ বলে সম্মোধন করেন একথা বোঝানোর জন্য যে, তার এ আহ্বান কেবল তার যুগের মানুষের জন্য নয় বরং সকল যুগের সকল মানুষকে উদ্দেশ করে তিনি এ ভাষণ দিচ্ছেন। অবশ্য তাঁর ভাষণের মূল উদ্দেশ্য সকল যুগের আলেম সমাজ। ইমাম হোসেইন (আ.) প্রশ্ন করেন: আপনারা কি জানেন পবিত্র কুরআনে ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদেরকে কেন ভর্ৎসনা করা হয়েছে? সূরা মায়েদার ৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ইহুদি ও খ্রিষ্টান আলেমরা কেন জনগণকে পাপ কথা বলতে এবং হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করে না? তারা খুবই মন্দ কাজ করছে।” ইহুদি আলেমদের দায়িত্ব পালনে এই অবহেলার কারণে বনি-ইসরাইল জাতি এতটা বিপথে চলে গিয়েছিল যে, তারা আল্লাহ তায়ালার আজাবের যোগ্য হয়ে যায়। এ সম্পর্কে সূরা মায়েদার ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা পরস্পরকে মন্দ কাজে নিষেধ করত না। ’ অর্থাৎ বনি-ইসরাইলের লোকজন সমাজে অত্যাচার, জুলুম ও অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়তে এবং আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থি কাজ হতে দেখেও পার্থিব স্বার্থ হাসিল কিংবা শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের ভয়ে নীরব থেকেছে। অথচ সূরা মায়েদার ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘মানুষকে (এবং অত্যাচারী শাসকদেরকে) ভয় করো না বরং শুধু আমাকে ভয় করো।’এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) সেইসব মানুষের প্রশংসা করেন যারা সমাজের অন্যায়-অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সূরা তওবার ৭১ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: “আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ (ও পাপাচার) থেকে বিরত রাখে।”ইমাম হোসেইন (আ.) এজিদের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার খোদায়ী নির্দেশ বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ করেন।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১৪

(পর্ব ৩৬): ইমাম হাসান (আ.)’র সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি লঙ্ঘন করে মুয়াবিয়ামে ১১, ২০১৯ ১৬:২৪ Asia/Dhakaপ্রতিবাদী জনগণের কণ্ঠস্বর নিস্তব্ধ করে দেয়ার যে নীতি মুয়াবিয়া নিয়েছিল ইমাম হোসেইন তার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং তিনি কখনোই মুয়াবিয়ার ইসলাম ও মানবতা বিরোধী কোনো আচরণ মুখ বুজে সহ্য করেননি। আজকের আসরে আমরা মুয়াবিয়ার মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে খানিকটা আলোচনা করার চেষ্টা করব।ইমাম হাসান (আ.)’র সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি লঙ্ঘন করে মুয়াবিয়া নিজের শেষ জীবনে নিজের ছেলে এজিদকে ক্ষমতার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে। অথচ এজিদের জীবনে ইসলামি শিক্ষার লেশমাত্র ছিল না। তার পিতা লোক দেখানোর জন্য হলেও ইসলামের যে পোশাক পরেছিল তারও কোনো ধার ধারত না এজিদ।এ কারণে নবী পরিবারের সদস্য এবং রাসূলের নবুওয়্যাতের সাক্ষী ইমাম হোসেইন (আ.) এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন। এজিদের পক্ষে বায়াত নেয়ার জন্য মদীনার গভর্নর ইমাম হোসেইনের কাছে আসলে ইমাম বলেন, হে গভর্নর! আপনি ভালো করে জানেন যে, আমি নবী পরিবারের সদস্য এবং ফেরেশতা জিব্রাইল যে ঘরে যাতায়াত করতেন আমি সেই ঘরের সন্তান। ইসলাম আমাদের পরিবার থেকে যাত্রা শুরু করেছে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিবারকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যাবে। এরপর তিনি এজিদের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে বলেন: কিন্তু আপনি যে ব্যক্তির হাতে বায়াত হওয়ার বার্তা নিয়ে এসেছেন সেই এজিদ প্রকাশ্যে মদ্যপানকারী ব্যক্তি যার হাত নিরপরাধ মানুষের রক্তে রঞ্জিত। সে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে প্রকাশ্যে সব ধরনের পাপকাজে লিপ্ত হয়েছে। ইমাম প্রশ্ন করেন, গভর্নর! এখন আপনিই বলুন আমার মতো একজন মানুষ কি এজিদের হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে পারে? একটু চিন্তা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে এজিদের হাতে আমার আনুগত্যের শপথ করা উচিত নাকি উল্টো এজিদের উচিত আমার কাছে বায়াত গ্রহণ করা।ইমাম হোসেইন (আ.)’র এই নীতি অবস্থান থেকে সকল যুগের সকল মুসলমানের যে শিক্ষাটি গ্রহণ করা উচিত তা হলো- একজন ধর্মপ্রাণ, ঈমানদার ও উন্নত মানবীয় চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি কখনো কোনো পাপী, অত্যাচারী ও মানবতার শত্রুর আনুগত্য মেনে নিয়ে তার বাধ্য হয়ে থাকতে পারে না। উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীসম্পন্ন একজন মানুষ কখনো অত্যাচারী শাসকের হুমকিকে ভয় পায় না বা তার লোভনীয় প্রস্তাবের কাছে আত্মসমর্পন করে না বরং অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে শাসকের স্বরূপ জনগণের সামনে প্রকাশ করে দেয়।ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, বিশ্বব্যাপী যুগে যুগে যত সংঘর্ষ ও রক্তপাত হয়েছে তার মূলে ছিল ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বার্থ উদ্ধার এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ক্ষমতায় যেতে বা ক্ষমতা ধরে রাখতে মানবতা বিরোধী কাজ করতেও কেউ দ্বিধা করেনি। কিন্তু ইমাম হোসেইন (আ.) এই ঐতিহাসিক ধারার বিপরীতে শুধুমাত্র দ্বীন ইসলামকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি এক ভাষণে বলেন, আমি আমার নানাজান রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, আবু সুফিয়ানের বংশধরদের জন্য খেলাফত হারাম ঘোষণা করা হলো।ইমাম নবীজীর এই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে একথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, শুধু এজিদ নয় তার বংশের কারো মুসলিম জাহানের খলিফা হওয়ার যোগ্যতা নেই। আবু সুফিয়ান ও তার পরিবারের সদস্যরা মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত ছিল ইসলামের চরম শত্রু এবং তারা সবরকম উপায়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং তার সাহাবীদের কষ্ট দিয়েছে। এ সম্পর্কে ইমাম হাসান (আ.) বলেন: এজিদের মতো লোক যদি ক্ষমতার মসনদে বসে তাহলে ইসলামের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। কারণ, সে ক্ষমতায় গিয়ে ইসলামকে ধ্বংস করা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে না।দুঃখজনকভাবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র রেহলাতের পর গাদিরে খোমের নির্দেশনা উপেক্ষা করে খেলাফত চালু হওয়ার কারণে মুসলিম সমাজে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে কুসংস্কার চালু হয় তার ফলে মুসলমানদের নেতা নির্বাচনের ক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। এ কারণে এক সময় এজিদের মতো পাপাচারী ব্যক্তি মুসলিম জাহানের খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরও কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। সবাই এজিদের হাতে বায়াত গ্রহণ বা আনুগত্যের শপথ করে। অবশ্য কখনো কখনো উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মানুষ রাসূলুল্লাহ (সা.)’র আহলে বাইতের কাছে আশ্রয় নিত। কিন্তু এ অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হতো না। শাসকরা হুমকি-ধমকি ও লোভ দেখিয়ে তাদেরকে আবার নিজেদের শাসনের ছায়াতলে নিয়ে নিত। এজিদের শাসন শুরু হওয়ার পর বর্তমান ইরাকের কুফা অঞ্চলের জনগণ এমনই এক পদক্ষেপ নিয়েছিল।এজিদের অত্যাচারে যখন তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে তখন তারা হাজার হাজার চিঠি পাঠিয়ে ইমাম হোসেইন (আ.)কে কুফায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। তারা এসব চিঠিতে জানায়, ইমাম কুফায় গেলেই তারা সদলবলে তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করে এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। ইমাম হোসেইন কুফাবাসীকে নিরাশ করেননি। তবে তিনি জানতেন, সত্যিকারের ঐশী নেতার গুণাবলী সম্পর্কে কুফার জনগণের কোনো ধারণা নেই এবং এ কারণেই তারা এর আগে মুয়াবিয়া ও এজিদের মতো লোকদের শাসন মেনে নিয়েছে। তাই তিনি কুফাবাসীর চিঠির জবাবে লিখে পাঠান: সত্যিকারের ঐশী নেতা ও ইমাম হবেন সেই ব্যক্তি যিনি নিজের জীবনে পবিত্র কুরআনের আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন করেন, ন্যায়পূর্ণ জীবন যাপন করেন এবং নিজের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে দ্বীন রক্ষা করার চেষ্টা করেন।অন্য সব ঐশী নেতার মতো ইমাম হোসেইন (আ.)ও শাসকগোষ্ঠীর ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। একইসঙ্গে ইসলাম রক্ষা ও মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্য ধরে রাখার জন্য যুদ্ধের মতো রক্তাক্ত পথও তিনি বেছে নিতে চাননি। ইমাম বসরার জনগণের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে এই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে লেখেন: আল্লাহ তায়ালা নবুওয়াত দান করার জন্য বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.)কে মনোনিত করেছিলেন। নবীজী তাঁর দায়িত্ব সূচারুরূপে পালন করার পর দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। এখন আল্লাহর রাসূলের আহলে বাইতের সদস্য হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য আমাদের চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই। কিন্তু কিছু দখলদার শক্তি আমাদের কাছ থেকে সে অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তবে তারপরও মুসলিম সমাজের নিরাপত্তা ও ঐক্যের কথা বিবেচনা করে আমরা সংঘাতের পথ বেছে নেইনি।এরপর মুসলিম সমাজে চালু হওয়া কুসংষ্কারসমূহের স্বরূপ উন্মোচন করে ইমাম তাঁর চিঠিতে লেখেন: আমি আপনাদেরকে আল্লাহর কিতাব কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সা.)’র সুন্নত পালনের দিকে আহ্বান জানাচ্ছি। আমি এই আহ্বান এজন্য জানাচ্ছি যে, আমরা এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছি যেখানে রাসূলের সুন্নত বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। তার জায়গায় বেদআত ও কুসংস্কার ব্যাপকভাবে চালু হয়ে গেছে। যদি আপনারা আমার আহ্বানে সাড়া দেন তাহলে আপনাদের জন্য আমি দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে কল্যাণের পথ দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমার কথা শুনলে আপনারা আল্লাহ তায়ালার রহমত ও বরকত লাভ করবেন।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১১

(পর্ব ৩৪): ইমাম হোসেইন (আ.)’র ইমামতের সূচনামে ০৬, ২০১৯ ১৮:৫২ Asia/Dhakaআমিরুল মুমেনিন আলী (আ.)’র শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (আ.)’র ইমামতের সময়কাল শুরু হয়। এ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা মুয়াবিয়ার সঙ্গে ইমাম হাসান (আ.)’র পত্র বিনিময় এবং এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সন্ধি চুক্তি করার পুরো সময়টাতে বড় ভাইয়ের পাশে ছিলেন ইমাম হোসেইন (আ.)।ইমাম হাসান সন্ধি চুক্তি সই করার পর কুফা থেকে মদীনায় চলে যান এবং সেখানে ১০ বছর পর শাহাদাতবরণ করেন। ইমাম হাসানের শাহাদাতের পর ইমাম হোসেইন (আ.)’র ইমামতের যুগ শুরু হয়। আজকের আসরে আমরা এই যুগের সূচনাপর্বের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা বর্ণনা করব।ইমাম হাসান (আ.)’র শাহাদাতের পরও মুয়াবিয়া আরো ১০ বছর বেঁচে ছিল। এই ১০ বছর ইমাম হোসেইন (আ.) বড় ভাইয়ের নীতি অনুসরণ করে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মনে করেন, বেশিরভাগ মানুষ যখন মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক কূটকৌশলের ফাঁদে পা দিয়েছে তখন মুসলিম উম্মাহর জন্য শান্তির পথ অবলম্বনই শ্রেয়। যদি সিফফিনের যুদ্ধের মতো আরেকটি যুদ্ধ বাধে তাহলে কোনো পক্ষের কোনো অর্জন ছাড়াই হাজার হাজার মানুষের রক্ত ঝরবে এবং এর ফলে ইসলামের শত্রুরা লাভবান হবে। ইমাম আলাইহিমুস সালামগণ মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কখনো যুদ্ধ করেছেন আবার কখনো শান্তির পথ বেছে নিয়েছেন। কখনো নিশ্চুপ থেকেছেন আবার কখনো সিংহের মতো গর্জে উঠেছেন। অন্য কথায় সব ইমামের মৌলিক নীতি অভিন্ন হলেও তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী কৌশল পরিবর্তন করতেন। এই কৌশল অবলম্বন করেই মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায় বড় ভাই ইমাম হাসানের মতো শান্তির পথে অটল থাকার সিদ্ধান্ত নেন ইমাম হোসেইন (আ.)। অবশ্য তিনি মুয়াবিয়ার শাসনের কুসংস্কার ও অত্যাচারের ব্যাপারে নীরব থাকেননি। কিন্তু মুয়াবিয়া বাহ্যিক বেশভুষায় মুসলমানিত্বের দাবি করে জনগণকে এমনভাবে ধোঁকা দিয়ে রেখেছিল যে, তাদের পক্ষে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন ধর্মপ্রাণ মুসলমান সব সময় বাহ্যিক পোশাক-আশাক দেখে একজন মানুষের ঈমানদারিত্ব পরিমাপ করে। ইমাম হোসেইন (আ.)’র যুগের মুসলমানরা ঠিক এ কারণেই যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব ইমাম হোসেইনকে উপেক্ষা করে মুয়াবিয়ার দলে যোগ দেয়। তবে বুৎপত্তিসম্পন্ন ঈমানদার মুসলমানরা এক মুহূর্তের জন্যও সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ পরিহার করেননি। তারা বরং বনি উমাইয়ার শাসকদের কর্মকাণ্ড নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন এবং জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শহীদ হওয়ার পথ বেছে নিয়েছেন। এই ঈমানদার ব্যক্তিদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন হুজ্‌র ইবনে আদি কেন্দি। তার নেতৃত্বে একদল ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমান মুয়াবিয়ার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে বনি উমাইয়ার শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করে। ইমাম হোসেইন (আ.) এই মর্মান্তিক ঘটনার ব্যাপারে চুপ থাকতে পারেননি। তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। এ সময় গুপ্তচররা ইমামের বিরুদ্ধে মুয়াবিয়ার কাছে নালিশ জানালে মুয়াবিয়া ইমামের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। ইমাম ওই চিঠির উত্তরে লেখেন: আমার হাতে তোমার এমন একটি চিঠি এসে পৌঁছেছে যাতে তুমি জানিয়েছো যে, আমার সম্পর্কে অসন্তোষজনক খবর তুমি শুনেছো। সেইসঙ্গে তুমি জানিয়েছো যে, আমার কাছ থেকে এমন আচরণ তুমি আশা করোনি।... জেনে রেখো, যারা তোমার কাছে এ খবর পাঠিয়েছে তারা মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্যের বীজ বপন করছে। আমি যেমন তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কোনো চিন্তা করিনি তেমনি যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতিও নেইনি। কিন্তু তাই বলে তুমি কখনো একথা মনে করো না যে, তোমার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নীরব থাকা আমার জন্য স্বস্তিদায়ক। বরং এই নীরবতা আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করেন কিনা আমি সেই আশঙ্কায় রয়েছি। এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) হুজ্‌র ইবনে আদি’র শাহাদাতের প্রসঙ্গ টেনে মুয়াবিয়াকে আরো লেখেন: তুমি কি হুজ্‌র ইবনে আদি’কে হত্যা করোনি? তুমি কি তার ঈমানদার ও নামাজি সহযোগীদের গর্দান নাওনি? তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও কেন তাদেরকে আটক করে বন্দি অবস্থায় হত্যা করলে?ইমাম হোসেইন (আ.) মুয়াবিয়াকে লেখা চিঠির অন্যত্র বলেন: তোমার চিঠিতে আমাকে হুমকি দিয়ে লিখেছ, তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিবর্তে আমি যেন নিজের জীবন, দ্বীন ও উম্মতকে রক্ষা করার লক্ষ্যে নীরবতা অবলম্বন করি। কিন্তু তুমি জেনে রেখো, আমি যদি তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেই তাহলে আল্লাহর কাছে তা হবে অনেক বেশি পছন্দনীয়। কিন্তু যদি তোমার বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকি তাহলে মহান আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন এবং সেক্ষেত্রে আমাকে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। চিঠির শেষাংশে ইমাম হোসেইন (আ.) মুয়াবিয়াকে লেখেন: তুমি নিজেকে ঐশী প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত করো এবং জেনে রেখো আল্লাহ তায়ালা তার আদালতে তোমার বিচার করবেন। সেই আদালতে তোমার মানবতা বিরোধী ও ধর্ম বিরোধী কর্মকাণ্ডগুলো উত্থাপন করা হবে।বন্ধুরা! আমরা শুরুতেই যেমনটি বলেছি, মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায় তার শাসনের ব্যাপারে ইমাম হোসেইন (আ.) তাঁর অগ্রজ ইমাম হাসান (আ.)’র নীতি গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ ইমাম হাসান যেমন সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন তেমনি ইমাম হোসেইনও ইসলাম রক্ষা, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা ও নিরপরাধ মানুষের রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকেন। মুয়াবিয়া নিজেকে ইসলামের ধ্বজাধারী বলে প্রচারণার এমন ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছিল যেখানে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেই সহজ-সরল মুসলমানরা তাকে ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ মনে করত। সাধারণ জনগণের এই ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার ওপর ভর করে মুয়াবিয়া নিজেকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল যে, সে তার ভাষায় ফেতনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য ইমাম হোসেইকে অভিযুক্ত করতেও দ্বিধা করেনি। মুয়াবিয়া ইমামকে ফেতনা পরিহার করার আহ্বান জানানোর ধৃষ্টতা দেখায়। এ কারণে ইমাম হোসেইন (আ.) এক চিঠিতে মুয়াবিয়াকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করে দিয়ে বলেন: তুমি আমাকে ফেতনা সৃষ্টি না করার আহ্বান জানানোর মতো ধৃষ্টতা দেখাও? কিন্তু আমি তো মুসলিম উম্মাহর জন্য তোমার শাসনের চেয়ে‌ আর কোনো কিছুকে বড় ফেতনা বলে মনে করি না।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ৬

(পর্ব ৩৫): মিনা ময়দানে দেয়া ইমাম হোসেইন (আ.)’র গুরুত্ব খুতবামে ০৮, ২০১৯ ২১:০২ Asia/Dhakaগত আসরে আমরা বলেছি, ইমাম হাসান (আ.)’র শাহাদাতের পর ইমাম হোসেইন (আ.) মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায় তার সঙ্গে সন্ধি অব্যাহত রাখলেও তার জুলুম ও দুঃশাসনের ব্যাপারে কখনোই নীরব থাকেননি।তিনি মুয়াবিয়ার মৃত্যুর দুই বছর আগে ৫৮ হিজরির জিলহজ্ব মাসে হজের সময় মিনা ময়দানে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে উমাইয়া শাসকের বিরুদ্ধে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। আজকের আসরে আমরা এই ভাষণের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরব।মিনা ময়দানে দেয়া ইমাম হোসেইন (আ.)’র এই খুতবার গুরুত্ব তখনই উপলব্ধি করা যাবে যখন আমরা জানব যে, ওই সমাবেশে ৭০০ জন আনসার, ২০০ জন তাবেয়ী এবং বানি হাশেম গোত্রের ৩০০ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এই বারোশ’ ব্যক্তি এক তাবুর নীচে সমবেত হলে ইমাম হোসেইন (আ.) হামদ ও সানা পেশ করার পর মুয়াবিয়ার দুঃশাসনের কথা উল্লেখ করে বলেন, এই অত্যাচারী ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে এবং আমাদের অনুসারীদের সঙ্গে কি আচরণ করেছে তা আপনারা দেখেছেন ও শুনেছেন। আমার অনুরোধ থাকবে আমার আজকের বক্তব্য এখানে যারা নেই তাদের কাছে পৌঁছে দেবেন।এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)’র আহলে বাইতের মর্যাদা বর্ণনা করে বলেন: আপনাদের কি জানা আছে, মদীনায় মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপনের সময় আলী ইবনে আবি তালিবের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ঘোষণা করেছিলেন নবীজী (সা.)? উপস্থিত সবাই বলে ওঠেন: জি একথা আমাদের সবার জানা। এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) বলেন: মসজিদে নববীর সঙ্গে যেসব ঘরের দরজা খোলা ছিল তার সবগুলো বন্ধ করে দিয়ে নবীজী শুধু নিজের ও আমার পিতা আলী (আ.)’র ঘরের দরজা খোলা রেখেছিলেন। এ সময় সবাই প্রতিবাদ জানালে নানাজী রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, আমি আল্লাহ আদেশে এ কাজ করেছি। একথা কি আপনাদের জানা আছে? সমবেত সবাই আল্লাহর শপথ করে একথার সত্যতা নিশ্চিত করেন।ইমাম হোসেইন (আ.) তার ভাষণের অন্য অংশে বলেন: আপনারা বলুন, গাদিরে খোমে নবীজী কি হযরত আলীকে ইমামত ও খেলাফতের দায়িত্ব দেননি? তিনি কি উচ্চস্বরে সেখানে উপস্থিত লোকদেরকে একথা অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দিতে বলেননি? উপস্থিত জনতা সমস্বরে বলে ওঠে: জি খোদার কসম, আমরা এর সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছি। এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) সমবেত জনতাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করেন: খায়বার যুদ্ধের আগের দিন নবীজী কি একথা ঘোষণা করেননি যে, আগামীকাল আমি এমন একজনের হাতে জিহাদের ঝাণ্ডা তুলে দেব যাকে আল্লাহ ও তার রাসূল ভালেবাসেন এবং সেও আল্লাহ ও তার রাসূলকে ভালোবাসে? এর পরদিন দেখা গেল তিনি সেই ঝাণ্ডা হযরত আলীর হাতে তুলে দিয়েছেন? উপস্থিত জনতা এ প্রশ্নের উত্তরেও ইমাম হোসেইন (আ.)’র বক্তব্যের সত্যতা স্বীকার করে নেয়।এরপর হযরত আলী (আ.)’র আরো কিছু ফজিলত বর্ণনা করে ইমাম হোসেইন বলেন, বিশ্বনবী (সা.) তাঁর জীবনের সর্বশেষ ভাষণে বলেছিলেন, আমি তোমাদের কাছে দু’টি মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি। এর একটি আল্লাহর কিতাব এবং অপরটি আমার আহলে বাইত। যতদিন তোমরা এই দু’টি আকড়ে থাকবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। তিনি প্রশ্ন করেন, আপনারা কি এই বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত করবেন? উপস্থিত জনতা সমস্বরে বলে ওঠে: হ্যা ইমাম আপনি সত্য বলেছেন।এরপর ইমাম হোসেইন (আ.) আরো বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.)কে কি আপনারা একথা বলতে শুনেছেন যে, যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসার দাবি করা সত্ত্বেও আলীর সঙ্গে শত্রুতা করবে সে মিথ্যা বলছে? আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণকারী ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসতে পারে না? এ সময় একজন রাসূলকে প্রশ্ন করেছিল- ইয়া রাসূলুল্লাহ কেন সেটা সম্ভব নয়? নবীজী উত্তরে বলেছিলেন, কারণ, আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। যে কেউ আলীকে ভালোবাসল সে যেন আমাকেই ভালোবাসল এবং যে আমাকে ভালোবাসল সে যেন আল্লাহকেই ভালোবাসল। পক্ষান্তরে যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা করল সে যেন আমার সঙ্গে শত্রুতা করল এবং যে আমার সঙ্গে শত্রুতা করল সে আল্লাহর শত্রু হয়ে গেল? উপস্থিত জনতা একসঙ্গে বলে ওঠে যে, হ্যাঁ তারা নবীজীর মুখে একথা বলতে শুনেছেন।মিনা ময়দানে বহু সংখ্যক সাহাবী, তাবেয়ী ও বানি হাশেম গোত্রের লোকের উপস্থিতিতে ইমাম হোসেইন (আ.)’র এই ভাষণ থেকে যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো- তিনি কেন হযরত আলী (আ.)’র মর্যাদা সম্পর্কে এত কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং কেনই বা এ ব্যাপারে উপস্থিত জনতার সাক্ষ্য গ্রহণ করলেন? এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- মুয়াবিয়া হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে বহু জাল হাদিস তৈরি করে তার ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছিল। এমনকি মক্কা ও মদীনাসহ মুসলিম জাহানের সর্বত্র মসজিদ ও জুমার নামাজ থেকে আলী (আ.)র বিরুদ্ধে অভিসম্পাত বর্ষণেরও নির্দেশ জারি করেছিল। সাধারণ সহজ সরল মুসলমান সেই নির্দেশ পালন করা শুরু করে দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের মন থেকে সেসব ভুল ধারণা দূর করার জন্য হযরত হোসেইন (আ.) সাহাবী ও তাবেয়ীদের সামনে হযরত আলীর মর্যাদা সম্পর্কে এ ভাষণ দিয়েছিলেন।সেইসঙ্গে ইমাম হোসেইনের আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হলো সাহাবী ও তাবেয়ীরা যাতে আহলে বাইতের সদস্যদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে এমন কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে না পারে যে, বিষয়টি আমাদের জানা না থাকার কারণে আমরা সময়মতো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। আমরা যদি জানতাম তাহলে শাসকচক্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আপনাদের পাশে থাকতাম।কিন্তু ইমামের এই সচেতনতামূলক বক্তব্যের পরও কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়। কারবালার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় বহু সাহাবী ও তাবেয়ীর উপস্থিতির পাশাপাশি ইরাক থেকে ইমাম হোসেইনের কাছে প্রায় ৩০ হাজার চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে কুফাবাসী জানায়, ইমাম যদি শামের উদ্দেশ্যে তাঁর বাহিনী নিয়ে রওনা দেন তাহলে তারা তাতে যোগ দেবে এবং উমাইয়াদের শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরাকের জনগণ তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তারা রাসূলের আহলে বাইতের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে বনি উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীর ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। এই দুনিয়া পূজারি মানুষগুলোই আবার কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর হযরত জয়নাব সালামুল্লাহি আলাইহা ও ইমাম সাজ্জাদ (আ.)’র জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে উদাসিনতার ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল। তারাই নিজেদের ভুলের ক্ষতিপূরণ করার জন্য তাওয়াবিন ও মুখতারের বিদ্রোহের মতো বীরত্বগাঁথা সৃষ্টি করেছিল।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ৮

(পর্ব ৩৩): ইমাম হোসেইন (আ.)’র জীবনী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনামে ০২, ২০১৯ ১৭:৩৯ Asia/Dhakaচতুর্থ হিজরির ৩ শাবান হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘর আলোকিত করে তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান ইমাম হোসেইন (আ.) জন্মগ্রহণ করেন।মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এ খুশির খবর শুনে প্রিয় দৌহিত্রকে দেখতে যান। নবজাতককে এক টুকরো কাপড়ে পেঁচিয়ে নবীজীর কোলে দিলে তিনি ইমাম হোসেইনের ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত দেন। রাসূলের এই সুন্নত পালন করে আজও মুসলমানদের ঘরে সন্তান জন্ম নিলে নবজাতকের ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামত শোনানো হয়। নবীজী (সা.) তার প্রিয় দৌহিত্রের নাম রাখে হোসেইন।সালমান ফারসি বর্ণনা করেন: একবার রাসূলুল্লাহ (সা.)’র খেদমতে হাজির হয়ে দেখি তিনি হাসান ও হোসেইন আলাইহিমুস সালামকে খাবার খাওয়াচ্ছিলেন। দুই দৌহিত্রকে খাবার খাওয়ানো শেষ হওয়ার পর নবীজী হাসানকে কাঁধে এবং হোসেইনকে নিজের কোলের উপর বসান। এরপর প্রশ্ন করেন: হে সালমান! তুমি কি এঁদেরকে ভালোবাসো? আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে যারা এত প্রিয় আমি কীভাবে তাদেরকে ভালো না বেসে থাকতে পারি? নবীজী বলেন: “হে সালমান! যে কেউ এঁদেরকে ভালোবাসবে সে যেন আমাকে ভালোবাসল এবং যে আমাকে ভালোবাসল সে আল্লাহকে ভালোবাসল। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরপর হোসেইন (আ.)’র কাঁধে হাত রেখে বলেন: সে হচ্ছে ইমামের সন্তান ইমাম। তার বংশে নয়জন নিষ্পাপ ইমাম আসবে এবং তাদের নবমজন হবে কায়েম বা অভ্যুত্থানকারী।এ সম্পর্কে প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: আলী আমার স্থলাভিষিক্ত, তার স্ত্রী ও আমার কন্যা ফাতিমা দোজাহানের নারীদের নেত্রী এবং আমার দৌহিত্র হাসান ও হোসেইন জান্নাতে যুবকদের সর্দার। যারা তাদেরকে ভালোবাসবে তারা যেন আমাকেই ভালোবাসল এবং যারা তাদের সঙ্গে শত্রুতা করে তারা যেন আমার সঙ্গে শত্রুতা করল। যারা তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে তারা যেন আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরল, যারা তাদের প্রতি অবিচার করবে তারা যেন আমার প্রতি অবিচার করল এবং যারা তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে তারা যেন আমার সঙ্গে সদাচারণ করল। যে ব্যক্তি তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে মহান আল্লাহ তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবেন এবং যে ব্যক্তি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ তায়ালা তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। তাদেরকে যে ব্যক্তি সাহায্য করবে মহান আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন এবং যে ব্যক্তি তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপহীন আল্লাহ তায়ালাও তার প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না। এ ছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্য এক হাদিসে বলেছেন: “হোসেইন আমা হতে এবং আমি হোসেইন হতে।” নবীজীর এ বক্তব্য শুধু রক্তের বন্ধনের প্রতি ইশারা নয় বরং বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা, চিন্তাদর্শন ও নেক আমলের দিক দিয়ে সত্যিই ইমাম হোসেইন (আ.) ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)’র একনিষ্ঠ অনুসারী। কারবালার ময়দানে এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সময় এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে ইমাম হোসেইন (আ.) বলেন: “...আমি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমার নানা রাসূলে খোদা (সা.) ও পিতা আলী ইবনে আবিতালেবকে অনুসরণ করেছি।” এ ছাড়া যখন ইমাম হোসেইনকে এজিদের হাতে বায়াত গ্রহণ অথবা শাহাদাতের যেকোনো একটি পথ বেছে নিতে বলা হয় তখন তিনি বলেন: “আমি যদি এজিদের হাতে বায়াত নিয়ে অমর্যাদাকর কাজ করে বসি তাহলে আল্লাহ, তাঁর রাসূল, খাঁটি মুমিনগণ ও যে ইসলামের ছায়াতলে বড় হয়েছি তাদের সবাই অসন্তুষ্ট হবে।” কাজেই দেখা যাচ্ছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইমাম হোসেইন (আ.)’র অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)। হয়ত এ কারণেই বলা হয়, ইসলামের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নবীজীর হাতে এবং ইমাম হোসেইনের শাহাদাত সে ভিত্তিকে চিরস্থায়ী রূপ দান করেছে।ইমাম হোসেইন (আ.) মাত্র ছয় বছর বিশ্বনবী (সা.)’র সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন এবং নানাজীর ওফাতের অল্প কিছুদিন পর তিনি মা ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহাকেও হারিয়েছিলেন। কিন্তু ইমামের উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর ভিত্তি ওই ছয় বছরেই রচিত হয়েছিল। ইমাম হোসেইন (আ.)’র বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা স্মরণ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেন: একজন নারী ছোট একটি ঘরে দীনহীন অবস্থায় এমন কিছু মানুষকে প্রশিক্ষিত করে তুলেছিলেন যাদের নূরের আলো জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত আলোকিত করে তুলেছিল।মা’কে হারানোর পর ইমাম হোসেইন (আ.) শৈশবের বাকি দিনগুলোর পাশাপাশি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রেখেছেন পিতা আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ.)’র সান্নিধ্যে। হযরত আলী (আ.) ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সিরাতুল মুস্তাকিমে অটল থেকেছেন এবং ন্যায়বিচার ও ইনসাফের পথ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি।অবশ্য ইমাম হোসেইন (আ.) শিশুকাল থেকে বেশ কিছু তিক্ত ও দুঃখজনক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে নানাজীকে হারানোর কিছুদিনের মধ্যে মা’কেও চিরদিনের জন্য হারাতে হয়। এরপর চোখের সামনে পিতা ইমাম আলী (আ.)কে তাঁর অকাট্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে দেখেন ইমাম হোসেইন। ২৫ বছর এভাবে কেটে যাওয়ার পর হযরত আলী (আ.) মুসলিম বিশ্বের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। এ পর্যায়ে পিতার সঙ্গে জঙ্গে জামাল, জঙ্গে সিফফিন ও জঙ্গে নাহরাওয়ানে অকুতোভয় যুদ্ধ করেন ইমাম হোসেইন (আ.)।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ২

(পর্ব ৩২) : বাধ্য হয়ে ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করেনএপ্রিল ২৩, ২০১৯ ১৮:২৩ Asia/Dhakaগত আসরে আমরা বলেছিলাম, ইমাম হাসান (আ.) যখন মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আগে নিজ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন তখন খারেজিরা ইমাম শিবিরে শুধু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছড়িয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি একইসঙ্গে তারা ইমাম হাসানকে ‘কাফির’ ফতোয়া দিতেও দ্বিধা করেনি। এই ফতোয়া দেয়ার পর তারা ইমামের শিবিরে হামলা চালিয়ে সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়।ইমাম হাসান (আ.) খারেজিদের হাতে এর চেয়ে বেশি অপদস্থ হওয়ার আশঙ্কায় নিজের একান্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। কিন্তু ঘোড়া ছোটা শুরু করতেই একজন খারেজি ইমামের শরীরে বর্শা নিক্ষেপ করে। বর্শার আঘাত ইমাম হাসান (আ.)’র পায়ের হাড় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সঙ্গীরা আহত ইমামকে সঙ্গে করে মাদায়েন অঞ্চলে ইমাম আলী (আ.)’র ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত সাঈদ বিন মাসুদ সাকাফির বাড়িতে নিয়ে যান। এদিকে ইমাম পক্ষের কিছু গোত্র প্রধান এই সুযোগে মুয়াবিয়ার কাছে গোপনে চিঠি পাঠিয়ে দেয়। ওই চিঠিতে তারা মুয়াবিয়াকে ইরাকের দিকে আরো অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলে, তারা কাছাকাছি এলে ইমাম হাসানকে আটক করে মুয়াবিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হবে। এই চিঠি পাওয়ার পর মুয়াবিয়া নিজের দূত পাঠিয়ে ইমাম হাসান (আ.)’র কাছে ওই চিঠি পৌঁছে দিয়ে তাকে বলেন: নিজের চারপাশে এই ধরনের বিশ্বাসঘাতক নিয়ে আপনি কীভাবে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চান?মুয়াবিয়া জনগণের কাছে সমাদৃত কিছু ব্যক্তিকে ইমাম হাসান (আ.)’র কাছে পাঠায়। এসব লোক মাদায়েনে স্থাপিত তাবুতে ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এ অবস্থায় ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন। কারণ, তাঁর তিন প্রধান সেনাপতি হুমকি ও লোভের কাছে আত্মসমর্পন করে মুয়াবিয়ার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, খারেজিরা তাঁকে কাফের ফতোয়া দেয়ায় ইমাম বাহিনীর মনোবল দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং গোত্র প্রধানরা গোপনে মুয়াবিয়ার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মনোস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিল। এদিকে ইমাম সন্ধি করতে সম্মত হওয়ার পর মুয়াবিয়ার প্রয়োজন ছিল শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা। এ কারণে সে ইমাম হাসান (আ.)’র কাছে সাদা কাগজ পাঠিয়ে দিয়ে ঘোষণা করে, তাতে ইমাম যেসব শর্ত লিখবেন তার প্রত্যেকটি সে মেনে চলবে। ইমাম হাসান এই সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করেন এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সন্ধির শর্ত হিসেবে লিখে দিয়ে সেগুলো মেনে চলার ব্যাপারে মুয়াবিয়ার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেন।সন্ধির প্রধান ধারা ছিল পাঁচটি। ১- মুয়াবিয়া পবিত্র কুরআন ও রাসূলের সুন্নত অনুযায়ী শাসনকাজ পরিচালনা করবে- এই শর্তে হাসান বিন আলী (আ.) শাসনক্ষমতার দাবি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবেন। ২- মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর হাসান বিন আলী (আ.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তবে তার আগে ইমাম হাসানের কোনো ক্ষতি হলে হোসেইন বিন আলী (আ.) মুসলিম জাহানের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করবেন এবং মুয়াবিয়া কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করতে পারবে না। ৩- মসজিদে আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে গালিগালাজ বন্ধ করতে হবে এবং তাঁর প্রশংসা করতে হবে। ৪- কুফার বাইতুল মালে যেসব সম্পদ রয়েছে সেগুলোর ওপর মুয়াবিয়া কোনো দাবি করতে পারবে না বরং এই সম্পদ ইমাম হাসান (আ.) মুসলমানদের স্বার্থে খরচ করবেন। এবং ৫- ‘দারাবগার্দ’ শহর থেকে অর্জিত খাজনার অর্থের একাংশ জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে ইমাম আলী (আ.)’র পক্ষে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারবর্গকে দিতে হবে। মুয়াবিয়া মহান আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে এই সন্ধির প্রতিটি শর্ত মেনে চলতে সম্মত হয় এবং শাম বা সিরিয়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সাক্ষী হিসেবে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন।এই সন্ধি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ইমাম হাসান (আ.) শক্তিশালী অবস্থানে থেকে সন্ধির শর্ত নির্ধারণ করেন। তিনি মুয়াবিয়াকে কোনো ছাড় দেননি এবং তাকে লিখে দিয়েছেন যে, ইমাম কোনোদিন তাকে আমিরুল মুমিনিন বলে সম্বোধন করবেন না। এ কারণে পরবর্তীতে মুয়াবিয়া উপলব্ধি করে এই সন্ধি মেনে চললে তার পক্ষে স্বাধীনভাবে শাসনকাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। তাই সে সন্ধি লঙ্ঘনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য মুয়াবিয়া ‘নাখলিয়া’ নামক সেনাঘাঁটিতে যায় এবং সেখানে জুমার নামাজের খুতবায় ঘোষণা করে: আল্লাহর কসম আমি আপনাদের সঙ্গে এজন্য যুদ্ধ করিনি যে, আপনারা নামাজ পড়বেন, রোজা রাখবেন, যাকাত দেবেন ও হজ্ব পালন করবেন। কারণ, এসব কাজ আপনারা আগে থেকেই করতেন। আমি যুদ্ধ করেছি ক্ষমতা গ্রহণের জন্য এবং আল্লাহ আমার সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছেন। আপনারা জেনে রাখুন, আমি হাসান বিন আলীর সঙ্গে সন্ধি করেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওই সন্ধি মানব না এবং এর কোনো শর্ত পূরণ করব না।নিঃসন্দেহে মুয়াবিয়া সন্ধির শর্তগুলো বাস্তবায়ন করলে ইমাম হাসান (আ.)’র কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যগুলো একে একে পূরণ হতো। মুয়াবিয়ার একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতা হলেও ইমাম শুধু চেয়েছিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে দিক নির্দেশনা অনুযায়ী শাসনকাজ পরিচালিত হোক এবং শাসনকাজে উমাইয়ারা যেসব বেদআত ও কুসংষ্কার চালু করেছিল সেগুলোর অবসান ঘটুক।এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইসলামে শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং মানবতাবাদী এ ধর্মে যতটা সম্ভব যুদ্ধ এড়ানোর দিকনির্দেশনা রয়েছে। ইমাম হাসান যখন উপলব্ধি করেন যুদ্ধের মাধ্যমে কিছু অর্জন করা সম্ভব নয় তখন সন্ধি ও শান্তির পথ বেছে নেন। এ ছাড়া তিনি দেখতে পান, যুদ্ধ লেগে গেলে কোনো কিছু অর্জন করা ছাড়াই দু’পক্ষের হাজার হাজার মানুষ নিহত হবে। সেইসঙ্গে মুসলমানদের মধ্যকার গৃহযুদ্ধের সুযোগে ইসলামের শত্রুরা মুসলিম বিশ্বে আঘাত হানত। ইমাম হাসান (আ.) সন্ধি করে ইসলামের শত্রুদের সে মনোবাসনা ব্যর্থ করে দেন। সে সময় রোম সাম্রাজ্য মুসলিম বাহিনীর হাতে একাধিকবার শক্ত মার খেয়েছিল এবং তারা সে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ইমাম হাসান (আ.) ও মুয়াবিয়ার বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেলে রোমের খ্রিস্টান বাহিনী অবশ্যই প্রতিশোধমূলক হামলা চালাত। সেই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করেন।ওদিকে সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন করে মুয়াবিয়া নিজের অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদকে নিজের স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করে। কিন্তু ইমাম হাসান (আ.) বেঁচে থাকতে এই দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। এ কারণে মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের অন্যতম স্ত্রী জা’দা’কে এক লাখ দিরহাম ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে তাকে দিয়ে ইমামকে শহীদ করায়। ইমাম হাসান (আ.)’র শাহাদাতের পর ইমামতের গুরুদায়িত্ব ইমাম হোসেইন (আ.)-এর ওপর অর্পিত হয়।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩

(পর্ব ৩১) : মুয়াবিয়ার সঙ্গে ইমাম হাসানের (আ.) চিঠি বিনিময় ও সংঘাতএপ্রিল ১৬, ২০১৯ ১৯:৪৬ Asia/Dhakaমুয়াবিয়াকে উপদেশ দিয়ে ইমাম হাসান (আ.)’র লেখা এক চিঠিতে বলা হয়েছে:বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। আল্লাহর বান্দা হাসান বিন আলী আমিরুল মুমিনিনের পক্ষ থেকে মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের উদ্দেশ্যে এই চিঠি লেখা হচ্ছে। তোমাকে সালাম। যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই চিঠির শুরুতেই তাঁর প্রশংসা করছি। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল হিসেবে মুহাম্মাদ (সা.)কে নির্বাচিত করেছেন। নবীজী ছিলেন সমগ্র বিশ্ববাসীর প্রতি রহমতস্বরূপ। তিনি মানুষের কাছে আল্লাহর বার্তা পূর্ণরূপে পৌঁছে দিয়ে আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ওফাতের পর আরবরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরস্পরেরর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। আমরা রাসূলের আহলে বাইতের পক্ষ থেকে যখন আমাদের অধিকার চাই তখন সবাই আমাদের চারপাশ থেকে দূরে সরে যায় এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। অবশ্য আমরা দ্বীন ইসলাম রক্ষার স্বার্থে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থেকেছি। আমরা মনে করেছি, মুনাফিকদের পাশাপাশি কাফের ও মুশরিকরা মুসলমানদের মধ্যকার বিভেদ থেকে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে। তারা ইসলামকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠতে পারে।মুয়াবিকে উদ্দেশ করে ইমাম হাসান (আ.)’র লেখা চিঠিতে আরো বলা হয়: কিন্তু আজ তুমি যে হুকুমাতের দাবি করছ তাতে তোমার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই এবং এখানেই আমি চরমভাবে বিস্মিত। দ্বীনদারির দিক দিয়ে যেমন তুমি অগ্রগামী নও তেমনি ইসলামের প্রচার ও প্রসারেও তোমার উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই। নবীজী (সা.)-এর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণকারী একজন কুরাইশ অধিপতির সন্তান তুমি। আমি তোমাকে সতর্ক করার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই পত্র লিখছি যাতে কিয়ামতের দিন তুমি আল্লাহর আদালতে বলতে না পারো যে, আমি তোমাকে সতর্ক করিনি। এখনই জুলুম থেকে বিরত থাকো এবং মুসলমানদের রক্ত ঝরানো বন্ধ করো। কিন্তু যদি তুমি নিজের অবস্থানে অটল থাকার জন্য জেদ ধরে থাকো তাহলে আমি মুসলিম বাহিনী নিয়ে তোমাকে প্রতিহত করতে অগ্রসর হবো যাতে আল্লাহ তায়ালা তোমার আর আমার মাঝে উপযুক্ত ফয়সালার ব্যবস্থা করেন।এই পত্র পাওয়ার পর মুয়াবিয়া ইমাম হাসান (আ.)কে জবাবি পত্র লেখেন যাতে তিনি নিজের ও পরিবারের নেতিবাচক অতীত অস্বীকার করার চেষ্টা করেন। তিনি লেখেন, “তোমার চিঠি পেয়েছি এবং সেখানে বিশ্বনবী (সা.)’র প্রশংসা করে যেসব বক্তব্য দিয়েছো তা বুঝতে পেরেছি এবং আমি জানি যে, তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। এই উম্মত যখন থেকে নবীজীর উত্তরাধিকার নির্বাচন করা নিয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে তখন থেকেই নবী পরিবারের সদস্য হিসেবে তোমাদের মর্যাদার কথাও তারা স্মরণে রেখেছে। তারা কখনেই নবী পরিবারের বিশেষ অবস্থানের কথা অস্বীকার করেনি।”চিঠিতে একথা স্বীকার করার পরও ইমাম হাসানের দুই প্রতিনিধিকে উদ্দেশ করে মুয়াবিয়া বলেন: “তোমরা ফিরে যাও। একমাত্র তরবারিই পারবে তোমাদের ও আমার মধ্যকার মতবিরোধ নিরসন করতে।”এভাবে ইমাম হাসান (আ.) ও মুয়াবিয়ার মধ্যে বেশ কিছু চিঠি বিনিময় হয়। এসব চিঠির ভাষা থেকে একথা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, ইমাম হাসান মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান। কিন্তু এরপরও তিনি যখন খবর পান, মুয়াবিয়া বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে ইরাকের দিকে রওনা দিয়েছে তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)’র অন্যতম সাহাবী হুজর ইবনে উদাইকে মুয়াবিয়াকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে সৈন্যবাহিনী প্রস্তুতের দায়িত্ব দেন। অন্যদিকে ইমামের নির্দেশে নগরীর সব মানুষকে মসজিদে আসার আহ্বান জানানো হয়। ইমাম হাসান কুফার মসজিদের মিম্বরে উঠে সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন: মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য জিহাদ ফরজ করেছেন। হে জনতা! আমি খবর পেয়েছি, মুয়াবিয়া তার বাহিনী নিয়ে ইরাকের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। তাকে প্রতিহত করার জন্য আমি আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। সবাই মুসলিম বাহিনীতে নিজেদের নাম লেখান।কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যায়, ইমামের বাহিনীতে যোগ দিতে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই নাম লেখিয়েছে। এ অবস্থায় ইমাম হাসান আরো তিনদিন অপেক্ষা করেন এবং এরপর আরেকবার কুফার লোকজনকে সমবেত করে উপদেশমূলক ভাষণ দেন। কিন্তু এবারও মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তেমন কেউ সাড়া দেয়নি। এই জনগণ বিশ্বনবী (সা.)’র ওফাতের পর চার খলিফার শাসন দেখেছিল এবং পঞ্চম খলিফার শাসনামলে বসবাস করছিল। এরা ছিল সেই জনগোষ্ঠী যারা চার খলিফার মধ্যে তিনজনকে হত্যা করার ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছিল। তারা যদিও বাহ্যিকভাবে ইমাম হাসান (আ.)’র হাতে বায়াত গ্রহণ করেছিল কিন্তু স্পর্শকাতর সময়গুলিতে ইমামের নির্দেশ পালন না করে নিজেদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।জনগণের ভ্রুক্ষেপহীনতা সত্ত্বেও ইমাম হাসান (আ.) ওবায়দুল্লাহ বিন আব্বাসকে একদল সেনাসহ মুয়াবিয়াকে প্রতিহত করতে পাঠান এবং তাকে নির্দেশ দেন, মুয়াবিয়ার বাহিনী হামলা করার আগে তোমরা আক্রমণ চালাবে না। আমি পরবর্তীতে আরো কিছু সৈন্য সংগ্রহ করে তোমার সঙ্গে মিলিত হব। কিন্তু কয়েকদিন পর ইমামের কাছে খবর আসে, ওবায়দুল্লাহ ১০ লাখ দিরহাম ঘুষ গ্রহণ করে যুদ্ধ করার পরিবর্তে উল্টো মুয়াবিয়ার সেনাদলে যোগ দিয়েছে।এ খবর শোনার পরও ইমাম হাসান (আ.) তার বাহিনী নিয়ে রওনা দেন এবং মাদায়েনের কাছে ‘বিসাবাত’ এলাকায় তাবু গাড়েন। তিনি তাঁর বাহিনীতে থাকা অবশিষ্ট চার হাজার সৈন্যকে এই পরীক্ষা করে নিতে চান যে, যুদ্ধক্ষেত্রে এরা তাঁকে সহযোগিতা করবে নাকি পালিয়ে মুয়াবিয়ার দলে যোগ দেবে। তিনি জামায়াতে নামাজ আদায় করার পর তার সহগামী যোদ্ধাদের উদ্দেশে শেষবারে তো ভাষণ দেন।ইমাম বলেন, আমি কখনো আমার মনে কোনো মুসলমানের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করিনি এবং কারো ক্ষতি চাইনি। তোমরা জেনে রাখো, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য জরুরি এবং বিভেদ ভালো নয়। তোমরা নিজেদের জন্য যতটুকু ভালো চাও তার চেয়ে অনেক বেশি শুভ কামনা আমি করি। কাজেই চুক্তি ভঙ্গকারীদের মতো আমার নির্দেশ অমান্য করো না। ইমামের এই বিজ্ঞচিত বক্তব্য শেষ হওয়ার পর উপস্থিত জনতা কানাঘুষা শুরু করে এবং একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করে, “সে কি বলতে চাইল?” তাদের কেউ কেউ বলে, “খোদার কসম, আমার মনে হয় সে মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়।”এরপর তারা চিৎকার করে বলতে থাকে, “ইমাম হাসান কাফের হয়ে গেছে।” আসলে এরা ছিল সেই দলের লোক যারা সিফফিনের যুদ্ধের পর তাদের সংকীর্ণ চিন্তার জন্য খারেজি হয়ে গিয়েছিল।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১৬

(পর্ব ৩০): হজরত ইমাম হাসান (আ.) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনাএপ্রিল ০৭, ২০১৯ ১৫:৩৪ Asia/Dhakaঐশী দিশারী (পর্ব ৩০): হজরত ইমাম হাসান (আ.) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের যুগে ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন পরিপূর্ণ যুবক। তিনি আলী (আ.)কে শুধু পিতা হিসেবে নয় সেইসঙ্গে একজন ইমাম ও নেতা হিসেবে সম্মান দেখাতেন এবং তাঁর আনুগত্য করতেন।অন্যদিকে সন্তান হাসানের যোগ্যতা ও প্রতিভা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন আলী (আ.)। তিনি জঙ্গে জামাল বা উষ্ট্রের যুদ্ধের সময় কুফাবাসীর সমর্থন লাভের জন্য আম্মার ইবনে ইয়াসিরের সঙ্গে পুত্র হাসানকে কুফায় পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা কুফায় পৌঁছালে সেখানকার মানুষ ইমাম হাসান (আ.)কে দেখার জন্য ছুটে আসে। এ সময় হাসান (আ.) মহান আল্লাহর প্রশংসা এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর শানে দরুদ পেশ করে কুফাবাসীকে যুদ্ধের ময়দানে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন:হে লোকসকল! আপনাদেরকে আল্লাহ তায়ালা, তাঁর কিতাব ও রাসূলের সুন্নতের দিকে আহ্বান এবং বর্তমানে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হযরত আলী (আ.)-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানাতে আমরা এখানে ছুটে এসেছি। পবিত্র কুরআনে হযরত আলী’র প্রশংসা করা হয়েছে এবং রাসূলের সুন্নত নিজের জীবনে বাস্তবায়নে তাঁর চেয়ে অগ্রগামী কেউ নেই। তিনি এমন এক ব্যক্তি যার সঙ্গে রয়েছে রাসূলের ভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি আত্মীয়তার সম্পর্ক।ইমাম হাসান (আ.) আরো বলেন: আপনাদেরকে তাঁর বাহিনীতে যোগদান করে জঙ্গে জামালের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে বিজয় নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি। হে লোকসকল! আপনারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার ফরজ দায়িত্ব পালনের জন্য ঈমানদার ব্যক্তিদের দলে শামিল হয়ে যান। তাহলে আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সাহায্য করবেন।ইমাম হাসান (আ.) শুধু সত্যের পথে জনগণকে সচেতন করে তোলার কাজই করেননি সেইসঙ্গে ইসলামের স্পর্শকাতর সময়গুলোতে কাফেরদের বিরুদ্ধে তরবারি ধরতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। জঙ্গে জামাল বা উষ্ট্রের যুদ্ধে শত্রু বাহিনীকে ঘায়েল করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। মুয়াবিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে সিফফিনের যুদ্ধেও হযরত আলী (আ.)’র অন্যতম কমান্ডার ছিলেন ইমাম হাসান (আ.)। কুফায় হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দিয়ে সিফফিনের যুদ্ধের জন্য অনেক সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। জঙ্গে জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধের পাশাপাশি নাহরাওয়ানে খারেজিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধেও ইমাম হাসান (আ.) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।খারেজিরা ছিল ঈমানের দাবিদার এমন একদল লোক যারা ইমাম আলী (আ.)’র শত্রুদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। খারেজিদেরকে বর্তমান যুগের উগ্র তাকফিরি জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বর্তমানে যেমন এই জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামের লেবাস পরিধান করে ইসলামের ক্ষতি করার জন্য মুসলমানদের শত্রুদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে খারেজিরাও ছিল ঠিক সেরকম। মূর্খ এই দলটি ইমাম হাসান (আ.)’র যুগে ইমামকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে ইমামের শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলায়। মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে ইমাম হাসান (আ.)’র পরিকল্পনাগুলো ব্যর্থ করে দেয়ার ক্ষেত্রে খারেজিদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।ইমাম আলী (আ.) মুসলিমদের নেতা হিসেবে শাসনক্ষমতা হাতে নেয়ার পর এ ধরনের নির্বোধ লোকদের কারণে তিনি গোটা শাসনকাল অসমাপ্ত যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হন। এক পর্যায়ে ইবনে মুলজাম নামক এক খারেজির বিষমাখা তরবারির আঘাতে আহত হন এবং তিনদিন পর শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। ইবনে মুলজামকে আটক করে আলী (আ.)’র কাছে আনা হলে ইমাম হাসান (আ.) তাকে উদ্দেশ করে বলেন: “তোমার প্রতি অভিশাপ হে আল্লাহর শত্রু, হে রহমত বঞ্চিত খোদাদ্রোহী, তুমি কিভাবে আমিরুল মুমিনিনকে আঘাত করলে? যে আমিরুল মুমেনিন তোমাকে আশ্রয় দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিলেন তাকে হত্যা করে এর প্রতিদান দিলে? তিনি তোমার কি ক্ষতি করেছিলেন যে, তুমি তাকে শহীদ করলে?” এ প্রশ্নের উত্তরে ঘাতক ইবনে মুলজাম নিজের অপরাধ স্বীকার করে বলে ওঠে: “হে রাসূলের সন্তান, “যে ব্যক্তি জাহান্নামের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তাকে আপনি কীভাবে আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা করবেন?”এ সময় দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ইমাম হাসান ডুকরে কেঁদে ওঠেন এবং মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর পিতার কপালে চুমু খেয়ে ইবনে মুলজামকে দেখিয়ে বলেন: এই হচ্ছে আল্লাহ এবং আপনার শত্রু। সে এখন আমাদের হাত বন্দি। একথা শোনার কিছুক্ষণ পর মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর আলী (আ.) চোখ খোলেন। তিনি ইবনে মুলজামকে উদ্দেশ করে বলেন: তুমি অনেক বড় পাপ ও অপরাধ করে ফেলেছ। আমি কি তোমার জন্য খারাপ নেতা ছিলাম যে, তুমি আমার রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করেছ? আমি কি তোমার প্রতি দয়া দেখাইনি? আমি কি তোমার কোনো উপকার করিনি? তোমার বিরুদ্ধে অনেকে আমার কাছে নালিশ জানিয়েছিল। কিন্তু তাদের কথা উপেক্ষা করে তোমাকে মুক্ত রেখেছিলাম। যদিও আমি জানতাম নির্বুদ্ধিতার কারণে তুমি আমাকে হত্যা করতে পারো। কিন্তু তারপরও আমি চেষ্টা করেছিলাম তোমাকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করতে।এরপর হযরত আলী (আ.) নিজের বড় সন্তান ইমাম হাসানের দিকে তাকিয়ে বলেন: এই বন্দির সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তাকে দয়া দেখাবে। এ সময় ইমাম হাসান বলেন:এত বড় অপরাধ করার পরও সে কি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য? জবাবে আলী (আ.) বলেন: হ্যা বাবা, আমরা এমন এক বংশের উত্তরসূরি ক্ষমা যাদের রক্ত ও অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে রয়েছে।হযরত আলী (আ.)’র বেদনাবিধুর শাহাদাতের পর ইমাম হাসান (আ.) মুসলিম সমাজের নেতৃত্বদানের গুরুত্বদায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় উমাই শাসকরা রাসূলের যুগের সাধাসিধে জীবনযাপন ছেড়ে প্রাসাদে চাকচিক্যময় জীবনযাপন শুরু করে। নবীজী সাম্যের যে বাণী নিয়ে এসেছিলেন তা ক্রমশ মিইয়ে যেতে থাকে এবং সমাজে বর্ণ ও শ্রেণিবৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে।আবু যর গিফারির মতো রাসূলের প্রিয় সাহাবীকে মরুভূমিতে নির্বাসনে পাঠানো হয় এবং মেইসাম তাম্মারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। মুয়াবিয়ার নির্দেশে হযরত আলী (আ.)’র অনুসারীদের লোভ অথবা হুমকির মাধ্যমে বশীভূত করা হয় এবং সরকারি পদে থাকা এ ধরনের ব্যক্তিদের বহিস্কার করা হয়।এ অবস্থায় মুসলিম সমাজে ইসলামী রীতি পরিপন্থি এসব কাজ সহ্য করা ইমাম হাসান (আ.)’র পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি মুয়াবিয়ার শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। কুফার মসজিদে জনগণকে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দেন। তবে তার আগে মুয়াবিয়ার সঙ্গে ইমাম হাসান (আ.)’র কয়েকবার চিঠি বিনিময় হয়।#পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১১